[পর্ব-১]

সন্ধ্যাবেলা রিচার্ড গেল আরলিনদের বাড়িতে। ১৫৪ ওয়েস্ট মিনিস্টার এভেনিউ – তাদের নতুন বাড়ি। রিচার্ড আগে কখনো যায় নি সেদিকে। অন্ধকার হয়ে গেছে, অথচ পোর্টিকোর বাতিটি জ্বালানো হয়নি তখনো। বাড়ির নম্বর দেখা যাচ্ছিল না। রিচার্ড বুঝতে পারছিল না ঠিক জায়গায় এসেছে কিনা। শেষে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে নিচু দেয়ালে লাগানো নম্বরগুলো হাত দিয়ে দেখল। না, ঠিক আছে ১৫৪।

ফিলোসফি নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিল আরলিন। ভীষণ সমস্যায় পড়েছে সে। রিচার্ডকে দেখে খুশি বা বিরক্ত কোন্‌টা হয়েছে ঠিক বোঝা গেলো না। বললো – “আমরা এখন দেকার্তে পড়ছি। যেখানে ‘আমি হলাম’ ‘আমি ভাবলাম’ ইত্যাদি দিয়ে শুরু হয়েছে, কিন্তু শেষ হয়েছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে। এই দেকার্তের ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই।”
“অসম্ভব” – বলল রিচার্ড। মহান দেকার্তের কথাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার যোগ্যতা সে রাখে কিনা বিবেচনা না করেই বলে ফেলল, “অসম্ভব, এরকম ধারণা ভুল।”

আসলে এরকম প্রতিক্রিয়া দেখানোটা রিচার্ড পেয়েছে তার বাবার কাছ থেকে। রিচার্ডের বাবা ‘কে বললেন’ তার ধার ধারতেন না। তিনি ‘কী বললেন’ তাকে গুরুত্ব দিতেন সবসময়। তিনি বলতেন “কী বলা হয়েছে তা দেখো। নিজের সাথে কথা বল। যদি যুক্তিসংগত হয় মেনে নাও। না হলে যুক্তি দাও, প্রতিবাদ করো।

রিচার্ড বললো, “তুমি কীভাবে একটা জিনিস দিয়ে শুরু করে ভিন্ন আরেকটা প্রসঙ্গ প্রমাণ করবে?”
আরলিন বললো, “জানি না, আমি কিসসু জানি না।”
তার চোখমুখ লাল। রিচার্ড বুঝতে পারল বেচারি অনেকক্ষণ থেকে খাটছে এই খটমটে দর্শন নিয়ে। সহানুভূতির সাথে বললো, “আরলিন, দেখি দাও তো পেপারটা আমাকে।”

এরপর তারা ফিলোসফি নিয়ে আলোচনায় মেতে রইল। দেকার্তের পেপারটা পড়ে দেখল রিচার্ড। যুক্তি যা দেয়া হয়েছে খুব সবল একটাও নয়। বলা হচ্ছে, “আমরা অনেক রকম চিন্তা করতে পারি। চিন্তাগুলো যে ভুল বা শুদ্ধ তা আমরা জানবো কীভাবে, যদি পরম বিশুদ্ধ কোন সত্যি না থাকে? যার সাথে তুলনা করে জানা যাবে কোন্‌টা সঠিক আর কোন্‌টা ভুল? সুতরাং পরম সত্য কোথাও আছে এবং সেই পরম সত্যই তো ঈশ্বর, মহান গড।”
পড়ে আঁৎকে ওঠে রিচার্ড – ওরে বাপরে, কী দার্শনিকতা! এরকম ফিলসফির কোন উত্তর দেয়া সহজ নয়। তবুও সেই বয়সে প্রতিবাদ করা, জোর দিয়ে কথা বলা তার চরিত্রের সাথে মিশে গেছে।

সে বললো, “কিছুতেই নয়। বিজ্ঞানে তুমি পরম সত্য বা অ্যাবসলিউট কিছু না ধরেও বলতে পারো শতকরা কতটুকু গ্রহণযোগ্য বা কত ডিগ্রি পর্যন্ত তা সঠিক। আমার মনে হচ্ছে দেকার্তের ব্যাপারটাকে এতটা সিরিয়াসলি নেবার দরকার নেই।”
আরলিন বুঝতে পারলো। দেকার্তের বিষয়টা আরেকবার চোখ বুলিয়ে সে দেখলো বা বুঝলো যে রিচার্ডের কথাটাই গ্রহণযোগ্য। বললো, “টিচার বলেছেন প্রত্যেক প্রশ্নেরই দুটো দিক আছে। যেমন প্রত্যেকটি কাগজেরই আছে দুটো পিঠ।”
“এ কথাটিরও দুটো দিক আছে।”
“মানে?”
“কোন কোন কাগজের দুটো পিঠ নাও থাকতে পারে।”

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে মোবিয়াস স্ট্রিপ সম্পর্কে জেনেছিল রিচার্ড। সে একটুকরো কাগজ নিয়ে দুপ্রান্তে আঁঠা লাগিয়ে একটা লুপ তৈরি করে আরলিনের হাতে দিয়ে বলল, “যেমন এই কাগজটা।”

পরদিন আরলিন তার ফিলোসফির ক্লাসে বেশ মজা পেলো। স্যারকে সে বললো, “প্রত্যেকটা প্রশ্নেরই দুটো দিক আছে, দু’রকম অর্থ হয়। যেমন একটা কাগজের দুটো পিঠ আছে। আবার এ কথাটিরও দুটো অর্থ হতে পারে। একটা কাগজের দুটো পিঠ নাও থাকতে পারে” – বলে সে মোবিয়াস স্ট্রিপ বানিয়ে দেখালো স্যারকে। ফিলোসফি ক্লাসের রানি হয়ে গেল আরলিন।

রিচার্ডের দেয়া ধারণা কাজে লাগিয়ে আরলিনের এই প্রাপ্তিতে আরেকটু মনযোগ দিল সে রিচার্ডের প্রতি। কিন্তু তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না রিচার্ড। জেরোমের পরে তার আরেকজন প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ঘটলো। হ্যারোল্ড গ্যাস্ট – রিচার্ডেরই খুব ভাল বন্ধু। আরলিন একবার রিচার্ডের দিকে ঝোঁকে তো পরমুহূর্তে হ্যারোল্ডের দিকে ঝুঁকতে থাকে। আরলিন আসলে মনস্থির করতে পারছিলো না।

এরমধ্যে রিচার্ডদের স্কুলের গ্র্যাজুয়েশান এসে গেলো। আরলিন সমাবর্তনে গেলো হ্যারোল্ডের সাথে। কিন্তু গিয়ে বসলো রিচার্ডের মা-বাবার পাশে।
রিচার্ড পদার্থবিজ্ঞান, গণিত আর রসায়নে সেরা ছাত্রের পুরষ্কার নিতে বার বার স্টেজে যাচ্ছিল। হ্যারোল্ডও কম নয়। সে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসে সেরা ছাত্র। স্কুলের বার্ষিক নাটক লিখেছে সে। সেও স্টেজে যাচ্ছিলো বার বার পুরষ্কার নিতে।

ইংরেজি সাহিত্যে রিচার্ড ছিল মারাত্মক রকমের খারাপ ছাত্র। এই বিষয়টাকে সে সহ্যই করতে পারত না। বানান ভুল করলে নম্বর কাটা যেত। সেটা নিয়ে তার মেজাজ যেতো চড়ে। এমন বিরক্তি লাগতো তার – “আরে বাপু, কীরকম বানানে আমি শব্দটা লিখলাম তাতে কী এসে যায়? একটা এ বেশি দিলে বা এ’র জায়গায় ই দিলে প্রাকৃতিক কোন নিয়ম বদলে যাচ্ছে? ভাষাটাতো মানুষের সৃষ্টি, কতকগুলো চিহ্ন। এখন তুমি চিহ্নের মাধ্যমে জিনিসটা বুঝতে পারলেই হল। তুমি ইচ্ছে করলে যে কোন ভাবে তোমার পছন্দমত চিহ্ন দিয়েও তো বানানটা লিখতে পারো।”

কিন্তু না, তার কথা কে শোনে। ইংরেজিটার ওপর তাই তার ভীষণ রাগ, সে জন্যই হয়তো সে ভীষণ খারাপ নম্বর পেতো এই বিষয়ে।

তখন নিউইয়র্ক স্টেট গভর্নমেন্ট অব এডুকেশন প্রত্যেক হাইস্কুলে কিছু পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করেছিল। পরীক্ষাগুলোর নাম ছিল রিজেন্টস। এই পরীক্ষাগুলো ছিল একটু উচ্চমার্গের। যেমন ইংরেজি সাহিত্যের কোন বইয়ের সমালোচনা লিখতে হলো, আবার রচনাও লিখতে হলো।
ক’মাস আগে রিচার্ড যখন পরীক্ষা দিচ্ছিল, তার বন্ধু হ্যারোল্ড আর ডেভিড জিজ্ঞেস করল – “বুক রিভিউর জন্য কোন্‌ বই বাছাই করেছিস?”
হ্যারোল্ডের মত ডেভিডও ঝানু ছাত্র, স্কুলের পত্রিকার এডিটর সে। রিচার্ড তাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো, “তোরা কোন বই ঠিক করেছিস?”

ডেভিড বাছাই করেছে সিনক্লেয়ার লিউজ এর ‘সোশাল ইমপ্লিকেশান্স’ নামক খটমটে এক বই। আর হ্যারোল্ড বাছাই করেছে এবস্ট্রাক্ট নাটকের কোন একটা বই। রিচার্ড যখন বললো যে সে লিখবে ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ নিয়ে তারা হাসতে শুরু করলো।
বন্ধুরা হাসলেও কিছু করার নেই রিচার্ডের। কারণ লিখতে গেলে তো পড়তে হয়। রিচার্ড তো সাহিত্যের বই কিছুই পড়েনি। ট্রেজার আইল্যান্ডটা ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে হয়েছে বলেই পড়েছে।

হ্যারোল্ড আর ডেভিড হাসতে হাসতে বললো, “এরকম একটা শিশুতোষ বই সম্পর্কে লিখলে গোল্লা পাবি তুই।”
রিজেন্টস পরীক্ষার জন্য রচনা লিখতে হতো। রচনা লিখতে গিয়ে রিচার্ড বেছে নিল ‘দি ইম্পর্ট্যান্স অব সায়েন্স ইন এভিয়েশান’। সে জানত তার বন্ধুরা সব জটিল বস্তু নিয়ে জটিল বাক্যে রচনা লিখবে। কিন্তু রিচার্ড তো সায়েন্স ছাড়া আর কিছুই তেমন লিখতে পারে না।

খুব সাধারণ ইংরেজিতেই রচনা লিখতে শুরু করেছিল রিচার্ড। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো হ্যারোল্ড বা ডেভিডরা এত চোস্ত ইংরেজি লেখে যে তাদের ভারী ভারী খটমটে ইংরেজিতে দাঁত ভেঙে যাবার অবস্থা হয় তাদের লেখা পড়তে।

সেও তো চেষ্টা করতে পারে। “এমনিতেই তো এই বিষয়ে আমি পাবো গোল্লা। সুতরাং চেষ্টা করতে দোষ কী। চেষ্টা ঠিক নয়, একটা খেলা খেলে দেখা যেতে পারে।”

যেই ভাবা সেই কাজ। রিচার্ড লিখলো – “Aeronautical science is important in the analysis of the eddies, vortices, and whirlpools formed in the atmosphere behind the aircraft…”

রিচার্ড জানতো যে eddies, vortices, whirlpools সবগুলো একই জিনিস, শুধুমাত্র তিন নামে ডাকা। শুনতে গালভারী শোনায়। তো রচনাটা এরকম মোটা মোটা ভারী ভারী শব্দের বহুল প্রয়োগে ভরিয়ে দিল রিচার্ড।
রিচার্ডের রচনাটি যিনি পরীক্ষা করেছিলেন তিনি তার শব্দচয়নে এতটাই মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন যে রিচার্ড একশ’র মধ্যে ৯১ পেয়ে গেল। তার জটিল কাব্যিক বন্ধুরা পেয়েছিল ৮৮।

সে বছর থেকে স্টেট গভর্নমেন্ট নিয়ম করেছিলো রিজেন্টসের কোন বিষয়ে যদি কেউ শতকরা ৯০ বা তার বেশি নম্বর পায় তাহলে তাকে ঐ বিষয়ের বেস্ট স্টুডেন্ট পুরষ্কার দেয়া হবে। সুতরাং নাট্যকার আর স্কুলের পত্রিকার এডিটর সাহেব চেয়ারে বসে থাকলো আর পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র রিচার্ডকেই ডাকা হলো পুরষ্কার নিতে – ইংরেজিতে বেস্ট স্টুডেন্ট।

এতগুলো পুরষ্কার প্রাপ্তিতে আরলিন রিচার্ডের দিকে আরো মনযোগী হলো। যাই হোক – রিচার্ডের বাবা-মা আর হ্যারোল্ডের বাবা-মা বসেছিলেন একসাথে। এসময় রিচার্ডের গণিত বিভাগের প্রধান উপস্থিত হলেন। এই স্যারটি রাশভারী। লম্বা, শক্ত চোয়াল, যাকে বলে পেটানো শরীরের মানুষ।
হ্যারোল্ডের মা তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে বললেন, “হ্যালো ডক্টর অক্‌সব্যারি, আমি হ্যারোল্ডের মা, আর ইনি ফাইনম্যানের মা।”

ডক্টর অগ্‌সব্যারি হ্যারোল্ডের মাকে কোন পাত্তাই দিলেন না। সরাসরি রিচার্ডের মায়ের কাছে এসে বললেন, “মিসেস ফাইনম্যান, আমি আপনাকে জানাতে এসেছি যে আপনার ছেলের মত প্রতিভাবান ছেলে খুব সহজে পাওয়া যায় না। এরকম ছেলেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করা দরকার। আপনারা তাকে অবশ্যই ইউনিভার্সিটিতে পড়াবেন। দেশের সেরা ইউনিভার্সিটিতে।”

রিচার্ডের অংকের স্যার হয়তো ভেবেছিলেন যে তার বাবা-মা হয়তো তাকে বেশিদূর পড়াবেন না। কারণ ওইসময় অসংখ্য ছেলেমেয়ে স্কুলের পরপরই চাকরিতে যোগ দিতো। পরিবারের দায়-দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে হতো তাদের। রিচার্ডের বন্ধু রবার্টও পড়তে পারেনি ইউনিভার্সিটিতে। অথচ সে খুব ভাল ছাত্র ছিল, তার বাড়িতে একটা ল্যাবরেটরিও ছিল।

যাই হোক, রিচার্ডের মা ডক্টর অগ্‌সব্যারিকে নিশ্চয়তা দিলেন, “আমরা আমদের সাধ্যমত চেষ্টা করছি তার জন্য। আমরা তাকে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে অথবা এম-আই-টিতে পাঠাবো।”

আরলিন সব কথাবার্তা শুনছিলো। রিচার্ডের ভবিষ্যত অনেক উজ্জ্বল দেখতে পেলো সে। আর রিচার্ডও দেখতে পাচ্ছিল আরলিনের মনের আয়নায় নিজের মুখ।

আরলিন রিচার্ডের চেয়ে বয়সে ছয় মাসের বড়। ন্যাসাউ কাউন্টি লরেন্স হাইস্কুলের স্কুল পত্রিকার এডিটর আরলিন। চমৎকার পিয়ানো বাজায় আর ভীষণ শৈল্পিক তার কাজকর্ম।

রিচার্ড আর আরলিনের মেলামেশা বেড়ে গেল। তাদের বাবা-মাও জেনে গেল তাদের সম্পর্কের কথা।
আরলিনের পরিবারটা ছিল খুবই ভদ্র। তারা সবাই অন্যের অনুভূতির ব্যাপারে ভীষণ সচেতন। আরলিনও তাই। সে রিচার্ডকে বোঝাতে শুরু করলো, “মানুষের মুখের ওপর দুমদাম কথা বলা তোমার উচিত নয়। লোকে কষ্ট পায় না? অন্যের দিকটাও তো তোমার ভাবা উচিত।”
আরলিনের মতে অনেক সময় অপ্রিয় সত্য কথা বলার চেয়ে নির্দোষ মিথ্যা অনেক ভালো।

কিন্তু রিচার্ডের দর্শন ছিলো অন্যরকম। সে ভাবত what do you care what other people think? লোকের কথায় তোমার কী আসে যায়?
আরলিনকে বললো, “অন্যের মতামত শোনার দরকার অবশ্যই আছে এবং সে মতামত বিবেচনা করার দরকারও আছে। কিন্তু যদি দেখো ঐ মতামত যুক্তিহীন, তখন তা বর্জন করাই উত্তম কাজ।”

আরলিন রিচার্ডের কথাটাকে গুরুত্বের সাথে মেনে নিলো। মনে হলো তার দর্শনও কিছুটা রিচার্ডের প্রভাবে প্রভাবিত হতে শুরু করেছে।
পরস্পরকে সব কথা খোলাখুলি বলতে শুরু করল রিচার্ড ও আরলিন। তাদের আশাগুলো, ভাবনাগুলো, হতাশাগুলো, স্বপ্নগুলো পরস্পর শেয়ার করতে শুরু করলো কোনরকম রাখঢাক না করেই। পরস্পরের কাছে তারা প্রথমেই অকপট হয়ে গেল। দেখলো তাদের ভালোবাসাও অকপট। এরকম পরম ভালোবাসার কোন তুলনা হয় না।

কোটার কারণে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারল না রিচার্ড ফাইনম্যান। ইহুদিদের জন্য কোন সিট খালি ছিল না। যেতে হলো ম্যাচাচুসেট্‌স-এ এম-আই-টিতে।

১৭ বছর বয়সে ১৯৩৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হলো ফাইনম্যানের। আরলিনের কাছ থেকে অনেক দূরে। বন্ধুদের কাছ থেকে চিঠি পেতে শুরু করল ফাইনম্যান। যাদের সাথে সে তেমন ঘনিষ্ঠ নয় তারাও চিঠি লিখে জানাতে লাগলো যে আরলিনকে এর-ওর সাথে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে, হ্যারোল্ডের সাথে ঘুরছে আরলিন ইত্যাদি ইত্যাদি।

বস্টনে এম-আই-টিতে ফাইনম্যানও মেলামেশা করছে অনেক মেয়ের সাথে, এখানে ওখানে বেড়াতেও গেছে অনেকের সাথে। সেসব যেমন আলাদা কোন গুরুত্ব বহন করে না, তেমনি আরলিনের ব্যাপারেও বিচলিত হবার কিছু নেই। কারণ ফাইনম্যান জানে আরলিন ও তার মধ্যে লুকোচুরির কোন ব্যাপার নেই, থাকতে পারে না।

সামারের ছুটিতে বাড়িতে আসে ফাইনম্যান, সময় কাটায় আরলিনের সাথে। রোমঞ্চকর দিনগুলো কেটে যায় বড় দ্রুত।
১৯৩৯ সালের জুন মাসে এম-আই-টি থেকে গ্র্যাজুয়েশান শেষ হলো ফাইনম্যানের। একটা পার্ট-টাইম কাজও জুটে গেল তার – ক্রাইসলার কোম্পানিতে।

সেই সামারে আরলিনও একটা বেবি সিটিং-এর কাজ নিয়ে চলে এলো কেমব্রিজ থেকে মাত্র বিশ মাইল দূরে। ইচ্ছে করলেই এখন দেখা হতে পারে আরলিন আর ফাইনম্যানের।

কিন্তু ফাইনম্যানের বাবা এসময় বারবার হুসিয়ারি দিতে শুরু করলেন। তিনি ভেবেছিলেন রিচার্ড যদি আরলিনের সাথে বেশি মেলামেশা করে তবে পড়ালেখার বারোটা বাজবে। তখনকার দিনে লেখাপড়াটা যা করার বিয়ের আগে করে নেয়াই ছিলো রেওয়াজ।

ছয় বছরের পরিচয়ে এবং ভালোবাসায় খুব সামান্য সময়ই কাছাকাছি ছিল আরলিন ও ফাইনম্যান। তাই তারা ঠিক করেছিল এম-আই-টি থেকে গ্র্যাজুয়েশানের পরপরই বিয়ে করবে।

কিন্তু গ্র্যাজুয়েশানের পরে পিএইচডি করার জন্য হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে বেশ ভাল স্কলারশিপ পাবার পরেও নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো ফাইনম্যান। কারণ আলবার্ট আইনস্টাইন তখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে।

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ইউজিন উইগনারের গবেষণা সহকারী হবার সুযোগ পেয়েছিল ফাইনম্যান। কিন্তু সে যোগ দেয় প্রিন্সটনে সদ্য যোগ দেয়া তরুণ প্রফেসর জন উইলারের গ্রুপে। ‘থিওরি অব লিস্ট অ্যাকশান’ নিয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা শুরু হয় ফাইনম্যানের।

প্রিন্সটন থেকে প্রায়ই বাড়িতে গিয়ে আরলিনের সাথে সময় কাটিয়ে আসতো ফাইনম্যান।
একবার ছুটিতে গিয়ে দেখলো আরলিনের ঘাড়ের একপাশে ছোট্ট একটা আঁচিলের মত হয়েছে। সে অত্যন্ত সুন্দরী মেয়ে। তাই খুব ঘাবড়ে গেছে এতে তার সৌন্দর্যহানি ঘটছে কিনা ভেবে।
কিন্তু ফাইনম্যান খুব একটা পাত্তা দিল না এটাকে। সুতরাং আরলিনও ভাবলো এটা সিরিয়াস কিছু নয়। আরলিন তার ডাক্তারকাকাকে দেখালো ওটা। কাকা বললেন ওমেগা তেল মালিশ করতে।

কিছুদিন পর আঁচিলটি বড় হতে শুরু করলো। আর আরলিনের হতে লাগলো জ্বর, ভয়ানক জ্বর। দিনের পর দিন অবস্থা খারাপ থেকে খারাপ হতে লাগলো। আরলিনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার বললো – টাইফয়েড।

ফাইনম্যান লাইব্রেরি থেকে মেডিকেলের বই নিয়ে এসে টাইফয়েড সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করে দিল। টাইফয়েড সম্পর্কে যত তথ্য বইতে পাওয়া যায় সব জেনে আরলিনকে হাসপাতালে দেখতে গেল ফাইনম্যান।
আরলিনকে রাখা হয়েছে আলাদা কেবিনে। কেবিনে ঢুকার সময় বিশেষ গাউন পরে ঢুকতে হলো। ডাক্তার ছিলেন সেখানে। ফাইনম্যান ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো – “ওয়াডেল টেস্ট এর রেজাল্ট কী?”

বই পড়ে ফাইমন্যান মোটামুটি কিছু বিষয় জেনেছে টাইফয়েড সম্পর্কে। টাইফয়েড এর ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষা করার জন্য ওয়াডেল টেস্ট করানো জরুরি। ডাক্তার উত্তর দিলেন – “নেগেটিভ।”
“নেগেটিভ? কেমন পরীক্ষা করলেন যে আপনারা জীবাণু খুঁজে পেলেন না। তাহলে এভাবে গাউন টাউন পরে এখানে ঢোকা কেন? নিশ্চয়ই আরলিনের টাইফয়েড হয়নি।”
ফাইনম্যানের এরকম চিৎকার চেঁচামেচিতে ডাক্তারের প্রতিক্রিয়া হলো মারাত্মক। তিনি আরলিনের বাবা-মা’র কাছে অভিযোগ করলেন ফাইনম্যানের বিরুদ্ধে।
আরলিনের বাবা ফাইনম্যানকে বললেন শান্ত হতে। অনুরোধ করলেন যেন ডাক্তারের কাজে বাধা না দেয়। “যাই হোক তিনি তো ডাক্তার। তিনি তোমার চেয়ে ভাল বুঝবেন।”

ফাইনম্যান বুঝতে পারছিলো এই ডাক্তাররা নিজেরাও পরিষ্কার জানেন না তাঁরা কী করছেন বা রোগীকে নিয়ে কী করতে যাচ্ছেন। অথচ কেউ কোন সৎ পরামর্শ দিলে নিজেদের অপমানিত ভাবছেন।

ফাইনম্যানের মনে হচ্ছে আরলিনের বাবা-মাকে তার তখুনি বলা উচিত ছিল যে ডাক্তারটা একটা ইডিয়ট। ডাক্তারটি জানেন না তিনি কী করছেন। কিন্তু তা বলা হয়নি। আরলিনের বাবা-মা’র সিদ্ধান্তই তখন গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত।

এর কিছুদিন পর আরলিন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠল। জ্বর নেমে গেল, আঁচিলটাও মনে হল একটু ছোট হয়েছে আগের চেয়ে।
কিন্তু না, কয়েক সপ্তাহ পরেই আঁচিলটা দ্রুত বড় হয়ে টিউমারের রূপ নিতে শুরু করলো। দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো আরলিনকে। আরলিনের বগলের নিচে ও তলপেটে আরো কয়েকটা টিউমারের সন্ধান পাওয়া গেল। ওগুলো শরীরের ভেতরে বেশ বড় হয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে চামড়ার ওপরে।

ডাক্তার বললেন আরলিনের লিম্ফেটিক গ্ল্যান্ডের সমস্যায় এসব হচ্ছে। তিনি সঠিক রোগের নাম বলতে পারলেন না। বললেন, “অন্য ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করতে হবে।”
খবর পেয়ে ফাইনম্যান ছুটে গেল প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে। লিম্ফেটিক ডিজিজ নিয়ে লেখাপড়া শুরু করে দিল। মেডিকেলের বইগুলোতে লিম্ফেটিক গ্ল্যান্ডের স্ফীতি সম্পর্কে লেখা আছে: Tuberculosis of the lymphatic glands – this is very easy to diagnose —

ফাইনম্যান ভাবলো আরলিনের নিশ্চয় এটা হয়নি। এটা হলে ডাক্তাররা নিশ্চয় সহজে ধরে ফেলতে পারতেন।
আরো পড়তে লাগল ফাইনম্যান – lymphodenema, lymphodenoma, Hodgkin’s disease এরকম আরো যত অসুখ আছে। এগুলো সব বিভিন্ন ধরণের মারাত্মক ক্যান্সার।

খুব মনযোগ দিয়ে পড়ার পরে lymphodenema আর lymphodenoma’র মধ্যে যে পার্থক্য খুঁজে পেল তা হলো – যদি রোগী মারা যায় lymphodenoma আর রোগী যদি অন্তঃত কিছুদিন বেঁচে থাকে তাহলো lymphodenema।
দিনরাত খেটে যেভাবেই হোক লিম্ফেটিক ডিজিজ সম্পর্কে যত তথ্য পাওয়া যায় সব পড়ে ফেলল ফাইনম্যান এবং বুঝতে পারল আরলিনের যে অসুখটি হয়েছে তা সারবার নয়।

বার বার পড়েও এ ছাড়া আর কোন সম্ভাবনা খুঁজে পেল না সে। ফাইনম্যানের মনে হলো তার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু নিজের মনের এ অবস্থাতেও তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের জগতে তেমন কোন পরিবর্তন হলো না। ক্লাস সেমিনার ছাড়াও প্রিন্সটনের সাপ্তাহিক চা-চক্রেও যোগ দিচ্ছিল সে। এমন কি পামার হল-এ গণিতবিদ বন্ধুদের সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তর্ক করছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
অথচ আরলিন আর বাঁচবে না এই তথ্যটি তাকে অসাড় করে দেয়ার কথা। দেখা গেলো খুব অদ্ভুত স্বভাব ফাইনম্যানের। যেন একই শরীরে সম্পূর্ণ দু’রকম মন নিয়ে একসাথে চলছে সে।

আরলিনকে দেখতে গিয়ে মন হালকা করার জন্য রসিকতা করে আরলিনকে বললো, “মেডিকেলের বইগুলো পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল যে কারোরই এমন রোগ হতে পারে। যে রোগের ওষুধ কেউ জানে না।”
তারপর হাঃ হাঃ করে হাসতে লাগলো। হাসি থামার পর তার মনে হলো কোন দরকার ছিল না হাসার। বুঝতে পারছিল নিজের অস্থিরতা।

আরলিনকে বললো, “দেখো আরলিন, আমরা খুবই সংকটে আছি এখন। তোমার জীবন সংকট। অসুখটা সহজে সারবার নয়।”
এরপর সদ্যশেখা লিম্ফেটিক ডিজিজগুলোর বর্ণনা দিতে শুরু করল আরলিনকে। হড্‌জকিন্স ডিজিজ সম্পর্কেও বলল সে।
পরের সপ্তাহে আরলিনকে যখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল, আরলিন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, আমার কি হড্‌জকিন্স ডিজিজ হয়েছে?”

ডাক্তার কপালে ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন তার দিকে। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, “হতে পারে, আমরা এখনো নিশ্চিত নই।”
আরলিন যখন পরের বার হাসপাতালে গেল তার কাগজপত্র দেখে ডাক্তাররা লিখলেন “হড্‌জকিন্স ডিজিজ।” ফাইনম্যান বুঝতে পারছিল যে ডাক্তাররা হাতড়ে হাতড়ে চিকিৎসা করছে। এই মুহূর্তে লিম্ফেটিক ডিজিজ সম্পর্কে ফাইনম্যান নিজেই ডাক্তারদের চেয়ে বেশি জানে।
যাই হোক, এরপর এক্সরে থেকে শুরু করে হড্‌জকিন্স ডিজিজে যে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয় আরলিনের সব করা হলো। হাসপাতালে মেডিকেল বোর্ড বসলো। ফাইনম্যান অপেক্ষা করছিল বোর্ডের বাইরে।

ডাক্তারদের মিটিং শেষে একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে আরলিনকে নিয়ে এলো একজন নার্স। ফাইনম্যান গিয়ে নার্সের হাত থেকে আরলিনের হুইল চেয়ার নিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছিল। হঠাৎ দেখল বেঁটে মতন এক লোক মিটিং রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে সোজা তাদের কাছে চলে এলেন।
হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার কাশির সাথে বা থুতুর সাথে কি কখনো রক্ত বেরিয়েছিল?”
এসব শুনে নার্সটি ভীষণ ক্ষেপে গেলো। লোকটিকে বললো, “এই মুহূর্তে চলে যান এখান থেকে। কেমন মানুষ আপনি? এসব কী প্রশ্ন করছেন?” বলে একপ্রকার জোর করে ঠেলে নিয়ে গেল লোকটিকে।
মিটিংরুম পর্যন্ত গিয়ে নার্সটি ফিরে এলো তাদের কাছে। বলল, “লোকটি ডাক্তার। মিটিং-এ এসেছিলেন। ডাক্তার হিসেবে খুবই ভাল, কিন্তু সবসময়ই কোন না কোন সমস্যা সৃষ্টি করেন। রোগীকে এসব জিজ্ঞেস করে কেউ?”

ফাইনম্যান বুঝতে পারছিল ডাক্তারটি কিছু একটা সম্ভাবনা খুঁজছেন। শেষ পর্যন্ত মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত জানানো হলো। রুমের ভেতর ফাইনম্যানকে ডেকে নিয়ে জানানো হলো – আরলিনের অসুখটা খুব সম্ভবত হড্‌জকিন্স ডিজিজ।
ডাক্তার বললেন, “এই অসুখটা মাঝে মাঝে খুব বাড়বে। তখন হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। কিছুদিন পরে অবস্থা একটু ভাল হবে। কিন্তু কখনোই একেবারে সেরে যাবে না। কয়েক বছর পর রোগী মারা যাবে।”

একটুও অবাক হল না ফাইনম্যান। কারণ হড্‌জকিন্স ডিজিজ সম্পর্কে ডাক্তার যা যা বললেন তার সবই সে জানে। সে বললো, ” এটা শুনতে খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি আরলিনকে বলবো আপনি যা যা বললেন।”
“না, কক্ষণো না।” ডাক্তার ফাইনম্যানের হাত চেপে ধরলেন।
“প্লিজ, তাকে এসব কিছুই বলবেন না। আমরা তাকে হতাশ করতে চাই না। আমরা তাকে বলবো রোগটা হলো গ্ল্যান্ডুলার ফিভার। গ্ল্যান্ডের গন্ডগোল। ততোটা ঘাবড়াবার মত কিছু নয়।”
“না, এটার দরকার হবে না। আমরা ইতোমধ্যেই আলোচনা করেছি। হড্‌জকিন্স ডিজিজের সম্ভাবনার কথা আমরা জানি। আমি তাকে বিস্তারিত বলেছি। সে মেনে নিতে পারবে।”
“কিন্তু তার মা-বাবা চাচ্ছেন না যে আরলিন কিছু জানুক। এখন আপনি যদি জানাতে চান তাহলে আরলিনের বাবা-মা’র সাথে আগে কথা বলুন।”
বাড়িতে সবাই ফাইনম্যানকে নিয়ে পড়লো। তার বাবা-মা, পারিবারিক ডাক্তার, তার দুই মাসী তাকে বোঝাতে লাগলেন, “কেমন ছেলে তুমি? বুঝতে পারছো না? আরলিনের মত এত চমৎকার একটা মেয়ে যখন জানতে পারবে যে সে আর বাঁচবে না, তখন তার কী প্রতিক্রিয়া হবে ভেবে দেখেছো? তুমি কীভাবে বলবে যে আরলিন তুমি আর বাঁচবে না?”

ফাইনম্যান খুব ধীরে পরিষ্কারভাবে বলল, “আমাকে বলতেই হবে। আমরা কখনোই কেউ কাউকে মিথ্যে বলিনা। কোন কিছু গোপনও করি না কেউ কারো কাছ থেকে। শুধু শুধু কথা ঘোরানোর কোন মানে হয় না। সে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করবে আমাকে তার কী হয়েছে। আমি তখন তাকে মিথ্যে বলতে পারব না।”
“ওসব ছেলেমানুষী কাজকারবার। আর এখন তো জীবন মরণের প্রশ্ন। কেন বুঝতে পারছো না তুমি?”
“তুমি বুঝতে পারছো না, তুমি ভুল করছো” – এরকম দীর্ঘক্ষণ তার কানের কাছে মন্ত্রের মত জপ করতে লাগলো সবাই।

কিন্তু ফাইনম্যান জানে সে ভুল করছে না। সে আরলিনকে ইতোমধ্যেই যথেষ্ঠ সম্ভাবনার কথা বলেছে। তার ধারণা আরলিন মানসিকভাবে প্রস্তুত আছে যে কোন বিষয় মেনে নেয়ার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফাইনম্যানকে হার মানতে হলো তার ছোটবোন জোয়ানের কাছে।
জোয়ানের বয়স তখন মাত্র এগারো কি বারো বছর। সে কাঁদতে কাঁদতে ফাইনম্যানকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, “আরলিন এত চমৎকার একটি মেয়ে। আর তুমি কিনা বলতে যাচ্ছো যে সে মরে যাবে। এত নিষ্ঠুর তুমি?”

ফাইনম্যান জোয়ানের কান্না সহ্য করতে পারলো না।
আরলিনের কাছে একটা চিঠি লিখল ফাইনম্যান। চিঠিতে সবকিছু খুলে লিখলো। সে যে তাকে মিথ্যা বলতে বাধ্য হচ্ছে তাও। যদি আরলিন কখনো সত্যি কথাটা জানতে পারে তখন তাকে দেখাবে এই চিঠি। চিঠিটা ভাঁজ করে তার ওয়ালেটে রেখে দিলো যেন সবসময় তার সাথে থাকে।
মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আরলিনকে হাসপাতালে দেখতে গেল ফাইনম্যান। আরলিন বিছানায় বসে আছে মন খারাপ করে। তার বাবা-মাও আছেন সেখানে।

ফাইনম্যানকে দেখার সাথে সাথে আরলিনের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আরলিন বললো, “এবার আমি বুঝতে পারছি রিচার্ড, আমরা যে একজন আরেকজনের কাছে মিথ্যা কথা বলি না তার মূল্য কতখানি।”
তার মা-বাবার দিকে একটু তাকিয়ে আরলিন আবার বললো, “এরা আমাকে বলছে আমার নাকি হয়েছে গ্ল্যান্ডুলার ফিভার। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তাদের কথা বিশ্বাস করবো কিনা। রিচার্ড, এবার তুমি বলো আমাকে, আমার কী হয়েছে? গ্ল্যান্ডুলার ফিভার নাকি হড্‌জকিন্স ডিজিজ?”
ফাইনম্যান বললো, “গ্ল্যান্ডুলার ফিভার।”

বলতে গিয়ে মনে হলো তার ভেতরটা মরে গেছে ততক্ষণে। অসহ্য লাগছে তার। অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা। এরকম মানসিক কষ্ট সে আগে কখনো পায়নি। এমনকি আরলিন আর বাঁচবে না জানার পরেও যতটা না কষ্ট পেয়েছে – তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেলো আরলিনকে মিথ্যে বলার পর।
আরলিনের প্রতিক্রিয়া ছিলো অবিশ্বাস্য রকম শান্ত। খুবই সহজ গলায় বললো, “ও, ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম।” তারা পরস্পরের প্রতি এত বেশি বিশ্বস্ত ছিল যে আরলিন সত্যিই বিশ্বাস করলো তার হড্‌জকিন্স ডিজিজ হয়নি। আরলিনের বাবা-মাও ফাইনম্যানের কথায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। মনে হলো সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

কয়েক দিনের ভেতর আরলিন কিছুটা সুস্থবোধ করলো এবং হাসপাতাল ছেড়ে বাড়িতে চলে গেলো।

সপ্তাহখানেক পরে আরলিন ফোন করলো ফাইনম্যানকে, “রিচার্ড, আমি তোমার সাথে সামনা-সামনি কথা বলতে চাই। তুমি এক্ষুণি বাসায় চলে এসো।”

পর্ব-৩