প্রথম পর্ব এখানে

জিন্নাহর অখন্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন আজ রক্তস্নাত

 

২৭ মার্চ, ১৯৭১
দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ

কেনেথ ক্লার্ক
করাচী থেকে ফিরে…

পাকিস্তানের পূর্বাংশের রাজধানী ঢাকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে; অখন্ড পাকিস্তানের শেষ আশার প্রদীপ নিভে গেছে।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর দ্বিজাতি ত্বত্তের ভিত্তিতে শুধুমাত্র ধর্মের মেলবন্ধনের উপর নির্ভর করে ভৌগলিকভাবে বিশাল ভারতকে মাঝখানে রেখে পরস্পর হতে হাজার মাইল দূরে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটো অংশকে একত্রিত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে, ধর্ম ব্যাতীত পাকিস্তানের দু’অংশের মানুষদের কোন কিছুতেই মিল নেই।
পাকিস্তানের পূর্বাংশে সাত কোটি বাঙালীর বসবাস। এই পূর্বাংশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবর রহমান এবং পূর্ণ কেন্দ্রীয় শাসনের পক্ষপাতী পশ্চিমাংশের নেতা ভূট্টোর মাঝে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আশা যখন দেখা যাচ্ছিল, ঠিক তখনই পূর্বাংশে গৃহযুদ্ধ শুরু হলো।

 

উদ্ভুত সংকটের জন্য ভূট্টোকে দায়ী করা হচ্ছে…

সত্তরের ডিসেম্বরে অনুষ্টিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের নেতা ভূট্টোর পিপল’স পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও পূর্বাংশের নেতা শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগ পুরো পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়। কিন্তু ভূট্টো বাঙালীর স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিরোধীতা করায় সংসদ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
গণতান্ত্রিক সরকার কাঠামো গঠনের জন্য মুজিব, ভূট্টো ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার মাঝে আলোচনাকে আরো সময় দেয়ার উদ্দেশ্য এই সপ্তাহের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জাতীয় সংসদের কার্যক্রম স্থগিত করে ইয়াহিয়া বলেন, পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখতে সেনাবাহিনী যেকোন পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
মুজিব-ভূট্টোকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত অচলাবস্থা নিরসনের জন্য এই সপ্তাহের শুরুতে শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া বারো দিন আগে ঢাকায় এসেছিল। পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলগুলোর ও সামরিক সরকারের প্রধানরা এই আলোচনায় যোগ দেয়। ভূট্টোও এই আলোচনায় অংশ নেবার সম্মতি জানিয়েছিল। কিন্তু ভূট্টো, তার দাবি মানা না হলে জাতীয় সংসদ বর্জনের হুমকি দিয়েছিল।
আলোচনাটি পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছিল, ইয়াহিয়া অখন্ড পাকিস্তান রক্ষার্থে পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে সমঝোতা সৃষ্টি করতে পারবেন। এই আশায় পশ্চিম-পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো “বিবাদ মীমাংসিত” শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছিল। কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানী সৈন্য ও পুলিশের সাথে নিপীড়িত বাঙালীর সংঘর্ষ লেগেই আছে। তিন সপ্তাহ আগে, এরকম এক সংঘর্ষে সরকারিভাবে ১৭২ জন বাঙালী নিহত হবার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

 

নিঁচু জাত…

 

পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পশ্চিমাংশের মানুষরা পূর্বাংশের বাঙালীদের নিঁচু জাতের মানুষ ভেবে এসেছে। পদে পদে বাঙালীদের নিষ্পেষণ করেছে। পশ্চিম-পাকিস্তানের নিপীড়ন হতে বাঙালীদের বাঁচাতে শেখ মুজিব পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন।
এখানে সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি হলো, পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য শেখ মুজিব দাবি উত্থাপন করলে, ভূট্টোও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি করে কিন্তু কোন এক অজানা কারণে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে মিল থাকার পরও মুজিব-ভূট্টো শেষ পর্যন্ত একমত হতে পারলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানীদের চোখে বাঙালীরা নিঁচু জাত, এটাই কি অনৈক্যর মূল কারণ?
স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে শেখ মুজিবের আহবানে বাঙালীরা অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন করছিল। অন্যদিকে, পশ্চিম-পাকিস্তানীরা ‘আন্দোলন’ নসাৎ করতে পূর্ব-পাকিস্তানে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে ও কারফিউ জারি করে জনজীবন অতিষ্ট করে তুলেছে।

 

চাপের মুখে ইয়াহিয়া…

 

ইয়াহিয়ার অধীনে অনুষ্ঠিত সত্তরের ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনের উদ্দেশ্য ছিল, সামরিক সরকার হতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে তুলে দেয়া কিন্তু অনেক ‘উর্ধ্ধতন পশ্চিম-পাকিস্তানী সেনা-অফিসার’ বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেনি। এর প্রেক্ষিতে, পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের রাজধানী করাচীতে সেনা অভ্যুত্থান হবার আশংকা করা হয়েছিল।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ‘সামরিক সরকারের অধীন অখন্ড পাকিস্তান’ চায়, এমন ‘উর্ধ্ধতন পশ্চিম-পাকিস্তানী সেনা-অফিসারদের’ চাপে ইয়াহিয়া বাঙালীদের নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে। যার ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে পূর্ব-পাকিস্তান; বাঙালীদের স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলা দেশ’।

পেপার কাটিং:

লেখকঃ সাব্বির হোসাইন