মূল : ম্যাট কার্টমিল*
একজন জীববিজ্ঞানীর পক্ষে জীববিবর্তনকে বিরোধিতা করে সৃষ্টিবাদী আক্রমণের (লেখার) পর্যালোচনা করা আর একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর (astronomer) পক্ষে সমতল পৃথিবী দাবি করে লেখা একটি বইয়ের পর্যালোচনা করা প্রায় একই ধরনের কাজ। পৃথিবী সমতল বলে যারা দাবি করে, ভুল একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে তারা শতাধিক ভুল যুক্তির অবতারণা করে থাকে। তবে এসব বিভ্রান্তিকর যুক্তির শতাধিক সমুচিত জবাব দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোও সম্ভব। বিজ্ঞানের প্রাথমিক পর্যায়ের কোনো বিষয়ের পাঠ্যবই লেখার মতো স্বীকৃতিবিহীন বেগার খাটুনির মত বলে এই ধরনের ভুল ধারণাকে খণ্ডন করার উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু যদি দেখা যায় সমতল পৃথিবীর প্রবক্তা বা জীববিবর্তন-বিরোধীদের বইয়ের রয়েছে বিশাল সংখ্যার আগ্রহী শ্রোতা ও ভক্ত-অনুসারী, তখন ‘ওইসব বই ভুয়া ও বিকৃত, এগুলোকে এড়িয়ে যাও!’ এরকম বলে দেয়াই যথেষ্ট হবে না। কারণ ওইসব ভুয়া ও বিকৃত ধারণাই এক সময় অন্ধ করে ফেলবে সবাইকে। অতএব এই বিকৃতিকে বিনাশ করতেই হবে।
চিত্র: আদনান অকতার উরফে হারুন ইয়াহিয়া
আমি শুনেছি তুরস্কে আদনান অকতার (হারুন ইয়াহিয়া তাঁর লেখালেখির ছদ্মনাম) ও তাঁর ‘সৃষ্টির মানচিত্র’ (Atlas of Creation, 2007a) বইটির বিশাল অনুসারীগোষ্ঠী রয়েছে। এতোই বিশাল যে (তার কথা অনুযায়ী) তুরস্কের আদালত সে দেশে অক্সফোর্ডের প্রসিদ্ধ জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্সের ওয়েব সাইট পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। কারণ অকতার আদালতে গিয়ে নালিশ করেছিলেন যে ডকিন্সের ওয়েব সাইটের বিষয়বস্তুগুলো তাঁর জন্য মানহানিকর! ডকিন্স তাঁর ওয়েব সাইটে অকতারের ‘সৃষ্টির মানচিত্র’ বই সম্পর্কে যেসব ‘আক্রমণাত্মক’ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, সেগুলো হচ্ছে (বইটি) ‘উদ্ভট’ (preposterous), ‘অন্তসার-শূন্য’ (inaner)। (ডকিন্সের সাইটে প্রকাশিত ‘Venomous Snakes, Slippery Eels and Harun Yahya’ শিরোনামের লেখাটির জন্য হারুন ইয়াহিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে আদালত পর্যন্ত দৌঁড়েছিলেন।-অনুবাদক)।
পশ্চিমের দেশগুলিতে প্রচুর রক্ষণশীল খ্রিস্টান সৃষ্টিবাদী রয়েছেন যারা মনে করেন মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরান আর চার্লস ডারউইনের লেখা ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ (১৮৫৯) দুটো একই রকম শয়তানি কাজ। আমি নিশ্চিত যখন তারা শুনবে ইসলামেও বিশাল আকাড়ে এবং প্রচুর অর্থকড়ি ব্যয় করে ডারউইনের বিরোধিতা করা হচ্ছে তখন তারা সত্যি অবাক হয়ে যাবে। খ্রিস্টান সৃষ্টিবাদীদের কেউ যদি আদনান অকতারের বিশাল সৃষ্টির মানচিত্র বইটি দেখে তবে তারা নিজেদের (এ বিষয়ে) একই মতের বলে মনে করবে। জীববিবর্তনের বিরোধিতা করে অকতার তাঁর বইয়ে যা কিছুই বলতে চেয়েছেন তা নতুন কিছুই নয়। এর সবই গত একশো বছর ধরে খ্রিস্টান-সৃষ্টিবাদীরা বলে আসছেন। বরং খ্রিস্টান সৃষ্টিবাদীরা আরো অনেক দক্ষতা ও ধূর্ততার সাথে এগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছে। তফাৎটা এখানে যে খ্রিস্টান সৃষ্টিবাদীরা তাদের বই নিয়ে এতো ব্যয়বহুল প্রচারণা চালাতে যান না।
অকতার অবশ্য বেশিরভাগ খ্রিস্টান সৃষ্টিবাদীদের মতো নবীন-পৃথিবীর সৃষ্টিবাদে বিশ্বাসী নন। (নবীন-পৃথিবীর সৃষ্টিবাদীরা মনে করেন, পৃথিবীর বয়স মাত্র হাজার দশেক বছর-অনুবাদক।) অকতার পুরাতন-পৃথিবীর সৃষ্টিবাদে বিশ্বাসী। এজন্য তিনি ভূবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো ঠিকই মেনে নিয়েছেন আবার জীববিজ্ঞানকে অস্বীকার করছেন। অকতার তাঁর বইয়ে কবুল করেছেন আমাদের মহাবিশ্ব হাজার কোটি বছর পুরানো এবং পৃথিবীতে প্রাণ এসেছে মিলিয়ন বছর আগে। এও স্বীকার করেছেন পুরাতন প্রাণীকুল দেখতে আধুনিক প্রাণীকুলের মতো হয় না এবং যতই আমরা অতীতে যাব প্রাণীকুল ততোই কম-আধুনিক বলে মনে হবে।
প্রাণীকুলের এই অনুবর্তন মাত্র দুটি পথে ব্যাখ্যা করা যায়। একটা হচ্ছে পুরাতন প্রজাতির প্রাণীকুলের মৃত্যুর পর নতুন প্রজাতির প্রাণীকুল এই স্থান দখল করে নিচ্ছে এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে পুরাতন প্রজাতি থেকে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটছে। দ্বিতীয় পয়েন্টটি আমাদের বিবর্তনের দিকে ঠেলে দেয়। হয়তো অকতার প্রাণীকুলের এই অনুবর্তনের ব্যাপারে প্রথম সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করবেন। কিন্তু প্রথমটি গ্রহণ করলে বেশকিছু পাল্টা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। যেমন নতুন প্রজাতির প্রাণীকুল কিভাবে, কোথা থেকে অস্তিত্বশীল হলো? স্বাভাবিকভাবে অকতার এই প্রশ্নটির প্রতি কখনোই সরাসরি মনযোগ দেন নি। তাঁর গোটা বইয়ে একটা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় তিনি ধারাবাহিকভাবে প্রাগৈতিহাসিক অলৌকিকতাকে সমর্থন করে গেছেন এবং বুঝাতে চেয়েছেন ঈশ্বর একসময় ট্রাইলোবাইটকে পৃথিবীর প্রাণীকুল থেকে বিলোপ করেছেন এবং তার স্থলে নতুন প্রজাতির ক্রাস্টেশন (শক্ত খোলকের কাঁকড়া জাতীয় প্রাণী) স্থাপন করেছেন। একইভাবে ‘অলৌকিক ইশারায়’ প্রাণীজগৎ থেকে (প্রায় ২০ কোটি বছর আগে ক্রিটাশিয়াস পিরিয়ডের দিকে) বেলামনেইটের (Belemnites) বিলুপ্তি ঘটিয়ে স্কুইডকে (অক্টোপাস জাতীয় প্রাণী) স্থাপন করা হয়েছে, মৎস-আকৃতির সামুদ্রিক সরীসৃপদের সাফ করে কিছু পরে মৎস-আকৃতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে। আর এভাবে ক্রমাগত চলছিল লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। অতিলৌকিক সৃষ্টি কার্যক্রমে লক্ষ লক্ষ প্রাণীর বিলুপ্তি আর আবির্ভাব ঘটে চলেছে।
কেন (নতুন জীবগুলির) এমন আজগুবি সূচনার কথা আমরা মেনে নেব (যা সম্পূর্ণ কল্পনাশ্রয়ী)? গায়েবি জিনিস থেকে নতুন জীবের উৎপত্তির কথা ভাবার চেয়ে বেঁচে থাকা জীবের ক্রম-পরিবর্তন থেকে তাদের উৎপত্তির সম্ভবনা দেখা বেশি যুক্তিযুক্ত নয় কি? একই সঙ্গে ভূবিজ্ঞানকে (সত্য বলে) মেনে নেয়া কিন্তু জীববিবর্তনকে অস্বীকার করার ফলে ঈশ্বরের যে চিত্র আমাদের সামনে ফুটে ওঠে তা মোটেও আকষর্ণীয় কিছু নয়। দেখা যাচ্ছে অকতারের ঈশ্বর বারবার ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, অপর্যাপ্তভাবে সৃষ্টি করে চলছেন লক্ষ প্রজাতি আবার এদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে শোধরানোরও চেষ্টা করছেন যুগের পর যুগ। সর্বশক্তিমান ও সবজান্তা ঈশ্বরের চিরায়ত ধারণার সঙ্গে এই ঈশ্বরকে মেলানো যায় না।
বেপরোয়া মতামত
বিবর্তনের বিরুদ্ধে অকতারের বেশিরভাগ মতই ভয়ঙ্কর। বেশিরভাগ আদৌ কোনো যুক্তি নয়, নিজের গভীর বিশ্বাসের প্রকাশ মাত্র, যা কোনো বিজ্ঞানসম্মত অর্থ প্রকাশ করে না। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন ভাবধারার কিছু পুরাতন-পৃথিবীর সৃষ্টিবাদী রয়েছেন, যারা লেখালেখি করতে গেলে কিছুটা পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে আসেন। বিবর্তনের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিজ্ঞানের লেখাগুলোর প্রতি মাঝে মাঝে চোখ বুলিয়ে নেন। কিন্তু অকতারের বইটি সেরকমটি নয়। এই বইয়ের বক্তব্যের মূঢ়তা একে এতোই জটিল করে ফেলেছে যে সমালোচনা করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন দার্শনিক জন সিয়ার্ল এ ধরনের বিষয় উপলব্ধি করেই হয়তো বলেছিলেন :
“একটি ভয়ঙ্কর আবোলতাবোল বিরুদ্ধমতের চেয়ে একটি খারাপ (নিম্নমানের) যুক্তি খণ্ডন করা অনেক সহজ কাজ। নিম্নমানের যুক্তিরও পর্যাপ্ত কাঠামো থাকে, যা থেকে এর দুর্বলতা ও অসারত্বকে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু অর্থহীন আক্রমণাত্মক মতের ক্ষেত্রে প্রথমে তোমাকে প্রস্তাবনাটিই পুনর্গঠন করার চেষ্টা করতে হবে, যাতে এর আসল বক্তব্যটি পরিষ্কার হয়। তারপর ধীরে ধীরে এগুতে হবে খণ্ডনের দিকে।” (Searle 2009:89)
চিত্র: আদনান অকতারের অ্যাটলাস অব ক্রিয়েশন বইয়ে ব্যবহৃত ক্যাডিস ফ্লাইয়ের ছবি
আমি এখানে অকতারের দেয়া সবগুলো মিথ্যা ভাষণ পুনর্গঠন করতে যাচ্ছি না। গুটি কয়েক উদাহরণ শুধু দিতে পারি। অকতার তাঁর বইয়ে দেখাতে চেয়েছেন জীববিবর্তন একটি ভুয়া বিষয়, কারণ অনেক ফসিল রয়েছে যেগুলো জীবন্ত প্রাণীদের মতোই দেখতে। অকতারের বইয়ে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য এবং এই আলোচ্যের উপর ভিত্তি করে তিনি তার ৮০০ পৃষ্ঠার বইয়ের ৭০০ পৃষ্ঠাই ব্যয় করেছেন। ‘সৃষ্টির মানচিত্র’ বইয়ে প্রচুর ফসিলের উজ্জ্বল আলোকচিত্র দেয়া হয়েছে এবং এর পাশে সঙ্গতিহীনভাবে বর্তমানকালের জীবিত উদ্ভিদ-প্রাণীর ছবি। সঙ্গে রয়েছে ছবির পরিচিতিমূলক ছোটোখাটো বর্ণনা। যেমন একটা জায়গায় রয়েছে কিছু ক্রিনয়েড (ইকাইনোডার্মাটা পর্বের সমুদ্রতারা প্রাণীর মতো দেখতে) ফসিলের পাশে অ্যানেলিডা পর্বের দেহখণ্ডকিত কীটের ছবি। এখানে অসঙ্গতি হচ্ছে- জীববিজ্ঞানের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী ক্রিনয়েডর সঙ্গে আমার মতো স্তন্যপায়ী জীবের দূরত্বের চেয়েও অ্যানেলিডা পর্বের প্রাণীর দূরত্ব বেশি। অকতার তাঁর সৃষ্টির মানচিত্র বইয়ের ২৪৪ পৃষ্ঠায় ক্যাডিস ফ্লাইয়ের (মথের মতো দেখতে পোকা) ছবি ব্যবহার করেছেন। ওই ছবির পোকাটির উদরে বড় বড়শি আটকানো রয়েছে, মাছ ধরার সময় বড়শিতে যে রকম কেঁচো বা ওই ধরনের কীট গাঁথা হয়। ফলে একে ডিম্বস্থাপকের মতো লাগছে। আবার ৫২৫ পৃষ্ঠায় একটি ক্রিটাসিয়াস যুগের জলজ কচ্ছপের ফসিলের পাশে আধুনিক যুগের গ্যালাপোগাস কচ্ছপের ছবি দেখানো হয়েছে। জলজ কচ্ছপের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ সেন্টিমিটার হবে আর গ্যালাপোগাসের স্থল কচ্ছপের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১ মিটার এবং ওজন প্রায় ২৫০ কেজির মতো। ছবি দুটির নীচের বর্ণনা হচ্ছে :
প্রাচীন কচ্ছপের ফসিলটি ১৪৬ থেকে ৬৫ মিলিয়ন বছর পুরাতন এবং এর সাথে আজকের যুগের কচ্ছপ দেখতে হুবহু এক রকম, কিন্তু ডারউইনবাদীরা এই বিষয়টি মানতে অনীহ। জীবিত প্রাণীরা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পরিবর্তিত হয় নি। অর্থাৎ তারা কখনোই বিবর্তিত হয় নি। (পৃষ্ঠা ৫২৫)
(১)
(২)
চিত্র: কচ্ছপের বিবর্তনের দুটি রেখাচিত্র
অকতারের বইয়ে উল্লেখিত অসংখ্য ভয়ঙ্কর আবোলতাবোল যুক্তির মধ্যে এটি একটি মোক্ষম উদাহরণ। কেমন করে তিনি ভীষণভাবে ভিন্ন দুটি প্রাণীর ছবি পাশাপাশি বসিয়ে দাবি করতে পারলেন যে প্রাণী দুটি অভিন্ন (Identical)? যদি তা হয়েও থাকে তবু তিনি কেমন করে প্রমাণ করবেন যে- এরা ভিন্ন চেহারার কোনো পূর্বপুরুষ প্রাণী থেকে উদ্ভূত হয় নি?
অকতারের উপরোক্ত মিথ্যা ভাষণকে কিছুটা হয়তো পুনর্গঠন করা যেতে পারে। শুরুটা এভাবে করতে পারি, অকতার হয়তো আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন ফসিল কচ্ছপ আর (গ্যালাপোগাসের) জীবিত কচ্ছপ দুটো দেখতে ‘একরকম’। কিন্তু তিনি বলতে পারেন না, এরা একই প্রজাতির দুটো কচ্ছপ। কারণ আজকের যুগের কচ্ছপ বলতে শুধু একটি প্রজাতির কচ্ছপকে বোঝায় না। (পৃথিবী জুড়ে বর্তমানে কচ্ছপের কমপক্ষে ২৬০ টি প্রজাতি রয়েছে-অনুবাদক) আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় দুটি প্রাণী ‘একরকম’ বলতে অকতার যা বোঝেন তা হচ্ছে-দুটি কচ্ছপকেই জীবের শ্রেণীবিন্যাসের একই পর্যায়ে স্থাপন করা যাবে। এক্ষেত্রে একজন প্রাণীবিজ্ঞানীর বক্তব্য হচ্ছে, এই দুটো প্রাণী সরীসৃপদের ‘চেলোনিয়া’ মহাবর্গের (superorder) অন্তর্ভুক্ত। উৎপত্তির দিক থেকে সকল প্রজাতির কচ্ছপই চেলোনিয়। যেহেতু প্রাণীবিজ্ঞানের সংজ্ঞানুসারে পূর্বের চেলোনিয়ান কচ্ছপ এখনো চেলোনিয় মহাবর্গের মধ্যে রয়েছে, অতএব এদের কোনো পরিবর্তন হয় নি! এই আবোলতাবোলের মধ্যে দিয়ে অকতার বোধহয় আমাদের এরকম কিছুই বোঝাতে চেয়েছেন।
অকতারের অনুসিদ্ধান্তটি যুক্তির পরম্পরা অনুসরণ করে নেয়া হয় নি। ক্রিটাসিয়াস যুগে শুধু কচ্ছপ নয়, পাখি, স্তন্যপায়ীসহ আরো অনেক ধরনের প্রাণী ছিল। এদের কেউই তাদের আধুনিক যুগের আত্মীয়দের সঙ্গে ‘অভিন্ন’ (বৈশিষ্ট্যের) নয়; বরং বেশিরভাগই এদের চেয়ে অনেক আদিম পর্যায়ের। প্রাণীজগতের প্রত্যেক গোত্রের প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রাচীনতম যেসব ফসিল পাওয়া গেছে সেসব প্রাণীর দেহবৈশিষ্ট্য বর্তমান সময়ে তাদের গোত্রের প্রাণীদের চেয়ে অনেকটা ভিন্ন ও আদিম। অনেক প্রাচীন পাখির দাঁত, ডানায় তীক্ষ্ণ নখরযুক্ত আঙুল, লম্বা হাড়যুক্ত লেজ ছিল যা তাদের পূর্বসূরি ডায়নোসরদের মতো দেখতে। (আধুনিক যুগের পাখিদের দাঁত নেই, লম্বা হাড়যুক্ত লেজ নেই, ডানায় তীক্ষ্ণ নখরযুক্ত আঙুল নেই-অনুবাদক)। আবার প্রাচীন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের চোয়ালের সংযোগস্থল, কাঁধের চ্যাপ্টা অংশ এবং পেষক দাঁত ইত্যাদি তাদের পূর্বসূরি সরীসৃপদের মতোই দেখতে ছিল। অকতার কচ্ছপের যে উদাহরণটি টেনেছেন তা মোটেও যুৎসুই উদাহরণ হয় নি। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন প্রায় ২২০ মিলিয়ন বছর পুরাতন চেলোনিয় ফসিল পাওয়া গেছে চীনে। প্রাণীবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘Odontochelys’।
চিত্র: চীন থেকে উদ্ধারকৃত ২২ কোটি বছর পুরাতন Odontochelys ফসিলের ছবি
আধুনিককালে যে কোনো জীবিত কচ্ছপের থেকে এর বৈশিষ্ট্যগুলো আদিম। (Li and Others 2008)। এর কোনো ঠোঁট ছিল না, আদর্শ সরীসৃপদের মতো চোয়ালে দাঁত ছিল, এর পাঁজরগুলো আলাদা ছিল এবং পিঠের শক্ত খোলস জোড়া লাগানো ছিল না। অকতার তাঁর বইয়ে এই ফসিলের ছবি ব্যবহার করতে পারেন নি, কারণ তাঁর বই প্রকাশিত হওয়ার পরে Odontochelys ফসিলের বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমার সন্দেহ আছে অকতার কি তাঁর বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে এই ফসিলের কথা তুলে ধরবেন? Odontochelys ফসিল থেকে এটা স্পষ্ট যে আজকের যুগের কচ্ছপদের সাথে Odontochelys মোটেও ‘অভিন্ন’ নয়।
অকতার যদি তাঁর বইয়ে প্রাচীন কচ্ছপদের কথা তুলে ধরেনও, তবু হয়তো তাঁর বইয়ের বেশিরভাগ পাঠক এই বিশ্বাসে স্থির থাকবেন যে প্রাচীন আর আধুনিক যুগের কচ্ছপগুলি ‘অভিন্ন’। সৃষ্টির মানচিত্র বইয়ের কতজন পাঠক জানেন যে কচ্ছপের কঙ্কাল দেখতে কেমন হয়? আসলে কচ্ছপের পিঠের শক্ত খোলসটি তৈরি হয় ভ্রূণাবস্থায় এর মেরুদণ্ড ও পাঁজরের হাড়গুলো একীভূত হয়ে সেটা কি তারা জানেন? এমন কি বর্তমানকালের জীবিত কচ্ছপদের যে দাঁত নেই, সেটাই বা কতজন জানেন? অকতার নিজেও এমনতর প্রশ্নের প্রত্যাশী নন। তিনি এমন কোনো উদাহরণ হাজির করবেন না যা তার দেয়া বর্ণনার বিরুদ্ধেই বিশ্লেষণী অনুসন্ধানের জন্ম দেয়। যেসব পাঠক কচ্ছপের অঙ্গসংস্থান সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন তারাও অকতারের বই পড়ে বেশিরভাগ সময় বুঝতে পারবেন না ঐ ফসিল এবং জীবিত প্রাণীর ছবি দুটিতে কতটুকু মিল রয়েছে। কারণ অকতার একটি কচ্ছপের কঙ্কালের অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট ছবি ব্যবহার করেছেন, আর বাইরের দিকের ছবি দিয়েছেন অন্য অন্য একটি কচ্ছপের। একটা শর্তে তিনি অবশ্য দাবি করতে পারেন তাঁর দেয়া দুটো কচ্ছপই ‘সাদৃশ্যপূর্ণ’, কারণ ছবি দুটোর আউট লাইনের মধ্যে মিল আছে!
অকতারের দৃষ্টিতে সকল কচ্ছপ ‘অভিন্ন’ জীব, কারণ তারা সকলেই সরীসৃপের একই উপশ্রেণীর (সাবগ্রুপ) অন্তর্ভুক্ত। ৫২৫ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখিত ছবি দুটির মধ্যে এটা কোনো বড় পার্থক্যের বিষয় নয়। অকতারের দাবিটা অনেকটা এরকম-মানুষ আর ইঁদুর দুটি জীবই ‘অভিন্ন’! কারণ তারা দুজনেই স্তন্যপায়ী শ্রেণীভুক্ত প্রাণীর একই মহাবর্গে (Euarchontoglires) অবস্থান করছে। অকতারের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে অন্য কেউ হয়তো বলতে পারে ‘ক্রিটাসিয়াস যুগের (১৩.৫ কোটি বছর আগে থেকে ৬.৫ কোটি বছর আগ পর্যন্ত বিস্তৃত) স্তন্যপায়ী জীব আর বর্তমানকালের স্তন্যপায়ী জীব দুটি ‘অভিন্ন’, কারণ এই দুটো জীবই তো স্তন্যপায়ী।’ মোদ্দা কথা হচ্ছে – জাঁকজমকপূর্ণ চিত্রবহুল বইটিতে অর্থহীন কতগুলো ছবি ব্যবহার করে অকতার আমাদের বোঝাতে চাচ্ছেন :
“দূরবর্তী অতীতে এক ধরনের কচ্ছপ ছিল এবং আজকের যুগেও সে ধরনের কচ্ছপই আছে, তাই জীববিবর্তন ‘রূপকথা’ ছাড়া আর কিছুই নয়!”
প্রমাণের খোঁজে
(প্রাচীন ফসিল ও বর্তমানে জীবিত) প্রাণীদের ‘সাদৃশ্য’ নিয়ে অকতারের কোনো দাবিই আসলে প্রমাণসম্মত নয়। মনগড়া বক্তব্যে ভরপুর তাঁর বই। যেমন বইয়ের ১৮ নং পৃষ্ঠায় তিনি একটি ব্যাঙের ফসিলের ছবি ব্যবহার করেছেন এবং বলেছেন এটি নাকি আজ থেকে ২৮ কোটি বছর আগের! অথচ ব্যাঙ-সদৃশ উভচর জীবের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন একক যে ফসিলের নমুনা উদ্ধার করা হয়েছে সেটি আজ থেকে ২৫ কোটি বছর আগের। উভচর বিশেষজ্ঞ প্রাণীবিজ্ঞানীরা এই নমুনার নাম দিয়েছেন ‘Triadobatrachus’। অকতারের বইয়ে ব্যবহৃত ব্যাঙের ফসিলের ছবি আর ‘Triadobatrachus’র ছবি কিন্তু এক নয়। যা হোক, আদনান অকতার আবারো ব্যাঙের ফসিলের ছবির নীচে বর্ণনায় লিখেছেন ‘২৮ কোটি বছর আগের ব্যাঙ ও আজকের যুগের ব্যাঙের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’ অকতারের ব্যবহৃত ফসিলের ছবিটি যদি পূর্ণবয়ষ্ক কোনো ব্যাঙের হয়ে থাকে তবে অন্তত পক্ষে একটা পার্থক্য তো থাকার কথা : আজকের যুগের পূর্ণবয়স্ক ব্যাঙের কোনো লেজ থাকে না কিন্তু ফসিল ব্যাঙে মেরুদণ্ডের নীচের দিকে সংযুক্ত মেরুদণ্ডের বাকি অংশের সমান দৈর্ঘ্যের হাড়যুক্ত লেজের অস্তিত্ব রয়েছে যা ব্যঙের পেলভিস থেকে বের হয় । বেশির ভাগ ব্যাঙ প্রজাতি ‘ব্যাঙাচি’ অবস্থায় (মাছ-সদৃশ লার্ভা থাকাকালীন) কিছুকালের জন্য লেজের অস্তিত্ব দেখা যায়।
বড় হওয়ার সাথে সাথে লেজের বিলুপ্তি ঘটে এবং ব্যাঙ আকৃতি লাভ করে। অকতারের দেয়া ফসিলটি বোধহয় কোনো কৈশোরকালীন একটা ব্যাঙের ছবি। তবে এ ব্যাপারে আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে প্রয়োজন এ বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার এবং কিছু অতিরিক্ত নিদর্শন। কিন্তু আদনান অকতার তো প্রমাণে উৎসাহী নন। যেনতেন লেজযুক্ত একটা ব্যাঙের কঙ্কালের ছবি দেখিয়ে দাবি করছেন ওটা এবং আজকের যুগের লেজহীন ব্যাঙ নাকি অভিন্ন! ‘Triadobatrachus’র পূর্ণবয়স্ক পর্যায়েও একটা ছোট লেজের অস্তিত্ব রয়েছে এবং এর মধ্যে ব্যাঙ এবং আরো আদিম-উভচর জীবের কিছু মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্যও প্রতীয়মান আছে। (Rage and Rocˇek 1989; Evans and Borsuk-Białynicka 2008)। কিন্তু অকতারের ব্যবহৃত ছবিতে সেগুলোর কোনো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। [Palaeontographica জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধটি পড়ুন এখান থেকে : http://bit.ly/10WWzeF। এবং Palaeontologica Polonica জার্নালে প্রকাশিত সুসান ইভান্সের গবেষণা নিবন্ধটি পড়ুন এখান থেকে : http://bit.ly/13PofQh।-অনুবাদক]
একথা সত্য যে বর্তমানকালের কিছু জীবিত প্রাণী দেখতে অনেকটা বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণীর মতো হয়। কিন্তু এটা কোনোভাবেই বিবর্তনের বিরুদ্ধে যুক্তি বা প্রমাণ নয়। যদি দেখা যেত ভূতাত্ত্বিক সময়ক্রমের শিলার স্তরগুলিতে একমাত্র আধুনিক যুগের প্রাণী ছাড়া অন্য কোনো পূর্বতন জীবের অস্তিত্ব নেই, তাহলে হয়তো আমরা জীববিবর্তনের প্রকল্পকে বাতিল করে দিতে পারতাম। কিন্তু সেরকম কোন ব্যাপার তো নেই। (এই স্তরগুলিতে) প্রাণীসমূহের ক্রমপরিবর্তিত অবস্থার নিদর্শন একটি বাস্তব ঘটনা। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে পূর্বের (স্তরের) জীবেরা নতুন (স্তরের) জীবে থেকে আদিম বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন হয়ে থাকে। এরকম সাধারণীকরণের ব্যতিক্রমও রয়েছে অনেক। কারণ বিবর্তনীয় গতিধারা সব জীবকুলে এক রকম ছিল না। ভিন্ন প্রাণীকুলে ভিন্ন ভিন্ন গতিতে কার্যকরী হয়েছে বিবর্তন। কিছু জীবের ক্ষেত্রে ধীর গতির বিবর্তনের ফলে উদ্ভব ঘটেছে তথাকথিত ‘জীবন্ত ফসিল’, এদের ক্ষেত্রে দেখা যায় আধুনিক আত্মীয় থেকে পূর্বপুরুষদের সঙ্গে দেখতে মিল বেশি। (জীবন্ত ফসিল সেইসব প্রাণীকে বলা হয় বর্তমান পৃথিবীর যেসব জীবে তাদের উদবংশীয় বিলুপ্ত প্রজাতিগুলোর বিভিন্ন আদিম শারীরস্থানিক বৈশিষ্ট্যগুলো বেশি মাত্রায় দেখা যায়। যেমন সিলাকান্থ মাছ, ফুসফুস মাছ, প্লাটিপাস ইত্যাদি। উদ্ভিদের মধ্যে ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ হিসেবে পরিচিত হচ্ছে নগ্নবীজী উদ্ভিদ ‘গিংকগো’। নগ্নবীজী হচ্ছে যেসব সপুস্পক উদ্ভিদের ফল হয় না, বীজগুলি অনাবৃত থাকে। ‘জীবন্ত-জীবাশ্ম’ বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে এইসব উদ্ভিদ বা প্রাণীর কোনোটিই নিজে নিজে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে বেঁচে আছে, তা নয়। অর্থাৎ এদের কারো বয়স মিলিয়ন মিলিয়ন বছর নয়। জীবন্ত জীবাশ্ম বলতে শুধু বোঝায় যেসব উদ্ভিদ বা প্রাণীর প্রজাতিতে ‘আদিম বিভিন্ন শারীরস্থানিক বৈশিষ্ট্যগুলো বংশপরম্পরায় অভিযোজনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে টিকে আছে। -অনুবাদক)।
অনেকে হয়তো জীবন্ত জীবাশ্মের উদাহরণ হিসেবে ক্যাঙ্গারু থেকে আপসামের কথা বলবেন। কিন্তু আপনি যদি প্রাণীবিজ্ঞানে অভিজ্ঞ না হন কিংবা প্রাণীদের অঙ্গসংস্থান সম্পর্কেও বেশি ধারণা না থাকে তবে আজকের যুগের ভার্জিনিয়া আপসামের হাড়ের সাথে ক্রিটাসিয়াস যুগের মারসুপিয়ালদের হাড়ের পার্থক্য আমরা সহজে ধরতে পারবো না। কিছু প্রাচীন জীব থেকে অনেক সময় জীবিত জীবও আদিম গঠনের হতে পারে। দৈহিক গঠনগত কারণে ক্যাঙ্গারু থেকে আজকের যুগের আপসাম অবশ্যই আদিম মারসুপিয়াল বর্গভুক্ত প্রাণী বলে মনে হয়; এমন কী ১৫ মিলিয়ন বছর পূর্বের (মায়োসিন কাল) পুরাতন ক্যাঙ্গারুর ফসিল থেকেও। একইভাবে বলা যায় আজকের যুগের অনেক বানর কিন্তু মানুষ থেকেও অনেক আদিম প্রাইমেট। এমন কী, আদিম মানুষের অনেক পুরাতন ফসিল থেকেও আজকের যুগের বানরের দৈহিক-গঠন আদিম ঘরানার। তার মানে কি এই যে, আজকের যুগের বানর থেকে পুরাতন যুগের আদিম-মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল! মোটেও তা নয়। জীববিবর্তন ক্রম অনুসারে আপসাম-সদৃশ পূর্বপুরুষ থেকে ক্যাঙ্গারুর উদ্ভব হয়েছে এবং মানবকুলের উদ্ভব হয়েছে বানর-সদৃশ প্রাচীন প্রাণী থেকে। অথচ বানরেরা এখনো আমাদের চারপাশেই আছে।
অকতারের বক্তব্যকে আমরা যেভাবেই সাজাই না কেন, বিবর্তনের বিরুদ্ধে তার যুক্তিগুলো শেষ পর্যন্ত তাঁর নিজের জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনছে। যদি আমরা ধরে নেই প্রত্যেক প্রজাতি আলাদা আলাদা বিশেষভাবে সৃষ্টি হয়েছে, তবে এটা আমাদের অবশ্যই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে যে, তাহলে ভিন্ন দুটো প্রজাতিকে কেন একত্রে শ্রেণীবিন্যস্ত করতে হবে? কেন সকল কচ্ছপকে ‘অভিন্ন’ ভাবতে হবে? ডারউইনের পূর্বে জীববিজ্ঞানীদের কাছে এই প্রশ্নের ভালো উত্তর ছিল না এবং অবশ্যই আদনান অকতারের কাছেও এর উত্তর নেই। কিন্তু তাঁর এ ব্যাপারে জানার প্রয়োজন আছে। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বিবর্তনের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে তিনি পাঠকের উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন-দুটো আলাদা প্রজাতি কোনো না কোনোভাবে একই জাতের জীব। ‘একই জাত’ বলতে কি বোঝাচ্ছেন অকতার তা মোটেও পরিষ্কার নয়। ফসিল কচ্ছপ ও জীবিত কচ্ছপকে একই প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করে ‘একই জাতি’ বলতে পারেন না, কারণ এই দুই কচ্ছপ মোটেও এক প্রজাতির নয়। আবার তিনি এও বলতে পারেন না, এরা দুজনে জীবজগতে খুব ঘনিষ্ট আত্মীয়। কারণ তাঁর সৃষ্টিবাদী ধারণা প্রত্যেক প্রজাতিকে আলাদাভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে বলেই বিশ্বাস করে। বিবর্তনের আলোকে জীবজগতে আত্মীয়তার ধারণাকে তো তিনি সমর্থন করেন না।
অকতারের মতো কট্টরপন্থী সৃষ্টিবাদীরা বলতে পারেন সব প্রজাতির কচ্ছপ অবশ্য কিছু প্রয়োজনীয় সাদৃশ্যগত মিল ভাগাভাগি করে থাকে। কিন্তু তাঁর দাবিকৃত সাদৃশ্যগুলো অবশ্য একে-অপরকে কাটাকাটি করে ফেলে। একেকজন মানুষ একেকভাবে মনে করতে পারে কোন কোন সাদৃশ্যগুলো প্রয়োজনীয়। ক্যারোলাস লিনিয়াস ‘Systema Naturae’ (Linnaeus, 1735) বইয়ের প্রথম সংস্করণে জীবজগতের প্রথম শ্রেণীবিন্যাস করেছিলেন, তখন তিমিকে ‘মাছ’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছিলেন, কারণ তিমির শরীরে লোম ও পা নেই। পরবর্তী সংস্করণে লিনিয়াস তাঁর মত পরিবর্তন করে ফেলেন এবং তিমিকে ‘স্তন্যপায়ী’ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বলে চিহ্নিত করেন। কারণ তিমির স্তনগ্রন্থি রয়েছে। একজন ডারউইনীয়-বিবর্তনের সমর্থক ব্যক্তি বলবেন লিনিয়াসের দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি সঠিক, কারণ (জীবনবৃক্ষে) তিমি ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সাধারণ পূর্বপুরুষ (common ancestor) মাছের সঙ্গে তাদের সাধারণ পূর্বপুুরুষের তুলনায় অনেক বেশি কাছাকাছি। কিন্তু একজন সৃষ্টিবাদী এরকম বলার কোনো ভিত্তি নেই কারণ এক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন।
কোনো কোনো পুরাতন পৃথিবীর সৃষ্টিবাদীরা জীবের ‘জাত’ (kinds) এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে যান। তাদের মতে একটা নির্দিষ্ট জাতের মধ্যে বিবর্তন ঘটে থাকতে পারে, কিন্তু এক জাত থেকে অন্য জাতের উদ্ভব কখনো ঘটে না। তাদের মতে ‘আলাদা আলাদা কচ্ছপ প্রজাতি বিবর্তিত হয়েছে তাদের পূর্বসূরি কচ্ছপ থেকে। কিন্তু কোনো কচ্ছপই অন্য কোনো অ-কচ্ছপ জাত থেকে বিবর্তিত হয়ে আসে নি।’ সৃষ্টিবাদীদের এই দলটি ‘জাত’-কে বিবর্তনের ধারাবাহিকতা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন। কিন্তু ডারউইনীয় বিবর্তনের এই অর্ধেক-ধারণা আদনান অকতারের জন্য প্রযোজ্য নয়, কারণ তিনি তো সব পর্যায়ের জীববিবর্তনীয় পরিবর্তনকে অস্বীকার করে বসে আছেন।
হয় আমার জিত নইলে তোমার হার (বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার)
যেহেতু অকতারের দৃষ্টিতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল কচ্ছপ একই তাই তিনি ওডন্টোচেলিসের (Odontochelys) মতো মধ্যবর্তী ফসিলের (transitional fossils) গুরুত্ব ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন। হাস্যকর খবর হচ্ছে ২০০৮ সালে অকতার এক বিশাল অংকের পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। ১০ ট্রিলিয়ন তুর্কি লিরা! (অর্থাৎ আট ট্রিলিয়ন দশ বিলিয়ন আটশত নব্বই মিলিয়ন মার্কিন ডলার মাত্র! সংখ্যায় লিখলে $৮,০১০,৮৯০,০০০,০০০)। বিবর্তনের প্রমাণ হিসেবে কেউ যদি একটি মধ্যবর্তী ফসিল হাজির করতে পারে তাকে নাকি এই পুরস্কারটা দিবেন অকতার! আমি নিশ্চিত অকতারের অ্যাকাউন্টে এই বিপুল অংকের টাকা নেই। তাঁর পুরস্কারের অংকটা তুরস্কের জাতীয় বার্ষিক বাজেটের ১০০ গুণ। অকতার কৌশলে শুভঙ্করের ফাঁকি তৈরি করে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে এই বাজি ধরেছেন, এক্ষেত্রে চন্দ্র-সূর্য-তারা পর্যন্তও তিনি বাজিতে ধরতে পারতেন। কোনো সমস্যা ছিল না। কোনো ব্যক্তি বিবর্তনের যে প্রমাণই হাজির করুক না কেন অকতারের সামনে, তাঁর কোনো ইচ্ছা নেই পুরস্কার প্রদানের। (অকতারের শুভঙ্করের ফাঁকিটি হচ্ছে তিনি নিজে ফসিলের ট্রাঞ্জিশনাল বৈশিষ্ট্য স্বীকার করেন না, মানতে চান না, তিনিই আবার ট্রাঞ্জিশনাল ফসিলের প্রমাণ চেয়েছেন। ফলে তাকে ট্রাঞ্জিশনাল ফসিলের যে প্রমাণই দেয়া হোক না কেন যথারীতি একে তিনি অস্বীকার করবেন। গ্রহণযোগ্য নয় বলে প্রমাণটি বাদ দিয়ে দেবেন।-অনুবাদক)।
এবার আমরা কিছু ট্রাঞ্জিশনাল ফসিলের চিত্র দেখতে পারি। সদ্য প্রকাশিত মানব বিবর্তনের উপর একটি বই (Cartmill and Smith 2009) থেকে ১৪টি খুলির ছবি চিত্র-১-এ দেয়া হল। খুলির ছবিগুলোর প্রথম চিত্রটি (A) একটি এপের, আজকের যুগের আধুনিক শিম্পাঞ্জির এবং সর্বশেষটি [N] আধুনিক মানুষের খুলি। বাকি ১২টি হচ্ছে দ্বিপদী এপের, যারা ফসিল মানব, এদের পূর্বপুরুষ কিংবা পূর্বআত্মীয়। প্রায় ৩৫ লক্ষ বছর থেকে কমবেশি ১ লক্ষ বছর পুরাতন এদের প্রাচীনতা। চিত্রে সময়ের ধারাবাহিকতা অনুসারে ফসিলগুলো সাজানো হয়েছে। ছবিতে এদের প্রত্যেকের ক্র্যানিয়াল ক্যাপাসিটি বা খুলির আয়তন (ভেতরের ধারণক্ষমতা) উল্লেখসহ তাদের প্রাচীনতা অনুসারে সর্বপ্রাচীন থেকে সর্বনবীন বয়সী পর্যন্ত সাজানো হয়েছে।
চিত্রে উল্লেখিত সবচেয়ে প্রাচীন ফসিল হচ্ছে [B] অস্ট্রেলোপিথেকাসের (Australopithecus)। ফসিলটি পূর্ব আফ্রিকা থেকে উদ্ধার করা হয়। অস্ট্রেলোপিথেকাসের শিম্পাঞ্জি-সদৃশ বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে এদের খুলির আয়তন ছোট এবং মুখমণ্ডল বড় ও বাইরের দিকে প্রসারিত। কিন্তু শিম্পাঞ্জির (A) সাথে অস্ট্রেলোপিথেকাসের [B] সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে ঘাড়ের মাংসপেশির সাথে খুলির যে সংযুক্তি স্থান রয়েছে (চিত্রে কালো তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে) তা অস্ট্রেলোপিথেকাসের নীচের অবস্থান করছে। এই বৈশিষ্ট্যটি মানব-সদৃশ। এই পার্থক্য দ্বারা পরিষ্কার বোঝা যায় শিম্পাঞ্জি (সামনের দুই হাত ব্যবহার করে) চার পায়ে চলাফেরা করে, কিন্তু অস্ট্রেলোপিথেকাসরা ছিল দ্বিপদী। মাথা উপরে এবং ঘাড় কিছুটা সোজা করে ভারসাম্য বজায় রেখে চলাফেরা করতো। সবচেয়ে নবীন বয়সী ফসিলটি (M) প্রাক-আধুনিক মানুষের। এটি ইজরায়েলের নাজারাত এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর সাথে আধুনিক মানুষের খুলির উল্লেখযোগ্য মিল বেশ লক্ষণীয়। আবার B থেকে M পর্যন্ত বাকি খুলির ট্রাঞ্জিশনাল বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোনো ধরনের ধারাবাহিকহীনতা নেই। অর্থাৎ এই খুলিগুলোর কেউ কেউ সম্পূর্ণ শিম্পাঞ্জি-সদৃশ বা কেউ কেউ সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষের মত বিষয়টা এমন নয়। বরং এখানে মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্যগুলোর উপস্থিতি ক্রমবিকাশের চিহ্নকে আরও স্পষ্ট করেছে।
চিত্র: মানুষের পূর্বপুরুষের খুলির ছবি
তাহলে আমি কি অকতারের ঘোষিত ১০ ট্রিলিয়ন লিরা জিতে গেলাম? না, সেই সুযোগ নেই। অকতার খুব সচেতনতার সাথে প্রচারণা চালিয়েছেন মানব বিবর্তনে কোনো ধরনের ক্রমরূপান্তরের বা বিকাশের ছাপ নেই। তাঁর সৃষ্টির মানচিত্র বইয়ের একদম শেষের দিকে মানব বিবর্তনের ফসিলের প্রমাণ নিয়ে কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। এই বক্তব্যের পুরোটাই খ্রিস্টান সৃষ্টিবাদীদের কাছ থেকে ধার করা। প্রত্ননৃবিজ্ঞানকে তিনি আক্রমণ করেছেন মূলত চারটি পয়েন্টেঃ (আর এখানে আদনান অকতার তৈরি করেছেন শুভঙ্করের ফাঁকি!)
(১) পিল্টডাউন মানব ফসিল একটা ধোঁকাবাজি। অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী এই ফসিল নিয়ে প্রতারণা করেছেন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী এপের খণ্ডিত ফসিলকে ভুলভাবে চিহ্নিত করেছেন, যেমন রামাপিথেকাস (Ramapithecus)। এমন কী পেকারি বা বন্য শূকরকেও (Hesperopithecus) মানুষের পূর্বপুরুষ বলেও চিহ্নিত করেছেন। তাই প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরা কে কি বললেন এগুলোকে এতো গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই।
(২) অস্ট্রেলোপিথেকাস (চিত্রে B ও C খুলি) শুধুই এপ ছিল, যেমন বর্তমান সময়ের এপরা সম্পূর্ণই এপ। এপদের মতো অস্ট্রেলোপিথেকাসদের ছিল দীর্ঘ বাহু আর ছোট পা। এছাড়া এপ-সদৃশ আরও অনেক বৈশিষ্ট্যও তাদের মধ্যে ছিল। ফলে তারা কোনোভাবে মানুষের সাথে সম্পর্কিত নয়।
(৩) হোমো হেবিলিস [D] এবং হোমো রুডোলফেনসিসরাও [E] বহুক্ষেত্রে এপ-সদৃশ ছিল। অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী এদের হোমো জিনাসের (গণ) অন্তর্ভুক্ত না করে অস্ট্রেলোপিথেকাস জিনাসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ফলে অস্ট্রেলোপিথেকাসদের এবং আজকের যুগের এপদের মতো তারাও মূলত এপ ছিল।
(৪) হোমো ইরগাসটার [F] এবং হোমো ইরেকটাস [G]) দুটোই এক এবং এর মধ্যে কোনো সত্যিকারের সিমিয়ান বৈশিষ্ট্য ছিল না। এটা পুরোপুরি মানুষই ছিল। খুব বেশি এপ-সদৃশ হোমো প্রজাতি হোমো হেবিলিস [D] ও হোমো রুডোলফেনসিস [E] এর একই সময়কালে হোমো ইরগাসটার [F] বাস করতো। তাই এদেরকে অস্ট্রেলোপিথেকাস এবং হোমো’র মধ্যবর্তী (ট্রাঞ্জিশনাল) ফসিল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। অর্থাৎ উপসংহার হচ্ছে মানুষ সর্বদাই মানুষ ছিল এবং এপরা সর্বদাই এপ ছিল।
অকতারের বইয়ের অন্যান্য আলোচ্যের মতো এই বক্তব্যগুলো অবশ্য মিথ্যা বানোয়াট ভাষণে ভরপুর নয়। এখানে শুধু ভুল বক্তব্য দেয়া হয়েছে। ফলে এগুলো খুব সহজে খণ্ডন করা যায়। প্রথম পয়েন্ট থেকে শুরু করা যাক। এখানে শুধু দূর থেকে মানব বিবর্তন নিয়ে বৈজ্ঞানিক বক্তব্যের ঐক্যমতের বিরোধিতা করা হচ্ছে। কিন্তু এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয় কিংবা বিস্ময়কর কিছুও নয়, আর প্রায় সবার মতো বিজ্ঞানীরাও অনেক সময় ভুল করতে পারেন। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। (পিল্টডাউন মানব ফসিল নিয়ে ইংল্যান্ডে গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরু থেকে ভাঁওতাবাজির ঘটনা ঘটে এবং এটি সম্পূর্ণরূপে ধরা পড়ে প্রায় চল্লিশ বছর পরে। এই জালিয়াতির সাথে ইংল্যান্ডের অপেশাদার এক ফসিল সংগ্রহকারী চার্লস ড্যাসনকে মূল কুশীলব হিসেবে সন্দেহ করা হয়। সঙ্গী হিসেবে সন্দেহ করা হয় কয়েকজন খ্যাতিমান নৃবিজ্ঞানীকে। যারা প্রত্যেকে ইচ্ছেকৃতভাবে অথবা কোনো না কোনোভাবে বিভ্রান্ত হয়ে বিজ্ঞানের প্রতি অপেশাদারসুলভ মনোভাব নিয়ে পিল্টডাউন মানব ফসিল নিয়ে জোচ্চুরির ঘটনায় জড়িত ছিলেন।-অনুবাদক)। কিন্তু আদনান অকতার তাঁর এই বক্তব্যে যে সত্য গোপন করেছেন তা হচ্ছে ফসিল সংক্রান্ত এইসব সুনির্দিষ্ট ভুলগুলো চিহ্নিত এবং সংশোধন করেছেন একমাত্র বিজ্ঞানীরাই। (এ কাজে সৃষ্টিবাদীদের কোনো ভূমিকা নেই।) বিজ্ঞানীরা নিজেরাই উৎসুক হয়ে খুঁজে বের করেছেন, জনগণের সামনে প্রকাশ করেছেন তাদের পূর্বসূরি বা সহকর্মী কর্তৃক কৃত গোপন ভুলগুলো।
দ্বিতীয় পয়েন্টের তথ্যের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল অকতার সেই চল্লিশ বছর পুরানো সোলি জাকারম্যানের (১৯০৪-১৯৯৩) সেকেলে নিবন্ধের উপর নির্ভর করেছেন। জাকারম্যানই সর্বশেষ এবিষয়ে অবহিত বিজ্ঞানী ছিলেন যিনি অন্য বিজ্ঞানীদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে বলতেন অস্ট্রেলোপিথেকাসরা মানুষের চেয়ে আফ্রিকান এপদের সাথেই বেশি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। (Ashton and Zuckerman 1950; Zuckerman 1966)। অকতারের মতো জাকারম্যানও মনে করতেন অস্ট্রেলোপিথেকাসরা বহুদিক থেকেই এপ-সদৃশ। মধ্যবর্তী প্রাণীদের মধ্যে এরকম বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়ার আশা আপনারা করতেই পারেন। বিজ্ঞানীরা এখন মোটামুটি একমত যে (চিত্রে উল্লেখিত) খুলি [C] থেকে অনেক বেশি এপ-সদৃশ বৈশিষ্ট্য রয়েছে খুলি [B]-এ। আবার খুলি [C] অনেক বেশি এপ-সদৃশ খুলি [D] ও খুলি [E] থেকে। খুলি [E] আবার খুলি [F] ও খুলি [G] থেকে বেশি এপ-সদৃশ। খুলি [H] থেকে খুলি [G] বেশি পরিমাণ এপ-সদৃশ এবং এভাবে চলেছে। তবে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে খুলি [D] মানে হোমো হেবিলিস ও খুলি [E] মানে হোমো রুডোলফেনসিস প্রজাতি নিয়ে। এদেরকে অস্ট্রেলোপিথেকাস নাকি হোমো জিনাসের অন্তর্ভুক্ত করা হবে এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক বিতর্ক রয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায় এ দুটির ফসিল নমুনাতে উভয় জিনাসের প্রচুর মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। জর্জিয়া থেকে একই সময়কালের খুলি ও হাড় পাওয়া গেছে, যাদেরকে কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানী হোমো হেবিলিস [D] প্রজাতির বলে শ্রেণীবিন্যস্ত করতে চান আবার কেউ কেউ এগুলোকে হোমো ইরগাসটার [F] প্রজাতির সাথে শ্রেণীবিন্যস্ত করতে চান। ফসিলগুলোর দৈহিক গঠনাকৃতিতে মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্য থাকার কারণেই এই বিতর্কের উদ্ভব। যদি এইসব ফসিলের মধ্যে কোনো ধরনের ট্রাঞ্জিশনাল বা মধ্যবর্তী গঠন বৈশিষ্ট্য না থাকতো, তবে এই বিতর্ক অনেক আগেই ফুরিয়ে যেত।
বোঝা যাচ্ছে অকতার ও তাঁর সহকারী-লেখকরা প্রাচীন-মানব নিয়ে লিখতে গিয়ে কিছুটা প্রস্তুতিমূলক কাজ আগেই সেরেছেন। সমতল পৃথিবীর বক্তারা যেমন কোনো ধরনের ভিত্তি ছাড়াই জীববিবর্তনকে অস্বীকার করে থাকেন সেই তুলনায় অকতারদের এই বক্তব্যগুলো অনেক বেশি কৌশলী ও তথ্যাভিজ্ঞ। কিন্তু আদনান অকতারদের অস্ট্রেলোপিথেকাস ও হোমো সম্পর্কে দাবিগুলো অনেকটা এরকম-সকল কচ্ছপই অভিন্ন কারণ সকলেই তো কচ্ছপ!’ তাঁদের কাছে অস্ট্রেলোপিথেকাসের কঙ্কালতন্ত্রের যে মানব-সদৃশ স্বাতন্ত্রসূচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয় কারণ এটা তো শেষ পর্যন্ত একটা এপ-ই! আবার খুলি [F] বা হোমো ইরগাসটার-এর খুলির মধ্যে যে প্রাক-মানবিক (subhuman) বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেমন খুলি ও মুখমণ্ডলের বড় আকার এবং ও প্রসারিত বাইরের দিক ইত্যাদি সেসব তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ (তাদের মতে) এটাও শেষ পর্যন্ত একটা মানুষের খুলি ছাড়া কিছু নয়! আসল কথা হচ্ছে আদনান অকতার তাঁর আকাঙ্ক্ষিত উপসংহার আগেই টেনে রেখেছেন। তাঁর আরেকটি বক্তব্য হচ্ছে হোমো ইরগাসটার [F] কখনো হোমো রুডোলফেনসিস [E] থেকে উদ্ভূত হতে পারে না কারণ দুটি খুলির ডেটিংয়ে একই বয়স দেখাচ্ছে। আদনানের এই বক্তব্যটা অনেকটা এরকম যুক্তি হাজির করছে যে–মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কেনিয়াতে বসবাসকারী তাঁর দাদির বংশোদ্ভূত হতে পারেন না কারণ উভয়েই তো এখনো জীবিত আছেন!
অন্ধত্ব মোচন
সৃষ্টির মানচিত্র বইয়ে প্রচুর সুন্দরভাবে রক্ষিত ফসিলের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে যাতে এদের বিভিন্ন অংশগুলো সহজে দেখেই আমাদের মনে এই ধারণা হয়- ছবির এই জীবগুলো সুক্ষ্ম ও নিখুঁত অংশসমূহের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। ছবিগুলো দেখে যেন আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই – সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সকল জীবকেই পরিপূর্ণ ও নিখুঁত রূপে সৃষ্টি করেছেন। যেমন একটা বক্তব্য হচ্ছে আমাদের চোখ নাকি অত্যন্ত নিখুঁত ডিজাইনে তৈরি। খ্রিস্টান সৃষ্টিবাদীদের কাছে এই বক্তব্যটি অত্যন্ত পছন্দের। রেভারেন্ড উইলিয়াম প্যালে ঈশ্বরের তৈরি সৃষ্টিতে নিখুঁত ডিজাইনের প্রমাণ দাবি করে এই বক্তব্যটি উপস্থাপন করেছিলেন। (Paley 1802)। কিন্তু চোখের গঠনের চমৎকার বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের আলোকে বিবর্তন অনুযায়ী কোনো অভিযোজনই নিখুঁত নয়।
প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হতে পারে (বংশগতির সূত্রে পাওয়া) পূর্বপুরুষের বংশানুক্রমিক এই বৈশিষ্ট্যাবলীর উপর, যা সমসাময়িককালে জীবের বর্তমান চাহিদা পূরণের জন্য আদর্শ নয়। প্রকৃতিতে প্রচুর উদাহরণ রয়েছে যা আমাদের সামনে বাজে (অপরিপূর্ণ) পরিকল্পনার নমুনা তুলে ধরে। যাই হোক, বাজে পরিকল্পনা শব্দদ্বয় আমাদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। এই বিভ্রান্তি কিন্তু বাজে শব্দটি থাকার কারণে নয়, বরং এর মূল কারণ হচ্ছে প্রকৃতিতে আসলে কোনো ডিজাইন (পরিকল্পনা) নেই।
এরপরও দুর্ভাগ্য আমাদের, মানুষ কিভাবে বিষয়টিকে দেখছে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য। সরীসৃপ, পাখিদের (একটি সুনির্দিষ্ট দ্রষ্টব্যের দিকে) দৃষ্টি নিবদ্ধ করার কৌশল মানুষের চেয়ে অনেক কার্যকরী ও উন্নত। মানুষের চোখ সাধারণ প্রয়োজন পূরণের উপযোগী হলেও মোটেও বিশেষভাব দক্ষতাপূর্ণ নয়। ৪০ বছর বয়সের পরই দেখা যায় মানুষের চোখের কার্যকারিতা আস্তে আস্তে কমে যায়, ফলে কোনো কিছু পাঠ করতে বা দেখতে বাধা সৃষ্টি হয় কিংবা আমরা চশমা ব্যবহার করতে বাধ্য করতে হই। আমাদের চোখের গঠন এমন কারণ (আজকের অধিকাংশ স্তন্যপায়ীদের মতোই) আমরা যে আদিম স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে উদ্ভূত হয়েছি যাদের ছিল ছোট চোখ এবং সেই চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ করার সামর্থ্য তেমন উন্নত ছিল না। পরবর্তীতে আমাদের চোখের ফোকাস কৌশলে ছোট ছোট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচন ক্রিয়াশীলতার কারণে। কিন্তু এখন এই বিষয়টিকে যদি (সর্বশক্তিমানের) পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে স্বাভাবিকভাবে আমাদের চোখের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা ঈশ্বরিক ক্ষমতার অর্ধেক বিফলতা হিসেবে তাঁর সুনামহানি ঘটায়। কিন্তু একে যদি আমরা প্রাকৃতিক নির্বাচনের উৎপাদন হিসেবে দেখি তবে একে চমকপ্রদ সাফল্য বলেই মনে হয়।
[প্রকৃতিতে যেসব মেরুদণ্ডী-অমেরুদণ্ডী প্রাণীর চোখ রয়েছে, তাদের চোখের গঠন ও কার্যকারিতার দিক দিয়ে অনেক পার্থক্য রয়েছে। আধুনিককালের প্রাণীদের তুলনায় আদিমকালের প্রাণীদের মধ্যে চোখের গঠন ও কার্যকারিতা অত্যন্ত দুর্বল। এর মাধ্যমে এটা বোঝা যায় হুট করে একদম পরিপূর্ণ চোখ প্রাণীদেহে উদ্ভূত হয় নি। দীর্ঘদিনের ক্রমবিকাশমূলক প্রক্রিয়ায় একটু একটু ভ্যারিয়েশনের ভিতর দিয়ে প্রাণীদেহে চোখ গঠিত হয়েছে। প্রাণীজগতে মানুষ হচ্ছে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের স্তন্যপায়ী শ্রেণীর। পৃথিবীতে প্রাণবৈচিত্র্যের যে বয়স-সীমা রয়েছে (প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি বছর) সেখানে মানুষের অবস্থান একদম নবীন (মাত্র দুই থেকে এক লক্ষ বছর মাত্র)। অর্থাৎ মানুষ তুলনামূলকভাবে আধুনিক। মানুষের চোখের গঠন ও কার্যকারিতার চেয়ে কেঁচো জাতীয় অমেরুদণ্ডী প্রাণী ফ্ল্যাটওয়ার্মদের চোখের গঠন ও কার্যকারিতা অর্ধেকের চেয়েও কম। ফ্ল্যাটওয়ার্মদের দেহে শুধু আলোকসংবেদী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাগ রয়েছে। সামুদ্রিক প্রাণী নটিলাসের (Nautilus) একটু উন্নত গঠনের চোখ রয়েছে। তবে তার চোখের গঠনের সাথে মানুষের চোখের গঠনের পার্থক্যও রয়েছে। ফ্ল্যাটওয়ার্ম ও মানুষের চোখের গঠনের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে নটিলাসের চোখের গঠন। প্রাণীবিজ্ঞানীরা দেখেছেন নটিলাসের পিনহোল ক্যামেরার মতো চোখের যে গঠন তা আলোকসংবেদনশীল। কোনো বস্তুর দিকে তাকালে ছায়া তৈরি হবে (ডিম লাইটের আলোতে দেখতে যেরকম লাগে) কিন্তু বস্তুর পূর্ণাঙ্গ ছবি তার দৃষ্টিতে তৈরি হয় না। নটিলাসের চোখের তুলনায় ফ্ল্যাটওয়ার্মের চোখের গঠন আরো দুর্বল। তার চোখে কোনো বস্তুর পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরি হয় না, ছায়াও তৈরি হয় না। শুধু আলোর প্রতি এর স্নায়ুগুলোর কিছু প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আদিম অমেরুদণ্ডী প্রাণী থেকে শুরু করে বর্তমানকালের প্রাণীদের চোখের গঠনের এবং কার্যকারিতার যে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য প্রাণীজগতে রয়েছে-এগুলো নিশ্চয়ই কোনো অলৌকিক বুদ্ধিদীপ্ত সত্তার ধীরে ধীরে দক্ষতা বৃদ্ধি আর ক্রমান্বয়ে উন্নতির ফল হিসেবে কেউ দাবি করাটা যৌক্তিক হবে না।-অনুবাদক]
রিচার্ড ডকিন্সের ওয়েব সাইট বন্ধ করে দেয়ার আর্জি জানিয়ে অকতারের আইনজীবী তুর্কি আদালতে বলেছিলেন ডকিন্সের অসভ্য আচরণ আদনান অকতারের মতো সম্মানিত এবং মার্জিত ব্যক্তির সুনামহানি ঘটিয়েছে। তাঁর মক্কেল আদনান অকতারের লেখা বিভিন্ন বিষয়ের তিনশত গ্রন্থ রয়েছে, এইসব বইয়ে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর মতামত রয়েছে কিন্তু এগুলোর কোথাও একটাও অসম্মানজনক শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন কী তাঁর এক ডজনেরও উপর ওয়েব সাইট রয়েছে সেখানেও এমন একটি শব্দও নেই। (দ্রষ্টব্য : http://bit.ly/16e44CA )। আমি অবশ্য তিনশত বইয়ের সবগুলো পড়ে দেখি নি। কিন্তু যেগুলো পড়েছি তাতে বিজ্ঞানী, বস্তুবাদী এবং সর্বোপরি চার্লস ডারউইনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ আর বিদ্বেষের সমাহার দেখতে পেয়েছি। তাঁর সৃষ্টির মানচিত্র বইয়ের প্রথম দিকে ডারউইনকে বাতিল করে দেবার অভিপ্রায়ে লিখেছেন :
“চার্লস ডারউইনের দাবির অবশ্যই কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ বা ভিত্তি নেই। কিন্তু যখন থেকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতি ঘটতে থাকলো একদম প্রাথমিক মাত্রায় সেই সময় থেকেই ডারউইনের হাস্যকর এবং অবাস্তব দাবিগুলো দিনের আলোর সামনে আর টিকে থাকতে পারলো না।” (পৃষ্ঠা ১৪)।
আমার বেশ মনে ধরেছে অকতার তাঁর প্রথম বাক্যে ‘অবশ্যই’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন! কেউ যদি ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিজ গ্রন্থটি খুব গভীরভাবে পাঠ না করেও শুধু দ্রুত পাতা উল্টিয়ে যায় তবু সে টের পাবে ডারউইন তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে কী গভীর পরিমাণ ও দীর্ঘ অনুসন্ধান কার্য চালিয়েছেন। কিন্তু আমার এ বক্তব্য দিয়ে অবশ্য প্রমাণিত হয় না ডারউইন সঠিক ছিলেন। কিন্তু অকতার সম্পূর্ণ ধৃষ্টতার সাথে, বোকার মতো ও কিছুটা ঔদ্ধত্যের সাথে দাবি করেছেন ‘ডারউইনের থিওরি অবশ্যই কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ব্যতিরেকে তৈরি হয়েছিল।’ তাঁর এই বক্তব্য শুধু ভুল নয় বরং পুরোপুরি সত্যের বিপরীত। অনেকটা এরকমভাবে বলা যায় যে তাঁর নিজের বইটিও ‘অবশ্যই’ কোরানের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল।
যদি (অকতার যেমনটা বলেছেন) জীববিবর্তনের অনুকল্পটি পুরোপুরি ভুল, বিশ্ব সম্পর্কে আদিম দৃষ্টিভঙ্গি আর আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ঘাটতির উপর ভিত্তি করে এটি গড়ে উঠতো। তাহলে আমরা আশা করি বিজ্ঞানীরা এতোদিনে আরো মার্জিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ভালো থিওরি ও প্রচুর তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ডারউইনের কাজগুলো নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে সত্য এর বিপরীতে অবস্থান করছে। যতই বিজ্ঞানীরা জীবজগৎ সম্পর্কে জানতে পারছেন ততই নিশ্চিতভাবে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে এই জগতে জীবনের বৈচিত্র্য বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত হয়েছে এবং ডারউইনের বর্ণিত প্রক্রিয়াটি (প্রাকৃতিক নির্বাচন) মৌলিকভাবে সঠিক। জ্ঞানের ক্রমবিকাশে আমরা জানতে পেরেছি বংশগতির সঞ্চারণ সম্পর্কে, ডারউইনের মূল থিওরিতে এ বিষয়ে বিশাল শূন্যতা আছে। কিন্তু বংশগতির সঞ্চারণের ধারণা পরবর্তীতে খুব বাস্তবসম্মতভাবে ডারউইনের প্রাকৃতিন নির্বাচন থিওরিকে শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করেছে।
আদনান অকতার তাঁর শতাধিক গ্রন্থের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে ইসলামের নাম ভাঙিয়ে ডারউইনকে আক্রমণ করেছেন। সৃষ্টির মানচিত্র বইকে তিনি তাঁর কর্মের বিশাল অর্জন এবং গৌরবের সাথেই দেখেন। এই বইটি আরো দুই খণ্ডেও প্রকাশিত হয়েছে। আমি অকতারের বাকি কাজগুলো দেখি নি, কিছু লেখার অনলাইন শিরোনাম পাঠ করা ছাড়া। যেমন কয়েকটার নাম হচ্ছে ‘The Skulls that Demolish Darwin’, ‘The Miracle of Electricity in the Body’, ‘The Miracle of Termites’, ‘Darwinism Refuted’, ‘Matter: The Other Name for Illusion’ ইত্যাদি। আগ্রহীদের জন্য বেশিরভাগ বই ওয়েব সাইটে পিডিএফ করে রাখা আছে। (তথ্যসূত্র দ্রষ্টব্য)।
অকতারের ‘The Miracle in the Mosquito’ বইটি (Yahya 2005) আমি তাঁর ওয়েব সাইট থেকে নামিয়ে দেখতে চেয়েছি অকতার কেমন করে ম্যালেরিয়া রোগকে ‘দয়ালু ঈশ্বরের’ (যদিও তিনি তা নন) ‘কৌশলী বিবেচনা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। যতদূর সম্ভব আমি এখানে বলতে চাচ্ছি অকতারের এই জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল ভলিউমগুলো আসলে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের প্রতি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অবিশ্বাস থেকেই লেখা হয়েছে। অকতার চিন্তাই করতে পারেন না কেমন করে কোনো কিছু বিবর্তিত হতে পারে, অতএব তার দৃষ্টিতে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
আমি আশা করবো অকতারের উচিৎ হবে তিনি যে পরিমাণ সময় লেখালেখিতে ব্যয় করেন তার থেকে আরো কিছুটা বেশি সময় যেন ‘চিন্তা’ করতে ব্যয় করেন। এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, মৌলিক চিন্তা করাটা আসলে দুরূহ। চিন্তা খুব আস্তে ধীরে তৈরি হয় এবং চিন্তা-প্রক্রিয়াটি অনেকের জন্য পীড়াদায়কও বটে। ডারউইন ১৯টি বছর ব্যয় করেছেন শুধু প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে ভাবতে গিয়ে। প্রাকৃতিক নির্বাচন বিষয়ে অরিজিন অব স্পিসিজ বইটি প্রকাশের আগে একটার পর একটা নোটবই লিখে শেষ করেছেন প্রচুর উদ্ধৃতি আর পর্যবেক্ষণ দিয়ে, তাঁর থিওরির সপক্ষে তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করে। অবশেষে বইটি যখন প্রকাশিত হল সঙ্গত কারণেই বইটি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের একটি স্মরণীয় কীর্তি এবং মানুষের বৌদ্ধিক চেতনার একটা বিশাল বিজয় হিসেবে স্বীকৃতি পেল। অরিজিন অব স্পিসিজ তবু একটা মাত্র বই। কোনো ব্যক্তি যদি প্রচুর সময় ব্যয় করে শুধু চিন্তার জন্য এবং গভীরভাবে বিষয়ভিত্তিক অধ্যয়নের জন্য, তার আসলে কখনোই প্রয়োজন পড়বে না অকতারের মতো ৩০০-এর উপর বই প্রকাশ করার।
তথ্যসূত্র
• Cartmill M, Smith FH. 2009. The Human Lineage. New York: Wiley Blackwell.
• Darwin CR. 1859. On the Origin of Species by Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life. London: John Murray.
• Evans SE, Borsuk-Białynicka M. 2008. The Early Triassic stem-frog Czatkobatrachus from Poland. Palaeontologica Polonica 65:79–105.
• Li C, Wu X-C, Rieppel O, Wang L-T, Zhao L-J. 2008. An ancestral turtle from the Late Triassic of southwestern China. Nature 456:497–501.
• Linnaeus C. 1735. Systema Naturae, sive Regna Tria Naturae Systematice Proposita per Classes, Ordines, Genera, et Species. 1st ed. Leiden: Theodorum Haak, ex Typographia Joannis Wilhelmi de Groot. Available from: http://www.biodiversitylibrary.org/item/15373#.
• Paley W. 1802. Natural Theology; Or, Evidences of the Existence and Attributes of the Deity as Collected from the Appearances of Nature. London: R Faulder. Available from: http://darwin-online.org.uk/content/frameset?itemID=A142&viewtype=text&pageseq=1
• Rage J-C, Rocˇek Z. 1989. Redescription of Triadobatrachus massinoti (Piveteau 1936), an anuran amphibian from the Early Triassic. Palaeontographica (A) 206:1–16.
• Searle J. 2009. Why should you believe it? New York Review of Books 56(14):88–92.
• Yahya H. 2000. Darwinism Refuted. Istanbul: Global Publishing. Available from: http://www.harunyahya.com/refuted1.php
• Yahya H. 2002. Matter: The Other Name for Illusion. Istanbul: Global Publishing. Available from: http://www.harunyahya.com/matter.php
• Yahya H. 2005. The Miracle in the Mosquito. Istanbul: Global Publishing. Available from: http://www.harunyahya.com/books/science/mosquito/miracle_mosquito_01.php
• Yahya H. 2007a. Atlas of Creation, 1st English ed. Istanbul: Global Publishing. Available from: http://www.harunyahya.com/books/darwinism/atlas_creation/atlas_creation_01.php
• Yahya H. 2007b. The Miracle of Termites. Istanbul: Global Publishing. Available from: http://www.harunyahya.com/books/science/termites/termites_01.php
• Yahya H. 2007c. The Miracle of Electricity in the Body. Istanbul: Global Publishing. Available from: http://www.harunyahya.com/books/science/electricity/electricity_01.php
• Yahya H. 2008. The Skulls that Demolish Darwin. Istanbul: Global Publishing. Available from: http://www.harunyahya.com/books/darwinism/skulls_demolish_darwin/skulls_darwin.php
* ম্যাট কার্টমিল : আমেরিকার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। জীববিবর্তন ও ব্যবহারিক অঙ্গব্যবচ্ছেদ বিষয়ে তাঁর প্রায় শতাধিক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন নৃবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা জার্নালে। একইসাথে তিনি বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের ইতিহাস ও দর্শন নিয়েও লেখালেখি করেছেন দীর্ঘকাল ধরে। কার্টমিলের পুরস্কারপ্রাপ্ত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘A View to a Death in the Morning’ (Cambridge [MA]: Harvard University Press, 1996)। এই বইয়ে মানুষের উদ্ভব ও আদিম মানুষের শিকারি জীবন-ব্যবস্থার উপর পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন কার্টমিল। লেখালেখি ছাড়াও তিনি শিক্ষকতা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রচুর পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন সময়। ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স’ সংস্থার একজন সম্মানিত ফেলো এবং আমেরিকার শারীর নৃবিজ্ঞানীদের সংগঠনের (আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিক্যাল অ্যানথ্রোপলজিস্ট্স) সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। নৃবিজ্ঞানীদের বিশ্বপ্রসিদ্ধ বিজ্ঞান পত্রিকা ‘International Journal of Primatology’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ‘American Journal of Physical Anthropology’র সম্পাদকমণ্ডলীর শীর্ষপদেও ছিলেন একসময়। অধ্যাপক কার্টমিলের গবেষণায় আগ্রহের বিষয় হচ্ছে দ্বিপদী প্রাণীর বিবর্তন, চতুষ্পদ প্রাণীর গতিশীলতা, প্রাইমেটের উদ্ভব, করোটি সংস্থান ও ব্যবহারিক অঙ্গব্যবচ্ছেদ বিদ্যা।
[বিশেষ দ্রষ্টব্য: অধ্যাপক ম্যাট কার্টমিলের ‘Turtles All the way Down: The Atlas of Creation’ শিরোনামের লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় আমেরিকার ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্স এডুকেশন সংস্থার ‘Reports of the National Center for Science Education’ দ্বিমাসিক পত্রিকা মার্চ-এপ্রিল, ২০১১ সংখ্যায়। অধ্যাপক ম্যাট কার্টমিল এবং পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক ইউজিন স্কট উভয়ে এই নিবন্ধ বাংলায় অনুবাদের সবিশেষ অনুমতি প্রদান করেছেন। তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অনুবাদটি বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার ছোটকাগজ যুক্তি (চতুর্থ সংখ্যা, জুলাই ২০১৩)-তে প্রথম প্রকাশিত হয়– অ.বি.দা.]
তথ্যবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির প্রাঞ্জল অনুবাদের জন্য ধন্যবাদ 🙂
একটা সময় ছিল যখন একটু টাকা জমলেই হারুন ইয়াহিয়ার ডকুমেন্টরী সিডি গুলো কিনতাম। এখনো আছে বেশ কয়েকটা; এখন আর ফিরেও তাকাই না সিডি গুলোর দিকে। ব্রেন ওয়াস দেয়ার জন্য তখন মস্তিষ্ক ছিল উর্বর; গোগ্রাসে গিলতাম। দিন বদলেছে। এখন তুলনার জন্য অনেক বই পত্র আছে; কিন্তু তখন হারুন ইয়াহিয়া আর জাকির নায়েক ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পেতাম না 😛 তাই যা দেখতাম তাই বিশ্বাস করতাম; কারন এত সুন্দর ভাবে এত মিষ্টি ভাষায় আর এত দৃঢ়টার সাথে তারা লেকচার বা ডকুমেন্টরী গুলো বানাতো যে অবিশ্বাস করতে বা তারা যে মিথ্যাচার করছে সেই চিন্তাই মাথায় আনতে পারতাম না।
টেকনিক্যাল ওয়েতে মিথ্যাচারের জন্য দক্ষতায় হারুন ইয়াহিয়ার চাইতে মাস্টার আর কেউ নেই 🙂
লেখাটি ভালো লাগলো (Y)