বিকল্পধারার ইসলামচর্চা ও এম. এ. খানে’র জিহাদ
লিখেছেন: আহমদ মিনহাজ

প্রথম প্রবাহ

মার্কিন প্রবাসী ভারতীয় লেখক-সাংবাদিক এম. এ. খান ইসলাম ধর্মে জিহাদের তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক পটভূমি ব্যাখ্যা করে একটি বই লিখেছেন। ‘Islamic Jihad : A Legacy of Forced Conversion, Imperialism, and Slavery’ নামে ইংরেজি ভাষায় রচিত বইটিকে বাংলা ভাষান্তরে ‘ইসলামী জিহাদ : জোরপূর্বক ধর্মান্তর, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার’ নামে অভিহিত করা যায়। লেখকের বইয়ের শিরোনামটি বেশ দীর্ঘ। আঠারো-ঊনিশ শতকে দীর্ঘ শিরোনামে বই লেখার খুব চল ছিল। চার্লস ডারউইনের যুগান্তকারী গ্রন্থের কথা সকলেই কমবেশি জানেন। সুদীর্ঘ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ফলাফল বইয়ে লিপিবদ্ধ করার সময় তিনি একটি লাগসই শিরোনাম বেছে নিয়েছিলেন। ডারউইন তাঁর বইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘On the Origin of Species by Means of Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life’। শিরোনাম দেখে ভিতরের বিষয়বস্তু সম্পর্কে পাঠকের একটি ধারণা হয়। বইয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণীজগতের উদ্ভব ও বিকাশের মনোজ্ঞ বিবরণ দিয়েছিলেন ডারউইন। সেইসঙ্গে বৈজ্ঞানিক যুক্তির সাহায্যে বিকাশের নেপথ্য কারণগুলোও ব্যাখ্যা করেছেন। সৃজনশীল চিন্তা আর অভিনব বিশ্লেষণ-পদ্ধতির কারণে তাঁর এই বইটি বিজ্ঞানী মহলে ক্লাসিক হিসাবে স্বীকৃত। যদিও ডারউইনকে এর জন্য সমালোচনার ঝড় সহ্য করতে হয়েছিল। তৎকালীন খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে তাঁর তত্ত্ব বা থিয়োরি অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। এমনকি এখনো পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের কাছে ডারউইনের নামটি স্বস্তিকর নয়। রাষ্ট্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সরল বিশ্বাসী লোকজন তাঁকে চুপচাপ এড়িয়ে চলা নিরাপদ মনে করেন। মশহুর বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তাঁর Selfish Gene-এর শুরুতে তাই লিখেছেন :-

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রাণীবিদ্যা এখনো একটি গৌণ বিষয় রূপে বিবেচিত হয়, এমনকি যারা একে পাঠ্য হিসাবে বেছে নেন তারা এর প্রকাণ্ড দার্শনিক গভীরতা উপলব্ধি না করেই সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকেন। দর্শন ও ‘মানবিকবিদ্যা’ আজো এমনভাবে পড়ানো হয় যেন ডারউইন নামে কেউ কখনো ছিলেন না।১

প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে মানুষের পুরোনো ধ্যান-ধারণা পালটে দেওয়ার কারণে ডারউইন বিশেষজ্ঞ মহলে সমাদর লাভ করেছিলেন। তবে আমজনতা তাঁর তত্ত্বটি আজো খুব একটা বোঝেন বলে মনে হয় না। কথাটি অন্যভাবে ইসলামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে ইসলামের স্বরূপ সম্পর্কে ধর্মভীরু মুসলমানদের ধারণা স্পষ্ট নয়। জ্ঞানতত্ত্বের পৃথক দুটি শাখা বিজ্ঞান এবং ইসলামের মধ্যে এইখানে মিল রয়েছে। প্রাণের বিকাশ-বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় সাধারণ মানুষ অনেকসময় অপব্যাখ্যার শিকার হয়ে থাকেন। যদিও জৈব-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বিষয়টি ইতিমধ্যে প্রমাণিত যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষে পুরোনো ধ্যান-ধারণার সাহায্যে প্রাণের বিকাশকে যুক্তিযুক্ত প্রমাণের সুযোগ আর নেই! অনেকে সাম্প্রতিক বুদ্ধিদীপ্ত নকশা’র (Inteligent Design) কথা তুলতে পারেন। পৌরাণিক ও ঐশী গ্রন্থে জেনেসিস বা সৃষ্টিতত্ত্বের চটকদার বিবরণ রয়েছে। ইহুদি সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এ ঈশ্বরের ছয় দিনে জগৎ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। যার শুরুটি এরকম :-

শুরুতে ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। প্রথমে পৃথিবী সম্পূর্ণ শূন্য ছিল; পৃথিবীতে কিছুই ছিল না। অন্ধকারে আবৃত ছিল জলরাশি আর ঈশ্বরের আত্মা সেই জলরাশির উপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল। তারপর ঈশ্বর বললেন, ‘আলো ফুটুক!’ তখনই আলো ফুটতে শুরু করল। আলো দেখে ঈশ্বর বুঝলেন, আলো ভালো। তখন ঈশ্বর অন্ধকার থেকে আলোকে পৃথক করলেন। ঈশ্বর আলোর নাম দিলেন ‘দিন’, এবং অন্ধকারের নাম দিলেন ‘রাত্রি’।২

‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ অনুসারে এভাবে ঈশ্বর দ্বিতীয় দিনে আকাশ সৃষ্টি করেন। তৃতীয় দিনে জমি ও গাছপালা। চতুর্থ দিনে সূর্য ও গ্রহ-নক্ষত্র। পঞ্চম দিনে মাছ, পাখি ইত্যাদি। এবং ষষ্ঠ দিনে মানুষ ও জীবজন্তু সৃষ্টি করলেন। সবকিছু সৃষ্টির পর সপ্তম দিনে তিনি বিশ্রামে গেলেন।

বিবরণটি সুখপাঠ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্রষ্টা সম্পর্কে মানুষের চিরন্তন কৌতূহল ও কল্পনাশক্তির অসাধারণ ক্ষমতাটি এখানে ভাষা পেয়েছে। সৃষ্টি কেন বা কীভাবে হলো তার চটজলদি উত্তর প্রদানে ধর্মগ্রন্থগুলো খুবই পারঙ্গম। এইসব বিবরণকে প্রকারান্তরে বৈধ প্রমাণে ব্যস্ত বুদ্ধিদীপ্ত নকশা কেন গ্রহণযোগ্য নয় তা এই আলোচনার বিষয় নয়। প্রসঙ্গটিকে তাই পরবর্তী কোনো সময়ের জন্য মুলতবি রাখতে হলো। তবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণের উদ্ভব ও বিবর্তন সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মন দিয়ে পড়লে আইডি তত্ত্বের অসারতা সচেতন পাঠক নিজেই ধরতে পারবেন।

সে যাহোক, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অপব্যাখ্যা মানুষের বিজ্ঞান-চেতনার বিকাশে বাধা হিসাবে কাজ করে। আর ধর্মশাস্ত্রের অপব্যাখ্যা মুক্তচিন্তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামের ইতিহাসে মনগড়া ব্যাখ্যা ও মিথ্যা প্রচার-প্রচারণার দাপট তার প্রমাণ। অবিরাম প্রচারণার ফলে নিরেট মিথ্যা অনেকসময় সত্য হয়ে ওঠে। প্রোপাগান্ডা থেকে জন্ম নেওয়া মিথ্যা ক্ষতিকর মিথ বা অতিরঞ্জনে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে তখন অতিরঞ্জন সরিয়ে মিথ্যাটিকে দেখা সম্ভব হয় না। বরং আরো নতুন কিছু মিথ্যা ও অতিরঞ্জন তারা সেখানে যোগ করেন। মানুষের অগ্রসর চিন্তা-চেতনার পক্ষে বিষয়টি দুঃখজনক। কেননা এর ফলে বিচিত্র রঙের প্রতিক্রিয়াশীলতা জন্ম নিতে থাকে। বিজ্ঞান ও মানবিকবিদ্যার সকল শাখায় সমস্যাটি রয়েছে। তবে তাকে প্রতিরোধের নজির কিন্তু কম নেই। এম. এ. খানে’র বই সেরকম এক প্রতিক্রিয়ার তাগিদে লেখা। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে ডারউইনের চোয়ালভাঙা পরিশ্রম প্রচলিত ধ্যান-ধারণার গালে চড় কষিয়েছিল। দেড়শো বছর পর ইসলামের প্রচলিত ও বহুল স্বীকৃত ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে খান তাঁর বইটি লিখেছেন। গতানুগতিক বইয়ের ভিড়ে ব্যতিক্রম এই রচনাটি তাই পাঠকের নিবিড় অনুসরণ দাবি করে।

JIHAD

প্রকাশকঃ ব-দ্বীপ প্রকাশনী, ৬৩ কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লেক্স, ২৫৩-২৫৪ এলিফ্যান্ট রোড, কাঁটাবন, ঢাকা-১২০৫

এম. এ. খানে’র বইয়ের শিরোনাম থেকে স্পষ্ট যে ইসলাম ধর্মে জিহাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং দাস প্রথার স্বরূপ অনুসন্ধানের তাগিদে বইটি তিনি লিখেছেন। লেখকের অনুসন্ধানে মহানবি হযরত মোহাম্মদের প্রচারিত ধর্ম একটি প্রতিক্রিয়াশীল হুমকি হিসাবে গণ্য হয়েছে, যাকে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। কোনো লেখক প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলে পাঠকের জন্য তা অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। আরামকেদারায় হেলান দিয়ে ঘুম-ঘুম চোখে সেই লেখকটিকে আর পড়া যায় না। এই অবস্থায় পাঠকের দায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়। লেখকের দাবি (অথবা থিয়োরি) কীভাবে মিথ্যা ও অতিরঞ্জনকে চিহ্নিত করছে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হয়। মিথ্যার মোকাবিলায় তাঁর বক্তব্য যুক্তিনিষ্ঠ হলো কিনা তা পরিমাপের দুরূহ কাজটিও পাঠকের ঘাড়ে এসে চাপে। ডারউইনের সাথে প্রাণের বিকাশ-বিবর্তনের জগতে সফর করার সময় এরকম একটি অভিজ্ঞতা হয়। Origin of species কিংবা Descent of man-এ তথ্যের প্রয়োগ ও শৃঙ্খলাকে উপলব্ধি করতে না পারলে ডারউইনের ভাবনার নতুনত্ব পাঠকের কাছে অচেনাই থাকে। বহুল স্বীকৃত বা প্রচলিত ধারণার বিপরীতে বসে লেখা কোনো বইয়ে তথ্যের প্রাসঙ্গিকতা, যুক্তি ও থিয়োরি’র বিন্যাস নিয়ে তাই গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। কথাটি এম. এ. খানে’র বই সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। তথ্যের দিক দিয়ে ব্যাপক হওয়ার কারণে তাঁর বইয়ের যুক্তি-বিন্যাস উপলব্ধি করা পাঠকের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। এরকম কোনো বই থিয়োরির বিচারে কীভাবে গ্রহণযোগ্য হয় মনের মধ্যে সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং প্রশ্নটির উত্তর করেছেন। তাঁর নতুন গ্রন্থ ‘মহান নকশা’য় (The Grand Design) হকিং একটি উত্তম থিয়োরির ক্ষেত্রে চারটি শর্তের কথা বলেছেন। তাঁর মতে ভালো কোনো থিয়োরিকে অবশ্যই এই চারটি শর্ত পূরণ করতে হবে। শর্ত চারটি হলো :-

১. থিয়োরিটি নান্দনিক গুণাগুণ সম্পন্ন হবে; ২. তাকে ইচ্ছে করলে যে-কোনো ব্যাখ্যা ও মতামতের সাথে জুড়ে দেওয়া বা খাপ খাওয়ানো যাবে না। অর্থাৎ Flexibility এখানে লাগামহীন বিষয় হবে না; ৩. বর্তমান ও ভবিষ্যতে সংঘটিত পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষণকে সে সমর্থন করবে ও তার ব্যাখ্যার সঙ্গে এগুলোর সাযুজ্য থাকবে; এবং ৪. সেই থিয়োরির মধ্যে ভবিষ্যৎ রূপরেখার ইঙ্গিত সবিস্তারে পাওয়া যাবে।৩

আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হকিংয়ের শর্তের অনুগত। নিরেট বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে অস্বীকার করে কোনো থিয়োরি সেখানে উপস্থাপন করা হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় হকিংয়ের এই শর্তগুলো কমবেশি কাজে লাগানো সম্ভব। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উৎকর্ষ বিচারে তারা কাজে লাগে। আবার ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যাঁরা প্রয়োগ করেন তাঁদের ক্ষেত্রেও শর্তগুলো প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হতে পারে। যে-কারণে শিরোনাম ছাড়া আর কোনো মিল না-থাকলেও চারটি শর্তকে সমর্থনের প্রশ্নে খান ও ডারউইনের মধ্যে বিশেষ কোনো ব্যবধান নেই। এটি হলো তাঁদের মিল ও সম্পর্কের জায়গা। যেখান থেকে একটি রচনার গুরুত্ব এবং অদূর ভবিষ্যতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠার আভাস আমাদের চেতনায় ক্রিয়া করে। এম. এ. খানে’র বই নিয়ে বাতচিতের সময় বিষয়টি স্মরণ রেখে আমরা আগানোর চেষ্টা করবো।


বিশ্বের প্রভাবশালী ধর্ম ইসলামকে মুসলমান সম্প্রদায় মানবজাতির জন্য একটি ‘পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান’ (Code of life) বলে মনে করেন। মরুভূমির বুক থেকে উৎসারিত এবং আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায় বিশ্বাসী ধর্মটি তার অন্য দুই সহোদর ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের ন্যায় সেমেটিক ভাবাপন্ন। যদিও ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে জটিল মতবিরোধ রয়েছে। এই ধর্মের একনিষ্ঠ উপাসকরা কোরান-সুন্নাহ ও ফিকাহ’য় বর্ণিত জীবনকে মানুষের নৈতিক উৎকর্ষের শেষ কথা বলে মানেন, কিন্তু সমালোচকরা তা মানতে নারাজ। তারা অন্য ধর্মের প্রতি নবি মোহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেইসঙ্গে প্রতিমা উপাসক, বহু ঈশ্বর বা দেবতায় বিশ্বাসী সমাজ অথবা ঈশ্বরের অস্তিত্বে অনাস্থা পোষণকারীদের প্রতি ইসলামের নির্দয় আচরণের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। যে-কারণে ইসলাম সংক্রান্ত বক্তব্য কোনো সহমত তৈরির পরিবর্তে বাহাস বা Argument-এর জটিল জালে ঘূর্ণিত হয়। এম. এ. খান বিদ্যমান সেই প্রথাকে অনুসরণ করে অগ্রসর হয়েছেন।

পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন পথের দিশারী রূপে ইসলামের আবির্ভাব, তার জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি, প্রচলিত ধর্মগুলোর সঙ্গে মতবিরোধ ও সংঘাতের কারণ এবং বিশ্বব্যাপী প্রসার লাভের ঘটনাকে ঐতিহাসিক তথ্যের সাহায্যে লেখক বোঝার চেষ্টা করেছেন। মানব সভ্যতায় নবি মোহাম্মদ ও তাঁর প্রচারিত ধর্ম নিয়ে কিছু লিখতে গেলে তথ্যের উৎস খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। বইয়ের মুখবন্ধে লেখক এ-সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন :-

এই বইটি মানবীয় ও অতিমানবীয় পণ্ডিত এবং লেখকদের বিবরণের উপর নির্ভর করেছে; কাজেই সকল কৃতিত্ব তাঁদের প্রাপ্য। সবার আগে কোরানের স্রষ্টা আল্লাহর নাম উল্লেখ করতে হয়; হাদিস সংকলক আল-বোখারি, আবু মুসলিম ও আবু দাউদ, নবি’র জীবনী লেখক ইবনে ইসহাক ও আল তাবারি, এবং মোহাম্মদ ফেরিশতা, ইবনে বতুতা, এইচ. এম এলিয়ট ও জে ডাওসন. জওহরলাল নেহেরু, কে. এস লাল, জাইলস মিল্টন, বার্নাড লুইস, ভি. এস নাইপল, জি. ডি খোসলা, পি. কে হিট্টি, এম. উমরউদ্দিন, এন্ড্রু বোস্টম, আর. এম ইটন, বাহারিস্তান-ই-শাহী ও আলবেরুনী’র ইন্ডিয়া তাদের মধ্যেই পড়েন।৪

খান যে উৎসগুলো উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে তিনটি বিভাগ চোখে পড়ে। প্রথম ভাগে রয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ্। মহাগ্রন্থ ‘আল কোরান’-এর রচয়িতা। সমগ্র মানবজাতির জন্য ওহি আকারে অমূল্য এই গ্রন্থটি তিনি নাজিল করেছেন। আল্লাহ্ স্বয়ং কোরানের স্রষ্টা হওয়ার কারণে এই গ্রন্থের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহ পোষণের অধিকার ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তির নেই। উৎসের দ্বিতীয় ভাগে আছেন নামকরা মুসলমান পণ্ডিতগণ। ইসলামী জীবনবোধের ভিত্তি শাহাদা ও ইমান-আকিদার একনিষ্ঠ অনুসারী বিদ্বানদের বক্তব্য নিয়ে মোটের উপর কোনো সংশয় নেই। উৎসের তৃতীয় ভাগে রয়েছেন ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ও ইসলামী জীবনধারার ঘনিষ্ট পর্যবেক্ষক অমুসলমান বিশেষজ্ঞগণ। কতিপয় ঘটনার কারণে ইসলামের সমালোচনা করলেও মানব সভ্যতায় নবি মোহাম্মদের অবদানকে তাঁরা ইতিবাচক মনোভাব সহকারেই বিশ্লেষণ করেছেন।

এই তিনটি উৎসের বাইরে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র খান তাঁর গ্রন্থে ব্যবহার করেছেন। মুসলমান ঐতিহাসিকদের রচিত গ্রন্থ এবং রাজা-বাদশাহদের জীবনী, চিঠিপত্র ও ফরমান যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এ-প্রসঙ্গে একটি কথা বলা উচিত। বইয়ের পরিশিষ্টে গ্রন্থতালিকায় (Bibliography) লেখক যেসব উৎস থেকে তথ্য ধার করেছেন তার একটি তালিকা দিয়েছেন। তালিকাটি ভালো করে লক্ষ করা প্রয়োজন। কেননা ইসলাম-সম্মত জীবনবোধের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে কেন্দ্র করে বিশেষজ্ঞ মহলে বিপরীতমুখী দুটি প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে। তথ্যের উৎস বা ব্যবহারের প্রশ্নে প্রবাহ দুটি পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক। তাদের গ্রন্থতালিকায় মিল থাকলেও দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তা-চেতনার মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। খান তাঁর গ্রন্থে ইসলামকে কী কারণে ‘প্রতিক্রিয়াশীল হুমকি’ মনে করেন সেই উত্তর হয়তো এই মতবিরোধের মাঝে লুকিয়ে রয়েছে। লেখার প্রাসঙ্গিক অংশে এ-নিয়ে আলোচনা জরুরি হয়ে উঠবে বলে কথাটি আগাম বলে রাখা।

এম. এ. খান তাঁর গ্রন্থে বিপুল পরিমাণ তথ্য ব্যবহার করেছেন। সুবিপুল এই তথ্যভাণ্ডারের পাঠ, বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিক প্রয়োগ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য একটি কাজ। কঠিন সেই কাজটি তিনি বেশ সাফল্যের সাথে সমাধা করেছেন। এ-ধরনের বইয়ে সংগৃহীত তথ্যের সূক্ষ্ম পঠন (Critical Reading) অনেকসময় জরুরি হয়ে পড়ে। অন্যথায় লেখকের বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে পাঠকের মনে নানা সন্দেহ তৈরি হয়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন কোনো তথ্য যাচাই হওয়ার সময় অনেকগুলো দৃষ্টিভঙ্গির সম্ভাবনা ধারণ করতে পারে। যার মধ্যে সবচেয়ে অকাট্য ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা গ্রহণ করে থাকি। ইসলামের স্বরূপ অন্বেষণ এবং তার প্রচার-প্রতিষ্ঠায় জিহাদের ভূমিকা আলোচনার সময় খান বিষয়টি মনে রাখার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বক্তব্যে সরলীকরণ ঘটেনি এমনটি দাবি করা যাবে না। সূক্ষ্ম পঠন-এর (Critical Reading) ঘাটতিও মাঝেমধ্যে চোখকে পীড়িত করেছে। সেটি নিয়ে আমরা যথাস্থানে আলোচনা করবো। তবে এই দোষটুকু ছাড়া ইসলামের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে এরকম তথ্য সমৃদ্ধ বই সহজে চোখে পড়ে না। লেখক এর জন্য সাধুবাদ দাবি করতে পারেন এবং অকুণ্ঠচিত্তে সেটি তাঁকে দেওয়া উচিত।

খানে’র বইয়ের পাতায়-পাতায় খাটুনির ছাপ স্পষ্ট হলেও তাঁর যুক্তিপ্রণালী অনেকের কাছে তির্যক মনে হবে। ইসলাম সম্পর্কে স্পর্শকাতর পাঠকরা এজন্য লেখকের উপর মনঃক্ষুণ্ন হতে পারেন। এ-ব্যাপারে লেখকের সমর্থনে দু’চারটি কথা বলার আছে। জ্ঞান উৎপাদনের নামে প্রতিদিন সারা বিশ্বে অজস্র বাজে ও গতানুগতিক বইপত্র বেরোয়। কিন্তু প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে আঘাত করতে সক্ষম বইয়ের সংখ্যা হাতের কড়ে আঙুলে গোনা যাবে। গতানুগতিকের ভিড়ে এরকম কোনো বই পেলে আমরা তার প্রশংসা করি। এম. এ. খানে’র বইয়ে সেই লক্ষণ পাঠকের খুঁজে পাওয়ার কথা।

আরেকটি কথা, পূর্ব-সংস্কার ও ভাবাবেগের কারণে সাধারণ মানুষ প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সমালোচনা করা হয়েছে শুনলে ভয় পান। ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা এড়াতে তারা তখন আঘাতকারী ব্যক্তিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। নতুবা তার উপর খেপে ওঠেন। জ্ঞানের গতিশীল স্বভাবের পক্ষে দৃশ্যটি বেমানান। আপত্তিকর তো বটেই! সুতরাং প্রচলিত বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণাকে আঘাত করার জন্য লেখকের উপর ক্ষুব্ধ না হয়ে তাঁর যুক্তির গভীরতা পরিমাপ করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ইসলামভীরু পাঠকরা সেক্ষেত্রে সহনশীলতার পরিচয় দেবেন এই আশা রেখে বইয়ের খুটিনাটি কিছু প্রসঙ্গ ও পরিপূরক আলোচনাটি এবার সেরে নেওয়া যেতে পারে।


এম. এ. খানে’র বইটি বেশ মোটাসোটা। মুদ্রিত সংস্করণ চারশো পৃষ্ঠার চেয়ে বেশি। আর অনলাইন (পিডিএফ) সংস্করণটি তিনশো পৃষ্ঠার কাছাকাছি। প্রায় আট বছরের নিবিড় অনুসন্ধানের ফসল ঘরে তোলার তাড়া থেকে বইটি তিনি প্রকাশ করেছেন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভালো লেখক ইসলামী শাস্ত্রে ডিগ্রিধারী কোনো বিশেষজ্ঞ নন। গ্রন্থের শুরুতে স্বীকার করেছেন ২০০১-এ সংঘটিত ৯/১১-এর ঘটনা তাঁকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। জোড়া দালান (Twin Tower) ধসের ঐ ঘটনাটি না-ঘটলে ইসলাম হয়তো তাঁর আগ্রহের বাইরে থেকে যেতো। মুসলমান পরিচয়টুকু ছাড়া ইসলামী ইমান-আমলের সাথে লেখকের সান্নিধ্য তাই নিবিড় ছিল না। ভারতবর্ষে বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়ার পরেও ছিল না। খান তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন রক্ষণশীল মুসলমান সমাজে জন্মগ্রহণ করলেও সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে বড়ো হওয়ার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। সেইসঙ্গে অন্য ধর্মের অনুসারী ও উদারমনা মানুষজনের সাথে ওঠ-বসের ফলে সংখ্যালঘুর চিরাচরিত অভিমান তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি।

সে যাহোক, খানে’র বিবৃতি থেকে এটা পরিষ্কার যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান তাঁকে আকর্ষণ করেনি। কাজেই এগুলো মেনে চলার প্রশ্নও ওঠেনি। তবে ইসলাম ধর্মের প্রতি পশ্চিমের পুঁজিবাদী শক্তি বৈরী মনোভাব পোষণ করে,-বহুল প্রচলিত এই অভিযোগে তিনি নিজেও বিশ্বাস করতেন। এ-ব্যাপারে তাঁর মনে কখনো কোনো প্রশ্ন জাগেনি। সারাবিশ্বে ইসলামী জঙ্গিবাদ ও সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে অনেকে দায়ী করেন। দায়ী শুধু মুসলমানরা করেন এমন নয়। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ঘোর বিরোধী বামপন্থী থেকে শুরু করে বহু উদার ও মুক্তমনা মানুষ জঙ্গিবাদের ঘটনায় লাদেন গংদের চেয়ে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তিকে আসল ভিলেন বলে ভাবেন। খান নিজেও তাই ভাবতেন। মুখে বলেননি, কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না, ওরিয়েন্টাল আবেগে আক্রান্ত সাঈদ-চমস্কি-অরুন্ধতি’র মতো বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া তাঁকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল। আর দশজন ধর্মভীরু মুসলমান ও Oriental Hegemony-র বুদ্ধিজীবীতায় বিভোর সুশীল সমাজের সাথে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনার ফারাক তখন ছিল না। কিন্তু ৯/১১ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ লেখকের চেতনায় আমূল পরিবর্তন ঘটায়। ভারতবর্ষের মুসলমানী ঐতিহ্যে বেড়ে ওঠা মানুষ হিসাবে তাঁর মধ্যে ইসলামকে গভীরভাবে বোঝার আগ্রহটি তৈরি হয়। ইসলামী বইপত্র ও রেফারেন্স ঘাটাঘাটির সেই শুরু। ২০০৮-এ felibri.com তাঁর সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেন। তখন থেকে নবি মোহাম্মদ ও ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণাগুলো দূর করা তাঁর মিশন হয়ে ওঠে। যার ফলস্বরূপ ইসলাম-ওয়াচ (http://www.islam-watch.org/) নামে একটি ওয়েব সাইট সম্পাদনার কাজ তিনি হাতে নেন।

মোটা দাগে এই হলো এম. এ. খান ও তাঁর বই লেখার নেপথ্য কাহিনী। এখানে অবশ্য ‘কাহিনী’র বদলে ‘তৎপরতা’ শব্দটি বসানো উচিত ছিল। কারণটি ব্যাখ্যা করেই বলি। মানবসভ্যতা একুশ শতকে পা দিয়েছে। কিন্তু সমাজ থেকে ধর্মীয় সংকীর্ণতা পুরোপুরি দূর হয়নি। আসমান থেকে প্রেরিত ওহি’র সাথে মানুষের সৃষ্ট জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার বিরোধ আজো বহমান। মানুষের সৃজনশক্তিকে ওহি’র মাধ্যমে পাওয়া জ্ঞানের সাহায্যে খাটো করে দেখার পুরোনো ছক তাই সুযোগ পেলে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। চলমান একুশ শতকে নিজের প্রভাব ধরে রাখার জন্য তার উদ্যমের শেষ নেই। এই জ্ঞানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী মুরুব্বিরা তাঁদের ওয়াজ-নসিহতে মানুষকে জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করেন। হাদিসে জ্ঞান আহরণের খাতিরে সুদূর চিন দেশ ভ্রমণের কথা বলা হয়েছে। বিখ্যাত এই রূপকটিকে ওহি’র সত্যতায় বিশ্বাসী মুসলমানরা অহরহ ব্যবহার করে থাকেন। অথচ সেই জ্ঞান অর্জনের প্রশ্নে নসিহতকারী মুরুব্বিদের আচরণ খুব একটা সুবিধের হয় না। ওহি থেকে পাওয়া জ্ঞান ও প্রেরণা নিয়ে প্রশ্ন বা সমালোচনা করা হলে তাঁরা তখন ভোল পাল্টে ফেলেন। সমালোচনাকে স্তব্ধ করার জন্য আকাশ থেকে হেঁয়ালি ও রহস্যীকরণের হাওয়াই মিটাই বর্ষণ করতে শুরু করেন। নতুবা সন্দিহান ব্যক্তিকে উপরওয়ালার গজব এবং শাপ-শাপান্তের তীরে অতিষ্ঠ করে মারেন।

ওহি’র অস্তিত্বে বিশ্বাসী ব্যক্তির নিকট জ্ঞানের উপমাটি হচ্ছে বন্ধ জানালা দিয়ে আকাশ দেখার মতো একটি ঘটনা! মানব সভ্যতায় প্রশ্ন, সন্দেহ ও বিনির্মাণ হলো জ্ঞান সৃষ্টির মৌলিক উপাদান। এগুলো ছাড়া নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হবে না। পুরোনো জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতাকে যাচাই করাও সম্ভব নয়। কিন্তু ওহি-বিশ্বাসী মানুষ সেক্ষেত্রে ঘোরতর রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করে থাকেন। উপরওয়ালা যদি সাত আসমান থেকে জ্ঞান নামক ‘মান্না ও সালওয়া’ বর্ষণ করেন তবেই তাদের পেট ভরে। অন্যথায় নয়। এখানে প্রশ্ন, সন্দেহ ও বিনির্মাণকে তাই দাবিয়ে রাখা হয়। নতুবা এই শর্তে অনুমতি দেওয়া হয় যে এগুলো জ্ঞান অর্জনের আসমানী তরিকাকে সত্য প্রমাণের জন্য ব্যবহৃত হবে। মুক্তমনা কোনো মানুষের পক্ষে সেই শর্ত মেনে এক পা আগানো সম্ভব নয়। তার কাছে শর্তটি পরিহাস মনে হয়। যেহেতু জ্ঞানকে এভাবে উৎপাদন করা যায় না। এতে বরং অজ্ঞানতা, অপব্যাখ্যা ও সরলীকরণের বিপদ ঘনায়!

জ্ঞানের স্বকীয়তার উপর এইসব জোরজুলুমের বিরুদ্ধে মুক্তমনা মানুষজন আজো লড়াই করে যাচ্ছেন। জ্ঞান উৎপাদনের নামে তথ্যের ক্ষতিকর রহস্যীকরণের বিরুদ্ধে পরিচালিত লড়াইকে শুধু ‘কাহিনী’ বলা হলে মানবসভ্যতায় তার প্রতিক্রিয়া ঠিক বুঝিয়ে ওঠা যায় না। এ হলো আসমান থেকে প্রেরিত জ্ঞানের জোরদার ‘তৎপরতা’র বিপরীতে মুক্তমনাদের পাল্টা ‘তৎপরতা’। পৃথিবীতে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির ইতিহাস জারি রাখতে যার কোনো বিকল্প নেই।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে,-ওহি’র উপর নির্ভরশীল জ্ঞানটি তাহলে টিকে আছে কীসের জোরে? মানবমন গতিশীল। সেই মনকে দীর্ঘদিন ধরে পুরোনো জ্ঞানের গোলকধাঁধায় চক্কর খাওয়ানো কী করে সম্ভব! এক কথায় এই প্রশ্ন ও বিস্ময়ের উত্তর করা মুশকিল। ‘বন্ধ জানালা দিয়ে আকাশ দেখা’র জ্ঞান টিকে থাকার পেছনে বহু কারণ থাকতে পারে। প্রথা-ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের সহজাত সংস্কার তাকে টিকিয়ে রাখে। অজ্ঞতার কারণে সে টিকে থাকে। পুরোনো ধ্যান-ধারণায় আবিষ্ট মানুষ তাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। এবং, নতুনকে গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষের চিরায়ত ভয়কে কাজে লাগিয়ে সে টিকে যেতে পারে। এছাড়া আরো কারণ রয়েছে। ওহি’র জ্ঞান বা আসমানী প্রেরণাকে জীবিত রাখার পেছনে সুবিধাভোগী কিছু মানুষ ক্ষতিকর ভূমিকা রাখেন। সেই ভূমিকার পেছনে আর্থ-সামাজিক কার্যকারণ গতিশীল থাকে। মিথ্যা ও প্রোপাগান্ডা উৎপাদনের জটিল সব হেঁয়ালি থাকে। সর্বোপরি থাকে রাজনীতি। এম. এ. খানে’র সমসাময়িক লেখকরা তাঁদের বইপত্রে সাত আসমান থেকে প্রেরিত জ্ঞানের এই টিকে থাকার প্রশ্ন ও বিস্ময়কে বোঝার চেষ্টা করেছেন। পাঠক ইচ্ছে করলে তাঁদের ব্যাখ্যার সাথে নিজের ভাবনাকে মিলিয়ে নিতে পারেন।

উপরে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হলো তার সবটাই সত্য। তবে মানুষের সাম্প্রতিক জীবনধারাও এর জন্য কমবেশী দায়ী। যন্ত্রনির্ভর জীবনের সর্পিল গতির সাথে মানিয়ে নেওয়া আসলেই কঠিন। এই চাপ সামলাতে গিয়ে মানুষ নানা স্ববিরোধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। যে-কারণে ওহি-নির্ভর জ্ঞানের উপযোগিতা শেষ হয়েও হচ্ছে না। আত্মার ক্ষুধা মিটানোর অজুহাতে নতুন করে সে আবার জাগতে চলেছে। কর্পোরেট সংস্কৃতির এই যুগে মানুষের জীবনে গতিবিকার ও মনোবিকার পরস্পরের হাত ধরে চলে। দুই সহোদরের চাপে নিঃস্ব জীবনে ওহি’র অবতরণ কিংবা আসমানী প্রেরণা লাভের উপায় নিয়ে ভাবনা করার লোকজন এখনো রয়েছেন। পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলোয় তাদের সংখ্যাটি ব্যাপক। আবার ভোগসর্বস্ব জীবনের পেছনে ফতুর উন্নত দেশেও তাদের দেখা মিলবে। সভ্যতার গরিমায় মোহিত উন্নত সমাজব্যবস্থায় নৈঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্নতা, অহম ও মনোবিকলনের সমস্যা মানুষকে বিভ্রান্তির সর্পিল গুহায় বন্দি করে রাখে। যা আবার নৈরাশ্য ও অবসাদের অন্যতম কারণ। মানুষের জীবনে আসমানী প্রেরণা হ্রাস পাওয়ার ফলে ব্যাধিগুলো প্রকট হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। সুতরাং তাকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চলছে সেখানে। যদিও গতিবিকলনে অস্থির সেই সমাজে অবিশ্বাসের আধিক্য সবার আগে চোখে পড়ে। কর্মযজ্ঞের ডামাডোলের মধ্যে আসমানী প্রেরণা সেখানে কতোটা ভূমিকা রাখতে পারবে সেটাই প্রশ্ন!

উপরের আলোচনা থেকে বোঝা গেলো বিশ্বের উন্নত দেশে ওহি-নির্ভর জ্ঞান ও আসমানী প্রেরণা এখনো জীবিত রয়েছে। তবে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার এবং ব্যক্তির জীবনকে তারা সরাসরি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে না। ‘বন্ধ জানালা দিয়ে আকাশ দেখা’র ঘটনায় বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়টিকে সেখানে ব্যক্তির নিজস্ব বোধ, অভিজ্ঞতা আর সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একটি উন্নত রাষ্ট্র বিচিত্র চেতনা বা বিশ্বাসের মাঝে তরঙ্গিত হয়। যার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্যক্তি, সম্প্রদায় অথবা জাতি তাদের নিজস্ব মূল্যবোধের অনুশীলন করেন। আচার-অনুষ্ঠান চর্চার স্বাধীনতাও ভোগ করেন। আসমান থেকে প্রেরিত গায়েবি ধর্ম সেখানে সাংস্কৃতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাঝে বিচরণ করতে বাধ্য থাকে। এছাড়া অন্য কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগ তার নেই। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিশ্বাস কেন্দ্রিক আচরণ সামূহিক কোনো সর্বনাশের কারণ না-হলে তাকে প্রতিরোধের জন্য উন্নত দেশগুলো মরিয়া হয়ে ওঠে না। কিংবা আসমানী প্রেরণার সমালোচনা করার অপরাধে চটজলদি সেন্সরশিপ আরোপ করে না। ব্যক্তির মতামত প্রকাশের অধিকারকে সেখানে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। উন্নত দেশগুলো ভারসাম্যের নীতিকে তাই কঠোরভাবে মেনে চলে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও পুঁজির বিশ্বায়নের স্বার্থে তারা তা মেনে চলে। এর পেছনে তাদের সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি হয়তো কাজ করে। অনুন্নত দেশগুলোর উপর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আধিপত্য আরোপের নানা ছল-বাহানাও থাকে। তবে দণ্ডনীতির সূক্ষ্ম প্রয়োগের কারণে উন্নত দেশগুলোয় প্রশ্ন, সন্দেহ ও বিনির্মাণের অবাধ এক বিচরণক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের (Cultural Diversity) ফলে তাদের সমাজব্যবস্থায় বিপরীতমুখী মত-পথের সক্রিয়তাকে স্বাভাবিক চোখে দেখা হয়। তার শক্তি ও অনন্যতা এতেই নিহিত!

একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা যাক। ইউরোপীয় রেনেসাঁকে অনেকে আধুনিক মানব সভ্যতার মাইলফলক বলে বিবেচনা করে থাকেন। রেনেসাঁর ফসল আলোকায়নের (Enlightenment) প্রশস্তিতে পশ্চিমের বিদ্বান ব্যক্তিরা সুযোগ পেলেই মুখিয়ে ওঠেন। কিন্তু ফরাসি পণ্ডিত মিশেল ফুকো’র গবেষণা আলোকায়নের অবদানকে অতিকথন বলে বাতিল করে। মানব সভ্যতায় আলোকায়নের প্রকৃত স্বরূপ ও আবেদন নিয়ে ফুকো প্রশ্ন তোলেন। যার ফলে এ-সম্পর্কে তীব্র কলহের সৃষ্টি হয়। বিতর্ক ও সন্দেহের ঝড় ওঠে। যা এখনো চলছে। তো এই অপরাধের জন্য কেউ ফুকো’র টুঁটি চেপে ধরেনি। বরং তাঁর গবেষণাকে ভিত্তি করে জ্ঞানের নতুন বিনির্মাণ ঘটছে। যে-কারণে ওরিয়েন্টাল, সাব-অলটার্ন ও উত্তরাধুনিক সমালোচনার তোড়ে আলোকায়নের দাবিটি অহরহ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকে।

জ্ঞানের বিপরীতমুখী প্রবণতাকে তার গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে পশ্চিমে উৎসাহিত করা হয়। রেডিমেড তত্ত্বের অভাব সেখানেও নেই। তবে প্রশ্ন, সন্দেহ ও বিনির্মাণের ঝড় মোকাবিলা করে তাকে টিকে থাকতে হয়। তত্ত্ব হিসাবে নিজের গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। যে-কারণে ওহি-নির্ভর জ্ঞান ও আসমানী প্রেরণার মতো রেডিমেড তত্ত্ব নিয়ে হুজুগ থাকলেও সেখানে তারা সহজে পার পায় না। আত্মার খিদে মিটানোর বাহানায় মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে ধরে বলাৎকার করতে পারে না। বরং সেই সৃষ্টিশীলতার কণ্ঠরোধ করতে গেলে শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়।

শৃঙ্খলার নাম করে শৃঙ্খল তৈরির জন্য পশ্চিমের সমাজব্যবস্থাকে ফুকো অভিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর অভিযোগটি অমূলক নয়। তবে ফুকোর যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা স্বীকার করেই বলতে হয়, আলোকায়নের ফলে পাশ্চাত্যের দেশগুলো খ্রিস্টান ধর্মের জগদ্দল দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছিল। মুক্তচিন্তা ও যুক্তি প্রয়োগে স্বকীয়তা অর্জনের কারণে বহুল প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সংশোধন এবং বিনির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। পশ্চিমে এখন ওহি-নির্ভর জ্ঞান ও আসমানী প্রেরণার পরিবর্তে মানুষের তৈরি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলাকে সভ্যতার নিয়ামকশক্তি বিবেচনা করা হচ্ছে। যার প্রভাবে মানুষ সেখানে সার্বভৌম এককে পরিণত হতে পেরেছে।

পৃথিবীর অনুন্নত দেশ এবং তাদের অনগ্রসর সমাজব্যবস্থায় মানবায়নের এই স্বরূপ যথেষ্ট সুলভ নয়। আর ইসলাম-শাসিত বিশ্বে মানবায়ন হচ্ছে এক অকল্পনীয় ঘটনা! আসমান থেকে প্রেরিত ওহি’র জ্ঞানকে সহি প্রমাণে ‘তৎপর’ ইসলামী শক্তি মানুষের ইহজাগতিক চেতনাকে প্রাপ্য মর্যাদা দানে সবসময় কুণ্ঠা প্রকাশ করেছে। আল্লাহ্ ও নবি’র সার্বভৌম ক্ষমতায় ইমান আনার প্রশ্নে শরিয়াপন্থীরা আপোসহীন মনোভাব পোষণ করেন। মানুষের ইহজাগতিক উৎকর্ষকে ছোটো করে দেখার প্রবণতা তাঁদের মধ্যে প্রবল। মানবজাতির সৃষ্টিশীলতাকে আল্লাহর মহিমা বলে জাহির করা এবং ইমানী নিশানায় সেটি পরখ করার ব্যাপারে এই শরিয়াপন্থীরা চিরকাল অতি উৎসাহ দেখিয়ে এসেছেন। একুশ শতকের মুক্তমনা নাগরিকের পক্ষে সেই উৎসাহ চুপচাপ সয়ে যাওয়া কঠিন। আটলান্টিকের ওপারে বসে এম. এ. খানে’র ইসলাম নিয়ে ‘তৎপর’ হওয়ার কাহিনীটি তাই বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না। ইসলাম-স্বীকৃত সার্বভৌম চেতনার মধ্যে লেখক মানবায়নের বীজ দেখতে পাননি। তাঁর মতে আল্লাহ্ ও নবি’র খেয়ালখুশিতে ভরা আসমানী বিশ্বাসটি ‘বন্ধ জানালা দিয়ে আকাশ দেখা’র বিফল চেষ্টাই শুধু করে গেছে। মানুষের মর্যাদাকে হেয় ও তুচ্ছ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো প্রগতি সেখানে যোগ হয়নি!

গতিশীল বিশ্বে ইসলামের মতো স্থবিরতা-প্রিয় শাসকের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে লেখক তাই নিঃসঙ্কোচে প্রশ্ন তুলেছেন। তার কঠোরচিত্ত স্বভাবের সমালোচনা করেছেন। যদিও ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনার ক্ষেত্রে তার পুতঃপবিত্র সারল্য ও সহজতার কথা বলা হয়ে থাকে। সাম্য, উদারতা, ক্ষমাশীলতা ও পরমত-সহিঞ্চুতার গুণগান প্রচার করা হয়। পৃথিবীতে আল্লাহর রাজ প্রতিষ্ঠার দাবিতে এই ধর্মের অনুসারীদের অকল্পনীয় আত্মত্যাগ ও ইমানী দৃঢ়তার খুতবা বর্ষিত হয়। সেইসঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মণীষায় তার অভূতপূর্ব অবদানকে বারবার বাজানো হতে থাকে। কিন্তু দীর্ঘ অনুসন্ধানে এম. এ. খান এইসব প্রচারণার সাথে সত্যের কোনো মিল খুঁজে পাননি। তাঁর ক্ষেত্রে বিষয়টি হয়েছে ঠিক উল্টো। ‘সারল্য’র পরিবর্তে তিনি দেখতে পেয়েছেন জটিল ও অর্থহীন আচার-বিশ্বাসের আধিক্য। ‘সাম্য, উদারতা, ক্ষমাশীলতা ও পরমত-সহিঞ্চুতার’ পরিবর্তে পেয়েছেন দাসত্ব, ক্রূরতা, নৃশংসতা আর অনাবশ্যক নিষ্ঠুরতার অজস্র নমুনা। ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মণীষা’র ক্ষেত্রে দেখেছেন সেন্সরশিপের কঠিন তালা ঝুলছে। নতুবা জ্ঞানসৃষ্টির অজুহাতে অনুকরণ ও বিরামহীন মিথ্যার বেসাতী করা হচ্ছে। আর ‘আল্লাহর রাজ প্রতিষ্ঠার দাবিতে’ সংঘটিত ‘ইমানী দৃঢ়তা’র মাঝে খোঁজ পেয়েছেন এক জিহাদী সংকল্পের, যেটি বিগত দেড় হাজার বছর ধরে অকল্পনীয় ঘৃণা ও বর্বরতার দ্বারা মানুষের আত্মাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে! এইসব মিলিয়ে খানে’র অনুসন্ধানী ভ্রমণকে ‘কাহিনী’ বলা হলে সত্যের অপলাপ হবে। ইসলামী জীবনাচারে বহুল স্বীকৃত কিছু মিথ্যা ও অতিরঞ্জনের বিরুদ্ধে ‘তৎপর’ প্রতিক্রিয়া থেকে বইটি লেখা। সেই ‘তৎপরতা’য় ইসলাম নিয়ে লেখক তাঁর আপত্তি ও অভিযোগের কথা লিখেছেন। আলোচনার ‘দ্বিতীয় প্রবাহ’-এ যার মূল অংশটি অনুসরণ করা যেতে পারে।
… … …

দ্বিতীয় প্রবাহ

বিশ্বব্যাপী আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় নবি’র একচ্ছত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার তত্ত্বে মুসলমান সম্প্রদায়ের আচরণকে এম. এ. খানে’র কাছে ‘সাম্প্রদায়িক’ মনে হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘সাম্রাজ্যবাদী’ শব্দটিও তিনি যোগ করার পক্ষে। ইসলামকে কেন ‘সাম্রাজ্যবাদী’ আখ্যা দেওয়া উচিত তার সপক্ষে তথ্যবহুল যুক্তি তাঁর বইয়ের সবচেয়ে পরিশ্রমী ও প্রয়োজনীয় অংশ। বইয়ের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম পরিচ্ছেদ জুড়ে সাম্রাজ্যবাদ, আরব জাতীয়তাবাদ ও ক্রীতদাস প্রথার পৃষ্ঠপোষক হিসাবে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা আর তৎপর বিশ্লেষণ পাঠককে চুম্বকের মতো ধরে রাখে।

বইয়ের এই তিনটি পরিচ্ছেদ স্নায়ুর উপর চাপ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। বিশ্বব্যাপী ইসলামী জীবনবিধান কায়েমের সংকল্পে কাফের পরিবেষ্টিত দেশগুলোয় মোহাম্মদের গর্বিত অনুসারীরা বারবার হানা দিয়েছেন। ভারত, পারস্য, মিশর, গ্রিসের মতো প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী জাতি-গোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার সেইসব বিবরণ পাঠ করে গা শিউরে ওঠে। ইসলামের ছদ্মবেশে আরব জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার মিশনে ভারতবর্ষ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ইত্যাদি), আফ্রিকা ও ইউরোপের একের-পর-এক জনপদে ইসলামের অগ্রসৈনিকরা হামলা ও আগ্রাসন চালিয়েছেন। প্রতিটি আগ্রাসনে সংঘটিত গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মন্দির ও দেবালয় ধ্বংস, নারী ও শিশুদের মালে গণিমত হিসাবে ব্যবহারের তথ্যগুলো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। অথচ বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো নিপীড়ন-নির্যাতনের সেইসব কাহিনীতে বোঝাই হয়ে আছে। যার হৃদয়বিদারক চাপ পাঠকের স্নায়ুর পক্ষে মর্মান্তিক হয়ে ওঠে!

খান তাঁর বইয়ের প্রাসঙ্গিক অনুচ্ছেদে ভারতবর্ষ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় অন্য ধর্মের অনুসারী নাগরিকদের ইসলাম গ্রহণের প্রচলিত কাহিনীর সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। যে-কারণে ভারতবর্ষের মতো বিরাট ভূখেণ্ড মোট জনসংখ্যার পঁচিশ শতাংশ কীভাবে ইসলামের ছায়াতলে এলো এবং অবশিষ্টরা কেন এলোনা সেই প্রশ্নের উত্তরটি তাঁকে খুঁজতে হয়েছে। প্রতিমা উপাসনায় মগ্ন এই ভূখণ্ড ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ইসলাম তরবারির মাধ্যমে, বণিক-পর্যটকদের সাহায্যে এবং সুফি-দরবেশদের আধ্যাত্মিক প্রচারণার প্রভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়ে থাকেন। এম. এ. খান এই তিনটি মতামতকে উপযুক্ত তথ্য সহকারে খণ্ডন করেছেন। সেইসঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তির সাহায্যে বিশেষজ্ঞদের মতামতকে ভুল প্রমাণের জন্য যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর মতে চলমান বিশ্বে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান Pact of Umar-এর মতো একপেশে চুক্তির মাধ্যমে কার্যকর করা হয়েছে। মহান সাহাবী ও দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবনে আল-খাত্তাব সিরিয়ার খ্রিস্টান শাসকের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। চুক্তিতে তিনি সিরিয়ায় বসবাসরত খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে মুসলমানদের অধীনে ‘ধিম্মি’(বা জিম্মি) হিসাবে নিরাপত্তা প্রদানের ব্যাপারে কিছু শর্ত আরোপ করেন।৫ ইতিহাসে তা Pact of Umar (দ্রষ্টব্য: http://wikiislam.net/wiki/A_Brief_Analysis_of_the_Pact_of_Umar) নামে পরিচিত। সিরিয়ার শাসক বাধ্য হয়ে সেই শর্তগুলো মেনে নেন এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। নিজেকে খ্রিস্টান কল্পনা করে কেউ যদি চুক্তিটি পড়েন তবে একে মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা একপেশে এই চুক্তির মধ্যে নিজের ধর্ম পালনের কোনো স্বাধীনতাই তার থাকে না। Pact of Umar-এর ছকটি কীভাবে একের-পর-এক জনপদে আরোপ করা হয়েছে তার নিষ্ঠুর বিবরণ লেখক দিয়েছেন।

খানে’র এই বিবরণ নিপীড়ন-নির্যাতন আর প্রতিরোধে ভরা বিক্ষুব্ধ এক ইতিহাসের সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে রাখে। ভারতবর্ষে ইসলামের প্রথম নিশান বরদার সিন্ধু বিজেতা মোহাম্মদ বিন কাশিমের উত্তাল লুণ্ঠন, উত্তর ভারতের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন বা সম্ভ্রম হরণে সুলতান মাহমুদের সতেরোটি হিংস্র অভিযান, এক লক্ষ দিল্লিবাসীর রক্তে স্নাত টেমার লেনের (আমির তিমুর) ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ, মরক্কোর শাসক মাওলা ইসমাইলের ক্রীতদাস শিকার ও শ্বেতাঙ্গ নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনী হজম করা দুঃসহ অভিজ্ঞতা বলে গণ্য হওয়া উচিত! খানে’র বই হাজার বছরের বাদশাহী শান-শওকতে প্লাবিত ভারতে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি ইসলামপন্থীদের রূঢ় আচরণের আসলি কারণ শুনতে পাঠককে বাধ্য করে। গৌতম ভদ্র বা ইরফান হাবিব’রা যে-কারণটি লিখে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা ভারতবর্ষে শ্রেণী-কাঠামোর ছক ও তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন। মুসলমান শাসনামলে কৃষক বিদ্রোহের পেছনে জিজিয়া, খারাজি’র মতো শোষণমূলক করের চাপ ও সামাজিক বৈষ্যম্যকে মার্কসীয় তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।৬ তাঁদের ব্যাখ্যায় ধর্মীয় জোর-জবরদস্তির প্রসঙ্গটিও উঠে এসেছে। তবে ঐ সময়ের ঘটনাবলী বিবেচনায় সেটি কোনো Landmark হয়ে উঠতে পারেনি। যার ফলে ভারতবর্ষের শ্রেণীকাঠামোয় নিম্নবর্গের (Sub-altern) ভূমিকা বিশ্লেষণের চাপে মুসলমানীত্বের জেহাদি জোশ ও জজবাইর আসলি কারণটি বিলকুল হাওয়া হয়ে গেছে!

আহমদ ছফা’র মতো সংবেদনশীল লেখকরা সাম্প্রদায়িক অভিমান থেকে বঙ্গীয় রেনেসাঁর অন্যতম প্রাণপুরুষ বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে মুসলমান বিদ্বেষী বলে চাবুকপেটা করেছিলেন। কিন্তু বঙ্কিম যে মিছে বিদ্বেষ প্রকাশ করেননি সেই সত্য বুঝে ওঠার স্থিরতা তাঁদের হয়নি। মুসলমান পর্যটক, ঐতিহাসিক ও রাজা-বাদশাহদের ফরমানের পাতা উল্টে দেখার পরিশ্রম তাঁরা করেছেন বলে মনে হয় না! খান সেই পাতাগুলোয় উঁকি মারার চেষ্টা করেছেন। ফলাফল সুখকর হয়নি। তাঁর বইয়ের পাঠককে তাই অবিশ্বাস্য কিছু তথ্য স্মরণে রাখার চাপ সইতে হয়। যার সারসংক্ষেপটি এরকম :-

মুসলমান শাসনামলে (*সম্রাট আকবরের শাসনামল ছাড়া। ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’র উদ্দেশ্যমূলক রাজনীতি সফল করার প্রয়োজনে আকবরের শাসনামলে ইসলাম-প্রতিষ্ঠার জোশ অপেক্ষাকৃত শিথিল ছিল। যদিও বিভিন্ন প্রদেশে সম্রাটের প্রতিনিধিরা সুযোগ পেলে ইসলামের নামে বলপ্রয়োগে কসুর করেননি। তবে অন্য শাসনামলের তুলনায় তার মাত্রা অনেক সহনীয় ছিল।) ভারতীয় জাতি-গোষ্ঠীকে Pact of Umar অনুসারে ধিম্মি (বা জিম্মি) হিসাবে বিবেচনা করা হতো। ভারতীয় শাসকরা তাদের উপর জিজিয়া, খারাজি সহ নানা প্রকার শোষণমূলক করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। সেই চাপ সইতে না-পেরে অনেকেই বনে-জঙ্গলে আত্মগোপন করে। জীবনধারণের জন্য তারা তখন ঠগিবৃত্তি ও বাণিজ্য-বহর লুটপাটকে পেশা হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য হয়। ধিম্মিদের মধ্যে করের বোঝা থেকে যারা রেহাই পেতে চেয়েছে তাদেরকে পুরোনো বিশ্বাস ত্যাগ করে মুসলমান হতে হয়েছে। কর প্রদানের পদ্ধতিও ছিল অমানবিক। করদাতাকে প্রতি পদে স্মরণ করিয়ে দেয়া হতো সে একটি মুসলমান শাসিত রাষ্ট্রের অধিবাসী। সুতরাং নিজেকে মুসলমানের সমকক্ষ ভাবার হিম্মত তার যেন না হয়।

মুসলমান বিজেতারা ভারতীয় রমণীদেরকে মালে গণিমত হিসাবে পাকড়াও করতেন। এই যুদ্ধবন্দি ক্রীতদাসীরা ইসলাম গ্রহণে বাধ্য ছিল। মালিকের যৌনক্ষুধা মিটানোর উপকরণ আর প্রজননযন্ত্রের ভূমিকায় জীবনের বাকি দিনগুলো তারা পার করে দিতো। সেকালের মুসলিম বিশ্বে ভারতীয় রমণীদের মারাত্মক কদর ছিল। মুসলমান শাসকদের হেরেমে দাসী ও উপপত্নী হিসাবে তাদেরকে নিয়োগ করা হতো। ভারতবর্ষে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই রমণীরা ছিল সবচেয়ে লাভজনক ও সহজ হাতিয়ার!

ইসলামীকরণের অব্যাহত চাপে ভারতবর্ষে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মণীষার জগতে দুষ্কাল ঘনিয়ে আসে। নালন্দা, তক্ষশীলার মতো সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের লক্ষ-লক্ষ মূল্যবান পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলা হয়। মুসলমান শাসকরা অসংখ্য হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ স্থাপনা ধ্বংস করেন। ইসলামকে অবমাননা করার তুচ্ছ সব অভিযোগে হিন্দু পণ্ডিত ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ভারত সফরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আল বেরুনী তাই মন্তব্য করেন,-ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী গুণী ব্যক্তিরা প্রাণের ভয়ে ইসলামের তরবারি তখনো পৌঁছেনি এমন সব অঞ্চলে (বেনারস, কাস্মীর ইত্যাদি) পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন!

এতো গেলো অত্যাচারের এক ধরনের বয়ান! অপর বয়ানটি আরো দুঃখজনক। ভারতবর্ষে ইসলামের শান্তিপূর্ণ প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখার জন্য আরব বণিক ও উদারচিত্ত সুফি-দরবেশদের ব্যাপক সুনাম করা হয়। আস্তিন-গুটানো বিপ্লবী থেকে শুরু করে উদারমনা বুদ্ধিজীবীরা সুফি-দরবেশদের মাঝে ধর্মের মার্জিত বহিঃপ্রকাশ দেখে বিগলিত হয়ে ওঠেন। শরিয়তের কঠোর নিয়ম-কানুনের বিপরীতে সুফি সাধকদের উদার, সহিঞ্চু ও মানবিক আচরণকে তাঁরা প্রশংসায় ভরিয়ে তোলেন। এইসব সাধকের মাঝে সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের নিরাপদ আশ্রয়টি অনেকে খুঁজে পান। প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে সুফি-দরবেশরা তাঁদের ধর্মাচারের মাধ্যমে সমগ্র ভারতবর্ষে ইসলামের ঝাণ্ডাকে মজবুত করেছিলেন! কিন্তু বাস্তবে কী ঘটেছিল? ভারতবর্ষে সুফি-দরবেশদের ইসলাম প্রচার নিয়ে আর. এম. ইটনদের ঐতিহাসিক গালগল্পকে এম. এ. খান প্রাসঙ্গিক যুক্তি সহকারে খণ্ডন করেছেন। যার ফলে ইতিহাসের অন্য পিঠের খবর নিতে পাঠককে তিনি বাধ্য করেন :-

বাংলা, দাক্ষিণাত্য ও কাশ্মীরকে কাফেরমুক্ত করার জেহাদি অনুপ্রেরণায় এতদঅঞ্চলের সুফি-দরবেশরা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। ভারতবর্ষের বিধর্মী নাগরিককে মোহাম্মদের ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে চাপ বা মদদ প্রদানে তাঁরা কখনোই সঙ্কোচ বোধ করেননি। হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ মঠগুলোকে সুফি সাধকরা জবরদস্তির মাধ্যমে নিজের খানকায় পরিণত করেন। অন্যায় এই কাজের জন্য তাঁদেরকে কখনো কুণ্ঠা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। খাজা মইনউদ্দিন চিশতি’র মুরিদরা আজমিরের আনাসাগর হ্রদের নিকটে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী হিন্দু মন্দিরের সামনে প্রতিদিন একটি করে গরু জবাই করতেন। গো-হত্যার ব্যাপারে মারাত্মক স্পর্শকাতর হিন্দুদের বিদ্রূপ করার উদ্দেশ্যে তারা এ-কাজটি করতেন। শুধু তাই নয়, জবাইকৃত গরুর মাংস থেকে তৈরি কাবাব ভক্ষণ করা তাদের প্রতিদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছিল। দাক্ষিণাত্যে (বীজাপুর) পীর মা’বারি নৃশংস পন্থায় জৈন ও হিন্দু সম্প্রদায়কে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন। ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধ পণ্ডিতদের পীঠস্থান হিসাবে স্বীকৃত কাস্মীরে প্রখ্যাত সুফি সাধক শামস-আদ্-দ্বীন মোহাম্মদ ইরাকী বিধর্মীদের উপর কোরান অবমাননার অভিযোগ আনেন। প্রভাবশালী এই সুফি সাধকের মদদ পেয়ে স্থানীয় প্রশাসন পবিত্র আশুরা’র দিনে কাস্মীরের বিধর্মী জনগণের উপর হামলা চালায়। আটশত বিধর্মীকে সেখানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কাফের নিধনে মুসলমান বিজেতাদের পৌরুষকে উচ্চকণ্ঠে বাহবা জানাতে নিজামউদ্দিন আউলিয়া ও আমির খসরুর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এতোটুকু গ্লানি বোধ করেননি। আর প্রখ্যাত সাধক হযরত শাহজালাল তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু নিজামউদ্দিন আউলিয়া’র আদেশে রাজা গৌরগোবিন্দের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নেওয়ার জন্য সুদূর শ্রীহট্টে (সিলেট) গমন করেন। পীরে কামিল নিজামুদ্দিন আউলিয়া, খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি, হযরত শাহজালাল অথবা শামস-আদ্-দ্বীন মোহাম্মদ ইরাকী’র মতো সুফি সাধকরা উপমহাদেশের মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য ভক্তি ও সমাদর লাভ করেছেন। অথচ অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি তাঁরা সবসময় ঘৃণ্য মনোভাব পোষণ করে গেছেন। ভারতবর্ষকে দ্বার-উল-ইসলাম-এ পরিণত করার জিহাদী সংকল্পে শরিয়াপন্থীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উপায়ে সহায়তা করার দায়িত্ব এইসব সুফি-সাধক সানন্দে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। যে-কারণে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁদের উদার মানবিকতার কাহিনীগুলো আজগুবি ও অতিরঞ্জন ছাড়া কিছু নয়।

‘মসনবি শরিফ’-এর রচয়িতা মরমী কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি তাঁর কবিতায় মানুষের বীর্যকে আলোর সাথে তুলনা করেছিলেন। বীর্যের মাধ্যমে বিচ্ছুরিত আলো পৃথিবীতে প্রাণের মহৎ প্রবাহ সম্ভব করে এবং ঈশ্বরকে ভালোবাসার জন্য নিজেকে সদা সচল রাখে। দুঃখের বিষয় হলো রুমি’র এই আলো আল্লাহর অলৌকিক প্রেরণা ও ভালোবাসায় সিক্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দ ধরে নিতে হচ্ছে! তা না-হলে পরম নিরাকারের সাধনায় লিপ্ত সুফি-দরবেশরা (গৌণ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) বিধর্মী জনগোষ্ঠীকে এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন না। খানে’র গ্রন্থে বর্ণিত নিজামউদ্দিন আউলিয়া, মইনউদ্দিন চিশতি, আমির খসরু ও ইরাকী’র মতো প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের উক্তি, বচন এবং কাজকর্মই তার প্রমাণ।

এগুলো পাঠের পর ভারতবর্ষের সুফি-দরবেশকে ঘিরে প্রচলিত অতিরঞ্জনের খোলস হাট করে খসে যায়। মুসলমান বিজেতা ও শাসক থেকে শুরু করে সুফি-দরবেশ সকলেই সৃষ্টির সেরা জীব (আশরাফুল মাখলুকাত) মানুষকে কমবেশি হেয় বা তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। যে-কারণে দীর্ঘ সময় ধরে ভারতবর্ষ শাসনের পরেও পঁচিশ শতাংশের বেশি মানুষকে তাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করাতে পারেননি। অথচ বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভের সময় উল্টো ঘটনা ঘটেছিল। গৌতম বৌদ্ধের বাণীর প্রভাবে হিন্দু ধর্মের চিরন্তন দাপট লোপ পেতে বসেছিল। বাংলা সহ গোটা ভারতবর্ষ তখন বৌদ্ধ-চিবরে ঢাকা পড়তে যাচ্ছিলো। হিন্দু ধর্মে বৌদ্ধকে নবম অবতার রূপে স্বীকৃতি প্রদান অতুলনীয় সেই প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করে। রক্তপাত ও জোর-জবরদস্তি ছাড়া গৌতম বৌদ্ধ অসাধ্য এই কাজটি সম্ভব করে তুলেছিলেন। এ-কথা সত্য, ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের জনপ্রিয়তা লাভের পেছনে বণিক-শাসিত অর্থনীতির স্বার্থ ও সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতা বড়ো ভূমিকা রেখেছিল। বণিক ও সম্রাটদের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া বৌদ্ধ সংঘগুলো খেয়েপরে বাঁচার শক্তি পেতো না। কিন্তু বণিকরা মিছেমিছি সংঘের পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। গৌতম বৌদ্ধের বাণী বা কর্মের মধ্যে মানুষ হিসাবে আত্মমর্যাদা লাভের প্রেরণাটি তারা খুঁজে পেয়েছিল। বর্ণপ্রথার নিগড়ে বন্দি ব্রাক্ষণ্যবাদী হিন্দু ধর্ম তাদেরকে যে মর্যাদা দিতে কুণ্ঠা বোধ করেছে! বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার লাভের ক্ষেত্রে এই কারণটিকে তাই উপেক্ষা করা যাবে না।

মহাভারতে ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দের প্রকৃত অর্থ নিয়ে একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে যার ভিতরে ব্রহ্ম অর্থাৎ ভগবান তাঁর গুণাবলী নিয়ে বিরাজ করেন তিনিই ব্রাহ্মণ। সমাজের নীচুতলার মানুষ বলে চিহ্নিত শূদ্র এই গুণাবলীর কারণে ব্রাহ্মণের স্তরে আসীন হতে পারে। আবার জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ উক্ত গুণাবলীর অভাবে শূদ্রে’র স্তরে পতিত হতে পারে। গীতা’য় চারিবর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-এর প্রচলিত স্তর বিন্যাসকে সিদ্ধি লাভের চারটি প্রধান ধাপ বা উপায় হিসাবে অনেকেই ব্যাখ্যা করে থাকেন।৭ কিন্তু গীতা’র এই তত্ত্ব আর তৎকালীন ভারতীয় সমাজে তার বাস্তব-স্বরূপের মাঝে আকাশ-পাতাল ফারাক ছিল। বাস্তবে বর্ণপ্রথা শ্রেণী শোষণ জারি রাখার অস্ত্রে রূপায়িত হয়েছিল। যেখানে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়’র তুলনায় বৈশ্য ও শুদ্র’কে সবসময় নীচু দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। সমাজের হোমরা-চোমড়া মানুষের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য পেয়ে তারা অভ্যস্ত ছিলেন। বৌদ্ধের ‘অহিংসা, কর্মফল, পুনর্জন্ম ও নির্বাণের বাণী’ এবং তা ব্যাখ্যার ধরন প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন সূচিত করে। অবক্ষয় ও কুসংস্কারে আক্রান্ত বর্ণপ্রথার বিপরীতে গৌতম বৌদ্ধের মতবাদে বণিকরা সময়ের নতুন ভাবনার বীজ দেখতে পেয়েছিল। মানুষ হিসাবে সকলের এক-গতি লাভের বিষয়টি তাদেরকে আলোড়িত করে। সংসারের কঠিন বন্ধন ও কর্মের যাঁতাকল হচ্ছে যাবতীয় দুঃখ-অনিষ্ঠের মূল। ভিক্ষুত্ব বরণ বা প্রব্যজার মাধ্যমে এর থেকে মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষা মানুষকে নির্বাণের স্তরে উন্নীত হতে সাহায্য করে। নির্বাণ এজন্য যে বাসনাময় কর্মফলের কারণে সত্তার নতুন আবির্ভাবের চক্র থেকে মানুষ তখন মুক্তি লভে। দুঃখ-ব্যাধি-জ্বরা ও মৃত্যুর দুঃসহ বন্ধনের চাপ তাকে আর সইতে হয় না। বোধিসত্ত্বের মাধ্যমে বাসনাময় কর্মফলের যাতনা থেকে সে চিরশান্তি লাভ করে। কিন্তু নির্বাণের এই কঠিন প্রশান্তির চাপ সকলের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। সংসারবদ্ধ জীবের পক্ষে বাসনাহীন সংযমের এই শুদ্ধস্তরে অটল হওয়া দুরাশা মাত্র! তবে জগতের কল্যাণে কাজ করা, ভিক্ষুদের প্রতি সদয় আচরণ এবং পরিমিত ধর্মাচারের মাধ্যমে নিজের বন্দিদশাকে তারা কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারে,-এই উপসংহার বৌদ্ধ সংঘগুলো সমাজের মর্মমূলে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল।

আদি বৌদ্ধ মতবাদে মানুষকে পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক, ইহকাল-পরকালের কোনো ভয়-ভীতি বা প্রলোভন দেখানো হয়নি। নিজের কৃতকর্মের প্রতি দায়বদ্ধ ও কল্যাণী হওয়ার আবেদন রাখা হয়েছিল। নির্বাণের কঠিনমার্গে সমাহিত হতে অনিচ্ছুক ব্রাত্য জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ মতবাদের এই উপসংহারের মাঝে ইহলোক-পরলোকশূন্য নতুন এক অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়। যে-কারণে বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা এগিয়ে আসে। রক্তপাত ও জোর-জবরদস্তি ছাড়াই বৌদ্ধ মতবাদ দ্রুত প্রসার লাভ করেছিল। সময়ের স্রোতে গৌতম বৌদ্ধের বাণী এবং আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে সংঘগুলোয় মতভেদ সৃষ্টি হয়। বৌদ্ধের প্রয়াণ লাভের পর সুক্ত, বিনয় ও অভিধর্মে বর্ণিত ধর্মাচার নিয়ে দলাদলি তীব্র হয়ে ওঠে। নিরীশ্বরবাদী ধর্মের মহিমা অনাচারের কবলে পড়ে আবিল হতে থাকে। বৌদ্ধ মতবাদের শক্তি এতে হ্রাস পায়। এ-সমস্ত কারণে বৌদ্ধের অনুসারীরা ভারতে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে পারেননি। ইসলামী ড্যাগারের ভয়ে বাংলা ও অন্যান্য অঞ্চলের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী গণহারে দেশ ছাড়েন অথবা মুসলমান ধর্ম গ্রহণে বাধ্য হন। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম শুরুতে যে কাজটি করতে পেরেছিল ভারতবর্ষে দীর্ঘ সময় পার করেও ইসলাম সেই কাজে সফল হতে পারেনি। মানুষকে স্বেচ্ছায় ধর্ম বদলের প্রেরণা যোগাতে মোহাম্মদের অনুসারীরা ব্যর্থ হয়েছিলেন।

ভারতবর্ষে ইসলাম সম্পর্কে যে ভয়, ঘৃণা ও প্রতিরোধের বীজ বঙ্কিমের মনে জন্ম নিয়েছিল তার পেছনে মুসলমান শাসনামলের ঐ সুদীর্ঘ কালপর্বটি দায়ী। ভারতবর্ষের উপাসক সম্প্রদায় একটি একরোখা, জবরদস্তিমূলক প্রয়াসের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরোধ বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরিস্থিতির খাতিরে মুসলমানদের উপস্থিতিকে তাঁরা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু মুসলমানী ধর্মটিকে অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারেননি। ১৯৪৭-এ দেশভাগের হিংসাত্মক রাজনীতি হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির সমস্যাকে আরো জটিল ও ঘোলাটে করে তোলে। তৎকালীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অনেকগুলো ভুল সিদ্ধান্ত জিন্না’কে কংগ্রেস ত্যাগে বাধ্য করেছিল। দ্বি-জাতি তত্ত্বের একনিষ্ঠ প্রচারকে পরিণত হওয়ার আগে অব্দি জিন্না ধর্মকে রাজনীতির গুটি হিসাবে ব্যবহারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু ভারতের অখণ্ডত্ব রক্ষার প্রশ্নে গান্ধি ও নেহেরু’র কতিপয় ভুল সিদ্ধান্ত তাঁকে কংগ্রেসের রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। যার পরিণামে ব্যক্তিজীবনে সেকুলার ও পশ্চিমা ধাঁচের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ভক্ত জিন্না কংগ্রেস নেতাদের প্রবল প্রতিপক্ষে পরিণত হন। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বলি জিন্না মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির সাথে নিজেকে একীভূত করা শুরু করেন। দেশভাগের পর যা তাঁর মনস্তাপের কারণ হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের মতো একটি প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের চাপ স্বয়ং জিন্না’র পক্ষেও বহন করা সম্ভব হয়নি। তাঁর অকাল মৃত্যুর এটিও এক কারণ! যশোবন্ত সিংহ (ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা) ও শৈলেশকুমার বন্দোপাধ্যায় (জিন্না/ পাকিস্তান/ নতুন ভাবনা) তাঁদের বইয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভুল রাজনীতির ফলে সৃষ্ট সেই ট্রাজেডির পরিচ্ছন্ন বিবরণ দিয়েছেন।

দ্বি-জাতি তত্ত্বকে ঘিরে ক্ষমতাকাঠামোর এই মনঃস্তাত্ত্বিক বাহাস এম. এ. খান’কে ভাবিত করেছে বলে মনে হয়নি। জিন্নাকে তিনি খলনায়ক হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু গান্ধি ও নেহেরু’র ভ্রান্তিগুলো নিয়ে সেভাবে আলোচনা করেননি। যদিও তা জরুরি ছিল। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস বৃদ্ধিতে ক্ষমতাকাঠামোর সংঘাত সেকালে জোরালো ভূমিকা রাখে। খানে’র আলোচনায় বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ায় তাঁর বইয়ের বিশ্লেষণী গভীরতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। তবে ৪৭-এ সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহ একটি বিবরণ তিনি দিয়েছেন। কলকাতা, পাঞ্জাব, নোয়াখালি ও লাহোরে সংঘটিত দাঙ্গায় হিন্দু বা শিখদের তুলনায় মুসলমানদের অতি উৎসাহী তৎপরতাকে লেখক উপযুক্ত তথ্যের সাহায্যে বিশ্লেষণ করেছেন। দাঙ্গার ক্ষতিকর প্রভাব বোঝাতে গিয়ে সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যানও সেখানে জুড়ে দিয়েছেন। তাতে দেখা যায় ১৯৪৭-এ ভারতভাগের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) পঁচিশ শতাংশ হিন্দু নাগরিক বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে গমন করেননি। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চল্লিশ বছরের মধ্যে সেই পঁচিশ শতাংশ কমতে-কমতে নয় শতাংশে এসে ঠেকেছে! দেশভাগের সময় দশ শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠী বিপদ মাথায় নিয়ে পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিলেন। বর্তমানে মাত্র এক শতাংশ হিন্দু পাকিস্তানে বসবাস করছেন। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা প্রদানে মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশ ও পাকিস্তান যে ব্যর্থ হয়েছে উক্ত পরিসংখ্যান তা প্রমাণ করে। মুসলমান সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইসলামী তরিকার কিছু উদাহরণ লেখককের বিবরণে উঠে এসেছে। সেইসঙ্গে মোহাম্মদ আসগরের (Muhammad : his Quran গ্রন্থের লেখক) বক্তব্যের উপর ভর করে ভারতবর্ষে ইসলামী সংস্কৃতির সমৃদ্ধ প্রভাবের দাবিকে তিনি খণ্ডন করেছেন। সাহিত্য, সঙ্গীত, স্থাপত্য, চিত্রকলা, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও রন্ধনশিল্পে মুসলমানদের অবদানকে যুক্তি সহকারে বিশ্লেষণেও কোনো কৃপণতা করেননি। কলেবর বাড়ার ভয়ে সেই বৃত্তান্তে আর যাচ্ছি না। আগ্রহী পাঠক খানে’র বই থেকে প্রতিরোধ ও অবদানের ইতিহাসটি পড়ে নিতে পারবেন।

ইসলামের এই সহিংস চরিত্রের জন্য কাকে দায়ী করা উচিত? খানে’র বইয়ের প্রথম থেকে চতুর্থ পরিচ্ছেদ অনুসারে স্বয়ং নবি মোহাম্মদকে এজন্য দায়ী করতে হয়। যে-কারণে তাঁর নবুয়ত লাভ এবং নিজেকে আল্লাহর বিশ্বস্ত বার্তাবাহক ও ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক রূপে দাবি করার প্রসঙ্গটি লেখক গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনায় অন্য ধর্মের প্রতি মোহাম্মদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মদিনায় হিজরত গ্রহণের প্রকৃত কারণটিও উপযুক্ত তথ্য সহ বিশ্লেষিত হয়েছে। মদিনায় ইহুদি নির্যাতন, মক্কা বিজয় এবং তৎপরবর্তী ঘটনাগুলোর আড়ালে নিহিত মনঃস্তত্ত্বের অনুসন্ধান খানে’র বইকে নাটকীয়তা প্রদান করেছে। লেখক দেখিয়েছেন ইসলামী বিশ্বাসে জিহাদী উগ্রতার বীজ বপনের কাজটি কীভাবে খোদ মোহাম্মদের জীবদ্দশায় ঘটে ও তাঁর মাধ্যমে সুসম্পন্ন হয়! নিজেকে আল্লাহ্-প্রেরিত বার্তাবাহক প্রমাণে মরিয়া মোহাম্মদ তাঁর জীবনে ৭০টির মতো ছোটবড়ো যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। মক্কা থেকে মদিনায় গমনের পর তিনি নিদারুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। তাঁর ভক্ত-আশেকানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার নাম করে তিনি তখন যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু করেন। হেজাজের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে বসবাসরত গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সাথে তুচ্ছ ছল-বাহানায় যুদ্ধ বাঁধানো মোহাম্মদের প্রিয় অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এটি তাঁর কাছে অতীব লাভজনক মনে হতে থাকে। ইসলামের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয়ের অজুহাতে বাণিজ্য কাফেলায় হামলা ও লুটপাট তাঁকে বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী করে। সুজিৎ দাস তাঁর Unmasking Muhammad-এ সেই ধন-সম্পদের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেছেন।৮ মদিনাপর্বের দিনগুলোয় মোহাম্মদ ও তাঁর শিষ্যরা মিলে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হন। মহানবি নিজে প্রবল ক্ষমতার অধিকারী আধ্যত্মিক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। মদিনা ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসরত ইহুদি সম্প্রদায়কে (বানু কাইনুকা, বানু নাদির, বানু কুরাইজা ও বানু মোস্তালিক) তিনি হত্যা ও বিতাড়িত করেন। মালে গণিমত হিসাবে ক্রীতদাস ও যৌনদাসী সংগ্রহ করা তাঁর জন্য লাভজনক বাণিজ্যে পরিণত হয়। আর জবরদস্তির মাধ্যমে প্রতিমা উপাসক সম্প্রদায়কে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করানোর মিশনে দ্বীনে মোহাম্মদের অনুসারীরা ক্রমাগত সাফল্য লাভ করতে থাকেন। মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে তা আরো সুবিস্তৃত হয়েছিল। পরবর্তী ইতিহাস সেই ধারাবাহিকতার দ্বারা কমবেশি অনুপ্রাণিত হয়েছে মাত্র!

ইসলামের এই ‘পরবর্তী ইতিহাস’ ও তার গতিধারাকে এম. এ. খান সাম্রাজ্যবাদী আরব জাতীয়তাবাদ নামে অভিহিত করার পক্ষে। মোহাম্মদ আগ্রাসনের কায়দাটি দেখিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীরা তা অনুকরণ করেছেন। অনুকরণের ইতিহাসে ভারতবর্ষের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু ভিন্ন নয় মিশর, মরক্কো, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের অভিজ্ঞতা। কেন ভিন্ন নয় তার উত্তর ‘ইসলামকে কী কারণে সাম্রাজ্যবাদী বলা উচিত’ সেই আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর বক্তব্যের সারকথাটি হলো এরকম :-

প্রাক্তন কলোনীগুলোয় সাদা সাহেবদের বেনিয়াবৃত্তি ও সাম্রাজ্যবাদী কাজকরবার নিয়ে গণ্ডায়-গণ্ডায় বই লেখা হয়েছে। দাসত্ব প্রথাকে তারা কীভাবে লাভজনক মৃগয়ায় পরিণত করেছিল তা সকলেই কমবেশি জানেন। সারাবিশ্বে শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশের ক্ষতিকর ফলাফল সম্পর্কে খোদ পশ্চিমা-বিশ্ব ও প্রাক্তন কলোনিগুলোয় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় আজো বইছে। স্থানীয় অধিবাসীদের উপর ইউরোপীয় ও আমেরিকান প্রভুদের সাংস্কৃতিক আরোপন নিয়েও যথেষ্ট বাকযুদ্ধ হয়েছে। মধ্যযুগে যিশুর নাম করে সংঘটিত অমানবিক ঘটনাগুলোকে বিশেষজ্ঞরা এখন নতুন পরিভাষার সাহায্যে ব্যাখ্যা করছেন। প্রাচ্যের দেশগুলোয় সাদা সাহেবদের উপনিবেশ স্থাপন এবং তাকে শাসন করার সাম্রাজ্যবাদী তরিকা নিয়ে গবেষণার ফলে তাদের আসল চেহারাটি বিশ্ববাসীর কাছে ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের সাম্রাজ্যবাদী আচার-আচরণের পঠন-পাঠনে সাব-অলটার্ন থেকে উত্তরাধুনিক সকল মহলের লোকজন তাই মারাত্মক সক্রিয়। অথচ ধর্মের নামে সাম্রাজ্যবাদী (এবং আরব জাতীয়তাবাদী) আচরণে ওস্তাদ ইসলামের ভূমিকা নিয়ে তেমন একটা শোরগোল শোনা যায় না। নিপীড়ন-নির্যাতন আর জবরদস্তিতে মহানবি’র অনুসারীরা খ্রিস্টীয় চার্চ ও সাদা সাহেবদের একাই অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের সেই ইতিহাস আজো অস্পষ্ট গোলকধাঁধার মধ্যে খাবি খাচ্ছে। খনিশ্রমিকের একাগ্রতায় লেখক অস্পষ্ট ধাঁধার জট খোলার চেষ্টা করেছেন। তাতে করে অনেক অজানা তথ্য তিনি হাজির করাতে পেরেছেন। পাঠকের জন্য তথ্যগুলো ইতিহাসের অচিন সাম্রাজ্য ঘুরে আসার আস্বাদ বয়ে আনে।

ভারতবর্ষ এবং আফ্রিকা’র বিশাল ভূখণ্ডে ইসলামী ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের এই তুলনামূলক পর্যালোচনা এম. এ. খানে’র বইকে পৃথক মাত্রায় উপনীত করে। সমাজের গতিশীল রূপান্তরের প্রশ্নে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের চেয়ে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদকে তাঁর কাছে কম প্রতিক্রিয়াশীল এবং অধিক গঠনমূলক মনে হয়েছে। ভারতবর্ষের মতো ভূখণ্ডকে মুসলমানরা হাজার বছর ধরে শাসন করেছেন। কিন্তু দেশটির অবকাঠামোয় কোনো গতি অথবা বৈপ্লবিক রূপান্তর সাধন করতে পারেননি। ভারতীয় সমাজের ‘উদ্ভিসুলভ স্থবিরতা’র মাঝে পশ্চাদপদ ধ্যান-ধারণায় আক্রান্ত এক আরব জাতীয়তাবাদকে তাঁরা অবিরত আরোপ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের এই ‘তৎপরতা’ হিন্দু ও মুসলমানের মাঝে মনঃস্তাত্ত্বিক বাধার প্রাচীরকে শুধু টেনে লম্বা করেছে। ব্রিটিশদের অনুপ্রবেশ লম্বা এই প্রাচীরকে রেল ও সড়ক, সংবিধান ও সংসদ, ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শ্রমিক ও কেরানি, মধ্যবিত্ত ও সুশীল সমাজ এবং সাহেব ও নেটিভের জটিল সব সংঘাতের ভিতর দিয়ে বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়। যার ফলশ্রুতিতে ‘উদ্ভিসুলভ স্থবিরতা’য় আক্রান্ত সমাজটি স্বাধিকারবোধের নতুন চেতনায় বলীয়ান হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক প্রভুকে পরিতুষ্টকারী শাবকের পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ-প্রতিরোধী শ্রেণীর বিকাশ ঘটতে শুরু করে। সমাজে দ্বান্দ্বিক রাজনীতির মেরুকরণ নয়া চরিত্র ধারণ করে। ইউরোপীয় প্রভুরা তাদের নিজস্ব অর্থনীতির স্বার্থে ভারতবর্ষ ও আফ্রিকা’র মতো ভূখণ্ডকে মর্মান্তিকভাবে পরাধীন করে তুলেছিল। যদিও আরোপিত সেই পরাধীনতা থেকে বেরিয়ে আসার উপকরণ সেইসব প্রভুকেই যোগান দিতে হয়েছে! হাজার বছরের মুসলমান শাসনামলে ভারত কিংবা আফ্রিকাবাসীর এহেন অভিজ্ঞতা হয়নি। প্রাগৈতিহাসিক প্রথা-আচার-মূল্যবোধের মধ্যে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে মানা অথবা না-মানার দ্বন্দ্বে তারা কেবল ঘুরপাক খেয়েছে! নতুবা সমাজের রইস আদমিদের বিলাস-বিলাসিতার খোরাকি যুগিয়ে গেছে। (*এ-প্রসঙ্গে প্রখ্যাত পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ারের Travels in the Mogul Empire (1656-1668) অবলম্বনে রচিত বিনয় ঘোষের ‘বাদশাহী আমল’ বইটি পাঠকের জন্য অতীব প্রাসঙ্গিক ও চিত্তাকর্ষক একটি রচনা। মোঘল আমলের শান-শওকত, সমরসজ্জা থেকে শুরু করে হারেম-বাসীনীদের খুটিনাটি বিবরণে পূর্ণ এই ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা সে-আমলের রাষ্ট্র-শাসনের সামন্তবাদী চরিত্রটি তুলে ধরে।) এম. এ. খান সেই পটভূমি থেকে দুটি সাম্রাজ্যবাদের মনঃস্তত্ত্ব পরখ করেছেন। সামাজিক পালাবদল বা গতিশীল রূপান্তরের প্রশ্নে ইউরোপীয় উপনিবেশকে তাঁর কাছে শ্রেয়তর মনে হয়েছে। লেখকের বক্তব্য অবশ্য উসকানিমূলক। এ-নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর বাদানুবাদ যে ঘটবে তা নিশ্চিত। তবে ইসলামী মহিমার বদ্ধমূল ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার স্বার্থে তাঁর বক্তব্য উপলব্ধি করা পাঠকের পক্ষে জরুরি। এবং, ইসলামের প্রতি সহনশীল অথবা উদাসীন উভয় পক্ষের জন্যই সেটি প্রয়োজনীয় গণ্য হওয়া উচিত।

বহুল স্বীকৃত ধ্যান-ধারণার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে কলেমা-বিশ্বাসী ব্যক্তির নিকট এম. এ. খানে’র বইটি স্বস্তিকর হওয়ার কথা নয়। পাঠকের বদ্ধমূল ধারণাকে নাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্য লেখক সেখানে গোপন করেননি। সঠিক প্রচারণা পেলে ইসলামী মূল্যবোধের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রের কাছে বইটিকে বিপদজনক মনে হতে পারে। নবি মোহাম্মদের প্রতি সহনশীল বিদ্বানদের জন্যও সে স্বস্তিকর নয়। মোহাম্মদের মনোরম ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার প্রশ্নে স্পর্শকাতর পাঠকরা সালমান রুশদীর চেয়ে এম. এ. খানে’র বইকে অধিক প্রতিক্রিয়াশীল মনে করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা তাঁর বইটি কোনো নভেল নয়। ঐতিহাসিক তথ্যের নিরেট বিশ্লেষণ। নবি’র জীবনে শয়তানের খপ্পরে পড়ে ওহি নাজিলের বিখ্যাত ঘটনাকে উপজীব্য করে সালমান রুশদী ‘শয়তানের পদাবলী (Satanic Verses) লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।৯ মোহাম্মদের কোরান-স্বীকৃত মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার অপরাধে আয়াতুল্লা খোমেনি লেখকের জীবনের উপর ফতোয়া জারি করেন। জাদুময় ভাষাশৈলীর অধিকারী রুশদীকে সেজন্য দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় পাহারায় দিন গুজরান করতে হয়েছে। রুশদী’র ক্ষেত্রে যদি ঘটনা এই হয় তবে খানে’র চাঁচাছোলা ভাষায় লেখা বইকে ইসলামী মূল্যবোধের পাবন্দ কোনো ব্যক্তির পক্ষে মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ব্লাসফেমির উপযুক্ত তথ্য ও বিস্ফোরক উক্তিতে ভরপুর হওয়ার কারণে তাঁর বইটিকে চলমান ইসলামপন্থী Activism-এর বিপরীতে ইসলাম-বিরোধী Activism হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। Activism কেন ও কী কারণে? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে মানব সভ্যতায় মোহাম্মদের অবদানকে কেন্দ্র করে বাহাসে (Argument) লিপ্ত দুটি পক্ষের মন-মানসিকতা বোঝা দরকার। তাঁদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণটিও ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। পরবর্তী প্রবাহে আমরা সে চেষ্টাই করবো।
… … …

তৃতীয় প্রবাহ

আগেই বলেছি, সারা বিশ্বে ইসলামের প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে নবি মোহাম্মদের অবিশ্বাস্য সাফল্যের কারণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যার ফলে তাঁর অবদান ও প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নে বিপরীতমুখী দুটি প্রবাহ বা ধারা তৈরি হয়েছে। তাদের একটিকে মূলধারা ও অন্যটিকে বিকল্পধারা নামে চিহ্নিত করা যেতে পারে। মূলধারার বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে ইসলামের শান্তি প্রিয়তা, পরমত সহিঞ্চুতা এবং উদারতার বাণী প্রচার করে যাচ্ছেন। এই ধারার মধ্যে মোহাম্মদী দ্বীনের অনুসারী ধর্মবেত্তা, পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকগণ রয়েছেন। অন্য ধর্মের উদারচিত্ত পণ্ডিতরাও সেখানে সুলভ। তুলনামূলক সাম্প্রতিকদের মধ্যে জন এল এসপোসিতো, ক্যারেন আর্মস্ট্রং প্রমুখের নাম নেওয়া যেতে পারে। মূলধারার বিশেষজ্ঞরা কোরান, হাদিস, সীরা, তাফসির ও ফিকাহশাস্ত্রের আলোকে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও জীবনবোধকে উপলব্ধির চেষ্টা করেন। তাঁদের মতে ইসলামকে মানবজাতির জন্য একটি আদর্শ জীবনব্যবস্থার প্রতীক বলে গণ্য করা উচিত। মূলধারার বিদ্বানদের নিরলস খাটুনির ফলে অতিকায় এক ইসলামী সাহিত্যের জন্ম সম্ভব হয়েছে। ড. জাকির নায়েক ও আহমদ দিদাতের মতো বিতার্কিকরা মুসলমান সম্প্রদায়ের রূহানিতে ইসলামের সেই মহান ইমেজ পুঁতে দেয়ার সংকল্পে নিরন্তর বক্তিমা দিয়ে বেড়াচ্ছেন!

মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তি তার বেড়ে ওঠার সময় ইসলামী সাহিত্যের মনোরম কাহিনীগুলো শ্রবণ করে। তাকে কোরান, হাদিস ও নবি মোহাম্মদের উপর অটল বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়। ইসলামের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে মোহাম্মদী দ্বীনে দীক্ষা গ্রহণের কাজটি সে সমাধা করে। ব্যতিক্রম ছাড়া সমগ্র কালপর্বে বিশ্বাসী হওয়ার এইসব যাগযজ্ঞ নিয়ে তাকে কোনো প্রশ্ন ও সন্দেহ পোষণের সুযোগ দেওয়া হয় না। যদি করে ফেলে তবে তার অভিজ্ঞতা আলী সিনা’র (বিখ্যাত Online Activist ও Understanding Muhammad গ্রন্থের লেখক) থেকে ভিন্ন হওয়ার কারণ নেই। ইসলামী মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণের কালে সিনা তাঁর কৌতূহলী মনে জেগে ওঠা প্রশ্নগুলোর সদুত্তর কখনোই পাননি। শিক্ষকরা তাঁর জিজ্ঞাসাকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে গেছেন। নতুবা ভুল ব্যাখ্যার সাহায্যে তাঁকে বিভ্রান্ত করেছেন। এইসব ঠকবাজির কাছে নিষ্পাপ কিশোরের প্রশ্ন ও সংশয় অসহায় হয়ে পড়ে। ফলে দ্বিতীয়বার ইসলামকে সন্দেহের তীরে বিদ্ধ করার কথা সে আর ভাবে না। একজন মুসলমান শিক্ষা, রুচি ও জীবনযাপনে আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও মোহাম্মদ ও তাঁর আল্লাহর কার্যকলাপকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ক্ষেত্রে ভয়ংকর স্ববিরোধী আচরণ করতে পারে! নবি মোহাম্মদের আসমানী ধর্মের সাফল্য এখানেই। সময়ের সঙ্গে অবিশ্বাস্য এক অতিরঞ্জনের চাদরে নিজের চেহারাটি সে ঢাকা দিতে পেরেছে। যেখানে প্রশ্ন, সন্দেহ ও বিনির্মাণ একপ্রকার নিষিদ্ধ।

মজার বিষয় হলো মুসলমান ছাড়াও বিশ্বের অনেক মুক্তমনা, প্রগতিশীল মানুষজন ইসলামের অন্ধকার দিক সম্পর্কে একবারেই নীরব। ইবনে ওয়ারাক (Why I am not a Muslim গ্রন্থের লেখক) এবং ভি. এস. নাইপলের রেফারেন্স ব্যবহার করে এম. এ. খান নীরবতার কারণটি বোঝার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে ওয়ারাক তাঁর বইয়ে ইসলামের স্বরূপ নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলের ভ্রান্ত ধারণা ও তার কারণগুলো সবিস্তারে আলোচনা করেছেন।১০ খানে’র লেখা ওয়ারাক-এর প্রতিধ্বনি। যার মূল কথা হচ্ছে মানব সভ্যতায় ইসলামের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিবেচনা করার সময় বিদ্বান সমাজের বড়ো অংশ বারবার একই ভুল করেছেন। ইসলামের আদি লিপিকারদের রচনাগুলো তাঁরা খুটিয়ে লক্ষ করেননি। মোহাম্মদী দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কালে মুসলমান পর্যটক, ঐতিহাসিক, জীবনীকার ও পণ্ডিতদের রচনাগুলোকে একরকম উপেক্ষাই করা হয়েছে। ইসলামের মূল ভিত্তি কোরান-হাদিস ও ফিকাহ’র সাথে এইসব রচনার তুলনামূলক অনুসন্ধানের বিষয়টি তাঁরা আমলে আনার প্রয়োজন বোধ করেননি। এর ফলে ইসলামিক বিশ্বাসের একটি একপেশে মডেল গড়ে উঠেছে। এই মডেলের আড়ালে তার প্রকৃত স্বরূপ প্রায় বিলীন হতে বসেছে। এবং, প্রকৃত ইতিহাস ছাপিয়ে মিথ্যা ও অতিরঞ্জন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। অতিরঞ্জনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে বিকল্পধারার জন্ম তাই অপরিহার্য ছিল। সত্যকে স্পষ্ট করার লক্ষ্যে এই ধারার লেখকরা ইতিহাসের অস্পষ্ট সব সীমারেখায় নিজেদের ভ্রমণ আজো জারি রেখেছেন।

বিকল্পধারার পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইসলামের স্বরূপ সম্পর্কে কৌতূহলী নাস্তিকরা রয়েছেন। অন্য ধর্মের অনুসারী বিদ্বান ব্যক্তিরা আছেন। এবং, মোহাম্মদ ও তাঁর আল্লাহর খোঁয়ারি কেটে গেছে অথবা এর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এমন Ex Muslim-রা এই ধারায় নাম লিখিয়েছেন। শেষের দলটি ক্রমশ একটি শক্তিশালী Activism-এর জন্ম দিতে যাচ্ছেন। অতীতে তাঁরা সংখ্যায় অল্প ছিলেন। তাঁদের পরিসর ও বিচরণের ক্ষেত্র ছিল সীমাবদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে বিকল্পধারার লেখকরা পরিপুষ্ট হতে শুরু করেছেন। ইন্টারনেট প্রযুক্তি ও সামাজিক গণমাধ্যম (Social Media) তাঁদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। সেই সুফলকে কাজে লাগিয়ে মানুষের কাছে নিজের ‘তৎপরতা’কে তাঁরা দ্রুত পৌঁছে দিতে সক্ষম হচ্ছেন। মূলধারার পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকদের জন্য এই Activist-রা এখন হুমকি ও অস্বস্তির কারণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন। সামাজিক গণমাধ্যমে বিকল্পদের ‘তৎপরতা’কে বিষোদগার করে মূলধারার বিরামহীন প্রচার-প্রচারণা সেই সাক্ষ্য বহন করে। ইসলামের বিজয়ডংকার মিথ্যা অতিরঞ্জন এভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ায় বাঁধাগৎ আওরে নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করা মুশকিল। হয় আপনাকে বিকল্পধারার লেখকদের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ও যুক্তি সহকারে খণ্ডন করতে হবে, নতুবা ইসলামের স্বরূপকে তাঁরা যেভাবে ব্যাখ্যা করছেন তা স্বীকার যেতে হবে!

ইসলামের সূক্ষ্ম পঠন-এর (Critical Reading) ক্ষেত্রে মূলধারার পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞরা মিলে ‘ইসলামী সাহিত্য’ নামে অতিকায় এক সন্দর্ভ (Discourse) তৈরি করেছেন। তাঁদের কাটাছেড়ায় নেমে বিকল্পধারার লেখক-বিশেষজ্ঞরা মিলে আরেকটি শক্তিশালী প্রতি-সন্দর্ভ (Counter Discourse) জন্ম দিতে চলেছেন। পাঠকের সুবিধার্থে এরকম কিছু রচনার নাম উল্লেখ হয়তো বিরক্তির কারণ হবে না। বিকল্পদের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হতে নিচের রচনাগুলো পাঠ করা যেতে পারে :-

ইবনে ওয়ারাক (Why I am not a Muslim), ননি দারবিশ (Now They Call Me Infidel), আনোয়ার শেখ (Islam : The Arab Imperialism), আলী সিনা (Understanding Muhammad), মোহাম্মদ আসগর (Muhammad : His Quarn), আবুল কাশেম (Women in Islam/ / Sex and Sexuality in Islam/ Who Authored the Quarn), আমর খান (Corruption and Distortion (Tahreef) in the Quran/ A Complete Guide to Pedophilia in Islam), কে. এস লাল (Indian Muslim Who Are They/ The Legacy of Muslim Rule in India), সুজিৎ দাস (Unmasking Muhammad/ Muhammad Dismantled), সুহাস মজুমদার (Jihad : The Islamic Doctrine of Permanent War)।

উপরে উল্লেখিত রচনাগুলো অনলাইনে মোটামুটি সুলভ। লেখকরা প্রায় সকলে সামাজিক গণমাধ্যমে ইসলামের সূক্ষ্ম পঠন-এ (Critical Reading) নিয়োজিত। এই দলের অন্যতম সদস্য হিসাবে এম. এ. খান নিজেও সেখানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। বিকল্প Activism অবশ্য মূলধারার ন্যায় অতোটা লক্ষ্যভেদী হয়ে উঠতে পারেনি। সাধারণ মানুষ এই ধারার লেখাপত্রের সাথে খুব একটা পরিচিত না। বিকল্পদের ‘তৎপরতা’ মূলত বিশেষজ্ঞ ও সচেতন পাঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে হকিংয়ের ‘ভালো থিয়োরি’র শর্তগুলো বহন করায় অদূর ভবিষ্যতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তাঁদের রয়েছে। কেননা সামাজিক গণমাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পন্থা অনুসরণ করে ধর্ম সংক্রান্ত প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিচার-বিশ্লেষণে নিজেকে তাঁরা নিয়োগ করতে পেরেছেন। ধর্মের ক্ষতিকর মিথ্যা ও অতিরঞ্জনকে ঠেকাতে হলে যার বিকল্প নেই। সুতরাং আশা করা যেতেই পারে।


এটি বহুল স্বীকৃত যে ধর্মীয় মতবাদগুলো একমাত্র বৈজ্ঞানিক পন্থায় সম্পাদিত বিশ্লেষণের কাছে বিব্রত বা অসহায় বোধ করে। ওহি-শাসিত মুরুব্বিরা তখন ধর্মতত্ত্বকে (Theology) ঢাল বানিয়ে আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা করেন। অনেকে মারিফতি লাইন ধরেন। শরিয়তের স্ববিরোধী কালাকানুনকে মরমীবাদের মলম দিয়ে নিরাময়ের চেষ্টা করেন। যেখানে ‘জিহাদ’ অন্তরের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। ‘হুরি’, ‘গেলমান’, ‘ছিনা ছাক’, ‘ওহি’ অথবা ‘মিরাজ’-এর মতো শব্দগুলোর উপর মরমী ব্যাখ্যা ও রহস্যীকরণ নাজিল করা হয়। আসমানী প্রেরণায় বিশ্বাসীরা এই সত্যটি প্রায়শ ভুলে যান যে দার্শনিক হেঁয়ালির বোরখা পরিয়ে তথ্যের নিরেট সত্যকে বেশিদিন চেপে রাখা যায় না। সেমেটিক ধর্মে একসময় তথ্যের প্রকৃত চেহারাটি ঢাকা দেওয়ার প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্মের মুরুব্বিরা ‘বাইবেল’-এর বিকৃত বা উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এর মাধ্যমে ইনকুইজিশন সহ বহু অপকর্ম তাঁরা করেছেন। ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের বিকৃতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যার সাথে আদি বৌদ্ধ মতের মিল শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।১১ হিন্দু ও ইহুদি ধর্মের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। ধর্মকে টাকা-আনা-পাই উপার্জনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার এতোসব কায়দা-কানুন শেষপর্যন্ত কাজে দিচ্ছেনা। খ্রিস্টান ধর্মের বিকৃত ও উদ্দেশ্যমূলক স্থবিরতার বিরুদ্ধে Reformation শব্দটি সেকালে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির মেরুকরণ থাকলেও খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ এবং চিন্তা-চেতনার সংস্কারে Reformation নতুন গতি এনেছিল। যার প্রভাবে খ্রিস্টান ধর্ম বিরামহীন সমালোচনার মুখে ধর্মতত্ত্বের (Theology) ছদ্ম-দার্শনিকতায় বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। অনেকদিন ধরে চালু সমালোচনাকে যুৎসইভাবে মোকাবিলা করতে না-পেরে ইহুদিবাদে প্রচলিত এই দাওয়াইটি অপ্রাসঙ্গিক বিবেচিত হচ্ছে। আর প্রতিমা উপাসক ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি সমালোচকদের জিজ্ঞাসার তূণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বেদ-উপনিষদের রূপময় দার্শনিকতার মধ্যে গীতা ও পুরাণের নতুন বিনির্মাণ খুঁজছে!

মোটামুটি এই হলো বিশ্ব-স্বীকৃত প্রাচীন ধর্মগুলোর অবস্থা। একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্যরা ধর্মতত্ত্ব ও মরমীবাদকে ঢাল বানিয়ে ফায়দা হাসিল করতে পারছে না। এক্ষেত্রে তাদের সাফল্য অতীতের মতো উল্লেখযোগ্য নয়। ইসলামের সফল হওয়ার কারণটি সহজ। দেড় হাজার বছর ধরে এটি একমাত্র ধর্ম যাকে Reformation-এর চাপ নিতে দেওয়া হয়নি। উৎপাদিকা শক্তির বৈপ্লবিক মেরুকরণ না ঘটায় ইসলাম নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের সংস্কার-সংশোধনের প্রশ্নটিকে দেড় হাজার বছর ধরে দাবিয়ে রাখতে সফল হয়েছে। ড. তৌফিক হামিদি’র (Inside Jihad : Understanding and Confronting Radical Islam গ্রন্থের লেখক) মতো বিজ্ঞ ব্যক্তিরা অবশ্য ইসলামে বিদ্যমান জিহাদী উগ্রতাকে Radical মতবাদের সাহায্যে সংস্কারের সুপারিশ করেছেন। ইসলামে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে হামিদি তাই লিখেন :-

সমালোচকরা আমার গায়ে হয়তো ইসলাম-বিরোধী ছাপ্পাটি লাগিয়ে দেবেন। কোনোকিছুই সত্যের চেয়ে দূরবর্তী নয়। প্রকৃত অর্থে আমি একজন মুসলমান এবং ইসলামে নিহিত সৌন্দর্য ও তাৎপর্যকে বিবেচনা করে থাকি। যে যাকগে, আজকের দিনে সিংহভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মাঝে ইসলামকে যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হয় তা বিকৃত ও ধ্বংসাত্মক। মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে Radical ইসলামের আবির্ভাব সেই ভূমিটি তৈরি করতে সক্ষম, যেটি এই শয়তানী বীজকে উপড়ে ফেলবে। যে-কারণে আমি প্রভাবিত যে ইসলামে সংস্কার অথবা ব্যাপকভাবে পুনঃ-ব্যাখ্যা প্রয়োজন, এবং এরকম একটি পরিবর্তন সার্বিকভাবেই সম্ভব।

হামিদি’র বইয়ে স্বচ্ছ বিচারবোধের আভাস রয়েছে। তবে উৎপাদিকা শক্তির বৈপ্লবিক রূপান্তর ছাড়া সংস্কার কীভাবে সম্ভব?-এই প্রশ্নের জবাব সেখানে নেই! ইউরোপে গিল্ড ভিত্তিক উৎপাদিকা শক্তির স্থলে বণিক ভিত্তিক উৎপাদিকা শক্তির উত্থান ধর্মীয় স্থবিরতার জলাশয়ে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যার তোড়ে সমালোচনা সহ্য করার গণতান্ত্রিক রীতির সাথে মানিয়ে নিতে খ্রিস্টীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হয়েছে। ইসলামে সেই সুযোগটি আজো তৈরি হয়নি। যে-কারণে হামিদি’র সংস্কারের প্রস্তাবনা (দ্রষ্টব্য : তাঁর বইয়ের পঞ্চম পরিচ্ছেদে’র Toward Islamic Reformation-এর How to Reform Islam অনুচ্ছেদটি) কতোটুকু কাজে দেবে সেটি নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। মোহাম্মদের জামানা থেকে আজকের জামানায় পৌঁছানোর পরেও সমালোচনা সহ্য করার গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে ইসলাম তার নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। এম. এ. খান সহ বিকল্পধারার লেখকরা এজন্য নবি মোহাম্মদকেই দায়ী করেছেন। প্যাগান আরব এবং ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতি মহানবি’র প্রতিহিংসামূলক আচরণের পেছনে নিজের সমালোচনা সহ্য করতে না পারার অসহিঞ্চু মনোভাবকে তাঁরা দায়ী করেছেন। তাঁদের অনুসন্ধানী ব্যাখ্যায় এক স্ববিরোধী মোহাম্মদের পরিচয় ফুটে উঠেছে। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক :-

মক্কায় বসবাসের সময় ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসকে মোহাম্মদ আগ্রহভরে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাদের আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁর মনোভাব যথেষ্ট অনুকূল ছিল। এমনকি মদিনার প্রথম দু’এক বছর প্যাগান আরবদের তুলনায় সকল দিক দিয়ে অগ্রসর সম্প্রদায় দুটির প্রতি নিজের ইতিবাচক মনোভাব তিনি ধরে রেখেছিলেন (দ্রষ্টব্য : সূরা বাকারা, ৬২ নং আয়াত)। উক্ত কালপর্বে প্রেরিত একাধিক সূরায় ইহুদি, খ্রিস্টান, সাবেইনদের বিশ্বাস ও ধর্মাচারকে প্রশংসনীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। মোহাম্মদ আশা করেছিলেন এর ফলে ঐশীগ্রন্থের অধিকারী সম্প্রদায় দুটি তাঁর প্রচারিত ধর্মে আকৃষ্ট হবে এবং তাঁকে মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা হিসাবে মেনে নিবে। নিজেদের বিশ্বাসের ভুল-ভ্রান্তি বুঝতে পেরে তারা ইসলামে দীক্ষিত হবে। কিন্তু ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ ও ‘নিউ টেস্টামেন্ট’-এ নবিত্বের কিছু লক্ষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা মোহাম্মদের প্রচারিত বাণী বা কর্মের সাথে সেই লক্ষণগুলোর কোনো মিল খুঁজে পায়নি। নবিদের বংশধারা সম্পর্কে তাঁর দাবি, কোরান অবতীর্ণ হওয়ার ভাষা, ত্রিত্ববাদ (Trinity), যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা এবং মরিয়মের বংশধারা সংক্রান্ত গোলমেলে তথ্যজটের কারণে উভয় সম্প্রদায়ের কাছে মোহাম্মদ হাস্যকর এক চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন।১২

সেমেটিক ঐতিহ্যে পরিপুষ্ট ধর্মীয় মতবাদ সম্পর্কে আবদুল্লাহ পুত্রের জ্ঞান যে নিতান্ত অগভীর সেটি বুঝে নিতে মুসা ও ঈসা’র অনুসারীদের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। যে-কারণে তাঁকে গুরুত্ব দেয়ার কোনো তাগিদ তারা বোধ করেনি। বিষয়টি মোহাম্মদকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রতি তাঁর মন এজন্য বিষিয়ে ওঠে। মদিনার ইহুদি সম্প্রদায়ের তুলনায় পশ্চাদপদ স্থানীয় আরবদের (পরে যারা আনসার নামে সম্ভাষিত হবে) কাছে তিনি অবশ্য সমাদর লাভ করেন, (*মদিনার স্থানীয় আরব জনগোষ্ঠী কেন মোহাম্মদকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল তার উত্তর লেখক প্রাসঙ্গিক যুক্তি সহকারে আলোচনা করেছেন। উৎসুক পাঠক খানে’র বই থেকে সেই অংশটি পড়ে নিতে পারেন।) এবং ক্রমশ একজন শক্তিমান নেতায় পরিণত হন। শক্তি সঞ্চয়ের পর পূর্ব অপমানের বদলা নিতে মোহাম্মদ মরিয়া হয়ে ওঠেন। যার ফলে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের উপর মোহাম্মদী বাহিনীর গজব নেমে আসে। মদিনাপর্বের প্রায় প্রতিটি সূরায় তাদের প্রতি আল্লাহর প্রিয় নবি’র রোষ ও আক্রোশ সংযমের বাঁধ মানেনি। পরবর্তিতে যা আরো তীব্রতা সহকারে কাফের ও অবিশ্বাসীদের উপর পতিত হয়েছিল। মোহাম্মদের রোষ থেকে কবিরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। এরকম কয়েকটি ঘটনা বিকল্পধারার বইপত্রে বিশ্বস্ত উৎস সহকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। পাঠকের সুবিধার্থে তার সারসংক্ষেপ এখানে তুলে দিচ্ছি :-

হযরত মোহাম্মদ তখন মদিনায় বসবাস করছেন। বয়োবৃদ্ধ ইহুদি কবি আবু আফাক মহানবি’র ধর্মের সমালোচনা করে বিদ্রূপাত্মক ভাষায় একটি কবিতা লেখেন। সেই অপরাধে ইসলামের মহান জনক লোক লাগিয়ে তাঁকে হত্যা করান। বানু খাতাম গোত্রের মেয়ে কবি আসমা বিনতে মারওয়ান আবু আফাকের এই হত্যাকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি কবিতার মাধ্যমে মোহাম্মদ ও তাঁর ধর্মের এহেন বর্বরতার প্রতিবাদ করেন। ইবনে ওয়ারাক তাঁর বইয়ে আসমা’র সেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াটি লিপিবদ্ধ করেছেন। বানু খাতামের সাহসী মহিলা আরব গোত্রগুলোর উদ্দেশ্যে নিজের ক্রোধটি এভাবে প্রকাশ করেন :-
মালিক ও নাবিতের লোকজনকে আমি ‘ইয়ে’ করি
আর আয়াজ ও খাজরাজ তোমাদেরও
তোমরা এক আগন্তুককে সমীহ করছো যে তোমাদের অংশ নয়
সে মুরাদ কিংবা মাদহিজেরও নয়
তোমাদের নেতারা যখন খুন হতে থাকে তোমরা কি নিজের আশাকে তার কাছে জিম্মি রাখো
স্যুপ রান্নার সময় লোকেরা যেমন তার প্রতি লোভী হয়ে ওঠে?
এমন কোনো বাঘের বাচ্চা কি নেই যে এক নিরস্ত্র মুহূর্তের সুযোগ নেবে
আর এই বর্বরের আশাগুলোকে খতম করে দেবে?

আসমা’র এই কবিতা মোহাম্মদকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে তোলে। শিষ্যদের ডেকে তিনি ঘোষণা দেন, ‘মারওয়ানের লাড়কিকে খতম করার রাস্তা থেকে কেউ আমায় আটকাতে পারবে না’। মহানবি’র শিষ্যরা রাতের অন্ধকারে আসমার ঘরে প্রবেশ করে এবং ছুরি দিয়ে তার পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। পাঁচ সন্তানের জননী আসমা তাঁর শিশুকে তখন দুধ পান করাচ্ছিলেন। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বানু খাতাম গোত্রের লোকজন প্রাণের ভয়ে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়। বানু নাদির গোত্রের প্রভাবশালী গোত্রপিতা কবি কাব ইবনে আশরাফকে অনুরূপ একটি পন্থায় লোক লাগিয়ে হত্যা করা হয়। পূর্ব পরিকল্পনা মতো কাব ইবনে আশরাফের রক্তসম্পর্কের আত্মীয় (*এই ব্যক্তিটি তখন মোহাম্মদের ভাষণে প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। নবি’র যে কোনো অপমানের বদলা নিতে তিনি দৃঢ় সংকল্প ছিলেন।) গভীর রাতে তাঁকে বাইরে ডেকে নেন এবং তাঁর গলায় ছুরি চালান। কাবে’র বিরুদ্ধে মক্কার কোরাইশদের সাথে গোপনে যোগাযোগ রক্ষার অভিযোগ ওঠে। মোহাম্মদকে দমনের জন্য তিনি নাকি কোরাইশদের জোটবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা দিচ্ছিলেন। কাজেই তাঁর বেঁচে থাকার প্রশ্নই ওঠে না! আলী সিনা, সুজিৎ দাশ প্রমুখ লেখকরা তাঁদের বইয়ে কবি কাব ইবনে আশরাফকে হত্যার নাটকীয় ঘটনাটি হৃদয়স্পর্শী ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন।১৩

বলা হয়ে থাকে মোহাম্মদের মক্কা বিজয় শান্তিপূর্ণ উপায়ে সাধিত হয়েছিল। একফোঁটা রক্তপাত না-ঘটিয়ে মক্কাবাসীকে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। এম. এ. খান সেই মিথ্যাভাষণকে বাতিল করে অন্য তথ্য দিচ্ছেন। তাঁর সংগৃহীত তথ্য অনুসারে মোহাম্মদের মক্কা বিজয় মোটেও শান্তিপূর্ণ উপায়ে ঘটেনি। মাত্র দুই বছর আগে সম্পাদিত হুদাইবিয়ার সন্ধিকে তুচ্ছ একটি অজুহাতে তিনি ছুঁড়ে ফেলেন এবং দশ হাজার অনুসারী সহ মক্কার অদূরে তাঁবু গাড়েন। উদ্দেশ্য মক্কায় জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ। হৃতবল কোরাইশদের প্রতিনিধি আবু সুফিয়ান তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে আল্লাহর প্রিয়তম বার্তাবাহক সুফিয়ানকে ইসলাম গ্রহণ ও তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নিতে চাপ প্রয়োগ করেন। কোরাইশ প্রধানকে তিনি ‘আসলিম তাসলাম’ বলে সতর্ক করেন। কথাটির মানে দাঁড়ায়,-‘যদি বাঁচতে চাও তো মুসলমান হয়ে যাও’। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোরাইশ গোত্রের সম্ভ্রান্ত এই প্রতিনিধি ইসলামকে কবুল বলতে বাধ্য হন। তাঁকে তিনি পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেন,-মক্কায় প্রবেশের দিন যারা কাবাগৃহে অথবা আবু সফিয়ানের ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করবে কেবল তাঁরা সহি-সালামতে জীবিত থাকবে। বাকিদের ক্ষেত্রে ‘আসলিম তাসলাম’-এর নীতিটি প্রযোজ্য হবে। খানে’র সংগৃহীত তথ্য মোতাবেক মক্কা বিজয়ের দিন মোহাম্মদ অতীতে তাঁর সমালোচনাকারী বারো জন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করেন এবং শূলে চড়ান।

মক্কা বিজয় সমাপ্ত হওয়ার পর আল্লাহর প্রিয় নবি তাঁর বিশ্বস্ত গানম্যান খালেদ বিন ওয়ালিদকে কোরাইশদের প্রতিবেশী জাযিমা গোত্রের নিকট প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য,-ইসলামের অমিত শক্তির মহড়া স্বরূপ ওই গোত্রের লোকজনকে শায়েস্তা করা। খালিদ জাযিমার লোকজনকে অস্ত্র সমর্পণের আদেশ দেন। সমর্পণপর্ব শেষ হওয়া মাত্র মহাবীর খালিদ তাঁর তলোয়ারের সাহায্যে গোত্রের সকল সদস্যকে একে-একে হত্যা করেন! মক্কা সহ সমগ্র আরববাসীর মনে আল্লাহ্ এবং তাঁর নবি সম্পর্কে ভয়, সন্ত্রাস ও সমীহ তৈরি করা ছিল এই আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য! ইবনে ইসহাক, ইবনে সাদ, আল তাবারি’র রচনায় নৃশংস ঘটনাগুলো অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ইসলামের গৌরবদীপ্ত বিজয়ের নমুনা হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। তাঁদের বর্ণনার ভিত্তিতে এম. এ. খান মোহাম্মদের মক্কা বিজয়ের প্রচলিত অতিরঞ্জনকে যাচাই করেছেন। যা প্রোপাগান্ডার আড়ালে চেপে যাওয়া সত্যকে প্রকাশ করেছে। আগ্রহী পাঠক খানে’র বইয়ের সেই পাতাগুলো উলটে দেখতে পারেন।

উপরের ঘটনাগুলো এজন্য উল্লেখ করা যে, ইসলামে অসহিঞ্চুতার বীজ খোদ মোহাম্মদের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে সুপ্ত ছিল। মোক্ষম সময়ে সেটি দানবীয় চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে। অন্য ধর্মের অনুসারীদের তুলনায় সকল দিক দিয়ে পশ্চাদপদ মুসলমান সমাজের মূল্যবোধে কোরান ও মহানবি’র আসমানী বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ হলো ‘নিষিদ্ধ কর নতুবা হত্য করো’। বিধানটি মোহাম্মদ নিজে কোরানের মাধ্যমে বৈধ করে গেছেন। Ban and killing শুধু ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রিয় শব্দ ভাবলে ভুল হবে। ইসলামের বিরুদ্ধে যে কোনো সমালোচনা প্রতিহত করার জন্য ইমানদার মুসলমানরা দ্বিতীয় কোনো রাস্তার কথা সহজে চিন্তা করতে পারেন না। কোরানের আয়াতগুলো ইসলামী জীবনবোধের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন, সন্দেহ ও ভিন্নমত পোষণকারীদের প্রতি ভয়ংকরভাবে নির্মম। সূরা তাওবার ৫ নং আয়াত১৪, শুধু এই একটি আয়াত দ্বীন-ই-মোহাম্মদের সহিংস চরিত্র বোঝার পক্ষে যথেষ্ট। এবং, এরকম অজস্র আয়াতে (http://www.thereligionofpeace.com/Quran/023-violence.htm) মহান গ্রন্থটি ভরপুর!

কোরানের নিরিখে মোহাম্মদের কর্মকাণ্ড উপলব্ধির জন্য বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ নবি’র আদি জীবনীকার ও প্রামাণিক হাদিস সংকলকদের গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এছাড়া ইসলামী মাযহাবের প্রাণপুরুষ চার ইমাম, কোরানের তাফসিরকার, ধর্মবেত্তা, পর্যটক ও ঐতিহাসিকদের রচনাকে সবিশেষ গুরুত্ব বা মর্যাদা প্রদান করা হয়। ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, ইবনে সাদ, আল তাবারি, বোখারি, মুসলিম, দাউদ, তিরমিজি, সুন্না ইবনে মাজি প্রমুখ রেফারেন্সগুলো সহি ও নির্ভরযোগ্য বলে বহু কাল ধরে স্বীকৃত। ইমাম গাজ্জালী, ইবনে খালদুন, আল বিলাদুরি, আল কিন্দি, আল বেরুনী, ইবনে বতুতা, জিয়াউদ্দিন বারণি, আমির খসরু, আবুল ফজল, আল কাফি, আল উৎবি সহ রাজা-বাদশাহদের আত্মজীবনী, চিঠিপত্র ও ফতোয়া-ই-আলমগীর-এর মতো রাজকীয় ফরমান ইসলামের মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং বিশ্বব্যাপী প্রচার-প্রসার লাভের পটভূমি বোঝার জন্য নিয়ামক উৎস বলে গণ্য হয়ে থাকে। এইসব রচনার স্রষ্টারা তাঁদের অগাধ পাণ্ডিত্য, বস্তুনিষ্ঠতা ও ঈমান-আকিদার কারণে ইসলামী সমাজে প্রবলভাবে সমাদৃত। ইবনে খাতির, হাসান আল বান্না, মাওলানা মওদূদী থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ইউসূফ কারজাভীর মতো শরিয়ত বিশেষজ্ঞরা এইসব নামের সমাদর করে থাকেন। অথচ এই নামগুলো এখন নবি মোহাম্মদের চারিত্রিক স্ববিরোধিতা ও মনোবিকার উন্মোচনের দলিল হয়ে উঠেছে। মহানবি’র চরিত্রের মাঝে সক্রিয় বৈপরীত্য, তাঁর দ্বি-মুখী আচার-আচরণ, কুসংস্কার ও মিথ্যাচার, এবং প্রতারণা, নৃশংসতা ও মারাত্মক যৌন-স্খলনের অ-Prophetic লক্ষণগুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এইসব নাম বা রেফারেন্স খোদ ইসলামের জন্য বুমেরাং প্রতীয়মান হচ্ছে। এবং এটাই মোহাম্মদী দ্বীনের সমালোচনামূলক পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে বিকল্পধারার অমেয় উৎস হয়ে উঠেছে।

এম. এ. খান তাঁর বইয়ে উক্ত রেফারেন্সগুলো ব্যবহার করেছেন। বিকল্পধারার Activism-এর মৌলিক প্রবণতা হলো ইসলামের প্রতিটি প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গকে আলোচনার টেবিলে পেশ করা। হকিং বর্ণিত পন্থা অনুসারে তথ্যের উৎস বিশ্লেষণকে সেখানে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। যার ফলে খানে’র ব্লাসফেমিতুল্য অভিযোগগুলো বাতিল করতে হলে শুধু গালগল্প ও দার্শনিক হেঁয়ালিতে কাজ হবে না। লেখক তাঁর বইটিকে অস্বীকার করার একটি পথ অবশ্য খোলা রেখেছেন। আর সেটা হলো আস্ত বইটিকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে উড়িয়ে দেয়া! সেক্ষেত্রে মিথ্যা প্রমাণের দায়ভার খোদ পাঠকের ঘাড়ে এসে পড়ে। খান যে পদ্ধতি অনুসরণ করে বইটি লিখেছেন সেখানে গালগল্প, ধর্মতত্ত্ব ও মরমীবাদের আলাপ-সালাপ জুড়ে দিয়ে তাঁর বক্তব্যকে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যার প্রশ্নটি সেখানে উঠবেই। লেখক তাঁর বইয়ে Logical Absurdity-কে প্রশ্রয় দেননি। যথাসম্ভব পরিষ্কার ভাষায় নিজের কথাগুলো বলার চেষ্টা করেছেন। যেসব পাঠক তাঁর কথায় আপত্তি তুলবেন তাঁদেরকে Logical Absurdity বাদ দিয়ে নিজের আপত্তিকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে হবে। কোনোপ্রকার ধর্মতাত্ত্বিক হেঁয়ালি’র (Theological Fallacy) সাহায্যে নিরেট তথ্য ও তার ব্যাখ্যাকে ঘুলিয়ে দেওয়ার সুযোগ সেখানে নেই। খান কিংবা বিকল্পধারার যে কোনো লেখকের বক্তব্য খণ্ডনের সময় বিষয়টি সকলের মনে রাখা দরকার।

বিকল্পধারার লেখকরা ইসলামের স্পর্শকাতর পাঠকদের জন্য আরেকটি কারণে বিপজ্জনক। মোহাম্মদের বাইশ বছরব্যাপী সাধনাকে তাঁরা ‘নকলি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। পাঠককে তাঁদের বক্তব্যের পেছনে বিদ্যমান যুক্তির মোকাবিলা করতে হবে। ইবনে ওয়ারাক তাঁর বইয়ের (Why I am not a Muslim) বিরাট অংশ জুড়ে নবি মোহাম্মদের বিরুদ্ধে কুম্ভীলকবৃত্তির সত্যতা যাচাই করেছেন। আর এম. এ. খানে’র বইয়ে সারসংক্ষেপ আকারে বিষয়টির উপর আলো ফেলা হয়েছে। লেখার ‘চতুর্থ প্রবাহ’-এ সেদিকে এবার দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
… … …

চতুর্থ প্রবাহ

এম. এ. খান তাঁর ‘তৎপর’ অনুসন্ধানে দেড় হাজার বছর পুরোনো ইসলাম ধর্মের মধ্যে মৌলিক কোনো গুণাবলী খুঁজে পাননি। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মধ্যে যেটুকু মৌলিকত্ব রয়েছে ইসলামে তার ছিটেফোঁটা নেই বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। লেখকের মতে ইসলাম হচ্ছে মোহাম্মদের যুগে বিদ্যমান ধর্মীয় মতবাদ ও শাখা-প্রশাখার সারসংক্ষেপ। তৎকালীন আরব-অঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতো। মূর্তিপূজারী আরব গোত্রগুলো ছাড়াও ইহুদি, খ্রিস্টান, সাবেইন ও জরথ্রুস্টীয় মতবাদে বিশ্বাসীদের অবাধ বিচরণ ছিল সেখানে। হেজাজের কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও সমগ্র আরব-অঞ্চলে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল। সেমেটিক ভাবধারার আদি পিতা ইব্রাহিমের ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপনকারী হানিফি এবং খ্রিস্টধর্মের শাখা হিসাবে বিকশিত মনি, নেস্তোরিয় ও সন্ন্যাসী সম্প্রদায় আরব অঞ্চলকে তাদের স্থায়ী ডেরা হিসাবে বেছে নিয়েছিল। ইসলাম হচ্ছে এগুলোর যোগফল। বিভিন্ন মহাজনদের বক্তব্য উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ সহকারে উপস্থাপনের মাধ্যমে লেখক তা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।

তাঁর মতে ইসলাম হলো ‘নকলি’। নবি মোহাম্মদ যে দ্বীনটিকে ঈশ্বর-প্রেরিত বলে দাবি করেছেন তার ষোল আনা উপরে বর্ণিত উৎসগুলো থেকে তিনি আত্মসাৎ করেছেন। ইসলামী জীবনব্যবস্থার ভিত্তি স্বরূপ নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, ওজু, মুসলমানী সহ প্রায় প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠান ইহুদি, খ্রিস্টান, সাবেইন, হানিফি, জরথ্রুস্টিয়ান ও প্রতিমা উপাসক আরবদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান থেকে সরাসরি হজম করা হয়েছে। জগতের সৃষ্টি, আদিপাপ, ইহকাল-পরকাল, রোজ হাশর, বেহেশত-দোজখ থেকে শুরু করে ‘মিরাজ’-এর ধারণার মধ্যে পারস্যের জরথ্রুস্টীয় ধর্মের ছায়া প্রকটভাবে বিদ্যমান। (*ইসলামে পারস্য ও অন্যান্য সভ্যতার প্রকট প্রভাব প্রসঙ্গে ওয়াইডেনগ্রেন, ইগনাজ গোল্ডজিহার, নলডেক, উইল ডুরাণ্ট-এর মতো খ্যাতিমান বিদ্বান ছাড়াও আরো অনেকেই লিখেছেন। ইবনে ওয়ারাক Why I am not a Muslim গ্রন্থে এইসব অনুসন্ধানের বিবরণ তুলে ধরার পাশাপাশি এ-সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর গ্রন্থের The Origin of Islam পরিচ্ছেদে বর্ণিত Zoroastrianism বা জরথ্রুস্ত্রবাদ অংশটি পাঠক পড়ে নিতে পারেন।) এমনকি মোহাম্মদের ‘আল্লাহ্’ পর্যন্ত মৌলিক নন। মক্কার প্রতিমা উপাসক গোত্রগুলো সকল দেবতার উৎস বা স্রষ্টা হিসাবে ‘হুবল’ নামে এক ঈশ্বরের আরাধনা করতো। কাবাগৃহে ‘হুবল’-এর মূর্তি সেই প্রাচীনকাল থেকে সংরক্ষণের রীতি ছিল। মোহাম্মদের ‘আল্লাহ্’ হচ্ছেন ‘হুবল’-এর সংশোধিত রূপ। মহানবি নিজের প্রয়োজনমতো বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য ধার করেছেন। এবং, তাঁর বিশ্বাসের উপযোগী করে ইসলামে প্রয়োগ ও ব্যবহার করে গেছেন। ফিকাহবিদ’রা পরে এগুলোকে ইসলামী জীবনবোধের ভিত্তি হিসাবে আইনে পরিণত করেন। যে-কারণে অন্য ধর্মের উপর মোহাম্মদী দ্বীনের শ্রেষ্ঠত্ব বা নতুনত্বের আত্মম্ভরী দাবিকে খান তাঁর গ্রন্থে প্রশ্নবিদ্ধ ও বাতিল করেছেন।

লেখকের এই প্রতিক্রিয়া কিছু সরলীকরণের রেশ রেখে যায়। ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের ইতিহাসে অন্য মতবাদের দ্বারা ‘প্রভাবিত হওয়া’ এবং ‘ধার ও ঋণ গ্রহণ’ স্বাভাবিক একটি বিষয়। খান তাঁর গ্রন্থে ইসলামকে ‘নকলি’ প্রমাণে ব্যস্ত থাকার কারণে ‘প্রভাব, ধার ও ঋণ’-এর সাথে ‘নকল’-এর ব্যবধানটি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়নি। এতে করে প্রতিপক্ষকে তাঁর বক্তব্য খণ্ডন করার সুযোগ তিনি করে দিয়েছেন। খানে’র অভিযোগকে তাঁর পাঠকরা অন্য খাতে প্রবাহিত করতেই পারেন। প্রখ্যাত ইরানী লেখক ও ইসলামী চিন্তাবিদ আলী দাস্তি এর মোক্ষম উদাহরণ। দাস্তি তাঁর Twenty three years গ্রন্থে হযরত মোহাম্মদের নবি হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেছিলেন। উটের রাখাল থেকে পয়গম্বরে পরিণত হওয়া মোহাম্মদের জীবনে ‘নকল’-এর অভিযোগকে তিনি ধর্মীয় ঐতিহ্যের পরম্পরা হিসাবে দেখেছেন। যেখানে এক পয়গম্বরের জীবন থেকে অন্য পয়গম্বর শিক্ষা নিয়ে থাকেন। একজনের মতবাদের দ্বারা অন্যজনের মতবাদ প্রভাবিত হয়। বিকৃতির করাল গ্রাসে আবিল হয়ে ওঠা পুরোনো মতবাদ এভাবে নতুন করে বিনির্মিত হয়। মানবজাতির জন্য নতুন পথের দিকনির্দেশনা বয়ে আনে। দাস্তির মতে মোহাম্মদ অনগ্রসর ও ক্ষয়িষ্ণু আরব সমাজে বৈপ্লবিক এই কাজটি সমাধা করেছিলেন। তাঁর অনুসারীরা আজো সেই কাজের মূল্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। যার ফলে গোঁড়ামি, অজ্ঞতা ও ভ্রান্তির মধ্যে তাঁরা ডিগবাজি খাচ্ছেন। দাস্তির ব্যাখ্যাকে মোকাবিলা করতে হলে ‘প্রভাব, ধার ও ঋণ’-এর সাথে ‘নকল’-এর অর্থগত ফারাকটি বোঝা প্রয়োজন। এম. এ. খান সহ বিকল্পধারার অনেক লেখক বিষয়টি উপক্ষো করায় সরলীকরণের বিপদ সেখানে রয়ে গেছে। শব্দগুলো সম্ভবত পৃথক অর্থ বোঝায়। আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও প্রসঙ্গটি নিয়ে খানিক বাকওয়াজি আশা করি পাঠকের বিরক্তির কারণ হবে না :-

ধর্মীয় বিশ্বাসের বিকাশ-বিবর্তনের ইতিহাসে অন্যের দ্বারা ‘প্রভাবিত হওয়া’ এবং ‘ধার ও ঋণ গ্রহণ’ সমাজ-বিবর্তনের ছক মেনে ঘটেছে। বহু ঈশ্বর বা দেবতায় বিশ্বাস থেকে এক-ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপনের ইতিহাসে মানবসমাজের উত্তরণ পারস্পরিক প্রভাব ও ঋণগ্রহণের মাধ্যমে ঘটেছিল। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উদ্দেশে হোম, যজ্ঞ ও পশুবলি, উপাসনাগৃহে ঈশ্বর ও তাঁর অবতারের মূর্তি সংরক্ষণ, লিঙ্গ-ত্বকের অগ্রভাগ কর্তন সহ বিবিধ প্রথা-অনুষ্ঠানের মাঝে বহু দেবতায় বিশ্বাসী সমাজের রেশ এখনো রয়ে গেছে।

বিজ্ঞজনদের মতে সমাজ-বিবর্তনের ধারা অনুসারে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মতবাদ বিবর্তিত হয়েছে। কৃষি ভিত্তিক জীবনধারায় সম্পদের বণ্টন এবং ব্যক্তিমালিকানা ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই সূত্রে নগর ভিত্তিক সমাজ ও শ্রম-বিভাজনের সিঁড়িগুলো গড়ে উঠতে শুরু করে। এমতাবস্থায় সমাজের আদিম ছকে পরিবর্তন অমোঘ ছিল। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান তাই বদলাতে শুরু করে। মানুষ এতোদিন প্রকৃতিকে সকল শক্তির আঁধার ভেবেছে। তাকে মোকাবিলার জন্য দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করেছে। প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্কটি ছিল দ্বৈততায় ভরা। নিজের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রকৃতির কাছে তাকে বারবার ধর্ণা দিতে হয়েছে। এটি ছিল সম্পর্কের একটি দিক। আবার প্রকৃতির মধ্যে সবকিছু ধ্বংস করার যে ক্ষমতা রয়েছে মানুষ তাকে সমীহ করতে বাধ্য ছিল। এটি হলো সম্পর্কের উল্টো দিক। এই দ্বৈততার কারণে মানুষ প্রকৃতিকে ভয় করেছে। বিচিত্র বিশ্বাস ও উপাসনার মাধ্যমে তার প্রতি প্রকৃতির সুদৃষ্টি কামনা করেছে। কিন্তু অধিক বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রকৃতিকে ব্যবহারের কৌশল শিখে নেওয়ার পরে দলবদ্ধ মানুষের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এলো। শ্রমের ধরনে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হতে লাগলো। সেইসঙ্গে মুনাফা ও সম্পদের উপর ব্যক্তিমালিকানার দাবি সামনে চলে আসায় মানুষ তখন অসমান হয়ে পড়লো। দল ও গোষ্ঠীর জায়গায় সমাজ, দলপতি ও গোত্রপিতার স্থলে শাসক, প্রকৃতির স্থানে তাকে নিয়ন্ত্রণকারী বিমূর্ত শক্তি সৃষ্টির চিন্তাধারা তখন থেকে শুরু হয়। প্রকৃতিকে নিরাকার ঈশ্বরে বদলে ফেলার ভাবনা অসমতা ভিত্তিক সেই ব্যবস্থার মাঝে সুপ্ত ছিল। পরে যা ধর্ম নামে লোকসমাজে বিদিত হয়েছে।

ধর্মীয় বিশ্বাসের এই সুদীর্ঘ ইতিহাসে একটি বিশ্বাসের উপর অন্যটির প্রভাব, একটি মতবাদের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ অন্য মতবাদের বিকাশ তাই অস্বাভাবিক ছিল না। আচার-অনুষ্ঠানের ‘নকলি’ বা অনুকরণের ঘটনাগুলো সেখান থেকেই এসেছে। উদাহরণ হিসাবে হিন্দু ধর্মকে বিবেচনা করা যেতে পারে। বৈদিক সুক্তগুলোয় ব্রহ্ম নামের একটি চরিত্রের দেখা মিলবে। বেদ-এ তাঁকে অন্ন, কবি ইত্যাদি উপমায় স্তব করা হয়েছে। ইনি হচ্ছেন ঈশ্বরের আদিতম রূপক। হোম ও যাগ-যজ্ঞের মাধ্যমে (যেগুলো আবার আর্য আক্রমণে বিধ্বস্ত হরপ্পা, মহেঞ্জদারো ভিত্তিক সিন্ধু সভ্যতা ও দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার অবদান) তাঁকে পরিতুষ্ট করা হতো। বৈদিক সেই ঈশ্বর উপনিষদ-এর রূপময় জগতে এসে নিরাকার ও অটল ব্রহ্ম-এ পরিণত হলেন। তিনি সকল গতি, শক্তি বা সক্রিয়তার কারণ। অথচ জাগতিক সৃষ্টি ও ঘটনায় অংশ নেওয়ার ব্যাপারে অক্রিয় বা নিরাসক্ত। এই ঈশ্বর কিছু সৃষ্টি করছেন না কিন্তু সৃষ্টি তাঁকে পরিবেষ্টন করে সক্রিয় রয়েছে। উক্ত হেঁয়ালির কারণে উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্ম’র পূজা ও আরাধনা অর্থহীন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিরাজমান থাকার ফলে সকল পূজা, আরাধনার ঊর্ধ্বে তাঁর অবস্থান।

উপনিষদে ভাববাদী চিন্তনের চরম উৎকর্ষ যে ঘটে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ভারতীয় মানসে দার্শনিক অধিবিদ্যার বিকাশ ঘটেছিল। ব্রহ্ম’র স্বরূপ অন্বেষণের তাগিদ থেকে সৃষ্ট অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ ও দ্বৈতাদ্বৈতবাদের মতো দার্শনিক মতবাদ তার প্রমাণ। কিন্তু এতোকিছুর পরেও উপনিষদ-বর্ণিত ব্রহ্ম’র নাগাল পাওয়া যায়নি। হিন্দু সম্প্রদায় তাই নিজেদের মানস-চেতনায় ব্রহ্ম’র প্রতীকী একটি স্বরূপ সৃষ্টির তাগিদ বোধ করেছেন। ইনি অপেক্ষাকৃত কম হেঁয়ালিপূর্ণ হবেন, যাতে করে তাদের ঈশ্বর উপাসনার খিদে মিটে। ব্রহ্মা, শিব ও বিঞ্চু সেই ভাবনার ফসল। তাঁদের মাধ্যমে ব্রহ্ম সৃষ্টি-স্থিতি ও প্রলয় সমাধা করছেন। এই ত্রয়ী বা ভগবানদের ঐশ্বরিক ক্ষমতার মধ্যে ব্রহ্ম’র আভাসটি ধরা পড়েছে বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করেন।

হিন্দু সমাজ ত্রয়ী’র আরাধনাকে শেষ কথা ভেবে বসে থাকেনি। ইহলোকে ব্রহ্মা, শিব ও বিঞ্চু’র মানবীয় স্বরূপ নির্মাণে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। যার ফলে শ্রীকৃষ্ণের মতো বিঞ্চু অবতারের আবির্ভাব ঘটে। পুরাণ অনুসারে জগতের কল্যাণে বিষ্ণু বারবার বিভিন্ন রূপ ধারণ করে মর্ত্যে আগমন করেছেন। শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে যা অবশেষে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। স্বর্গের মুনি-ঋষি, দেবী ও দেবতারা পুনর্জন্মের দায় মিটাতে মানুষের দেহ ধারণ করেছেন এবং মানবীয় নিয়তি অনুসারে ইহলোক দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। হিন্দুরা তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসে এভাবে একটি বিচিত্র রূপকল্প সৃষ্টি করে নিয়েছেন। যেখানে ব্রহ্ম’র পুরুষরূপী অক্রিয়তার মাঝে নারীরূপী প্রকৃতি নিজেকে সক্রিয় রাখে। যার ফলে সৃষ্টি ও লীলা সম্ভব হয়।

বহু লোকের ভাবনা গলেমিশে বিচিত্র শাখা-প্রশাখা ও কিংবদন্তি জন্ম দেওয়ার কারণে হিন্দু ধর্মে অনুকরণ, সংশোধনের বিষয়গুলো ‘ধার, ঋণ’ ও ‘নকলি’র অভিযোগকে গৌণ করে ফেলে। হিন্দু ধর্মের প্রেক্ষাপটে এই অভিযোগের কোনো গুরুত্বই যেন থাকে না! এটি এমন এক ধর্ম যে নিরাকার ব্রহ্ম থেকে প্রতিমা-উপাসনায় এবং সেখান থেকে পুনরায় নিরাকার ব্রহ্ম-এ পৌঁছানোর অভাবিত সিন্থেসিসের কারণে আজো বিস্ময় জাগায়। সংশোধনের ব্যাপকতায় হিন্দুরা তাই সকল ধর্মকে একাই অতিক্রম করেন!

ভারতবর্ষ ছেড়ে যদি সেমেটিকে আসি অভিজ্ঞতা অতোটা বর্ণাঢ্য না হলেও ‘প্রভাব, ধার ও ঋণ’-এর প্রবণতা এখানেও দেখা যায়। সেমেটিক ইহুদি ধর্মে একটি মাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপনের বীজ মিশরীয় সূর্যদেবতা রা-এর মাঝে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তাঁকে সর্বময় ক্ষমতার প্রতীক ভাবার মধ্যে একেশ্বরবাদের এই বীজটি সুপ্ত ছিল। ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা সঠিক হলে ফারাও তুতমিস সম্ভবত এই ভাবনাকে মূর্তিপূজারী ও বহুদেবতায় বিশ্বাসী মিশরীয় সমাজে পুঁতে দেওয়ার সংকল্প করেন। তিনি সফল হতে পারেননি। তবে মিশরীয় রাজদরবারে প্রতিপালিত মোজেস তুতমিসের ভাবনাকে নিজের মধ্যে জীবিত রাখতে বাধ্য ছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এ ঈশ্বরের ধারণাটি সৃষ্টি হয়। মোজেস যাঁর বার্তাবাহক হিসাবে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন।

ফারাও শাসিত মিশরে মোজেসের সম্প্রদায় শ্রমিকশ্রেণীর কাতারভুক্ত ছিল। চোখে পড়ার মতো কোনো মর্যাদা তাদের ছিল না। সম্প্রদায়টি সেখানে ক্রীতদাসসুলভ জীবন অতিবাহিত করছিল। মোজেস তাদের মধ্যে স্বাধিকার, আত্মমর্যাদা ও নিজস্ব একটি ভূখণ্ডের স্বপ্ন জাগিয়ে তোলেন। স্বপ্নটি তাদের মধ্যে পাথরের মতো অনড় হয়ে ওঠে। নতুন একটি ভূখণ্ডে বসতি স্থাপনের উদ্দেশে তারা মোজেস ও তাঁর ভাই এরোনকে অনুসরণ করে মিশর ত্যাগ করে। ৪০ বছরের ঘটনাবহুল পথ-পরিক্রমায় সম্প্রদায়টি আব্রাহামকে জাতির পিতা হিসাবে মেনে নেয় এবং মোজেস ঈশ্বর প্রেরিত বার্তাবাহকে পরিণত হন।১৫

দীর্ঘ পথযাত্রায় ইহুদিরা ‘প্রভাব, ধার ও ঋণ’-এর সাহায্যে ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি রূপে নিজেদের পরিচিত করে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। ইহুদি সুন্নত প্রথা মিশরীয় ঐতিহ্যের স্মারক। ঐতিহাসিক হিরোডোটাস প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম সূতিকাগার মিশর ভ্রমণকালে তাদের মধ্যে সারকামসেশনের প্রচলন দেখতে পেয়েছিলেন। পারস্য সভ্যতার প্রভাবও সেখানে ব্যাপক। খ্রিস্ট ধর্ম মূলত ইহুদি ধর্মের মজ্জা চুষে বড়ো হয়েছে। যিশু একজন ইহুদি ছিলেন। এবং ইহুদি পরিচয়ে ত্রিত্ববাদের বাণী প্রচার করেছেন। নিজের বাণীর সাথে সামঞ্জস্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে ইহুদি কিছু আচার-অনুষ্ঠানকে (যেমন বিশ্রাম দিবসে কোনো কাজ না করা, শূকরের মাংস না খাওয়া ইত্যাদি) সংশোধন করেছিলেন মাত্র।১৬ তবে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের ভিন্নতা ছাড়া ধর্ম দুটিকে অনেকক্ষেত্রে পরস্পরের নকল মনে হয়।

উপরের উদাহরণ ধর্মীয় মতবাদের বিকাশ-বিবর্তনে ‘প্রভাব, ধার ও ঋণ’ গ্রহণের ছবিকে তুলে ধরে। চাইলে একে ‘নকলি’ বলা যেতে পারে। সমস্যা হলো ইসলামে অন্যের থেকে ধার করার স্বীকৃত এই পন্থাকে অস্বীকার করার প্রবণতা রয়েছে। মুসলমানরা কোরানকে মৌলিক ও নির্ভুল গ্রন্থ বলে ভাবতে অভ্যস্ত। এই গ্রন্থটি সকল আসমানী গ্রন্থের চূড়ান্ত সংশোধন রূপে নাজিল হয়েছে বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন। সুতরাং কোরানের প্রতিটি আয়াতকে নির্ভুল বা সংশোধনের অতীত গণ্য করতে হবে। এবং তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ও সন্দেহ করা যাবে না। বদ্ধমূল এই ধারণার কারণে মুসলমান মানসে ‘প্রভাব, ধার ও ঋণ’-কে অন্য ধর্মের বিকৃত প্রচারণার বিরুদ্ধে আদর্শিক জিহাদ হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যদিও সরল বিশ্বাসী মুসলমানকে বিশ্বাস করানো দুরূহ যে কোরান কোনো নির্ভুল গ্রন্থ নয়। গ্রন্থটি নবি মোহাম্মদের মনঃস্তাত্ত্বিক জটিলতার ফসল।

উক্ত বিষয়টির উপর আলী সিনা তাঁর Understanding Muhammad এবং সুজিৎ দাশ Ummasking Muhammad-এ বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। সেখানে তাঁরা মোহাম্মদকে একটি সাইক্রিয়াটিক কেস হিসাবে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। কোরান, হাদিস, সিরা ও ঐতিহাসিক তথ্যের আলোকে মহানবি’র জীবনে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার মনঃস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও লেখকরা দিয়েছেন। তাঁদের মতে পিতা-মাতার স্নেহবঞ্চিত মোহাম্মদ তাঁর জীবনের বিভিন্ন স্তরে নানারকম মানসিক ব্যাধি ও জটিলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ফ্রয়েড, ভাকনিন, মাস্টারসন প্রমুখ মনোবিশেষজ্ঞদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে উভয় লেখক তা প্রমাণ করেছেন। তাঁদের ব্যাখ্যা অনুসারে নবি মোহাম্মদ তাঁর অবতার-জীবনে আত্মপ্রেম বৈকল্য (Narcissistic Personality Disorder), বাতিক বৈকল্য (Obsessive Compulsive Disorder), অস্থায়ী মৃগী বা মূর্চ্ছা রোগ-এর (Temporal Lobe Epilepsy) চমৎকার শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। এছাড়া কিশোরীমৈথুন মোহ (Phedophilia), গায়েবি মোহ (Positive Schizophrenia) এবং অতিরিক্ত হরমোন উৎপাদনের বিশৃঙ্খলা (Acromegaly) তাঁকে প্রচণ্ডভাবে ভুগিয়েছে। যার ফলে তিনি বিকারগ্রস্ত একজন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। মোহাম্মদের এই আত্মপ্রেম বৈকল্য পরবর্তিতে ঘনিষ্টজনদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। তাঁর স্ত্রী খাদিজা সহচারী আত্মপ্রেম বৈকল্য-এ (Co-Dependent Narcissistic Personality Disorder) আক্রান্ত হয়েছিলেন। এবং, মোহাম্মদী দ্বীনের অন্ধ ভক্ত-অনুসারী সকলেই কোনো-না-কোনোভাবে আত্মপ্রেম বৈকল্য অথবা সহচারী আত্মপ্রেম বৈকল্য-এর শিকার।

সিনা ও সুজিতের বিশ্লেষণী ব্যাখ্যা এই ইঙ্গিত প্রদান করে যে মোহাম্মদের মানসিক-জটিলতার ফলাফল থেকে কোরান ও আল্লাহ্ উভয়েই জন্ম নিয়েছিলেন। আত্মপ্রেম বৈকল্য-এ আক্রান্ত মানুষ ভীষণ চতুর, স্বার্থপর এবং প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে থাকে। স্বার্থ হাসিলের জন্য এই ব্যক্তি বিরাট মিথ্যাকে (Big Lie) অবলীলায় সত্যে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে। এটি তার স্বভাবের মধ্যে সহজাতভাবে সক্রিয় থাকে। নিজের তৈরি মিথ্যাকে সত্য হিসাবে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার এক-পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বয়ং ঐ মিথ্যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। তার সহি সত্তা (True Self/ Id) মিথ্যা সত্তা’র (False Self/ Ego) কাছে তখন পরাজিত হয় এবং চরম সত্তা’র (Super Ego) মনোরম মিথ্যাটি সৃষ্টি করে বসে। মোহাম্মদের মিথ্যা সত্তা এভাবে কোরানের সাহায্যে আল্লাহর চরম সত্তা’কে সৃষ্টি করেছিল। নিজের সহি সত্তা’কে মোকাবিলা করার ভয় ও আতংক থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে মোহাম্মদ কোরানে বর্ণিত আল্লাহ’কে সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর মিথ্যা সত্তা আল্লাহ্ নামক চরম সত্তা’কে জন্ম দিতে বাধ্য ছিল। মানসিক জটিলতার ক্রমবিকাশে চরম সত্তা’র ইমেজ খাড়া করতে না-পারলে নবি রূপে জনগণের কাছে নিজেকে বৈধ প্রমাণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না। সুতরাং মোহাম্মদ তাঁর মনোভূমে আল্লাহ’র (চরম সত্তা) বীজ কর্ষণে বাধ্য ছিলেন।

আত্মপ্রেম বৈকল্য-এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো স্বার্থ বা উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে নিজেকে সে অবিরত রূপান্তর করতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় উদ্দেশ্য সফল করার জন্য মিথ্যা সত্তা পদে-পদে তার নিজেকে চরম সত্তা’র বাধ্য বা অনুগত রূপে উপস্থাপন করে। কিন্তু উদ্দেশ্য সফল হওয়ার পর চরম সত্তা’র জায়গাটি নিজেই দখল করতে শুরু করে। চরম সত্তা’র স্থানে স্বয়ং নিজেকে সে ‘প্রতিস্থাপিত’ করে। মোহাম্মদের জীবনেও এমনটি ঘটতে দেখা যায়। মক্কাপর্বে প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন মোহাম্মদ চরম সত্তার (আল্লাহ) দাস রূপে নিজেকে জাহির করেছিলেন। কিন্তু মদিনাপর্বে দাবার ছক পাল্টাতে শুরু করে। আল্লাহর জন্য নির্ধারিত আসনে মোহাম্মদ নিজেই চড়ে বসেন। তাঁর মিথ্যা সত্তা তখন চরম সত্তা’র আসনে নিজেকে ‘প্রতিস্থাপিত’ করে। আলী সিনা ও সুজিৎ দাশ মক্কা এবং মদিনাপর্বে অবতীর্ণ কোরানের একাধিক সূরা’র নজির পেশ করার মাধ্যমে ‘প্রতিস্থাপন’-এর খেলাটিকে ব্যাখ্যা করেছেন। মিথ্যা’কে সত্যে পরিণত করার মনঃস্তাত্ত্বিক খেলায় (Mind Game) হিটলার, জিম জোনস, ডেভিড কোরাইশ সহ বর্তমান বা অতীতের অন্যান্য Cult Leader-এর সাথে মোহাম্মদের কোনো তফাত নেই। তাঁরা সকলে এক-কাতারেই পড়েন। কোরান নামক আসমানী মিথ্যাটি মোহাম্মদের মনোজগতে উৎপাদিত হয়েছিল, যার চৌদ্দ আনা আবার অন্যের থেকে তিনি ধার করেছিলেন! আত্মপ্রেমী’র স্বভাবসুলভ চরিত্র অনুসারে ‘ধার’-এর অভিযোগকে পরে ‘বিকৃতি সংশোধন’-এর অজুহাতে তিনি অস্বীকার করেছেন। এম. এ. খান সম্ভবত সেই পটভূমি থেকে কোরান ও ইসলামী প্রথা-অনুষ্ঠানকে ‘নকলি’ নামে আখ্যায়িত করে থাকবেন।

ইসলামী ব্যাখ্যা অনুসারে কোরান সংকলনের ইতিহাস মোটের উপর ২৫ বছর। কিন্তু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ও রাজশক্তি গ্রন্থটির উপর বারবার কলম ঘষেছে। প্রায় ৩০০ বছর ধরে কোরানকে সুবিধামতো সংস্কার, সংশোধন ও পরিমার্জনা করা হয়েছে। ইয়েমেনের প্রাচীনতম মসজিদ সানা’র সংস্কার কাজ চলাকালে মসজিদ কর্তৃপক্ষ কোরানের একটি হস্তলিখিত প্রাচীন পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান। বিশেষজ্ঞদের দ্বারা এটি পরীক্ষা করানো হয়। সানা’য় সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপির সাথে বর্তমানে পঠিত কোরানের গরমিল রয়েছে। সূরার বিন্যাস থেকে শুরু করে শব্দ, বাক্য ও অর্থের ক্ষেত্রেও বাজারে প্রচলিত কোরানের সাথে তার ব্যবধান পাওয়া গেছে।১৭ খলিফা ওমর ও ওসমানের শাসনামলে ‘কোরান সংকলন কমিটি’ যেসব আয়াতকে সহি নয় বলে বাতিল বা ধ্বংস করেছেন সেগুলো নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। আল্লাহ্ হচ্ছেন কোরানের স্রষ্টা। ইসলামী ব্যাখ্যা মতে ধরায় মোহাম্মদের আগমনের অনেক আগে থেকে লওহ-মাহফুজে এই গ্রন্থটি সংরক্ষিত ছিল। ইতিপূর্বে প্রেরিত আসমানী গ্রন্থগুলোকে কোরানে বিকৃতির শিকার বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহর বাণী হিসাবে সেগুলো অনুসরণ না করার জন্য নবি মোহাম্মদ সবাইকে সাবধান করেছেন। আসমানী বাণী বিকৃত হওয়ার এমন জলজ্যান্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও এতোসব জটিলতার মধ্য দিয়ে কোরান সংকলনের প্রয়োজন কেন হলো? আল্লাহ্ চাইলে সহজেই এটাকে সংরক্ষণ করতে পারতেন! সুতরাং কোরানের ঐশী নির্ভুলতার যে দাবি করা হয় তার শক্ত কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। আল্লাহর প্রিয় দূত জিব্রাইলের মাধ্যমে প্রেরিত আসমানী গ্রন্থটি ইতিপূর্বে প্রেরিত গ্রন্থগুলোর মতো স্ববিরোধী বক্তব্য আর চতুর ও মিথ্যা গালগল্পে ভরা। কোরান পাঠের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে Online Activist (এবং আলী সিনা (http://alisina.org), ফেইথফ্রিডম (http://www.faithfreedom.org/) ও ফ্রিডমবুলওয়ার্ক-এর (http://www.freedombulwark.net/) প্রদায়ক) আলী সিনা তাই পরিষ্কার ভাষায় লিখেছেন :-

কোরান পাঠের পর আমি মর্মাহত হয়ে পড়ি। … আল্লাহর সৃষ্ট গ্রন্থে সহিংসতা, ঘৃণা, অশুদ্ধি, বৈজ্ঞানিক ত্রুটি-বিচ্যুতি, গাণিতিক ভুল-ভ্রান্তি, কিম্ভূতকিমাকার যুক্তিবিন্যাস, ভাষা ও ব্যাকরণের অশুদ্ধ প্রয়োগ এবং নৈতিকতা সংক্রান্ত গোলমেলে ঘোষণাগুলো দেখে আমি মর্মাহত বোধ করতে থাকি। গ্রন্থটিকে প্রত্যাখ্যান করার কারণে মনের মধ্যে জেগে ওঠা অপরাধবোধ, বিভ্রান্তি, মোহের অবসান, অবসাদ ও ক্রোধের স্তরগুলো পার হওয়ার পর আমি এই উপসংহারে উপনীত হই যে কোরান ঈশ্বর-প্রেরিত কোনো গ্রন্থ নয়, বরং এটি হচ্ছে শয়তানের লেখা পদাবলী, একটি তামাশা, এবং অসুস্থ মনের তৈরি মাল।১৭

এম. এ. খানে’র বক্তব্য সিনা’র অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। ইসলামের ‘নকলি’ প্রবণতা, ইহুদি-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মাচার সম্পর্কে নবি মোহাম্মদের ভ্রান্ত ধারণা ও কোরানে প্রতিফলিত ভুল-ভ্রান্তির কারণ নিয়ে আরো অনেকেই লিখেছেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক উইলিয়াম ম্যূর (Life of Prophet Mohamet/ The Apology of Al-Kindi-In Defense of Christianity Against Islam), বেঞ্জামিন ওয়াকার (The Foundation of Islam১৯) ও টিসডলের (The Originic Source of Quran) গ্রন্থগুলো এক্ষেত্রে খুবই জরুরি। ইতিপূর্বে উল্লেখিত ইবনে ওয়ারাক-এর ‘Why I am not a Muslim’ এবং সৈয়দ কামরান মির্জা’র ‘Samples of Quranic Contradictions, Inconsistencies and Errors’ হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস। কোরানের ভুল-ত্রুটি নিয়ে গ্রন্থ দুটিতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। এছাড়া ‘কোরান কি ঈশ্বর প্রেরিত কোনো গ্রন্থ?’-এই প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে ১৯৯৫ সালে কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে আয়োজিত বিতর্কটি এখানে অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রখ্যাত ইসলাম বিশেষজ্ঞ ড. জামিল বাদওয়ানী অমুসলিম বিশেষজ্ঞ জে স্মিথের সাথে এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। পরে যা তিনটি পর্বে ‘ডিবেট পেপার’ (http://debate.org.uk/topics/history/home.htm) আকারে অনলাইনে প্রকাশিত হয়। আলী সিনা’র সঙ্গে প্রখ্যাত পাকিস্তানী ইসলাম-বিশেষজ্ঞ ড. জাভেদ আহমদ গামিদি’র লিখিত বিতর্ককে প্রাসঙ্গিক রেফারেন্স হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। গামিদি’র প্রিয় ছাত্র ড. খালিদ জহিরের মধ্যস্থতায় ‘প্রুভিং ইসলাম’ (http://alisina.org/islam-probed/) নামের এই লিখিত বিতর্ক উভয় পক্ষের শর্ত ও সম্মতির ভিত্তিতে প্রায় ছয় মাস ধরে চলমান ছিল। ইসলামের সামগ্রিক তাৎপর্য নিয়ে আয়োজিত এই বিতর্ক পাঠকের জন্য আকর্ষণীয় খোরাকি। ইরানের আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু এবং আয়াতুল্লা খোমেনি’র অন্যতম ঘনিষ্ট সহচর (*পরবর্তিতে খোমেনি’র সাথে মতবিরোধের কারণে গৃহবন্দি) মরহুম আয়াতুল্লা মুনতাজেরি’র সাথে সিনা’র আরেকটি লিখিত বিতর্কও (http://alisina.org/ayatollah-montazeri-vs-ali-sina-2/) বেশ চিত্তাকর্ষক। জীবনের অন্তিমপর্বে মুনতাজেরি এই বিতর্কে অংশ নেন। উক্ত রেফারেন্সগুলো ছাড়াও এ-সংক্রান্ত প্রচুর লেখাপত্র অনলাইনে সুলভ। পাঠক ইচ্ছে করলে সেগুলো পড়ে নিতে পারেন। এম. এ. খানে’র বক্তব্যে যে সরলীকরণ ঘটেছে এইসব লেখাপত্র তা পূরণের জন্য যথেষ্ট হবে বলে মনে হয়।
… … …

পঞ্চম প্রবাহ

এতোক্ষণের আলোচনায় এটি বোধহয় স্পষ্ট করা গেলো যে এম. এ. খানে’র রচনা প্রাসঙ্গিক তথ্য ও নিরেট যুক্তি দিয়ে বোনা। তাঁর বইটিকে Ban and killing-এর পুরোনো ভাবাবেগের সাহায্যে হয়তো অনেকদিন দাবিয়ে রাখা যাবে! কিন্তু বইটির যৌক্তিক বাহাস-এর (Logical Argument) শক্তি তাতে বিনষ্ট হয়ে যাবে না। ইসলাম সম্পর্কে যেসব আপত্তি তোলা হয়েছে সেগুলোর যৌক্তিকতা নিরূপনের জন্য বিকল্পধারার রচনার সূক্ষ্ম পঠন (Critical Reading) তাই জরুরি। তাতে করে ইসলাম-সমালোচকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা করার পদ্ধতি নিয়ে পাঠক ভাবনা করার সময় পাবেন। তাঁদের দোষ-ত্রুটি বা ভ্রান্তিকে চিহ্নিত করাও সহজ হবে। পৃথিবীতে কোনো জ্ঞান প্রশ্ন, সন্দেহ ও বিনির্মাণের বাইরে নয়। সুতরাং পাঠকের কাছে এম. এ. খান তাঁর বইয়ের যৌক্তিক পঠন-পাঠন ও আলোচনা দাবি করতেই পারেন। লেখক যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ইসলামকে হেয় করে থাকেন তবে পাঠকের ‘যৌক্তিক অনুসন্ধান’ নিশ্চয় সেটি ধরিয়ে দিতে সক্ষম হবে। এবং উপযুক্ত তথ্য ও ব্যাখ্যার কারণে অন্যরা তা মেনে নিতে দ্বিধা করবেন না।

খানে’র বইটি পাঠের সময় মনের মধ্যে তাই নানা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। জগতে এই মুহূর্তে মানুষের অনেক গুরুতর সমস্যা রয়েছে। আয়-বৈষম্যের সাথে বেকারি, মূল্যস্ফিতি ইত্যাদির চাপ মানুষকে পিষে মারছে। দরিদ্র দেশগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারছে না। বিশ্বব্যাপী সুশাসনের তীব্র সংকট ক্ষমতার রাজনীতিকে এরিমধ্যে ক্যারিকেচারে পরিণত করেছে। যার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তাদের ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা আস্তে-আস্তে হারিয়ে ফেলছেন। সামাজিক পরিবর্তন ঘটানোর মতো নিয়ামক শক্তির অভাবে তাদের প্রতিবাদী হওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। যার ফলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার গড্ডল প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে তারা বাধ্য হচ্ছেন। এতোসব জটিল সমস্যা মোকাবিলায় ধর্মীয় বিশ্বাস ও ‘তৎপরতা’ কি আসলেই খুব শক্ত প্রতিপক্ষ? এম. এ. খানে’র বইটি পড়ার সময় পাঠকের এমনটি মনে হওয়া স্বাভাবিক। অন্তত মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোর সাম্প্রতিক দুর্দশা উপলব্ধি করার পর তাঁর বক্তব্য চট করে খারিজ করা মুশকিল। এই দেশগুলোর পিছিয়ে থাকার কারণ হিসাবে তাদের অতীতমুখী মন-মানসিকতার কথা তিনি লিখেছেন। ইসলামী মূল্যবোধের নিশ্চল কঠোরতার মাঝে আটকে-থাকার সমস্যা নিয়েও প্রচুর বাহাস করেছেন। তাঁর বক্তব্য Logically Absurd অথবা আবেগী নয়। যুক্তির দ্যুতি ও বাস্তব কাণ্ডজ্ঞানের একটি সজাগ উপস্থিতি সেখানে রয়েছে। যে-কারণে বইটি চলমান সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার বিচারে এখনো প্রাসঙ্গিক।

অস্বীকার করি কী করে, সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রশ্নে মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রে ধর্মের উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগ আজো একটি প্রবল বাধা হিসাবে কাজ করে! মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় আরব জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশে ইসলামের মারমুখী উত্থান অনেকেই লক্ষ করেছেন। সাম্প্রতিক আরব-বসন্তের ডামাডোলে সেটি আরো পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। হাসান আল বান্না ও মাওলানা মওদূদী’র ভাবাদর্শে উজ্জীবিত মুসলিম ব্রাদারহুড জনতার রায়ে মিশরকে পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন। অন্যদিকে ‘খিলাফত’ কায়েমের সংকল্পে হিযবুত তাহরির-এর মতো সংগঠন বিভোর হয়ে আছে। বুদ্ধিজীবীসুলভ তুখোড় প্রচারণার মাধ্যমে সংগঠনটি ইতিমধ্যে শিক্ষিত মুসলমানদের ইমানী চেতনা জয় করে নিয়েছে। এর কর্মীরা প্রায় সকলেই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে নীরব গণজোয়ার সৃষ্টির কাজে তাঁদের সক্রিয়তা তাই চোখে পড়ার মতো ঘটনা হয়ে উঠছে। যা হয়তো ইসলামী বিপ্লবের আভাস বহন করছে! অন্যদিকে ইসলামী দল, উপদল ও শরিয়া ভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠনগুলো ইসলামী তরিকার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল মানুষকে একীভূত করার জিহাদে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। এইসব সক্রিয়তার পেছনে মোহাম্মদ প্রণীত জীবনব্যবস্থার প্রতি তাঁদের অন্ধ অনুরাগ যে কাজ করে তাতে সন্দেহ নেই। তবে তাকে জিন্দা রাখার পেছনে পশ্চিমা রাষ্ট্রের ভুল-ত্রুটি ও সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার বিষয়গুলো লেখক তাঁর বইয়ে এড়িয়ে গেছেন। মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোর অমানবিক শাসনব্যবস্থা এবং সেই ব্যবস্থাকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী ব্লকের সুবিধাবাদী আচরণ আরো ভালোভাবে বিশ্লেষিত হওয়া উচিত ছিল।

মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রে ইসলামী মূল্যবোধের নামে পশ্চাদপদ ধ্যান-ধারণার চর্চা ও উদ্দেশ্যমূলক নিষ্ঠুরতার বিবরণ লিপিবদ্ধ করার সময় লেখক কিছু সরলীকরণ ঘটিয়েছেন। মিশর, পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক রাষ্ট্রের জীবনধারায় আরব জাতীয়তাবাদের প্রভাব আর বাংলাদেশে উক্ত প্রভাব কিছুতেই এক নয়। তাদের মধ্যে গুণগত ব্যবধান রয়েছে। খানে’র লেখায় বিষয়টি স্বচ্ছতার সাথে বিশ্লেষিত হয়নি। আনোয়ার শেখের (Islam : The Arab Imperialism গ্রন্থের লেখক) বক্তব্য তুলে ধরে লেখক মিশরে আরব জাতীয়তাবাদের নাম করে সংঘটিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিবরণ দিয়েছেন। যার পরিণামে মিশরের মতো সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের দেশটি অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর এক সংস্কৃতির দ্বারা অবরুদ্ধ ও রূপান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে। প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক মিশর যে ইসলাম-শাসিত মিশরের তুলনায় সকল দিক দিয়ে অগ্রসর ছিল তাতে সন্দেহ নেই। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইসলামীকরণের অভিজ্ঞতা মিশরের অনুরূপ হয়নি। সকলপ্রকার আগ্রাসন মোকাবিলার ইতিহাস এই ভূখণ্ডের রয়েছে। খানে’র বইয়ে ইতিহাসের সেই সেকুলার প্রতিরোধের বিবরণটি উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে পাঠকের মনে বাংলাদেশ সম্পর্কে ঘোরতর একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। এক্ষেত্রে লেখক আরো সচেতন ও অনুসন্ধানী হতে পারতেন।

এ কথা সত্য, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট নাগরিক ধর্মভীরু। তারা ইসলাম ধর্মে গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। ইসলামী জীবনবোধ ও অনুষ্ঠানগুলো একনিষ্ঠভাবে পালনের ব্যাপারে দেশের মুসলমান নাগরিকরা অসম্ভব আন্তরিক। তাদের এই প্রশ্নহীন সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে ফায়দা হাসিলের রাজনীতি এখানে অনেকদিন ধরে চলছে। যে-কারণে মাঝেমধ্যে অত্যন্ত পীড়াদায়ক ঘটনার জন্ম হয়। হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন-নির্যাতন এবং তাদের সংখ্যা ক্রমাগত কমে আসা যার প্রমাণ বহন করে। এর পেছনে রাষ্ট্রশক্তির ভ্রান্ত রাজনীতি ও সুশাসনের সমস্যাটি মূলত দায়ী। এতোকিছু সত্ত্বেও মিশরের ন্যায় নিজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আরব জাতীয়তাবাদের পদতলে বিসর্জন দেওয়ার হৃদয়বিদারক ঘটনা বাংলাদেশে এখনো শক্ত মাটি পায়নি। ইসলামী জীবনবোধের সমান্তরালে উদার, সহিঞ্চু ও মিশ্রিত এক জীবন-চেতনা রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ট নাগরিকরা দীর্ঘকাল ধরে নিজের মধ্যে বহন করে চলেছেন। বাঙালিয়ানার পুরোনো ঐতিহ্য থেকে তারা সেই শক্তিটি সঞ্চয় করেছেন। যেখানে ইসলামী প্রথা-আচার ও বিশ্বাসের সাথে প্রাচীন প্রথা-আচার ও মূল্যবোধের চোরাস্রোত মিলেমিশে বাংলাদেশের ধর্মভীরু মানুষের চেতনাকে একটি সহজ আকার দিয়েছে। এর সূক্ষ্ম প্রভাব দেশের নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনস্রোতে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। যার ফলে সকল প্রকার ধর্মীয় উগ্রতা ও জঙ্গিবাদী রাজনীতিকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বারবার প্রত্যাখান করে এসেছেন। ইসলামীকরণের অব্যাহত চাপ এখানে রয়েছে। সুবিধাবাদী নোংরা রাজনীতির কারণে ইসলামী আরব জাতীয়তাবাদ ও ওহাবী প্রবাহ মাঝেমধ্যে দেশটিকে গ্রাস করে ফেলে। তা-সত্ত্বেও ধর্মীয় বিশ্বাস ছোট্ট এই দেশের জীবনধারাকে আজো সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সফলকাম হয়নি।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম ও বিকাশের ইতিহাস খানে’র লেখায় স্বচ্ছতার সাথে বিবেচিত হয়নি। লেখকের স্মরণ রাখা উচিত ছিল, এই রাষ্ট্রের বাসিন্দারা উর্দু ও আরবি ভাষা দিয়ে মাতৃভাষাকে দমন করার ষড়যন্ত্রটি সফলভাবে মোকাবিলা করেছেন। এবং পাকিস্তানের মতো প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী গণযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন জাতি হিসাবে পৃথিবীর বুকে নিজের নাম লিখিয়েছেন। স্বাধীনতা লাভের সুদীর্ঘ কালপর্বে সকল প্রকার উদ্দেশ্যমূলক জাতীয়তাবাদকে প্রতিহত করার জন্য তারা সচেতন ছিলেন। এক্ষেত্রে আবহমান সাংস্কৃতিক চেতনা ও লোকায়ত ঐতিহ্যের শক্তিকে দেশের মানুষ ব্যবহার করেছেন। বিশ্বাস ও মূল্যবোধের জগতে ইসলামকে তারা পরিত্যাগ করেননি। ইসলাম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাবে সেটা করেননি। কিন্তু শরিয়াপন্থীদের আপোসহীন বিধানের মধ্যে যে অপমান নিহিত, মানবতার চিরায়ত সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির সাহায্যে তারা সেটা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছেন।

এই প্রয়াস সিংহভাগ বাঙালিকে ধর্মের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবহারের বিরুদ্ধে সজাগ ও প্রতিবাদী হতে প্রেরণা যুগিয়েছে। যেমন, নববর্ষ উদযাপনকে (পহেলা বৈশাখ) দেশের ইসলামপন্থীরা ‘হিন্দুয়ানী’ কৃষ্টির বাহক বলে ভাবেন। এটিকে তাঁরা বহুভাবে মুসলমানী রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের এই কঠোর মনোভাব ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাঙালিরা পহেলা বৈশাখকে একটি জাতীয় উৎসবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। যে-কারণে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে ফায়দা হাসিলের রাজনীতি এখানে যারা করেন তাদের প্রতি সক্রিয় প্রত্যাখ্যানের মনোভাব বাংলাদেশে ফিরে-ফিরে প্রকট হয়েছে। এইসব কারণে আরব জাতীয়তাবাদের শিকড় এই দেশে এখনো গভীর হতে পারেনি। ধর্মের নামে সাংস্কৃতিক আরোপণের ঝুঁকি বরাবর ছিল। তবে তাকে প্রতিরোধ করার বিবেকি সত্তাটিও সমানভাবে সক্রিয় থেকেছে। কাজেই বাংলাদেশে ইসলামীকরণের স্বরূপ পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মিশর থেকে ভিন্ন। খানে’র লেখায় বিষয়টি প্রাধান্য না-পাওয়ায় তাঁর বক্তব্য খানিক একপেশে ও সীমাবদ্ধ মনে হয়েছে। ইসলামের প্রচলিত ভাবমূর্তির বিপক্ষে লেখকের সক্রিয় Activism-এর কারণে হয়তো এমনটি ঘটেছে।

মনে রাখা প্রয়োজন এম. এ. খান পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বাসিন্দা। আধুনিক মানব সভ্যতায় এই রাষ্ট্রের অবদান স্মরণীয় হলেও কর্পোরেট পুঁজির বিশ্বায়নে তার ভূমিকা নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। বিশ্বমন্দার সাম্প্রতিক প্রবণতার কারণে পুঁজিবাদী ব্লক অস্থির মেরুকরণের সম্মুখীন হয়েছে। পুঁজিবাদকে অনেকে এখন ইতালীয় সিনেমার প্রবাদপুরুষ ফেদরিকো ফেলিনির ‘লা দলচে ভিতা’র (The Sweet Life) অন্তিম দৃশ্যের সাথে তুলনা করেন। সিনেমাটি যারা দেখেছেন তাদের নিশ্চয় সাগরপারে অবস্থিত মনোরম সেই ভিলাটির কথা মনে আছে। রাতের পার্টিতে যোগদানের জন্য সিনেমার চরিত্ররা সেখানে জড়ো হয়। তারা সকলেই রোম শহরের বনেদী বিত্তবান শ্রেণীর প্রতিনিধি। পাপারাজ্জিরা (*এই শব্দটি ফেলিনির কারণে পরে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে।) তাদের হাড়ির খবর সংগ্রহে দিনরাত আঠার মতো পেছনে লেগে থাকে। সিনেমার পর্দা জুড়ে চরিত্রগুলোর অস্থির বিচরণ, বিকারগ্রস্ত কাণ্ডকলাপ আর পাপারাজ্জিদের হুটোপুটি দর্শককে হাসিয়ে মারে। এবার সেই হাসিকে বমন করানোর উদ্দেশ্যে পরিচালক আজব এক পার্টির আয়োজন করেন। সকলে মিলে পার্টির হুল্লোড়ে গা ভাসায়। আজগুবি ফুর্তিতে ভরা ক্লাইমেক্সটি শেষ হওয়ার পর ফেলিনির ক্যামেরা ভোরের আবছা আলোকে ধারণ করে। সিনেমার চরিত্ররা নিজেদের খোঁয়ারি কাটাতে শিথিল পা’য়ে বেলাভূমিতে নেমে আসে। অদূরে জেলেরা তখন অক্টোপাসের মতো দেখতে অতিকায় এক জন্তুকে ধরেছে। তাকে দেখার জন্য সবাই সেখানে ভিড় করে। জন্তুটির মুখমণ্ডল তার পিচ্ছিল দেহের সাথে এমনভাবে একাকার যে আগামাথার হদিস হয় না। দর্শককে একটি উদ্ভট ও আবেশী ইঙ্গিতের মধ্যে রেখে সিনেমাটি শেষ হয়ে যায়।

সেলুলয়েডে নির্মিত এই দৃশ্যটির সাথে অনেকে পুঁজিবাদের তুলনা দিতে পছন্দ করেন। তাঁরা মনে করেন বিরামহীন ভোগের বিকারে পিচ্ছিল হওয়ার কারণে পুঁজিবাদ অতিকায় সেই জন্তুর মতো উদ্ভট এক জীবে পরিণত হয়েছে। নিজের অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে মানুষ তাকে একদিন বধ করতে বাধ্য হবে। নতুবা মুক্তির অন্য কোনো পথ খোলা নেই! নাইন-ইলিভেন, আফগানিস্তান-ইরাক ও লিবিয়ায় সংঘটিত যুদ্ধ, পাকিস্তানে অব্যাহত সন্ত্রাসী হামলা, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোয় শরিয়াপন্থীদের বিকট কাজ-কারবার এবং ওয়াল স্ট্রিট ও আরব-বসন্ত মিলে পুঁজিবাদকে চেপে ধরার কারণে নাম-পরিচয়হীন এই দানবের পতন আসন্ন বলে অনেকে রায় দিচ্ছেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চিরায়ত ছকটি যে সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও জঙ্গিবাদের ত্রিমুখী চাপের মধ্যে গিয়ে পড়েছে তা নিয়ে কারো সংশয় নেই। পুঁজিবাদী আগ্রাসনকে মোকাবিলার প্রশ্নে এই মুহূর্তে উক্ত চাপসৃষ্টিকারী শক্তিগুলোর মধ্যে একটি সহাবস্থান তৈরি হয়েছে। আদর্শের দিক থেকে তারা পৃথক। কিন্তু নাইন-ইলিভেন থেকে সাম্প্রতিক আরব-বসন্তের ঘটনা তাদের মধ্যে যোগাযোগের অদৃশ্য সেতু গড়ে তুলেছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে বধ করার মিশনে সক্রিয় এই জোট পৃথিবীর দুর্বল রাষ্ট্রের নাগরিককে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করছে। মুদ্রাস্ফিতি ও বেকারত্বের চাপে খাবি-খাওয়া সবল রাষ্ট্রের নাগরিকরাও তার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শুরু করেছেন। জোটবদ্ধতার বিষয়টিকে তাই সাঈদ-চমস্কি’র ‘শ্বেতাঙ্গ ইউরোপ ও আমেরিকার বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনতার গণসঙ্গীত’-এর (Political anthem of tortured people against the White Europe and America) ভাবাবেগের সাথে তুলনা করা যায়। পুঁজিবাদ এখন তার ভেতরের ও বাইরের মানুষ দ্বারা প্রচণ্ডভাবে আক্রান্ত। কতিপয় কর্পোরেট মুনাফাখোরের মনোপলি বিস্তারের নেশা তাকে সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। মানুষের জীবনমান যেভাবে ক্রমাগত নিচে নামছে তাতে করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে এই জনতাই হয়তো একদিন হজম করার জন্য খেপে উঠবে। সঙ্গতকারণে পুঁজিবাদী ব্লকগুলোকে এসব চাপ সামলানোর প্যাঁচ কষতে হচ্ছে। এরকম ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে বসে কোনো ধর্মীয় মতবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ বা প্রাসঙ্গিক করার কাজটি সত্যিই কঠিন। এম. এ. খান সেই ঝুঁকিটি নেওয়ার কারণে তাঁর বই কৌতূহল উদ্রেক করে। গ্রন্থটি পাঠ করার ক্ষেত্রে আসমানী ওহি’র সততায় বিশ্বাসী পাঠক ও মূলধারার Activism কতোদূর তৎপর হতে পারেন সেটাই এখন দেখার বিষয়!
… … …

পুনশ্চ : এম. এ. খানে’র বইটি পাঠের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য খোদ লেখকের কাছে ঋণ স্বীকার করা প্রয়োজন। গুগল ও আমাজন-এ বইটির সন্ধান লাভের পর পাঠতৃষ্ণা প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু বিনামূল্যে Online Edition পাঠের সুবিধা নিতে গিয়ে হয়রান হয়ে পড়েছিলাম। কাঙ্ক্ষিত লিংকটি কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। অগত্যা ইসলাম-য়াচ-এর (http://islam-watch.org/contact-us.html) মাধ্যমে লেখককে ই-মেইল করলে তিনি দ্রুত সাড়া দেন। ফিরতি মেইলে খান তার বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ ডাউনলোড করার লিংকটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই লেখায় উক্ত অনলাইন সংস্করণটি (পিডিএফ) ব্যবহৃত হয়েছে।

এবার ভাষা প্রসঙ্গ। বিকল্পধারার সিংহভাগ লেখক ইংরেজি ভাষায় লেখেন। আলী সিনা’র মতো এম. এ. খানে’র লেখার ভাষাটিও তাই ইংরেজি। তাঁর ইংরেজি সিনা’র মতো কবিত্বশক্তিতে বলীয়ান নয়। তবে ভীষণ সাবলীল। লেখকের যুক্তিবিন্যাস এবং পরিহাসের ভঙ্গি যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। সাংবাদিক প্রতিবেদন রচনার অভিজ্ঞতা সম্ভবত তাঁর ভাষার শরীরে নীরবে কাজ করেছে। যে-কারণে তথ্যের বিশ্লেষণ এতোটা প্রাঞ্জল হতে পেরেছে।

সবশেষে আরেকটি কথা, সাম্প্রতিক কোনো রচনা পাঠ বা প্রাসঙ্গিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কপিরাইট আইনের একশোরকম মশকরা অনেকসময় গুরুতর ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিকল্পধারার অনেক লেখকের বই কপিরাইট সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতার কারণে অনলাইনে পড়া যায় না। কোনো বইয়ের মুদ্রিত সংস্করণে (Printed Edition) কপিরাইট সংক্রান্ত বিধি-নিষেধের প্রয়োজন হয়তো আছে। তবে অনলাইন সংস্করণের ক্ষেত্রে কপিরাইট কি খুব জরুরি? পদে-পদে লেখকের অনুমতি ও বিধিনিষেধ বিরক্তির উদ্রেক করে। অন্তত Online Edition-এর ক্ষেত্রে এইসব শর্তের বেড়াজাল শিথিল হওয়া প্রয়োজন। অবশ্য বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থাকলে আলাদা কথা!

এম. এ. খান তাঁর বইটিকে এইসব বাধ্য-বাধকতা থেকে মুক্ত রাখায় পাঠ-অনুভূতি জানানোর তাগাদাটি মনের মধ্যে আপনা থেকে প্রবল হয়েছিল। বইটি এরিমধ্যে ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তরিত হয়েছে। বর্তমান লেখাটি তৈরির সময় ইংরেজি’র পাশাপাশি বাংলা সংস্করণটি হাতের নাগালে থাকায় অনেক সুবিধে হয়েছে। বাংলায় অনূদিত সংস্করণটিকে মূলানুগ ও প্রাঞ্জল মনে হলো। এজন্য অনুবাদক শামসুজ্জোহা মানিক কৃতিত্বের দাবিদার। তবে বাংলা সংস্করণের তেমন কোনো প্রচারণা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি সত্ত্বেও এরকম একটি বইয়ের ব্যাপক প্রচারণা মুক্তচিন্তার স্বার্থেই জরুরি। আশা করি বইটির প্রকাশক ব-দ্বীপ প্রকাশনা এ-ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন। ইংরেজি (http://www.islam-watch.org/books/islamic-jihad-legacy-of-forced-conversion-imperialism-slavery.pdf) এবং বাংলা (http://www.bangarashtra.net/) সংস্করণের জন্য পাঠক এম. এ. খানে’র সরবরাহ করা লিংক দুটি ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া ঘরে বসে বাংলা সংস্করণটি পেতে হলে অনলাইন বইয়ের বাজার রকমারী’র (http://www.rokomari.com/) লিংকটি পাঠক ব্যবহার করতে পারেন।

পাঠসূত্র

১. Selfish Gene by Richard Dawkins, Online (PDF) Version, 30th Anniversary Edition, 2006

২. জগৎ সৃষ্টির শুরু, আদিপুস্তক, ১.১-২.১৫, ওল্ড টেস্টামেন্ট।

৩. The Grand Design by Stephen Hawking and Leonard Mlowdinow, Translated by Tanvirul Islam, Online (PDF) Version, 2010, http://www.biggandunia.wordpress.com

৪. Islamic Jihad : A Legacy of Forced Conversion, Imperialism, and Slavery by M. A. Khan, Online (PDF) Version, 2008

৫. Chapter IV, Propagation of Islam: By Force or Peacefully, Islamic Jihad : A Legacy of Forced Conversion, Imperialism, and Slavery by M. A. Khan, Online (PDF) Version, 2008

৬. ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রসঙ্গ : মার্কসীয় চেতনার আলোকে, ইরফান হাবিব, ভাষান্তর : কাবেরী বসু, ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিঃ, ১৯৯৯/ মুঘলযুগে কৃষি-অর্থনীতি ও কৃষক-বিদ্রোহ, গৌতম ভদ্র, সুবর্ণরেখা, কলিকাতা, ১৯৯১।

৭. ‘… কর্মকে চারটি শ্রেণীতে বিভাগ করা হয়েছে, সেই চারটিই বর্ণ। সাধনা-পথে একজন সাধকেরই উঁচু-নীচু স্তর হল সেই বর্ণ। জাতি-বিশেষ নয়, যা বর্তমান সমাজে প্রচলিত। … সাধনার প্রারম্ভিক অবস্থাতে প্রত্যেক সাধক শূদ্র অর্থাৎ অল্পজ্ঞ হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভজনে বসেও সাধক ১০ মিনিটের জন্য একাগ্রচিত্ত হতে পারে না, প্রকৃতির মায়াজাল কাটিয়ে উঠতে পারে না। এই অবস্থায় কেবল মহাপুরুষের সেবাদ্বারা স্বভাবে সদগুণের সঞ্চার হয়, অতএব তখন সাধকের স্থিতি বৈশ্য শ্রেণীর হয়। আত্মিক সম্পত্তিই স্থির সম্পত্তি। সাধক ধীরে ধীরে এর সংগ্রহ ও গোপালন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহের সুরক্ষা করতে সমর্থ হয়। কাম, ক্রোধ ইত্যাদি থেকে ইন্দ্রিয়ের হিংসা হয় এবং বিবেক-বৈরাগ্যের মাধ্যমে এদের সুরক্ষা হয়; কিন্তু প্রকৃতিকে নির্বীজ করবার ক্ষমতা তার মধ্যে এখনও আসে না। ক্রমশঃ উন্নতি করতে করতে সাধকের অন্তরে ত্রিগুণকে খণ্ডন করার ক্ষমতা এসে যায়। এই স্তর থেকেই সাধক প্রকৃতি ও তার বিকার সমূহকে বিনষ্ট করবার ক্ষমতা লাভ করেন (*ক্ষত্রিয় স্তর)। এইজন্য যুদ্ধ এখান থেকেই শুরু হয়। ক্রমশঃ সাধক সাধনা সম্পূর্ণ করে ব্রাহ্মণত্বে পরিবর্তিত হন। … কর্মের একমাত্র পথকেই মহাপুরুষগণ চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন-নিকৃষ্ট, মধ্যম, উত্তম এবং অতি উত্তম। এই শ্রেণী বিভাগকে সাধ্যকের জন্য ক্রমশ শূদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণের নাম দিলেন। শূদ্র স্থিতি (সেবাধর্ম) থেকে কর্মের আরম্ভ হয় এবং সাধনাক্রমে ঐ সাধকই ব্রাহ্মণের স্থিতিলাভ করতে পারেন। এর পরের অবস্থায় সাধক যখন পরমাত্মায় স্থিতি লাভ করেন তখন ‘ন ব্রাহ্মণো ন ক্ষত্রিয়ঃ ন বৈশ্যে ন শূদ্রঃ চিদানন্দরূপঃ শিবোহহম শিবোহহম’। তিনি বর্ণগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে যান।‌” দ্রষ্টব্য : দ্বিতীয় অধ্যায় ৩১ নং ও তৃতীয় অধ্যায় ৩৫ নং শ্লোক, শ্রীমদ্ভভগবত গীতা, স্বামী অড়গড়ানন্দ কর্তৃক ব্যাখ্যাত ‘যথার্থ গীতা’।

৮. Unmasking Muhammad by Sujit Das, Online (PDF) Version, 2010

৯. The Rushdie Affair, Why I Am Not A Muslim by Ibn Warraq, Promethus Books, 1995 Online (PDF) Version, 2005; /Muhammad and the Satanic Verses, http://www.answeringislam.org/; http://wikiislam.net/wiki/Main_Page

১০. Why I Am Not A Muslim by Ibn Warraq, Promethus Books, 1995, Online (PDF) Version, 2005

১১. মিলিন্দপঞহ (অভিধর্মপিটক-এর ব্যাখ্যা হিসাবে স্বীকৃত রাজা মিলিন্দ ও ভিক্ষু নাগসেন-এর কথোপকোথন), অনু: সাধনকমল চৌধুরী, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০১; /বৌদ্ধধর্ম, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১১; /বুদ্ধ : ক্যারেন আর্মস্ট্রং, অনু: শওকত হোসেন, রোদেলা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১০।

১২. The Quarn and the Holy Trinity : Islam’s mistaken views of Basic Christian Doctrines by Sam Shamoun, http://www.answeringislam.org/; http://wikiislam.net/wiki/Main_Page / Misunderstanding of the story of Marry and the doctrine of the Trinity, Why I Am Not A Muslim by Ibn Warraq, Promethus Books, 1995, Online (PDF) Version, 2005

১৩. Assassination, Who was Muhamamd, Understanding Muhammad by Ali Sina, Second Edition, Online (PDF) version, 2008; /Unmasking Muhammad by Sujit Das, (PDF Version), 2010

১৪. “অতঃপর, যখন নিষিদ্ধ মাসগুলো অতিবাহিত হয়ে যায় তখন ঐ মুশরিকদের যেখানে পাও (বধ) হত্যা কর, তাদেরকে গ্রেফতার কর, তাদেরকে অবরোধ করে রাখো এবং প্রত্যক ঘাঁটিস্থলে তাদের সন্ধানে অবস্থান কর, অতঃপর যদি তারা তওবা করে নেয়, নামাজ আদায় করে এবং যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাপরায়ণ, পরম করুণাময়।” কুরআনুল করীম, বাংলা তাফসীর, ভাষান্তর : প্রফেসর ড, মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান, http://dar-us-salam.com/ / http://www.quraneralo.com/

১৫. যাত্রাপুস্তক, ২.১-৪০.৩৮, ওল্ড টেস্টামেন্ট।

১৬. মথি ১২.১-১২.৮, মার্ক ২.২৩-২৮, লুক ৬.১-৫, নিউ টেস্টামেন্ট।

১৭. Ancient Qur’anic Manuscripts of Sana’a and Divine Downfall by Sujit Das, http://www.faithfreedom.org/;

১৮. Understanding Muhammad by Ali Sina, Second Edition, Online (PDF) version, 2008

১৯. বেঞ্জামিন ওয়াকার-এর বহুল আলোচিত বই The Foundation of Islam ২০০৫ সালে বিশিষ্ট অনুবাদক সা’দ উল্লা বংলায় ভাষান্তর করেন। সময় প্রকাশনী থেকে বইটি ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে জামায়াতপন্থী বুদ্ধিজীবীদের কারণে বইটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। নিষেধাজ্ঞার সেই ফাঁড়া কাটিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বইটি আজো আলোর মুখ দেখেনি!