কবি নজরুলকে অনেকগুলি নামে ডাকা হয়। যেমন; জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, ইসলামী কবি বা মুসলমানের কবি, সাম্যের কবি।সমাজের প্রবাহমান অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে তার অনেক অনেক দুঃসাহসী লেখা রয়েছে। যেমন; কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কারার ঐ লৌহ কবাট, শিকল-পরা ছল মোদের এই শিকল-পরা ছল,ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া, প্রভৃতি। এই রকম চরম প্রতিবাদী, সৎসাহসী, ও নিয়মভাঙার লেখার জন্য তাকে অবশ্যই বিদ্রোহী বলা যায়।
তিনি লিখেছেন, পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
আমার মতে তার সর্বোচ্চ সাহসিকতার পরিচয় মেলে এই কবিতায়। এই কবিতায় তিনি যারা গ্রন্থ পূজা করে তাদের সবাইকেই ভণ্ড বলেছেন। শুধু নির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ বা নির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থের পূজারীদের নয়। বলেছেন, মানুষই গ্রন্থ এনেছে। তাও নির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ নয়। সবগুলি গ্রন্থই মানুষের রচনা, কোনো ঐশী কিতাব নয় গ্রন্থগুলি। এই রকম সংবেদনশীল মারাত্মক সত্য যিনি গলা উঁচিয়ে বিশ্বের সামনে বলতে পারেন, তিনিই আবার কীকরে বা কী কারণে বলেন, “ এক সে স্রষ্টা সকল সৃষ্টির এক সে পরম প্রভু/ একের অধিক স্রষ্টা কোনো সে ধর্ম কহে না কভু/ অজ্ঞানে যদি শয়তানে শরীকী স্বত্ব আনে/ তার বিচারক এক সে আল্লা লিখিত আল কোরানে।“
এখানে নজরুল বলেছেন কোরান আল্লার লিখিত।একই ব্যক্তি এক জায়গায় বলছেন সকল ঐশী গ্রন্থই মানুষের লিখিত, আরেক জায়গায় বলছেন কোরান আল্লার লিখিত। তবে কি তিনি সময়ে সময়ে তার বিশ্বাস নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়তেন? কী জানি! তবে বিশ্বাসের বেলায় তার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মতবাদে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।
নজরুল লিখেছেন, বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে/ আমরা তখন ব’সে/ বিবি তালাকের ফতওয়া খুঁজেছি/ ফিকাহ হাদিস চ’ষে।
এই কবিতায় তিনি বলেছেন, প্রগতির পথে ঐশী কিতাবগুলি ও ধর্মীয় বিধি-ব্যবস্থা কত অপ্রয়োজনীয়, কত ভীষণ বাধা। এমন নিরেট বিপজ্জনক সত্য যিনি অকপটে, অবলীলায় লিখতে পারেন, তিনিই আবার কী জন্য বলেন, “কোরানে আল্লা এদেরই কন- শাখামৃগ হয়ে যাও।“ অলৌকিক বইগুলিকে যিনি অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর উপলব্ধি করেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন যে এই বইগুলি মানুষেরই লেখা, তিনি কেন বা কি পরিস্থিতিতে আল্লা কোরানে কাকে শাখামৃগ বলেছেন তাতে গুরুত্ব খুঁজে পান?
নজরুল অনেকগুলি ইসলামী গান ও কবিতা রচনা করেছেন। যেমন; নামাজ পড়ো রোজা রাখো কলেমা পড়ো ভাই, শোনো শোনো য়্যা এলাহি আমার মুনাজাত, ওরে দরিয়ার মাঝি মোরে নিয়ে যা মদিনা, মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই/ যেন গোর থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই প্রভৃতি। তার এই গানগুলি শুনে বা পড়ে যে কারুরই মনে হবে তিনি একজন অত্যন্ত ধর্ম অন্তপ্রাণ মুসলমান।
আবার নজরুল অনেকগুলি শ্যামাসংগীতও রচনা করেছেন। যেমন; মাটির প্রতিমা, স্থির হয়ে তুই বোস দেখি মা, আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, আমার হাতে কালি মুখে কালি, প্রভৃতি। তার শ্যামাসংগীতগুলি পড়ে বা শুনে যে কারুরই মনে হবে তিনি একজন কালি অন্তপ্রাণ হিন্দু। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো মানুষ কি একই সাথে হিন্দু ও মুসলিম দুটোই হতে পারে? না। ইসলাম বা হিন্দু কোনো ধর্মেই এই সুবিধা নেই।
নজরুল লিখেছেন, “কালো মেয়ের আঁধার কোলে/ শিশু নবীন শশী দোলে।“
আবার তিনিই লিখেছেন, “ মধুপূর্ণিমারি সেথা চাঁদ দোলে/ তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।“ প্রশ্ন হচ্ছে, নজরুল আসলে কার কোলে শশী বা চাঁদ দুলতে দেখেছেন? কালো মেয়ের কোলে, নাকি আমিনা মায়ের কোলে? নাকি উভয়ের কোলে? নাকি একই সময়ে বা একই বিশ্বাসে, অথবা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বা ভিন্ন বিশ্বাসে বা ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন জনের কোলে? জানি না। তার চাঁদ দেখার স্থান ও পাত্র ভেদ দেখে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই আমি। তিনি লিখেছেন, আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, মাকে কে দিয়েছে গালি/ রাগ করে তাই সারা গায়ে মেখেছে সে কালি/ পরেনি সে বসন-ভূষণ, বাঁধেনি সে কেশ/ তারি কাছে হার মানে রে ভুবন মোহন বেশ।“
আবার লিখেছেন, সম্ভ্রম-নতা কহিল সালাম করি/ হে পিতৃব্য-পুত্র! কত যে দিবস ধরি/ তোমার সত্যনিষ্ঠা তোমার মহিমা বিপুল/ তব চরিত্র কলঙ্কহীন শশী সমতুল, ক্ষমা করো হযরত।
সকল বিশ্বাস, জাতি, ধর্মের ঊর্ধ্বে নজরুল অনেক দুঃসাহসী লেখা লিখেছেন, অনেক কাজও করেছেন। তবে তার একবার কালীভক্তি আরেকবার হযরতভক্তি, খাদিজাভক্তির মত বিভ্রান্তিমূলক ব্যাপার দেখে আমিও বিভ্রান্ত হয়ে যাই।
তিনি লিখেছেন, ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা
ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ
ভাঙিয়া গির্জা গাহি সংগীত-
এক মানবের একই রক্ত মেশা,
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।
নজরুল এখানে বলছেন, ধর্মযাজকী শুরুই একটা পেশা। এই পেশা ধ্বংস করে দেয়া উচিত। উপাসনালয়গুলি পৃথিবীর ভূমি, অর্থ ও সময়ের অপচয় এবং মানবের জন্য অকল্যাণকর। তাই এগুলি ভেঙে মানবতার গান গাওয়াই প্রকৃত মনুষ্যত্ব। তিনি উপাসনাকে মূল্যহীন পশুর চিৎকারের সাথে তুলনা করেছেন। এসকল কথা মনে মনে আমরা অনেকেই ভেবে থাকি। তবে প্রকাশের স্পর্ধা ক’জন রাখি? কিন্তু আশাহত ও বিভ্রান্ত হই তখনই যখন সেই বীরের মুখেই শুনতে হয়,
মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই
যেন গোর থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
প্রয়োজনহীন, ক্ষতিকর উপাসনালয়গুলি ভেঙে ফেলতে বলে কেন তিনি আবার নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের উপাসনালয়ের পাশেই নিজেকে সমাহিত করার আকুলতা জানিয়ে গিয়েছেন? যিনি বলতে পেরেছেন, “কে শুনিবে ভজনালয়ের হ্রেষা” তিনিই কেন এবং অথবা কোন পরিস্থিতিতে মৃত্যুর পরেও সেই হ্রেষা শোনার আকুতি জানিয়ে গিয়েছেন? তবে নজরুল লিখে গিয়েছেন, মসজিদের পাশেই যেন তাকে কবর দেওয়া হয়। অনেক কালীভক্তি দেখালেও, অনেকগুলি কালীসংগীত রচনা করলেও কিন্তু নিজেকে কালীমন্দিরের পাশে সমাহিত করতে বলেননি!
সহায়ক গ্রন্থাবলি; নজরুলের কবিতা সংগ্রহ, আমার অবিশ্বাস-হুমায়ুন আজাদ, সার্বজনীন সংস্কৃতির বরপুত্র নজরুল-আনু মাহমুদ।
আপনার যদি ইলমে তাসাউফ বা সুফিজম সম্পর্কে ধারণা বা জ্ঞান থাকত তবে নজরুলের কথাগুলোর আসল মানে বুঝতে পারতেন ।।
কাজী নজরুল ইসলাম জীবনের শুরুতে ইসলামী সংগীত রচনা করেন ও গেয়েছেন জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি বিভিন্ন ধর্মের কুপ্রথা গুলো দেখে নিজেকে ঈশ্বরে বিশ্বাস করাতে পারেন নি
নজরুলে আপনার বিভ্রান্তির প্রকাশটি আরও একটু বিস্তারিত হলে আমার মনে হয় ভাল হত।এত ছোট লেখায় আগে পরে বিশ্লেষণবিহীন হওয়াতে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
আর
কালী সংগীত না বলে শ্যামা সংগীত বলা হয়। আর আপনি মন্তব্যে বলেছেন
নজরুল কেন শ্যামা সংগীতের মাধ্যমে কালীবন্দনা করেছেন তা জানতে নজরুল বিষয়ক বই পড়া প্রয়োজন।
অসাধারণ লেখা,,
আসল বিষয় হলো নজরুল ছিল একজন স্বভাব কবি। তার লেখা পড়ার গভীরতা ছিল না তেমন যে কারনে আস্তিক , নাস্তিকতা মত গভীর দর্শন সম্পর্কে তার পরিস্কার ধারনা ছিল না। তার সময়ে আবার রাশিয়ায় ঘটেছিল বলশেভিক বিপ্লব যার ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দুনিয়া ব্যপী। অর্থাৎ নাস্তিকতার দর্শনটাও গোটা দুনিয়ায় বেশ প্রভাব ফেলেছিল। এমতাবস্থায় গভীর দার্শনিক জ্ঞানের অভাব হেতু চঞ্চলমতি নজরুলের মনের মধ্যে যখন যে ভাবের উদয় হয়েছে তখন সেটাই লিখেছেন। এছাড়াও তার কিছু কবিতা তাকে আলেম সমাজে ভীষণ অজনপ্রিয় করে তোলে, তখন তাদেরকে সন্তুষ্ট করতেই তাকে ঈদ নামাজ রোজা এসব নিয়েও লিখতে হয়, কারন সর্বোপরি তিনি জন্মগতভাবে একজন মুসলমানই ছিলেন। সার্বিক বিবেচনায়, নজরুল কোন স্থির আদর্শে বিশ্বাসী হতে পারেন নি তার জ্ঞানের অগভীরতাহেতু , চরিত্রগত ভাবেও তিনি ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির আর তারই প্রতিফলন ঘটেছে তার গোটা সাহিত্য কর্মে।
@বিদ্রোহী,
আমারও তা-ই মনে হয়। তবে তার কালীবন্দনার ব্যাপারটি মোটেই বোধগম্য নয়।
@তামান্না ঝুমু,
তামান্না কি হুমায়ুন আযাদ দ্বারা প্রভাবিত হলেন? নজরুলের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে হুমায়ুন আযাদ যা লিখেছেন সেটা পড়েছি। নজরুলকে মন্দিরে মা কালীর সামনে নতজানু হয়ে অশ্রুজল ফেলতে দেখেছি, মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জীনের আযান ধ্বনিতে আকুল হতে দেখেছি কিন্তু আমি মোটেই বিভ্রান্ত হইনি। তিনি কে, কী তার পরিচয়, নজরুল নিজে বলছেন- যদি আর বাঁশি না বাজে-
অনেকেই ভাল ভাল মন্তব্য করেছে্ন, বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছেন, ভাবছিলাম নীরবে নিশ্চুপে গ্যালারিতে বসে থেকেই মন্তব্যগুলো উপভোগ করবো কিন্তু তা আর পারা গেলনা আপনার এই মন্তব্যে-
কোন ব্যাখ্যা দিলেন না যে? একটা বই একদিন পড়েছিলাম এখন হাতের কাছে নেই। বইটির নাম ছিল বোধ হয়- ‘নজরুলের জীবনে নারী ও প্রেম’ । অন্য জায়গায় প্রকাশিত লেখা থেকে ধার করে এখানে কিছুটা তুলে দিলাম-
নার্গিসের আসল নাম সৈয়দা খানম (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস, ফার্সি ভাষায় যার অর্থ গুল্ম)। তিনি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের মেয়ে ছিলেন।
তার মামা আলী আকবর খানের সাথে নজরুলের পরিচয় কলকাতায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে। আলী আকবর খান সম্রাট বাবরের জীবনী নিয়ে একটা নাটক লিখেছিলেন এবং টুকটাক পুস্তিকা লিখে নিজেই ফেরি করে বিক্রি করতেন। তার সে সব হাস্যকর কবিতা দেখে নজরুল নিজে “লিচু চোর” কবিতাটি আলী আকবর খানকে লিখে দেন। এতে খুশি হয়ে সে নজরুলকে তার গ্রামের বাড়ি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লাতে দাওয়াত দেন। এই আলী আকবরকে নজরুলের বন্ধুরা তেমন পছন্দ করতেন না এবং সর্বদাই তার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু সরল মনা নজরুল কখনই বন্ধুদের উপদেশ গ্রহণ করেন নি।
দৌলতপুরে নজরুলের জন্য আলী আকবর খানের নির্দেশে উষ্ণ অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়। আলী আকবর খানের বোন আসমাতুন্নেসার বিয়ে হয়েছিল খাঁ বাড়ির পাশেই। আসমাতুন্নেসার স্বামী মুন্শী আবদুল খালেক একটি মেয়ে রেখেই মৃত্যুবরণ করেন। সেই মেয়েটিই নার্গিস।
নজরুলের গান, কবিতা, গল্প, বিদ্রোহ প্রভৃতি আমাদের কাছে বিখ্যাত। অথচ নার্গিসের সাথে কবির আলোচনার সূত্রপাত কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে। এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশির সুরে মুগ্ধ হন নার্গিস। একদিন নজরুলকে এসে শুধান, “গত রাত্রে আপনি কি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি”। এই পরিচয়ের পরই নজরুলের আচার আচরণে নার্গিসের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেতে থাকল।
আলী আকবর খানও ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। মূলত নজরুলকে কুমিল্লা আনবার তার উদ্দেশ্য এই ছিল, নিজ পরিবারের কারো সাথে নজরুলের বিয়ে দেওয়া। নার্গিসের মাকে তিনি জানান, “এই ছেলে (নজরুল) একসময় জগৎ বিখ্যাত দার্শনিক কবি হবে। এই কাজীকে কোন রকমে আটকাতেই হবে। তাহলে ভবিষ্যতে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে”। পরবর্তীতে এই সব তথ্য নার্গিসের ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া যায়।
এক পর্যায়ে আলী আকবর খানের কাছে খোদ নজরুল বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আষাঢ় বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। আলী আকবর খান তার ভাগিনী গ্রাম্য নার্গিসকে বিখ্যাত কবি নজরুলের জন্য গড়তে নেমে পড়লেন। অশিক্ষিত নার্গিসকে খুব কম সময়ে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব ছিল না কিন্তু তিনি শরৎচন্দ্র ও অন্যান্য সাহিত্যিকের উপন্যাসের নারী চরিত্র গুলো থেকে নার্গিসকে জ্ঞান দিতে থাকলেন। নজরুলের এইসব ভনিতা একেবারেই পছন্দ ছিল না, তিনি আলী আকবর খানকে তা জানালেও তিনি নজরুলকে পাত্তা দেন না। সেই সাথে খুব দ্রুত বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন, নিমন্ত্রন পত্রও অতিথিদের মাঝে বিলিয়ে ফেলেন। এসব ব্যাপার নজরুলকে পীড়া দেয়, আস্তে আস্তে তার মোহ ভাঙতে থাকে।
এর ফাঁকে আলী আকবর খান আরো একটি কাজ করে যাচ্ছিলেন যা সবারই অগোচরে ছিল। তিনি নজরুলের জন্য কলকাতা থেকে আসা বন্ধুদের সব চিঠিই সরিয়ে ফেলতেন, সেই সাথে নজরুলের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে পাঠানো চিঠিও পোস্ট না করে নিজের কাছে রেখে দিতেন। কলকাতায় নজরুলের বন্ধুদের এমন সময় দাওয়াত দেওয়া হয় যেন কেউ আসতে না পারে। কবির অন্যতম ঘনিষ্ট বন্ধু কমরেড মোজাফফর আহমেদ নিমন্ত্রন পত্র পান বিয়ের পরে।
এরপর এল সেই বহু প্রতিক্ষিত ৩ আষাঢ়। যতদূর জানা যায় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় এবং আকদ্ও সম্পন্ন হয়। কিন্তু কাবিনের শর্ত উল্লেখ করবার সময়ই ঝামেলা বাঁধে। আলী আকবর খান শর্ত জুড়ে দিতে চান, নজরুলকে ঘর জামাই থাকতে হবে। বাঁধন হারা নজরুল এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করেন। সেই রাতেই দৌলতপুর থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত কর্দমাক্ত (আষাঢ় মাস) রাস্তা পায়ে হেটে নজরুল কুমিল্লা পৌছেন। নজরুলের জীবনে নার্গিস পর্ব সেখানেই শেষ।
১৯২১ এর সেপ্টেম্বর মাসে আলী আকবর খান কুমিল্লা হতে আবার কলকাতা পৌছে নজরুলের সাথে দেখা করেন। নজরুলকে তিনি টাকার লোভ দেখান, এতে নজরুল আরো রেগে যান। দীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সাথে নার্গিসের আর কোন যোগাযোগও হয় নি। ১৯৩৭ সালে নজরুলকে নার্গিস একটা চিঠি লেখেন। ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নজরুল নার্গিসকে আর একটি চিঠি লেখেন। এর প্রায় বছর খানেক আগেই শিয়ালদহতে নার্গিস ও নজরুলের উপস্থিতিতে উভয়ের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
বিচ্ছেদের সাত-আট মাসের মাথায় আলী আকবর খানের বই ব্যবসার ম্যানেজার আজিজুল হাকিমের সাথে নার্গিসের বিয়ে হয়। আজিজুল হাকিমও বাংলা সাহিত্যে কবি হিসেবে সমাদৃত। এক সময় তিনিই নার্গিসের কাছ থেকে পাওয়া সেই ১৯২১ সালে আলী আকবর খানের সরিয়ে ফেলা নজরুলের বন্ধুদের ও বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠি গুলো প্রকাশ করেন। আলী আকবর খানের মূল চরিত্র জনসম্মুক্ষে প্রকাশিত হয়।
আলী আকবর খানকে লেখা নজরুলের চিঠি-
বিয়ের ষোল বছর পরে নার্গিস নজরুলকে একটি চিঠি লিখেন, নজরুল সেই চিঠির উত্তর দেন-
@আকাশ মালিক,
হুমায়ূন আজাদ দ্বারা প্রভাবিত ঠিক নই। তবে নজরুল সম্মন্ধে তিনি যা লিখেছেন তা আমার কাছে নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণ ও সঠিক সমালোচনা মনে হয়েছে।
নার্গিসের মামার দোষ ছিল অবশ্যই। কিন্তু মেয়েটি যে নির্দোষ! তারা পরষ্পরকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের রাতে নজরুল রাগ করে চলে গেলেও পরে ত নার্গিসের সাথে যোগাযোগ করতে পারতেন। চিঠি লিখতে পারতেন। সাথে সাথে রাগ না পড়লেও কয়েক মাস, এমন কি কয়েক বছর পরে। নার্গিস সে রাতে নজরুলের সাথে চলে যেতে পারেননি। পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়ার সাহস সব মেয়ের সব সময় হয়ে উঠে না। আর সেটা ছিল খুবই তাৎক্ষণিক ব্যাপার। এক মুহূর্তে এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। পরে তার সাথে যোগাযোগ করে, চিঠি লিখে সে ব্যাপারটি তাকে বোঝান যেত, সহজ করে তোলা যেত। নার্গিস জীবনে আর বিয়ে করেননি। সারা জীবন দূর থেকে নজরুলকেই ভালোবেসে নিঃসঙ্গ থেকেছেন। একবার ভাবুন, কতটুকু ভালো মেয়েটি বেসেছিল, কতটুকু কষ্ট পেয়েছিল সারা জীবনভর।
@তামান্না ঝুমু,
কথাটার বিভিন্ন কারণ ব্যখ্যা, বিভিন্ন মত-অভিমত থাকতে পারে। আমি এক জায়গায় পড়েছিলাম, নজরুলের সাথে বিচ্ছেদের পর নার্গিসের বিয়ে হয়েছিল তার মামার ব্যবসার ম্যানেজার আজিজুল হাকিমের সাথে।
নজরুলের বৈচিত্রময়ী, অসহনীয় দুঃখ-যাতনার জীবন, রসে-রঙ্গে বিরহ-বিচ্ছেদে রহস্যা্বৃত তার প্রেম ভালবাসার দিনগুলো, তার বিশ্বাস দর্শন নিয়ে গবেষণামূলক আলোচনার জন্যে আপনার এই ছোট্ট পরিসরের লেখাটি যথেষ্ট নয়।
হ্যাঁ, নজরুল বিশ্বাসী ছিলেন, শুধু বিশ্বাসী নয় রক্তের শিরা উপশিরায় মনে অন্তরে একজন মুসলমান ছিলেন। প্রমীলার সাথে তার বিয়ের আসরে এর প্রমাণ তিনি দিয়েছেন। আর এই নজরুলই প্রতিবাদ করেন যখন প্রমীলাকে কেউ কেউ মুসলমান হওয়ার জন্যে প্রস্তাব করেন। কিছু বুঝা গেল? ঘরে প্রমীলা বাহিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার কাছে প্রেম নিবেদন। সাক্ষী শুধুমাত্র কাজী মোতাহার হোসেন। কী হচ্ছে বিষয়টা? তারপরে রানু সোম, উমা মৈত্র আরো অনেক অনেক সুন্দরী হিন্দু মুসলিম যুবতি নারী এসেছেন নজরুলের কাছে অথবা নজরুল গিয়েছেন তাদের কাছে। কী হচ্ছে বিষয়টা? কোনটা প্রেম আর কোনটা সুন্দরের পুজা? আমার ব্যক্তিগত মত হলো, নজরুল মানুষ এবং একজন পুরুষ। একজন মানুষ ও পুরুষ সত্বার, সাধারণ কমন বৈশিষ্টের বাইরে নজরুল চলে যেতে পারলে তিনি আর মানুষ থাকেন না, তাকে কোন নবী বা ফেরেস্তা হতে হয়। আমার এইটুকু মন্তব্য পড়েই মুহাম্মদভক্ত আমার নিন্দুকেরা হয়তো আমার প্রতি তীর্ষকবাণী নিক্ষেপ করে বলবেন, নজরুলের নেগেটিভ-পজেটিভ দিকগুলো মেনে নিতে পারলে মুহাম্মদের বেলা ব্যতিক্রম কেন? নজরুল এর উত্তর দিয়েছেন-
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
নজরুলকে নিয়ে আরো আলোচনা গবেষণা হউক। সাথে নিচের বইগুলো পেলে সংগ্রহে রেখে দিবেন একদিন কাজে আসবে-
‘নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম’: ড. আবুল আজাদ
‘স্মৃতিকথা’ (প্রবন্ধ সংকলন) : কাজী মোতাহার হোসেন
‘কুমিল্লায় নজরুল’ – আবদুল কুদ্দুস।
‘কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা’ – কমরেড মুজফ্ফর আহমদ
‘যুগস্রস্টা নজরুল’ – খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন
‘নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়’ – সৈয়দ আলী আশরাফ
‘সওগাত যুগে নজরুল ইসলাম’ – মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন
‘কাজী নজরুল ইসলামঃ জীবন ও সাহিত্য’ – রফিকুল ইসলাম
@বিদ্রোহী,
আমি খুব অবাক হয়েছি। নজরুল অন্য কিছু না হোক অন্তত এটা জানতে কোনটা করলে বেদাত কোনটা করলে পাপ হয়। তো নজরুল জেনেশুনেই তো এসব বেদাতি কাজ কর্ম করেছেন। তিনি খুব অগভীর চিন্তা থেকে এসব করেছেন আমার তা মনে হয় না।
বিনয় ঘোষ তাঁর বাংলার নবজাগৃতি গ্রন্থে এদেশের সমাজ বিকাশের প্রধান বাধা হিসেবে ২টি ধর্মকে চিহ্নিত করেছেন। বিনয় ঘোষ যখন এই বই লিখেছেন নজরুল তার অনেক আগেই গত হয়েছেন। কিন্তু আমার ধারণা নজরুলও বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। নজরুলের লেখা ঐ দুটি ধর্মের নিষ্ঠাবান অনুষারীকে বিপদগ্রস্থ করে। একজন মুসলমান যদি শ্যামা সঙ্গীত শুনে আপ্লুত হয় তাহলে সে ইসলামের নিয়মানুযায়ী বেদাত কাজ করছে। নজরুল যদি মুসলমানদের ঐ শ্যামা সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহি করতে পারেন তাহলে কি তিনি ইসলামের ক্ষতি করছেন না? আর একারণেই তো জীবিত থাকাকালে তিনি ধর্মান্ধদের রোষের স্বীকার হয়েছেন। একইভাবে ইসলাম, আল্লাহ বা নবী নিয়ে রচিত গান বা কবিতা কোন হিন্দু বা অন্য ধর্মের অনুসারীর মনে ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি করতে পারে যা ঐ ধর্মের নিয়মানুযায়ী অপরাধ বা পাপ কাজ।
আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ বা হুমায়ুন আজাদ ধর্মের বিরধিতা করেছেন। ধর্ম নিয়ে নানা বিচার বিশ্লষণ করে ধর্মের অসারতা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। নজরুল এসব ঠিক এই পথটি বেছে নেননি। তিনি ভিন্ন পথে হেঁটেছেন।
নজরুলকে শুধুমাত্র মুসলমানের কবি হিসেবে চিহ্নিত করতে হলে তাঁকে বা তাঁর সৃজনশীল কর্মকে কেটে কিছু অংশ বাদ দিতে হয়। নজরুল তখন খণ্ডিত হয়ে পড়েন। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় এই নজরুলে উপস্থিত দেখা গেছে বাংলাদের সরকারি মিডায়াগুলোতে। তারা যদি পারত তাহলে হয়তো নজরুলকে নিষিদ্ধ করত কিন্তু নজরুল সে সুযোগ তাদের জন্য রেখে যান নাই।
আমি বলব নজরুল মুসলমানও না হিন্দুও না বরং হিন্দু মুসলমানের ঊর্ধ্বে তৃতীয় কোনো চেতনার জন্ম দিতে চেয়েছিলেন। আর এ কাজটি তিনি খুব অসচেতন এবং অগভীর চেতনা থেকে করেছেন বলে মনে হয় না।
@আলসে কুড়ে,
আমরা নজরুলের ব্যক্তিগত জীবন যদি জানি তাহলে দেখতে পাব তিনি দশম শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছিলেন। তার জীবন ছিল সংগ্রাম মূখর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাগত যোগ্যতা যদিও নজরুলের চেয়ে বেশী কিছু ছিল না , কিন্তু তার পরেও তার জীবন সংগ্রাম মূখর ছিল না , যৌবনে ইংল্যন্ডে যাওয়ার ফলে তার জ্ঞান চর্চা বা সাহিত্য জানার ব্যপক সুযোগ ঘটেছিল। তাই অবশ্যই জানাশোনার পরিধি নজরুলের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের বেশী ছিল। সেকারনেই দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে নজরুলের চেয়ে অনেক বেশী গভীরতা ছিল। পক্ষান্তরে নজরুলের ইসলাম বা হিন্দু কোন ধর্মের উপরেই গভীর জ্ঞান ছিল বলে মনে হয় না। উপরে উপরে যা জানতেন বা শুনেছেন তার ওপরেই তিনি উভয় ধর্মের বিষয়ে লিখেছেন এবং এটা করে বড় জোর যেটা করেছেন সেটা হলো – তিনি নিজেকে ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্দ্ধে তুলে ধরেছেন মাত্র । আমাদের জানা উচিত সাহিত্য চর্চা যারা করেন তারা অধিকাংশই দেখা যায় ধর্মীয় সংকীর্ণতায় আবদ্ধ থাকেন না। যদিও গোড়া পন্থী সাহিত্যিকেরও উদাহরন দেয়া যাবে।
@বিদ্রোহী, (Y)
আমার কৈফিয়ত-এর পাশাপাশি বিদ্রোহী কবিতাটি পড়লে কী অনুভূতি হয়? বিদ্রোহী কবিতার দর্শনকে বাদ দিয়ে কেন আমার কৈফিয়ত কবিতাটির দর্কেশনকে নজরুলের মূল দর্শন হিসেবে গ্রহণ করব? আমার কাছে এই দুইটা কবিতা মিলেই নজরুল। আর তাছাড়া আমি নজরুলে বিভ্রান্ত হই না। একজন কবি বা লেখক হিসেবে তাঁর সৃজনকর্মের মাধ্যমে মানবিক যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়, যে কল্পনার বিস্তার ঘটে সেটাই আমার ভালো লাগে। চলমান ঝঞ্ঝা মুখর জীবনে পথ চলতে প্রেরণা দেয় নজরুল। নজরুলের ইসলামী গানও ভালো লাগে নজরুলের শ্যামা সঙ্গীতও ভালো লাগে। এসব গানের মধ্যে একটা সাধারণ বিষয় থাকে তা হলো ভক্তি রস। কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি আগ্রহ না থাকলেই কেবল এই দুই ধরনের গানের ভক্তি রসটুকু বা তার বাইরেও শিল্প সৃজনের সৌন্দর্যটুকু অনুভব করা যায়।
এতো কিছু পড়লেন আর আমার কৈফিয়ত টা পড়লেন না ??
নজরুল মানবতাবাদী ছিলেন। এবঙ মানবতাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু তিনি যে সময়ে জন্মেছেন, যে সমাজে এবং সমাজ ব্যবস্থায় তার বেড়ে ওঠা সেই দিকটি বিবেচনায় রাখা জরুরী। নজরুলকে সাহিত্যি হিসাবে সামাজিক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। হিন্দু-মুসলমানের সংকটে তিনি ভুমিকা রাখতে গিয়েই সম্ভবত উভয় ধর্মের বিষয় নিয়ে সমানতালে কবিতা লিখতে হয়েছে। সম্ভবত ২৫০০ এর উপরে নজরুলের গান। সেখানে শ্যমা সংগীত আর ইসলামী গান মিলিয়ে মোটে ৩০০ এর কাছাকাছি হবে। ফলে সহজেই বোঝা যায় এগুলো নজরুলের মৌলিক চিন্তার ফল নয়। বরঙ রাজনৈতিক-সামাজিক প্রয়োজনে লিখিত। কবিতার ক্ষেত্রে যে টা হয়েছে, তিনি পাশাপাশি হিন্দুপুরাণ ও মুসলিম হৈতিহ্য সামনতালে ব্যবহার করেছেন এটা নিরিীক্ষা হিসাবেই দেখি। সেই সাথে নজরুলের আগে সেই অর্থে মূলধারার বাংলা সাহিত্যে হিন্দুপুরাণেরই প্রাধাণ্য ছিল। নজরুল মুসলিম ঐতিহ্যের সিম্বলগুলো এনছেন তার আরেকটি কারণ হয়তো মুসলমানদেরকে ব্যপকভাবে বাংলাসাহিত্য চর্চায় আগ্রহী করে তোলা। এবং পুথিসাহিত্যে অভ্যস্ত আধুনিক শিক্ষা থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসিত মুসলিম সমাজে বাংলাসাহিত্যকে জনপ্রিয় করার জন্য।
নজরুলকে আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই, আর তাই হয়ত আমাদের এত বিভ্রান্তি!
নজরুল সাহিত্য গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি পূজারিদের ভালবাসতেন, পূজাকে ততটা নয় হয়ত! তবে এ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পেত শুধু সৎ ও মানবপ্রেমিক পূজারিরা। ভণ্ড ও মানব-বিদ্বেষী পূজারিদের উনি যে কি তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন বা তাদের ভণ্ডত্বের আগাপাছতলা তুলে এনেছেন কি চরম সার্থকতার সাথে, তা তার সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে মেলে।
ঈশ্বর নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, যেমনটা ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, যেমন ছিল আরও অনেক মনীষীর। এ থেকে বোঝা যায়, এ দ্বিধাদ্বন্দ্ব খুব একটা অস্বাভাবিক বা বিরল বা বিভ্রান্তিকর বিষয় নয় হয়ত। হয়ত খুব স্বাভাবিক ব্যাখ্যা রয়েছে এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের।
এ লাইন দ্বারা কিন্তু প্রমাণ হয় না ‘আল্লাহ্র লিখিত কোরান’
‘নজরুল’ নাস্তিক না আস্তিক ছিলেন!-এপ্রশ্ন চেয়ে যে-প্রশ্ন অনেক বড় তাহল ‘মানুষ’ এর জন্য নজরুলের কি অবদান রেখে ছিলেন? অথবা ‘মানবতা’ লঙ্ঘিত হয় এহেন কর্ম তাঁর দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে কিনা? ‘নজরুল’কে নিয়ে বিতর্ক তার সমমায়িককালে ছিল এখনও আছে। নজরুল বলেছেন, ”আমি গালির গালিচার বাদসা।” নজরুল গালাগালিকে গলাগলি পরিণত করার প্রয়াশ ছিল। তার সৃষ্টিকর্ম সর্বদা সাম্য- শান্তি- সুন্দর- অসাম্প্রদায়িক- সর্বোপরি মানবতার জয়গান গেয়েছেন! তিনি তার জীবন যৌবনকে মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন। ব্রিটিশ রাজ শক্তির রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে তিনি মানুষকে জাগিয়ে তুলতে সারা ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন। এ বছর খানিক জেলও খেটেছেন, ৪০ দিন অনশন করেছেন। তিনি তাঁর সামর্থ্যনুযায়ী কি করেন নাই? নজরুলের চেতনা- ‘যা কিছু অন্যায়- অসাম্য- কলুষিত- পুরাতন- বার্ধক্য- অধর্ম- কুধর্ম- শোষণ- অসুর এর বিরুদ্ধে ন্যায়- সাম্য- সুর- শান্তি- সত্য- সুন্দরের ধ্যানজ্ঞান কর্ম তপস্যা করা’;
*** শোনতে পারেন এখানে http://www.youtube.com/watch?v=E9CNnpIz6cU নজরুল বলেছেন, “ যদি আর বাঁশি না বাজে, আমায় ক্ষমা করবেন- আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতে আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে অভেদ- সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। অসুন্দরকে ক্ষমা করতে- অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম- আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম- প্রেম পেতে এসেছিলাম সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। মনে করবেন পূর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তাঁরই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল। আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যতই দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান- বেদনার গান গেয়ে যাব আমি, দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা। রবীন্দ্রনাথ আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলির মত কিটস্- এর মত খুব বড় একটা tragedy আছে, তুই প্রস্তুত হ!’ জীবনের সেই ট্রাজেডি দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারণে অন্যের জিবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুরভুমির মত তপ্ত মেঘের ঊর্ধ্বে শূন্যের মত। কেবল হাঁসি! কেবল গান! কেবল বিদ্রোহ! আমার বেশ মনে পড়ছে, একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা! আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন তীব্র পুত্র শোকে যখন ভেঙ্গে পড়েছে- ঠিক সেই দিনই, সেই সময়ে আমার বাড়িতে হাসনা হেনা ফুটেছে আমি প্রাণ ভরে সেই হাসনাহেনার গন্ধ উপভোগ করছিলাম। যেদিন আমি চলে যাবো সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা- কত কবিতা বেরুবে হয়তো আমার নামে। দেশ—প্রেমিক, বীর বিদ্রোহী- বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পড় মেরে। বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে, বন্ধু, তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশেপাশে যদি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি।”
“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু
আর আমি জাগিব না-
কোলাহল করি সারাদিনমান
কারো ধ্যান ভাঙ্গিবনা।
নিশ্চল, নিশ্চুপ-
আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধুর ধূপ”।
নজরুল গবেষক আব্দুর রাজ্জাকের রচিত ”লোকোত্তর দর্শন ও পুরুষোত্তম নজরুল” গ্রন্থে সদর উদ্দিন চিশতী বলেছেন,”নজরুলকে জাতীয় কবি বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নজরুল কোন দেশ, জাতি বা সম্প্রদায়ের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না, বরং তিনি ছিলেন সমগ্র মানব জাতির কবি। নজরুল ছিলেন সকল গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার বহু ঊর্ধ্বে। এই মহাপুরুষ ছিলেন মহাসত্য দ্রষ্টা আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্ন, তাই তার লেখা ও চিন্তা ধারায় মহাসত্য জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সুতারাং নজরুলকে সম্যকরূপে উপলব্ধি করার প্রয়াস থাকা সকল দেশ ও জাতির মধ্যে অবশ্য কর্তব্য। বিশ্ববাসী এই কর্তব্য মুক্তমন লইয়া যতই অনুশীলন ও গ্রহণ করিতে পারিবেন ততই মঙ্গল।
….নজরুলের লোকোত্তর দর্শনকে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশবাসি বিশেষতঃ মোল্লা সমাজ গ্রহণ করতে পারে নাই, বরং চরম উপেক্ষা ও অবহেলা করে চলেছে। শুধু তাই নয়, কেহ কেহ এই মহাপুরুষকে কাফের বলিয়া ফতোয়া দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। সত্যের বানী যাদের মুখ হইতে বেরিয়ে আসে তাঁদেরকে লোকেরা সর্বযুগে কাফের বলিয়া আসিতেছে।…”-সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশতী-লোকোত্তর দর্শন ও পুরুষোত্তম নজরুলঃ আব্দুর রাজ্জাক
নজরুল’কে নিয়ে যে বিতর্ক! নজরুল নিজেই বিভিন্ন অভিমত বা অভিব্যাক্তির মাধ্যমে তার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন,(*শোনতে পারেন http://www.youtube.com/watch?v=X-GqBVCFUFI&list=LLSWuprEkb3Ex7j_woOQF6oQ&feature=mh_lolz)
আমার কৈফিয়ৎ
– কাজী নজরুল ইসলাম
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!
কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’।
পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!
গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!
মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’
আনকোরা যত নন্ভায়োলেন্ট নন্-কো’র দলও নন্ খুশী।
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!
নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী!
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’-
যুগের না হই, হজুগের কবি
বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্-পেশী,
দু’কানে চশ্মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্ বেশী!
কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু?
হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!
বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?
বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে!
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে।
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!
আমি বলি, ওরে কথা শোন্ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্ খোশ্-হালে!
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্, এবার এ দাঁও ফস্কালে
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে
নিস্ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।
বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে!
রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে।
মাতা কয়, ওরে চুপ্ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্ চেয়ে!
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?
আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!
বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
কাজেই নজরুল কোন বিশেষ একটি সুনিদিষ্ট ধর্মে আস্থা ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন ‘মানব ধর্মে’
আমার ধারণা-‘মানুষের স্বভাবধর্ম, আত্মধর্ম কি? আত্মধর্ম- নাস্তিক না আস্তিক সে যাইহোক না কেন সে-টা তাঁর একান্ত নিজস্ব ব্যাপার বা ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু তাঁর ‘আত্মধর্ম’ বা আস্তিকতা বা নাস্তিকতার দ্বারা যদি অন্যের কোন ক্ষতি সাধন হয়। তাহলে মানব সমাজের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে; যা না থাকায় শ্রেয়। ‘মানুষ’এর মান রক্ষার জন্য কতটা মনুষ্যত্বকে বিকশিত করতে হয়? মানবতার শক্তিশালী মানদণ্ড দাঁড় করাতে কি পরিমান সঠিক, মানবিক হতে হয়? সে-সবের জবাব হল ‘মানুষ’ এর চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান;(*পড়তে http://www.bangla-kobita.com/nazrulislam/manush/ শোনতেhttp://www.youtube.com/watch?NR=1&v=3sAPUtETmiA&feature=endscreen&list=LLSWuprEkb3Ex7j_woOQF6oQ)
সবার উপর মানুষ সত্য তাঁহার উপর নাই। ধন্যবাদ
@শামিম মিঠু,
অতি চমৎকার বলেছেন, ভাই!
(Y) (Y) (Y)
(Y) (Y)
@শামিম মিঠু,
সমাজের প্রবাহমান অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুলের অসামান্য অবদানের কথা কিন্তু আমি বলেছি। যদিও কোনো উদাহরণ দিইনি।
অবশ্যই তিনি একজন উঁচু মনের মানুষ ছিলেন। তার অনেক কাজ ও লেখায় আমরা তার সে পরিচয় পাই। আমার এই লেখাটি হচ্ছে তার ধর্ম বিশ্বাস ও অবিশ্বাস নিয়ে বিভ্রান্তির ব্যাপারে। ‘
যদিও এই পোস্টে সেই কথা অপ্রাসঙ্গিক, তবুও আপনি বললেন সেই সূত্রেই বলছি, নার্গিসের সাথে তিনি যা করেছিলেন তাকে কিন্তু মানবতার লঙ্ঘনই বলা চলে।
@তামান্না ঝুমু,
নার্গিস প্রসঙ্গে আপনি কি জেনেছেন? তা আমার অজ্ঞাত! অনুগ্রহপূর্বক কোন তথ্য দিলে আমার জানাকে সংশোধন করে নিতাম। গ্রন্থিত নজরুল জীবনী (দুঃখিত! যা এ মুহূর্তে সংগ্রহে নাই, তাই সুনির্দিষ্ট করে কোন গ্রন্থের নাম উল্লেখ করতে পারছিনা) থেকে যতদূর জেনেছিলাম নার্গিসের মামা প্রকাশক আলী আকবার খান কাবিনের (বিবাহ) ব্যাপারে কয়েকটি শর্ত জুড়ে দেয় যেমনঃ নজরুলকে ঘর জামাই থাকতে হবে। নজরুলের লেখা প্রকাশক আলী আকবার খানের প্রকশনায় প্রকাশ করতে হবে। নজরুল এসব শর্ত মেনে নেয়নি বরং তিনি নার্গিসকে প্রস্তাব করে তুমি যদি আমাকে ভালবাস তাহলে আমার সাথে এ মুহূর্তে বের হয়ে চলে আস। কিন্তু নার্গিস নজরুলের প্রস্তাবে রাজি হয়নি, তারপর নজরুল নার্গিসকে রেখে ঝড়ের রাতে বিবাহের আসর হতে চলে আসে। আমার কথাগুলি কিছুটা বাংলা উইকিপিডিয়া উল্লেখ আছে। এবং সুবর্ণ কাজি ও মিম অভিনীত নজরুলের জীবনীর উপর নির্মিত বাংলা নাটকেও এরকমই দেখেছিলাম। (আবারও দুঃখিত নাটকের নামটি স্মরণে নাই, তাই ইউতুবে খুঁজে পেলাম না)। নজরুলের উপর শিল্পকলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে জেনেছিলাম নার্গিস তাঁর সমস্ত সম্পত্তি মৃত্যুর পূর্বে নজরুলের নামে উইল করে দিয়েছিলেন। এবং জেনেছি তিনি (নার্গিস) পরবর্তীতে আর বিবাহ করেননি! নজরুলের বিরুদ্ধে নার্গিস কোন কি অভিযোগ ছিল কিনা জানা হয়নি, যদি কারোর জানা থাকে তবে পরিজ্ঞাত করলে কৃতার্থ হবো।
@শামিম মিঠু,
“১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল। তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।”
-উইকি (কাজি নজরুল ইসলাম)
তামান্না ঝুমু,
সম্ভবতঃ কবিতাংশের শেষ লাইনে তিনি বলেন নি যে অল্লাহতালা কর্তৃক কোরাণ লিখিত হয়েছে। বলতে চেয়েছেন যে ঐরূপ বিশ্বাসীদের বিচারক একজনই এবং তিনি আল্লাহতালা! যাই হোক ভাবনা জাগাটা স্বাভাবিক যে, এমন অসীম সাহসী মানুষটি কি আসলেই দ্বিধান্বিত ছিলেন কিনা। তবে এর উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে, কবির সমসাময়িক কাল, লেখা গুলোর সময়কাল, তৎকালীন আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষনের মধ্যে। আলোচনাটা বোধ হয় আরোও বিস্তারিত হতে পারতো। ভালো লেগেছে প্রশ্ন গুলো তুলে আনায়।
@কেশব অধিকারী,
শুধু এই কবিতায় নয়, নজরুলের আরো অনেক লেখাই আছে যাতে আল্লার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস অত্যন্ত সুস্পষ্ট। যেমন, শোনো শোনো ইয়া এলাহি, নামাজ পড়ো রোজা রাখো ইত্যাদি। তিনি কি শুধু সময়কাল, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতেই ভিন্ন বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের কথা লিখেছেন? নাকি তার মনের বিশ্বাসও সময়ে সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছিল? কোনো ধর্মই তিনি ঠিক ধর্মের মতন করে পালন করেননি। আবার কোনো ধর্ম থেকে পুরোপুরি বেরিয়েও আসেননি, যদিও কিছু কিছু লেখায় অবিশ্বাসে কথা জোড়ালোভাবে লিখেছেন।
আমারো এ রকম প্রশ্ন মনে আসে।
ব্যাপারটা মনে হয় খুব একটা অস্বাভাবিকও নয়। আস্তিকতা/নাস্তিকতা কিংবা কোন ধর্মের প্রতি অনুরাগ বিরাগ এসদের মাত্রা একজন মানুষের ব্যাক্তিগত উপলব্ধিতে জীবনের নানান পর্যায়ে বিভিন্ন ভাবে প্রভাব রাখতে পারে। আস্তিক থেকে ঘোর নাস্তিক আবার কোন কারনে ঘোর আস্তিকে পরিনত হওয়া খুবই সাধারন ঘটনা।
নজরুলের জীবনে বিভিন্ন কারনে ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনই কাব্যচর্চায় বিভ্রান্তিকর পরিবর্তনের প্রভাব রেখেছিল কিনা তা জানতে তার সেসব পরস্পর বিরোধী কাব্যচর্চার সময়কালের সাথে ব্যাক্তিজীবনের তূলনা করতে হবে। তাহলে হয়তবা সূত্র পাওয়া যেতে পারে। যে কোন কবি সাহিত্যিকেরই জীবন কাল বিশ্লেষন করা না হলে তার কাব্যচর্চায় ঠিক কিসের প্রভাব কোন সময় ছিল বোঝা যায় না।
তার জীবন যাত্রায় মনে হয়নি তার জীবনে ধর্মের কোন প্রভাব আছে বলে। তিনি কালী সাধনা জাতীয় কার্যকলাপও কখনো কখনো করেছেন বলে জানা যায়। ধর্মীয় বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করেই বিধর্মী বিবাহ করেছেন। তার জীবনযাত্রা ছিল বেশ অনিয়ন্ত্রিত। এমনও হতে পারে আসলে কোন ধর্মের প্রতিই তার বিশ্বাস ছিল না, কিন্তু উপমহাদেশীয় পাঠকের কাছে ধর্ম খুব গুরুত্বপূর্ন বলে কাব্যচর্চায় ধর্ম গুরুত্ব দিয়েছেন, সে কারনেই হয়ত গুরুত্ব পেয়েছে কেবল হিন্দু এবং মুসলমানদের ধর্ম। ধর্মের ভএল দিকগুলি দেখাতে চেয়েছেন। আবার সাথে সাথে লোকের ধর্মের নামে নানান আদিখ্যেতায় বিরক্তি বোধ করলে সেটাও চাপতে পারেননি।
@আদিল মাহমুদ, আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিকটি পয়েন্ট করেছেন। ভারতবর্ষে তখনও বেশ কয়েকটি ধর্ম ছিল। তবে নজরুল শুধু প্রধান দুটি ধর্মের প্রতিই গভীর অনুরাগ প্রকাশ করেছেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। আবার ধর্মিবিরোধী মানবতার কথাও বলেছেন নির্ভিক চিত্তে।যে কোনো বিশ্বাসী মানুষ সাধারণত একটি ধর্মের প্রতিই বিশ্বাসী থাকে। নজরুলের বিশ্বাস ছিল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দুটি ধর্মে। ভারতবর্ষের অন্য সকল ধর্মকে বাদ দিয়ে তিনি কেন দুটি ধর্মের প্রতি এত আকুল হয়ে পড়েছিলেন সেটি আসলেই একটি বড় প্রশ্ন।
@তামান্না ঝুমু, :-s :-s :-s (Y)
কি জানি? মনে হয় উনি একেকটা Trance এর মধ্য দিয়ে যেতেন। প্রতিভা বসুর “জীবনের জলছবি”-তে লেখা, নজরুল একদিন উদ্ভ্রান্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, কালীঘাটের উদ্দেশ্যে কারণ তিনি মাকে দেখেছেন, সেই মা উনাকে ডাকছেন। তাতে শ্যামা সঙ্গীত লাভবান হয়েছে বলেই মনে হয়। কিন্তু উনার মনের হদিস পাওয়া সত্যিই দুরুহ হয়ে যায়।
অন্যান্যদের সাথে একমত, লেখাটা আরেকটু বড় হলে ভাল হত।
@প্রতিম লালা, একই ব্যক্তি একবার শ্যামা সংগীত লিখেছেন, আবার ইসলামী সংগীত লিখেছেন। এটা কি তার বিশ্বাসের বিভ্রান্তি? নাকি অন্য কিছু? বুঝি না।
@ ঝুমু,
লেখাটা বড় করে দিলে আরো ভাল লাগত । আমি কিছুটা যোগ করতে চাই ..যেমন ‘ঈশ্বর’ কবিতায় লিখেছেন … (এখানে পাবেন)
আবার ‘মানুষ’ কবিতায় –
তার বিপরীতে..ক্ষমা করো হজরত কবিতায়…
নিজের ভিতরে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কাটিয়েছেন সারাজীবন । প্রশ্ন ছুঁড়েছেন আমাদের দিকে …উত্তরও দিয়েছেন অনেকগুলোর । আজকের দিনে বিজ্ঞান এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চ্চায় আমরা অনেক প্রশ্নের সহজ উত্তর সহজে পেয়ে যায় । আর দেখতে পাই ধারালো যুক্তির উপমা । রবীঠাকুরের ভাষায়…
কবে যে অন্ধকার কাটবে কে জানে !!
ভাল থাকবেন ।
@অসীম,
একেকবার একেক বিশ্বাসের দিকে ছুটেছেন। আবার অবিশ্বাসের কথাও বলেছেন। পুরাই দ্বিধান্বিত। আমাদেরকেও দ্বিধায় ফেলে গেলেন।
@অসীম, :clap :clap :clap
সহমত
@অনিমেষ শুভ্র, :))