বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একের পর এক ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটছে, প্রশাসন নির্বিকার। রাষ্ট্র নির্লিপ্ত। নির্লিপ্ত বলাটা বোধকরি ঠিক হলোনা। রাষ্ট্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণপণ চেষ্টা করছে ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষা করতে । উপাচার্য, প্রক্টর, প্রশাসন যে ভাষায় কথা বলছে তাতে মনে হচ্ছে খুব একটা কিছু হয়নি। ‘বিচ্ছিন্ন’ ‘ছোটখাটো’ ঘটনা। এভাবে ভাবার বা বলার পেছনের কারণটি হচ্ছে নিজের এবং প্রতিষ্ঠানের বায়বীয় ‘ভাবমূর্তি’ বাঁচিয়ে রাখা। প্রক্টরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে স্বীকার করা হয় উনি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। সাথে ঘটনাকেও গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু এই ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনার তদন্ত কমিটি গঠন করে সময় ক্ষেপণের মাধ্যমে সবকিছুই এভয়েড করা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন একই পথে হাঁটছে। পুলিশের মুখপাত্র বলেছেন -ছাত্ররা যে মাত্রায় অভিযোগ করেছেন সে মাত্রায় ঘটনা ঘটেনি, সিসি টিভি ফুটেজে তেমন কিছু ধরা পড়েনি, বিবস্ত্র করার কোন দৃশ্য শনাক্ত হয়নি। মুখপাত্র আরো বলেছেন যেসব ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে এর অনেকগুলো অন্য ঘটনার ছবি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে সেই ‘অন্য ঘটনার’ হোতাদের আপনারা ধরতে পেরেছেন কী? কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না সবকিছু হালকা চালে উড়িয়ে দিতে দিতে আমরা কোথায় এসে ঠেকেছি সেটা কেন প্রশাসন বুঝতে পারছেনা? একটি ঘটনার বিচার নিষ্পন্ন না হওয়া অন্য একটি ঘটনার রাস্তা প্রসস্থ করে। একুশের বই মেলায়ও যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ আছে। বেশ কিছু ছবি/ফুটেজও মিডিয়ায় এসেছে। যথারীতি ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে ঘটনা। অভিজিৎ রায়কে নৃশংস ভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। পুলিশ প্রশাসন কোন সুরাহা করতে পারলোনা দুইমাসেও। ওয়াশিকুর বাবুর দুই খুনি হাতে নাতে ধরা পড়লো। পুলিশ কি পেরেছে নির্দেশদাতা বা পরিকল্পনাকারীদের কারো হদিস বের করতে? আমরা জানিনা। রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডেরও বিচার শেষ হয়নি। এর শেষ কোথায়? এক-একটি নতুন নৃশংসতা ঘটে, চাপা পড়ে যায় আগের ঘটনা। কারো কোন জবাবদিহিতা নেই। কোন ঘটনাতেই আমরা দেখিনা প্রশাসন বলছে দায়িত্বরতরা সঠিক দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছে। ফলে দায়িত্ব পালনে খামখেয়ালিপনা ক্রমে বাড়ছে।

সব ঘটনারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। একের পর এক ঘটনার বিচারহীনতার সংস্কৃতি, দায়িত্বরতদের খামখেয়ালিপনা, অতঃপর তাদের রক্ষা করার প্রশাসনিক প্রচেষ্টা- বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্রমে সন্ত্রাসী এবং অনৈতিক কার্যকলাপের অভয়ারণ্যে পরিণত করছে। ঘটনার হোতারা আরো বেপরোয়া হচ্ছে। রমনায় ভিড় কিছু কম হয়নি। কিন্তু সেখানে এরকম ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি, কখনো ঘটেওনা। সব ঘটনা কেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘটে? ঘটে কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বড় ভাইরা’ থাকে, যারা আগলে রাখে অপরাধীদের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চড় থাপ্পড় দিয়ে ঘটনা মেটানোর চেষ্টা করেছে ‘বড় ভাইরা’। আর এই বড়ভাইদের কথা চিন্তা করে কোন ঘটনাতেই বাই-স্ট্যান্ডাররা এগিয়ে আসেনা। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেদের ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষা করতে গিয়ে ঘটনা এড়ানোর চেষ্টা করে বারে বারে। আমরা অতীতেও একই দৃশ্য দেখেছি। প্রফেসর আনোয়ার উল্লাহ্‌ উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করার সময় শামসুন্নাহার হলের ঘটনাকে খাটো করে দেখে পরিস্থিতি এড়াতে চেয়েছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। এই নির্লজ্জ ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষার প্রচেষ্টা কিংবা গদি রক্ষার প্রচেষ্টা তলানিতে সার্বিক পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এখন বিচ্ছিন্ন ভাবে হলেও কখনো সখনো বাইরে খুন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলে আসার ঘটনা আমরা দেখি। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সেটি নিয়মিত হবে। সেজন্যই বলছিলাম, সময় ফুরিয়ে যায়নি, এখনি ব্যবস্থা না নিলে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পড়বে দেশের সবচে’ ভয়ঙ্কর এলাকা, যে এলাকায় সাধারণ জনগণ ঢুকতেও ভয় পাবে।

বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রচারিত সিসি টিভি ফুটেজ দেখে মনে হলো এ যেনো এক বীভৎস নরক! এক নারী তার সন্তান সহ রিক্সা যোগে যাচ্ছিলেন। তাকে টেনে হিঁচড়ে নামানোর চেষ্টা করছে কিছু হায়েনা। দু’একজন সাহসী মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে তাঁদের বাঁচাতে। আরেক ফুটেজে দেখা যায় স্বামী বা পুরুষ সঙ্গী হাজার চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারলোনা রিক্সায় থাকা তার নারী সঙ্গীকে। ভিড়ের মাঝে হঠাৎ মভ তৈরি হচ্ছে, কোন নারীকে মভের মাঝখানে ফেলে হায়েনারা উল্লাস করছে। এগুলো সাধারণ কোন ঘটনা? শুধুই কি মানসিক বিকারগ্রস্তদের যৌন সন্ত্রাস? হতেই পারেনা। এটি পরিকল্পিত আক্রমণ। যৌন বিকারগ্রস্ত ‘সুবোধ’ পুরুষটি আড়ালে আবডালে ভিড়ের মধ্যে অসভ্যতা করতে পারে, কিংবা প্রচলিত যৌন সন্ত্রাসীরা ভিড়ের মাঝে কিংবা নির্জনে এক-দুইটি ঘটনার জন্ম দিবে, যেমনটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে। কিন্তু টিএসসি’তে যা হয়েছে সেটি পরিকল্পিত। এদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। ঘটনা পরম্পরায় হয়তো বিকারগ্রস্ত ‘সুবোধ’ পুরুষরা অংশ নিয়েছেন কিংবা যৌন সন্ত্রাসীরাও, কিন্তু আমি নিশ্চিত কোন উগ্রবাদী সংগঠন রীতিমতো পরিকল্পনা করে পহেলা বৈশাখের এই সার্বজনীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছে, চেয়েছে সেকুল্যার এই উৎসবকে নোংরামির অজুহাতে বন্ধ করার পথ প্রসস্থ করতে। কিংবা নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে সাধারণ মানুষ যাতে বর্ষ বরণের অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলে সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে। হাজারো ফতোয়া দিয়ে, বয়ান দিয়ে যখন বাঙালীর জোয়ার থামানো যায়নি, তখন ন্যক্কারজনক এই রাস্তায় যেতে এই চক্রটি দ্বিতীয়বার ভাবেনি। তাই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি বা বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষার বায়বীয় অজুহাতে ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ বা ‘যতোটা অভিযোগ উঠেছে সেই মাত্রার নয়’ বলে চেপে যাওয়া বাঙালী জাতিসত্তার এই উৎসব, সার্বজনীনতার এই উৎসবকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে দীর্ঘমেয়াদে।

রাষ্ট্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মনে রাখতে হবে কুৎসিত সত্যকে ঢেকে রাখার যে সংস্কৃতি তাঁরা চালু করছেন সেটি কখনোই সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেনা। বরং প্রতিরোধযোগ্য সন্ত্রাসী কিংবা যৌন সন্ত্রাসের ঘটনায় বাই-স্ট্যান্ডার’রা (প্রত্যক্ষদর্শী) এগিয়ে আসবেনা যদি এই লুকোছাপার সংস্কৃতি চালু থাকে। কারণ প্রত্যক্ষদর্শীর ঘটনা প্রতিরোধে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় ভূমিকা রাখে তার মধ্যে রাষ্ট্রীয় আচরণ, সাহায্য পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিগত জটিলতায়/ ব্যবহারিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা, সচেতনতা, দায়িত্ববোধ, আত্মবিশ্বাস, ঘটনার প্রকৃতি বুঝা ইত্যাদি অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোন ঘটনা ঘটলে সহজে কেউ এগিয়ে আসতে চায়না কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা এবং সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের একচেটিয়া আধিপত্য। কোন ঘটনায় যখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ যখন সহযোগিতার হাত গুটিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে তখন সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখানোর সম্ভাবনা কমে যায় অবধারিত ভাবেই। মনে রাখতে হবে সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি অনেকটা ঐচ্ছিক, তবে যাঁদের এটি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে সেই পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, নির্লিপ্ততা, অপেশাদার ভূমিকা সাধারণ জনগণের মাঝে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। লিটন নন্দী’দের সামাজিক দায়বোধ দিয়ে সবার দায়বোধ বিবেচনা করাটা হবে বোকামি; আশাকরাটাও। বরং ঘটনাস্থলে নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা এবং পরবর্তীতে প্রশাসনিক পদক্ষেপ পরবর্তী ঘটনা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে অনেক বেশি। মনে রাখতে হবে মুখে সেকুল্যার বাংলাদেশের কথা বলে, বর্ষবরণের মতো সার্বজনীন উৎসবে সংঘবদ্ধ এবং পরিকল্পিত এই আক্রমণকে ‘বিচ্ছিন্ন’ অথবা ‘সেই মাত্রার নয়’ বলে এড়িয়ে যাওয়া প্রকারান্তরে আক্রমণকারীদেরই আরো বেশি সংগঠিত হবার সুযোগ করে দেবে। যে আঘাত প্রকারান্তরে বাঙালী জাতিসত্তার উপরে আঘাত।

দ্রষ্টব্য : লেখাটি ভিন্ন শিরোনামে দৈনিক সমকালে ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে।