আমরা নিউটনের মহাবিশ্বে বাস করি। অনেকেই আপত্তি করবেন, বলবেন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে নিউটনীয় তত্ত্বকে আহরণ করা যায়, কাজেই নিশ্চয় আমাদের মহাবিশ্ব আইনস্টাইনীয়। বিবেচক পাঠক এটাও প্রশ্ন করবেন যে, এখানে কোন বিষয়টিকে মূল ধরে নিউটন ও আইনস্টাইনের মধ্যে পার্থক্য করা হচ্ছে? আমি হয়ত বলব আমাদের অল্প গতির জীবনে – জাহাজে মালামাল তুলতে কিংবা চাঁদে মানুষ পাঠানোর জন্য নিউটনীয় বলবিদ্যা বা মধ্যাকর্ষণ সূত্রই যথেষ্ট। আপনি হয়ত বলবেন, কিন্তু আমরা যে স্পেস-টাইম বা দেশ-কালের চাদরে বাস করি সেটি আইনস্টানের সূত্র মেনে চলে, কাজেই সেটির অর্থ আরো গভীর। আমি নিশ্চয় এই কথায় আপত্তি করব না, কিন্তু বলব আমাদের দৈনন্দিন জীবন একটি মাত্র জিনিসের ওপর ভরসা করে চলে – সেটি হল জড়তা, জাড্য বা ইনারশিয়া, এবং এই বোধটিকে বিজ্ঞানের ভাষায় প্রকাশ করার জন্য আমরা নিউটনের কাছে ঋণী। একটি প্রাকৃতিক রাশিকে তিনটি ভিন্ন শব্দ (জড়তা, জাড্য, ইনারশিয়া) দিয়ে প্রকাশ করলাম, কারণ সেটির ব্যাপ্তি এতই বিস্তৃত যে তাকে উপস্থাপন করতে তিনটি শব্দও যেন অপ্রতুল। আমাদের মহাবিশ্ব হল ইনারশিয়ার, তবে সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে আমি বলি আইজাক নিউটনের (১৬৪২ – ১৭২৬) কোন আবিষ্কার বা উদ্ভাবনা নিয়ে আমরা আজ আলোচনা করব না।


চিত্র ১: নিউটনের নিজ হাতে আঁকা প্রতিফলক দুরবিন

নিউটনের যখন ২৪ বছর বয়স তখন তিনি ত্রিশারা কাচ ব্যবহার সূর্যের আলোকে তার বিভিন্ন রঙের বর্ণালীতে বিশ্লেষণ করেছিলেন এবং আর একটি কাচ ব্যবহার করে সেগুলোকে আবার সাদা আলোতে ফিরিয়ে এনেছিলেন। ‘সাদা’ আলো যে বিভিন্ন তরঙ্গের আলোর সমষ্টি এটি ছিল প্রথম সম্যক প্রমাণ, কিন্তু তাঁর আলোর তত্ত্বকে প্রকাশ করতে তিনি ৩৮ বছর অপেক্ষা করলেন, ‘প্রিনসিপিয়া’র পরে তাঁর দ্বিতীয় বিখ্যাত বই হল ‘অপটিক্স’ যেটা ১৭০৪-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৬৬৫ থেকে ব্রিটেনে প্লেগ রোগের মহামারী দেখা দিল, নিউটন সেই সময়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন, এবং সেখানে, নিভৃতে, অন্য শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের সঙ্গ বাতিরেকে দু বছর ধরে যুগান্তকারী সব কাজ করলেন। উদ্ভাবন করলেন প্রতিফলিত দুরবিন – যে দুরবিনের মূল গঠন জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে আধুনিক সময়ও ব্যবহৃত হচ্ছে। পরে, ১৯৬৭ সনে লন্ডনে ফিরে, ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটিতে এই দুরবিন দেখিয়ে অখ্যাত নিউটন সদস্যপদ লাভ করলেন। কিন্তু এর চেয়ে বড় যে কাজটি সেটি হল, যখন তাঁর বয়স ২৬-ও ছোঁয়নি, নিউটন উদ্ভাবন করলেন ক্যালকুলাস বা সমাকলন। তিনি দেখলেন পৃথিবীর বুকে পড়ন্ত বস্তুর গতি বা সূর্যের চারদিকে গ্রহগুলির পরিক্রমায় যে পরিবর্তনশীল গতির উদ্ভব হয় সেটিকে গণনা করতে ক্যালকুলাস ছাড়া উপায় নেই। অথচ ১৬৮৭-তে তিনি যখন তাঁর ‘প্রিনসিপিয়া বইতে বলবিদ্যার গতিসূত্র, কেন্দ্রাভিমুখী বল, সর্বজনীন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র, গ্রহের উপবৃত্তাকার পথ ইত্যাদি বর্ণনা করলেন তাতে কোথাও ক্যালকুলাস ব্যবহার করলেন না, বরং দুরূহ জ্যামিতি দিলেন, যার এর ফলে বইটি সাধারণের বোধগম্যতার বাইরে রয়ে গেল। এই কাজটি যে ইচ্ছাকৃত তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু কেন নিউটন এটা করেছিলেন সেটির বিশ্লেষণে আমরা এখানে যাব না।

আর কিছু আছে? আছে। ১৭০১ সনের একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে নিউটন দেখালেন যে, একটি বস্তুর তাপ বিকিরণের পরিমাণ ওই বস্তুটির তাপমাত্রা এবং সেটির চারপাশের যে তাপমাত্রা আছে তার পার্থক্যর ওপর নির্ভর করবে। পার্থক্য বেশি হলে তাপ ক্ষয়ের পরিমাণ বেশি হবে, তাপমাত্রার পার্থাক্য কম হলে বস্তুর তাপ বিকিরণ কম হবে। এটিকে আমরা নিউটনের শীতলতার সূত্র বলি। এছড়া নিউটন একজন আলকেমিস্ট ছিলেন, অন্য ধাতু থেকে কেমন করে স্বর্ণ সৃষ্টি করা যায় সেরকম রসায়ন প্র‍্যাকটিস করতেন। যদিও আজ আমরা জানি যে, এটি সম্ভব নয়, কিন্তু তাঁর রসায়নের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে, তিনি যখন রাজকীয় টাঁকশালের প্রধান ছিলেন, তখন টেঁকশই উন্নত মানের ধাতব মুদ্রা সৃষ্টিতে কাজে দিয়েছিল।


চিত্র ২: নিউটনকে উৎসর্গীকৃত ব্রিটিশ ডাকটিকিট

ওপরে নিউটনের যেসব কীর্তি বললাম সেগুলো নিয়ে আর কথা বাড়াব না, এবার আসব আমাদের আলোচনার মূল বিষয়ে। সেই কবে ইস্কুলে প্রথম পড়েছি নিউটনের প্রথম গতিসূত্র – কোনো বস্তু যদি স্থির অবস্থায় থাকে এবং তার ওপর যদি সম্মিলিত বল শূন্য হয় তবে বস্তুটি স্থির থাকবে; অথবা যদি বস্তু গতিশীল থাকে এবং তার ওপর সম্মিলিত ভর শূন্য হয় তবে বস্তুটি সমবেগে সরলরেখায় চলবে। খুব সাধারণ একটি বাক্য – যাকে নিউটনের জড়তা, জাড্য বা ইনারশিয়ার সূত্র বলা হয়। সূত্রটির প্রথম অংশে বস্তুটি নড়বে না তার স্থিতি জড়তার কারণে, দ্বিতীয় অংশে বস্তুটি চলবে তার গতি জড়তার কারণে। ইস্কুলে যখন পড়েছি তখন জিনিসটা মনে দাগ কাটেনি, বরং ভেবেছি এ আর এমন কী – এতো জানা কথাই। অথচ আমাদের মহাবিশ্বর পুরো কাঠামোই দাঁড়িয়ে আছে স্থিতি ও গতি জড়তার ওপরে। মনে করুন এমন একটি মহাবিশ্বের কথা যেখানে জাড্য বা ইনারেশিয়া নেই। সেখানে কখনই বস্তুকণারা তারা বা গ্রহর সৃষ্টি করতে পারবে না, সেই কণাগুলো কখনই স্থির থাকবে না, তারা যদৃচ্ছভাবে চলাফেরা করবে, এক জায়গায় আটকানো যাবে না। অন্যদিকে সৌরজগতের মত সুগঠিত কাঠামোও সৃষ্টি হবে না, কারণ গতি জড়তা না থাকলে সেই কবেই পৃথিবীর মত গ্রহরা তাদের সূর্যের ওপর আপতিত হত।


চিত্র ৩: নিউটনের চিত্র সম্বলিত ব্রিটিশ ব্যাঙ্ক নোট

নিউটনের আগে গ্যালিলেও গ্যালিলেই জড়তা বা জাড্যর ধারণাটি দিয়ে গেছেন, নিউটন গ্যালিলেওর কাজ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং তাঁর প্রিনসিপিয়া বইতে প্রথম সূত্রটি প্রসঙ্গে গ্যালিলেওর একটি এক্সপেরিমেন্টের উল্লেখ করেছেন যেটিতে গ্যালিলেও দেখিয়েছিলেন যে, অভিকর্ষজ ত্বরণ-অনুভবকারী পড়ন্ত বস্তু যে দূরত্ব অতিক্রম করবে তা সময়ের বর্গের আনুপাতিক হবে (দূরত্ব ~ সময় x সময়)। গ্যালিলেও এবং নিউটনের আগে দু হাজার বছরের বিজ্ঞান জাড্য, জড়তা বা ইনারশিয়ার রূপটি ধরতে পারে নি, আর ধরতে পারে নি বলে পৃথিবী যে নিজের অক্ষের চারদিকে বা সূর্যের চারদিকে পরিক্রমা করছে সেটিকে বুঝতে পারে নি। জড়তা বিদ্যার আগে চিন্তকরা ভাবতেন পৃথিবী যদি ঘোরেই (পশ্চিম থেকে পূর্ব থেকে) তবে কেউ ঘরের মধ্যে লাফ দিলে ঘরের পশ্চিম দিকের দেয়াল এসে তাকে ধাক্কা দেবে। সেই সময়ে দ্রুত গতির যান ছিল না, নইলে তারা দেখতে পেত যে বাস বা ট্রেনে বসে একটা বস্তুকে ওপর দিকে ছুড়লে সেটি আবার আগের জায়গাতেই ফিরে আসে কারণ বস্তুটির গতি, যে ছুড়ছে তার গতিতেই ভ্রমণ করছে, তাই ওপর দিকে ছুড়লেও সেটির গতি জড়তার কারণে সামনের দিকেও ভ্রমণ করবে এবং তার আদি অবস্থানে ফিরে আসবে।


চিত্র ৪: লাটিন ভাষায় লেখা প্রিনসিপিয়ার প্রথম পাতা

তাই আমাদের মহাবিশ্ব হল ইনারশিয়ার মহাবিশ্ব। এবার আসি নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রে যেখানে বলের একটি সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। F = ma, বল = ভর x ত্বরণ। এই সমীকরণটি কিন্তু প্রিনসিপিয়া বইতে এ’ভাবে দেয়া নেই। নিউটন যেটা বলেছিলেন সেটা হল ভরবেগের পরিবর্তনের হার আপতিত বলের সমানুপাতিক, যেটাকে পদার্থবিদ্যার ভাষায় এ’ভাবে লেখা যায় F = (mv)/t = m(v/t) = ma। এখানে v হল বস্তুর বেগ ও t হল সময়। সমস্যা হল যদিও নিউটন ইতিমধ্যে ক্যালকুলাস বা সমাকলন গণিত উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি সেটা প্রিনসিপিয়াতে ব্যবহার করেন নি। আগেই বলেছি, ওই বইটি লেখা হয়েছে জ্যামিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেটার অর্থোদ্ধার সাধারণ পাঠকের পক্ষে কঠিন ছিল। নিউটন বুঝেছিলেন তিনি বিজ্ঞানে ভর, বল, সময়ের মত রাশিগুলির প্রবর্তন করছেন এবং এগুলির জন্য সংজ্ঞা প্রয়োজন। ভরকে তিনি বর্ণনা করেছেন এইভাবে – বস্তুর ভর হল বস্তুটির ঘন আকার (বা আয়তন) ও ঘনত্ব থেকে যে পরিমাণ পদার্থ পাওয়া যায় তার একটি পরিমাপক। প্রিনসিপিয়া বইটির অন্যান্য অংশে তাঁর লেখা থেকে এটি পরিষ্কার যে, তিনি বস্তুর ভর যে ইনারশিয়া বা জাড্যর সঙ্গে জড়িত সেটা বুঝেছিলেন। বস্তুর ভর হল বস্তুটির জাড্য বা জড়তার পরিমাপক; জড়তা বেশি হলে ভর বেশি হবে, জড়তা কম হলে ভর কম হবে, আবার ভর বেশি হলে তাকে ত্বরাণিত করতে বেশি বল লাগবে (নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী)।


চিত্র ৫: নিউটনের হাতে লেখা একটি গণনা

এখন প্রশ্ন হল বস্তুর জড়তার উৎস কী? নিউটনের পক্ষে এর উত্তর দেয়া সম্ভব ছিল না, কিন্তু নিউটন পরম স্থান বা দেশ (absolute space) সম্পর্কে একটি এক্সপেরিমেন্টের কথা বলে গিয়েছেন, যাকে আমরা নিউটনের বালতি (bucket) পরীক্ষা নামে চিনি, যেটির ব্যাখ্যা দিতে মহাবিশ্বে জড়তার উৎস প্রসঙ্গটি আসে। বালতি পরীক্ষার ব্যাখ্যা দিতে আইনস্টাইনকে বেশ ভাবতে হয়েছিল এবং মনে হয় এর প্রকৃত কার্যকারণ এখনো আমরা পুরোপুরি জানি না। বাকেট বা বালতি পরীক্ষার বর্ণনা দেবার আগে বলি নিউটনের কাছে স্থান বা দেশ ছিল absolute। absolute-এর বাংলা পরম, নিরঙ্কুশ, অনপেক্ষ বা সার্বভৌম হতে পারে। এই ক্ষেত্রে অনপেক্ষ কথাটি আমরা গ্রহণ করতে পারি, ‘অনপেক্ষ স্থান’ অন্য কোনো কিছুর ওপর নির্ভর নয়।

নিউটন জড়ত্বীয় রেফারেন্স কাঠামোর (inertial reference frame) ধারনাটির কথা উল্লেখ করেছেন, যে কাঠামোগুলি হয় স্থির থাকে নয় সমবেগে সরলরেখায় ভ্রমণ করে, এবং যেখানে নিউটনের বলবিদ্যার সূত্রগুলি কার্যকর হয়। সমস্যা হল এই জড়ত্বীয় কাঠামো কিসের তুলনায় স্থির বা সমবেগে ভ্রমণ করছে সেটা আমরা জানি না। নিউটনের জন্য এগুলো স্থির বা সমবেগে চলছে ‘অনপেক্ষ’ স্থানের তুলনায়। নিউটনের ভাষায় – অনপেক্ষ দেশ বা স্থানের প্রকৃতি (বা বৈশিষ্ট্য) হল, কোনো কিছুর সাপেক্ষ ব্যতীত, সেটি থাকে সবসময় সদৃশ ও অনড়। অনেপক্ষ সময় নিয়েও নিউটনের এরকম একটি ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু ‘সবসময় সদৃশ ও অনড়’ বলতে তিনি ঠিক কী বুঝিয়েছেন সেটা বিশেষ বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। নিউটন নিজে এই সমস্যা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন এবং এই জন্য প্রিনসিপিয়া বইটির সমস্ত স্বতঃসিদ্ধ, সম্পাদ্য, প্রমাণ ও অনুসিদ্ধান্ত ‘আপেক্ষিক’ স্থান/দেশ ও সময়ের ওপর ভিত্তি করে গঠন করেছেন।

‘অনপেক্ষ স্থানের’ ব্যাপারে নিউটন এই বালতি এক্সপেরিমেন্টের সুপারিশ করেছেন। সেটি হল এরকম। মনে করুন একটি বালতি (সেটির হাতল মারফৎ) একটি দড়ি দিয়ে ঝুলানো, বালতিটি জল দিয়ে অর্ধেক ভরা। এবার দড়িটা যদি একদিকে পাকিয়ে (বালতিটিও তার সাথে বহুবার পাক খাবে) তার আমরা ছেড়ে দিই তবে সেটি উল্টোদিকে জট ছাড়ানোর সাথে সাথে ঘুরবে, বালতিটিও ঘোরা শুরু করবে। বালতির জলের তল প্রথমে সমান থাকবে, কিন্তু ধীরে ধীরে বালতির ভেতরের দিকের দেয়ালের সঙ্গে ঘর্ষণের কারণে সেখানকার জলের কণা বালতির গতি পাবে। অন্যদিকে আমরা যত বালতির ভেতরের দিকে যাব সেই ঘর্ষণ কমে আসবে এবং সেখানে জলকণাদের গতি কম হবে। শেষ পর্যন্ত আমরা দেখব যে বালতির দেয়ালের পাশে জলের উচ্চতা বেড়ে গেছে এবং বালতির কেন্দ্রে কমে গেছে, অর্থাৎ জলের তলটি একটি বক্র আকার পাবে। দেয়ালের সাথে লাগানো জলকণাদের গতি ও বালতির গতি এক, অর্থাৎ তাদের আপেক্ষিক গতি শূন্য, আবার বালতিটি ঘুরতে শুরু করার আগেও তাদের আপেক্ষিক গতি ছিল শূন্য। কিন্তু পরীক্ষাটির শুরুতে জলের পৃষ্ঠ সমতল, আর পরীক্ষার শেষে জলের পৃষ্ঠ বক্র, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই জল ও বালতি-দেয়ালের আপেক্ষিক গতি হল শূন্য। কাজেই আমরা যেখানে বলছি সব গতি আপেক্ষিক সেখানে এই যে জলের ঘূর্ণন তাকে কার তুলনায় ‘আপেক্ষিক’ বলা যাবে? নিঃসন্দেহে বালতির দেয়ালের তুলনায় নয়, কারণ বালতিটির ঘূর্ণন গতি তো জলের সমানই। নিউটন এই ঘূর্ণনটিকে অনপেক্ষ স্থানের তুলনায় ঘূর্ণন বলেছেন। নিউটন বুঝেছিলেন যে, কোনো বস্তু যদি স্থান/দেশে সমবেগে ভ্রমণ করে সেটিকে বোঝার কোনো উপায় নেই, কিন্তু ঘূর্ণনের ব্যাপারে অনপেক্ষ স্থানের ধারণাটি তিনি আনতে চেয়েছিলেন। আপনারা যদি বালতি এক্সপেরিমেন্টের উপসংহারে বিভ্রান্ত বোধ করেন তাহলে আপনি একা নন, নিউটন পরবর্তী বহু বিজ্ঞানী নিউটন ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, তাঁরা যে এটাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন এমন নয়, কিন্তু এটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আরনেস্ট মাখ এবং আলবার্ট আইনস্টাইনের মত বিজ্ঞানীরা ইনারশিয়ার উৎস সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।


চিত্র ৬: নিউটনের বালতি পরীক্ষা

মনে করুন সারা মহাবিশ্বে কোনো বস্তু নেই শুধু বালতিটা ছাড়া। তাহলে কী জল বালতির দেয়াল বেয়ে উঠবে, সে কি নিউটনের বলবিদ্যার প্রথম সূত্র মানবে? অর্থাৎ যে জড়তা বা জাড্যর কারণে প্রথম সূত্র কার্যকারি সেটি কী আর কাজ করবে? আরনেস্ট মাখ বলেছিলেন একটি স্থানীয় বিন্দুতে যা ঘটছে তাতে মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা প্রভাব রাখছে, অর্থাৎ জড়তার উৎস হচ্ছে সামগ্রিকভাবে মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তুরা, তাঁর মতে মহাবিশ্বে যদি শুধুমাত্র একটি কণা থাকে তাহলে সেটির ভর হবে শূন্য, কারণ জড়তা সৃষ্টিকারি অন্য বস্তুরা সেখানে অনুপস্থিত। এটিকে ‘মাখের নীতি’ বলা হয় এবং আইনস্টাইন প্রাথমিকভাবে মাখের এই নীতিতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

বালতি পরীক্ষাটির বিকল্পে আর একটি সাধারণ এক্সপেরিমেন্টের কথা বলি যেটা আপনি সহজেই করতে পারেন। রাতের মেঘমুক্ত তারা-ভরা আকাশের নিচে বাড়ির ছাদে বা কোনো মাঠে যেয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে ঘুরতে থাকুন – দেখবেন আকাশের তারারা আপনার ঘোরার উল্টোদিকে ঘুরছে আর আপনার হাত দুটো দুদিকে উঠে যাচ্ছে। বিষয়টাকে এ’ভাবে দেখা যেতে পারে যে, আপনি ঘুরছেন না, মহাবিশ্বই আপনার চারপাশে ঘুরছে এবং সেটার প্রভাবে আপনার হাতদুটো ওপরে উঠে যাচ্ছে। এরকম যদি আসলেই হয়, অর্থাৎ মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তুরা আপনার চারপাশে ঘোরে, তবে আপনার হাতদুটির ওপরে উঠে যাবার সম্ভাবনা আছে, যদিও এটির পূর্ণ প্রমাণ আমরা করতে পারি নি। আইনস্টাইন অবশ্য দেখিয়েছিলেন যে একটি ঘুরন্ত বস্তুর খোলক সেটির কেন্দ্রে কোরিয়লি বলের মত একটি বল সৃষ্টি করবে এবং সেখানে একটি দোদুল্যমান পেন্ডুলামের দোলন-তল পরিবর্তন করবে। পরবর্তীকালে কার্ট গোডেল আর এক ধরণের গণনায়, ঘুরন্ত মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে দেখালেন যে, ব্যাপারটা অত সহজ নয় – অর্থাৎ এই সমস্যাটা এখনো অমীমাংসিত।

তাহলে কি জড়তা বা ইনারশিয়া আসলেই মহাবিশ্বের সমগ্র বস্তুসমূহের অস্তিত্বের ফলাফল? তাহলে মহাবিশ্বের স্থান যদি শূন্য হয়, অর্থাৎ তাতে কোনো বস্তু যদি না থাকে, এবং সেখানে আমরা একটি কণা রেখে দিই তবে সেটির ভর শূন্য হবে, কারণ ভর হল গিয়ে জড়তার পরিমাপক। আরনেস্ট মাখের উত্তর হবে শূন্য মহাবিশ্বে ইনারশিয়া বলে কিছু নেই, নিউটনের বলবিদ্যার সূত্র সেখানে অকার্যকর। অন্যদিকে হিগস কণা এবং ক্ষেত্র আবিষ্কারের পরে আমরা বলছি হিগস ক্ষেত্র কণার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে তাকে ভর দেয়, কিন্তু একটি শূন্য মহাবিশ্বে হিগস ক্ষেত্রর অস্তিত্ব থাকবে না, কাজেই সেই মহাবিশ্বে একটি কণার ভর শূন্যই হবে।

জড়তা নিয়ে এই বিস্তৃত আলোচনা পাঠকের মনে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করবে, কিন্তু আমি দেখাতে চাইছিলাম যে, নিউটন শুধুমাত্র তাঁর মহাকর্ষ সূত্র বা গ্রহগুলির উপবৃত্তাকার পথের বিশ্লেষণের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়, বরং আমাদের মহাবিশ্ব যে জড়ত্বের মহাবিশ্ব তা নিয়ে প্রাথমিক ভাবনা-চিন্তার জন্যও প্রাসঙ্গিক। এছাড়াও একটি অনুকল্পকে এক্সমেরিমেন্ট মাধ্যমে যাচাই করা, সেটিকে লিপিবদ্ধ করে বিজ্ঞান মহলে উপস্থিত করা, এই যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সেটি নিউটন পাকাপোক্ত করলেন। তাঁর বালতি এক্সপেরিমেন্টটি সেই ধারার একটি অন্যতম উদাহারণ যা কিনা তিন শ বছরের ওপর আমাদের চিন্তার খোরাক হয়ে রয়েছে। আর পৃথিবীর পথে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ নিউটনের বলবিদ্যার তিনটি সূত্রর জন্যই বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাই শুরুতে বলেছিলাম আমাদের মহাবিশ্ব নিউটনীয়।