কবি নজরুলকে অনেকগুলি নামে ডাকা হয়। যেমন; জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, ইসলামী কবি বা মুসলমানের কবি, সাম্যের কবি।সমাজের প্রবাহমান অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে তার অনেক অনেক দুঃসাহসী লেখা রয়েছে। যেমন; কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কারার ঐ লৌহ কবাট, শিকল-পরা ছল মোদের এই শিকল-পরা ছল,ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া, প্রভৃতি। এই রকম চরম প্রতিবাদী, সৎসাহসী, ও নিয়মভাঙার লেখার জন্য তাকে অবশ্যই বিদ্রোহী বলা যায়।

তিনি লিখেছেন, পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
আমার মতে তার সর্বোচ্চ সাহসিকতার পরিচয় মেলে এই কবিতায়। এই কবিতায় তিনি যারা গ্রন্থ পূজা করে তাদের সবাইকেই ভণ্ড বলেছেন। শুধু নির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ বা নির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থের পূজারীদের নয়। বলেছেন, মানুষই গ্রন্থ এনেছে। তাও নির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ নয়। সবগুলি গ্রন্থই মানুষের রচনা, কোনো ঐশী কিতাব নয় গ্রন্থগুলি। এই রকম সংবেদনশীল মারাত্মক সত্য যিনি গলা উঁচিয়ে বিশ্বের সামনে বলতে পারেন, তিনিই আবার কীকরে বা কী কারণে বলেন, “ এক সে স্রষ্টা সকল সৃষ্টির এক সে পরম প্রভু/ একের অধিক স্রষ্টা কোনো সে ধর্ম কহে না কভু/ অজ্ঞানে যদি শয়তানে শরীকী স্বত্ব আনে/ তার বিচারক এক সে আল্লা লিখিত আল কোরানে।“
এখানে নজরুল বলেছেন কোরান আল্লার লিখিত।একই ব্যক্তি এক জায়গায় বলছেন সকল ঐশী গ্রন্থই মানুষের লিখিত, আরেক জায়গায় বলছেন কোরান আল্লার লিখিত। তবে কি তিনি সময়ে সময়ে তার বিশ্বাস নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়তেন? কী জানি! তবে বিশ্বাসের বেলায় তার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মতবাদে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি।
নজরুল লিখেছেন, বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে/ আমরা তখন ব’সে/ বিবি তালাকের ফতওয়া খুঁজেছি/ ফিকাহ হাদিস চ’ষে।
এই কবিতায় তিনি বলেছেন, প্রগতির পথে ঐশী কিতাবগুলি ও ধর্মীয় বিধি-ব্যবস্থা কত অপ্রয়োজনীয়, কত ভীষণ বাধা। এমন নিরেট বিপজ্জনক সত্য যিনি অকপটে, অবলীলায় লিখতে পারেন, তিনিই আবার কী জন্য বলেন, “কোরানে আল্লা এদেরই কন- শাখামৃগ হয়ে যাও।“ অলৌকিক বইগুলিকে যিনি অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর উপলব্ধি করেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন যে এই বইগুলি মানুষেরই লেখা, তিনি কেন বা কি পরিস্থিতিতে আল্লা কোরানে কাকে শাখামৃগ বলেছেন তাতে গুরুত্ব খুঁজে পান?

নজরুল অনেকগুলি ইসলামী গান ও কবিতা রচনা করেছেন। যেমন; নামাজ পড়ো রোজা রাখো কলেমা পড়ো ভাই, শোনো শোনো য়্যা এলাহি আমার মুনাজাত, ওরে দরিয়ার মাঝি মোরে নিয়ে যা মদিনা, মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই/ যেন গোর থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই প্রভৃতি। তার এই গানগুলি শুনে বা পড়ে যে কারুরই মনে হবে তিনি একজন অত্যন্ত ধর্ম অন্তপ্রাণ মুসলমান।
আবার নজরুল অনেকগুলি শ্যামাসংগীতও রচনা করেছেন। যেমন; মাটির প্রতিমা, স্থির হয়ে তুই বোস দেখি মা, আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, আমার হাতে কালি মুখে কালি, প্রভৃতি। তার শ্যামাসংগীতগুলি পড়ে বা শুনে যে কারুরই মনে হবে তিনি একজন কালি অন্তপ্রাণ হিন্দু। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো মানুষ কি একই সাথে হিন্দু ও মুসলিম দুটোই হতে পারে? না। ইসলাম বা হিন্দু কোনো ধর্মেই এই সুবিধা নেই।

নজরুল লিখেছেন, “কালো মেয়ের আঁধার কোলে/ শিশু নবীন শশী দোলে।“
আবার তিনিই লিখেছেন, “ মধুপূর্ণিমারি সেথা চাঁদ দোলে/ তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।“ প্রশ্ন হচ্ছে, নজরুল আসলে কার কোলে শশী বা চাঁদ দুলতে দেখেছেন? কালো মেয়ের কোলে, নাকি আমিনা মায়ের কোলে? নাকি উভয়ের কোলে? নাকি একই সময়ে বা একই বিশ্বাসে, অথবা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বা ভিন্ন বিশ্বাসে বা ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন জনের কোলে? জানি না। তার চাঁদ দেখার স্থান ও পাত্র ভেদ দেখে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই আমি। তিনি লিখেছেন, আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, মাকে কে দিয়েছে গালি/ রাগ করে তাই সারা গায়ে মেখেছে সে কালি/ পরেনি সে বসন-ভূষণ, বাঁধেনি সে কেশ/ তারি কাছে হার মানে রে ভুবন মোহন বেশ।“
আবার লিখেছেন, সম্ভ্রম-নতা কহিল সালাম করি/ হে পিতৃব্য-পুত্র! কত যে দিবস ধরি/ তোমার সত্যনিষ্ঠা তোমার মহিমা বিপুল/ তব চরিত্র কলঙ্কহীন শশী সমতুল, ক্ষমা করো হযরত।
সকল বিশ্বাস, জাতি, ধর্মের ঊর্ধ্বে নজরুল অনেক দুঃসাহসী লেখা লিখেছেন, অনেক কাজও করেছেন। তবে তার একবার কালীভক্তি আরেকবার হযরতভক্তি, খাদিজাভক্তির মত বিভ্রান্তিমূলক ব্যাপার দেখে আমিও বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

তিনি লিখেছেন, ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা
ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ
ভাঙিয়া গির্জা গাহি সংগীত-
এক মানবের একই রক্ত মেশা,
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।
নজরুল এখানে বলছেন, ধর্মযাজকী শুরুই একটা পেশা। এই পেশা ধ্বংস করে দেয়া উচিত। উপাসনালয়গুলি পৃথিবীর ভূমি, অর্থ ও সময়ের অপচয় এবং মানবের জন্য অকল্যাণকর। তাই এগুলি ভেঙে মানবতার গান গাওয়াই প্রকৃত মনুষ্যত্ব। তিনি উপাসনাকে মূল্যহীন পশুর চিৎকারের সাথে তুলনা করেছেন। এসকল কথা মনে মনে আমরা অনেকেই ভেবে থাকি। তবে প্রকাশের স্পর্ধা ক’জন রাখি? কিন্তু আশাহত ও বিভ্রান্ত হই তখনই যখন সেই বীরের মুখেই শুনতে হয়,
মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই
যেন গোর থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
প্রয়োজনহীন, ক্ষতিকর উপাসনালয়গুলি ভেঙে ফেলতে বলে কেন তিনি আবার নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের উপাসনালয়ের পাশেই নিজেকে সমাহিত করার আকুলতা জানিয়ে গিয়েছেন? যিনি বলতে পেরেছেন, “কে শুনিবে ভজনালয়ের হ্রেষা” তিনিই কেন এবং অথবা কোন পরিস্থিতিতে মৃত্যুর পরেও সেই হ্রেষা শোনার আকুতি জানিয়ে গিয়েছেন? তবে নজরুল লিখে গিয়েছেন, মসজিদের পাশেই যেন তাকে কবর দেওয়া হয়। অনেক কালীভক্তি দেখালেও, অনেকগুলি কালীসংগীত রচনা করলেও কিন্তু নিজেকে কালীমন্দিরের পাশে সমাহিত করতে বলেননি!

সহায়ক গ্রন্থাবলি; নজরুলের কবিতা সংগ্রহ, আমার অবিশ্বাস-হুমায়ুন আজাদ, সার্বজনীন সংস্কৃতির বরপুত্র নজরুল-আনু মাহমুদ।