কিছু কিছু জিনিস আছে অনিবার্য্যভাবে জীবনে আসবেই- প্রবল প্রতিরোধের বাঁধও তার কাছে হার মানে। সেসবের কিছু জীবনকে অনেক অনেক আলোতে নিয়ে আসে এক ঝটকায় আলাউদ্দীনের চেরাগের মতো। তবে অধিকাংশ অনিবার্য্যতা জীবনকে ক্ষনিকের জন্য হলেও নিয়ে ফেলে অনির্দেশ্যের ঘুটঘুটে অন্ধকারে। ভাগ্যের সান্তনা-প্রদীপটাই তখন সেখানে নিবু নিবু আলো জ্বেলে রাখে ভবিষ্যতের আশ্বাসে। এটুকু ভূমিকার আলো কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যৌবনের সীমানায় আচমকা ঢুকে পড়া মেয়ে ফিরোজার জীবনের উপর ফেললে নিছক অপাত্রে যাবে না। ফিরোজা ওরফে ফিরু বাবা মা আর আশপাশের সবার কাছে শুধু যে লক্ষি মেয়ে ছিল তাই নয়, সে স্বরস্বতিও। নাঁচ, গান, খেলাধুলা আর পড়াশুনা- সব কিছুতে তার বাড়-বাড়ন্ত ছিল ঈর্ষনীয়। কিন্তু হলে কি হবে! সেই দুর্লঙ্ঘ্য অনিবার্য্যতাই তার কাল হলো, তাকে নিয়ে ফেললো গভীর খাঁদে। একটা ভয়াবহ যুদ্ধের অনিবার্য্যতা তার জীবনে আনলো নতুন মোড়- কিন্তু কোন দিকে?

নয় মাস যুদ্ধের দুর্গম উতরাইয়ের শেষ প্রান্তে এসে সবাই স্বাধীন হলেও ফিরোজা হলো বীরঙ্গনা। মেয়েটার ভাগ্যই খারাপ। খারাপ না হলে এতবড় এক খিলাতের সাথে সাথে এমন আস্ত এক দৈবশিশু উপহার পায় সে? যাকে নিয়ে কাঁদা যায় শুধু, হাসা যায় না একরত্তি। শুধু কাঁদা দিয়ে কি জীবন চলে? তার থেকে মরণ ভালো- কাঁদাও নেই, হাসাও নেই। কিন্তু মরতে পারেনা ফিরোজা- বীরঙ্গনা ফিরোজা। সঙ্গে আরো অনেক সতীর্থ্য পেয়ে মনে বাঁচার বল পায় সে। ভাগ্য প্রদীপ জ্বালে সান্তনার। মন ডেকে বলে- আরে, তুইতো একা না, চেয়ে দেখ আরো অনেকে আছে তোরই মতো। শান্ত হয় মন ক্ষণিকের জন্য।

দৈবশিশুর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে ঝাড়া হাত-পা হতে পারলেও বীরঙ্গনা নাম তার হাতে পায়ে শক্ত শেকল পরিয়ে দেয়। কি করবে সে এখন, কি বা করার আছে! সবই ভাগ্য। দিন কয়েক যেতে না যেতেই নামের মাহাত্ম বুঝতে পারলো ফিরোজা। আশপাশের সাবাই তাকে বীরঙ্গনার মাংশ চামড়া ছেঁচে ছুলে দেখিয়ে দিল ভেতরে বসে আছে আসলে বারাঙ্গনা। নামের মোজেজায় ফিরোজা হারালো তার মা-বাবা আর তাবত স্বজন। কলজের টুকরো ভাইটি বোনটি কিভাবে যেন তাকায়, যেন কোন দিন এই বড় বোনটিকে তারা দেখেনি- এমনই অপরিচিত যেন। বাবা অন্যদিকে মুখ করে বললেন- “তুই আমাদের মাফ করে দে”। মা নাকে মুখে কাপড় গুঁজে কি যেন সাংঘাতিক কথা বলতে গিয়ে ব্যার্থ হয়ে দৌড়ে পালালো অন্যত্র। এসবে এখন আর কান্না পায় না ফিরোজার, তবে বুকের ভিতরে উইপোকার ঢিবির মতন কি এক বস্তু ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু পারে না আসতে। এরা সব এমন করছে কেন? এরা কি তার ফিরু নামটাও ভুলে গেল নাকি? একটা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না বীরঙ্গনা, মাথাটাকে যতটা সম্ভব নীচু করে বাড়ির চৌহদ্দী পেরিয়ে পায়ে চলা রাস্তায় এসে পড়ে।

ঢাকা শহর রাজার শহর- রাজা থাকে এখানে। ফিরোজাও থাকে, তবে প্রজা হয়ে। চৌরাস্তার মোড়ে কংক্রীটের ঢিবিটার উপরে সারাদিন ঠায় বসে থেকে নানান কিছিমের মানুষ আর যানবাহনের চলাচলের দিকে তাকিয়ে থাকা, আর রাত হলে ধবলীর খালের পাড়ে দাড়িয়ে থাকা পরিত্যাক্ত বাড়ীটায় রাত কাটানো- এই তার যেন নিত্য দিনের কাজ। দিন-রাত তার মন্দ যায় না। কিন্তু কিভাবে যে জীবন চলবে, পেট চলবে তার কোন হিসেব নেই মাথায়। আশ্রয় শিবির থেকে পাওয়া পঞ্চাশটা টাকাই সম্বল, বাধা আছে তা তার আঁচলের প্রান্তে শক্ত গেরো দিয়ে। শুধু পেটের ক্ষিদেটাই তার লাগে ঠিক মতো, ঠিক সময়ে। তখন হাত-পা চালু হয়ে শরীরটাকে বয়ে নিয়ে যায় খাবার দোকানে। এই চৌরাস্তায় এভাবেই ফিরোজার চার চারটা দিন কেটে গেছে।

চৌরাস্তার রিক্সা স্ট্যান্ডে একগাদা রিকশা এসে ভিড় করে প্রত্যেক সকালে খ্যাপ ধরার আশায়। তারা সব গন্তব্যে চলে গেলেও দুয়েকটা সব সময়ই থেকে যায়। তারা সেখানে বিশ্রাম করে, সিটের উপর বসে অবেলার ঘুমটা ঘুমিয়ে নেয়। কেউবা খাবার দোকানে বসে রুটি চিবোয়। এই চার দিনে লক্ষ করেছে ফিরোজা একটা রিক্সাওলা তাকে যেন সময় অসময় কেবলই অনুসরন করে চলেছে। বিশ্রাম বেলায় যাত্রীর সিটে বসে না ঘুমিয়ে কি দেখে অমন করে লোকটা? কি আছে দেখার তার ভেতরে? ভয় লাগে না, গর্বও লাগে না তার। সে কি সুন্দরী? আগে ছিল হয়তো, তবে এখন তা মনে করতে ভয় হয়। ওগুলোর আর অবশেষ নেই, সব গেছে শকুনের পেটে। তবে লোকটার তাকিয়ে থাকা দেখে বিরক্ত লাগে একটু, নিজের উপরে নিজের জন্য বেশ খানিকটা ঘৃনাও জমা হয়ে যায় তার মনে।

বেলা পড়ে গেছে। এখনই কুতসিত অন্ধকারে ছেয়ে যাবে চারদিক। উঠতে হবে এখনই ফিরোজাকে। আজন্মের অভ্যাসে তাড়িত হয়ে সন্ধার আগে ঘরে ফেরার তাড়া বোধ করে সে। ঢিবি ছেড়ে উঠতে যাবে, অমনি খুব কাছে পেছন থেকে কে যেন ডাক পাড়ে।
-বইন।
সন্ধ্যার আবছা নির্জন আঁধারে মানুষের স্বর শুনে মোটেও চমকায় না ফিরোজা, তবে পেছন ফিরে অদ্ভুতভাবে চেয়ে থাকা সেই রিক্সাওলাটাকে দেখে একটুখানি অবাক হয় যেন। কোন কিছু বলার মত খুজে না পেয়ে চুপ করে তাকিয়ে থাকে সাদা-পাকা চুল দাড়িতে ভরা মাঝবয়সী লোকটার দিকে। কথা বলতে শুরু করে লোকটা।
-কারো কিছু বলতে হয় না আমারে। তোমারে দেইখাই আমি চিনছি।
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল লোকটা, মাঝপথে থামিয়ে দিল তাকে বিরঙ্গনা ঠিক ক্ষ্যাপা বীরের মত। লোকটার কথার ভাপে যেন তার সমস্ত শরীরে আগুন ধরে গেল। আপৃষ্ঠলম্বিত উস্কখুস্ক চুলে কয়েকবার উন্মাদিনীর মত ঝাকি দিয়ে ঝাঁঝালো শব্দে বাক্যে ভেতরের গরল উগ্রে দিল সে।
-চিনতে পারছেন, খুব ভাল কথা। এইবার থুক মারেন আমার গায়। থুথু মাইরা আমারে পাক সাফ করেন। ধার ধারিনা আমি কারো খোজ খবরের। আমার কারো কিছুর দরকার নাই।
চোখের দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরে বিরঙ্গনার।
হঠাত খীপ্র আক্রমনে কথার খেই হারিয়ে ফেলে রিক্সাওলা লোকটা।
-আমি ঠিক ঐডা কইতে চাই নাই। তুমি আমারে ভুল বুচ্ছ বইন। আমার সোনার টুকরা বইনডা তোমার বয়সেই আছিল, দেখতেও অনেক খানি তোমারি লাহান। তারেও শকুনদের ক্যাম্পে যাইতে হইছিল, কিন্তু হেয় আর কোন দিন ফেরত আহে নাই।
গলা ধরে আসে রিক্সা শ্রমিকের। স্বজন বিয়োগের কাহিনী সেই কন্ঠ দিয়ে আর বেশীদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না, সশব্দ কান্নায়ও ভেঙ্গেও পড়তে পারে না- শুধু দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে কংক্রীটের ঢিবির উপরে।
-এই কয়দিন হুদা তুমারে তাকাই তাকাই দেখছি, আর মনে হইছে আমি যেন আমার ছোড বইনটারে দেখতাছি। তুমি আমার সেই বইন। আমার হারানো মানিকটার লাইগা আমারে কিছু করবার দেও তুমি। তুমার জন্য কিছু করলে তার আত্মায় শান্তি পাইবো।
বিগলিত শিশুর মতন নিজের পাথর-চাপা মনটাকে বেরিয়ে আনে লোকটা সর্বহারা বীরঙ্গনার সামনে। এমন এক চরম ও অপ্রত্যাসিত আবহে যেন পুরাপুরি বোবা হয়ে যায় ফিরোজা- লোকটার এত কথার জবাবে শুধু বড় একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ছাড়া আর কিছু দিতে পারে না। একবার মনে মনে বলে- হে পরোয়ারদেগার, তোমার এত বড় দুনিয়ায় এত অসংখ্যা মানুষের ভিতরে কিছু কিছু মানুষ তুমি এখনও রেখছ- সংখ্যায় অল্প হলেও তারা আছে। তা না হলে এই জগত আনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যেত।

এরপরে আর কোন আপত্তি করতে পারেনি ফিরোজা। রিক্সাচালক রমিজ মিঞার দাবীর তীব্র স্রোতের মুখে তার কোন আপত্তি টেকেওনি। অবশেষে রমিজ মিঞার পরিবারে নিঃশর্ত আশ্রয় মিললো তার। সেখানে সে ভাই পেলো, বোন পেল, পেল আরো স্বজন। এখন কে বলবে বিরঙ্গনা ফিরোজা সর্বহারা! কে বলবে এরা তার রক্ত-সম্পর্কীয় নয়! এখন নতুন দিনের স্বপ্ন দেখে ফিরোজা, আর সে স্বপ্নে জ্বালানি জোগায় তার ভাই, তার স্বজনেরা। ভাবে সে- না না এইভাবে হেরে যাওয়া চলবে না। তাকে ফুটতে হবে- বিকশিত হতেই হবে। লেখাপড়া শেষ করে এই সমাজের দশজন হতে হবে। স্বপ্ন একদিন যেখানে থেমে গিয়েছিল আজ সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। ঘরের বাইরে যে বিরাট পৃথিবী, সেখানে তার জন্যে শুধু অপেক্ষা করছে ঘৃণা আর উপেক্ষা। এভাবে বাঁচা যায় না- এভাবে হেরে যাওয়া যায় না।

দিনের পর দিন মেধা আর পরিশ্রমের সন্মেলনে লেখাপড়া শেষ হলো- সনদ মিললো ফিরোজার আর্ট কলেজ থেকে। শিল্পি হলো সে। এখন দরকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু কিভাবে? প্রতিষ্ঠার আলিগলি একেবারেই তার অজানা? অনেক শিল্পকর্ম জমা হয়ে আছে ঘরে, অনেকগুলো পেইণ্টিং পড়ে আছে। একটা প্রদর্শনী করা জরুরী। এই প্রতিযোগীতার দিনে ভাল পৃষ্ঠপোষক না থাকলে টেকা দায়। তার উপরে এটা ঢাকা শহর। এখানে সব কিছু বড় বড়- বড় বড় শিল্পী, বড় বড় মানূষ, বড় বড় জায়গা। এত বড়র ভীড়ে তার মতো একজন ক্ষুদ্র বিরঙ্গনা, যার গায়ে শত কলঙ্কের দগদগে ঘা কেমন করে পাবে একটুখানি জায়গা, যেখানে দাড়িয়ে সে মেলে ধরতে পারবে নিজের ভিতরের আগুনটুকু। তার সারা দেহে বীরঙ্গনা নামের মহিমা। তার প্রতি চারপাশের সবার কেমন এক অস্বস্তিকর কৌতুহল- সহ্য হয় না আবার কিছু বলাও যায় না। সত্যিই নিজেকে এখন জানান দেয়াটা তার খুবই জরুরী।

সময় বহুগর্ভা। এই জগতে সে অনেক বিচিত্র ঘটনা প্রসব করে- এটা তার স্বভাব। সময়ের এই স্বভাবের আচড় আছে ফিরোজার গায়েও। খুজার মতো খুজলে কি না পাওয়া যায়, ইচ্ছা থাকলে কি না মেলে। সে পাওয়াও সময়েরই দান। একসময় সে প্রাপ্তি ধরা দেয় তার হাতে। শিল্পের সমঝদার মেলে- বীরঙ্গনার শিল্পকর্মের প্রকৃত সমঝদার। এই শহরের সবাই চেনে তাকে আশরাফ সাহেব বলে। শুধু নামে নয়, কাজে কামেও সে যথেষ্ট আশরাফ। নাম-জশ-বিত্ত কোনটার অভাব নেই তার- শুধু একটুখানি অভাব আছে প্রনয়ের, ভালবাসার। তার এ চির-অভাবী মনটা খুলে যায় শিল্পীর জন্যে- হয়তো শিল্পের জন্যেও। বীরঙ্গনার জন্যে মুখে তার আশরাফী বাণী, অনেক শ্রমলব্ধ প্রশংসা- “আপনি বহুগুনা। আপনি প্রিয়দর্শিনী প্রতিভা। আপনার প্রতিষ্ঠা, প্রদর্শনী কিছুই আটকাবে না”। আলাদীনের চেরাগ বটে। বীরাঙ্গনা ফিরোজা ‘ফিরোজা প্রিয়দর্শিনী’ হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে প্রদর্শনীর ব্যানারে- সকল লোক-চরাচরে। বিত্তবান আশরাফ সাহেব চিত্তবানও। তার স্তুতি শুনে রহস্যের হাসি হাসে ফিরোজা, মনে মনে বলে- ভস্মে ঘি ঢালছো তুমি প্রণয়ের সওদাগর। হাসতে হাসতে গলে পড়ে নিজের মনের উদাস উঠোনে। তাতে একটুও উতসাহ কমেনা সওদাগরের। চোখে তার স্তুতীর ফোয়ারা, মুখে কথার ফুলঝুরী।
-সামনে আপনার বিরাট সময়, তারজন্যে পিছনের ওসব দুঃসময় ভুলতে হবে। গৃহযুদ্ধের সময় সব দেশেই এসব হয়ে থাকে। ওসব এখন অতীত- মৃত ইতিহাস। তাই বলে জীবনে আলো জ্বলবে না? কোকিল ডাকবে না? এই আমিই নিশ্চুপ কোকিলের গলায় স্বর দেব। এই আমিই, আর কেউ নয়।
আশরাফ সওদাগর অধিকারের বুনিয়াদী খুটীটা গেড়ে দেয় বীরঙ্গনার উদাস উঠোনে আগ্রাসী ভুমিদস্যুর মতন। সেই আগ্রাসনের প্রবল চাপে মাখনের ফাঁদ গলে প্রিয়দর্শিনী গিয়ে পড়ে এক অদ্ভুত খাঁচায়। বুঝে অথবা না বুঝে হাসে- শুধুই হাসে, রহস্যের হাসি, উদাস হাসি অথবা প্রশ্রয়ের।
নিজের উপর একটুখানি রাগ হয়, হয় ঘৃনাও। কিন্তু সওদাগরের উপর হয় করুনা। নয় মাসের নরক বাসের অভিজ্ঞতা তাকে হঠাত করে নিয়ে ফেলে যেন ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারে। তার ভিতরেও সহসা নিজের মনকে প্রশ্ন করে বসে- সওদাগরের ঘি খাঁটি তো? তারপরে বাস্তবে ফিরে এসে বিদ্রুপে ঠোট উল্টায়। কিচ্ছু যায় আসে না তাতে- সওদাগারের প্রণয় খাঁটি না ভেজাল। ধরা দিতে হয় প্রিয়দর্শিনীকে সওদাগরের ভেজাল প্রণয়ে। এই পৃথিবীতে খাঁটি ভেজাল সব সময় পাশাপাশি চলে। মায়ের দরদের পিছে পিছে চলে মাসীর দরদ। ভক্তির পিছে চলে অতি-ভক্তি। আপাততঃ ভক্তদের ভক্তিতো জুটলো। হোক তা ভেজাল, হোক অতিভক্তি। বাঁকা সমাজের সেই সর্বগ্রাসী ঘৃনা আর উদাসীনতার হাত থেকে তো কিছুটা বাঁচা গেল। এটা কি কম? এখন সে কত বড় মানুষ! কত বড় শিল্পী! তাকে নিয়ে, তার শিল্প নিয়ে কত মানুষের কৌতুহল! তারপরেও মাঝে মাঝে নিরবে নির্জনে ভিতরের আজন্ম লালিত মানুষটা সামনে এসে দেখা দেয়, প্রশ্ন করে বসে- একি করছিস তুই ফিরু? আবার সান্তনাও আসে সেখান থেকেই। কি আর হারাবার আছে তার? নয় মাস শকুনের সাথে নরকবাসের চেয়ে মাত্র কয়েক দিন কাকের ঠোকর খাওয়া তার কাছে এত বেশী অসহ্য নয়। ঘৃনাকে সে প্রায় জয় করে ফেলেছে- ওতে তার মৃত্যু হবার নয়। বুনো সাইক্লোনের আঘাতে যার মরন হয়নি আটপৌরে কার্তীকের ঝড়ে তার কিছুই হবে না।

অনেক দিনের আশাটা তার পুরন হলো। তিল তিল পরিশ্রমে নিজের শিল্প-মনের সবটুকু রস নিংড়ে গড়া স্বপ্নের সার্থক প্রদর্শনের আনন্দভার মাথায় করে যেন সময়ের রেশমী পাখায় উড়ে চলেছে ফিরোজা বাড়ীতে, যে বাড়ীতে আছে তার ভাই স্বজন অনেকে। তার ভাই রমিজ মিঞা রিক্সা চালক থেকে হয়েছে রিক্সা মালিক। সংসারে এসেছে সাচ্ছন্দ্য। বাড়ীতে ফিরছে ফিরোজা। অনেকদিন এত গর্ব বুকে নিয়ে তার বাড়ীতে ফেরা হয় না। আজকের বাড়ী ফেরাটা একেবারে অন্যরকম। ঘরে ঢুকতেই ভাইয়ের সাথে দেখা। অনেক কিছু জানতে চায় সে তার বোনের কাছে।
-দাড়াও
ছোট্ট একটা শব্দে কত কি জানি প্রকাশ পেয়ে যায় রমিজ মিঞার কন্ঠে। নিজের একটা সচ্ছন্দ্য গতিতে সামান্য হোচট খেয়ে থেমে যায় বীরঙ্গনা।
-তোমার সম্পর্কে এইসব যা শুনতাছি তা কি সত্যি? ছিঃ ছীঃ!
অনেক খবর রাখে এখন রিক্সা মালিক রমিজ মিঞা। সে এখন সমাজের মোটামুটি একজন। মালিকের মতই কন্ঠের জোর দিয়ে জানতে চায় সে তার প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু সহসা ভাইয়ের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না ফিরোজা। কয়েক মুহুর্ত মাত্র অপেক্ষায় নিজেকে জড় করে ফেলে বীরঙ্গনা। স্থান-কাল-পাত্র ডিঙ্গিয়ে ভিতরের আগুনটা যেন হঠাতই বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়।
-আমি কে? আমারে কি দশ জনে মাথায় বসাই রাখছে? নামের গোরায় একটা খিলাত লাগাই দিলেই হলো- অমনি আমি ফেরেশতা? আমি আর সবারই মতন। আমি ফিরোজা ছাড়া আর কিছু হইবার চাই না। আমি লোভ, হিংসা ভাল-মন্দে ভরা ফিরু ছারা আর কিছু না, হইবারও চাই না অন্য কিছু। পারলে একটুখানি মানুষ কইও আমারে, না কইলে নাই।
এতগুলো শব্দ বাক্যের অবারিত স্রোতের তোড়ে চোখে তার বৃষ্টি ঝরে না, সশব্দ কান্নায়ও উচ্চকিত হয় না চরাচর। শুধু শেষের দিকে কন্ঠটা একটুখানি কেপে যায় শব্দাঘাতে ভাইকে আঘাত করার অনুতাপে।

সূর্য্য উঠে আবার ডোবে। বসন্তও এসে গাছের পাতাদের কাঁপিয়ে দিয়ে যায়- আকাশের দেয়ালে লেপে দিয়ে যায় বিচিত্র সব রঙ। সবকিছু ঠিক আগের মত। শুধু ফিরজাই কেমন যেন আলাদা- সে তার মনের অতি পরিচিত উঠোনে খুজে ফেরে নিজের রঙ- কিন্তু শত চেষ্টায়ও তাদের আর পায় না। কারা যেন সেখানে অনধিকার প্রবেশ করে সব রঙ লুট করে নিয়ে গেছে। তবে ফিরোজা অনুভব করে মাথার ভিতরে এক আজব বোধের নড়াচড়া। যে যুদ্ধ তার অস্তিত্বের উপর দিয়ে গেছে তা মৃত হয় কি করে? কেমন করে হয়ে যায় ইতিহাস? সে তো এখনো বেঁচে আছে আর তার মতো আরো সহস্র বিরঙ্গনার মনের ভিতরে জীবন্ত যুদ্ধটাও বেঁচে আছে অবিকল, যে কোন সময় তা বেরিয়ে আসতে পারে লুট হয়ে যাওয়া রঙের দাবীতে- জীবনের দাবীতে।