( মিঃ বিশ্বাসদের ঘরবাড়ি নাই বলিয়া অভিমত দিয়াছিলেন নোবল বিজয়ী সাহিত্যিক ভি এস নাইপল।ভদ্রলোক উপন্যাসে যাহা বুঝাইতে চাহিয়াছিলেন তাহা কতখানি যৌক্তিক তাহা বোদ্ধা শ্রেণীরা নির্ণয় করিতে পারিবেন।তবে আমরা যাহারা অধুনা ব্রক্ষান্ডের বংগদেশে বাস করিতেছি তাহারা ইহার মর্ম যে হাড়ে হাড়ে টের পাইতেছি তাহা হলফ করিয়া বলিয়া দেওয়া যায়।অধিকন্তু যাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িতেছে তাহারা ব্যাপারটা শিরায় শিরায় উপভোগ করিতেছে বলিয়া বোধ হইতেছে। তবে প্রত্যেক ইউনিভার্সিটির নিজস্ব যন্ত্রণার ধরণ আছে বলিয়া শুনিয়াছি। সেই হেতু নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কিঞ্চিত বিবরণ পেশ করিলাম। বাকিটা বিরতি সহকারে প্রকাশ হইবে। একটা কথা বলিয়া রাখা ভালো আমরা যাহার ভুক্তভোগী তাহারা ঐ হতভাগা মিঃ বিশ্বাসের মতনই দৌড়ের উপর আছি)

বিশ্বাস-১

ঠিক প্রথম দিনই ফ্যাসাদে পড়িলাম। হলে উঠিয়া দেখি শুধু টুপি আর টুপির ছড়াছড়ি। ব্যাপার কী! বেশ খানিকক্ষণ পর জানা গেল কোনো এক ধর্মীয় প্রভাবশালী সংগঠনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হইবে। সকলেই যোগ দিতে যাইতেছে।আমাকেও যাইতে হইবে। না গেলে চিহ্নিত হইয়া থাকিব। প্রথম আসিয়াই কাহাকেও বৃদ্ধাংগুলি দেখাইবার সাহস হইল না। গেলাম।

অনুষ্ঠান শুরু হইল। হলের মসজিদের ইমাম সাহেব-যিনি কিনা ওই প্রভাবশালী সংগঠনের সদস্য-দোয়া দরুদ পড়িলেন। তাহার পর হাজির করা হইল একজন সুদর্শন তরুণকে। তরুণটি কোনো এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। উপরন্তু ঐ সংগঠনের উপরের দিককার নেতা। যিনি তাহাকে আমাদিগের সহিত পরিচয় করাইয়া দিলেন তাহার কথায় জানা গেল তরুণটি খুবই মেধাবী- কিংবা সম্ভবত ঐ সংগঠনের সাথে জড়িত বলিয়াই খুব মেধাবী হইতে পারিয়াছিলেন-এবং অন্তঃপ্রাণ মুসলিম। আমরা বসিয়া বসিয়া ঐ ঝকঝকে তরুণ সুদর্শন এবং একই সাথে অন্তঃপ্রাণ মুসলিমের কথা আধঘন্টা ধরিয়া শুনিলাম। অনেকেই আপ্লুত হইয়া গেল। মিলাদ হইল। খাবার আসিবার পর আমাদিগের মধ্যকার কেউ কেউ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলিল-এইখানেই, এই সংগঠনেই যোগ দিতে হইবে। অন্যথায় ক্যারিয়ার কিংবা আল্লাহর পথে যাওয়া অনিশ্চিত ও অসম্ভব হইয়া পড়িবে।

রাত্রিবেলা খাবার খাইয়া যখন আমরা আরাম করিতেছিলাম আবারো ওরা আসিয়া গেল। আমাদিগকে নিয়া গেল অতীব পরিপাটি করিয়া সাজানো হলের গেস্ট রুমে। এইস্থান হইতেই পরিচালনা করা হয় হলভিত্তিক দাওয়াতী কার্যক্রম। আমাদের শোনানো হইল নানারকম অলৌকিক কাহিনী। এবং তাহারপর আমাদিগকে অত্যাশ্চর্য করিয়া দিয়া বলা হইল নীল আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন চন্দ্রে গিয়া শুনিতে পাইয়াছেন আযানের ধ্বনি; দেখিয়া আসিয়াছেন চঁন্দ্র দুই টুকরো হইয়া আছে আর ওইস্থানে বড় বড় পাথরে খোদাই করা হইয়াছে কিছু আরবী শ্লোক। যাহারা বিকালের অধিবেশনে দোটানায় পড়িয়া গিয়াছিল তাহারা এইবার ঠিক ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়া ফেলিল এইরূপ সংগঠনের লাগিয়া জান দিয়া ও ফেলিয়া দেওয়া যায়। ইসলামের মহিমা উহাদের মধ্য দিয়াই প্রজ্জ্বলিত হইয়া আকাশ বাতাসে ভাসিয়া বেড়াইবে। উহাদের শক্তিমত্ততার উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হইল এক আতংকজনক পরিসংখ্যানঃ বংগদেশের কেন্দ্রস্থিত যে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রগতিশীল হিসাবে গণ্য করা হয় (ওইস্থানে হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করা হইয়াছিল) তাহা নাকি অসংখ্য ও অগনিত গোপন শহীদি প্রাণের আখড়া হইয়া উঠিতেছে এবং উঠিবে। আমরা ভয় পাইয়া গেলাম। ইসলামী জোসে অনেকেই আপ্লুত হইয়া গেল। কোথায় যেন পড়িয়াছিলাম মিথ্যা তিন প্রকার-মিথ্যা, ডাঁহা মিথ্যা ও পরিসংখ্যান। অসংখ্য গোপন শহীদি প্রাণের পরিসংখ্যান কতখানি সত্যি উহা বোধগম্য হইল না।

বিশ্বাস-২

কিছুদিনের মাঝেই হল ছাড়িয়া আমরা যে যার মত ছোটখাট মেসে উঠিলাম। মেসগুলো ভার্সিটিকে একপাশ হইতে সর্পের মতো পেঁচাইয়া রাখিয়াছে বহুবছর। আমরা নিশ্চিন্তে ছিলাম বহুদিন। একদিন হঠাৎ উহারা উপস্থিত হইল। আমাদিগের সহপাঠিদের অনেকেই ততদিনে জিহাদী জোসে মাতোয়ারা হইয়া গিয়াছে। আমাদিগকে আবার দাওয়াত দেয়া হইল। সবজিভোজী হইয়া গিয়াছিলাম বলিয়া দাওয়াত কবুল করিলাম না। বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হইলে পর, রাত্রি গভীর হইয়া আসিলে, দুই জিহাদী( মুজিবের অনুসারী বলিয়া কথিত ছাত্রলীগ ও মওদূদীর ছাত্রশিবির) দলের সংঘর্ষে ভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা করা হইল। আমরা জান হাতে নিয়া, পিঠে কয়েক কেজি ওজনের ব্যাগ ঝুলাইয়া ,বাড়ির উদ্দেশ্যে নিষ্ক্রান্ত হইলাম। বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসার পর এক সপ্তাহও গত হয় নাই মুজিববাদী এক নেতা নিহত হইলেন। সুতরাং আবারো যুদ্ধ শুরু হইল । আবারো সকলের সহিত পলাইলাম।