গরু পিটিয়ে মানুষ বানাবার প্রবচনটি কিছুদিন আগেও খুব প্রচলিত ছিলো। বড়জোর আট কী দশ বছর পূর্বেও অামাদের মাস্টারমশাই ও অভিভাবকদের মুখে মুখে ফিরতো প্রবচনটি। গ্রামদেশে আরো একটি কথা বহুল প্রচলিত ছিলো। ছাত্রকে শিক্ষকের সম্মুখে দাড় করিয়ে অভিভাবকরা বলতো,
এই যে স্যার দিয়া গেলাম; আমার খালি হাড্ডি পাইলেই চলবো
এ যেনো শিক্ষক নয়, রাক্ষসের হাতে নিজ সন্তানকে তুলে দিয়ে গেলেন অভিভাবক।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কি তারা তাদের সন্তানদের ভালোবাসতেন না?
-অবশ্যই বাসতেন আর সন্তানের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের চিন্তা করেই ওসব বলতেন। তখনকার সমাজে স্বাভাবিকভাবে এমনটাই প্রচলিত ছিলো যে, না পেটালে বুঝি বাচ্চাকাচ্চা মানুষ হয়না! “মানুষ” গড়ার কারিগরগণও ছাত্রদের ভবিষ্যত মঙ্গলের কথা ভেবে রীতিমতো তেল মালিশ করে বেত চকচকে রাখতেন!
অবোধ পশুকে বশ করে সেটাকে নানা কাজে লাগানোর সময় থেকেই মানুষ দেখে আসছে “অবোধ প্রাণি” মিষ্টি, তেতো কোনো কথা তেমন না শুনলেও বেদনা উদ্রেককারী লাঠির আঘাত খেয়ে ঠিকই লাইনে আসে। হতে পারে এ শিক্ষাটাই মানুষ পরবর্তীতে “অবোধ শিশু”র ক্ষেত্রে প্রয়োগে ব্যপৃত হয়েছে।
যাহোক, দেরিতে হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রহারের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আসুন দেখে নেয়া যাক এ সংক্রান্ত নীতিমালা কী বলা আছে…
হাইকোর্ট এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির নামে শিক্ষার্থী নির্যাতন করা অবৈধ, অসাংবিধানিক, মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বলে রায় দেন। এ রায়ের মূল বক্তব্যের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও একমত পোষণ করে। একই বছরের ২১ এপ্রিল শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি না দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে নীতিমালা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীকে মারধর করতে পারবেন না এবং তাদের উদ্দেশ্যে অশালীন মন্তব্য বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করা যাবে না। এ নীতিমালা লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
অর্থাৎ প্রহার তো দূর কর্কশ আচরণ পর্যন্ত করা যাবেনা। অথচ ক’দিন পর পরই সংবাদপত্রের পাতায় দেখি অমুক ছাত্রকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন শিক্ষক। যাঁরা নীতিশিক্ষা দেবেন তাঁরাই যদি নীতির প্রতি যত্নশীল না হন তাহলে কোথা যাই! কারো কারো বিরুদ্ধে এমনও অভিযোগ তাঁরা ক্লাসটিচারের কাছে কোচিং বা প্রাইভেট না পড়ার কারণেই মূলত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে! এ ব্যাপারেও একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে…
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানো যাবে না মর্মে গত ১৪ জুন নীতিমালা-২০১২ চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নীতিমালা অনুযায়ী আইন ভঙ্গকারী শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও বাতিল করার কথা বলা হয়। এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না_ তা তদারকি করতে শিক্ষামন্ত্রী কর্তৃক উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে মনিটরিং কমিটি করার কথা বলা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর এবং শিক্ষা বোর্ডকেও কমিটিতে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়। শিক্ষকদের কোচিংয়ে ক্লাস নেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়ে গত বছর হাইকোর্ট একটি রুলও জারি করেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, শিক্ষকগণ একটি নয়; দু দুটি নীতিমালা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন। পত্রপত্রিকা হতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় শহরের স্কুল-কলেজের চেয়ে মফস্বলের স্কুল-কলেজে প্রহারের হার বেশি। আর ক্বওমী মাদ্রাসার এ নীতিমালাকে স্রেফ বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ইচ্ছেমত পেটাচ্ছেন ওস্তাদগণ। স্কুল-কলেজে যেখানে প্রহারের ঘটনা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে সেখানে কয়েকদিন পরপরই বিভিন্ন মাদ্রাসায় প্রহারের ঘটনা উঠে আসছে খবরের কাগজে। এখানে উল্লেখ থাকে যে, ক্বওমী মাদ্রাসায় প্রহারের বেশিরভাগ ঘটনাই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসেনা সংগত কারণে।
এ ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ তো করেই এমনকি বড় হওয়ার পরও তার প্রভাব দেখা যায়। বিভিন্ন নেতিবাচক চরিত্র যেমনঃ অল্পতেই রেগে যাওয়া, হীনস্মন্যতা, একগুঁয়ে, আত্নবিশ্বাসহীনতা, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি উপসর্গের পেছনে গবেষকগণ শৈশব-কৈশোরে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদানকে অনেকটা দায়ী বলে মনে করেন।
এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে অভিভাবকদের মন থেকে “কেবল পিটিয়ে মানুষ করা সম্ভব” টাইপের ভ্রান্ত ধারণা দূরীকরণ, বাজারের প্রতি সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষকগণের বেতন-বোনাসের সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের উপর শাস্তি প্রদানের পরিমাণ শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব।
অবশ্য ক্বওমীদের ক্ষেত্রে এভাবে হয়তো সম্ভব হবে না। ক্বওমীদের নাকি অলিখিত স্বীকার্যই আছে “ওস্তাদের বেত না খেয়ে কেউ হাফেজ হতে পারেনা!” ক্বওমীতে মাওলানা হতে গিয়ে অনেকেরই বয়স কুড়ির কোঠা ছাড়িয়ে গেলেও মার খাওয়া থেকে নিস্তার জোটেনা! একটা ৬-৭ বছরের বাচ্চা যখন বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা বঞ্চিত অবস্থায় ওস্তাদদের কাছ থেকে ক্রমাগত মার খেতে খেতে বড় হয় তখন তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা কিরূপ হয় তা ভাবতেই আমি শিউরে উঠি। এরা যখন আবার পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষাদান করে তখন অবধারিতভাবেই নিজের খাওয়া মারের হিস্যা আদায় করে নেয়! এভাবে চলতেই আছে।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য আমি এখনো কোনো ক্বওমীর ছাত্র পাইনি যে কীনা প্রহার ছাড়া তার শিক্ষাজীবন শেষ করেছে! ওস্তাদরা যেনো মুখিয়েই থাকেন প্রহারের জন্য! একসাথে শ’খানেক প্রায় সমবয়সী ছেলেপেলে থাকলে সেখানে দুষ্টুমি, হাতাহাতি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এসবের কারণে তো প্রহার করা হয়ই উপরন্তু কুরান মুখস্ত করা, পুরনো পড়া মশকো করা, তাকবীরুল্লার সাথে নামায আদায় করা, সুন্নতের বরখেলাপ না করা ইত্যাদির ব্যত্যয়জনিত কারণে মার খাওয়া অবধারিতই বলা চলে। কিশোর মন কতক্ষণ বাঁধাধরা নিয়মে থাকতে চায়! এমন অনেককেই দেখেছি যারা প্রহার সহ্য করতে না পেরে মাদ্রাসাই ছেড়ে পালায়।
সরকার এদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে গিয়েও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে ক্বওমী বোর্ডের একগুঁয়েমির কারণে। ভোটের রাজনীতিতে সরকারও চাইছে না তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো নীতিমালা করতে। ফলশ্রুতিতে এ সেক্টরটার সার্বিক অবস্থা লেজে গোবরে হয়ে থাকলেও কারো বিকার নেই। এ ব্যাপারে বিস্তারিত হয়তো আগামী কোনো পোস্টে আলোচনা করা যাবে…
আপনার লেখা পড়ে মনে হল জলের উপর থেকে শুকনো পাতা কুড়ালাম। ভিতরে ঢুকতে হত আরো। আরো অনেক কিছু পড়তে চেয়েছিলাম। দ্রুত আরো ডিটেইলস লেখা চাই এই বিষয়ে।
যুগোপযোগী পোস্ট।
@আদার ব্যাপারী,
উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ (F)
ক্ষতিকর সামাজিক এ চর্চা নিয়ে লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। তবে শুধু ক্বওমী নয়, কম বেশি সব প্রাইমারী ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শাস্তি বিরাজমান। সরকার 3Cs অর্থাৎ child marriage, child labour ও corporal punishment নির্মূলে কাজ করছে ইউনিসেফ এর সহযোগিতায়। তবে এর মূল উৎপাটন বড্ড কঠিন !
@গীতা দাস, আমি পোস্টে সেটা বলার চেষ্টা করেছি। সরকারের বিবিধ পদক্ষেপ ও অভিভাবকদের সচেতনতায় প্রাইমারি কিংবা মাধ্যমিক লেভেলে এটা অনেকখানি কমে এসেছে অথচ মাদ্রাসায় এখনো মধ্যযুগীয় কায়দায় পেটানো হয়…
শিক্ষার প্রক্রিয়া যদি আনন্দময় না হয় তবে তা মানসিক বিকাশকে বাঁধাগ্রস্ত করবে।
@রসি মজুমদার,
সহমত…
শারীরিক শাস্তি, মারধোরকে এককালে শিক্ষার অপরিহার্য অংগ মনে করা হত। এখন সেটা প্রায় সব দেশেই নিষিদ্ধ। এককালে এমনকি বাবা মারাও মাষ্টার পেটালে মনে মনে খুশী হতেন, যাক বেশ জবরদস্ত মাষ্টার পাওয়া গেল। ছেলের দারুন পড়াশুনা হবে।
উন্নত দেশগুলিতে বহু আগেই এমনকি আসামী ইন্টারেগেশনের জন্যও মারধোর কঠিনভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে। ইন্টারোগেশনে অন্যায় কিছু হয় কিনা সেটা নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে ভিডিও করতে হয়। আমাদের দেশে কাগজে কলমে নিষিদ্ধ হলেও আম জনতা থেকে হাইকোর্টের বিচারক সকলেই জানেন যে পুলিশী তদন্তের অন্যতম উপায় এখনো সেই আদি অকৃত্রিম বেদম পেটানো। মারধোর করে কথা আদায়ের অমানবিকতার সাথে আরেকটি মন্দ দিক আছে তা হল মারের চোটে অনেক সময় লোকে গা বাঁচাতে মিথ্যা কথা বলে।
কওমীদের কথা বলে লাভ নেই। তারা ভিন্ন জগতে বসবাস করে।
@আদিল মাহমুদ,
সম্পূর্ণ সহমত…
আল্লাহর ওয়াস্তে ছেড়ে দিলে যে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না… 🙁
আইন বেশিরভাগ সময়ই কাগজগত থাকে। বাস্তবে দেখা যায় তার উল্টো।
@তামান্না ঝুমু, এটাই বোধ করি আমাদের বড় সমস্যা… 🙁
এই দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার শেকড়ে আছে সামর্থহীন পরিবারের সন্তানদের স্বল্প খরচে থাকা খাওয়া ও তথাকথিত শিক্ষার সুযোগ দানের ব্যপারটি। মূলধারার শিক্ষায় যতদিন পর্যন্ত সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য সুযোগ বাড়ানো না হবে ততদিন পর্যন্ত এই সব মাদ্রাসা আর মাদ্রাসার কাটমোল্লাদের দৌড়াত্ম কমানো যাবে না। আর মাদ্রাসার উপর মানবাধিকার কিংবা আইনী ব্যবস্থা!!! বলেন কি? সাথে সাথে সরকারকে নাস্তিক উপাধি দিয়ে অসংখ্য তেতুল-কচু-মূলা-গাজর হুজুরদের আবির্ভাব ঘটবে যার পুরো ফায়দা নেবে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রহার বলেন আর কোচিং ব্যবসাই বলেন সেটা দূর করতে সরকারের আইন প্রয়োগের আগে দরকার সাধারন মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী। আর সেটা করতে গেলে নিশ্চিত করতে হবে সব বিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে যেন গুটিকয় ভালো শিক্ষকের কাছে সবাইকে লাইন ধরে যেতে না হয়। আর ভালো শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আবার লাগবে শিক্ষকদের উন্নত নাগরিক সুবিধা নিশ্চয়তা তথা ভালো বেতন ও সুবিধাদি। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পাদন করতে গেলে সময়ের চাইতে সদিচ্ছাটা সবচাইতে জরুরী বিষয়।
@মেঠুসেলাহ,
সরকার তো এরই মধ্যে শিক্ষাকে অবৈতনিক করেছে। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়েছে কি?
@ঔপপত্তিক ঐকপত্য,
অবৈতনিক করেছে বটে কিন্তু এখানে সেই লোভনীয় ব্যপারগুলো যেমন – প্রায় বিনামূল্যে খাবার, সস্তায় বা ক্ষেত্রেবিশেষে বিনামূল্যেই থাকার ব্যবস্থা এগুলো অনুপস্থিত। আমাদের দেশের গরীব পরিবারগুলো এই ভেবে মাদ্রাসায় ছেলে পেলেদের পাঠায় যে অন্তত থাকা খাওয়া আর পড়াশোনা (তথাকথিত) একই সাথে হয়ে যাবে অল্পের উপর দিয়েই। তার উপর পরকালের অনন্ত সুখের প্রতিশ্রুতি তো আছেই।