এসো, এদিকটায়।
এই এখানটায় ছিলো নারকেল গাছের গুড়িটি। হারানি নানি এখানটায় বসে রোদ পোহাতো। দৃষ্টি থাকতো ভর দুপুরের চিক চিক করা অনির্ণীয় রঙ্গের জল আর রোদ্দুরের গর্বিত সংগমে। কি অত ভাবতো কে জানে! যে সব হারিয়েছে তার ভাবনায় কি থাকতে পারে আমার অজানা।

আমার হাত ধরো।
আজ তোমায় সমস্ত পুকুর ধারটি ঘুরে দেখাব।

তোমার ক্ষুদে পা যেখানটায় সেখানে কৃষ্ণচূড়া গাছের একটি ডাল নুয়ে থাকত।
সে ডাল ধরে মাতামাতি হতো আমাদের ক্ষুদে হাতের।

দেখছ না যে!

ছ’জন বসে খাবার জন্যে ভীষণ দামী এ ডাইনীং টেবিলটার শেষ প্রান্তে – ঘাটের প্রথম ধাপ।
মাত্র ছ’জন মানুষকে একসাথে ধারণ করার ক্ষমতা।
অথচ –
এই এক ঘাটে পুরো বাড়ির সব ছেলেপুলে ধরেও জায়গা রইতো।

আমার হাত ধরো।
ঘাটের শেষ ধাপটি সব সময় থাকতো পিচ্ছিল।
আমার হাত শক্ত করে ধরো।
একবার সেজদি ও জায়গায় পড়ে গিয়েছিল।
মায়ের সে কি বকুনী।

পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা দামের রাজকীয় চেয়ারটা দেখছ?
ওখানটায় একবার দাদা তার হাতে বানানো
ভেলা বেঁধে রেখেছিলো।

আরেকটু যাই?

এখনো ঘাটের ধাপে আছি। কি অদ্ভুত সুখময় জলের স্পর্শ!
এ-ই শুরু পুকুরতলার মাটির।
ওভাবে ঝুঁকে পড়ে কি দেখছে আমার সোনামনি?
ওগুলো সব ছোট মাছ।
এই পুকুর, নারকেল গাছ, কৃষ্ণচূড়ার ছায়া আর
বহু পুরনো ঘাটের মতন ওরাও তোমার আপন।
ওহ! বহুমূল্যে আমদানী কৃত কার্পেটের নকশা।

পায়ের তলায় কি ঠেকল?
মুন্নার সেই লাল জামা বাঁশের কঞ্চির সাথে এখনো লেগে।
মুন্নার লাল জামা, লাল রং-এর মখমলের সোফা।

আরেকটু যাই?
বাঁ পাশে জংলায় দেখো।
ওখানে মাছরাঙ্গা তার সভাবশীতল রঙ্গে আচরণে
এখনো অনড়। ওর গায়ের রং-এ নীল ছাওয়া।
নীল আকাশের রং।
এ জল আকাশকে বুকে ধরে রাখে। দেখো।
আকাশ শুয়ে আছে জলের বুকে। পুকুরের বুকে।

আবার সংঘর্ষ ছাদ আর দৃষ্টিতে। দৃষ্টি আর মেঝেতে।
আকাশের আর জলের যেখানে ছিল ছড়াছড়ি
এখন সেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ আকাশ ক্রয় বিক্রয়।
যত কম আকাশ আর জল দেয়া যায় মানুষ নামের প্রানীগুলোকে।
সব জমা রাখতে হবে। কেন কেউ জানে না।
এক মুঠো আকাশের দাম, এক ব্যালকনি আকাশের দাম- একটি পুকুর।

মাছরাঙ্গা দেখো মামণী। কি অকৃত্রিম সুন্দর!
মাছরাঙ্গা নয়? তবে কি?
বাঁ পাশের জংলায় তবে কি ওটা?
জংলায় জায়গা করেছে আশি হাজার টাকার মোনালিসার হাসি।
কি হয় এতো রহস্যভরা হাসি নিয়ে?
যে হাসির স্রষ্টা ডুব সাঁতার-ই জানলো না
তাকে কি রহস্য মানায়?

আরেকটু যাই।
তুমি ওখানটায় থাকো।
ওখান থেকে মায়ের সাঁতার দেখতে পাবে। যেমনটি আমি দেখেছিলাম এক সন্ধ্যেয়।
বড়দির আঁচল আর জল যখন অবিচ্ছেদ্য।
বড়দির ছলকে ওঠা হাসির ঝংকার।তার সাথে
ওপারে টিম টিম করে কুঁড়ে ঘরের বেড়ার ফোঁকর দিয়ে হেসে আসা আলো।
বড়দিরা সবাই অনায়াসেই ওপারে চলে যেত। আমার কখনো হলো না।
আরেকটু যাই।
এই ব্যালকনির দরজা পর্যন্ত এলেই আমি ঠাঁই হারিয়ে ফেলতাম।
পায়ের তলার মাটি হারিয়ে ফেলতাম।

কতবার যে ব্যালকনি পার হবার দুঃসাহস যুগিয়েছিলাম। কিন্তু
ঠাঁই হারাবার পর ভীষণ ভয়!
চারপাশে কোন কিছুকে আঁকড়ে ধরার আকুল চেষ্টা।
নারকেলের শুকনো পাতা ভিজে পিচ্ছিল হয়ে মাছের পিঠের মতন হয়ে গেছে।
নাকি ওই ছিল বোয়াল মাছের পিঠ?
কত মাছ! ক্ষুদে ক্ষুদে মাছ কাঁচের বাক্স ভরতি।
উনিশ হাজার টাকা দিয়ে কেনা চৌকনা বাক্সের ভেতরে একবার ওদিক আরেকবার এদিক করছে,
প্লাস্টিকের গাছের গায়ে লেজের ডগা ছুঁইয়ে দিয়ে।
পাড়ে দাঁড়িয়ে চুল শুকোচ্ছে জ্যাঠিমা।
দাদার কলা্র ভেলা ওই ভাসছে।
ভেলাটা একটু ধরবার জন্যে শরীরের সমস্ত অক্সিজেন ব্যয় করে আঁকুপাঁকু করছিলাম।

চলে এসেছি ব্যালকনিতে।
যেখানটায় ছিল তিনটে বাঁশ পোঁতা –ঠাঁই বোঝার জন্যে।
আর একটু গেলেই আবার ওপারে যাবার যাত্রা। একটু পা বাড়ালেই। সেই ছোটবেলায় ঠাঁই
হারাতাম। এখন নিশ্চয়ই পারব।
ওই টিম টিম আলো। সাঁতরে ক্লান্ত হয়ে ডুবতে গেলে সেই ভেলা। সেই পাড়ে দাঁড়ানো জ্যাঠিমা ঝাঁপিয়ে পড়া।
এক পা মাত্র…

“কার সাথে কথা বলছ রীনু?”
“আমার মেয়ের সাথে”
“আচ্ছা? ব্যালকনির পাশ হতে সরে এসো, আমিও শুনি কি কথা হচ্ছিলো”
“না”
“লক্ষীটি, তোমার শরী্রের এ অবস্থায় ব্যালকনির অত কাছে যেতে হয় না। সরে এসো। আমাদের অনাগত সন্তানের সাথে আমিও কথা বলি তোমার মাতৃ জঠরের পাশে বসে।“
“আজ আমি সমস্ত পুকুর ধার তাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছি।“
“বেশ তো।“
“দাদার বানানো ভেলা, সেই কৃষ্ণচূড়া, সেই বাঁ পাশের জংলা। ঘাটের প্রথম ধাপের শেষ, শেষ ধাপের শুরু সব দেখেছে ও!”
“তোমার শরীর এখন সুস্থ নয়। গর্ভবতী নারীদের এ সময়ে হরমোন ইমব্যালেন্স হতেই পারে। যার কারনে মানসিক ভাবে তুমি সুস্থ নও। বিছানায় শোবে চলো।“
“না। আর এক পা এগুলেই ওপারে যাবার সাঁতার। মামণি আমার ওপার দেখেনি। কারণ দেখিনি কখনো আমি। ওপাড়ের কোন মায়াময়, ছোট্ট একটি বাড়ি যা আমার বয়সের কারনে মনে হত রহস্যভরা? সাঁঝবেলা বাতি জালিয়ে সে কি ভাবত? আমাদের জলের দাপাদাপি শুনতে পেত? চাইতো কি এপাড়ের কলরবমুখর দৃশ্যের অংশীদার হতে? আমায় জানতে হবে রঞ্জু, জানতে হবে আমার মেয়েকে জানাতে।“
“সে কাল হোক? আজ তো ও সব-ই দেখেছে।আমাদের ছোট্টমনি ছোটবেলা হতেই সবুজ আর নীল চিনলো। শুধু পুকুরের ওপাড় বাকি। সে কাল হবে? ফিরে এসো রীনু।“
“সব দেখেছে? বাঁ পাশে ওটা কি রঞ্জু?”
“কি আবার? যেখানটায় মাছরাঙ্গা ঠাঁয় বসে থাকে তার খাবারের প্রতীক্ষায়।“
“উপরে আর নিচে তাকালে কি দেখা যায়?”
“দেখা যায় নীল চাদরে সাদা তুলির কাজ। পুকুর জলে আকাশ ছাড়া আর কি ডুবে থাকবে?”
“বাঁ পাশের জংলায় মাছরাঙ্গা নয় – মোনালিসার হাসি। উপরে তাকালে আকাশ নয় কংক্রিটের ছাদ দৃষ্টিকে চড় দিয়ে নিচে ধাবিত করে। হরমোন ইমব্যালেন্স আমার রঞ্জু, তোমার তো নয়।“
“তুমি স্বাভাবিক নেই। একটু শুয়ে থাকলে ভাল লাগবে।“
“আমার কন্যাকে গাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া অস্বাভাবিকতা। যে প্রকৃতির কারনে সে শ্বাস নেবে, সে সবুজের কাছে যাওয়া মানসিক অসুস্থতা। আমি, আমরা মেনে নিয়েছি এক ব্যালকনি আকাশ। তাকেও মেনে নিতে হবে শৈশব দিয়ে কৃত এ ন’তলা ভবন। তাকে মেনে নিতে হবে সাথীহারা, বন্ধুহারা এক কৈশর। যে কৈশরে তার সময় কাটবে যন্ত্রের মাধ্যমে একাকিত্ত ঘোচাতে না পারার অস্থিরতায়।“
“তোমার শরীরের এ অবস্থায় এসব ভাবতে হয়না রীনু। বিশ্রাম নেবে চলো।“
“কবে ভাবব বলতে পার? কবে আমাদের সন্তানেরা তাদের অস্তি্ত্বে প্রকৃতির প্রবেশ টের পাবে? জীবনের ব্যস্ততায় কবে বোধ করবে একটি গাছের অবদানের প্রতি সে কৃতজ্ঞ নয়? একটি নদীর গভীরতায় সে মুগ্ধ নয়?”
“আজ এসব থাক। তুমি আগে একটু সুস্থ হয়ে ওঠো। আমরা প্রতি মাসে গ্রামে বেড়াতে যাব আমাদের সন্তানকে নিয়ে। সঠিক বয়শে ও শিখবে প্রকৃতির মূল্য।“
“প্রকৃতির সৌন্দর্য, গভীরতা, তার অনুদান আমাদের বসবার ঘরের দামী show piece-এর মতন প্রদর্শনীয় বস্তু নয়! এ ভেতরে লালন করার এক প্রশান্তি। প্রকৃতির একাংশ হয়ে বাস করার অহংকার!”
“লক্ষী আমার, কিছুক্ষন পর আমাদের বন্ধুরা আসবে, অনেক আগ্রহ করে কেনা আমাদের সন্তানের জন্যে দামী সব উপহার নিয়ে। তুমি একটু বিশ্রাম নাও…”
“দামী উপহার! একটি গাছের চাইতেও দামী? বাতাসে গাছের পাতার হাসি আর নৃত্যের চাইতে? একা্ত্ববোধ শেখার চাইতেও? তবুও আমি সব উপহার হাসি মুখে বিনয়ী হয়ে গ্রহন করব। তার আগে, দামী উপহারের আগে আমার সন্তানকে জলের যে দাম হয়না সেটা বুঝতে দাও। শৈশব যে বিক্রীর নয় তা অনুভব করতে দাও। ছোট্ট একটি বেড়ার ঘরে কি করে এক পরিবারের সাতজন সদস্য অফুরন্ত হাসিতে দিন কাটায় সে মমতার মর্মার্থ বুঝতে দাও। রাতের বেলার টিমটিমে আলো পুকুরের এ পাড়ের ছোট্ট একটি মেয়েকে কিভাবে হাতছানি দিয়ে ডাকে সে তাকে নিজ হতে আবিস্কারের আনন্দটুকু পেতে দাও! আমায় যেতে দাও।“
“রীনু! আর এক পা এগুলে কি হবে বুঝতে পারছ? আর এক পাও সামনে দেবে না তুমি!”
“শুধু এক পা এগুলেই রঞ্জু, ওপারে যাবার যাত্রা। যা এ শতাব্দীর সবার কাছে ভীষণ রোমান্টিক আর সাপ্নিক – অথচ এই হবার কথা ছিলো ভীষণ বাস্তব সমস্ত মনুষ্য জাতির। এক পা এগুলেই আকাশের বুকে, যে শুয়ে আছে পুকুরের মধ্যিখানে জলের টলমলে বুকে। সেই পুকুর যার কাছে ভীড় করে আসা মানুষগুলো ছিল পুকুরের চারপাশের মতনই সবুজ, গহীন, আর আলো আঁধারে ভরপুর। সেই পুকুরের দাম এখন ন’তলা ভবন, সেই পুকুরের দাম অনেকের শৈশব আর তারুণ্য। এক পা এগুলেই রঞ্জু…”

রীনুর ওপার যাত্রা শুরুর এক পা দেবার আগেই রঞ্জু ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে। গভীর ভালবাসায় আঁকড়ে ধরে তাকে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়।
রঞ্জু ও রীনুর গভীরতর ভালবাসা হতে সৃষ্ট তাদের অনাগত সন্তান ও মায়ের শারীরিক এবং মানসিক সাস্থ্যের কথা ভেবে পরিবারের সবাই রীনুকে নিয়ে যায় একটি পর্যটন স্থলে। যেখানে আছে ভীষণ সুন্দর নদী, পরিস্কার আকাশ, পাখির কথা, চারপাশে উচ্ছল বাতাস আর গাছের চঞ্চল মাতামাতি।
বেশ কিছুদিন কেটে গেল।

একদিন ভীষণ প্রশান্তিতে চারপাশে তাকাতে গিয়ে অবাক হয়ে রীনু বুঝতে পারে সেও প্রতিক্ষায় আছে কবে নাগাদ এখানটায় হবে একটি ঝলমলে shopping mall, অথবা একটি বহুতলা ভবন যেখান হতে আবার কোন মা অন্য একটি শ্বাস নেবার ও দেবার জায়গা খুঁজে বেড়াবে। প্রতিক্ষা নাকি আতংক?