( নবম পর্বের পর…)

করুণার ধন স্ত্রীধন
পিতৃসম্পদে নারীর কোন উত্তরাধিকার নেই। কিন্তু যে ধনটুকুতে নারীর অধিকার স্বীকৃত তা হচ্ছে স্ত্রীধন। তবে এটা এমনই ধন যা নারীর প্রতি করুণার ধনই বলা যায়। মনুশাস্ত্রে ছয় ধরনের স্ত্রীধনের উল্লেখ রয়েছে, যা বণ্টনেও জটিলতা রয়েছে-

‘অধ্যগ্ন্যধ্যাবাহনিকং দত্তঞ্চ প্রীতিকর্মণি।
ভ্রাতৃমাতৃপিতৃপ্রাপ্তং ষড়বিধং স্ত্রীধনং স্মৃতম্।।’
স্ত্রীধন ছয় প্রকার- অধ্যাগ্নি, অধ্যাবাহনিক, প্রীতিদত্ত, ভ্রাতৃদত্ত, মাতৃদত্ত ও পিতৃদত্ত। অধ্যাগ্নি-স্ত্রীধন হলো বিবাহকালে পিতাপ্রভৃতিদের দ্বারা দত্ত ধন, অধ্যাবাহনিক ধন হলো পিতৃগৃহ থেকে পতিগৃহে নিয়ে আসার সময় যে ধন লব্ধ হয়, প্রীতিদত্ত ধন হলো রতিকালে বা অন্যসময় পতি কর্তৃক প্রীতিপূর্বক যে ধন স্ত্রীকে প্রদত্ত হয়। (৯/১৯৪)।

এই স্ত্রীধনের মালিক স্ত্রী হলেও সামাজিক বাস্তবতা হচ্ছে তা সাধারণভাবে স্বামীর রক্ষণাবেক্ষণেই থাকে এবং প্রকৃতপক্ষে স্বামীই তা ভোগ করে। যদিও তা ভোগ করার ক্ষেত্রে স্ত্রীর অনুমতি নেয়ার নৈতিক দায়িত্ব থাকে, বাস্তবে তা পালিত হয় না।
এই স্ত্রীধন রেখে স্ত্রীর মৃত্যু হলে তা বণ্টনেরও একটি নির্দেশিকা রয়েছে-

‘অন্বাধেয়ঞ্চ যদ্দত্তং পত্যা প্রীতেন চৈব যৎ।
পত্যৌ জীবতি বৃত্তায়াঃ প্রজায়াস্তদ্ধনং ভবেৎ।।’
বিবাহের পর পিতা, মাতা, স্বামী, পিতৃ-কুল এবং ভর্তৃকুল থেকে লব্ধ যে ধন তাকে সাধারণভাবে ‘অন্বাধেয়’ বলা হয়। স্ত্রীলোকের ‘অন্বাধেয়’ ধন এবং তার পতিকর্তৃক তাকে প্রীতিপূর্বক প্রদত্ত যে ধন তা-ও স্বামীর জীবদ্দশায় স্ত্রীলোকের মৃত্যু হলে তার সন্তানেরা পাবে। (৯/১৯৫)।

এই সন্তান বলতে এই স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র ও অবিবাহিতা কন্যারা সমান ভাগ প্রাপ্য (৯/১৯২)। আর তার বিবাহিত কন্যার যদি অবিবাহিত কন্যা অর্থাৎ অবিবাহিতা দৌহিত্রী থাকে তাদেরও মাতামহীর ধন থেকে কিছু কিছু অংশ দিয়ে সম্মানিত ও সন্তুষ্ট রাখতে (৯/১৯৩) বলা হয়েছে। কিন্তু নিঃসন্তান অবস্থায় স্ত্রীধন রেখে কোন স্ত্রীলোক মারা গেলে-

‘ব্রাহ্মদৈবার্ষগান্ধর্বপ্রাজাপত্যেষু যদ্বসু।
অপ্রজায়ামতীতায়াং ভর্তুরেব তদিষ্যতে।।’
ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, গান্ধর্ব ও প্রাজাপাত্য- এই পাঁচপ্রকার বিবাহে লব্ধ যে স্ত্রীধন, তার সবই কোনও স্ত্রীলোক নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তার স্বামীই পাবে। (৯/১৯৬)।
.
‘যৎ তস্যাঃ স্যাদ্ধনং দত্তং বিবাহেষ্বাসুরাদিষু।
অপ্রজায়ামতীতায়াং মাতাপিত্রোস্তদিষ্যতে।।’
আসুর, রাক্ষস ও পৈশাচ- এই তিন প্রকার বিবাহে লব্ধ যে স্ত্রীধন, তা রেখে কোনও স্ত্রীলোক যদি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যায় তাহলে ঐ ধনে ঐ স্ত্রীর মাতার প্রথম অধিকার, কিন্তু মাতার মৃত্যু হলে পিতা অধিকারী হয়। (৯/১৯৭)।

মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক উত্তরাধিকারে নারীর কোন অধিকার না থাকায় এই করুণালব্ধ স্ত্রীধন যে আসলে একধরনের ভিক্ষালব্ধ ধনই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সামাজিক বাস্তবতা হচ্ছে, এই সামান্য ধনও আসলে স্ত্রী ভোগ করে যেতে পারে না। এজন্যেই হয়তো মৃত্যুপরবর্তী তা বণ্টনের নির্দেশনা মনুশাস্ত্রে দেখা যায়। তাছাড়া স্মৃতিশাস্ত্র নির্দেশিত বিধানে স্ত্রীর কোন আলাদা সত্তাই থাকে না-

‘ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ ত্রয় এবাধনাঃ স্মৃতাঃ।
যত্তে সমধিগচ্ছন্তি যস্য তে তস্য তদ্ ধনম্।।’
স্মৃতিকারগণের মতে, ভার্যা, পুত্র ও দাস- এরা তিনজনই অধম (বিকল্পপাঠ- অধন); এরা তিনজনেই যা কিছু অর্থ উপার্জন করবে, তাতে এদের কোনও স্বাতন্ত্র্য থাকবে না, পরন্তু এরা যার অধীন ঐ ধন তারই হবে। (৮/৪১৬)।

অতএব, চূড়ান্ত বিচারে নারী কোন ধন-সম্পদেরই অধিকারী হতে পারে না। কেননা সে নিজেই ভোগ্যা, পিতৃতন্ত্রের উপাদেয় ভোগ-সামগ্রি। ব্যবহার্য ধন সে অন্যের ব্যবহার্য ধন মাত্র, কিছুতেই নিজেরও নয়। এবং এভাবেই পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার বলয়ে কুক্ষিগত নারী শেষপর্যন্ত নারীই থেকে যায়, মানুষ হতে পারে না।
.
অতঃপর নারী অধিকার ও সামাজিক প্রেক্ষিত
সমাজের অনিবার্য অংশ হয়েও যৌক্তিক সামাজিক ক্ষমতার অধিকার থেকে যাবতীয় নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারীকে বিতাড়ণের গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছে পুরুষ তার পিতৃতান্ত্রিক হাতিয়ার তথা ধর্মশাস্ত্র নাম দিয়ে কতকগুলো বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক শাসনতান্ত্রিক অনুশাসন সৃষ্টির মাধ্যমে। আর এই ধর্মসৃষ্টির হোতা যে পুরুষই, এসব ধর্মশাস্ত্রে কথিত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্রষ্টার পুরুষপ্রকৃতি এবং নারীকে পুরুষকর্তৃক ভোগ-ব্যবহারের উদগ্র প্রকাশই এর প্রমাণ। কোন অলৌকিক ঈশ্বরের চিন্তারাজিতে তাঁর সৃষ্টি বিষয়ক বিষয়বস্তু নিয়ে এতোটা অরুচিকর অবনমন ও বৈষম্য অচিন্তনীয়। বৈদিক ধর্মে মনুসংহিতা হচ্ছে এর উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এবং পরবর্তীকালের সৃষ্ট ও প্রচলিত অন্য ধর্মকাঠামোগুলোও মনে হয় তারই আরেকটু উৎকর্ষ ও বিবর্তিত প্রতিরূপ মাত্র। এর মাধ্যমেই তথাকথিত ধর্মশাস্ত্র সৃষ্টির পূর্বের নারী আর পরবর্তীকালের ধর্মপ্রবাহে নারীর অবস্থার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায় শাস্ত্র-নির্দেশিত অনুশাসনগুলোর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে। অর্থাৎ পরবর্তীকালের এই নারী সম্পূর্ণই পুরুষের ইচ্ছার প্রতীক এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজসৃষ্ট, যাকে মনুসংহিতার মতো কথিত শাস্ত্রগ্রন্থগুলোর মাধ্যমে বৈধরূপে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই নারীর প্রকৃত অন্তর্জগত আর পুরুষসৃষ্ট এই সামাজিক নারীতে আরোপিত জগত কখনোই এক নয়। পুরুষের ক্ষমতার বলয়ে বন্দী নারীর নিজস্ব ঐ জগতটা শেষপর্যন্ত একান্ত গোপন ও সুপ্তই রয়ে গেছে। তাকে কখনোই বাইরে আসতে দেয়নি পুরুষ, সেই জগতটিকে অস্বীকারের মাধ্যমে। আর যে আক্রান্ত নারীটিকে ইচ্ছার বর্বরতা দিয়ে নিজের মতো করে সাজিয়েছে পুরুষ, সেটাই বহিঃবাস্তবের সামাজিক নারী। এ নারী আসলে এক কল্পিত নারীই, যে কিনা পুরুষের অসভ্য মনের মাধুরি মেশানো প্রতিকৃতি। তাই নারীর মুক্তি মানে এই অসভ্য ক্ষমতার কবল থেকে মানবিক নারীসত্তার মুক্তি। অবগুণ্ঠিত অন্তর্জগতের ঘেরাটোপ থেকে মানুষ হিসেবে বাইরে বেরিয়ে আসার অধিকারই নারী-অধিকার। যেখানে সে তার মুক্তির আনন্দে নারী থেকে মানুষ হয়ে ওঠবে। কিন্তু মানবিক বোধ বর্জিত পিতৃতন্ত্র কি কখনো হতে দেবে তা ?
.
পিতৃতন্ত্রের সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি হচ্ছে তার ধর্মজাগতিকতা, কাল্পনিক ঐশিকতায় অপ্রমাণিত এক পারলৌকিক জগত তৈরি করে যেখান থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের শাসনতান্ত্রিক সুতোটাকে ধরে রেখেছে। এটাই তার ক্ষমতার উৎস, যা সে নিজেই সৃষ্টি করেছে। এবং এই ক্ষমতাই তার অস্তিত্ব। এখানে সামান্য আঁচরটুকু পড়তে গেলেই, কিংবা সামান্যতম আঁচর লাগার কোন কল্পিত সম্ভাবনা তৈরি হলেও সে মারমুখি হয়ে ওঠে। দেশীয় প্রেক্ষাপটে বা বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় গোষ্ঠিগুলোর উগ্রবাদী ক্রিয়াকলাপ এই রেশই বহন করছে। অতএব, নারী-পুরুষের সমতা বিধান তথা সার্বিক সামাজিক মঙ্গলবিধানের উপায় খুঁজতে হলে এক চিরায়ত মানবতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়ার গত্যন্তর নেই বলেই মনে হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সেই কল্যাণমূলক ক্ষমতায় উন্নীত করতে হবে, যাতে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মানবিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের উপর নিবর্তনমূলক সবধরনের ধর্মীয় কুশাসন রাষ্ট্রীক ও সামাজিকভাবেই রদ করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এজন্যে প্রথমেই দরকার রাষ্ট্র কর্তৃক সব ধরনের ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা। ধর্ম যে আসলে কোন অলৌকিক বস্তু বা ধারণা নয়, তা মানুষেরই সৃষ্টি এবং সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক পুরুষতান্ত্রিক বৈষম্যমূলক কূটভাবনার আর্থ-সামাজিক রূপই যে ধর্ম, এই বিজ্ঞান চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে মুক্তচিন্তাকে শানিয়ে তোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতে হবে রাষ্ট্রকেই। আর এই উদ্যোগ নিতে হবে মুক্ত-চেতনায় বিশ্বাসী জনগোষ্ঠিকেই।
.
এ প্রেক্ষিতে একটা বিষয় অনুধাবনযোগ্য যে, প্রচলিত ধর্মশাস্ত্রগুলোয় উল্লেখকৃত সামাজিক আবহ আদতে দেড় থেকে দু’হাজার বছর বা তারও আগের সমাজকাঠামোয় সৃষ্ট। মনুসংহিতার নারী প্রতীকগুলোও সেই দু’হাজার বছর আগেরই প্রতিকৃতি। ইতোমধ্যে সমাজ বিকাশের সুদীর্ঘ ধারায় সভ্যতার বহু বহু পরিবর্তন পরিবর্ধন সাধিত হওয়ার ফলে সেইসব শাস্ত্রীয় অনুশাসনের সবগুলো এখন আর সামাজিকভাবে প্রয়োগ করা হয় না বা তা প্রয়োগযোগ্যতায় নেই। এবং কালান্তরে এসে এগুলো অবিকল বা একেবারেই প্রয়োগ না করার কর্তৃত্বে একধরনের অধিকারবোধও রাষ্ট্রকাঠামোয় সংযোজিত হয়েছে। রাষ্ট্রের জনচেতনাও সেভাবেই বিকশিত হয়ে গেছে। তাই এমন ধারণা বদ্ধমূল করা মোটেও ঠিক নয় যে, রাষ্ট্র চাইলে সমস্ত ধর্মজাগতিকতাকে সরিয়ে তার জনমত প্রভাবিত করে কোন জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে না। রাষ্ট্র চাইলে অবশ্যই তা পারে। এজন্যেই ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। এ প্রেক্ষিতে যেকোন ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেই বর্জনের সপক্ষে মানবিক চেতনাসম্পন্ন নাগরিকদের একাট্টা হওয়া জরুরি। তার জন্যে দরকার মুক্তচিন্তা প্রকাশের অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা। এটা নিশ্চিত করা না গেলে বাকি অর্জনগুলোও সুদূরপরাহতই থেকে যাবে। এবং নারীর অধিকার একটা অধরা কাল্পনিক বিষয় হয়েই থাকবে।
.
অতএব, যে মাতৃ-নারীর গর্ভ থেকে উৎপন্ন পুরুষ, আমৃত্যু মঙ্গলকামী সুহৃদ হিসেবে যে প্রিয়তমাকে সাথে নিয়ে গোটা জীবন পারি দেয় পুরুষ, এবং যে অপত্যস্নেহে কন্যাশিশুটির নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে পিতৃবাৎসল্যে ঝলমল করে ওঠতে পারে একজন পুরুষ, সেই নারীকে কোন মানবিক পুরুষ নিজের মতো মানুষ হিসেবে ভাবতে না পারার কোন কারণ কি থাকতে পারে ! যে পুরুষ তা ভাবতে পারে না, সে মানুষ হতে পারে না। আর মানুষ হতে না-পারা অমানুষের জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী এবং মানুষের স্বপ্নময় জীবন নষ্ট হয়ে যাবে, তা কি আদৌ কাম্য কারো ?

[১ম পর্ব ] [২য় পর্ব ] [৩য় পর্ব] [৪র্থ পর্ব] [৫ম পর্ব ] [৬ষ্ঠ পর্ব] [৭ম পর্ব] [৮ম পর্ব ] [৯ম পর্ব] [শেষ * ]

তথ্য সহায়তা:
১. ঋগ্বেদ-সংহিতা /অনুবাদ রমেশচন্দ্র দত্ত /প্রথম প্রকাশ, জুন ১৯৭৬, কলকাতা।
২. মনুসংহিতা /সম্পাদনা ড. মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী /সুলভ সংস্করণ, বইমেলা ১৪১২, কলকাতা।
৩. ভারতীয় দর্শন /দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় /পঞ্চম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০০৭, কলকাতা।
৪. ভারতীয় শাস্ত্রে নারীকথা /সিরাজ সালেকীন /প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১০, ঢাকা।
৫. অবমুক্ত গদ্যরেখা /রণদীপম বসু /প্রথম প্রকাশ, শুদ্ধস্বর, ফেব্রুয়ারি ২০১১, ঢাকা।