আশির দশকের শেষ কিংবা নব্বই দশকের শুরুর দিকের কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন অপরাধ প্রবণতা খুব প্রকট আকার ধারণ করেছিল। এর চাইতেও ভয়ের ব্যাপার ছিল যে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছিলেন যে এই ক্রাইম রেট কমার কোনই সম্ভাবনা তো নেই-ই, বরং কত টুকু বাড়বে এইটা নিয়েই যা দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল। ১৯৯৫ সালে বোস্টনের নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনলজিস্ট জেমস অ্যালান ফক্স অনুমান করেছিলেন কমপক্ষে ১৫ শতাংশ অপরাধ বাড়বে পরের দশকে, তবে সেই সাথে এই বলেও সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে অপরাধের মাত্রা পুরোপুরি দ্বিগুণও হয়ে যেতে পারে। তার সাথে সুর মিলিয়ে অন্যরাও তাল মিলিয়েছিল যে আসলেই আমেরিকানদের সামনে অপেক্ষা করছে এক সংঘাতময় সময়। কিন্তু সব বিশেষজ্ঞকে অবাক করে দিয়ে নব্বই দশকের শেষের দিকে ক্রাইম রেট আসলে কমা শুরু করলো, কমতে কমতে ৫ বছরের মধ্যেই অপরাধ একেবারে ৫০ শতাংশ কমে গেল। ২০০০ সালে মার্ডার বা হত্যার ঘটনা গত ৩৫ বছরের ইতিহাসে সর্বনিম্ন ছিল। কি এমন ঘটেছিল যে দুম করে সবাইকে অবাক করে আমেরিকায় ক্রাইম হঠাৎ করে ধাই ধাই করে কমতে থাকলো?

 

এরকম একটা ইন্টেরেস্টিং বিষয় নিয়ে পড়ছিলাম স্টিভেন লেভিট আর স্টিফেন ডাবনার-এর ফ্রিকোনমিক্স  বইতে। এই বই বেশ বিখ্যাতই বলা যায়, একটা মুভিও নির্মিত হয়েছে এই বইয়ের উপর ভিত্তি করে, একটা  ওয়েবসাইটও আছে এই নামে। অনেকেই হয়ত বইটা পড়ে ফেলেছেন, কিন্তু তারপরও আমার কাছে এই ক্রাইম রেট কমানোর কারণ হিসেবে যা বলা হয়েছে এই বইয়ে তা বেশ অভিনবই লেগেছে, তাই এই গল্প বলার লোভ সামলাইতে পারলাম না। 🙂 অবশ্য মূল বইয়ে শুধু এইটা নয়, আরও অনেক বিষয় নিয়েই লেভিট লিখেছেন, আমি শুধু ক্রাইম রেট নিয়ে যে একটি অনুচ্ছেদ আছে, সেই গল্পটাই বলছি।

 

যাই হোক, হঠাৎ করে এই ক্রাইম রেট হ্রাস করার পিছনে আবার একেক বিশেষজ্ঞ একেক রকম যুক্তি দেখানো শুরু করলো। এই যুক্তি গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ

  • অপরাধ দমনে পুলিশের নিত্যনতুন অভিনব কৌশল
  • জেলের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি
  • পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি
  • মাদক দমনে কঠোর আইনকানুন
  • জনসংখ্যার গড় বয়স বেড়ে যাওয়া
  • আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন
  • শক্তিশালী অর্থনীতি

 

লেভিটের মতে উপরের যুক্তি গুলোর মধ্যে মাত্র তিনটি ক্রাইম রেট কমার ব্যাপারে আসলেই ভূমিকা রেখেছে, বাকি গুলোর কোনই ভূমিকা নেই। তবে একটি যুক্তির কথা কেউ উল্লেখ করেনাই, মুলত সেই যুক্তিটি নিয়েই আলোচনা করব, তবে তার আগে উপরের যুক্তি গুলো নিয়েও কিছু কথা বলা দরকার বলে মনে করি।

 

নব্বইের দশকে আমেরিকার অর্থনীতির ‘বুমিং’ অবস্থা ক্রাইম কমাতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে বলে অনেকে মনে করেন। শক্তিশালী অর্থনীতি অবশ্য ভায়লেন্ট ক্রাইম যেমন খুন, ধর্ষণ কমানোর ব্যাপারে ভালো যুক্তি হতে পারেনা, তবে অর্থনীতি শক্তিশালী হলে বেকারত্ব কমে, আর বেকারত্ব কমলে নন-ভায়লেন্ট ক্রাইম যেমন ছিনতাই, ডাকাতি’র মত অপরাধ কমতেই পারে। গবেষণাতেও দেখা গেছে যে বেকারত্বের হার ১% কমলে নন-ভায়লেন্ট ক্রাইমও ১% কমে। নব্বয়ের দশকে বেকারত্বের হার ২% কমলেও নন-ভায়লেন্ট ক্রাইম কমেছে ৪০%! সেই সাথে এইটাও মনে রাখুন ৬০’এর দশকে অর্থনীতির খুব ভালো অবস্থা থাকলেও ক্রাইমও তখন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। সুতরাং শক্তিশালী অর্থনীতির যুক্তি মনে হয় ধোপে টিকে না।

 

জেলের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাবার ফলে ক্রাইম যে হ্রাস পেয়েছে এইটা ৬০’এর দশকের কথা চিন্তা করলে ভালো ভাবে বুঝা যায়। ৬০’এর দশকের দিকে আমেরিকায় বিচার ব্যবস্থা কিছুটা ঢিলে ঢালা ছিল। সেই সাথে যারা শাস্তি পেতও, তারাও এখনকার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম বছর শাস্তি ভোগ করত। কিন্তু আশির দশকের শেষের দিকে এই অবস্থা পাল্টাতে থাকে। ড্রাগ সম্পর্কিত কোন মামলায় আগের তুলনায় শাস্তি আরও কঠোর করা হয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল এই ২০ বছরের মধ্যে মাদক সম্পর্কিত আসামি ১৫ গুণ বৃদ্ধি পায়। ভায়লেন্ট ক্রাইমের জন্য শাস্তির মেয়াদও বাড়ানো হয়। আর ফলাফলও হাতেনাতে পাওয়া যায়। ২০০০ সালের মধ্যেই ২০ লাখের মত মানুষকে জেলে ঢুকানো হয়, যা প্রায় ১৯৭২ সালের চার গুণ এবং এই বৃদ্ধির প্রায় অর্ধেকই হয়েছে নব্বয়ের দশকে। অবশ্য এই জেলবন্দী মানুষের সংখ্যা হঠাৎ এত বৃদ্ধি পাবার জন্য অনেকেই সমালোচনাও করেছেন, প্রতিটি জেলবন্দীর পিছনে বছরে প্রায় ২৫ হাজার ডলার ব্যয় করতে হয় সরকারকে। কিন্তু সব মিলিয়ে দেখা গেছে, আইনকানুন আরও কঠোর করার ফলে আদতে লাভই হয়েছে, ক্রাইম রেট যে হ্রাস পেয়েছে তার এক-তৃতীয়াংশ কৃতিত্বই তাই এই যুক্তিকে দেয়া যায় বলে মনে করেন লেভিট।

 

পুলিশের অভিনব সব কৌশলের কারণেই অপরাধ কমছে- এই ধারণাটি নিউইয়র্কে বেশ হালে পানি পেয়েছিল, বিশেষ করে রুডি গিলিয়ানি(১৯৯৪-২০০১) মেয়র হবার পর থেকে তিনি এবং তৎকালীন পুলিশ কমিশনার উইলিয়াম ব্র্যাটন অপরাধ কমানোর জন্য আসলেই বেশ কিছু অভিনব পদক্ষেপ নিয়েছিল। এছাড়া ব্রোকেন উইন্ডো থিওরি’র কথা মাথায় রেখে ছোটখাটো অপরাধীকে শায়েস্তা করার ব্যাপারেও তারা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। নিউইয়র্ক আসলেই আপাতদৃষ্টিতে এর ফলাফল হাতেনাতেই পেয়েছে, আমেরিকার সবগুলো বড় শহরের মধ্যে নিউইয়র্কেই ক্রাইম রেট সবচেয়ে কমেছে। হোমিসাইড রেট(প্রতি ১০০,০০০ জনে) ৩০.৭(১৯৯০) থেকে কমে ৮.৪(২০০০) হয়েছে অর্থাৎ প্রায় ৭৩ শতাংশ হোমিসাইড হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু লেভিট এই জনপ্রিয় ধারণার বেশ কিছু ফাঁক ফোঁকর বের করেছেন। তাঁর যুক্তি হচ্ছে, ’৯৩ সালের মধ্যেই অর্থাৎ রুডি মেয়র হবার আগেই ক্রাইম রেট ২০ শতাংশ কমে গিয়েছে এবং পুলিশের নিত্যনতুন কৌশলের সাথে সাথে এই দশ বছরে পুলিশের সংখ্যাও ৪৫ শতাংশ(পুরো দেশের গড়ের চাইতে যা তিনগুণ) বেড়েছে। পুলিশের সংখ্যা বাড়লে গবেষণায় দেখা গেছে ক্রাইম রেটও কমে, এবং দেখা গেছে এই বিপুল সংখ্যক পুলিশের বৃদ্ধি অন্যান্য শহরের তুলনায় নিউইয়র্ক শহরের ১৮ শতাংশ অপরাধ কমাতে সাহায্য করেছে। পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির অনুঘটক বাদ দিলে নিউইয়র্ক আর ক্রাইম রেট কমার লিস্টে সবার উপরে থাকেনা, বরং নিউইয়র্ক এর অবস্থান হয় সবগুলো স্টেটের মধ্যে মাঝামাঝির দিকে। তবে সবচেয়ে লক্ষণীয় হল, এই সময়টায় পুরো আমেরিকা জুড়েই ক্রাইম কমেছে, এমনকি যেসব স্টেটে পুলিশের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক না, সেখানেও অপরাধ কমেছে।

 

অনেকে আবার ’৯৩ সালে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘ব্র্যাডি অ্যাক্ট’ এর ভূমিকার কথা বলেন। এইটা সত্য যে অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় আমেরিকায় অস্ত্র কিছুটা সহজলভ্য। কিন্তু এর বিপরীতে সুইজারল্যান্ডের কথাও বলা যায়, সে দেশে প্রায় প্রতিটি পরিবারে একটা করে ‘গান’ বা অস্ত্র আছে, তারপরও পৃথিবীর অন্যতম নিরাপদ জায়গা হচ্ছে সুইজারল্যান্ড। কিন্তু এই যুক্তির অসাড়তা টের পাবেন যখন চিন্তা করবেন যে অপরাধীরা অধিকাংশ সময়েই আসলে অস্ত্র কিনেই ব্ল্যাক মার্কেট থেকে। ব্র্যাডি অ্যাক্ট অনুসারে অস্ত্র কেনার আগে ক্রিমিনাল চেকের পরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হতো, কিন্তু আদতে অপরাধীরা এত ঝামেলায় যেতই না, অস্ত্রের ব্ল্যাক মার্কেট বেশ শক্তিশালী হবার ফলে খুব সহজেই এসব ঝামেলা তারা চাইলেই এড়াতে পারত। এছাড়া ওয়াশিংটন আর শিকাগো’তে এই ক্রাইম রেট কমতে শুরু করার আগেই কঠোর ‘গান কন্ট্রোল’ আইন ছিল, কিন্তু এই দুইটা শহরেই দেখা গেছে ক্রাইম কমা শুরু করছে সবার পরে।

 

এই পরিচিত যুক্তিগুলো বিশ্লেষণের পর লেভিট নিজে একটি যুক্তি বিশদ আকারে দেখিয়েছেন যা কিনা তার আগে কোন বিশেষজ্ঞই ভুলেও উচ্চারণ করেনি। লেভিট বলছেন, আমেরিকায় যে হঠাৎ করে হু হু অপরাধ কমা শুরু করল, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে একজন মহিলা যার নাম নরমা ম্যাককরভি(উনি অবশ্য জেন রো নামেই বেশি পরিচিত), তো কি করেছিলেন উনি?  ১৯৬৯ সালে ২১ বছর বয়সে তৃতীয় বারের মত প্রেগন্যান্ট হবার পর এই মহিলা অ্যাবরশন লিগাল করার জন্য মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন এবং জিতেও গিয়েছিলেন। আর লেভিট বলছেন আমেরিকা জুড়ে অ্যাবরশন লিগাল করার একটা বড় ভুমিকাই আছে এই অপরাধ কমার পিছনে।

 

এই যুক্তির গভীরে যাওয়ার আগে উনি রুমানিয়ার একটা উদাহরণ দিয়েছেন।  ১৯৬৬ সালের দিকে রুমানিয়া’তে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি নিকোলাই চাছেসি(Nicolae Ceaușescu) গর্ভপাত বেআইনি ঘোষণা করেন। নিকোলাই-এর শাসনকাল নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে, সেদিকে না যাই। যাই হোক, এর আগ পর্যন্ত রুমানিয়ার অ্যাবরশন পলিসি বেশ লিবেরাল ছিল, এতটাই যে একজন শিশুর জন্মের বিপরীতে চারটা করে গর্ভপাত হতো, বুঝতেই পারছেন, সেখানে গর্ভপাতই ছিল অন্যতম প্রধান জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবং রুমানিয়ার জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয়। শুধু গর্ভপাত নিষিদ্ধই নয়, যে কোন ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি এবং যৌন শিক্ষাও নিষিদ্ধ করা হয়। হাস্যকর শোনালেও সত্য যে কোন মহিলা যদি  প্রেগন্যান্ট না হতে পারতেন, তাকে সেলিব্যাসি ট্যাক্স(আয়ের ১০ ভাগ) দিতে হতো। তো ফলাফল কি ছিল? এক বছরের মধ্যেই জন্মহার দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং এই জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে সমাজে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া যেমন, অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। কারণটা খুব সহজ, যে বাচ্চা গুলোকে হয়ত বাধ্য হয়ে তার বাবা-মা পৃথিবীতে আনছে, তার প্রতি আদর-যত্নের যথেষ্ট অবহেলাই করা হয় এবং অনেক সময় হয়ত তার বাবা-মা’র ইচ্ছে থাকলেও তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সুবিধাজনক থাকেনা। ফলে এই রকম অবহেলায় বড় হওয়া বাচ্চারাই অনেকেই পরবর্তীতে ক্রিমিনাল হবার সম্ভাবনা অনেক অনেক বেড়ে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৮৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন নিকোলাইকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, তখন সেই আন্দোলনের পিছে কিশোর-তরুণরা, যাদের অনেকেরই হয়ত অ্যাবরশন লিগাল থাকলে জন্মই হতো না, বেশ অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছিল।

 

রুমানিয়া’য় যে ঘটনা ঘটেছে, তার ঠিক উল্টোটা আসলে ঘটেছে আমেরিকায়। আমেরিকায় অ্যাবরশন এর ইতিহাস নিয়ে একটু বলি। আমেরিকায় প্রথম দিকে প্রেগন্যান্ট হবার ১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে অ্যাবরশন বৈধ ছিল। ১৮২৮ সালে নিউইয়র্ক প্রথম অ্যাবরশন নিয়ে টালবাহানা শুরু করে এবং ১৯০০ সালের মধ্যে পুরো আমেরিকা জুড়েই অ্যাবরশন নিষিদ্ধ করা হয়। অ্যাবরশন তখন অবশ্য এমনিতেই বেশ ব্যয়বহুল আর ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। গত শতাব্দীর ’৬০ এর দশকের শেষের দিকে অনেকগুলো স্টেট অ্যাবরশন বিশেষ পরিস্থিতিতে যেমন-ধর্ষণ, ইন্সেস্ট বা মা’র শরীরের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ হলে অ্যাবরশনের অনুমতি দেয়। ১৯৭০ সালের মধ্যে নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়াশিংটন, আলাস্কা এবং হাওয়াই অ্যাবরশন কোন শর্ত ছাড়াই পুরোপুরি আইনসম্মত বলে ঘোষণা দেয়। ১৯৭৩ সালের ২২ জানুয়ারি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট ‘রো ভার্সেস ওয়েড’ এর রায়ের মাধ্যমে পুরো দেশেই অ্যাবরশন লিগাল করার সিদ্ধান্ত দেয়। কোর্ট তার রায়ে জানায়, যখন একজন মা তার সন্তান জন্মদানে অনিচ্ছুক থাকে, প্রায় সবসময়ই তার পিছে বেশ ভালো যুক্তিই থাকে। হয়ত সে খুব তার বৈবাহিক জীবনে খুব খারাপ সময় অতিবাহিত করছে, কিংবা হয়ত বাচ্চা ঠিকঠাক মানুষ করার মত অর্থনৈতিক অবস্থায় সে নেই, সে নিজেই হতে পারে মাদকাসক্ত যা হয়ত তার বাচ্চার স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর হবে। সে হয়ত আরও কিছুদিন পর নিজেকে মা হবার উপযুক্ত বলে গণ্য করবে, কিন্তু একটি ঠিক এই মুহূর্তে হাজারটা যুক্তিযুক্ত কারণেই তার পক্ষে হয়ত মা হওয়া সমীচীন হবেনা। তাই এই সিদ্ধান্ত কোর্ট মা’র হাতেই ছেড়ে দেবার পক্ষে রায় দিয়েছিল।

 

‘রো বনাম ওয়েড’ এর রায়ের পর এক বছরের মধ্যে ৭৫০,০০০ মহিলা অ্যাবরশন করায়, যা প্রতি চারটি শিশুর জন্মদানের বিপক্ষে একটি অ্যাবরশন। ১৯৮০ সালের মধ্যে অ্যাবরশন ১.৬ মিলিয়নে পৌঁছায়। ২২৫ মিলিয়নের দেশে ১.৬ মিলিয়ন অ্যাবরশন অর্থাৎ প্রতি ১৪০ জন অ্যামেরিকান এর বিপরীতে একটি করে অ্যাবরশন! রুমানিয়াতে অবশ্য অ্যাবরশন পুনরায় লিগাল করার পর প্রতি ২২ জন রুমানিয়ানের বিপরীতে একটি করে অ্যাবরশন হতো!

 

‘রো বনাম ওয়েড’ এর আগে মধ্য বা উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই অবৈধ উপায়ে ব্যয়বহুল ভাবে অ্যাবরশন করাতো। কিন্তু আইনসম্মত করার পর যে কেউই অনেক কম খরচে করাতে পারতো। এই আইনের সুবিধা আসলে কারা পেয়েছিল? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই আইনের সুবিধা মূলত পেয়েছে তারাই যারা কিনা অবিবাহিত, টিনএজার বা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। তো এই মেয়েদের যদি বাচ্চা নিতেই হতো অর্থাৎ অ্যাবরশন লিগাল না হতো, তাহলে এই বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ কিরকম হতো? গবেষণা বলছে একজন গড়পড়তা শিশু যে অ্যাবরশন লিগালাইজ করার ফলে জন্মাতে পারেনি তার একজন অ্যাভারেজ অ্যামেরিকান শিশুর তুলনায় দারিদ্রের মধ্যে শৈশব কাটানোর  সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ বেশি এবং সিঙ্গেল প্যারেন্ট পরিবারে বেড়ে উঠার সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ বেশি। গবেষণা আরও বলছে, এই দুটি প্রধান ফ্যাক্টর ছাড়াও টিনেজ মা এবং মা’র শিক্ষার অভাবও অবশ্য ভালো ধারণা দিতে পারে একজন শিশু ভবিষ্যতে ক্রিমিনাল হবে কিনা।  মোট কথা, যে কারণগুলোর জন্য একজন মেয়ে অ্যাবরশনে হয়ত উৎসাহিত হয়, সেই বৈশিষ্ট্য গুলোই সন্তানদের ক্রিমিনাল হবার পিছনে ভালো ভূমিকা রাখে।

 

’৭৩ সালে আইন পাস করার পর নব্বয়ের দশকের শুরু থেকেই অপরাধ কমতে শুরু করে। চিন্তা করে দেখুন, অ্যাবরশন যদি নিষিদ্ধই থাকত এবং অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুর তখন জন্ম হতো, তাহলে তারা নব্বয়ের দশকের শুরুতে তারা তাদের টিন এজের শেষের দিকে পৌঁছাত, যে সময়টাতেই আসলে অপরাধ প্রবণতা অন্যান্য বয়সের তুলনায় একটু বেশিই থাকে। লেভিট বলছেন যে এই ভবিষ্যৎ অপরাধপ্রবণ শিশুদের জন্মই না হওয়াতে ক্রাইম কমা শুরু করেছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই যে কেউ প্রশ্ন করতে পারে, এমনও তো হতে পারে, এইটা সিম্পল করেলেশন, কোন Causal রিলেশন নেই( এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য দেখুন)।

 

একটা উপায় হতে পারে, যদি দেখা যায় যেসব স্টেটে পুরো দেশে করার আগেই অ্যাবরশন লিগালাইজ করা ছিল, সেই সব স্টেটে ক্রাইম আগে কমা শুরু করেছিল কিনা। নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়াশিংটন, আলাস্কা, হাওয়াই-এই স্টেট গুলোতে ‘রো বনাম ওয়েড’-এর দুই বছর আগে থেকেই অ্যাবরশন লিগালাইজ ছিল। ডাটা বলছে সত্যি সত্যিই এই স্টেট গুলোতে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে ক্রাইম অন্যান্য ৪৫ স্টেটের তুলনায় ১৩% বেশি কমেছে, ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে অন্যান্যর তুলনায় ক্রাইম কমেছে ২৩%।

 

আরও প্রমাণ হিসেবে লেভিট দেখিয়েছেন, ১৯৭০ থেকে ’৯০ সালের মধ্যে যে স্টেটগুলোতে অ্যাবরশন রেট অন্যান্য স্টেটের চাইতে কম ছিল, সেই স্টেট গুলোতে ক্রাইম কমার হারও ছিল কম। মোট কথা, লেভিট সব শেষে বলতে চেয়েছেন, যখন একজন নারীর হাতে যথেষ্ট অধিকার থাকে, সে অধিকাংশ সময়ই খুব ভালো মতই বুঝতে পারে সে সেই অনাগত বাচ্চাকে উপযুক্ত পরিবেশে বড় করে তুলতে পারবে কিনা, তার পছন্দসই পরিস্থিতি না থাকলেই কেবল সে অ্যাবরশন করে।

 

অ্যাবরশন ঠিক না ভুল, মোরালি এইটা ঠিক কিনা সেই প্রশ্নের জবাব আসলে সরাসরি দেয়া হয়নি। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন, এই রো বা নরমান ম্যাককরভি যার কারণেই এত কেচ্ছা কাহিনী হল, সে নিজেই পরবর্তীতে অ্যাবরশন বিরোধিতায় নামে, প্রো-লাইফ ব্যানারে রিপাবলিকানদের হয়ে আন্দোলনও করেছেন।  তবে অ্যাবরশন কাহিনী আসলে এখানেই শেষ হওয়ারও কোন লক্ষণ নেই। সামনের নির্বাচনেও এইটা নিয়ে ভালোই বিতর্ক হবে বলেই মনে করছে অনেকে।

 

এই তর্কে-বিতর্কের মারপ্যাঁচে যদি ‘রো বনাম ওয়েড’ আর বলবৎ না থাকে, প্রশ্ন হচ্ছে ক্রাইম কি আবার সত্তর-আশি ‘র দশকের মত বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করবে?