ধর্ষণের মত একটি নিন্দনীয় অপরাধের বিরুদ্ধে যত কথা’ই বলা হোক না কেন, স্বল্প হয়ে যাবে। কিন্তু, এর কারণগুলো খোঁজার সময় আবেগের মাত্রাটা অনেক সময় এতটাই বেশি হয়ে যায়, যে ‘কারণের কারণ’-গুলি যুগ যুগ ধরে বেঁচে-বর্তে থাকার রসদ পেয়ে যায়। ভারতের সাম্প্রতিক ধর্ষণকান্ডটি মিডিয়া যেভাবে প্রচার করেছে, তাতে আর যাই হোক না কেন – ‘সুরক্ষা’-র ছবিটা স্পষ্ট হয়ে গ্যাছে। ভারতের একটি রাজ্যে থাকার সুবাদে বলতে পারি, প্রতিদিন-ই সংবাদপত্রে প্রায় ১০-১২ টি করে ধর্ষণকান্ডের খবর প্রকাশিত হয়। দুঃখের কথা, sensationalization-এর মাত্রাটা খুব একটা বেশি না হওয়ায় এই সব ভয়ঙ্কর ঘটনা অনেক সময় চাপা পড়ে যায়। তবে, ফেসবুকে কিছু কমেন্ট দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এক যুবতী একটি পোস্টে কমেন্ট করেছেন,”এইসব ঘটনা তো রোজ ঘটে। একটা ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে, সবক’টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যায় না?” শুনে এক যুবক কার্যত ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠলেন,”এই রেপ-টা অনেক বেশি নৃশংস।” তারপর কিছু অভব্য শব্দ। বুঝুন! যুবক যদি বলতেন যে এটা আসলে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, তাহলে ভালই লাগত। কিন্তু, এ কোন মানসিকতা?

সৌজন্যে - গণশক্তি

সে যাই হোক, এখন দেখতে হবে, ধর্ষণ-এর আসল কারণটা কি। যৌনতা আমাদের অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এই স্বাভাবিক আচরণটাই যখন বিকৃত রূপ নেয়, তখন-ই ধর্ষণের মত অপরাধগুলো জন্ম নেয়। কিন্তু, এই মানসিক বিকৃতির কারণগুলো প্রেক্ষিত অনুযায়ী তৈরি হয়। চরম দারিদ্রের মধ্যে মনের অবদমিত ইচ্ছার বিকৃত বহিঃপ্রকাশের ফলেও এ’অপরাধ ঘটে। আবার, ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়ানো কলার-তোলা ‘বড়োলোক’-দের মধ্যেও ধর্ষক রয়েছে। কোন শ্রেণির মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি, সে প্রশ্নের উত্তর জানি না। কিন্তু এই মানসিক ব্যধিটা সব শ্রেণির মধ্যেই বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। মূলে রয়েছে নগ্ন individualism, আর সেই সঙ্গে যৌনতা সম্পর্কে অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি।

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় নারীকে একটি যৌনযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে প্রশ্রয় দেয়। যেন পুরুষদের হাতে ব্যবহৃত হওয়ার জন্যই নারীর জন্ম। এর প্রমাণ আমরা সর্বত্রই পাব। কারণ, মান্ধাতার আমলের ‘নিয়মকানুন’-ও এসবকে সাহায্য করে। “বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে ‘জিনস’ পরা যাবে না” – এ ফতোয়া আমার অতি-পরিচিত। এইভাবে নারীকে ‘যন্ত্র’ বানানোর প্রচ্ছন্ন মদত তো বহুদিন ধরেই চলছে। এটাই কি ধর্ষক তৈরির মূল কারণ নয়? ধর্ষণ যারা করে, তাদের কি ‘মনুষত্ব’ আছে? আগুনের ধর্ম যেমন জ্বলে ওঠা, মানুষের ধর্ম তেমন-ই ‘মনুষত্ব’। কিন্তু, বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীকে ‘যৌনযন্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করার সময় এই মনুষত্বের ছিটেফোঁটাও কি ধর্ষকের থাকে? থাকে না। কিন্তু, তাদের এই মনুষত্ব হারানোর কারণটা নিশ্চিতভাবেই পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ আপন বক্ষে লালন-পালন করে এই ধর্ষকদের। বিপাকে পড়লে দু-চার’টে কে শাস্তিও দেয়। কিন্তু, চিরতরে এই অপরাধ-প্রবণতাকে বন্ধ করার জন্য সামান্য ব্যবস্থাও নেয় না। উলটে, ধর্ষকদের মদত দেয়। এই সিস্টেমের দোষেই আজ নাবালক-ও ধর্ষকে পরিণত হয়েছে। যে সিস্টেম এক নাবালক-কে ধর্ষকে রূপান্তরিত করে, সেই সিস্টেমের কোনো শাস্তি হবে না?

‘নারী-স্বাধীনতা’ ব্যাপারটাকেও কেমন যেন মরীচিকা বানিয়ে রাখা হয়েছে। নারীর স্বাভাবিক অধিকারগুলো কেড়ে নিয়ে এক রক্ষণশীল এবং প্রগতিবিরোধী সমাজব্যবস্থা কায়েমের অপচেষ্টা চলছে। রোজ-ই শুনতে পাচ্ছি, ধর্মগুরু থেকে রাজনীতিবিদ – সবাই সাফ জানাচ্ছে,”স্বল্প পোশাক-ই ধর্ষণের কারণ।” কিংবা,”অত রাতে একা একা গেলে এসব তো হবেই”, “ধর্ষিতা-ও যথেষ্ট দোষী”। এইসব ‘মানুষ’-দের আমরা বিশ্বাস করি! নারী-পুরুষের স্বাভাবিক মেলামেশাকেও এরা ধর্ষণের কারণ হিসেবে জানাচ্ছে। দায় এড়ানোর এই অপচেষ্টার মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা ধোঁয়াশা-ও তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ ভাবছেন, স্বল্পবসনা হওয়াটা বোধ হয় দারুণ ‘সাহসিকতা’। না! আমি সেটা মনে করি না। ‘স্বল্পবসনা’ হওয়া বা না হওয়া তো অধিকারের মধ্যেই পড়ে। এটা প্রত্যেকের অধিকার। এর বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়ার মানে – সেই অধিকারে থাবা বসানো। এটাই সহজ কথা। ‘ভোগবাদ'(এক্ষেত্রে, নারীকে ‘ভোজ্যবস্তু’ হিসেবে উলে ধরে)-এর মোহে আকৃষ্ট হয়ে স্বল্পবসনা হলেও সেটা ধর্ষণের কারণ নয়। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, এই যে ভোগবাদ আজ সুযোগ পেয়ে মনে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, সেই ভোগবাদ-ই কিন্তু ধর্ষকদের মনে অপরাধের বীজ-টা বপন করে(অবাক লাগে, যখন এই ভোগবাদ-ই খোলামেলা পোশাকের জয়গান গেয়ে নিজে ভাল সাজে)। পোশাক কখনোই ধর্ষণের কারণ নয়। যারা ধর্ষণের কারণ হিসেবে পোশাক-কে চিহ্নিত করে, তারা তাদের ভোগবাদী মানসিকতাকে লুকিয়ে রাখার জন্যই এই কাজটা করবে। তাই, পোশাক স্বল্প হলে সেটা হোক স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ। এটা কোনো সাহসিকতার ব্যাপার নয়। মিডিয়াতে তো স্বল্পবসনাদের ‘সাহসী-দৃশ্যে’র কথা বলা হয়। মানি না। এটা তো একটা অধিকার। এর সাথে সাহসের কি সম্পর্ক? পোশাকের স্বাধীনতা সকলের। এই অধিকার যারা ছিনিয়ে নিতে চায়, আদতে তারাই ধর্ষণকে প্রশ্রয় দেয়।

ধর্ষকদের হয়তো শাস্তি হবে। সিস্টেম আমাদের ক্রোধকে কয়েকদিনের জন্য প্রশমিত করবে। কিন্তু, প্রশ্ন থেকেই যায়। শাস্তিটা তো “শুধুই ধর্ষকদের” দেওয়া হয়, “ধর্ষকদের সঙ্গে খোদ ধর্ষণ-প্রবণতা”-কে সিস্টেম আদৌ কোনোদিন শাস্তি দেবে কি?