‘ভাই  আমি আপনে সবাই একদিন মইরা যামু। ধরেন  ঈশ্বর থাকা – না থাকার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফিটি।  ঈশ্বর যদি না থাকে তাইলে আস্তিক নাস্তিক কারোরই কোন সমস্যা নাই। হগগলেই তো মাটির তলায়। কিন্তু  ঈশ্বর যদি থাকে আমরা যামু বেহেস্তে আর আপনেরা খাইবেন হের কোপানি। তাই আস্তিক হওয়াটাই নিরাপদ না?’

অবিশ্বাসী হওয়ার জ্বালা অনেক। এইগুলা হাব্জাব প্রশ্ন অহরহ শুনতে হয়।  মঞ্চায় প্রশ্নগুলান ফ্রেমে বান্ধায় রাখি।  আমার মনে হয় এমন কোন নাস্তিক ভাই এই ধরাধামে পয়দা হয় নাই যিনি জীবনের কখনো না কখনো এই প্রশ্নের বিশাল ধাক্কা হজম করেন নাই। একটা সময় আমি এগুলো হেসে উড়িয়ে দিতাম।  ভাবতাব – এই হাবিজাবি কথায় এতো গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে! এইটা তো ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ না, খালি বাচ্চা-কাচ্চা গো ভুতের ভয়ের মত ভয় দেখানির লাহান । পরে দেখি আমার বহু ধার্মিক বন্ধুরাই ঈশ্বরের অস্তিত্বের পেছনে সত্য সত্যই এটাকে একটা বিরাট দাবী বলে মনে করেন।  যে কোন আড্ডায় গেলেই প্যালের ঘড়ি, হয়েলের বোয়িং, কিংবা হাল আমলের হুমায়ুনের নাইকন ক্যামেরা সহ হরেক রকমের ত্যানা প্যাচ্যানির মাঝামাঝি সময়ই ত্যানায় গিটঠুর আকারে  নাস্তিকদের বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে হাজির হয়ে যায়  তাদের এই  ‘নিরাপদ বাজির’ যুক্তি – ‘ভাই আমি মরলে তো সমস্যা নাই, আপনে নাস্তিক হইয়া মরলে তো খবর আছে!  দোজখে পুড়বেন। পি-মারা খাইবেন। হ্যানো ত্যানো’।  এই যেমন  সেদিন দেখলাম, মুক্তমনার নাস্তিকের ধর্মকথার এই পোস্টে এসে মন্তব্য করতে গিয়ে ফরহাদ নামের এক ভদ্রলোক মন্তব্য করেছেন

… শেষ বিচারের দিন আমাদেরকে নিজেদের কাজের হিসাব দিতে হবে যার ভিত্তিতে আল্লাহপাক আমাদের হয় শাস্তি দিবেন না হয় পুরস্কার দিবেন। …যদি আমরা সঠিক হই তবে আমরা অনন্ত জীবনের পুরস্কার পাব, আর যদি কিছু না পাই তবেও কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু আপনারা যে ভাবে চিন্তা করছেন তা যদি সত্যি না হয় ( মানে আল্লাহ যদি সত্যি সত্যি একজন থাকেন এবং আপনাদের বিচার করেন) তখন আপনারা খুব বিপদে পরবেন। চিন্তা করে দেখেন তো…………

এই যুক্তিটা আসলে পুরানো। বলা হয় ফরাসী দার্শনিক কাম গণিতবিদ ব্লেইজ প্যাস্কেল  (১৬২৩ – ১৬৬২) নাকি এই যুক্তিটা একসময় দিয়েছিলেন, তাই একে বলে প্যাস্কেলের ওয়েজার  বা প্যাস্কেলের বাজি। বলা হয়, যে সমস্ত অবিশ্বাসীরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রথাগত ‘যুক্তি’গুলোতে সন্তুষ্ট নন,  তাদের জন্য সম্ভাবনার গণিত ব্যবহার করে যুক্তিমালা সাজিয়েছিলেন ঈশ্বর-বিশ্বাসী প্যাস্কেল। ভেবেছিলেন এটা হবে নাস্তিকদের কফিনে শেষ পেরেক।   প্যাস্কালের ভাষাতেই –

“If you believe in God and turn out to be incorrect, you have lost nothing — but if you don’t believe in God and turn out to be incorrect, you will go to hell. Therefore it is foolish to be an atheist.”

নাস্তিকেরা যে কত বড় গাধা সেটা আবার  নানা ধরণের ছক টক কেটে দ্বিমাত্রিক ম্যাট্রিক্স বানিয়ে একেবারে গাণিতিক ভাবে ‘প্রমাণ’ করে দেন প্যাস্কেল।

কিন্তু তার গণিতের শুভঙ্করের ফাঁকি তিনি ধরতে না পারলেও অন্যরা ঠিকই ধরে ফেলেছিল। আসলে তার সম্ভাবনার সূত্রে ফাঁক ফোকর এতই বেশি যে একে গণিত না বলে গোঁজামিল বলাই ভাল।  যে ব্যক্তিকে ‘ফাদার অব মডার্ন প্রোবাবিলিটি’ বলে উপাধি দেয়া হয়েছে তার মাথা থেকে এমন দুর্বল গনিতে খোঁজা যুক্তি বেরিয়ে এসেছিল, যে ভাবতেই এখন অবাক লাগে।

চলুন দেখা যাক এই প্যাস্কালীয় (মামদো)বাজির দুর্বলতাগুলো কী কী …

কোন্‌ ধর্ম সত্য ধর্ম? আর সত্যিকার ঈশ্বরটাই বা কোন্‌টা?

প্রথম সমস্যাটা হৈল – ক্যামনে বুঝুম কোন্‌ ধর্মটা সঠিক, আর সত্যিকার ঈশ্বরই বা কোন্‌টা? প্যাস্কাল সাহেব ছিলেন রোমান ক্যাথলিক। তার কাছে ক্যাথলিক ধর্মের ঈশ্বরই ছিলেন সত্যিকার ঈশ্বর। কিন্তু মজার ব্যাপার হইতাছে তার ক্যাথলিক ধর্মের ঈশ্বরকে সত্য প্রমাণের জন্য কষ্ট টষ্ট করে যে যুক্তিমালা সাজাইছিলেন, তা দেদারসে এখন ব্যবহার করেন প্রটেস্টাণ্ট, ইস্লামিস্ট, বুদ্ধিস্ট, হিন্দু, জৈন – হগগলতেই, তারা সবাই নিজ নিজ ধর্মের ঈশ্বরকে সত্যিকারের ঈশ্বর মনে করেন। প্যাস্কালীয় যুক্তিতে ‘ঈশ্বর কোপাইবো’ – এই হুমকি থাকলেও হুমকিতে বলা নাই, কোন ধর্ম অনুসরণ করলে কোপানি থিকা আলটিমেটলি বাঁচন যাইব।  এটাকে ইংরেজীতে কয় ‘avoiding the wrong hell dilemma’ ।  হ্যাঁ, আপনে  সঠিক ধর্ম অনুসরণ করলে স্বর্গে যাইবেন, আর দোজখের হাত থেকে বাঁচবেন;  মাগার আপনে যদি ভুল ধর্মের অনুসারী হইয়া মইরা যান, কোন উপায় নাই – দোজখে/নরকে যাইবেন, আর পি-মারা খাইবেন।

এখন  কথা হইল, সব ধর্মবিশ্বাসীরাই হুক্কা-হুয়া রব তুইলা ধরে নেন, তার নিজের ধর্মটাই সঠিক। তাদের কখনোই মনে হইব না যে মিথ্যা একটা ধর্ম পালন করে মারা যাইতাছেন আর মরার পর কোপানি খাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন। এইটাই হৈল ডিলেমা। আপনি এই ডিলেমা ত্যানা-প্যাচানি ধার্মিকবাবারে ধরায় দিলে একটুক্ষণের জন্য হয়ত থমকাইবেন, কিন্তু  আবার সম্বিত ফিরা পাইয়া বুঝায় দিব – আরে ‘আমার ধর্মই যে সঠিক হে তো দ্যাকলেই বুঝা যায়’।

আমার মনে আছে – একবার এক খ্রিষ্টান পাদ্রী কি কারণে জানি বাসায় আসছিল। আইসাই  যীশু যীশু কইরা মুখে ফ্যানা তুইলা ফালাইলো, আমগো দেশের তবলীগ পার্টির মতন অনেকটা। যখন শুনলো আমি নাস্তিক ওমনি  যীশুর মহিমা কীর্তনের পর প্যাস্কালের (কু)যুক্তি হাজির হয়া গেল … “ঈশ্বর যদি সত্যি সত্যি একজন থাকেন এবং … তখন আপনারা … দোজখে …”। আমি বললাম কিন্তু সত্যিকারের ঈশ্বর যে যীশুই হবেন এটা স্বতঃসিদ্ধ ভাবে মেনে নেয়া কেন রে বাপ, মা-কালী বা গণেশ বাবা হৈলে তখন কি করবেন,  এত যীশু যীশু করার পরেও তো সেই নরকের আগুনে পুড়বেন অ্যালায়। পাদ্রী সাব একটু থমকাইলেন, তারপরেই একগাল হাইসা বললেন – ‘আহ! আরে গণেশ টনেশ আবার ঈশ্বর হৈতে পারে নাকি, যীশুই আসল ঈশ্বর’।  পেট মোটা হাতীর শুরওয়ালা মোটা মাথা গণেশ আসল ঈশ্বর হইবারই পারে না, তারচেয়ে আমগো ভার্জিন বার্থ হুইপ্টেল গিরগিটি মার্কা যীশুই প্রকৃত ঈশ্বর। আমীন। চুম্মা আমীন!

এখন পাদ্রী সাবরে ক্যামনে বুঝাই – এই পৃথিবীতে হাজারটা ধর্ম হাজারটা বিশ্বাস পাঙ্খা মেইল্যা উইড়া বেড়াইতাছে। সবাই যে যার মত নিজেদের ‘সহি ধর্ম’ বইলা জিকির পাড়তেসে আর নিজের ঈশ্বরকে আসল ঈশ্বর বইলা দাবী করতেসে – ‘মাই গডস ডিক ইজ বিগার দ্যান ইয়োরস’।  বহু ধর্ম আবার একটা আরেকটার লগে দায়ে-কুমড়ায় সম্পর্ক, এক ধর্মের বিশ্বাসের সাথে আরেক ধর্মবিশ্বাসের আকাশ পাতাল তফাত। রাহুল সাংকৃত্যায়নের উদ্ধৃতি দিয়েই বলি-

‘এমনিতে তো  ধর্মগুলির পরস্পরের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। একটি যদি পূবদিকে মুখ করিয়া পূজা করিবার বিধান দেয় তো অপরটি পশ্চিম দিকে। একটি যদি মাথার চুল বড় রাখিতে বলে, অপরটি বলে দাঁড়িকে বড় করিতে। একটি যদি গোঁফ কাটিতে নির্দেশ দেয় তো অপরটি বলে গোঁফ রাখিতে। একটি যদি জবাই করিয়া পশু হত্যা করিতে বলে তো অপরটি বলে এক কোপে কাটিয়া ফেলিতে। এক যদি জামার গলা দক্ষিণদিকে রাখে তো অপরটি বামদিকে। একটি এঁটোর বিচার করে না, অপরটির একটি জাতির মধ্যেও অনেক ভাগ। একটি একমাত্র খোদাতালা ছাড়া পৃথিবীতে দ্বিতীয় কাহারো নাম নিতে রাজি নয়, অপরটিতে দেবতাদের সীমা নাই। একটি গাভীর জীবন রক্ষা করিতে গিয়া নিজের প্রাণ উৎসর্গ করিতে বলে তো অপরটি গো-কোরবানিকে পুন্যকার্য বলিয়া মনে করে।‘

পাদ্রী সাবেরে কইলাম,  আপনেরা যেমন যীশুরে গড মনে করেন, মুসলিমরা তা মনে করে না। তাগো চোখে ঈশা নবী গড না, মানুষ। আপনেরা যে সূর্যমুখী ফুলের পাপড়ির লাহান রং বেরঙের  হোলি ট্রিনিটির ঝাঁপি খুইলা বইছেন – কী সব – গড দ্য ফাদার, জিসাস দ্য সন, আর হোলি স্পিরিট – এই থ্রিসাম গড –এই ধুন ফুন হেরা বিশ্বাস যায় না। এখন ইসলাম ধর্ম যদি সত্যি হয়,আর  হলি ট্রিনিটি যদি বালু-সালু হয়, তাইলে তো আপনের খবরাছে। কোরানে (সূরা সূরা আল ইমরান) আল্লাহ স্পষ্টই বলছে –

‘যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত।‘ (৩: ৮৫)

কাজেই বোঝা যাইতেসে যে, খ্রিষ্টান বাবা, হিন্দু বাবা, সাই বাবা, মঙ্গা বাবা – সব গুষ্টি শুদ্ধা দোজখের আগুনে বেগুন-পোড়া হবে – নাস্তিক হওয়ার জন্য না,  বরং না জাইনা ভুল একটা ধর্ম পালন কইরা যাবার জন্য। চিন্তা কইরা দেখেন – আইজ যে পোলাডার সুদূর উত্তর মেরুর কাছাকাছি Inuit Religion মানে এস্কিমো পরিবারে জন্ম হৈছে, হেই ব্যাটা ক্যামনে জানব আর বুঝব তার শত সহস্র মাইল দূরে আরব মরুর বুকে চোদ্দশ বছর আগে জন্ম নেওয়া এক বেদুইনের প্রচারিত ধর্মটার ঈশ্বরই আসল ঈশ্বর?   ব্যাটায় না জাইনাই, না বুইঝাই মরার পরে বেগুন পোড়া হৈয়া যাইবো, পরম করুণাময়ের করুণ কারসাজিতে।  সবাই তো আর ক্যানাডার এস্কিমোল্লা হওনের তৌফিক অর্জন করতারে না।   মুসলিম ভাইয়েরা আবার দাঁত ক্যালায় হাইসেন না।   খ্রিষ্ট ধর্মের ঈশ্বর – হলি ট্রিনিটির থ্রিসাম গড – মুসলমানদের আল্লাহ থেকে অনেক আলাদা। কাজেই  যদি মরার পর গিয়া দেখা যায়  সেই খ্রিষ্টান থ্রিসাম ঈশ্বরই প্রকৃত ঈশ্বর – তখন মুসলিমগো কম্ম সাবাড়।  বাইবেলে আছে –

John 12:47-48 And if any man hear my words, and believe not, I judge him not: for I came not to judge the world, but to save the world. He that rejecteth me, and receiveth not my words, hath one that judgeth him: the word that I have spoken, the same shall judge him in the last day.

মানে খ্রিষ্টান ধর্মের দেওয়া ফর্মের ঈশ্বররে আপনে না মানলে আপনে যতই ধর্ম মানে-ওয়ালা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া কামেল আদমি হন না কেন, আগুনে পুড়বেন  কনফার্ম – তাগো গড সত্য হৈলে। কিন্তু কার বাপের সাধ্য মুসলমানগো মাথায় হেই লজিক ঢুকায়। তাগো কাছে আল্লাহই প্রকৃত গড। কোরানে কইছে না! আমগো ফরিদ ভাই একবার কার কমেন্টে জানি দিছিলো মোক্ষম ইসলামী  লজিক  –

আচ্ছা, কোরান যে খাঁটি তা কিভাবে জানি আমরা?
সোজা। কারণ মহান আল্লাহ তালা বলেছেন যে।

আল্লাহ বাবাজী যে মিথ্যে বলছেন না বুঝবো কি করে?
খুব সহজেই। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলেছেন যে।

মোহাম্মদ ব্যাটাই যে সত্যি বলছে তারই বা নিশ্চয়তা কি?
কেন? কোরান সাক্ষী দিয়েছে না।

বাহ! কোরানই যে সত্যি কথা বলছে সেটাই বা কে বললো?
কেন? জান না বুঝি? আল্লাহইতো বলেছেন যে কোরান সত্যি।

এতো ত্যানা প্যাঁচাও ক্যান শুনি?

এখন ইহুদী, খ্রিষ্টান আর মুসলমান গো আব্রাহামিক ধর্ম একেশ্বরবাদ শিক্ষা দেয়। একখান ঈশ্বরই আসমানে আছেন, তিনিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু তৈরি করছেন ছয় দিন ধইরা। আবার অন্য দিকে হিন্দুরা লক্ষ কোটি দেব দেবীতে বিশ্বাস যায়। মুসলমানেরা মূর্তি পূজারে শিরক সমতুল্য অপরাধ মনে করে।  আর অন্যদিকে হিন্দুরা  বুকে পেটে গলায় ঘণ্টা বাইন্ধা মূর্তির সামনে জপ করতে বইসা যায়। মুসলমানেরা  গরু খাইয়া সাফা কইরা ফালায় তো হিন্দুরা হেইডারে মা ডাইকা কূল পায় না।  অন্য ধর্মের আচার ব্যবহার তুক তাক আর মন্ত্র টন্ত্রে এত ধরনের পরষ্পরবিরোধিতা থাকলে কি হইব বিধর্মীদের ক্ষেত্রে হেইডা সব ধর্মের মত একই রকমের খচ্চর। কইছে –

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ

মানে সোজা কথা হইল হিন্দু ধর্মে থাইকা জুতা খাওনও ভালা,  অন্য ধর্মের  দিকে যাওনের চেয়ে। অন্য ধর্মে গেলে বাঁচলে জুতা খাইবা, মরলে বেগুন পোড়া হইবা। অনেকটা  মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজির উল্টাডা।

তাই হেচকিহয়রানোমোল্লারা যদি মইরা গিয়া দ্যাখেন আখেরাতের ময়দানে কোন সফেদ দাঁড়ি সমেত আল্লাহপাক বইসা নাই – বরং  পীনোন্নত কালা পাহাড় মা-কালী খড়গ উচায়া খাড়ায় রইছে আর মোল্লা দেখলেই দেদারসে কোপাইতাছে – তখন আঙ্কেল-প্যাস্কেল কিংবা হুজুরেআলমপনা-মুহম্মদ কারো নাম লইয়াই বাঁচবার পারবেন না, কয়া দিলাম।

আইচ্ছা ফাইজলামি না হয়  বাদ দেই। গাণিতিক ভাবেই না হয় দেখি।  ‘‘ভাই  আমি আপনে সবাই একদিন মইরা যামু। ধরেন  ঈশ্বর থাকা, না -থাকার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি …’ এই সমস্যার একটা সুন্দর উত্তর অপার্থিব অনেক আগে একটা ফোরামে  দিছিলেন ইংরেজিতে । বাংলা করলে দাঁড়াইবো এইরকমের –

‘এই মৃত্যুর পর ঈশ্বর থাকা না থাকা -ফিফটি-ফিফটি  (এটা স্রেফ সম্ভাবনা, কোন ‘ফ্যাক্ট’ নয়) ব্যাপারটা আসলে কি মিন করে?  প্রথমতঃ একজন বিশ্বাসীর কাছে এই সম্ভাবনাটাই  শতকরা ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে হাজির হয়।  আর একজন অবিশ্বাসীর কাছে তা শতকরা ০ ভাগ।  অজ্ঞেয়বাদী কিংবা হাল্কা ধরণের বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা ০  থেকে ১০০এর মধ্যে যে কোন জায়গায় থাকতে পারে। এখন এই শতকরা হিসেব যাই হোক না কেন, এটা নির্দেশ করে একজন বিশ্বাসীর মনোজগতে তার (ঈশ্বরে)বিশ্বাসের স্তরকে, কোন ভাবেই  মৃত্যুর পর প্রকৃত ঈশ্বর থাকা বা না থাকার কোন সত্যিকার প্রোবাবিলিটি নয়। কারণ, এই সম্ভাবনার হিসেব এসেছে বিশ্বাসীদের মানসপটে থাকা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে যেটা বস্তুনিষ্ঠ-ভাবে গণনা করাই সম্ভব নয়, প্রমাণ তো পরের কথা। কাজেই এই ‘ফিফটি-ফিফটি’ এনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ বড় সড় হেত্বাভাস দোষে দুষ্ট, কারণ, মানসজগতে বিশ্বাসের স্তরের উপর ভিত্তি করে  কোন কিছু অস্তিত্ব প্রমাণের যুক্তি  নির্মিত হওয়া উচিৎ নয়,  সেটা বরং হওয়া উচিৎ বৈজ্ঞানিক কিংবা বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ সাপেক্ষে।

এখানে ধরেই নেয়া হচ্ছে ফিফটি-ফিফটি চান্স-এর যুক্তি (যেটা আসলে কুযুক্তি উপরেই দেখান হয়েছে) উপস্থাপন করলেই বিশ্বাসের উপকারিতা বুঝা যাবে আর অবিশ্বাসের বিপদের আলামত পাওয়া যাবে। সেই কত শতক আগে প্যাস্কালের এই বাজিকে খণ্ডন করে দেয়া হয়েছে, অথচ সেটা এই শতাব্দীতেও বিশ্বাসীদের হৃদয়ে সেটা দোলা দিয়ে চলেছে অবলীলায়। প্যাস্কালের বাজির আরেকটা বড় ত্রুটি হল  – যদি ধরেও নেয়া হয় মৃত্যুর পরে পরকাল বলে কিছু একটা আছে, তারপরেও প্রমাণিত হয় না যে একটা নির্দিষ্ট ধর্মই (religion-X) প্রকৃত  ধর্ম। যেহেতু ঐ ধর্মের বাইরেও আরো ধর্ম (religion-Y, Z etc..)  আছে  আর  সেগুলো ও তাদের মত করে পরকালকে নির্দেশ করে, কাজেই যে কোন একটা ধর্মকে সত্য মনে করে সার্বজনীন ভীতি তৈরি করা আর এর প্রেক্ষিতে মনের মাধুরী মিশিয়ে যুক্তি সাজানো আসলে প্রতারণার নামান্তর।‘

কিন্তু মুশকিল হৈল কোন বিশ্বাসীরেই এই লজিকের দুর্বলতা বোঝানো যাইবো না। তারা প্যাস্কালের মতোই ধইরা নেন তাদের ধর্মের ঈশ্বরই প্রকৃত ঈশ্বর;  আর সব ঝুটা হ্যাঁয়।  ইংরেজিতে এই ধরনের হেত্বাভাসকে বলে ‘fallacy of false dilemma/false dichotomy/bifurcation’  অন্য সব অপশনকে বাতিলের খাতায় পাঠায়া নিজেরটারে উপ্রে তুইলা ধরা। বাংলা  ব্লগে এই প্রজাতির একটা মজার নাম আছে –  আল্লামা তালগাছবাদী!

এই (চাপা)বাজির ক্রাইটেরিয়াই বা কী?

বাজি ধরবার চান ভালা কথা। কিন্তু ক্রাইটেরিয়া ছাড়া বাজি ধরার তো কোন মানে নাই। আস্তিকতা একটা ব্যাপক আর বিস্তৃত বিষয়। একটা হিন্দুরেও আমরা আস্তিক কই, একটা মুসলিমরেও কই আস্তিক। এখন হিন্দুর আস্তিকতা আর মুসলমানের আস্তিকতা তো এক না। অথচ প্যাস্কালের বাজিতে হিন্দু-মুসলমান-ক্যাথলিক সবডিরেই এক কইরা দেখানো হইসে আর ধইরা নেয়া হইসে নাস্তিক হইলেই পাঙ্গা মারা।  এক আস্তিকের লগে আরেক আস্তিকের বিশ্বাসের বিরোধগুলা চামে চিকোনে চাইপা যাওন হইসে। এইটা কোন  বাজির ক্রাইটেরিয়া হৈল নাকি?

আরো গুরুতর সমস্যা হইল, নাস্তিক হৈলেই পাঙ্গা-মারা খাইব, এই বিশ্বাসেরই বা হেতু কি?  আমি একবার ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিছিলাম –

ভেবে দেখলাম, আমাদের মহান ঈশ্বর হচ্ছেন নাস্তিকূলশিরোমনি, মানে সবচেয়ে বড় নাস্তিক (উনি বিশ্বাস করেন না যে কোন সৃষ্টিকর্তা তারে বানাইছে), তাই তার দর্শন হওয়া উচিৎ অবিশ্বাসের দর্শন!

যে সৃষ্টিকর্তা নিজেই নাস্তিক, তিনি নাস্তিকগো  পাঙ্গা মারবেন, আর আস্তিক-মোল্লাগো মাথায় কইরা রাখবেন, এইডা কেউ বুঝায় দিলেই হইব নাকি।   🙂

আর তাছাড়া যে ব্যাটারে ঘটা কইরা  ‘ঈশ্বর’ উপাধি দেওন হইসে, তার ঘটে তো এক্টু বুদ্ধিশুদ্ধিও আমরা আশা করি, নাকি! যে মোল্লারা নির্বিবাদে আর আন্ধা বিশ্বাসে জিহাদ,  জাতিভেদ, শরিয়া, ক্রুসেড সব কিছু বিশ্বাস করছে, নারী গো শস্যক্ষেত্র বানায় রাখসে, নাইন ইলেভেন ঘটাইছে, গুজরাতে দাঙ্গা লাগাইছে, পয়লা বৈশাখে রমনা বটমূলে গিয়া বোমা মারছে, চার্চে বইসা শিশুকামিতা করছে, গাছের মগডালে বইসা ননী চুরি আর কৃষ্ণলীলা করছে, ফুসলাইয়া পালক পুত্রের বউরে বিয়া করছে,  বিধর্মী গো মুরতাদ আখ্যা দিছে, চোখ বন্ধ কইরা হুমায়ুন আজাদরে কোপাইছে, পৃথিবীডারে আবর্জনার গোডাউন বানায় রাখসে – মহান ঈশ্বর পঙ্গপালের লাহান হেদের গণহারে বেহেস্তে পাঠাইবো, আর যারা যুক্তি বুদ্ধি দিয়া চিন্তা কইরা এই অমানবিকতা আর নাফরমানির বিরোধিতা করছে, তারা নাকি যাইবো দোজখে। এইটা তো প্রকৃত ঈশ্বর করবার পারেন না। হয়তো, ক্যাডা জানে – তার কাছে যুক্তিবাদীরাই সবচেয়ে আপন, কারণ তারা পৃথিবীতে যুক্তি বুদ্ধি দিয়া চিন্তা করছে, গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসায় দিয়া ভেড়ার পালের মতোন চিন্তা করে নাই। তাগোই তো ঈশ্বরের পরীক্ষায় ফুলমার্ক পাইয়া পাশ করনের কথা। সেই জন্যই সংশয়বাদী রিচার্ড ক্যারিয়ার ২০০২ সালে  একটা প্রবন্ধ লিখছিলেন, শিরোনাম ‘ প্যাস্কালের ওয়েজারের সমাপ্তি – কেবল অবিশ্বাসীরাই স্বর্গে যাবেন’ । সেই প্রবন্ধ থিকা কিছু অংশ বয়ান করি –

“Therefore only intellectually committed but critical nontheists (nonbelievers) are genuinely good and will go to heaven. Therefore, if a god exists, his silence and allowance of evil  are explained and justified by his plan to discover the only sorts of people who deserve to populate heaven: sincere nontheists. And this makes perfect sense of many mysteries, thus explaining what theists struggle to explain themselves.”

একই কথা কইছেন ম্যাসিমো পাগ্লিউসি তার “Pascal’s Wager: Is It Safer To Believe In God Even If There Is No Proof That One Exists?  প্রবন্ধে।  এই প্রবন্ধ থিকা কিছু লাইন –

“Many Agnostics, for example, have evaluated all the “proofs” for God’s existence, and all of the “proofs” of God’s non-existence. They conclude that neither belief can be substantiated. They feel that they cannot rationally believe in the existence or non-existence of God; they must remain Agnostic. Under these conditions, a person can only believe in God if they violate their honesty. And God might punish a lack of honestly more severely than not being able to believe in God.

It can also be argued that if people believe something on insufficient evidence, that the result is the promoting of credulity — something that harms society. Again, that could be a sin that God is particularly concerned about punishing.”

সারমর্ম হইল – ঈশ্বরের লিচ্চয় মাথা খারাপ না যে কুন হালায় বিনা প্রমাণে বলদের লাহান মাথা ঠুইকা ঠুইকা যাবতীয় হুর পরী কুসংস্কার অপসংস্কারে  বিশ্বাস করছে বইলাই হেরে  চুম্মা দিয়া বেহেস্তে পাঠায় দিবো, আর নাস্তিক যুক্তিবাদী গো কোপাইব। বরং অবিশ্বাসীরা হেই কাজটাই ভালমত করছে যা ঈশ্বরের পছন্দ – মানবিকতা, যুক্তিবাদ আর মুক্তবুদ্ধির চর্চা। একজন সত্যিকার ন্যায়বিচারক কোন সত্য-সন্ধানীকে শাস্তি দিতে পারে না।কাজেই, আল্লায় দিলে,  অবিশ্বাসী নাস্তিকেরাই পরীক্ষায় পাশ কইরা বেহেস্তে যাইবো, চিন্তা কইরেন না।  বলেন আমীন!

ঈশ্বরের পরীক্ষাটা আসলে কিয়ের পরীক্ষা?

ঈশ্বরের পরীক্ষার কথা যখন আসলোই একটা মজার ব্যাপার মনে হইল। আরজ আলী মাতুব্বর তার সত্যের সন্ধান গ্রন্থে লিখছিলেন –

বলা হয় যে, আল্লাহর অনিচ্ছায় কোন ঘটনা ঘটে না। এমনকি গাছের পাতাটিও নড়ে না। বিশেষত তাঁর অনিচ্ছায় যদি কোন ঘটনা ঘটতে পারে তাহা হইলে তাঁহার ‘সর্বশক্তিমান’ নামের সার্থকতা কোথায়? আর যদি আল্লাহর ইচ্ছায়ই সকল ঘটনা ঘটে তবে জীবের দোষ বা পাপ কি?

এখন কেউ কইতে পারে ঈশ্বরের অনিচ্ছায় যদি কোন ঘটনা না ঘটে, তাইলে পুরা বাজিই একটা তামাসা হইয়া যায়। ঈশ্বর যেহেতু সর্বজ্ঞ, তিনি নিশ্চয় জানেন  ক্যাডা আস্তিক হৈব আর ক্যাডায় নাস্তিক। যে ব্যাটা নাস্তিক হৈতাছে, সেই ব্যাডা আসলে কিন্তুক কোন না কোনভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছা আর উদ্দেশ্যই পূরণ করতাছে। কারো বাপের সাধ্য আছে নাকি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওনের? নাই।  ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে গেলে তো তার সর্বশক্তিমান  খেতাবটাই প্রশ্নবিদ্ধ হৈয়া যায়। তাই ঈশ্বর চান যে নাস্তিকেরা নাস্তিক থাকুক। এই দিক দিয়া চিন্তা করলে প্যাস্কেলের বাজি ফাজি  সবকিছুই কিন্তু ভোজবাজি হইয়া মিলায় যাইতে দেরী লাগে না।

আসলেই কি (অন্ধ)বিশ্বাসে কিছুই হারানোর নাই?

এখন কথা হইতাছে যদি কোন ঈশ্বর খালি অন্ধবিশ্বাসী হওনের কারণে কুনো মোল্লারে বেহেস্তে পাঠায়, আর অবিশ্বাসীরে কঠিন শাস্তি দেয়, সেই ঈশ্বর তো আসলে স্তাবকতাপ্রিয় ঈশ্বর। ইনি চাটুকারিতা পছন্দ করেন। এখন একটা লোক ক্যামন আছিল, কি করল, মানুষের জন্য কি কি ভালা কাজ কর্ছে,  হেইগুলান না বিবেচনা কইরা খালি ব্যাটায় সাড়া জীবন ধইরা চাটুকারিতা কর্ছে নাকি  আর মহারাজার কাছে ঈমানদন্ড খাড়া কইরা ঈমান আনছে নাকি –এইডাই যদি হয় একমাত্র ক্রাইটেরিয়া – তাইলে  কোন সুস্থবুদ্ধির লোক হেই ব্যাডারে পুছব না। অন্ততঃ আমি নাই এইডাতে, কইয়া দিবার পারি।

ক্যানো এইডাতে আমি নাই? কারণ প্যাস্কাল সাব আর তার অনুসারীরা এই টাইপের রেসিস্ট ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে পরকালে  ‘কিছুই হারানোর নাই’ বইলা জিগির তুললেও আমার তো মনে হয় আমি মানুষ হিসেবে চিন্তা করার ক্ষমতাটাই হারায় ফেলতাছি। চাটুকারিতার কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ কইরা আমার সততা হারাইতাছি, আমার সাহস হারাইতাছি, নিষ্ঠা হারাইতাছি, হারাইতাছি আমার সুস্থ বিচার বোধ। তারপরেও কইবেন আমার কিছুই হারানোর নাই? দার্শনিক জর্জ স্মিথ তার Atheism: The Case Against God, বইয়ে সেজন্যই বলেছেন –

‘আমরা কী হারাবো? আমরা হারাবো বৌদ্ধিক সততা, আত্মসম্মানবোধ, হারাবো একটা চৌকস জীবন-দর্শন।  সংক্ষেপে, জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে যা যা লাগে, সবই হারিয়ে ফেলব আমরা। না, প্যাস্কালের ওয়েজার কোন ‘নিরাপদ বাজি’ নয়, বরং এটি অভীষ্ট জীবন আর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে কেনা ছলনা’।

জীবন তো ভাই একটাই। সততা, আত্মসম্মানবোধ, সুস্থ বিচার বুদ্ধি হারায়া লাভটা কী? তাই আসেন – প্যাস্কালের মামদো বাজিরে কইষা লাথি!

বোনাস – পাঠকদের জন্য প্যাস্কালের বাজি নিয়া একখান ভিডিও –

httpv://www.youtube.com/watch?v=v9WRG4e6m2s

:line:

দর্শন শাস্ত্রের প্রান্তিক টুকিটাকি বিষয়গুলো নিয়ে  প্রাসঙ্গিক কিছু পোস্ট