মানুষের মাঝে বহুল প্রচলিত ধারণা – ব্যবসা মানুষকে স্বার্থপর করে। বাজার অনৈতিক। বাজার হলো লোভ লালসার আখরা। ব্যবসায়ীরা লুটেরা। ম্যাট রিডলি ওনার “The Rational Optimist: How Prosperity Evolves” বইটিতে বাজার অর্থনীতিকে বিবর্তনীয় বিশ্লেষণে উদ্ঘাটন করেছেন। এতে প্রচলিতের চেয়ে ভিন্ন ধারণা উঠে এসেছে। এ কাজ তিনিই প্রথম করেছেন এমন নয়। জৈব বিবর্তন কোন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার বাইরে স্বতস্ফূর্ত শৃঙ্খলার মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। একইভাবে মানুষের সমাজের নানা উপাদানেও স্বতস্ফূর্ত শৃঙ্খলা বিদ্যমান। কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা অনুপস্থিত। এমনটা এর আগে অনেকেই উদ্ঘাটন করেছেন। এদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ ফ্রিডরিখ হায়েকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মানুষের বাজার-কেন্দ্রিক আচরণের বিবর্তনীয় মনস্তত্ত্ব নিয়ে সংশয়বাদী বিজ্ঞানলেখক মাইকেল শারমার একটা গোটা বই লিখেছেন “The Mind of the Market: Compassionate Apes, Competitive Humans, and Other Tales from Evolutionary Economics” নামে।

এবার ছিলো ম্যাট রিডলির পালা। কেবল বাজার অর্থনীতি নিয়ে নয় বইটি। মানুষের এক লক্ষ বছর আগের ইতিহাস থেকে বইটার শুরু। ম্যাট রিডলি সন্ধান করেছেন, এই বিবর্তনীয় যাত্রায় ঠিক কোন ব্যাপারগুলো মানুষকে সভ্য ও সমৃদ্ধ করেছে। উৎপাদনে দক্ষ হয়ে ওঠা আর উৎপাদিত দ্রব্যের বিনিময়কে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি হিসেবে আবিষ্কার করেছেন। লক্ষ্য করেছেন, কোনো দুইটি কুকুর নিজেদের মধ্যে তাদের ভোগ্য সম্পদ বিনিময় করে না। বানর প্রজাতিতেও বিনিময়ের আচরণ প্রায় নেই বললেই চলে। তাদের মধ্যে বিনিময়ের আচরণ আরোপের চেষ্টা করে সুফল পাওয়া গেছে অল্পই। কিন্তু মানুষের আদিম সভ্যতার ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে পাওয়া গেছে উৎপাদনে দক্ষতা, শ্রম বিভাজন আর পারস্পরিক বিনিময়ের সাথে বিভিন্ন প্রাচীন সমাজের সমৃদ্ধির সরাসরি সম্পর্ক।

রহিম ও করিম। একজন মাছ ধরে, আরেকজন পশু শিকার করে। রহিম নিজের কাছে দশটা মাছ থাকার বদলে পাঁচটা মাছ আর পাঁচ টুকরো মাংস থাকাটাকে শ্রেয় মনে করলো। করিমও ভাবলো যে গোটা একটা পশুর মাংস থাকার চেয়ে পাঁচ টুকরো মাংসের বিনিময়ে পাঁচটা মাছ থাকলে উত্তম হয়। তারা নিজের কাজে দক্ষতা বাড়ালো, এবং তাদের বাড়তি উৎপাদনের বিনিময় করা শুরু করলো। এভাবে ব্যবসায়িক বিনিময়ে উভয়েরই লাভ হলো। এটাই হলো পারস্পরিক বিনিময়ের সারসংক্ষেপ। মানুষের সমৃদ্ধির চাবিকাঠি।

কিন্তু কী কারণে এই বিনিময় সম্ভব হলো? তৃতীয় অধ্যায়ে এর সন্ধান। ম্যাট রিডলি উপলব্ধি করলেন, আত্মোন্নয়ন ও অধিক লাভের ইচ্ছার পাশাপাশি একটা অপরিহার্য গুণ ছিলো পরস্পরের প্রতি আস্থা। কোনো দুইটি পশু তাদের নিজেদের খাবার নিয়ে সামনাসামনি হলে একটা রক্তক্ষয়ী লড়াই লেগে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। সে জায়গায় দুজন মানুষ কী বিশ্বাসে তাদের নিজেদের উৎপাদন পরস্পরের মাঝে বিনিময় করলো? পারস্পরিক আস্থা ছাড়া এটা সম্ভব ছিলো না। এর পর ম্যাট রিডলি উপলব্ধি করলেন, আস্থার কারণে ব্যবসা সম্ভব হয়েছে শুধু তা-ই নয়, ব্যবসাও মানুষের পারস্পরিক আস্থাকে সমুন্নত করেছে। ব্যবসা তথা পারস্পরিক বিনিময় মানুষকে মানবিক করেছে। ব্যবসার কারণে দুটো সম্পূর্ণ অচেনা প্রাণী পরস্পরের সাথে একটা রক্তপাতহীন সম্পর্ক তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। সামনের পরিচ্ছেদটাতে ম্যাট রিডলি ওনার এই উদ্ঘাটনেরই উচ্ছ্বাসটা প্রকাশ করেছেন।

মানুষের পারস্পরিক আস্থার বিকাশ ও বাজার
অনুবাদ (মূল: ম্যাট রিডলি, গ্রন্থ: The Rational Optimist)

দুজন মানুষের মাঝে একটা সফল ব্যবসায়িক বিনিময়ে দুজনেরই লাভ হবার কথা। বিনিময়ে যদি দুজনেরই লাভ না হয়, তাহলে সেখানে শোষণ ঘটে। ওই রকম বিনিময়ে জীবনযাত্রার মানের কোনো উন্নয়ন হয় না। যে বিনিময়ে একের লাভের কারণে অন্যের লোকসান ঘটে, তাকে অর্থনীতি ও গেইম থিওরিতে বলে জিরো-সাম গেইম। অর্থাৎ দুইজনের লাভক্ষতির যোগফল শূন্য। একজনের ১০ টাকা লাভ হলে অন্যজনের ক্ষতি ঠিক ১০ টাকাই। কিন্তু ব্যবসায়িক বিনিময় হলো নন-জিরো সাম গেইম। সেখানে দুজনেরই লাভ হবার সম্ভাবনা থাকে। রবার্ট রিট দেখিয়েছেন (২০০০) – মানুষের সভ্যতার সমৃদ্ধির ইতিহাস জুড়ে রয়েছে নানা রকম নন-জিরো-সাম গেইম উদ্ঘাটনের ঘটনা। দ্য মার্চেন্ট অভ ভেনিসের পোর্শা ক্ষমা সম্পর্কে যেমনটা বলেছিলেন –

এ আশীর্বাদ দুজনের জন্যেই। যে দেয় তার জন্যেও, যে নেয় তার জন্যেও।

 

ব্যবসায়িক বিনিময় নন-জিরো সাম গেইম। এটা সেই জাদু, যা আমাদের সভ্যতাকে সমৃদ্ধশালী করেছে।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, খুব অল্প লোকেই ব্যাপারটা এভাবে দেখে। মানুষ মূলত জিরো-সাম উপায়ে চিন্তা করে। ফলে ব্যবসায়িক বিনিময়কেও সে ভুলভাবে জিরো-সাম গেইম ভেবে থাকে। মানুষের দৈনন্দিন ডিসকোর্সে এই জিরো-সাম কেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনার ছড়াছড়ি। তা সে বাণিজ্যিক চুক্তির ব্যাপারেই বলুন আর সেবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারেই বলুন। এমন মানুষ ক’টা দেখেছেন যে দোকান থেকে বের হতে হতে বলছে – “জিনিসটা বেশ ভালো দামে পেয়েছি, তবে দোকানির কথাও চিন্তা করতে ভুলি নি। সে যাতে তার বউ বাচ্চাকে খাওয়াতে পড়াতে পারে সেটাও মনে রেখেছি।” মাইকেল শারমার মনে করেন (২০০৭) – জিরো-সাম চিন্তা ভাবনা আমাদের প্রস্তর যুগের মন-মানসিকতা থেকে বিবর্তনীয়ভাবে বয়ে এসেছে। প্রস্তুর যুগে বিনিময় সাধারণত জিরো-সাম গেইমই ছিলো। দুজনের বিনিময়ে দুজনের লাভের ঘটনা ছিলো দুর্লভ। হান্টার গ্যাদারারদের সময়ে একজনের অর্জনে অপরের বিয়োজন ছিলো খুব স্বাভাবিক। মাইকেল শারমার বলেন,

আমাদের বিবর্তনের ইতিহাসের অধিকাংশটা জুড়ে রয়েছে জিরো-সাম সমাজ, যেখানে একজনের লাভ মানে ছিলো অন্যজনের ক্ষতি।

 

এই জিরো-সাম চিন্তা ভাবনাগুলো এখনো বয়ে বেড়ানোটা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে লজ্জাজনকে পরিণত হয়েছে। এই জিরো-সাম চিন্তাভাবনার কারণেই বিগত শতকগুলিতে বহু বহু ব্যর্থ মতবাদের জন্ম হয়েছে। যেমন, মার্কেন্টাইলিজমের কথা বলা যেতে পারে। মার্কেন্টাইলিজম দেশের সামরিক নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্যে সরকার নিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক বাণিজ্যের কথা বলে। মার্কেন্টাইলিজম আমাদের ভুলভাবে শিখিয়েছে – ভোগ্যপণ্যের রপ্তানী আমাদের ধনী করে, আর ভোগ্যপণ্যের আমদানী করে দরিদ্র। ফলে ভোগ্যপণ্য আমাদানীর বিনিময়ে যদি ধীর-ক্ষয়িষ্ণু সম্পদ যেমন স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি রপ্তানী করা হয়, তাহলে তার চেয়ে অলাভজনক বাণিজ্য আর কিছু হতে পারে না। অ্যাডাম স্মিথ এই যুক্তির ফ্যালাসিটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন বহু আগেই। যেমন, অ্যাডাম স্মিথের সময়ে ইংল্যান্ড লোহালক্কড়ের মতো স্থায়ী সম্পদ ফ্রান্সে রপ্তানী করতো ওয়াইনের মতো ভোগ্যপণ্য আমদানীর বিনিময়ে। এতে ইংল্যান্ডে হাহাকার পড়ে গিয়েছিলো যে ওয়াইন খেয়ে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু ওদিকে ফ্রান্স তো তাদের আমদানী দিয়ে অনেক স্থায়ী ব্যবহার্য দ্রব্য বানিয়ে ফেলবে! অ্যাডাম স্মিথ এই ফ্যালাসিপূর্ণ অনুভূতিটাকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন – “আহা, রপ্তানী না করলে কতো থালা পাতিল বানিয়েই না আমরা আমাদের ইংল্যান্ডকে ভরিয়ে ফেলতে পারতাম!”

মার্ক্সবাদের কথাই ধরুন। মার্ক্সবাদ বলে যে পুঁজিপতি ধনী হয় শ্রমিককে গরীব বানিয়ে। আরেকটা জিরো-সাম ভাবনাপূর্ণ ফ্যালাসি। ওয়াল স্ট্রিট চলচ্চিত্রের গর্ডন গেকো সেই ফ্যালাসিপূর্ণ চিন্তাভাবনাকেই উস্কে দিয়ে বলেন – গ্রিড ইজ গুড (greed is good)। শুধু তাই নয়, তিনি বাণিজ্যিক বিনিময় সম্পর্কে মানুষের জিরো-সাম ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করে বলেন – এখানে কেউ জেতে তো কেউ হারে। পুঁজি ও ধনসম্পত্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা স্পেকুলেটিভ মার্কেটে এটা সত্য হলেও হতে পারে, কিন্তু পণ্য ও সেবার মার্কেটে এটা আলবৎ সত্য নয়।

ব্যবসায়িক বিনিময়ে যে উভয়েরই লাভ হতে পারে এই ব্যাপারটা মানুষের মাথায় স্বাভাবিকভাবে আসেই না। অধিকাংশ মানুষের কাছে বাজার তাই কোনো নিষ্কলুষ কর্মকাণ্ডের জায়গা নয়। এটা তাদের কাছে একটা রণভূমি, যেখানে ক্রেতার সাথে বিক্রেতার একটা যুদ্ধ চলে। এখানে নিজে জিতে সকলে যেনো অপরকে হারিয়ে দিতে চায়। ২০০৮ এর অর্থনৈতিক ধ্বসের অনেক আগে থেকেই পুঁজিবাদ ও বাজার মানুষের চোখে বড়জোর একটা প্রয়োজনীয় শয়তানে পরিণত হয়েছে।

আজকাল একেবারে স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেয়া হয় যে মুক্ত বিনিময় মানুষের ভেতরে স্বার্থপরতা তৈরি করে। মানুষের মাঝে এমন ধারণা বিরাজ করে যে বাণিজ্যিকীকরণ ঘটার পূর্বে মানুষের জীবন যেনো অনেক বেশি নম্র ও দয়াপূর্ণ ছিলো। সবকিছুর গায়ে মূল্য বসিয়ে দেয়াটা সমাজে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, মানুষের আত্মাকে সস্তা করে ফেলে। এর পেছনের দৃষ্টিভঙ্গিটি হলো বাণিজ্য মূলত একটা অন্যায্য কাজ। অর্থোপার্জন একটা কলুষিত বাসনা। বাজার ও বাণিজ্যের কারণে আধুনিক মানুষ উন্নত ও দয়াশীল হয়েছে এমন ভাবা হয় না। বরং বাজার ও বাণিজ্যের কুপ্রভাব থেকে মানুষ নিজেদের বাঁচিয়ে রেখে বাহিরের অন্য কোনো কারণে উন্নত ও দয়াশীল চরিত্র ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে এমনটা ভাবা হয়। যেকোনো অ্যাংলিকান যাজকের মুখে এমন বাণীই শোনা যাবে।

মার্ক্স বহু আগেই দেখিয়েছিলেন যে মুক্ত ও অবাধ পুঁজিবাদ একটা পৌরাণিক গাঁথায় পরিণত হয়েছে, যেই পৌরাণিক গাঁথায় পুঁজিবাদ সমস্ত জড় কিংবা বিমূর্ত বস্তুর মাঝে ক্ষমতা, বাস্তবতা আর কর্তাচরিত্র আরোপ করে।

 

– কোনো সমাজতন্ত্রীর নয়, এটা ক্যান্টাবারির আর্চবিশপের (চার্চ অভ ইংল্যান্ডের প্রধান যাজকের) ২০০৮ সনে দেওয়া উক্তি।

জৈব বিবর্তনের মতোই বাজার হলো বটম-আপ জগত, টপ-ডাউন শৃঙ্খলা নয়। এখানে দেখভাল করার কোনো একক কর্তার অস্তিত্ব নেই। অস্ট্রেলিয়ান অর্থনীতিবিদ পিটার সন্ডার্সের ভাষ্যে (২০০৭) – “বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে কেউ ছক কেটে পরিকল্পনা করে তৈরি করে নি, কেউ একে চালায় না, কেউ একে বুঝেও উঠতে পারে না। এই ব্যাপারটা বুদ্ধিজীবীদের পীড়া দেয়। পুঁজিবাদ বুদ্ধিজীবীদেরকে অনাবশ্যকে পরিণত করে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কোনো বুদ্ধিজীবীর প্রয়োজন ছাড়াই বেশ ভালোভাবে চলতে পারে।”

পুঁজিবাদের উপর বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর রুষ্টভাব কোনো নতুন ব্যাপার নয়। পশ্চিমা িবশ্বের সমগ্র ইতিহাস জুড়ে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী বাণিজ্যকে অবজ্ঞার চোখে দেখে এসেছে। হোমার এবং আইজেয়াহ বণিকদের ঘৃণা করতেন। সেইন্ট পল, সেইন্ট থমাস অ্যাকোয়াইনাস এবং মার্টিন লুথার, ওনারা সকলেই কুসীদজীবীতাকে পাপ বলে গণ্য করতেন। শেইক্সপিয়ার নিপীড়িত শাইলককে তার গল্পের নায়ক বানাতে পারেন নি।

১৯০০ এর সময়কাল সম্পর্কে ব্রিঙ্ক লিনডসে লিখেছেন (2007), “কালের বহু উৎকৃষ্ট চিন্তকই প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাকে আধিপত্য ও নিপীড়নের প্রধান মাধ্যম হিেসবে ভাবার ভুলটা করেছেন।” থর্স্টাইন ভ্যাবলেনের মতো বহু অর্থনীতিবিদ মানুষের লভ্যাংশ অর্জনের মানসিকতাকে জনসেবামূলক চেতনা এবং সরকারী কেন্দ্র-পরিকল্পিত ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। ১৮৮০-এর দশকে আর্নল্ড টয়েনবি অবাধ পুঁজিবাদের নির্মম নিন্দা করে একে “স্বর্ণলোভী পশুর জগত” বলে অভিহিত করেছিলেন, যে জগত সকল মানবিক গুণাবলী বিবর্জিত এবং লিলিপুটের দ্বীপের চেয়েও যা অবাস্তব। এ কথা তিনি শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া ইংলিশ শিল্প-বিপ্লব-সংক্রান্ত লেকচারে বলেছিলেন, যে শিল্প বিপ্লব শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অপরিসীম অবদান রেখেছিলো। আর অ্যাডাম ফিলিপ্স ও বারবারা টেইলর বলেছেন (২০০৯), “পুঁজিবাদ কোনো হৃদয়বানের ব্যবস্থা নয়। এর ভক্তরাও সে কথা স্বীকার করেন। এর ভক্তরা বলেন যে পুঁজিপতির উদ্দেশ্য যতোই অসৎ হোক, শেষে গিয়ে তা সমাজের উপকারেই আসে।”

অবাধ পুঁজিবাদ ও বাজারকে এভাবে দেখার যে যুক্তি, তার প্রতিজ্ঞা আর সিদ্ধান্ত দুটোই ভুল। বাজারভিত্তিক সমাজে আপনি যদি অন্যায্য আচরণ করেন, আপনার কুখ্যাতি হবে, লোকে আপনার সাথে স্বেচ্ছায় বিনিময়ে আগ্রহী হবে না। যখনই প্রথাগত, সম্মানভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক সমাজে বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে, যেমন ১৪০০-তে ইতালিতে, ১৭০০-তে স্কটল্যান্ডে কিংবা ১৯৪৫-এ জাপানে, তখনই সমাজ আরো সভ্য হয়েছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন প্যাজেট (২০০৭) ফ্লোরেন্সের চতুর্দশ শতকের বাণিজ্য বিপ্লবের উপর তথ্য জোগাড় করে দেখতে পেলেন, বাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে সে সমাজে স্বার্থপরতা বৃদ্ধি পাবার বদলে বরং তা হ্রাস পাওয়া শুরু করেছিলো। সেখানে পারস্পরিক-স্বীকৃতি ভিত্তিক একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো। সেই ব্যবস্থায় ব্যবসায়িক সহযোগীরা একে অন্যের প্রতি আস্থা পোষণ ও সহায়তা প্রদান করা শুরু করে।

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় উত্তরণে মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা সৃষ্টির একধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। চার্লস, ব্যারন দে মনটেস্কু, দেখতে পেলেন, “যেখানেই মানুষের মাঝে দয়া ও নম্রতার অস্তিত্ব পাওয়া যায়, সেখানেই বাণিজ্য আছে। আর যেখানেই বাণিজ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, সেখানেই মানুষের মাঝে দয়া ও নম্রতা আছে।” ভলতেয়ারের ভাষায় – ভিন্ন ঈশ্বরকে পুজো করার অভিযোগে যেই মানুষগুলো একে অপরকে খুন করে ফেলতো, তারাই লন্ডন এক্সচেন্জের এক ছাদের নিচে পরস্পরের সাথে সভ্য আচরণ করতে বাধ্য হয়। ডেভিড হিউম বাণিজ্য সম্পর্কে ভেবেছেন – “বাণিজ্য বরং মানুষের মুক্তির প্রতি অনুকূলজনক। বাণিজ্যের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো মানুষের স্বাধীনতার অনুকূল সরকার গঠন করা ও তা সংরক্ষণ করা।” জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো ভিক্টোরিয়ানদের মধ্যে এই উপলব্ধি আসে যে বোনাপার্ট কিংবা হাব্সবুর্গদের শাসনের চেয়ে একজন রথসচাইল্ড কিংবা ব্যারিংয়ের অধীনে কাজ করা অনেক বেশি স্বস্তিকর। বাণিজ্যিক হিসাব নিকাশের জন্যে যে চিন্তা ভাবনাপূর্ণ গুণের উদ্ভব হয় তা সাহস, সম্মান বা বিশ্বাস-নির্ভর গুণাবলির চেয়ে অনেক কম রক্তপাতজনক। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, সাহস, সম্মান কিংবা বিশ্বাসকে মহিমান্বিত করাটা সব সময়ই অধিক আকর্ষণের। খচ্খচ্ করার একজন রুসো কিংবা মার্ক্স সবসময়েই থাকেন, ছ্যাঁ ছ্যাঁ করার একজন রাস্কিন কিংবা গ্যাটেও সবসময় পাওয়া যায়। এর বিপরীতে আবার একজন ভলতেয়ার কিংবা হিউমও থাকেন, যিনি উপলব্ধি করে ওঠেন যে ব্যবসাপ্রসূত আচরণই মানুষকে বেশি ন্যায়নিষ্ঠ করে।

 

চার্লস (ব্যারন দে মনটেস্কু), ভলতেয়ার ও ডেভিড হিউম

:line:

 

Wright, R. (2000). Non Zero: the Logic of Human Destiny. Pantheon.

Shermer, M. (2007). The Mind of the Market. Times Books.

Saunders, P. (2007). Why capitalism is good for the soul. Policy Magazine 23:3–9.

Lindsey, B. (2007). The Age of Abundance: How Prosperity Transformed America’s Polit- ics and Culture. Collins.

Phillips, A. and Taylor, B. (2009). On Kindness. Hamish Hamilton.

Padgett, J. Described in Clippinger, J.H. (2007). A Crowd of One. Public Affairs Books.

McFarlane, A. (2002). David Hume and the political economy of agrarian civilization. History of European Ideas 27:79–91.