( নবম পর্বের পর…)
…
করুণার ধন স্ত্রীধন
পিতৃসম্পদে নারীর কোন উত্তরাধিকার নেই। কিন্তু যে ধনটুকুতে নারীর অধিকার স্বীকৃত তা হচ্ছে স্ত্রীধন। তবে এটা এমনই ধন যা নারীর প্রতি করুণার ধনই বলা যায়। মনুশাস্ত্রে ছয় ধরনের স্ত্রীধনের উল্লেখ রয়েছে, যা বণ্টনেও জটিলতা রয়েছে-
‘অধ্যগ্ন্যধ্যাবাহনিকং দত্তঞ্চ প্রীতিকর্মণি।
ভ্রাতৃমাতৃপিতৃপ্রাপ্তং ষড়বিধং স্ত্রীধনং স্মৃতম্।।’
স্ত্রীধন ছয় প্রকার- অধ্যাগ্নি, অধ্যাবাহনিক, প্রীতিদত্ত, ভ্রাতৃদত্ত, মাতৃদত্ত ও পিতৃদত্ত। অধ্যাগ্নি-স্ত্রীধন হলো বিবাহকালে পিতাপ্রভৃতিদের দ্বারা দত্ত ধন, অধ্যাবাহনিক ধন হলো পিতৃগৃহ থেকে পতিগৃহে নিয়ে আসার সময় যে ধন লব্ধ হয়, প্রীতিদত্ত ধন হলো রতিকালে বা অন্যসময় পতি কর্তৃক প্রীতিপূর্বক যে ধন স্ত্রীকে প্রদত্ত হয়। (৯/১৯৪)।
এই স্ত্রীধনের মালিক স্ত্রী হলেও সামাজিক বাস্তবতা হচ্ছে তা সাধারণভাবে স্বামীর রক্ষণাবেক্ষণেই থাকে এবং প্রকৃতপক্ষে স্বামীই তা ভোগ করে। যদিও তা ভোগ করার ক্ষেত্রে স্ত্রীর অনুমতি নেয়ার নৈতিক দায়িত্ব থাকে, বাস্তবে তা পালিত হয় না।
এই স্ত্রীধন রেখে স্ত্রীর মৃত্যু হলে তা বণ্টনেরও একটি নির্দেশিকা রয়েছে-
‘অন্বাধেয়ঞ্চ যদ্দত্তং পত্যা প্রীতেন চৈব যৎ।
পত্যৌ জীবতি বৃত্তায়াঃ প্রজায়াস্তদ্ধনং ভবেৎ।।’
বিবাহের পর পিতা, মাতা, স্বামী, পিতৃ-কুল এবং ভর্তৃকুল থেকে লব্ধ যে ধন তাকে সাধারণভাবে ‘অন্বাধেয়’ বলা হয়। স্ত্রীলোকের ‘অন্বাধেয়’ ধন এবং তার পতিকর্তৃক তাকে প্রীতিপূর্বক প্রদত্ত যে ধন তা-ও স্বামীর জীবদ্দশায় স্ত্রীলোকের মৃত্যু হলে তার সন্তানেরা পাবে। (৯/১৯৫)।
এই সন্তান বলতে এই স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র ও অবিবাহিতা কন্যারা সমান ভাগ প্রাপ্য (৯/১৯২)। আর তার বিবাহিত কন্যার যদি অবিবাহিত কন্যা অর্থাৎ অবিবাহিতা দৌহিত্রী থাকে তাদেরও মাতামহীর ধন থেকে কিছু কিছু অংশ দিয়ে সম্মানিত ও সন্তুষ্ট রাখতে (৯/১৯৩) বলা হয়েছে। কিন্তু নিঃসন্তান অবস্থায় স্ত্রীধন রেখে কোন স্ত্রীলোক মারা গেলে-
‘ব্রাহ্মদৈবার্ষগান্ধর্বপ্রাজাপত্যেষু যদ্বসু।
অপ্রজায়ামতীতায়াং ভর্তুরেব তদিষ্যতে।।’
ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, গান্ধর্ব ও প্রাজাপাত্য- এই পাঁচপ্রকার বিবাহে লব্ধ যে স্ত্রীধন, তার সবই কোনও স্ত্রীলোক নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তার স্বামীই পাবে। (৯/১৯৬)।
.
‘যৎ তস্যাঃ স্যাদ্ধনং দত্তং বিবাহেষ্বাসুরাদিষু।
অপ্রজায়ামতীতায়াং মাতাপিত্রোস্তদিষ্যতে।।’
আসুর, রাক্ষস ও পৈশাচ- এই তিন প্রকার বিবাহে লব্ধ যে স্ত্রীধন, তা রেখে কোনও স্ত্রীলোক যদি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যায় তাহলে ঐ ধনে ঐ স্ত্রীর মাতার প্রথম অধিকার, কিন্তু মাতার মৃত্যু হলে পিতা অধিকারী হয়। (৯/১৯৭)।
মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক উত্তরাধিকারে নারীর কোন অধিকার না থাকায় এই করুণালব্ধ স্ত্রীধন যে আসলে একধরনের ভিক্ষালব্ধ ধনই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সামাজিক বাস্তবতা হচ্ছে, এই সামান্য ধনও আসলে স্ত্রী ভোগ করে যেতে পারে না। এজন্যেই হয়তো মৃত্যুপরবর্তী তা বণ্টনের নির্দেশনা মনুশাস্ত্রে দেখা যায়। তাছাড়া স্মৃতিশাস্ত্র নির্দেশিত বিধানে স্ত্রীর কোন আলাদা সত্তাই থাকে না-
‘ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ ত্রয় এবাধনাঃ স্মৃতাঃ।
যত্তে সমধিগচ্ছন্তি যস্য তে তস্য তদ্ ধনম্।।’
স্মৃতিকারগণের মতে, ভার্যা, পুত্র ও দাস- এরা তিনজনই অধম (বিকল্পপাঠ- অধন); এরা তিনজনেই যা কিছু অর্থ উপার্জন করবে, তাতে এদের কোনও স্বাতন্ত্র্য থাকবে না, পরন্তু এরা যার অধীন ঐ ধন তারই হবে। (৮/৪১৬)।
অতএব, চূড়ান্ত বিচারে নারী কোন ধন-সম্পদেরই অধিকারী হতে পারে না। কেননা সে নিজেই ভোগ্যা, পিতৃতন্ত্রের উপাদেয় ভোগ-সামগ্রি। ব্যবহার্য ধন সে অন্যের ব্যবহার্য ধন মাত্র, কিছুতেই নিজেরও নয়। এবং এভাবেই পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার বলয়ে কুক্ষিগত নারী শেষপর্যন্ত নারীই থেকে যায়, মানুষ হতে পারে না।
.
অতঃপর নারী অধিকার ও সামাজিক প্রেক্ষিত
সমাজের অনিবার্য অংশ হয়েও যৌক্তিক সামাজিক ক্ষমতার অধিকার থেকে যাবতীয় নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারীকে বিতাড়ণের গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছে পুরুষ তার পিতৃতান্ত্রিক হাতিয়ার তথা ধর্মশাস্ত্র নাম দিয়ে কতকগুলো বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক শাসনতান্ত্রিক অনুশাসন সৃষ্টির মাধ্যমে। আর এই ধর্মসৃষ্টির হোতা যে পুরুষই, এসব ধর্মশাস্ত্রে কথিত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্রষ্টার পুরুষপ্রকৃতি এবং নারীকে পুরুষকর্তৃক ভোগ-ব্যবহারের উদগ্র প্রকাশই এর প্রমাণ। কোন অলৌকিক ঈশ্বরের চিন্তারাজিতে তাঁর সৃষ্টি বিষয়ক বিষয়বস্তু নিয়ে এতোটা অরুচিকর অবনমন ও বৈষম্য অচিন্তনীয়। বৈদিক ধর্মে মনুসংহিতা হচ্ছে এর উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এবং পরবর্তীকালের সৃষ্ট ও প্রচলিত অন্য ধর্মকাঠামোগুলোও মনে হয় তারই আরেকটু উৎকর্ষ ও বিবর্তিত প্রতিরূপ মাত্র। এর মাধ্যমেই তথাকথিত ধর্মশাস্ত্র সৃষ্টির পূর্বের নারী আর পরবর্তীকালের ধর্মপ্রবাহে নারীর অবস্থার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায় শাস্ত্র-নির্দেশিত অনুশাসনগুলোর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে। অর্থাৎ পরবর্তীকালের এই নারী সম্পূর্ণই পুরুষের ইচ্ছার প্রতীক এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজসৃষ্ট, যাকে মনুসংহিতার মতো কথিত শাস্ত্রগ্রন্থগুলোর মাধ্যমে বৈধরূপে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই নারীর প্রকৃত অন্তর্জগত আর পুরুষসৃষ্ট এই সামাজিক নারীতে আরোপিত জগত কখনোই এক নয়। পুরুষের ক্ষমতার বলয়ে বন্দী নারীর নিজস্ব ঐ জগতটা শেষপর্যন্ত একান্ত গোপন ও সুপ্তই রয়ে গেছে। তাকে কখনোই বাইরে আসতে দেয়নি পুরুষ, সেই জগতটিকে অস্বীকারের মাধ্যমে। আর যে আক্রান্ত নারীটিকে ইচ্ছার বর্বরতা দিয়ে নিজের মতো করে সাজিয়েছে পুরুষ, সেটাই বহিঃবাস্তবের সামাজিক নারী। এ নারী আসলে এক কল্পিত নারীই, যে কিনা পুরুষের অসভ্য মনের মাধুরি মেশানো প্রতিকৃতি। তাই নারীর মুক্তি মানে এই অসভ্য ক্ষমতার কবল থেকে মানবিক নারীসত্তার মুক্তি। অবগুণ্ঠিত অন্তর্জগতের ঘেরাটোপ থেকে মানুষ হিসেবে বাইরে বেরিয়ে আসার অধিকারই নারী-অধিকার। যেখানে সে তার মুক্তির আনন্দে নারী থেকে মানুষ হয়ে ওঠবে। কিন্তু মানবিক বোধ বর্জিত পিতৃতন্ত্র কি কখনো হতে দেবে তা ?
.
পিতৃতন্ত্রের সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি হচ্ছে তার ধর্মজাগতিকতা, কাল্পনিক ঐশিকতায় অপ্রমাণিত এক পারলৌকিক জগত তৈরি করে যেখান থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের শাসনতান্ত্রিক সুতোটাকে ধরে রেখেছে। এটাই তার ক্ষমতার উৎস, যা সে নিজেই সৃষ্টি করেছে। এবং এই ক্ষমতাই তার অস্তিত্ব। এখানে সামান্য আঁচরটুকু পড়তে গেলেই, কিংবা সামান্যতম আঁচর লাগার কোন কল্পিত সম্ভাবনা তৈরি হলেও সে মারমুখি হয়ে ওঠে। দেশীয় প্রেক্ষাপটে বা বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় গোষ্ঠিগুলোর উগ্রবাদী ক্রিয়াকলাপ এই রেশই বহন করছে। অতএব, নারী-পুরুষের সমতা বিধান তথা সার্বিক সামাজিক মঙ্গলবিধানের উপায় খুঁজতে হলে এক চিরায়ত মানবতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়ার গত্যন্তর নেই বলেই মনে হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সেই কল্যাণমূলক ক্ষমতায় উন্নীত করতে হবে, যাতে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মানবিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের উপর নিবর্তনমূলক সবধরনের ধর্মীয় কুশাসন রাষ্ট্রীক ও সামাজিকভাবেই রদ করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এজন্যে প্রথমেই দরকার রাষ্ট্র কর্তৃক সব ধরনের ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা। ধর্ম যে আসলে কোন অলৌকিক বস্তু বা ধারণা নয়, তা মানুষেরই সৃষ্টি এবং সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক পুরুষতান্ত্রিক বৈষম্যমূলক কূটভাবনার আর্থ-সামাজিক রূপই যে ধর্ম, এই বিজ্ঞান চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে মুক্তচিন্তাকে শানিয়ে তোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতে হবে রাষ্ট্রকেই। আর এই উদ্যোগ নিতে হবে মুক্ত-চেতনায় বিশ্বাসী জনগোষ্ঠিকেই।
.
এ প্রেক্ষিতে একটা বিষয় অনুধাবনযোগ্য যে, প্রচলিত ধর্মশাস্ত্রগুলোয় উল্লেখকৃত সামাজিক আবহ আদতে দেড় থেকে দু’হাজার বছর বা তারও আগের সমাজকাঠামোয় সৃষ্ট। মনুসংহিতার নারী প্রতীকগুলোও সেই দু’হাজার বছর আগেরই প্রতিকৃতি। ইতোমধ্যে সমাজ বিকাশের সুদীর্ঘ ধারায় সভ্যতার বহু বহু পরিবর্তন পরিবর্ধন সাধিত হওয়ার ফলে সেইসব শাস্ত্রীয় অনুশাসনের সবগুলো এখন আর সামাজিকভাবে প্রয়োগ করা হয় না বা তা প্রয়োগযোগ্যতায় নেই। এবং কালান্তরে এসে এগুলো অবিকল বা একেবারেই প্রয়োগ না করার কর্তৃত্বে একধরনের অধিকারবোধও রাষ্ট্রকাঠামোয় সংযোজিত হয়েছে। রাষ্ট্রের জনচেতনাও সেভাবেই বিকশিত হয়ে গেছে। তাই এমন ধারণা বদ্ধমূল করা মোটেও ঠিক নয় যে, রাষ্ট্র চাইলে সমস্ত ধর্মজাগতিকতাকে সরিয়ে তার জনমত প্রভাবিত করে কোন জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে না। রাষ্ট্র চাইলে অবশ্যই তা পারে। এজন্যেই ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। এ প্রেক্ষিতে যেকোন ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেই বর্জনের সপক্ষে মানবিক চেতনাসম্পন্ন নাগরিকদের একাট্টা হওয়া জরুরি। তার জন্যে দরকার মুক্তচিন্তা প্রকাশের অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা। এটা নিশ্চিত করা না গেলে বাকি অর্জনগুলোও সুদূরপরাহতই থেকে যাবে। এবং নারীর অধিকার একটা অধরা কাল্পনিক বিষয় হয়েই থাকবে।
.
অতএব, যে মাতৃ-নারীর গর্ভ থেকে উৎপন্ন পুরুষ, আমৃত্যু মঙ্গলকামী সুহৃদ হিসেবে যে প্রিয়তমাকে সাথে নিয়ে গোটা জীবন পারি দেয় পুরুষ, এবং যে অপত্যস্নেহে কন্যাশিশুটির নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে পিতৃবাৎসল্যে ঝলমল করে ওঠতে পারে একজন পুরুষ, সেই নারীকে কোন মানবিক পুরুষ নিজের মতো মানুষ হিসেবে ভাবতে না পারার কোন কারণ কি থাকতে পারে ! যে পুরুষ তা ভাবতে পারে না, সে মানুষ হতে পারে না। আর মানুষ হতে না-পারা অমানুষের জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী এবং মানুষের স্বপ্নময় জীবন নষ্ট হয়ে যাবে, তা কি আদৌ কাম্য কারো ?
…
[১ম পর্ব ] [২য় পর্ব ] [৩য় পর্ব] [৪র্থ পর্ব] [৫ম পর্ব ] [৬ষ্ঠ পর্ব] [৭ম পর্ব] [৮ম পর্ব ] [৯ম পর্ব] [শেষ * ]
…
তথ্য সহায়তা:
১. ঋগ্বেদ-সংহিতা /অনুবাদ রমেশচন্দ্র দত্ত /প্রথম প্রকাশ, জুন ১৯৭৬, কলকাতা।
২. মনুসংহিতা /সম্পাদনা ড. মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী /সুলভ সংস্করণ, বইমেলা ১৪১২, কলকাতা।
৩. ভারতীয় দর্শন /দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় /পঞ্চম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০০৭, কলকাতা।
৪. ভারতীয় শাস্ত্রে নারীকথা /সিরাজ সালেকীন /প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১০, ঢাকা।
৫. অবমুক্ত গদ্যরেখা /রণদীপম বসু /প্রথম প্রকাশ, শুদ্ধস্বর, ফেব্রুয়ারি ২০১১, ঢাকা।
…
শরিয়া ৯১৪ সালে লেখা হয় উগ্র আশআরি মাউলানাদের প্ররোচনায়। এর অনেক কিছু সত্যিকার মতবাদ মুতযিলার পরিপন্থী আর মনুসংহিতা তো সনাতন ধর্মের শেষ কথা নয়। সত্যি কথা তো এই যে হিন্দুরা নিজের প্রকৃত ধর্মগ্রন্থ বেদকেই সবথেকে কম মুল্য দিয়ে থাকে।
@রণদীপম বসু
অভিনন্দন।
আমাদের এলাকার ওপর লেখা জটিল আর কষ্টসাধ্য একটা অসাধারন সিরিজ শেষ করবার জন্য অভিনন্দন।
রেফারেন্স নেবার জন্য এই লেখাটা যত্ন করে তুলে রাখলাম।
অনেক ধন্যবাদ। (C)
শ্রমসাধ্য একটি মূল্যবান দলিল সম্পন্ন করার জন্য আপনাকে অনেক অভিনন্দন। প্রাচীণ হিন্দু নারীরা যে কত অসহায় কত পরাধীনতার শৃঙ্খলে নির্যাতিত ভাবে দিন কাটিয়ে বর্তমান অবস্থায় ঠেকেছে তা আপনার এই লেখার মাধ্যমে আবারো আমাদের স্মরণ করিয়ে দিল। (Y)
অপ্রাসংগিক ভাবে জানাচ্ছি আজ গত বছর বই মেলার আপনার কিছু ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে।
দাদা,
আপনার লেখায় নারীর পরাধীনতার যে অবস্থান দেখলাম, তাতে অন্যান্য ধর্মের চাইতে কম নয়। শেষ
প্যারাতে লিখেছেন,
এমন ভাবনা তথাকথিত ধার্মিকেরা যদি ভাবত তাহলে গোটা সমাজ ব্যাবস্থায় বদলে যেত। নারীদের কে এখন ও আদৌ মানুষ বলে কী গন্য করা হয় অনেক ক্ষেত্রে? পরিবর্তব ঘটছে কিছু ক্ষেত্রের পটভূমিকায়,
কিন্তু বেশির ভাগই এখনও অবস্থান যে তিমিরে ছিল সেই সেখানেই আছে। কেবল ভাব আর ভাষার বদল হয়েছে। এখনকার ভাব ভাষা আধুনিক আগেকার ভাষা পৌরানিক।
দারুণ লেখাটা শেষ হয়ে গেলো 🙁
আরো এমন লেখা আপনার কাছে দাবি রইল। ধন্যবাদ (F)
@আফরোজা আলম,
আপা, গোয়াল তো গোয়ালই ! কোনটায় দেশি গরু বাঁধবেন, কোনটায় অস্ট্রলিয়ান গরু, কোনটায় আবার সিন্ধি গরু। হয়তো কোথাও ছাগল বা ভেড়া বা অন্যকিছুও বাঁধতে পারেন। এটুকুই তফাৎ !
মানুষ হতে হলে এই গোয়ালের বাইরে এসে নিজেকে জানান দেয়া ছাড়া গতি আছে কি ? তাই গোয়ালমুক্তির গান তো গেয়ে যেতেই হবে !!
মুক্তমনায় আপনার এই লেখাটি গুরুত্তপূর্ণ রেফারেন্স হিসেবে লেখকদের কাজে লাগবে। অনেক অজানা বিষয় জানলাম, শিখলাম, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ দাদা।
না দেবেনা। তাই তো নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে, ছিনিয়ে নিতে হবে অধিকার, দেখিয়ে দিতে হবে তারা পুরুষের কল্পিত নারী নয় তারা মানুষ।
@আকাশ মালিক,
সহমত আপনার সাথে।
মধু মধু।
রণদীপম দা আপনাকে এরকম একটা অসাধারন তথ্য বহুল সিরিজ এর জন্য অনেক ধন্যবাদ।
যেহেতু আপনি অনেক পুরানো হিন্দু বিবাহ আইন নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন, আমি আপনাকে আধুনিক হিন্দু বিবাহ নিয়ে একটি প্রশ্ন করতে চাই। আমার অনেক হিন্দু বন্ধু বিয়ে করেছে, কিন্তু তারা নাকি মুসলিমরা যেরকম কাজি দিয়ে বিয়ে হলেও সাক্ষী সহ সাইন করে, এরকম নাকি সাইন করে না! এটা কি সত্যি? এজন্য নাকি হিন্দু মেয়েদের তালাক চাইতে সমস্যা হয়। মুসলিম বিবাহ কাবিননামায় অনেকগুলো অনুচ্ছেদ আছে, তার মধ্যে ১৮(ক) মনে হয় মেয়েদের সরাসরি তালাক দেবার অধিকার দেয়, যদি বিবাহ পড়ানোর সময় এরকম উভয় পক্ষে সাক্ষ্য হয়ে থাকে। হিন্দুদের কি আলাদা কাবিননামা? বা খ্রিস্টান্দের? আমি আশা করি প্রশ্নটা পরিস্কার করে বুঝাতে পেরেছি। জানি না আপনি বাংলাদেশের বিবাহ আইন জানেন কিনা, কিন্তু ভাবলাম আপনাকে জিজ্ঞেস করি।
যদি হিন্দুদের ও আইন অনুযায়ী বিবাহ রেজিস্ট্রি করার নিয়ম থাকে, তাহলে কেন শিক্ষিত হিন্দু মেয়েরা এটা জানে না? বিবাহ রেজিস্ট্রি কি বাধ্যতামূলক নয়? আমি মনে হয় মনু থেকে বেশি দূরে চলে গেছি। :p
@নির্মিতব্য,
আমি আজ পর্যন্ত যত হিন্দু বিয়ে দেখেছি তাতে কখনোই রেজিস্টার করে বিয়ে হয় নি। যখন দরকার হয় তখন আলাদা ভাবে ম্যরেজ সার্টিফিকেট নিতে দেখেছি।তবে সেটা বিয়ের পর কখনোই বিয়ের সময় না। আমি নিশ্চিত নই কিন্তু মনে হয় না যে হিন্দু বিবাহে রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামুলক বাংলাদেশে।
@নির্মিতব্য,
চমৎকার একটা প্রশ্ন করলেন। আপনার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছি।
আইনের ছাত্ররা পারসোনাল ল’তে বিষয়টা জানার সুযোগ পান, যদিও সাধারণ্যে এটা অস্পষ্ট। পারসোনাল ল’র বিবাহ বিষয়ক প্রথম কথাটাই হলো- মুসলিম আইনে বিবাহ একটা চুক্তি, হিন্দু আইনে বিবাহ একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ফলে যেকোন চুক্তির নিয়ম মেনে মুসলিম বিয়েতে চুক্তির যাবতীয় শর্তাবলী উল্লেখপূর্বক উভয় পক্ষকে সাক্ষির উপস্থিতিতে স্বাক্ষর করেই চুক্তি সম্পন্ন করতে হয়। চুক্তির কোথাও ভঙ্গ হলে শর্তানুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থাগুলোও গৃহিত হওয়ার পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু হিন্দু বিয়ে যেহেতু ধর্মীয় অনুষ্ঠান, তাই সেখানে অগ্নি সাক্ষি রেখে মন্ত্রোচ্চারণ করে ধর্মীয় যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পন্নের মাধ্যমেই ধাপে ধাপে বিয়ে সম্পন্ন করতে হয়, যা এই পোস্টেও এর নমুনা আঁচ করতে পেরেছেন বলে ধারণা করি। ফলে ধর্মানুষ্ঠানে স্বাক্ষরের বিষয়টাও প্রযোজ্য নয়।
মুসলিম আইনে যেহেতু বিয়ে একটি চুক্তি, তাই চুক্তি বাতিলেরও বিষয় থাকে, যাকে প্রেক্ষিত বিবেচনায় তালাক নামে অভিহিত করা হচ্ছে। কিন্তু হিন্দু আইনে এটা অত্যাবশ্যকীয় ধর্মানুষ্ঠান বলেই এ আইনে বলা হয়- বিয়ের মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রীর অস্তিত্ব একাত্ম হয়ে যায় অর্থাৎ অস্থির সাথে অস্থি, মজ্জার সাথে মজ্জা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। ফলে ধর্মীয় দৃষ্টিতে আলাদা হবার আর কোন উপায় থাকে না। তাই বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়টি হিন্দু সমাজে প্রযোজ্য হয় না। এই সিরিজ থেকেই ধারণা করতে পেরেছেন বোধয়, স্বামী তার বিয়ে করা স্ত্রীটিকে পরিত্যাগ করলেও স্ত্রীর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তার স্ত্রীত্ব তাকে ত্যাগ করে না। এ বড় ভয়ঙ্কর বিধান !! সাধে কি আর মনুশাস্ত্রকে বর্ণবাদী কালো আইন বলছি !!
এবার ভিন্ন প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোর্ট ম্যারেজের বিষয়টা আলোচনা করি। এক্ষেত্রে সরাসরি নিজের অভিজ্ঞতাই শেয়ার করা যাক।
আমারই পছন্দ করা কন্যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হলো। বাগড়া বাঁধলো যখন বললাম যে আমি ধর্মীয় পদ্ধতিতে বিয়ে করবো না। কেননা এসব প্রচলিত ধর্মেকর্মে আমার বিশ্বাস শূন্য। আর যা বিশ্বাস করি না তা আমি পালন করতে পারবো না। যা বিশ্বাস করি না তা পালন করার মাধ্যমে একটা ভণ্ডামির মধ্যে দিয়ে আমি যুগল জীবন শুরু করতে আগ্রহী নই। আমার তখনকার পুলিশ অফিসার বাবা (বর্তমানে প্রয়াত) তাঁর পুলিশি মেজাজে সরাসরি এই বিয়েটাই বাতিল করে দিলেন। কিন্তু তিনি ভুল করলেন সেখানে যে, তাঁর ওই মেজাজি রক্ত আমার শরীরেও বইছে। তাঁর পুলিশি আয়ে ধর্ম কোন বাধার সৃষ্টি করে না, কেবল আমার বিয়েতে এটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে এটা আমার দ্বারা মানা সম্ভব ছিলো না। ফলে যা হবার তা-ই হলো। পিতৃহারা কনের বড় ভগ্নিপতি (এককালে সিলেটের ডাকসাইটে সাংবাদিক এখন বৃটেন প্রবাসী) আমাকে সহযোগিতা করলেন কনেপক্ষকে রেজিস্ট্রি বিয়েতে রাজী করাতে।
নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বিয়ের দলিল তৈরি হলো। সাক্ষি হিসেবে কন্যার আত্মীয়স্বজন ছিলো। তবে আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের সায় থাকলেও উপস্থিত ছিলো না। কাগজে স্বাক্ষর করতে গিয়ে দেখি ওখানে লেখা- আমি অমুক পিতা অমুক… কন্যা অমুক পিতা অমুক…কে হিন্দু ধর্ম ও আইন মোতাবেক স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলাম। অনুরূপ কথাবার্তা কন্যার দলিলেও লেখা। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম ! হিন্দু ধর্ম ও আইন মানে !! উকিল বললেন- এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় আইন বলতে হিন্দু আইন মুসলিম আইন ইত্যাদি। অর্থাৎ আমি যা-ই করি না কেন, রাষ্ট্র আমাকে সেই গোয়ালেই ঢুকিয়ে দিলো দলিলপত্রে। অর্থাৎ আমার উত্তরাধিকার তথা সবকিছুই সেই হিন্দু আইন মোতাবেকই চলবে। ঘুরেফিরে সেই মনুসংহিতা !!
অতএব এবার বলেন, আমি কি বোঝাতে পারলাম কিছু ?
@রণদীপম বসু,
আপনার আন্তরিক উত্তর থেকে অনেক কিছু জানলাম। কিন্তু এটা কি দুঃখজনক যে একটা দেশের বিবাহ আইন পর্যন্ত ধর্ম দাড়া নিয়ন্ত্রিত। আপনি নিজে পরিবারের সাথে যুদ্ধ পর্যন্ত করলেন এই ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে থাকতে, কিন্তু রাষ্ট্র আপনাকে হতাশ করলো। আমার এক ইরানী মেয়ে বন্ধু বলেছিল, যে সে কখনো ইরানে ভিতরে বিয়ে করবে না, কারন ইরানের আইন তাকে কোনো বিবাহে, বিবাহুত্তর অধিকারই দেয় না। আমি খুব দুঃখিত হয়েছিলাম শুনে, কিন্তু আমাদের দেশের (মুস্লিম) বিবাহ আইনও মেয়েদের সম্মান দায় না। ঐ যে ১৮(ক) অনুচ্ছেদের কথা বললাম, চিন্তা করেন একটা মুসলিম পরিবারে বড় হওয়া একটা মেয়ে, যাকে কোন দিনও বাবা, মা পরিবার, সমাজ কারো কাছে ছোট হতে হয় নি, সে বিয়ে করার কাবিননামায় ১৮(ক) তে স্বামী এর কাছে অধিকার নিচ্ছে যাতে তাকে তালাক দেবার অনুমতি দেওয়া হয়।রাষ্ট্র নারীকে নারীর স্থান দেখিয়ে দিল। বাবা ছিল অভিভাবক, এখন স্বামী। স্বামীর অভিভাবক কে? ঘুরেফিরে সেই মনুসংহিতা!!!
অসাধারণ এই সিরিজটার জন্য রণদীপমদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। রেফারেন্সের জন্য চমৎকার এই সিরিজটা ব্যবহার করা যাবে। হিন্দুধর্মে নারীর অবস্থান নিয়ে এমন বিস্তারিত লেখা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল।
কৌস্তুভের সাথে সহমত। সিরিজটি একত্রিত করে ই-বুক হিশেবে প্রকাশ করা হোক।
@অবর্ণন রাইমস,
অনেক ধন্যবাদ। এককালে মনুসংহিতা নিয়ে নেটে সার্চ দিয়ে বাংলায় একটা অক্ষরও পাই নি। তখন থেকেই মাথায় ভূত চেপেছিলো যে অন্তর্জালে রেফারেন্স রাখতে হবে। এরই প্রথম পদক্ষেপ ছিলো মুক্তমনায় ‘অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং একজন বাবাসাহেব’ শিরোনামের আটপর্বের সিরিজটি। এবার নারী বিষয়ক সিরিজটি দিয়ে তা সম্পন্ন করতে পেরেছি বলে ভালো লাগছে।
আর ই-বুকের ব্যাপারে কৌস্তুভের মন্তব্যের উত্তরে সাময়িক দ্বিধার কারণটা জানিয়েছি। দেখা যাক্ কী করা যায় !!
সময়ের অভাবে নিয়মিত মুক্তমনা দেখা হয় না। তবুও যেহেতু শেষ পর্ব তাই লিখতে হচ্ছে–
আপনার লেখা অপূর্ব হয়েছে–হিন্দু ধর্মের আঁতুড়ের খবর জানা গেল।
আশ্চর্য্যের ব্যাপার—ইসলামের শরিয়া আইনে নারীদের যেইভাবে দেখানো হয়েছে—তার সাথে এই হিন্দু শরিয়ার বিস্ময়কর মিল। যেহেতু হিন্দু ধর্ম ইসলামের অনেক আগেই হয়েছে–তাই বুঝা যাচ্ছে নারীদের ব্যাপারে ইসলামী শরিয়া হিন্দুদের থাকে ধার করা। কোথায় যেন পড়েছিলাম প্রাচীন আরবে আসলে হিন্দু ধর্মই চালু ছিল। প্রাচীন আরবের দেব দেবীদের নামের সাথেও ভারতবর্ষের হিন্দু দেব দেবীদের নামের অনেক মিল আছে।
@আবুল কাশেম,
ভুলে গেছেন এই লেখা আমরা ছোট বেলায় ইসলামের ইতিহাসেই পড়েছিলাম- কাবা ঘরে আগে ৩৭০( ভুল হতে পারে) মূর্তি ছিল এবং কুরাইশ বংশ মুর্তি পূজারি ছিল।তাহলে কী দাঁড়ায়, এই যে হিন্দু ধর্মই হচ্ছে
আদি এবং সনাতন ধর্ম। বাংলাদেশের সর্বত্রই মাটি খুড়লে পাওয়া যায় হিন্দু ধর্মের মন্দির। তার মানে মাঝে মাঝেই সন্দেহ হয় আমাদের সব পূর্ব পুরুষ আগে হিন্দু ছিল।
অঃটঃ কেউ মনে আঘাত নিবেন না অনুগ্রহ করে। এই কথা আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে।
@আফরোজা আলম,
কাবা ঘরে ৩৬০ টি মূর্তি ছিল।
@আফরোজা আলম,
বহু প্রজন্ম ধরে আমরা প্রভুভক্ত জনগোষ্ঠী। প্রাচীন বংগদেশের (বাংলাদেশ, পশ্চিমবংগ, আসাম, বিহার ইত্যাদি) অধিবাসীদের এথনোগ্রাফী সম্পর্কে জানলে দেখবেন আমাদের পূর্বপুরুষরা বহু ঘাটের পানি খেয়েছেন। বংগদেশের দূর প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়না; প্রাচীন ভারতীয় কিছু পুথিঁতে এ অন্চলের মানুষরা কুয়া থেকে পানি টানতো, নিরামিষভোজী ছিলো, প্যাগান দেবদেবীতে বিশ্বাস করতো এবং নিরীহ গোবেচারা ছিলো – এ ধরণের কিচু অস্পষ্ট (এবং অবমাননাকর) তথ্য পাওয়া যায়। সপ্তম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে পাল বংশের রাজত্য শুরু হয়। পাল সম্রাটরা অধিবাসীদের বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন – দলেদলে মানুষ নতুন ধর্ম গ্রহণ করে। এরপরে ক্ষমতায় আসে কম্বোজ-পাল সম্রাটরা – এরাও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলো। তারপর, দ্বাদশ শতাব্দীতে পাল বংশ দূর্বল হয়ে পড়লে সাম্রাজ্য বিস্তার করে কর্ণাটকের সেন বংশ। সেন সম্রাটরা কট্টর হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছহিলেন। বলা হয়, সেন বংশের শাসকরা এখানকার অধিবাসীদের জোর পূর্বক হিন্দু ধর্মে কনভার্ট করান – সবাই দলেদলে হিন্দু হয়ে যায়। সেন বংশের কোনো একজন সম্রাট (সম্ভবত: বল্লাল সেন) ঢাকেশ্বরী মন্দির তৈরী করেছিলেন – বাংলাদেশের রাজধানীর নামটি কিন্তু এই বিখ্যাত মন্দির থেকেই এসেছে। সেন সাম্রাজ্য পতনের পরে দেব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, এরাও হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এ পর্যন্ত ইতিহাস জানে না, বা জানলেও বিব্রত বোধ করে। তবে তারপরের কাহিনী সবার জানা – দ্যা মোগল কনকুয়েস্ট অব ইন্ডিয়া। সিলেট দখলের মাধ্যমে বাংলাদেশে মোঘলদের সাম্রাজ্য বিস্তার… ইসলামের আগমণ, অত:পর বংগবাসীর দলেদলে পুনরায় ধর্ম পরিবর্তন।
আমার পরিচিত অনেকেই নিজের ধর্ম ছাড়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। তাদের আমাদের পূর্বপুরুষদের আদি ইতিহাস সম্পর্কে জানিয়ে যখন প্রশ্ন করি, “আপনার প্রপিতামহে কপালে তো দোযখের আগুন ছাড়া আর কিছু নাই, তা সে ব্যাপারে আপনার কি মতামত?” তখন দীর্ঘ নীরবতা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না
আর আরবদের ব্যাপারে আল্লাহ শব্দটির উৎপত্তি কিন্তু exclusively Islamic নয়। পৃ-ইসলামিক আরবরা বহু শতাব্দী ধরেই তাদের প্যাগান ধর্মের সর্বোচ্চ সত্বাকে এই নামটি দ্বারা ডেকে আসছে। একদলের মতে, আল্লাহ শব্দটি হলো প্রাচীন “আল-ইলাহ” শব্দের আধুনিক অপভ্রংশ। এছাড়া, প্রাচীন হিব্রু ভাষায় “এলোআহ” (বহুবচন “এলোহিম”) শব্দটিও ইশ্বরকে বোঝাতে ব্যবহার করা হতো, আরামায়িক ভাষায়ও “আলাহা” শব্দটি ছিলো।
আমরা God/Goddess এবং ভগবান/ভগবতীর বলি। আপনি জেনে অবাক হবেন, প্যাগান আরব ধর্মমতে ইশ্বরেরও নির্দিষ্ট লিংগ ছিলো। “Ilah” শব্দের “Ilu” অংশটির প্রাচীন (প্রোটো-সেমিটিক) অর্থ হলো sky God। আল-ইলাহ বা আল্লাহ ছিলেন moon God; প্রোটো-সেমিটিক pantheon-এর সবচাইতে ক্ষমতাধর God ছিলেন তিনি এবং তাঁর বিবাহ হয়েছিলো sun Goddess-এর সাথে (এই গডেস-এর নাম অবশ্য জানিনা neutral)। রাতের আকাশে যত তারা দেখা যায় সেগুলো তাঁদের সন্তান বলে প্রোটো-সেমিটিক প্যাগানরা বিশ্বাস করতো।
অনেকেই deity শব্দটি উল্লেখ করেছেন – প্রাচীন যুগে আল্লাহ শব্দটি ৩৬০ pagan deity-র প্রধান ঈশ্বরকে নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হতো।
ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও আল্লাহ নামটি পরিবর্তিত হয় নি। তবে নামটি অপরিবর্তিত থাকলেও ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রাচীন ধারণাগুলো আমূল পাল্টেছে। প্যাগান ধর্মগুলোতে বহুঈশ্বরবাদ প্রচলিত ছিলো। আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে (জুডাইজম, খ্রীস্টানিজম, ইসলাম) ঈশ্বর হলেন সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী।
God (noun) সম্পর্কে একটু কনফিউশন হচ্ছে। এই শব্দটির উৎপত্তি হয় ১২ শতকে, শব্দটি প্রাচীন High জার্মানিক ভাষায় প্রথম দেখা যায়। জুডাইজম বা ক্রিসচিয়ানিটির কথা বাদ দিন, এমনকি ইসলাম ধর্মও আবির্ভূত হয়েছে ১৪০০ বছর আগে। বোঝাই যাচ্ছে, God শব্দটি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের ইশ্বরের নাম (প্রপার নাউন) না। সংস্কৃত ঈশ্বর শব্দটি দ্বারা ভগবানকে বোঝানো যায়, আল্লাহকেও বোঝানো যায়, আবার বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, ইহুদী কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মের উপাসিত সত্বাকেও বোঝানো যায়। ইংরেজী ভাষাতে God শব্দটিও তেমনি।
টেকনিকালী, ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী বিবলিকাল গডের নাম হলো YAHWEH (YHWH) – তবে ঈহুদীরা ছাড়া এ নামটি মনে হয় না কেউ ব্যবহার করে, খ্রীস্টানরা তো নয়ই।
কিছু অঞ্চলে আল্লাহ শব্দটিও কিন্তু God/ঈশ্বর সমার্থক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং আরবী খ্রীস্টানরা তাদের ঈশ্বরকে আল্লাহ নামে ডাকে। এই লোকগুলোই আমেরিকা ইউরোপে থাকলে God শব্দটি ব্যবহার করতো। মালয়শিয়ায় গত কয়েক বছর ধরে ব্যাপারটি নিয়ে অনেক রাজনীতি চলছে।
প্রোটো-সেমিটিক ধর্মের deity নিয়ে আলোচনা করেছি, এখানেও আরেকটি ব্যাপার খেয়াল করতে পারেনঃ ইসলামের আবির্ভাবের আগে থেকেই আরব খ্রীস্টানরা আল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করে আসছে। এরা কিন্তু মূর্তি-পূজকও ছিলো না, কোনো moon God-এরও উপাসনা করেনি। ব্যাপারটি বেশ কনফিউজিং।
ইসলামিক অনেক প্রথাই কিন্তু পৌত্তলিক কাল থেকে প্রচলিত ছিলো। প্যাগান আরবরা মক্কার দিকে মুখোমুখি হয়ে তাদের পূজা-উপাসনা করতো। কা’বা শরীফের হাজর’এ আসওয়াদ কালো পাথরটিকে তারাও পবিত্র বলে গণ্য করতো – পাথরে চুম্বন করার নিয়মটি সেকালেও ছিলো। চাঁদের উদয় দেখে তারা বছরের কিছুদিন উপাস থাকতো। অনিষ্টকারী দেবতা/শয়তানের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য তারা পাথর ছুড়তো।
@ডেথনাইট,
চমৎকার মন্তব্য ! এই বিষয়গুলো নিয়ে একটা স্বাস্থ্যবান লেখা কি আপনার কাছ থেকে আমরা আশা করতে পারি ?
@রণদীপম বসু, চেস্টা থাকবে।আসলে ধর্ম ব্যাপারটাই নারীকে শৃঙ্খলিত করার পুরুষবাদী ধারনার ফলাফল।নিওলিথিক পিরিওডে ধর্মের ধারণা এল সেই সাথে এল শ্রেনীবিভাগ।পরবর্তী নদীবিধৌত সভ্যতায় ধর্ম তার নাগপাশ ছড়িয়েছে আর ক্রমান্বয়ে নারীকে করেছে আবদ্ধ।খেয়াল করলেই দেখবেন কোন ধর্মেই গুরু/নবী/সন্ন্যাস পর্যায়ে নারীদের উপস্থিতি নেই।প্রাচীন থেকে বর্তমান সবসময়ই নারীর প্রতি মনোভাব পরস্পর বিরোধী।একাধারে সে দেবী এবং দাসী,সাধ্বী এবং বেশ্যা।
@ডেথনাইট,
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি যখন রাস্ট্র বিজ্ঞানে (সম্মান) নিয়ে পড়তাম, তখন সাবসিডিয়ারি ছিল,
ইসলামের ইতিহাস, এবং সোসিওলোজি। অনেক কিছুই মনে আছে। ইবনে বতুতা , পাল বংশ, থেকে মোঘলদের আগমন, পলাশির যুদ্ধ। তখন দিন সন মুখস্ত করতে এতো বিরক্ত লাগতো :-X
তবে ইতিহাস আমার সব সময় প্রিয় ছিল। তথ্য প্রদানের জন্যে অনেক ধন্যবাদ- 🙂
@আবুল কাশেম, ভাই,
মোড়কের হেরফের কেবল, মাল কিন্তু একই প্রায় ! যেকোন ধর্মেরই বিচিত্রবর্ণের অনুশাসনগুলোর ভেতরগত দর্শনে কিন্তু খুব একটা পার্থক্য নাই !
@রণদীপম বসু,
বিশেষ করে নারীর ব্যাপারে সব ধর্মই তলে তলে একমত। হবেই তো, পুরুষের ঈশ্বর তো আসলে তার লিঙ্গভুক্তই। নিজের লৈঙ্গিক জাতভাইকে কিছু বিশেষ সুবিধা তো দেয়া হবেই। নারীকেই প্রথম এগিয়ে আসতে হবে ও নেতৃত্ব দিতে হবে সমানাধিকারের লড়াইয়ে আর মানবতাবাদী পুরুষ হবে তার সঙ্গী। সুন্দর লেখার জন্য শুভেচ্ছা। (F) (F)
দাদা, এইটা একটা ইবুক হোক। বললে বানিয়ে দিতে পারি।
@কৌস্তুভ, (Y) (Y)
@কৌস্তুভ,
আগ্রহের জন্য শুধু ধন্যবাদ নয়, কৃতজ্ঞতাও। আমার আগ্রহেও ঘাটতি নেই। তবে মুক্তমনায় ‘অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ…’ নামের পূর্বে পোস্টকৃত আট পর্বের সিরিজটা এবং নারী বিষয়ক বর্তমান সিরিজটার প্রয়োজনীয় এডিট করে ‘মনুশাস্ত্রে নারী ও ব্রাহ্মণ্যবাদ’ নামে একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি কেবল হস্তান্তর করলাম শুদ্ধস্বর প্রকাশনাকে। সেদিক থেকে প্রকাশকের ব্যবসায়িক বা নৈতিক বা আইনগত কোন সমস্যা আছে কিনা তা তো বলতে পারছি না ! তা না জেনে মতামত দেয়াটা উচিৎ হবে কি ?
@লেখক,
আপনার তথ্যসুত্রে যে সব বই এর নাম দিয়েছেন তা কোথায় পাওয়া যাবে বললে খুবই সুবিধা হত। সবচেয়ে ভাল হত যদি নেটে পাওয়া যেত।
আর নারীদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিষয়টি ছোট বেলা থেকে জেনে আসলেও তেমন করে কখনো ভাবি নি।ধন্যবাদ আমাদের চিন্তার খোরাক যোগান দেয়ার জন্য।
@আধ্যাত্মিক,
”মনুসংহিতা /সম্পাদনা ড. মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী” বইটি আজিজ মার্কেটে পাবেন। ”অবমুক্ত গদ্যরেখা /রণদীপম বসু /প্রথম প্রকাশ, শুদ্ধস্বর” এটাসহ অন্যগুলোও পাওয়ার সম্ভানা রয়েছে একই জায়াগায়।
@আধ্যাত্মিক,
আপনার আগ্রহকে সম্মান জানিয়েই বলি, নেটে এর কোনটাই পাওয়া যাবে না বা যাওয়ার কথাও নয়। তবে বইগুলো পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজি মামুন ভাই বলেছেন। মনুসংহিতা আর বেদের সবগুলো খণ্ড আজিজে পাবেন না বলেই মনে হয়। কাটাবনের কনকর্ড টাওয়ারের পুস্তক পল্লীতে ‘মধ্যমা’ নামের চমৎকার একটা নতুন বুকস্টলে আজই দেখে এলাম এগুলো সেখানে। যদিও আমার এ বইগুলোসহ ধর্ম ও দর্শনের আরো অনেক বই কালেকশন করতে হয়েছিলো দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন সময়ে।
প্রথমেই দশ পর্বের একটা অনবদ্য সিরিজ উপহার দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ রণদীপমদাকে! আপনার লেখা নারীর পরাধীনতায় ধর্মের মৌলিক ও অগ্রগন্য ভূমিকাকেই শুধু ব্যাখ্যা করেনি, সাথে প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অনেক প্রাসঙ্গিক ছবিও! ইতিহাসের পাঠকদের জন্য সংগ্রহে রাখার মত একটা সিরিজ এটি!
ভার্ষা বা দাস যে অধম তা বোঝা গেল। কিন্তু পুত্র কেন অধম, তা বুঝতে পারিনি।
ধর্মশাস্ত্র সৃষ্টির পূর্বের নারীরা তাহলে ভাল অবস্থায় ছিল? বিপ্লবদা (বিপ্লব পাল) তার ‘স্বামী বিবেকানন্দ-একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ’ শিরোনামের লেখাটিতে ”Why men rule- A theory of male dominance : Stefan Goldberg” এই তথ্যসূত্র ব্যবহার করে বলেছেন, নারীবাদের উত্থান মূলত শিল্প বিপ্লবের সাথে এবং শিশুমৃত্যু হার কম হওয়ার সাথে সাথে। তিনি একটি লিংকও দিয়েছেন।
আপনার আজকের লেখার সেরা লাইন! এই জগত এতটাই সুপ্ত রয়েছে যে, স্বয়ং নারীরা পর্যন্ত এখন আর তার দরজা খুলতে চাইছে না (অবশ্যই সব নারীর কথা বলা হচ্ছে না এখানে; ফ্রান্সের মুসলিম নারীদের বোরকা পড়ার আন্দোলনের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা)।
সহমত।
@কাজি মামুন, আপনার দুর্দান্ত মন্তব্যগুলো আমাকে প্রেরণা যুগিয়ে গেছে। অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি আপনাকে।
আর সাথে অনেক অনেক ধন্যবাদ।