নির্জন রাত। একা একা। কেমন যেন লাগছিলো। আকাশে একটু মেঘের গর্জন ছিলো। ঝড়ো হাওয়ায় মনটা কেন উদাস হয়ে যায়। উদাস মনটাকে কীভাবে একটু ব্যস্ত রাখবো তা নিয়ে ভাবছিলাম।হাতে কোন বই নেই। তাই কম্পিউটার খুললাম। কী পড়বো?পত্রিকায় সর্বশেষ সংবাদ জেনে নেওয়ার জন্যে দৈনিক পত্রিকার ওয়েবসেইটে প্রবেশ করলাম। অনলাইন সংস্করণে সংবাদ শিরোনামগুলো পড়ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ বিদ্যূত চলে গেলো।বিদ্যূত চলে গেলে মেজাজটা কেমন হয় তা বলা মুশকিল। করার কিছুই নেই। বিদ্যূত উৎপাদনের ক্ষমতা আমার নেই। বিদ্যূত নেই। তাই কম্পিউটার বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

শুয়ে শুয়ে একাকী মনে বাধাবন্ধনহীনভাবে ভাবনার জগতে বিচরণ করছিলাম।কিন্তু তাও করতে পারলাম না।হঠাৎ করে পাশের বাড়ীর কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।এরপর ঘেউ ঘেউ শব্দটা সারা গ্রামের কুকুরদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। এক সময় ঘেউ ঘেউ থেকে সারা গ্রামজুড়ে কুকুররা ছন্দ শুরু করলো উ-উ-উ-উউ…সে এক ধরনের করুণ সুর।অনেকদিন পর কুকুরের এরকম করুণ ধ্বনি শুনতে পেলাম।কুকুরদের এরকম করুণ সুরে ফিরে গেলাম ছোটবেলার অনেক অতীতে। মনে পড়ছে ছোটবেলার সেই দুঃসময়ের অনেক কথা। সামরিক শাসনের কথা।

আমাদের দু’টো কুকুর ছিলো। একটা কালো। নাম হলো কালু। সে ছিলো খুব সাহসী।অন্যটা হলো লাল। নাম হলো লালু। লালু ছিলো একটু ভীতু ধরনের। কিন্তু ভীতু হলে কী হবে, পাহাড়ে চরম গন্ডগোলের সময় লালুই প্রথমে ঘেউ ঘেউ করে জানিয়ে দিতো আর্মিদের আগমণ বার্তা।লালুর ঘেউ ঘেউ শব্দের মধ্যে এক ধরনের টান ছিলো, সেটা শুনেই আমরা বুঝতে পারতাম আর্মি না অন্য কেউ আসছে।তখন ছোট ছিলাম। লালুর ‘অন্য ধরনের’ ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনলে ভয়ে ঘরের ভিতর গিয়ে চুপচাপ করে বসে থাকতাম।মা-বাবার নির্দেশ থাকতো আর্মি আসলে চুপচাপ করে থাকতে হবে। কোন কান্নাকাটি বা দৌঁড়াদৌড়ি করা যাবে না। আর্মির ভয়ে ‍কুঁকড়ে থাকতাম কখন কাকে কী করে বসে!তখন যুবকদের ঘরে থাকা নিরাপদ ছিলো না। জলপাই রঙের প্যান্ট পরা নিষেধ ছিলো। মনে পড়ছে, একদিন তো জলপাই রঙের প্যান্ট ছিলো বলে বড় ভাইকে আর্মিদের হাতে কতই না হেস্তনেস্ত হতে হয়েছিলো। ছাত্র হিসেবে পরিচয়পত্র ছিলো বলে মার খাওয়া থেকে কোনমতে রেহাই পেয়েছিলো।

আজ রাতের অন্ধকারে গ্রামের কুকুররা উ-উ-উ-উউ কান্না দিয়ে সে এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি করে ফেলেছে। মনটা খুব খারাপ লাগছিলো। মনে পড়ছে আমাদের সেই কালু ও লালুর কথা। তারা এখন ইহজগতে নেই। ২৫ বছর আগে শরণার্থী যাওয়ার সময় কালু ও লালুকে শুন্য ঘরে নীরবে ঘুমের মধ্যে পেছনে ফেলে রেখে গিয়েছিলাম। যেখানে নিজেদের জীবন বাঁচানো দায় ছিলো, সেখানে কীভাবে কালু ও লালুকে সঙ্গে নিয়ে যাই।তাছাড়া ওরা অবুঝ প্রাণী। পলায়নরত অবস্থায় বন-বাদারে তাদেরকে ঘেউ ঘেউ বা উ-উ-উ-উউ করা থেকে বিরত রাখা কোনভাবে সম্ভব হতো না। আর তাদের ঘেউ ঘেউ বা উ-উ-উ-উউ কান্না পলায়নরত লোকজনের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারতো। সে কারণে একান্তই নিজেদের মনের উপর অত্যাচার চালিয়ে চুপে চুপে কালু ও লালুকে ঘুমের মধ্যে ফেলে গিয়েছিলাম। আজ অনেক বছর পর গ্রামের কুকুরদের উ-উ-উ-উউ করুণ কান্না মনে করিয়ে দিচ্ছে কালু ও লালুর কথা। জানিনা, শুন্য ঘরে, জনমানবহীন গ্রামে কতদিন অনাহারে থেকে কালু ও লালুর মৃত্যূ হয়েছিলো। শুধু আমাদের কালু ও লালু নয়, গ্রামে আরো অনেক কুকুর ছিলো। সেই কুকুরগুলো কয়দিন না খেয়ে ছিলো সেকথা ভাবতেই মনটা হু হু করে উঠতে লাগলো। মনে খুব করে বেজে উঠতে লাগলো, কালু ও লালুও তো ঘেউ ঘেউ করে শত্রুদের আগমণ বার্তা আগে থেকেই জানিয়ে দিতো।আগাম সতর্কীকরণ করতো। তাদের ঘেউ ঘেউ’র কারণে তো অনেক শান্তিবাহিনী সদস্য ও কালেক্টর আর্মির কাছে ধরা খাওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিলো। জুম্ম জনগণের অধিকার আন্দোলনে কালু-লালুর মত অনেক কুকুরেরও তো আত্মত্যাগ ছিলো। লালু-কালুদের সেই অবদান কেউ কী কখনো স্মরণ করবে?মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। সে এক অবর্ণনীয় নস্টালজিয়া পেয়ে বসলো আমাকে।

চোখের সামনে কত স্মৃতি ভেসে উঠতে লাগলো। শরণার্থী জীবনের দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়তে লাগলো। স্টীলের থালায় শক্ত ও রসকষহীন দুর্গন্ধযুক্ত ভাত।কখনো এমন দিন গিয়েছিলো যেদিন একমুঠো ভাতের সাথে কেবল লবন আর লাল মরিচের বাটা জুটেছিলো।এভাবে শরণার্থী শিবিরে দিন কেটে গিয়েছিলো দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময়।শরণার্থী শিবিরে শক্ত শক্ত দু’মুঠো খেয়ে জীবন বাঁচিয়েছিলাম, কিন্তু কালু-লালুদের সেই শক্ত ভাতও জুটেনি। জনমানবহীন জনপদে অনাহারে মারা গিয়েছিলো। আজকে ভাবতে খুব কষ্ট লাগছে। চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো কালু-লালুদের কৌশলে চুরি করে ফেলে যাওয়ার স্মৃতি।এখন এ কাজটা খুব অমানবিক বলে মনে হচ্ছে।

আজকে গ্রামের কুকুরদের উ-উ-উ-উউ কান্না মনটাকে খুব ভারী করে দিলো। বিরস মনে শুয়ে শুয়ে “এক, দুই, তিন” করে গুণে গুণে মনটাকে একটু হালকা করার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় শুনতে পেলাম একজন লোক স্যান্ডেলের টাস্ টাস্ শব্দ করে উঠান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর স্বগতোক্তির মত করে বলে যাচ্ছে, “মগদাউনর বাড়াবাজ্জ্যা হামানি থুম ন অব আর। অল্প বয়স্যা এক্কো গাবুজ্জ্যা মরদরে হুত্তুন ধুরি আনিলাক হিজেনি। হি গরন্দোই ভগবান জানে” (হারামজাদাদের বাঁদরামির কাজগুলো আর শেষ হবে না। কী জানি, অল্পবয়সী এক যুবককে কোথা থেকে ধরে নিয়ে এসেছে। ভগবান জানে, তার ভাগ্যে কী আছে)।

ঐ লোকটার কথা শুনে হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বুঝতে আর বাকী রইলো না কেন কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠেছিলো। তারপর ঘেউ ঘেউ থেকে উ-উ-উ-উউ করে করুণ সুরে কান্না শুরু করে দিয়েছিলো সারা গ্রামজুড়ে। কুকুরের এই কান্না শুনে আজ এই অধম অডঙের মনে আরো একটি প্রশ্ন জাগলো – মানুষ হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কী তাহলে কালু-লালুর মত কুকুরদের চেয়েও অধম? আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে কী প্রভুভক্ত কুকুরা মানুষের দুঃখগুলো বুঝতে পারে? মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো।


এখানে ঐ লোকের নাম দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তার কাছ থেকে যা জানা গেলো, তা হলো রাঙামাটির লেকের পাড় থেকে এক যুবককে ধরে নিয়ে টেক্সিতে করে কোন এক জায়গায় নামানো হয়েছে। আর গ্রামের ভেতর দিয়ে ঐ যুবককে কোন এক অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঐ যুবকের নাম ঠিকানা কেউ জানে না, কেউ চিনে না। তার ভাগ্যে কী ঘটবে তা বলাও কঠিন। রাতের অন্ধকারে এরকম ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। কারোর জানার কথা নয়। আর কখনো পত্রিকায় এরকম ঘটনা প্রকাশিত হবে বলেও মনে হয় না। জানি না, পাহাড়ে এরকম আরো কত ঘটনা ঘটছে? কেউ কী এসব ঘটনার তদন্ত করবে?

আর এরকম অপহরণ ও খুনোখুনি ঘটনার কুশীলব কারা? অপ্রিয় হলেও চরম সত্য হলো জেএসএস বনাম ইউপিডিএফ।কে ভালো? জেএসএস নাকি ইউপিডিএফ? ভাবতে কষ্ট লাগছে, তারা নাকি জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করে। কার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে তারা এসব অপহরণ ও খুনোখুনি করছে?

ভাদ্রমাসে কুকুরের উ-উ-উ-উউ কান্না আর সেই কান্নার সাথে অপহরণের সংবাদ মনটাকে খুব ভারী করে দিলো। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না।এমন সময় বিদ্যূত চলে এলো।

আবার কম্পিউটার খুললাম। ফেসবুকে গেলাম।সিএইচটিবিডি’ গ্রুপের অপঠিত বার্তাগুলো প্রথমে চোখে পড়লো। কতজনের কত কিসিমের কথা। জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর লোকজন বা সমর্থকদের কথা তো কী আর বলার আছে! জাতি প্রেম, দেশপ্রেম কেবল ওদের আছে। আমাদের কিছুই নেই। ইচ্ছে হলো, কড়া ভাষায় কিছু মন্তব্য দিই। না, পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলাম শ্রদ্ধেয় বনভান্তের উপদেশবাণী স্মরণ করে। পরম শ্রদ্ধেয় ভান্তের অমিয়বাণী হলো “পরধর্ম চর্চা হতে বিরত থাকো”। এর অর্থ হলো, হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, মোহ ইত্যাদি হতে বিরত থাকতে পারলে পরম শান্তি পাওয়া যায়।জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর লোকজন পরধর্ম চর্চা করছে বলে তাদের মত আমারও করতে হবে কেন? “তুমি অধম হলে আমি উত্তম হইবো না কেন?” তাই ফেসবুক স্ট্যাটাসে আর কড়া ভাষায় কোন কিছু লিখতে পারলাম না।

নেতিবাচক চিন্তা বাদ দিয়ে ইতিবাচকভাবে কোন মন্তব্য ফেসবুকে লেখা যায় কী না তা ভাবতে লাগলাম।কিন্তু কিছুতেই ঐ লোকটার “মগদাউনর বাড়াবাজ্জ্যা হামানি থুম ন অব আর” (হারামজাদাদের বাঁদরামির কাজগুলো শেষ হবে না) কথাটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিলাম না। এটাই সত্য, আমরা যা বলি না কেন, শেষ পর্যন্ত সন্ত লারমা ও প্রসিত খীসা এক হতে না পারলে জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর বাঁদরামি কখনো শেষ হবে না।সেজন্যে তাদের দু’জনকে পাশাপাশি দেখতে খুব মন চাচ্ছে। বাস্তবে সেটা এখন সম্ভব না হলেও কল্পনা করতে অসুবিধা কী? ছবি এঁকে দেখাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ছবিও আঁকতে পারি না। তাই আমার ফেসবুক স্টাট্যাসে লিখলাম। স্ট্যাটাসের ভাষা ছিলো অনেকটা এরকম,

“কেউ কী একটা ছবি আঁকতে পারবেন সন্তু লারমা আর প্রসিত বি. খীসা কোলাকুলি করছেন।ফটোশপেও করা যাবে। দু’জনে কোলাকুলি করছেন – এরকম একটি ছবি দেখে দেখে লেখা লিখতে ইচ্ছে করছে”।

ব্যক্তিগতভাবে আমার যদিও কিছুই হয়নি, তারপরেও কোন তরুণ যুবকের অপহরণের ঘটনা শুনে মনটা খুব ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। চোখের সামনে একটা চিত্র ভেসে উঠতে লাগলো কীভাবে ওরা ঐ যুবককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা কারা? ওরা আর কেউ নয়, আমাদের জুম্মসমাজেরই লোক।শুধু লেবেল আঁটা আছে ওরা জেএসএস কর্মী ও ইউপিডিএফ কর্মী। যুবক অপহরণের এই ঘটনার সাথে পুরনো স্মৃতি জেগে উঠছে। ওরা আড়াই দশক আগে লাম্বা-বাদিতে ভাগ হয়েছিলো। লাম্বা-বাদিতে বিভক্ত হয়ে ওরা তখন কত মানুষ মেরেছিলো কখনো সন্দেহের বশে, আর কখনো “লাম্বা” সমর্থক কিংবা “বাদি” সমর্থক হিসেবে দায়ী করে। পরিস্কার করে মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি, একদিন শান্তিবাহিনীর “লাম্বা” গ্রুপের একদল সৈনিক কীভাবে আমাদের পাশের গ্রামের এক মুরুব্বিকে (তিনি জেএসএস প্রতিষ্ঠার পরে গ্রামপঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ছিলেন, গ্রাম সংগঠক ছিলেন) আমাদের বাড়ীর ‘ইজরের’ (মূল বাড়ীর সাথে সংলগ্ন মাচার মত উঁচু প্লাটফর্ম) পাশ ঘেঁষে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলো। তখন ছোট বালক ছিলাম। সন্ধ্যাবেলায় ইজরে বসে হাওয়া খেতে খেতে সেই দৃশ্যটা দেখেছিলাম।ঐ মুরুব্বীকে কোথায় নেওয়া হয়েছিলো আত্মীয় স্বজন কিংবা অন্য কেউ তা জানে না।তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি। সেই “লাম্বা-বাদির” পরে এখন হলো জেএসএস বনাম ইউপিডিএফ। জেএসএস-ইউপিডিএফ “লাম্বা-বাদি”র মত পরস্পরকে খুন করছে, রাতের অন্ধকারে অপহরণ করছে, চাঁদাবাজি করছে, মুক্তিপণ আদায় করছে। মিলিটারিদের মত জঘন্য কাজ করে যাচ্ছে। এসব কথা ভাবতেই মনটা আরো ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। অবশেষে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখে ঘুমুতে গেলাম।

একদিন পরে ফেসবুক খুলে দেখি আমার দেওয়ালে একটা ছবি ট্যাগ করে দেওয়া হয়েছে। ফেসবুক বন্ধু আবালা চাকমা করেছেন। তিনি আমার স্ট্যাটাসের বার্তা অনুসারে সন্তু লারমা ও প্রসিত বি. খীসার মধ্যে কোলাকুলির ছবি দিয়েছেন (দেখুন ছবি ১)। ছবির জন্যে আবালাকে আগেভাগে ধন্যবাদ জানিয়ে রাখি।

ছবি ১ সন্ত লারমা ও প্রসিত বি. খীসা। সৌজন্যে আবালা চাকমা

ছবির নীচে বেশ কয়েকজন বন্ধু মন্তব্য দিয়েছিলেন।তাদের মধ্যে ফেসবন্ধু শিবচরণ মন্তব্য করেছিলেন, “এক সময় তারা এরকম ছিলেন”। এছাড়া ইউপিডিএফ-এর এক সময়ের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ও বর্তমানে সুইজারল্যান্ড প্রবাসী সঞ্চয় চাকমাও মন্তব্য দিয়েছিলেন। তিনিও জোর দিয়ে বলেছেন, জুম্মজাতির অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। তিনি আরো বলেন, শুধু অডঙ চাকমাদের কল্পনায় নয়, বাস্তবে কীভাবে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে তা নিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।তার সাথে কোন দ্বিমত নেই।

পাঠকবন্ধুরা, এখন আপনারাই বলুন, এ ছবিগুলো দেখে আপনাদের কেমন অনুভূতি জাগছে?

তবে আমার মনে হয়েছিলো, প্রথম ছবিটা নিয়ে আরও কাজ করার দরকার ছিলো। কিন্ত আমি প্রযুক্তি ব্যবহারে বড়ই “সেদামপাঞ্জা” (অদক্ষ) সেটা কীভাবে বুঝাই (আশা করি বন্ধুবর সেদামপাঞ্জা চাকমা তার নামটা ব্যবহার করলাম বলে কিছু মনে করবেন না)। তাই ফেসবুকবন্ধু আবালা চাকমাকে আবারো অনুরোধ করলাম ছবিটাকে আরো একটু বাস্তবভিত্তিক করা যায় কী না। যেই কথা সেই কাজ। আবালা চাকমা আমার অনুরোধ রেখেছিলেন। তিনি পরপর কয়েকটা ছবি পাঠিয়ে দিলেন। পাঠক বন্ধুরা আগে ছবিগুলো দেখে নিন। কোন প্রতিক্রিয়া থাকলে ফেসবুকের মাধ্যমে অথবা ব্লগের মাধ্যমে জানাতে পারেন।

ছবি ২ এসো গাই, চলো আমরা বদলে যাই…। সৌজন্যে আবালা চাকমা

ছবি ৩ রাজনৈতিক ক্লাশ। বিষয়ঃ পূর্ণস্বায়ত্তশাসন ও চুক্তিবাস্তবায়ন। সৌজন্যে আবালা চাকমা

ছবি ৪ ধঙে, কাকা, আর ছিনিমিনি খেলা নয়, চলো জনতার কথা শুনি
সৌজন্যে আবালা চাকমা

বন্ধুরা, আসুন এখন ছবির জগত থেকে বাস্তব জগতে ফিরে যাই। শুরুতে আমাদের কালু-লালু ও গ্রামের কুকুরদের কান্নার কথা বলেছিলাম। তারপর বলেছিলাম জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর “বাড়াবাজ্জ্যা” কাজের কথা।কেন তাদের এই “বাড়াবাজ্জ্যা” (বাঁদরামি)কাজ? তাদের এই “বাড়াবাজ্জ্যা” কাজ দিয়ে কার লাভ? কবি ও ফেসবুক বন্ধু প্রতিভাস তার “তবুও স্বপ্ন বুনি” কবিতায় প্রশ্ন রেখেছেন,

“দুনিয়াজুড়ে হানাহানি, তা পাহাড়ে ভাইয়ে ভাইয়ে
বুঝি না বুঝতে চাও না, কী লাভ এই রক্তোক্ষয়ে?”

রক্তক্ষয় হচ্ছে, মানুষের জীবন ক্ষয় হচ্ছে, তবুও জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর কোন হুঁশ হচ্ছে না। থেমে থেমে মারামারি করে, খুনোখুনি করে। ফেসবুকে চোখে পড়ে, জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর অনেক নেতা, আন্ডানেতা ও সমর্থক তাদের মধ্যেকার এই “বাড়াবাজ্জ্যা” কাজকে আদর্শগত দ্বন্দ্ব হিসেবে চালিয়ে দিতে চান। এসব অস্পষ্ট বুলির মাধ্যমে মারামারি, খুনোখুনি ও অপহরণের মত জঘন্য কাজগুলোকে তারা জায়েজ করতে চান। তাদের মধ্যেকার এই দ্বন্দ্ব আসলে কী আদর্শিক নাকি সম্পূর্ণ ভাঁওতাবাজী? পাঠকবন্ধুরা, তাহলে চলুন সন্তু লারমা ও প্রসিত বি. খীসার রাজনৈতিক ক্লাশে অংশগ্রহণ করি তারা জেএসএস ও ইউপিডিএফ সম্পর্কে কী বলেন। (তার আগে রেফারেন্স হিসেবে ৩ নং ছবিটা দেখে নিন)।

জেএসএস সম্পর্কে সন্তু লারমা’র লেকচার

পাঠকবন্ধুরা, মনে মনে কল্পনা করুন, আপনারা এখন সন্তু লারমার লেকচার শুনছেন। তিনি শুরু করেছেন এভাবেঃ জুম্মজনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জেএসএস ’৭২ সালে মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়…। তার কথার মধ্যে তাকে থামিয়ে দিয়ে ফেসবুক বন্ধু আবালা চাকমা প্রশ্ন করতে চাইলেন। বললেন, “এক্সকিউজ মি স্যার! আমি কী প্রশ্ন করতে পারি?”

সন্ত লারমাঃ লেকচার শুরু না করতে প্রশ্ন কেন?

আবালাঃ না, মানে স্যার…!

সন্তু লারমাঃ না, মানে কী?

আবালাঃ স্যার, আগে আমাদের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে যদি আপনার লেকচার শুরু করতে পারতেন?

সন্তু লারমাঃ তুমি কী বলতে চাচ্ছো?

আবালাঃ স্যার, না মানে…

সন্তু লারমাঃ মানে কী?

আবালাঃ স্যার, মানে… মানে…জেএসএস জুম্মজনগণের জন্যে কী রকম সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়? মানে, জেএসএস-এর চূড়ান্ত লক্ষ্য কী সে ব্যাপারে যদি আগে ধারনা দিতেন…।

সন্তু লারমাঃ বুঝছি, তুমি বসো।

এর মধ্যে অনেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ স্যার, আবালার সাথে আমরা একমত। জেএসএস সম্পর্কে আমরা তেমন কিছু জানি না।পার্টির কর্ণধার হিসেবে জেএসএস আমাদের জুম্মজনগণের জন্যে কী রকম সমাজের স্বপ্ন দেখাতে চায় সে ব্যাপারে যদি আগে বলেন, তাহলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে”।
“আচ্ছা, ঠিক আছে”।এই কথা বলে সন্তু লারমা একজনকে দিয়ে গঠনতন্ত্রের একটা কপি আনালেন। গঠনতন্ত্র থেকে জেএসএস-এর মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্তু লারমা পড়ে শোনাচ্ছেন।

জেএসএস-এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলোঃ

১. সমতাভিত্তিক শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা;
২. পার্বত্য চট্টগ্রামের বহুভাষাভাষি ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের মধ্যে ভেদাভেদ, নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চণা দূর করা;
৩. জুম্মজাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা;
৪. সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ জুম্মজনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করা;
৫. পার্বত্য চট্টগ্রামের বহুভাষাভাষি জাতিসত্তাসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষা করা;
৬. পার্বত্য চট্টগ্রামে অগণতান্ত্রিক ও সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব পরিহার করা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ, মৌলবাদ ও সম্প্রসারণবাদ প্রতিরোধ করা;
৭. সমাজে নারীদের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তিসংগ্রামে নারীদের সংগঠিত করা।

জেএসএস-এর আদর্শ ও নীতি

জেএসএস-এর মূল আদর্শ হলো মানবতাবাদ। আর এই আদর্শ পাঁচটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিতঃ
১. জাতীয়তাবাদ;
২. গণতন্ত্র;
৩. ধর্মনিরপেক্ষতা;
৪. সমতা; ও
৫. সামাজিক ন্যায়বিচার।

(তথ্যসূত্র হিসেবে জেএসএস-এর ওয়েবসাইট দেখুন http://www.pcjss-cht.org/aimsandobjectives.php)।

জেএসএস সম্পর্কে সারসংক্ষেপ ও কিছু প্রশ্ন

সন্তু লারমা জেএসএস লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও আদর্শ সম্পর্কে বক্তব্য দিয়ে মঞ্চ থেকে অন্য কাজে চলে গেলেন। তবে তার বক্তব্য সারসংক্ষেপ করলেন উবচুলো চাকমা এভাবেঃ

“এখানে সন্তু লারমা জেএসএস-এর সাতটি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। তাদের মধ্যে কোনটা চূড়ান্ত লক্ষ্য (কী রকম সমাজ ব্যবস্থা কাম্য) আর কোনটা আশু লক্ষ্য (যা নিকটতম সময়ে অর্জন করা যায়) সে ব্যাপারে স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে সময়ের দূরবর্তীতা আর নিকটবর্তীতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথমটাই হলো জেএসএস-এর চূড়ান্ত লক্ষ্য। অর্থাৎ জেএসএস-এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো “সমতাভিত্তিক শোষণহীন” সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এমন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানবতাবাদের কথা বলা হয়েছে। জেএসএস-এর মানবতাবাদ পাঁচটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, যেমন, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা, সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, জেএসএস “সমতাভিত্তিক শোষণহীন” সমাজ বলতে কী বুঝাতে চায় এবং সমতাভিত্তিক শোষণহীন সমাজের মানদন্ডগুলো কী কী? কীভাবে সমতাভিত্তিক শোষণহীন জুম্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে? জেএসএস-এর মূল কর্মসূচীগুলো কী কী? তাদের সেসব কর্মকান্ডে তাদের কথিত মানবতাবাদের পাঁচটি নীতি কীভাবে প্রয়োগ করা হয় কিংবা বাস্তবে তারা সেসব নীতি প্রয়োগ করেন কী?

ইউপিডিএফ সম্পর্কে প্রসিত বি. খীসার লেকচার

সন্তু লারমা চলে যাওয়ার পর ইউপিডিএফ প্রধান প্রসিত বি. খীসা মঞ্চে এলেন। মাথায় একটা ক্যাপ। তার বক্তব্যের পালা শুরু হলো। তিনি আঙুল উঁচিয়ে বক্তব্য দেওয়া শুরু করলেন। বললেন, “সংগ্রামী বন্ধুরা, আজকে জুম্মজাতি এক মহাসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে।কেন এই করুণ অবস্থা? এই করুণ অবস্থার পেছনে জেএসএস-এর “আপোসচুক্তি” দায়ী। জেএসএস জুম্মজাতির সাথে বেঈমানী করে চুক্তি স্বাক্ষর করে সরকারের কাছে আত্মসমর্পন…”। প্রসিত বাবু বাক্যটা শেষ করতে পারেননি। আবালা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “প্রসিত দা, আপনার কাছ থেকে এরকম উত্তেজক লেকচার শুনতে আসিনি। ইউপিডিএফ জুম্ম জনগণের জন্যে কী রকম সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় সে ব্যাপারে শুনতে এসেছি।”

প্রসিত খীসাঃ লেকচার তো শুরুই করতে পারলাম না। আমাকে থামিয়ে দিলেন…

আবালাঃ না, মানে…দাদা, শুনেন, আপনি যা বলছেন সেসব তো অনেক শুনেছি। এখন শুনতে চাচ্ছি, আপনাদের ইউপিডিএফ-এর চূড়ান্ত লক্ষ্য বা রূপকল্প কী? মানে, আপনারা আমাদের জন্যে কেমন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেন, আর আপনাদের পার্টির নীতি-আদর্শ কী সেসব ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে বললে আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে”।

প্রসিত খীসাঃ পার্টির জন্মের ইতিহাস না বললে তো আপনাদের জানা সম্পূর্ণ হবে না…

আবালাঃ না, না, প্রসিত দা, ইউপিডিএফ কখন, কীভাবে গঠিত হয়েছে সেসব ব্যাপারে তো অনেক কথা বলেছেন আপনাদের নেতারা… মানে, কিছু মনে করবেন না…রাজনীতির মঞ্চে যেভাবে গলাবাজি করে বক্তব্য দেন ঠিক সেরকম বক্তব্য নয়। শ্রেণী কক্ষে শিক্ষকরা যেভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়া বুঝিয়ে দেন, ঠিক সেভাবে আমাদের মত অশিক্ষিত জুম্মজাতিকে আপনার পার্টি ইউপিডিএফ-এর চূড়ান্ত লক্ষ্য কী, জেএসএস-এর চেয়ে আপনারা জুম্ম জাতির জন্যে ভিন্ন কিছু কী কী দিতে চাচ্ছেন, আপনাদের পার্টির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও আদর্শ কী – এসব ব্যাপারে যদি আগে বলতেন, তাহলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে।

প্রসিত খীসাঃ ওহ! বুঝছি।

এরপর প্রসিত বি. খীসা তার পকেট থেকে ছোট্ট একটা লাল নোটবুক বের করলেন। তারপর ইউপিডিএফ সম্পর্কে লেকচার শুরু করলেন।

ইউপিডিএফ-এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যঃ

ইউপিডিএফ-এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো “পূর্ণস্বায়ত্তশাসন কায়েমের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষা করা এবং শোষণ-নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ ইউপিডিএফ-এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলোঃ

১. পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষা করা; এবং
২. শোষণ-নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।

ইউপিডিএফ-এর কর্মনীতি ও পদ্ধতি (principle and style of work)

ইউপিডিএফ তার সকল কর্মকান্ডে নিম্নোক্ত নীতিগুলো অনুসরন করবে।
১. সকল জাতির মধ্যে সমতা;
২. নারী পুরুষের মধ্যে সমতা;
৩. অসাম্প্রদায়িকতা; ও
৪. গণতান্ত্রিক আদর্শ

প্রসিত খীসা আরো বললেন, ইউপিডিএফ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। অর্পিত শত্রু সম্পত্তি আইনসহ যে কোন কালাকানুন বাতিলের দাবী জানাবে। এছাড়া দলের কার্যক্রম চালাতে গিয়ে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বাসিন্দার সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাবে। দেশে সকল নাগরিকের অধিকার ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তারা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলগুলোর সাথে কাজ করবে (তথ্যসূত্র: ইউপিডিএফ-এর ওয়েবসাইট: http://www.updfcht.org/menifesto.html)।

ইউপিডিএফ সম্পর্কে সারসংক্ষেপ ও কিছু প্রশ্ন

প্রসিত খীসাও তার বক্তব্য শেষ করে তাড়াতাড়ি মঞ্চ ছেড়ে চলে গেলেন।কারণ, তারও অন্য জরুরী কাজের তাড়া আছে। তাই নোনাহাজি হেডম্যান জনভীড় ঠেলে এসে উপস্থিত সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে প্রসিত খীসার বক্তব্যের সারসংক্ষেপ তুলেন ধরলেন আর কিছু প্রশ্ন রাখলেন। তিনি বললেন এভাবেঃ

“প্রসিত বি. খীসার কথা অনুসারে ইউপিডিএফ চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষা করা এবং শোষণ-নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে হিসেবে “পূর্ণস্বায়ত্তশাসন”-এর কথা বলছেন। সন্দেহ নেই, তাদের পার্টির লক্ষ্য হলো আদর্শিক (idealistic) বা কাংখিত।

কিন্তু কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে। ইউপিডিএফ “জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষা” আর “শোষণ-নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ” বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছে? কী কী শর্ত বা মানদন্ড থাকলে পরে বুঝবো “জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষা” হবে? কীভাবে “শোষণ-নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ” প্রতিষ্ঠিত হবে?

“পূর্ণস্বায়ত্তশাসন” বলতে ইউপিডিএফ কী বুঝাতে চাচ্ছে? পূর্ণস্বায়ত্তশাসন-এর রূপরেখা বা ক্ষমতার পরিধি কী রকম হবে? তাদের “পূর্ণস্বায়ত্তশাসন” প্রতিষ্ঠা করতে দলের কী কী কর্মসূচী এবং কৌশল কী কী আছে? ইউপিডিএফ যে চারটি নীতির কথা বলেছে, সেগুলো তাদের কাজে কর্মে কীভাবে প্রয়োগ করা হয় কিংবা আদৌ প্রয়োগ করা হয় কী? বাস্তব কোন উদাহরণ দেখাতে পারবেন কী কোথায় কীভাবে তারা তাদের নীতিগুলোর সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন?
এ লেখার শেষ প্রশ্নঃ জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য আছে কী? তারা তাদের নীতি-আদর্শ মানে কী?

পাঠক বন্ধুরা, আপনারা জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা ও ইউপিডিএফ প্রধান প্রসিত খীসার লেকচার থেকে তাদের পার্টির মূল লক্ষ্য ও নীতি আদর্শ সম্পর্কে জানলেন। এখন আপনারা দেখুন, দুই দলের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য আছে কী? তাদের গঠনতন্ত্র অনুসারে, জেএসএস-এর মূল লক্ষ্য হলোঃ সমতাভিত্তিক শোষণহীন সমাজ (জোর দেওয়া হয়েছে) প্রতিষ্ঠা করা। আর ইউপিডিএফ-এর মূল লক্ষ্য হলোঃ সকল জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষা করে শোষণ-নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ (জোর দেওয়া হয়েছে)। লক্ষ্য করুন, জেএসএস “সমতাভিত্তিক শোষণহীন” বিশেষণ ব্যবহার করেছে আর ইউপিডিএফ ব্যবহার করেছে “শোষণ-নির্যাতনমুক্ত”।দুই দলের আকাংখার মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য আছে কী?

এখন তাদের নীতি-আদর্শ লক্ষ্য করুন। জেএসএস-এর আদর্শ মানবতাবাদ। এই মানবতাবাদ পাঁচটি নীতি – “জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার” –এর উপর প্রতিষ্ঠিত। খুব সুন্দর কথা। অন্যদিকে, ইউপিডিএফ-এর নীতি হলো “সকল জাতির মধ্যে সমতা; নারী পুরুষের মধ্যে সমতা; অসাম্প্রদায়িকতা; ও গণতান্ত্রিক আদর্শ” । এগুলোও সুন্দর কথা। দু’দলই গণতন্ত্র মানে, অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে, সামাজিক ন্যায্যতায় বিশ্বাস করে।

দেখা যাচ্ছে, দু’দলের মূল লক্ষ্য, আদর্শ ও নীতি বিশ্লেষণ করলে তাদের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। শুধু ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় তাদের মৌলিক আকাংখাগুলো ব্যক্ত করা হয়েছে মাত্র। তাহলে তাদের মধ্যেকারে দ্বন্দ্বকে কেন আদর্শগত দ্বন্দ্ব বলা হচ্ছে? আদর্শের দোহাই দিয়ে জেএসএস-ইউপিডিএফ কেন খুনোখুনি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মারামারি ইত্যাদি জঘন্য কাজ করছে? কেনই বা জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর লোকজন, নেতা ও আন্ডানেতারা প্রশ্নহীনভাবে নিজেদের পার্টির অন্যায়গুলোকে মেনে নিচ্ছেন?

শেষ কথা

আরো অনেক কথা বলা যায়, অনেক প্রশ্ন করা যায়। লেখাটা অনেক লম্বা হয়ে যায়। তাই লেখা শেষ করার আগে, আবারো আমাদের কালু-লালুর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের কেবল অধিকারহারা জুম্ম জনগণ নয়, তাদের সাথে কালু-লালুর মত অনেক পশু-পাখীকেও জীবন দিতে হয়েছিলো অনাহারে, অর্ধাহারে। প্রভুভক্ত কালু-লালুরা দুর্যোগের ঘনঘটা দিনেও তাদের ঘেউ ঘেউ করে শত্রুবাহিনী মিলিটারিদের আগমণ বার্তা জানিয়ে দিতো। আজকে পাহাড়ের জনপদে রাতের অন্ধকারে জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর ধাওয়া-ধাওয়ি ও অপহরণের ঘটনায়ও কালু-লালুর উত্তরসূরীরা ঘেউ ঘেউ করে সতর্ক বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ অপহরণের নেপথ্য নায়কদের কোন বোধয় ঘটছে না, বিবেকের কোন দংশন হচ্ছে না। অথচ জুম্মভাইবোনের অকালমৃত্যু দেখে কালু-লালুর মত কুকুররা আজও উ-উ-উ-উউ সুরে অন্তহীন বেদনায় কান্না করে। মনে হয়, জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর লোকজনের মধ্যে সেই মানবিক অনুভূতি হারিয়ে গেছে। আদর্শ, নীতি কিংবা “আত্মরক্ষার” দোহাই দিয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বাঁচিয়ে রাখছে? জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর লোকজনের কোথায় বিবেক? কোথায় আদর্শ? আপনাদের গঠনতন্ত্রে উল্লেখিত নীতি-আদর্শগুলো কী মানুষ হত্যার অনুমতি দেয়? আর কত প্রশ্ন করবো!

নীতি আদর্শ যদি না মানেন, তাহলে সেগুলো গঠনতন্ত্রে লিখলেন কেন? যারা কথা ও কাজে সৎ নয়, তাদের কী বলা হয়? কার স্বার্থে এত অন্যায়, জঘন্য কাজ?

আর কয়দিন? কয়যুগ? তবে আমরা চুপ থাকতে পারি না। আমরা কথা বলি, আমরা প্রশ্ন করি। ফেসবুক বন্ধু ও কবি প্রতিভাস চাকমার সুরে আমিও জেএসএস-ইউপিডিএফকে প্রশ্ন করি, “বুঝি না, বুঝতে চাও না, কী লাভ এই রক্তোক্ষয়ে?” আরও প্রশ্ন করি, দুই দলের প্রধান সন্তু লারমা ও প্রসিত খীসা কী একসঙ্গে সুর ধরতে পারেন না, “চলো, আমরা বদলে যাই”।

অডঙ চাকমা, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১
……………………………………………….

কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ ছবিগুলোর সব কৃতিত্ব আবালা চাকমার। তাকে ধন্যবাদ।

দুঃখপ্রকাশঃ লেখার প্রয়োজনে অনেকের নাম এখানে উল্লেখ করেছি। আশা করি, তারা বিষয়টা নেতিবাচক হিসেবে নেবেন না। গল্পের উপস্থাপনা কিছুটা ছোটগল্পের ঢঙে হলেও বিষয় ও ঘটনা অবাস্তব নয়। কেবল কিছু চরিত্র অন্তর্ভুক্ত করে উপস্থাপন করা হয়েছে।