ফিজিক্সের সাবসিডিয়ারি ক্লাসে বসে রীতিমত ঝিমুচ্ছে শাহানা। বোরিং একটা ক্লাস। এমনিতেই ফিজিক্স তার পছন্দের বিষয় নয়, তার উপর ক্লাসে আজ ঢুকেছে অনেক পরে, বসেছে সবচেয়ে পেছনের দিককার কোনার একটা বেঞ্চে। বেঞ্চের পেছনে একটা খাড়া দেয়াল। ডানপাশেও তাই। ডানপাশের দেয়ালের খানিকটা আবার স্যাঁতস্যাঁতে – হালকা শ্যাওলা ধরা। গাঢ় সবুজ একটা রেখা উপর থেকে নেমে গেছে মাঝ দেয়াল অব্দি। বৃষ্টির সময় নির্ঘাত ছাদ আর আর দেয়াল চুইয়ে পানি পড়ে। এখন অবশ্য বৃষ্টি টিষ্টি কিছু নেই। খড়খড়া রোদ চারিদিকে, কিন্তু দেয়ালের দিকে চোখ গেলেই কেমন গা ঘিন ঘিনে গা গুলানো একটা ভাব আসছে শাহানার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বাজে রুম গুলোর একটা নিশ্চয়। কী আর করা – সাবিসিডিয়ারি ক্লাসগুলোকে পাত্তা দেয় না কেউ, বেছে বেছে এই সমস্ত রুমগুলোতেই এইগুলো ক্লাস ফেলা হয়। আগেও ভেবেছে শাহানা ব্যাপারটা।

দেয়াল থেকে মন সরিয়ে সামনের দিকে নজর দিল সে। ক্লাসে লেকচার দিচ্ছেন তরুণ শিক্ষক তানভীর কুদ্দুস। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের নতুন শিক্ষক তিনি। এক দেড় বছর হল মাত্র যোগ দিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষক সুলভ ভারিক্কি ভাব একদমই আসেনি। চেহারা ছবি এমনিতে খারাপ নয়, কিন্তু কোথায় যেন একটা গেঁয়ো ভাব লুকিয়ে আছে, যেটা আবার তিনি প্রাণপণে ঢেকে রাখতে চান। কিন্তু ঢাকতে গিয়ে সেটাকে কায়দা করে আরো সামনে নিয়ে আসেন। সব সময়ই ‘ওখে’ বলে বাক্য শেষ করেন কুদ্দুস স্যার। ‘দিস ইজ হাউ ইট ওয়ার্ক্স, ওখে?’ ‘ইউ হ্যাভ টু আণ্ডারস্ট্যাণ্ড, ওখে?’ এর মধ্যে গোটা দশেক বার ‘ওখে’ ‘ওখে’ করে ফেলেছেন স্যার। ওখের চোটে শাহানার মাথা ঝিম্‌ ঝিম্‌ করা শুরু করেছে এর মধ্যেই।

লাল টকটকে একটা মাফলার পড়ে ক্লাস নিতে এসেছেন আজ কুদ্দুস স্যার। এই মাফলারটা মনে হয় স্যারের খুব প্রিয়। শীত নেই গ্রীষ্ম নেই – প্রায়ই এই মাফলার গলায় দিয়ে ক্লাসে চলে আসেন। আজও তাই করেছেন। মাফলারের একপ্রান্ত গলার সাথে প্যাঁচানো, আরেক প্রান্ত প্রায়ই ব্ল্যাকবোর্ডের সাথে লেগে লেগে যাচ্ছে। আর যখনই কুদ্দুস স্যার বোর্ডে কিছু লিখছেন, চকের গুড়া গিয়ে মাফলারে পড়ছে। মাফলারের নীচের দিকটার বড় একটা অংশ এর মধ্যেই বিঘৎ খানেক সাদা হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য কুদ্দুস স্যারের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। একটু আত্মভোলা গোছের শিক্ষক তিনি। কাউকে পড়া টড়া জিজ্ঞাসা করেন না কখনোই। ক্লাসের ছেলে মেয়েরা বেশি গোলমাল করলে ‘আহ আস্তে, ওখে?’ বলে আবার পড়ানোতে মন দেন। কেউ কোন প্রশ্ন করলে খুব সংক্ষেপে সেটা অবশ্য বুঝিয়ে দেন তিনি। যত জটিল প্রশ্নই আসুক না কেন, কখনোই কুদ্দুস স্যারকে বিব্রত হতে দেখেনি শাহানা। এই একটা সময়েই কুদ্দুস স্যারকে কেন যেন দারুণ সার্প মনে হয় শাহানার। ছোট্ট সেই সময়গুলোতে গেঁয়ো আত্মভোলা মানুষটির ভিতরে খুঁজে পায় চৌকষ এক স্মার্ট মানুষকে।

আজ অবশ্য তেমন কিছুই ঘটছে না। মাফলারে চক মাখামাখি করে জটিল কিছু সমীকরণ লিখছেন কুদ্দুস স্যার। লোরেন্স- ফিটজেরাল্ড ট্রান্সফরমেশন থেকে লোরেন্স ফ্যাকটর বের করেছেন –

where

স্যার বলে চলেছেন, এগুলো নাকি স্পেশাল রিলেটিভিটি পড়ানোর সময় কাজে লাগবে। আইনস্টাইন তার রিলেটিভিটির থিওরিতে কী সব টাইম ডায়ালেশন না লেন্থ কন্ট্রাকশন ছাতা মাথা বের করতে এই লোরেন্স ট্রান্সফরমেশন কাজে লাগিয়েছেন। এগুলো কেন এতো ঘটা করে জানা দরকার শাহানা বুঝতে পারে না। ব্যবহারিক জীবনে এগুলো কি আদৌ কোন কাজে লাগে? লোরেন্স ট্রান্সফরমেশন দিয়ে টাইম ডায়ালেশন বের করা গেলেই বা কি, আর না গেলেই বা কি! শাহানার মাথা ঝিম্‌ ঝিম্‌ করা ভাব কী আর এতে কমবে? ক্লাসে কেউ এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করেছে না। তাই কোন গোলমাল নেই। শাহানার ধারণা, তার মতোই কেউ আসলে কিছু বুঝতেই পারছে না। সবকিছু যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। বিদ্ঘুটে দেখতে দীর্ঘ আর কদর্য সব সমীকরণ তার মাথাব্যাথা আর ঝিমুনি বাড়িয়ে দিয়েছে আরো। ঢুলতে ঢুলতে তার মাথা দেয়ালের শ্যাওলা ধরা জায়গাটাতে ঠোকাঠুকি লাগার উপক্রমও হল বার দুয়েক। গা গুলানো ভাবটা যাও বা চলে গিয়েছিল বলে মনে করেছিলো কিছুক্ষণ আগে, আবার ফিরে এল মনে হয়। নাহ্‌, সকালে একটা নাপা বা এস্‌প্রিন খেয়ে ক্লাসে আসা উচিৎ ছিলো।

এর মধ্যে শুরু হয়েছে এক মাছির উপদ্রপ। কোত্থেকে কালো রঙের ঢাউস একটা মাছি শাহানার নাকের সামনে ভন ভন শুরু করেছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। বার কয়েক হাত দিয়ে তাড়াতে চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। অলি বার বার ফিরে আসে, অলি বার বার ফিরে যায়। কী মুশকিল, কুৎসিৎ মাছির উপদ্রপের সময় রোমান্টিক গান মনে পড়ার কোন অর্থ হয়? ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে শাহানা। রুমালের এক প্রান্ত গিট্টু পাকিয়ে ওৎ পেতে বসে থাকে আবার কখন মাছিটা নাকের সামনে আসবে। রুমালে গিট্টু দিয়ে ঠিক জায়গা মতো চটাস করে বাড়ি দেয়ার খেলাটা শাহানা একসময় শিখেছিলো তার ছোটভাই সোহাগের কাছ থেকে। বাঁদর সোহাগটা সুযোগ পেলেই রুমালে গিট্টু মেরে শাহানার হাতে বা পিঠে বসিয়ে দিত। মাঝে মধ্য ভীষণ ব্যাথা পেত শাহানা। পরক্ষণেই তাড়া করতো সোহাগকে – বাঁদর ছেলে থাপড়ে দাঁত ফেলে দিব। সোহাগ হি হি করে হেসে ভোঁ দৌড়। কাঁহাতক আর ছোটভাইয়ের বিৎলামি সহ্য করা যায়। এক সময় শাহানাও রুমাল গিট্টু লাগানো শিখে ফেলে। শিখে ফেলে কীভাবে গিট্টুকে পিঠের উপর চালান করে দেয়া যায়। সোহাগের পিঠে দু চারবার ঠিকমতো রুমাল চালানোর পর সোহাগটা ঠাণ্ডা হয়েছে। এখন আর রুমাল নিয়ে শাহানার সাথে তাফালিং করার সাহস দেখায় না। একটা সময় পরে শাহানা আবিস্কার করে এই রুমাল গিট্টুর প্রয়োগ কেবল সোহাগের পিঠেই নয়, আরো অনেক জায়গাতেই সার্থক ভাবে প্রয়োগ করা যায়। যেমন, গভীর রাতে পড়ার সময় টেবিল ল্যাম্পের সামনে কোন মথ, মাছি জাতীয় কোন ছোটখাট আপদ অযথাই ঘোরাঘুরি করলে – যাদের হাত দিয়ে ধরতে ঘেন্না হয় শাহানার, সহজেই রুমাল চালিয়ে দেয়ালের সাথে সেপ্টে দিতে পারে সে। পরে একটা টিস্যু এনে পরিস্কার করে ফেললেই হল।

আজকেও সেই একই কাজ করবে শাহানা, যেটা সে বাসায় বহুবার করে হাত পাকিয়ে ফেলেছে এর মধ্যেই। টেবিলের নীচে রুমালে গিট্টু পাকিয়ে রুমাল হাতে নিয়ে বসে আছে কখন মাছিটা দেয়ালের সামনে দিয়ে উড়ে যাবে আর চটাস করে রুমালের আঘাতে তার দেহটা লেপ্টে যাবে দেয়ালের স্যাঁতস্যাঁতে জায়গাটায়। ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে শাহানার। এই প্রথম মনে হচ্ছে ঝিমুনি আর মাথা ব্যাথাটা একটু কমছে। তার নারীসুলভ মনের মধ্যে মাছি মারার এমন পৈশাচিক আক্রোশ আছে – কেউ তা বিশ্বাস করবে না!

কিন্তু হতচ্ছাড়া মাছিটা কেবল শাহানার নাকের সামনেই ঘোরাঘুরি করছে, দেয়ালের দিকে যাচ্ছে না মোটেই। নাকের সামনে থেকে তো আর মাছিকে রুমাল দিয়ে বাড়ি মারা যায় না। অবশ্য বাড়ি মারলে যে খুব একটা খারাপ হত তা নয়। শাহানার ঠিক সামনের বেঞ্চে বসে থাকা ছেলেটা মুখ হা করে বাইরের দিকে তাকিয়ে নাক খুটছে – এই কুৎসিৎ দৃশ্যটা থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। রুমাল সহ মাছিটা ছেলেটার সাদা জামায় লেপ্টে গেল – আর ছেলেটা নাক খোঁটা বাদ দিয়ে ভরকে গিয়ে লাফিয়ে উঠলো, আর কুদ্দুস স্যার ‘আহ আস্তে, ওখে?’ বলে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন – এই দৃশ্যপটগুলো ধারাবাহিকভাবে কল্পণা করে নিজের অজানতেই আমোদিত হয়ে উঠলো শাহানা।

ব্যাপারটা হয়তো ঘটিয়েই ফেলতো শাহানা, কিন্তু দেখল মাছিটা এর মধ্যেই দেয়ালের দিকে সরে গেছে বেশ খানিকটা। আহ্‌ ভাগ্য ভাল তাইলে সামনের ছেলেটার। ছেলেটাকে বাদ দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে মাছিটাকে লক্ষ্য করছে সে। নিজেকে শিকারী টিকটিকির মতোই মনে হচ্ছে তার। টেবিলের নীচে রাখা রুমাল সমেত হাতদুটো আস্তে আস্তে টেবিলের উপর উঠিয়ে আনছে। আরেকটু দেয়ালের দিকে এগোও বাপু, তখনই দেখবে পিঠে বিরাশি সিক্কার গিট্টুর চোট কেমন লাগে। মাছিটা দেয়ালের দিকে একটু একটু করে এগুচ্ছে আর শাহানার হাতও উঠে এসেছে, এবারই তাক করবে মাছিটাকে …

ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। মাছিটা দেয়ালের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ করেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে মাছিটাকে নজর রাখছিলো তীক্ষ্ণ চোখে, হঠাৎ সেটা রীতিমত হাওয়া হয়ে গেল? এতো হবার নয়।

নাহ কপালটাই খারাপ, নিশ্চয় এক সেকেণ্ডের জন্য আনমনা হয়ে গিয়েছিলো শাহানা। এর মধ্যেই মাছি বাবাজি চম্পট দিয়েছে। ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে গিয়েই দেখল মাছিটা আবার উদয় হয়েছে। সেই একই জায়গাতেই – যে জায়গা থেকে একটু আগেই হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো বলে সে মনে করেছিলো। আবারো কিছুক্ষণ উড়াউড়ি করে আবারো হাওয়া। এবারো ঐ ঠিক একই জায়গা দিয়ে। মনে হচ্ছে মাছিটা উড়তে উড়তে ঐ জায়গাতে পৌঁছুলেই মাছিটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বাতাসের মধ্যে একটা গর্ত আছে – অদৃশ্য ম্যানহোল টাইপের কিছু। সেই অদৃশ্য ম্যানহোল দিয়ে মাছিটা গায়েব হয়ে যাচ্ছে বারে বারেই।

এ কী জুয়েল আইচের যাদু নাকি সাঁইবাবার হাত সাফাই? ঐ জায়গাটাতে আছেটা কী? ঠিক নাকের সামনেই তো খোলা জায়গাটা – বড় জোর বিঘৎ খানেক দূরে, এর পরেই দেয়ালের শুরু। ফাঁকা এই জায়গাতে তো এমন কিছু নেই যে কোন কিছু গায়েব হয়ে যেতে পারে। মাছিটা যে পথ দিয়ে উধাও হয়ে গ্যাছে, সেই পথে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দেয় শাহানা। কই সব কিছু তো ঠিকই আছে! হাতটা আরো কিছুটা এগিয়ে নেয় শাহানা। এর পরে আরো কিছুটা। এভাবে হাতটা আরো কিছুদূর আগাতেই দেখে হাতের সামনের আঙ্গুলগুলো এখন আর দেখা যাচ্ছে না। হাতের সামনের দিকটা অদৃশ্য, কিন্তু পেছনের দিকটা দিব্যি দেখা যাচ্ছে।

‘অ্যা’! বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে শাহানা।

‘কী হল?’ কুদ্দুস স্যার পড়ানো বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন।

‘কিছু না স্যার, সরি!’

বায়বীয় সেই গর্ত থেকে ততক্ষণে হাত বের করে নিয়েছে শাহানা। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বসে আছে । সাড়া ক্লাসের দৃষ্টি তার দিকে।

‘হাতের কলমটা হঠাৎ করে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো, স্যার’!

‘ও’। কুদ্দুস স্যার তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বোর্ডে লেখা শুরু করেন। লরেন্স সমীকরণ শেষ করে এখন ট্রান্সফর্মেশনের ম্যাট্রিক্স সমাধান করছেন বোর্ডে –

ছাত্র-ছাত্রীরাও আবার যে যার মত নিজের কাজে মন দিয়েছে। কেউ কুদ্দুস স্যারের দেখানো সমীকরণ টুকছে, কেউ বা ফুসুর ফুসুর করে পাশের বন্ধুর সাথে খোশগল্প করেছে। সামনের ছেলেটা যথারীতি বাইরে তাকিয়ে নাক খোঁটায় মন দিয়েছে।

শাহানা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবারো তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো। তবে খালি হাত নয়, এবারে কিন্তু হাতে সত্য সত্যই ধরা রয়েছে তার কলম। কলমটা নিয়ে শাহানা সোজা সেই বায়বীয় গর্ত বরাবর সুট করে প্রবেশ করিয়ে দিল প্রায় অর্ধেকটা। যা ভেবেছিলো তাই। কলমের সামনের দিকটা দেখা যাচ্ছে না। আর পেছনের দিকটা তো তার হাতেই ধরা। আস্তে আস্তে কলমের পুরোটুকু গর্তে প্রবেশ করিয়ে দেয় শাহানা। হাতের আঙ্গুলের পর থেকে ধরে থাকা কলমের আর কিছুই এখন দেখা যাচ্ছে না। এবারে হাতের আঙ্গুলগুলো আস্তে আস্তে মেলে কলমটা ছেড়ে দিলো শাহানা।

কলম মাটিতে পড়ার আওয়াজ শোনার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল শাহানা। কুদ্দুস স্যারকে এবারে কী বলবে সেটাও মনে মনে চিন্তা করে ফেলেছিল সে। কিন্তু কোথাও কোন আওয়াজ হল না। কলম মাটিতে পড়েনি। একেবারে উধাও হয়ে গেছে হাওয়ায়। আসলেই কি উধাও হয়েছে, নাকি মেঝেতেই পড়ে আছে? মাথা নীচু করে বেঞ্চের নীচে যতদূর চোখ যায় আড়চোখে দেখে একপ্রস্থ খুঁজে নিল শাহানা। নেই।

চোখ বড় বড় হয়ে গেছে শাহানার। জলজ্যান্ত একটা কলম হাওয়া হয়ে গেল! এমন ঘটনা শাহানা তার জীবনে কখনোই দেখেনি, শোনেওনি। কলমটার জন্য হালকা মত একটু দুঃখভাব হচ্ছে যদিও। হাজার হোক, গত জন্মদিনে ছোট মামার উপহার দেয়া দামী পার্কার কলম ছিলো ওটা। কিন্তু কলম নিয়ে চিন্তা করার সময় নয় এটা। বরং যে ঘটনা তার চোখের সামনে ঘটলো তা নিয়ে রীতিমত শিহরিত শাহানা এখন।

মাছি মারার জন্য যে রুমালটা বের করেছিলো, সেটা টেবিলেই পড়ে আছে। সেটা নিয়েও একই কাজ করলো শাহানা। হাতে তুলে নিয়ে ঠিক সেই জায়গাটায় বাতাসের মধ্যে ছেড়ে দিল। সেটাও মাটিতে না পড়ে হারিয়ে গেল নিমেষে।

এ তো ভারী অবাক ব্যাপার। এগুলো হচ্ছেটা কী বাপু! জিনিসগুলো গায়েব হয়ে যাচ্ছে ক্যামন করে?

শাহানা আবারো হাত বাড়ায় সেই বায়বীয় গর্ত বরাবর। এবারে প্রথমে হাতের আঙ্গুল, ধীরে ধীরে হাতের কবজি, এর পর পুরো ডান হাতই ঢুকিয়ে দেয়। আসলেই হাতটা দেখা যাচ্ছে না।

এবারে আরেকটু সাহসী হয় শাহানা। বাম হাতটাও গলিয়ে দেয় শাহানা গর্ত বরাবর। দুটো হাতই এখন চোখের সামনে থেকে উধাও।নিজেকে হাওয়ার মধ্যে বাদুড়-ঝোলা হয়ে ঝুলে আছে বলে মনে হচ্ছে। ভাগ্যিস একেবারে পেছন দিকের কোনার একটা বেঞ্চে বসেছে শাহানা আজ। কেউ তাকে লক্ষ্যও করছে না। করলে বিপদ হত। দুই হাত বিহীন হয়ে ঝুলে থাকা এমন অদ্ভুত বিকলাঙ্গ শাহানাকে দেখে ভয় পেয়ে চ্যাচামেচি শুরু করে দিত ছেলেপিলেরা।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এবারে নিজের মাথাটাও গর্তে গলিয়ে দেয় শাহানা। কেমন শীতল একটা অনুভূতি, কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ভিতরে। কেমন যেন কুয়াশা ঘেরা চারিদিক। একবার মা বাবার সাথে দিনাজপুরে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো শীতকালে। সেখানে পৌঁছিয়েই এর পরদিন সূর্য ওঠার আগে অন্ধকার থাকতে থাকতেই বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে পড়েছিলো সে। এতো ভোরে বাড়ির বাইরে উঠোনে পা রেখেই শাহানা থমকে গিয়েছিলো। হাল্কা আলো আঁধার আর কুয়াশা সবকিছু মিলিয়ে একটা পরাবাস্তব অনুভূতি যেন ঘিরে ধরেছিলো তাকে। এখনকার অনুভূতিটা অনেকটা সেদিনের দিনাজপুরের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের মতোই অনেকটা। মাথাটা আরেকটু বেশি করে ঢোকানর সিদ্ধান্ত নেয় শাহানা। কিন্তু আরেকটু ঢোকাতেই সুরুৎ করে পিছলে গেল যেন। তারপর শো করে ঢুকে গেল একদম ভিতরে। আসলেই গর্তে পড়ে যাবার মতই লাগছে। ঠিক গর্তও নয় আবার – কেউ বিল্ডিং থেকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিলে মাটিতে পড়ার আগ পর্যন্ত শুন্যে ভেসে বেড়ালে যেমন লাগে – শাহানার অনুভূতি ঠিক তেমন যেন। পড়ছে তো পড়ছেই । এর যেন কোন শেষ নেই। যত এগুচ্ছে সামনের জায়গাটা যেন আরো খুলে যাচ্ছে, আর পেছনের সব কিছু যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাথাটাও ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে শাহানার। জ্ঞান হারানোর আগে বহু দূর থেকে শাহানা শুনতে পেল কুদ্দুস স্যারের গলা, তিনি পড়িয়ে চলেছেন তখনো –

…আইনস্টাইনের এই সমীকরণের অনেকগুলো সমাধান আছে… সে জন্য আমাদের আগে ইভেন্ট হরাইজনের ব্যাপারটা বুঝতে হবে… এখানে আমরা আইনস্টাইন রজেন ব্রিজ ইকুয়েশন প্রয়োগ করে পাই … আর এখান থেকেই বেড়িয়ে আসে …শোয়ার্ডসচাইল্ড ওয়ার্মহোল … ১৯১৬ সালে কার্ল শোয়ার্ডসচাইল্ড এই সমাধানটা দিয়েছিলেন … অনেকটা স্পেসটাইমের ভেতর দিয়ে সরু একটা টানেলের মত করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিমেষমধ্যে চলে যাওয়া সম্ভব। …হয়তো সম্ভব সময় পরিভ্রমণও, তাই মনে করেন অনেক বিজ্ঞানী। … ১৯৮৮ সালে ক্যাল্টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কিপ থোর্ণ, এভাবে স্পেসটাইম ফুটো করে অন্য সময়ে চলে যাবার একটা উপায়ের কথা বলেছিলেন…একে নাম দেয়া হয়েছে ট্র্যান্সভার্সিবল ওয়ার্মহোল …

এরপর আর কিছু মনে নেই শাহানার। কোন কুক্ষণে যে হতচ্ছাড়া মাছিটাকে তাড়া করার কথা মনে হয়েছিলো …

***

ঘুম ভেঙ্গে শাহানা দেখে বিছানায় শুয়ে আছে। নরম গদির পরিপাটি করে সাজানো বিছানা। গায়ের উপর মোটা একটা কম্বল পাতা। মখমলের মতোই নরম। কম্বলের গায়ে সূচের হাল্কা কাজ করা। বিছানার পাশে একটা তেপায়া স্ট্যান্ড। এ ধরণের স্ট্যান্ড খুব পছন্দ শাহানার। ছিমছাম কিন্তু আধুনিক। তার বন্ধু রেহানার বাসায় এরকম একটা স্ট্যান্ড ছিলো। সেটা নাকি আমেরিকায় আইকিয়া থেকে কেনা। স্ট্যাণ্ডের উপর এর পানির একটা জগ।

শুয়ে শুয়েই দেয়ালের দিকে নজর দেয় শাহানা। পাশের সাদা দেয়ালে একটা পোস্ট মডার্ন আর্ট ঝুলছে। কার আঁকা ছবি ওটা? জন বাল্ডেসারির নাকি রেচেল হুইটার্ডের?

বাড়িটাও খুব চেনা। মনে হচ্ছে বাড়িটাকে বহুদিন ধরে দেখেছে। পায়ের দিকের দেয়ালের দরজাটা লাগানো। পাশের দেয়ালটা প্রায় পুরোটুকু জুড়ে বিরাট একটা জানালা। সেই জানালা দিয়ে বিরাট মাঠ আর আকাশ দেখা যায়। খুব বেশি আসবাবপত্র নেই ঘরটায়। কিন্তু যা আছে সেগুলো খুবই সুন্দর আর ছিমছাম। তার সব পছন্দের জিনিসগুলো খুব পরিপাটি করে মনমতো সাজানো।

ড্রেসিং টেবিলটাও খুব সুন্দর। লাগোয়া বিরাট আয়না। প্রাসধনসামগ্রী রাখার ছোট একটা জায়গা। গলার নেকলেসগুলো ঝুলিয়ে রাখার একটা ক্লিপ আছে। অনেকগুলো নেকলেসের মধ্যে তার সবচেয়ে প্রিয় নেকলেসটাও ঝুলছে। হোয়াইট স্যাফায়ারের ডায়মণ্ডের কারুকাজ করা সেই সরু হোয়াইট গোল্ড চেইনের নেকলেসটা – চাচী সেটা সিঙ্গাপুর থেকে নিয়ে এসেছিলেন তার জন্য বছর কয়েক আগে।

মেঝের দিকে নজর গেল শাহানার। কঙ্ক্রিটের নয়, হার্ডউড ফ্লোরের পরিপাটি মেঝে। হাল্কা কমলা রঙের। আমেরিকান আর ব্রিটিশ মুভিতে এই ধরনের মেঝেওয়ালা বাসা অনেক দেখেছে শাহানা। ঝকঝকে তকতকে মেঝে – যেনো কিছুক্ষণ আগেই মুছে পরিস্কার করা হয়েছে। কোথাও একসুতো ময়লা পর্যন্ত নেই। কিন্তু …

মেঝের মাঝামাঝি জায়গায় একটা কলম আর একটা সাদা রুমাল পড়ে আছে। অনেকটা ছন্দ পতনের মতোই দেখাচ্ছে এখন। এতো সুন্দর করে সাজানো একটা ঘর – যেখানে সবকিছুই নিখুঁতভাবে পরিপাটি করে সাজানো – সেখানে মেঝেতে অযথা একটা কলম আর রুমাল পড়ে আছে কেন এভাবে? আর কলম আর রুমালটাকেই বা এতো চেনাই বা লাগছে কেন শাহানার… কোথায় যেন দেখেছে। আরেকটা জিনিসও ব্যাজায় বিরক্তিকর। ঘরের মধ্যে কী করে যেন একটা মাছি ঢুকে পড়েছে। বার বারই নাকের সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে হতচ্ছাড়া মাছিটা।

এরমধ্যে পায়ের দিকের দেয়ালের দরজাটা খুলে গেলো হঠাৎ করেই। গাঢ় নীল রঙের টি শার্ট আর খাকি প্যাণ্ট পরে এক সুদর্শন তরুণ দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। চুলগুলো নিখুঁতভাবে ব্যাকব্রাশ করা, টি শার্টের বুকে মাওয়ি জিমের সানগ্লাস গোঁজা, আর বাঁ হাতের কব্জিতে আরমানী একচেঞ্জের মোটা ব্যাণ্ডের ঘড়ি। লোকটিকে খুব চেনা মনে হচ্ছে। তার চালচলন তাকানো সবকিছুই তার খুব চেনা। তারপরেও লোকটিকে চিনতে পারছে না কেন শাহানা? শাহানাকে চোখ মেলতে দেখেই আকর্ণবিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে পড়লো তরুনটির চোখে মুখে। হাসি আর তাকানো দেখেই চমকে উঠে শাহানা বুঝলো এ লোকটি তার পরিচিত কুদ্দুস স্যার।

‘ওখে, ইউ আর অলরাইট দেন! খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রাত্রী…’

শাহানাকে কুদ্দুস স্যার ‘রাত্রী’ বলে ডাকছেন! অবাক ব্যাপার। রাত্রী তার ডাক নাম। এ নামটা তার খুব পছন্দের। বাবা মা আর খুব কাছের দু একজন বন্ধুবান্ধবী ছাড়া এ নাম ধরে কেউই তাকে কখনো ডাকে না। কুদ্দুস স্যার তার প্রিয় রাত্রী নামটা জানলেনই বা কীভাবে, আর এ নামে ডাকার অধিকারই বা পেলেন কেমন করে? সব কিছুই ক্যামোন যেন মনে হচ্ছে শাহানার।

‘বিয়ের পর এতো ভয় আমি আর কখনোই পাইনি। ফরএভার টুয়েণ্টিওয়ান থেকে কিছু জামা কাপড় কিনবে বলে আমার সাথে মলে বেড়াচ্ছিলে তুমি, মনে পড়ছে? তারপর হঠাৎ দেখি তুমি পাশে নেই। ভাবছিলাম আইস্ক্রিম কিনতে হেইগেনডাসের স্টলে গেছ বুঝি। ওখানে গিয়েও দেখি নাই। তোমার সেলফোনে কল দিলাম, দেখি বন্ধ। তন্ন তন্ন করে সাড়া মল খুঁজেও তোমাকে পেলাম না। …’

বিয়ে? মলে ঘোরাঘুরি? শাহানা হতভম্ব।

‘তারপর?’ শাহানা উদ্গ্রীব বাকিটা জানার জন্য।

‘জিপিএস ট্র্যাক করে দেকলাম তোমার লোকেশন দেখাচ্ছে বাসায়। আমি তো অবাক। হুড়মুড় করে বাসায় ফিরলাম, দরজা খুলে দেখি তুমি মেঝেতে পড়ে আছ। আমি তাড়াতাড়ি তোমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাশের বাসায় ডক্টর আজীমকে ফোন করলাম। উনি এসে দেখে গিয়েছেন এর মধ্যে একবার। বলেছেন চিন্তার কোন কারণ নেই। হার্টবিট পালস সবই নরমাল। বলেছেন ডিহাইড্রেশন কিংবা গরম থেকে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে থাকবে। এর মধ্যে তোমাকে স্যলাইনও দেয়া হয়েছে’।

শাহানা এতক্ষণ লক্ষ্যই করেনি আগে যে বিছানার অন্যদিকে সট্যান্ড থেকে স্যালাইনের টিউব ঝুলছে।

‘বুঝলে?’ কুদ্দুস শাহানার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আজীম জিজ্ঞেস করছিলেন ছোটবেলায় বা কখনো তোমার এপিলেপ্সি ছিলো কিনা । আমি বলেছি যে ছিলো না’।

‘ঠিকি বলেছেন’।

‘হ্যা? আজীম এপিলেপ্সির ব্যাপারটা যে সন্দেহ করেছেন সেটা ঠিক বলছ?’

শাহানা বুঝতে পারে কুদ্দুস ‘আপনি’ সম্বোধন শুনে কনফিউজড ।

‘নাহ, বলছি তুমি ঠিক বলেছ। আমার কখনোই এপিলেপ্সি জাতীয় কিছু ছিলো না’। কুদ্দুসকে আশ্বস্ত করে শাহানা।

কুদ্দুসকে আশ্বস্ত করলেও নিজে আশ্বস্ত হয় না শাহানা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরের মাছিটার দিকে দেখছে এখন সে। মাছিটা ঘরের কোনার দিকে বাথরুমের দরজার কাছে ঘুর ঘুর করছে। প্রায়ই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে বাথরুমের দরজাটার কাছে গিয়েই।

‘আমার একটু বাথরুমে যেতে হবে’ বলে উঠে দাঁড়ায় শাহানা।

যাওয়ার সময় শাহানা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে যায় পড়ে থাকা কলম আর রুমালটা ।

***

তানভীর কুদ্দুস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে বসে নিজের লেকচার নোট তৈরি করেছেন। অন্য দিনের তুলনায় মন তার একটু উৎফুল্ল। একটু পরেই একটা সাবসিডিয়ারি ক্লাসে তার লেকচার দিতে হবে তাঁর। এ বছর রিলেটিভিটির সবটুকু পড়ানোর ভার তার ঘাড়ে এসে পড়েছে। সাধারণতঃ খুব সিনিয়র টিচারেরা এ বিষয়টা পড়ান। কিন্তু অধ্যাপক মৃন্ময় সেনগুপ্ত স্যার ছুটিতে থাকায় তাকেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

কুদ্দুসের অবশ্য খারাপ লাগছে না। অনেকদিন ধরেই তার ইচ্ছে ছিলো এই বিষয়টা ছাত্রদের পড়ানোর। ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডির কাজের সময় অধ্যাপক লি স্মোলিনের আণ্ডারে লুপ কোয়ান্টাম গ্রাভিটির গানিতিক সমস্যা সমাধানের কাজ করেছিলেন কুদ্দুস। সে সময়ই রিলেটিভিটি আর কোয়ান্টাম গ্রাভিটি নিয়ে দারুণ আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল তার। ইচ্ছে ছিলো আরো কিছুটা কাজ করার। কিন্তু তা হয়নি। পিএইচডি শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর ইলেকট্রো ম্যাগনেটিজম, থার্মোডায়নামিক্স আর ক্লাসিকাল ফিজিক্সের উপর কিছু গৎবাঁধা ক্লাসের ভার তার উপর গছিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এই বছরটাই কেবল ব্যতিক্রম। তার পছন্দের বিষয় ছাত্রদের পড়াতে পারছেন। তানভীর কুদ্দুস ঠিক করেছেন, তার কোর্সে স্পেশাল রিলেটিভিটি, জেনারেল রিলেটিভিটি সবকিছু কভার করে স্ট্রিং থিওরী, লুপ কোয়াণ্টাম গ্রাভিটি, ইভেন্ট হরাইজন, ব্ল্যাক হোল, হোয়াইট হোল থেকে শুরু করে টাইম ট্র্যাভেল নিয়েও লেকচার দেবেন তিনি ছাত্রদের। এই টপিকগুলো সাধারণতঃ শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়ান না তেমনভাবে। ভুতের ভয়ের মতো ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলেন টপিকগুলোকে। অথচ বাইরে এ নিয়ে দারুণ সব কাজ হয়েছে কয় বছরে। বাংলাদেশের ছাত্রদের এগুলো জানা দরকার অল্প স্বল্প হলেও।

অবশ্য পছন্দের বিষয় পড়ানোটাই তার মন প্রফুল্ল হবার একমাত্র কারণ নয়। এরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে একটা চিঠি এসেছে আজ সকালে। পোস্ট ডক্টরেট ফেলোশিপ পেয়েছেন তিনি। এটা একটা বিরাট সুযোগ।

তানভীর কুদ্দুস লেকচার দিতে ক্লাসে ঢুকলেন। খুব আনন্দ নিয়েই পড়িয়ে চলছেন ক্লাসে। লেকচারের ফাঁকে ফাঁকে বোর্ডে লোরেন্স ট্রান্সফরমেশনের সমীকরণগুলো লিখছেন। হঠাৎ পেছন থেকে একটি মেয়েলী গলার আওয়াজ হল -‘অ্যা’।

‘কী হল?’

‘কিছু না স্যার, সরি!’

একদম পেছনের বেঞ্চে একটি মেয়ে অপ্রস্তুত আর লাজুক ভঙ্গিতে বসে আছে।

‘হাতের কলমটা হঠাৎ করে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো, স্যার’!

‘ও’। কুদ্দুস স্যার তাকিয়ে থাকেন মেয়েটার দিকে। বাইরের জানালা দিয়ে সকালের রোদ এসে মেয়েটির গালে পড়েছে। অন্যপাশটা অন্ধকার। আলো আঁধারিতে কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে। এই লাজুক মেয়েটিকে আজ বিকেলে টিএসসিতে চা খেতে ডাকলে খুব কী অন্যায় করা হবে?

ক্লাসের পরে মেয়েটির সাথে কথা বলবেন বলে ঠিক করেন তানভীর কুদ্দুস। ব্ল্যাকবোর্ডের সমীকরণের দিকে আবারো মন দেন। লোরেন্স ট্রান্সফরমেশনের সমাধানের শেষদিকে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি।