০১. সারা পৃথিবীতে ‘টারজান’ চরিত্রটি কমিক্স বই, উপন্যাস, সিনেমা ও কার্টুন ছবিতে প্রায় একশ বছর ধরে দাপটের সঙ্গে নিজস্ব জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। ছোট বেলায় ’টারজান’ বা তার প্রেমিকা ’জেন’ হতে চায়নি, এমন বালক-বালিকা খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

টারজান একটি কাল্পনিক চরিত্র। এডগার রাইজ বারোজ এই কমিক্স চরিত্রের নির্মাতা। ’টারজান’ কথাটির অর্থ ‘শাদা মানুষ’। ‘টারজান অব দা এপস’ উপন্যাসে টারজান চরিত্রটি প্রথমে জনপ্রিয়তা পায়। মূল গল্পে দেখা যায়, দুর্ঘটনার কবলে পড়ে সভ্য জগত থেকে একটি পশ্চিমা শিশু আফ্রিকার গহিন অরণ্যে গোরিলাদের (এপ) খপ্পরে পড়ে। এক গোরিলা মাতা তাকে স্তন্যদান করে এবং এপ শাবক হিসেবে যতেœ বড় করে তোলে। ক্রমেই শক্তি, বুদ্ধি মত্তায় টারজান গোরিলাকূলের তো বটেই অরণ্যের সমস্ত বন্য প্রাণীর রাজা হিসেবে ঘোষিত হয়। আফ্রিকার হিংস্র ‘জংলি’ কালো মানুষরাও তাকে প্রভু হিসেবে মেনে নেন।

টারজানের বিপরীত পাঠ বলছে, এডভেঞ্চার, বীরত্ব, প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীর প্রতি দুর্বার আকর্ষনের ছদ্মবেশে ‘টারজান’ আসলে শিশু মনো জগতে সাদা মানুষের নয়া উপনিবেশ। এই চরিত্রটি শিশুমনে প্রছন্নভাবে এই ধারণা বদ্ধমূল করে, সাদা মানুষেরাই সর্ব শ্রেষ্ঠ, সভ্য জগতে তো বটেই, এমনকি বনে-জঙ্গলে, পশু-পাখির জগতে এবং ‘জংলি, নরখাদক, অসভ্য, আদিম’ কালো মানুষদের চেয়ে সর্বদাই সাদা মানুষ শ্রেষ্ঠতর। টারজান হচ্ছে তারই প্রতীক। আবার নারীবাদিরা টারজানের একক পুরুষোচিত শৌর্য-বীর্য জাহির করা নিয়ে সমালোচনায় মুখর।

০২. ইউরোপীয় সাদা চামড়ার এই জাত্যাভিমান কি এক আশ্চর্য মিথস্ক্রিয়ায় আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদী মগজে হানা দিয়ে পাহাড়, বনে-বাঁদাড়ে বসবাসকারী ভাষাগত সংখ্যালঘু আদিবাসী মানুষদের বামন সংস্কৃতিতে দেখার চোখ তৈরি করে। পর্যটক থেকে শুরু করে শিশু মাত্রই মনছবিতে এই ধারণা নিয়ে বড়ো হয়, আদিবাসী মানেই ‘জংলি, অসভ্য, নরখাদক’ বা খুব বেশী হলে ‘মদ-শুকর-সাপ-ব্যাঙ খেকো’।

উন্নয়ন ও তথা কথিত সভ্যতা থেকে পিছিয়ে পড়া আদিবাসীদের দেখার ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু বাঙালি এই জাত্যাভিমান সাধারণের মনে এক বৈপরিত্যের সহাবস্থানে লোভাতুর চোখও তৈরি করে। দৃষ্টি সুখের মোহটি বিশেষভাবে প্রকট আদিবাসী মেয়েদেরকে ‘রোমান্টিক’ বা ‘প্রেম কাতর’ হিসেবে বাঙালি মনছবিতে দেখায়। এর একটি কারণ বোধহয়, আদিবাসী মেয়েরা প্রকৃতির মতোই সরল, সুন্দর ও সাবলীল [রাঙামাটির রঙে, চোখ জুড়ালো, সাম্পান মাঝির গানে, মন ভরালো…]।

কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বড়োই নির্মম। যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত এই সেদিনের আদিবাসী অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস পর্যলোচনা করলে দেখা যায়– পাহাড়, অরণ্য, ঝর্ণা ধারায় নয়নাভিরাম পার্বত্যাঞ্চলের ইতিহাস হচ্ছে গণহত্যা, গণধর্ষণ, শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস। সেনা সন্ত্রাসে দেড় দশক আগে নিখোঁজ নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার শেষ পরিনতি কি — তা সহজেই অনুমেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সমতল কি পাহাড়ে — আদিবাসী অধ্যুষিত অন্যান্য এলাকার চিত্রও কি প্রায় একই রকম নয়? জমি কেড়ে নিয়ে, ভাষা কেড়ে নিয়ে, ধর্ম নষ্ট করে, মেয়েদের নষ্ট করে, গলা টিপে ক্ষুদ্র জাতিসমূহকে ধ্বংস করার এক নিরব সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা কি সর্বত্রই বাস্তবায়িত হয়ে চলছে না?

ল্যনীয়, ৬০ দশক থেকে এ পর্যন্ত চলে আসা বাংলা — হিন্দী সিনেমা, এমন কি টিভি নাটকে কি হেয় ভাবেই না উপস্থাপন করা হয় আদিবাসীদের — বিশেষ করে আদিবাসী মেয়েদের। এই সব গণমাধ্যম ছোট-বড় সবার মনছবিতে প্রচ্ছন্নভাবে এই ধারণাটি প্রকট করে তোলে যে, আদিবাসী মানেই ‘জংলি, অসভ্য, বর্বর ও নরমাংসভোজী’।

সেইসব বাজারী সিনেমা বা নাটকে দেখা যায়, শহর থেকে পরদেশী বাঙালি বাবু সাহেব গেছেন পাহাড়ে কি অরণ্যে বেড়াতে বা শিকারে বা কর্মসূত্রে। ছমক ছমক নৃত্যগীতি-ঢোল-বর্শা-মদ্যপানে প্রেম হলো তার জংলী রাণীর সঙ্গে। এতেই ক্ষেপে গেলো ‘পরদেশী বাবু’র ওপর পুরো অরণ্যচারী জনপদ– ইত্যাদি ইত্যাদি [তুই দূর পাহাড়ের দেশে যা, রাঙামাটির দেশে যা, হেথায় তোরে মানাইছে না রে, হেথায় তোরে ইক্কেবারে মানাইছে না রে…]।

একই উগ্র জাতীয়তাবাদী দর্শন বলে শিশুতোষ পাঠ্য থেকে শুরু করে উচ্চতর শিক্ষা ও নানা গবেষনাপত্রেও আদিবাসী সর্ম্পকে জনমনে হেয় ও ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে চলেছে।

০৩. এই বাজারী দর্শনের সূত্রে বেশ কিছুদিন ধরে টেলিভিশনে প্রদর্শিত হচ্ছে গ্রামীণ ফোনের ‘আমন্ত্রণ প্যাকেজ’এর একটি কুৎসিত বর্ণবাদী বিজ্ঞাপন। সেখানে দেখা যাবে, অদ্ভুদ সাজ-পোষাকে রং মেখে কিম্ভুদ-কদাকার ‘জংলি’রা বন্দী করেছে এক শহুরে বাঙালি বাবুকে। হঠাৎ বন্দীকে চিনে ফেললো জংলি-রাজা। এর পর চাকভূম ঢোলের তালে তালে চললো উদ্দাম নৃত্যগীত। পত্রিকাতেও প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটির স্থির চিত্রে বাঙালি বাবুর সঙ্গে ‘জংলি রাজা’র হাস্যোজল যুগল ছবি দেখা যায়।

এই বিজ্ঞাপন চিত্রটি নিয়ে এরই মধ্যে ফেবু’র একাধিক আদিবাসী বিষয়ক গ্রুপে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ব্লগে ব্লগে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভ। করপোরেট গ্রুপ গ্রামীণ ফোনকে আন্তর্জাতিকভাবে কালো তালিকাভূক্ত করার দাবি উঠেছে। আদিবাসী তরুণ বুদ্ধিজীবীরা বিজ্ঞাপনটির বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে শুরু করেছেন। দাবি উঠেছে, সব কয়েকটি আদিবাসী দল ও সংগঠনের প থেকে এর বিরুদ্ধে গণস্বার সংগ্রহ করার, জনমত গড়ে তোলার ও সম্মিলিতভাবে তীব্র প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার।

গ্রামীণ ফোনের ‘আমন্ত্রণ প্যাকেজের’ বিজ্ঞাপন চিত্রটির আরেকটি বড়ো বিপদ পার্বত্য চট্ট্রগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীদের জন্য। এই বিজ্ঞাপনের অন্তরজাত দর্শন বলে সংখ্যাগুরু বাঙালিরা মনে করতেই পারেন, পাহাড়িরা যেহেতু এখনো ইউরোপিয় মানের তো বটেই, এমনকি বাঙালি মানেও ‘আধুনিক’ হয়ে ওঠেনি, ‘জংলি ও অসভ্য’ রয়ে গেছে, সেহেতু সেখানে প্রায় চার দশক ধরে সেনা মোতায়েন, তথা সেনা শাসন বজায় রাখা খুবই যৌক্তিক। অন্যথায় পাহাড়ে জঙ্গলের আইন কায়েম হওয়ার খুবই আশঙ্কা রয়েছে [বেতাল, অরণ্যের প্রহরী]।

০৪. বিজ্ঞাপনের এই বর্ণবাদী/ উগ্র সাম্প্রদায়িক/জাত্যাভিমানী দর্শনের বিপরীতে সভ্যতা, পর্যটন বিষয়ক বিপরীত পাঠে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে এক বর্ষিয়ান আদিবাসী নেতাকে উদ্ধৃত করা যাক। খাসি নেতা অনিল ইয়াং উইম সম্ভব তার জনগোষ্ঠির মধ্যে একমাত্র, যিনি এখনো ধর্মান্তরিত হননি, পুরো খাসি জনগোষ্ঠি অনেক আগেই খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হলেও তিনি এখনো প্রকৃতি পূজারি আদি ধর্মেই রয়ে গেছেন।

কয়েক বছর আগে কুলাউড়ার খাসিয়া পাহাড় গর্জে উঠেছিলো ইকো-পার্ক ঠেকাও আন্দোলনে। একই আন্দোলনে সে সময় প্রাণ দেন মধুপুরে পিরেন স্নাল। এক-এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় চলেশ রিছিল।

সে সময় খাসি নেতা অনিল ইয়াং ইউম এই লেখককে বলেছিলেন:

যে পর্যটন আমার গ্রাম ধ্বংস করবে, নষ্ট করবে গাছবাঁশ, পানের বরজ, পাহাড়ি ছড়া, আর আমার মেয়েদের, আমি নেতা হিসেবে নয়, এই পাহাড়ের সন্তান হিসেবে বলছি, যে কোনো মূল্যে সেই পর্যটন আমরা রুখে দেবো। আমি শহর চাই না, দালান চাই না, রাস্তা চাই না, বিদ্যুত, টিভি, সিনেমা — এসব কিছুই চাই না। আমার অরণ্যে যুগ যুগ ধরে আমার মতো করেই আমি বাঁচতে চাই!

___
ছবি: গ্রামীণ ফোনের বিজ্ঞাপন চিত্র।