ছোবল
আফরোজা আলম

ঝন-ন-ন ঝনাৎ। একটু পরেই আর্ত চিৎকার। হঠাৎ থমকে গেলাম। শব্দ অনূসরণ করে দৃষ্টি গেল জানালায়। মুখ সরিয়ে নিলাম চোখাচোখি হতেই। মিসেস রহমান। তিনিও ঝুঁকে, কাত, হয়ে হয়তো আমার মতোই বুঝতে চাইছেন আসলে হচ্ছে টা কী? অতি কৌ্তুহলি ও পরচর্চা বিলাসী এই মহিলাকে পারত পক্ষে এড়িয়ে চলি। দৃষ্টি বিনিময়ে একটুকরা হাসি ছুড়ে চলে গেলাম।
বেশ চড়া গলা কানে আসছে। স্বরটা জড়ানো। কেনো জানি মনে হল অনেকগুলো উৎকর্ণ মুখ তাকিয়ে আছে এই দিকেই। লোড শেডিং চলছে। সেই সাথে জেনারেটরের বিচ্ছিরি শব্দ। চারদিকে আলো আঁধারির খেলা।

বারান্দায় দাড়ালাম দূর থেকেই জমায়েত দেখতে পাচ্ছি। এক মুহূর্তে মনে হল ও বাড়িতে কী ডাকাত পড়েছে? কেউ খুন হয়েছে? আজকাল খুন জখম খুব স্বাভাবিক ব্যপার হয়ে দাড়িয়েছে। মানুষ মানুষকে পাখির মত মারছে।
গোঙ্গানির শব্দ ধরে বুঝতে চেষ্টা করছি। ঝুঁকে দেখছি। ঠিক বুঝতে পারছিনা শব্দটার উৎস কোথায়?

তবে নারী চিৎকার এই বিষয়ে নিশ্চিত। স্নায়ুকে শক্ত করে ঘাড়টা সোজা সামনে রাখলাম। হঠাৎ ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস পড়তেই চমকে উঠলাম।
-আহারে কারে কে মারতাসে কে জানে। নাকী কাজের মাইয়াডারে মাইরা ফালাইব-
-ক কেনো মারবে শুধু শুধু? আমি জিজ্ঞেস করি। আমার কাজের মহিলা হাসল। তার হাসিতে এক প্রছন্ন ভাব ছিল যে- আমি এক নিরেট আহাম্মক।

-হুনেন, কানের কাছে এগিয়ে আসতেই একটু পিছালাম। মুখ থেকে পানের সাথে সাদা পাতার বাজে কটু গন্ধ আসছে। কতবার বলেছি –মতির মা’কে এই সব ছাই-পাশ না খেতে।
মোদ্দা কথা আমাদের মতির মার কথা থেকে জানলাম –
অল্প বয়সি কাজের মেয়েদের নিয়ে আসে দারোগার ড্রাইভার( সবাই দারগাই ডাকে,তার পদবি আমি জানিনা)।
২/৩ জন তো থাকেই সব সময় বাড়িতে। ওরা সবাই গৃহকর্ম করে। আর দারোগা সাহেব একএক সময় একএক জনের দেহ সূধা পান করেন। এই কচি মেয়েগুলোর মাঝে সুফিয়া নামের মেয়েটা একদম বেয়াড়া। কথা শোনেনা। তাঁর প্রয়োজন আবার যখন তখন হয়। তিনি তখন স্ত্রী, কন্যার সম্মুখে দরজা বন্ধ করে দেন। তিনি কিন্তু ধর্ম-কর্মে খুব নিষ্ঠাবান। হজ্জ্ব করা মানুষ।
কচি মেয়ের কচি মাংশের গন্ধ শুঁকেন। তার দেহতে তিনি সাঁতার কাটতে ভালোবাসেন।
আজ বিধি বাম। দারোগা ভদ্রলোকের স্ত্রী সেই সময় রুখে দাড়িয়েছেন। তিনি স্ত্রীকে পৈশাচিক ভাবে মারধর করছেন।

বাড়ন্ত বয়সের তাঁর নিজের তিনটি কন্যা সন্তান আছে। তার মাঝে বড় মেয়েটা ১৮ পেরুতে না পেরুতে ডিশের(ক্যাবল লাইন) এক ছেলের সাথে চলে গেছে। শোনা গেছে এখন সে স্বামীর বাড়িতেই আছে শান্তিতে ঘর করছে।
এই সব কথা আই জেনেছি আমার কাজের মানুষের কাছ থেকে নয়। কাজের মানুষের কথা নাকী সব সময় সত্য হয়না। তাতে কিছুটা রঙ, চং মিশ্রন থাকে। তাই শোনা কথায় কান না দিতেই চেষ্টা করি। তবু জেনেছি, পাশের ফ্ল্যাট, ও পাশের ফ্ল্যাট, ডান, বাম সব দিক থেকেই।
-কেউ এর প্রতিবাদ করেনা? জিজ্ঞেশ করি পাশের প্রতিবেশীকে। আমি তখন এই ফ্ল্যাট এ সদ্য এসেছি। অনেক কিছুই জানিনা। এখানকার হাওয়া বাতাস পরিচিত না।
– কী যে বলেন-থুক করে পানের পিক ফেলে বলেন-কার এতো বড় বুকের পাটা আছে বলেন আপা? উনি দারোগা যখন যে সরকার আসে সেই দলেরই ক্ষমাতাবান মানুষ। তায় আবার উকিল পাশ শুনেছি- কার এতো সাহস?
মাথা ঝিমঝিমিয়ে উঠল, ঠিক যেনো শর্ট সার্কিট হয়ে থাকা কোন বিপজ্জনক যন্ত্রে হাত ছোঁয়াতে গেলে যেমনটা হয়।
এই আবছা অন্ধকারে পালিয়ে আসা মনকে শক্ত করলাম। মনকে বুঝাতে ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। কী করব? আমার মত সাধারণ মানুষ কীই বা করতে পারি?

পরের দিন-
দরজা সজোরে কে যেনো ধাক্কা মারছে। কয়েকবার উচ্চস্বরে কাজের মেয়েটাকে ডাকলাম,
-দেখতো কে এলো? দু’হাতই আমার আটকানো কি একটা কাজ করছি। চিন্তিত হলাম, কেউ আসার আগে তো ইন্টারকমে জানায় দারোয়ান। তবে- ভাবতে ভাবতেই দরজা খোলা হল। দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ৫/৬ জন প্রায় ঢুকে পড়ে ঘরে। আমি ও হাতের কাজ ফেলে দ্রুত গেলাম ।
-কে কে তোমরা? না বলে কয়ে ঢুকে পড়লে? কিছুটা ভীত হলাম। এ আবার কোন বিপদ আমার ঘাড়ে এলো।
একজনের মুখ চেনা লাগলো। ড্রাইভার- সেই দারোগার ড্রাইভার। সেই মুহূর্তে মনে এলো। সে বলে,
-ম্যাডাম আমাদের বাসার কাজের মাইয়াটা পাইতাসিনা, তাই খুঁজতে আইসি।
আমি টের পাচ্ছি আমার পিঠ বেয়ে বিন বিনে ঘাম। কেমন একটা ভয় ভয় আতংক আমাকে গ্রাস করল।
শক্ত চোয়ালে বলি-
-তোমাদের কাজের মেয়ে এ বাসায় থাকবে কেন? কেউ নেই এখানে তোমরা বিদায় হও –
বলে হাঁফাতে লাগলাম। চলে গেলে দড়াম করে দরোজা লাগিয়ে দিলাম।
দরোজার ফুটো দিয়ে দেখলাম ওরা হন হনিয়ে চলে গেল। এরপরে শোনা গেল সমস্ত ফ্ল্যাটেই তারা তল্লাসি চালিয়েছে। পালিয়েছে মেয়েটি-
২৪ ঘন্টা পরে-
এই ক’ঘন্টার মাঝেই কাজের মেয়েকে তার দেশের বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এল সেই দারোগার ড্রাইভার আর তার অনুগতের দল। আবার চলবে উপভোগের মহোৎসব। পালিয়েও রক্ষা পেলোনা। এই ভাবে কেউ রক্ষা পায়না। যেই এই মানুষের নেক নজরে পড়ে তার জীবনে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার।
জীবনে অনেক দেখেছি। দেখতে দেখেই পর্যন্ত কম অভিজ্ঞতা হল না। চাক্ষুস এমন অমানবিক ব্যপার এই প্রথম দেখলাম, শুনলাম, জানলাম।
এ দেশে এমন কতো সুফিয়া এই রকম রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার এর শিকার হচ্ছে তার হিসেব নেই। তার মাঝে পুলিশ( সবাই নয় সবাইকে এককাতারে ফেলছিনা) তো সর্বময় ক্ষমতাধর।
সুফিয়াদের মুক্তি কী ভাবে মিলবে জানিনা। বা আদৌ মিলবে কিনা। দারোগার স্ত্রীর আর একটা পরিচয় আছে। তিনি একজন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ। বেশ প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। এমন পেশায় থেকেও কেনো তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে কিথা বলতে পারেন না, বা তাঁর অনৈতিক চলনে বাধা দিতে পারেন না , সে কথা একদিন তাঁর নিজের মুখের থেকেই জেনেছি।

অনেকদিন পরে-
অদূরেই থাকেন আমার এক চাচি। আমাকে তিনি যথেষ্ট স্নেহ করেন। তো সেই চাচি একদিন বিকেল হয় হয় সময়ে আমার বাড়ি সময় কাটাতে এলেন। সাথের সঙ্গীকে তাঁর বান্ধবী বলে পরিচয় দিলেন। আমি কূশল জিজ্ঞেশ করে যথারীতি চা-নাশতা দিলাম। খেতে খেতে জানলাম, এই মহিলা সেই দারোগা ভদ্রলোকের স্ত্রী।
আমি বিস্মিত হলাম। থাকতে না পেরে জিজ্ঞেশ করেই ফেললাম কেন তিনি এই সব সহ্য করে চলেছেন। কেন তিনি দেশে এতো আইন আদালত থাকতে, বিশেষ করে জানালাম “নারী নির্যাতন” আইন আমাদের দেশে ভালো মত কাজ করছে যখন, তবে কেনো যান না।
উত্তর শুনে অবাক হয়ে গেলাম। তিনি জানালেন তাঁর তিনটি কন্যা আছে। তাদের বিয়েশাদি আছে, এমতঅবস্থায় এমন কিছু পদক্ষেপ নিলে তো তাঁর কন্যা সন্তানের ক্ষতি হবে। ভালো কিছুই হবে না। এই গেলো এক সমস্যা। দ্বিতীয় সমস্যা তাঁর স্বামী অনেক ক্ষমতাধর। তাঁর দুই হস্ত অনেক প্রসারিত। তাই যে কোনো বিরুদ্ধাচারণই করেন না কেনো, তাতে কোন লাভ হবেনা। বরং দেখা গেছে আর ক্ষতি হয়েছে।
ছোট বেলা থেকে জানি এক প্রবাদ-
-সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে’
তবে এই রমনীর গুনের কী এমন কোন ঘাটতি ছিল যে এমন করে দিনের পর দিন সেই ভদ্রলোক স্বেচ্ছাচারিতা করেই যাবেন? আর এই মহিলা সয়ে যাবেন? মনে তো হয়না। যদি মহিলা গৃহিনী হন মহিলাদের দোষ বলে মনে করা হয়। দাপট তো সংসারের হর্তা কর্তারই থাকবে। কেননা তিনিই একমাত্র উপার্জন সক্ষম ব্যক্তি। এ ক্ষেত্রে তো তা নয়।
তাঁর ঘাড়ে হাতে, শরিরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলাম। আসলে এই সব কথা শোনার পরে আমার আর কিছু বলার মত ছিলনা। আমি অনেকটা বোবা হয়ে গেলাম। কিসে যে সমস্যার সমাধান, কার জন্য কোন পদক্ষেপ ভালো হয় তা তিনিই জানেন। বলে গেলেন এটা একান্ত তাঁদের পারিবারিক সমস্যা।
এর বেশ কিছুদিন পরে জানতে পারি সেই ডাক্তার মহিলা নাই। তাঁকে বের করে দেয়া হয়েছে মারধোর করে। তিনি কী এর কোনো প্রতিকার চেয়েছিলেন কিনা জানার আর চেষ্টা করিনি। কেননা মনের বেদনা তাতে বাড়বে বৈ কমবে না।

এই সব মানুষ নামধারী পুলিশ, (সকলে নন) সাপের খোলশ বদলের মত বর্বরতার খোলশ খুলে কর্মক্ষেত্রে ভদ্রতার লেবাস পরে কাজ করে যায় দিনের পর দিন। এরাই নীতি বাক্য আউড়ে যায়। এরাই সমাজের ধারক বাহক।
এরা শিক্ষকদের উপরে হামলা চালায়। শিক্ষকদের অপরাধ” চাকরি জাতীয়করনের” দাবী। পত্রিকায় ছবিতে দেখা যায় গলা টিপে ধরে আছে এই পুলিশের দল বিক্ষোভকারীদেরকে।এর নাম গনতন্ত্র।
এ সব পত্রিকার কথা, মানুষের আমজনগনের কথা শোনার সময় তাঁদের নেই। তাঁরা দেশে আইনের শাসন বলবৎ করতে ব্যস্ত। কিন্তু, অন্তরালে যে পৈশাচিক যৌন নিপীড়ন করছে এই আইন শৃংখলা বাহিনী(সবাই নন) তার খবর আমরা অনেকেই জানিনা। বা অনেক অনাচার থেকে যায় নীরবে, চোখের আড়ালে।
আর জানলেও তাদের কাছে সাধারণ মানুষ অসহায়। কে রক্ষা করবে এই নিরীহ কচি মেয়েদের এই কালো ছোবলের হাত থেকে?
দাসত্বপ্রথা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এখনও বর্তমান। তবে এমন পৈশাচিকতার অবসান হোক এইটাই কাম্য।