লিখেছেন শাহেদ ইকবাল

‘মহানবী মোহাম্মদের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র, পর্ব-২` পড়লাম। মুক্তমনা ব্লগে যে ধরনের যুক্তিপূর্ণ, প্রগতিবাদী ও বিশ্লেষণমূলক লেখা আশা করি, ভেবেছিলাম সে রকম একটা লেখা পড়ার সৌভাগ্য হবে। কিন্তু লেখাটি পড়ে ভীষণ হতাশ হয়েছি। আমরা জানি, মুক্তমনা ব্লগে লেখা প্রকাশের কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। এ সকল নীতিমালা যেমন সুস্পষ্ট, তেমনি স্বব্যাখ্যাত। যাঁরা এ ব্লগের লেখা পড়েন, তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করেন যে সেখানে এ সকল নীতিমালা অনুসরণ করা হবে। সেখানে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, উত্তেজক ভাষায় পরিপূর্ণ কিংবা বিদ্বেষমূলক ভঙ্গিতে কিছু লেখা হবে না। লেখায় যদি কোন যুক্তি প্রদর্শন করা হয়, সে যুক্তি হবে যতদূর সম্ভব হেত্বাভাস (Fallacy)মুক্ত। কিন্তু আলোচ্য লেখায় তার প্রতিফলন পাওয়া যায়নি। লেখাটিতে যুক্তির আড়ালে প্রচুর হেত্বাভাস (Fallacy), ভুল তথ্য, বিকৃত ও খণ্ডিত উদ্ধৃতি, অনুমাননির্ভরতা, স্ববিরোধিতা, সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও বিদ্বেষপূর্ণ ভাষার সমাবেশ ঘটেছে, যা নীতিমালার ২.৯, ২.১০ ও ২.১২ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। এছাড়া অতিরিক্ত বানান ভুলের কারণে লেখাটি ২.১৪ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রকাশযোগ্যতা পায় কি-না সে প্রশ্নও তোলা যায়। এ লেখায় এমন অনুচ্ছেদ খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেখানে ভুল বানান নেই। উদাহরণঃ গেছিলেন, ভ্রমন, খুজতে খুজতে, দারুন, কারন, খোজাখুজি, তাৎক্ষনিক, বর্ননা, আপ্রান, দোজক, অবতারনা, ব্যখ্যা, প্রান, টানাহেচড়া, দাড়ায়, গাজাখুরী, দুরত্ব, পৌছে, যতদুর, বন্দ, প্রানী, ধোকা, জঙ্গলাকীর্ন, দাড়িয়ে, লেগিছিল, মুহুর্ত, আপক্ষিক, উদাহরন, সাধারনত, বানী, সাব্যাস্ত ইত্যাদি। এই শব্দগুলো গোটা লেখাতেই আগাগোড়া ভুল বানানে লিখিত হয়েছে। বানান ভুলের সূচনা হয়েছে লেখার শিরোনাম দিয়েই। ‘ফুলের মত`-এর স্থলে লেখা হয়েছে ‘ফুলে মত`। আমার বর্তমান পর্যালোচনায় যেখানে যেখানে লেখককে উদ্ধৃত করেছি, সেখানে অবশ্য বানানগুলো শুদ্ধ করে নিয়েছি।

এখন আমরা দেখব এই লেখাটিতে কুটযুক্তি বা হেত্বাভাস (Fallacy), বিকৃত ও খণ্ডিত উদ্ধৃতি, ভুল তথ্য, অনুমাননির্ভরতা, স্ববিরোধিতা, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা প্রয়োগের কি কি প্রমাণ রয়েছে। প্রমাণগুলো নিচে তুলে ধরা হলোঃ

লেখক বলেছেন, এক রাতে মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের নিয়ে কাবা শরীফে অবস্থান করছিলেন। গভীর রাতে তিনি চুপি চুপি উম্মে হানি (তার চাচাত বোন)-এর বাড়ি হাজির হন। আরও বলেছেন, সে রাতে উম্মে হানির স্বামী বাড়ি ছিল না। এই তথ্যের সমর্থনে তিনি নিচের দু’টি  লিংক সূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেনঃ

(1)   http://ismaili.net/histoire/history03/history313.html

(2)   http://www.muhammadanreality.com/ascentionmiraj.htm

যে কেউ এ দুটি লিংক Click করলেই একটা ধাক্কা খাবেন। দেখবেন, লিংকে লেখা আছে একরকম আর লেখক বলছেন আরেক রকম। যেমন, প্রথম লিংকে উম্মে হানি বলছেনঃ ‘Just before dawn, the Prophet of God awoke us and we all prayed the dawn prayer together.` তার মানে কি? মুহাম্মদ (সাঃ) উম্মে হানিকে একলা জাগালেন না, উম্মে হানিসহ আরও কয়েকজনকে জাগালেন এবং তারা সবাই একত্রে ফযরের নামায পড়লেন। কিছু কিছু ইতিহাস গ্রন্থ থেকেও জানা যাচ্ছে, উম্মে হানি বলছেন, ‘তিনি (রাসুল) রাত্রির প্রার্থনা সেরে পরে ঘুমিয়েছিলেন। এবং আমরাও ঘুমিয়েছিলাম। অতি প্রত্যুষে আল্লাহ্‌র নবী উঠলেন এবং আমাদের জাগালেন। তখন তিনি তাঁর প্রার্থনা সারলেন। আমরাও তাঁর সাথে প্রার্থনা সারলাম।` (সূত্রঃ মহানবী, ডক্টর ওসমান গনী, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মল্লিক ব্রাদার্স, পৃঃ ১৭৪ এবং সাইয়েদুল মুরসালীন, আবদুল খালেক, প্রথম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ২৬৬-২৬৭ )। এই ‘আমরা` কারা? এই ‘আমরা` কি উম্মে হানির পরিবার নয়? তাহলে লেখক কেন এই লিংকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন যে, সে রাতে উম্মে হানির স্বামী বাড়ি ছিল না?

এছাড়া লেখক আল-আকসা মসজিদের ইতিহাস বর্ণনার জন্য reference হিসেবে একটি লিংক  ব্যবহার করেছেন। লিংকটা হলোঃ

http://www.questionsonislam.com/index.php?s=article&aid=10849

এই লিংক-এ Click করলেও যে কেউ দেখবেন সেখানে লেখা আছে, ‘The Prophet (s.a.w.) had prayed the evening prayers with Umm Hani and her family, then they all went to sleep. At dawn he said to them, “I prayed the evening prayers with you in this valley, then I went to Jerusalem where I prayed, and here I am praying the dawn prayers with you. অর্থাৎ উম্মে হানি সে রাতে তার নিজ পরিবারবর্গের সাথে (অর্থাৎ স্বামীর সাথে) ছিলেনআরও দেখা যাচ্ছে, উম্মে হানি তার স্বামীসহ মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে এশা ও ফজরের নামায পড়েছেন। ফলে উম্মে হানির স্বামী প্যাগান (অগ্নি উপাসক) ছিলেন বলে শুরুতে যে উল্লেখ করা হয়েছে, তা-ও সঠিক পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু লেখক তাঁর বর্ণিত লিংক থেকে এই অংশ বাদ দিয়ে শুধু আল-আকসা মসজিদের অংশটুকু নিয়েছেনকিন্তু কেন? এ আচরণের রহস্য কি লেখক আমাদের জানাবেন?

উপরের বর্ণনায় আরেকটি বিষয় চেপে যাওয়া হয়েছে। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চাচা আবু তালিব তখন সদ্য মৃত। উম্মে হানি ও হযরত আলী (রাঃ) দু’জনই তখন পিতৃহারা। দু’জনই শোকগ্রস্ত। হযরত আলী (রাঃ) তখনও অবিবাহিত। ইতিহাস অনুযায়ী মদীনায় হিযরতের দ্বিতীয় বর্ষে হযরত আলী (রাঃ)-এর সাথে হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর বিবাহ হয় (সূত্রঃ মহানবী, ডক্টর ওসমান গনী, পৃঃ ২৩৮)। এ অবস্থায় উম্মে হানির স্বামী ছাড়াও হযরত আলীরও (রাঃ) এ সময় বোনের কাছে থাকা খুবই স্বাভাবিক। আরও চেপে যাওয়া হয়েছে যে, মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর পিতার মৃত্যুর পর এই বাড়িতেই মানুষ হয়েছেন এবং উম্মে হানি ছিলেন তাঁর দুধ-বোন। (সূত্রঃ  নূর নবী, হাফেজ অধ্যক্ষ এম এ জলিল, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, ঢাকা, পৃঃ ৬৮)। ‘বিয়ের পর স্ত্রীর বাড়ী হয় তার স্বামীর বাড়ী`—লেখকের এই উক্তিও তাঁর অতি সরলীকরণের একটি নমুনা। বিয়ের পর সব স্ত্রী স্বামীর বাড়ি যায় না। গেলে ‘ঘর জামাই` শব্দটা থাকত না। আবু তালিবের মৃত্যুর পর উম্মে হানি তার পিতার বাড়িতেই থাকতেন। যারা হজ্ব কিংবা অন্য কোন প্রয়োজনে মক্কায় গেছেন, তারা বিষয়টি জানেন এবং বাড়িটিও দেখেছেন।

দ্বিতীয় লিংকের reference দিয়ে লেখক বলছেন, মুহাম্মদ (সাঃ) প্রথমে মেরাজে গিয়েছিলেন, তারপর সে ঘটনা সবিস্তারে বলার জন্য তিনি উম্মে হানির নিকট গমন করেন। যে কেউ উক্ত লিংক (http://www.muhammadanreality.com/ascentionmiraj.htm) Click করলেই দেখবেন, এখানেও লিংকের বর্ণনার সাথে লেখকের বর্ণনা মিলছে না। মুহাম্মদ (সাঃ) মেরাজ থেকে ফেরার পর উম্মে হানির সাথে এই কথোপকথন হয়নি। বরং তিনি যখন দিনের বেলায় কাবাগৃহে প্রার্থনারত ছিলেন, তখন আবু জাহেলসহ কোরাইশদের সাতটি দল পর্যায়ক্রমে তাঁকে নানাভাবে বিদ্রুপ ও গালমন্দ করে। দিনটি ছিল ২৬ রজব। কোরাইশদের ব্যবহারে তিনি মনে খুব দুঃখ পান। এ অবস্থায় তিনি মাগরিবের পরে আবু তালিবের বাসায় গমন করেন, যেখানে তাঁর মেয়ে উম্মে হানি থাকতেন। আরবী হিসাবে রাত আগে আসে, দিন পরে আসে। সে অনুযায়ী সূর্যাস্তের পরই ২৭ রজব শুরু হয়ে গেছে। উম্মে হানি রাসুল (সাঃ)-কে এরকম বিষণ্ন ও ভারাক্রান্ত অবস্থায় দেখে তার কারণ জানতে চাইলেন। রাসুল (সাঃ) তাকে সবকিছু খুলে বললেন। উম্মে হানি তাঁকে সান্তনা দিয়ে বললেন, “These men undoubtedly know that as a Prophet of Allah bringing the message of Truth you are not in need of servants and accomplices. But as they are a stubborn, envious and ill-tempered lot, they spoke these words with the sole purpose of insulting you and wounding your spirit.” These words served to comfort the Muhammad {s} somewhat, but he still remained distraught. It is reported that soon after praying the night prayer (Salat-al-‘Isha), he fell asleep in Umm Hani’s house in a saddened state of mind.‌` তারপর সেখানে লেখা আছে, মহান আল্লাহ্‌তায়ালা জিব্রাইল (আঃ)-কে বলছেন, ‘আমার সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়তম ব্যক্তি অবিশ্বাসীদের ব্যবহারে মনে কষ্ট পেয়েছে এবং ঐ অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে। তুমি তাঁকে দাওয়াত দিয়ে আমার কাছে নিয়ে আস।` এরপর মেরাজের ঘটনার বর্ণনা আছে। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, রাসুল (সাঃ) মেরাজ থেকে ফেরার পর এ ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু লেখক আগের ও পরের ঘটনা বাদ দিয়ে ‘That night was the twenty-seventh night of the month of Rajab, a Monday night.` থেকে শুরু করে ‘Now, Umm Hani was an intelligent and resourceful woman.` পর্যন্ত এসে থেমে গেছেন। এর কারণ কি এই নয় যে, ওই লিংকে লেখা আছে মুহাম্মদ (সাঃ) এশার নামাযের পূর্বে আবু তালিবের বাড়িতে গমন করেন, যেখানে তাঁর মেয়ে উম্মে হানি থাকতেন? ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী মাগরিবের পর থেকেই এশার নামাযের সময় শুরু হয়। আর এশার নামাযের পূর্বের সময় কখনও গভীর রাত নয়। এ সকল তথ্য প্রকাশ পেলে লেখকের নিম্নলিখিত দুটি তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায়ঃ

(১) এক রাতে মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের নিয়ে কাবা শরীফে অবস্থান করছিলেন।            (২)  সেখান থেকে গভীর রাতে তিনি গোপনে উম্মে হানি (তার চাচাত বোন)-এর বাড়ী হাজির হন।

এবার দেখা যাক, রাসুল (সাঃ)-এর মেরাজ সম্পর্কে হাদিসগ্রন্থগুলি কি বলে। মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে জানার জন্য ইতিহাসবিদ ও গবেষকগণ যে সকল হাদিসগ্রন্থকে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য বলে রায় দেন, তা হলো, সহীহ বোখারী, মুসলিম, তিরমিজি ও আবু দাউদ। সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, মেরাজের রাতে মুহাম্মদ (সাঃ) খানায়ে কাবার পাশে বা হাতিমে শায়িত ছিলেন (সূত্রঃ বুখারী শরীফ, ৫ম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, পৃঃ ৩৬৭-৩৬৯ ও ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ৪০৮-৪১৪, সহীহ মুসলিম, প্রথম খণ্ড, হাদিস নম্বর ৩২২ ও ৩২৪, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ২৭২ ও ২৭৭)। ইতিহাসগ্রন্থেও এর সমর্থন আছে। তাতেও দেখা যায়, মেরাজের রাতে মুহাম্মদ (সাঃ) কাবাগৃহে শায়িত ছিলেন। অর্থাৎ হানির বাড়িতে অবস্থানের বিষয়টি সত্য নয়। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুনঃ

1.http://en.wikipedia.org/wiki/Isra_and_Mi%27raj

2.http://download.sunnionlineclass.com/ya_nabi/files/al-isra_wal-miraaj_english.pdf

মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর চাচা আবু তালিবের মেয়ে উম্মে হানির প্রেমে পড়েছিলেন ও বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর চাচা রাজী হন নি—এই আজগুবি তথ্যের সমর্থন কোথাও পাওয়া যায় না। না হাদিস, না ইতিহাস। লেখক দুর্বোধ্য কারণে কোন Reference ছাড়া এই তথ্য সরবরাহ করেছেন। তারপর Jump করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছেন। ইতিহাস বলছে, খাদিজা (রাঃ) মারা যাওয়ার পর মেরাজের পূর্বেই মুহাম্মদ (সাঃ) সাওদা (রাঃ)-কে বিবাহ করেন (সূত্রঃ স্যার সৈয়দ আমীর আলী, দ্য স্পিরিট অব ইসলাম, ডঃ রশীদুল আলম অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ৩২৯ )। এ থেকে দেখা যাচ্ছে, মুহাম্মদ (সাঃ) সে সময় স্ত্রীবিহীন ছিলেন না। কাজেই ‘ওদিকে কিছুকাল আগেই মোহাম্মদের স্ত্রী খাদিজা মারা গেছে। তাই মনের অবস্থা তার বিশেষ ভাল না`— লেখকের এই বর্ণনাটিও সত্য নয়।

গভীর রাতে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গীগণ কর্তৃক হঠাৎ তাঁকে কাবাঘরে দেখতে না পেয়ে তাঁর তালাশে বের হওয়া এবং সারারাত ধরে তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে উম্মে হানির ঘরে গিয়ে সেখানে তাঁকে ভোরবেলা খুঁজে পাওয়ার যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন, তা-ও সত্য নয়। এ বর্ণনার সাথেও Reference নাই। ইতিহাস ও হাদিস তালাশ করেও এ রকম কোন ঘটনা পাওয়া যাচ্ছে না। বরং তার বিপরীত বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, রাসুল (সাঃ) নিজেই কাবাঘরে এসে মক্কার লোকজনের কাছে মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করছেন। আরও দেখা যাচ্ছে, এ বর্ণনা শুনে আবু জাহেল নিজেই হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে খুঁজে বার করছেন এবং তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন যে, মুহাম্মদ (সাঃ) এরকম একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা বলছেন। তারপর হযরত আবু বকরের (রাঃ)-এর সাথে রাসুল (সাঃ)-এর প্রথম দেখা হচ্ছে এবং কথোপকথন হচ্ছে। (সূত্রঃ সহীহ মুসলিম, প্রথম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, হাদিস নম্বর ৩৩৮, পৃঃ ২৮৮, সাইয়েদুল মুরসালীন, আবদুল খালেক, প্রথম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ২৬৬-২৬৭, নূর নবী, হাফেজ অধ্যক্ষ এম এ জলিল, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, ঢাকা, পৃঃ ৮৩-৮৪ )।

আমরা যারা ইতিহাস থেকে মেরাজের ঘটনা পড়েছি, তারা নিশ্চয়ই মেরাজের আগে সংঘটিত অন্য একটি ঘটনাও জানি। এ ঘটনা সবগুলো হাদিস ও ইতিহাস গ্রন্থ দ্বারা সমর্থিত। কি সেই ঘটনা? কোরাইশ দলপতি ওতবাসহ অন্যান্য কোরাইশ প্রধানগণ শেষ কৌশল হিসেবে দুই-দুইবার মুহাম্মদ (সাঃ)-কে ইসলাম ত্যাগের বিনিময়ে আরবের যে কোন সর্বাপেক্ষা সুন্দরী রমণী, দাবীকৃত যে কোন পরিমাণ ধনসম্পদ, আরবের নেতৃত্ব ও রাজত্বের প্রলোভন দেখান। মুহাম্মদ (সাঃ) যথারীতি তা প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, ‘আমার এক হাতে সূর্য আরেক হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমার ধর্ম থেকে আমি বিরত হব না।` (সূত্রঃ সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩১৪, মহানবী, ডক্টর ওসমান গনী, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মল্লিক ব্রাদার্স, পৃঃ ১৪৯-১৫০ এবং আবদুল খালেক, সাইয়েদুল মুরসালীন, প্রথম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ১২৭)। লেখক এ ঘটনা চেপে গেলেন কেন? সে কি এ কারণে যে, মুহাম্মদ (সাঃ) চাইলে সে সময় তাঁর পছন্দের যে কোন নারীকেই পেতে পারতেন? সে উম্মে হানি হোক আর অন্য যে-ই হোক। কাজেই, এ ঘটনা উম্মে হানি সংক্রান্ত আগের বর্ণনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।

‘উম্মে হানি তার চাচা আবু তালিবের মেয়ে যার প্রেমে পড়েছিলেন মোহাম্মদ ও বিয়ে করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার চাচা রাজী হয় নি।`—এ কথার সাহায্যে কি লেখক বুঝাতে চাইছেন যে, মুহাম্মদ (সাঃ)-কে চাচা আবু তালিব বিশ্বাস করতেন না? ইতিহাস কিন্তু বলছে অন্য কথা। যখন আবু তালিব জানতে পারেন যে, তাঁর পুত্র আলী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ধর্ম গ্রহণ করেছেন, তখন তিনি পুত্রকে বললেন, ‘বৎস, তুমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কেননা, আমার বিশ্বাস, মুহাম্মদ তোমাকে শান্তি ও মঙ্গল ছাড়া অন্যকিছুর দিকে আহ্বান জানাবে না। (সূত্রঃ ইবনে হিশাম, সিরাতুর রাসুল, পৃঃ ১৫৯-১৬০, ইবনুল আসির, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪২-৪৩, স্যার সৈয়দ  আমীর আলী, দ্য স্পিরিট অব ইসলাম, ডঃ রশীদুল আলম অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ৮৬)। এছাড়া কোরাইশগণ আর একবার আবু তালিবকে মাখজুম পরিবারের ওমারা-বিন-অলীদ-বিন-মুগিরা নামক এক যুবকের বিনিময়ে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে (মুহাম্মদ) তাদের কাছে প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছিল। আবু তালিব তাতে রাজি হননি। (সূত্রঃ ইবনে হিশাম, পৃঃ ১৬৯, ইবনুল আসির, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪৮, স্যার সৈয়দ আমীর আলী, দ্য স্পিরিট অব ইসলাম, ডঃ রশীদুল আলম অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ১০৬)। আবু তালিব যেমন হযরতকে আপন পুত্র অপেক্ষা বেশি ভালবাসতেন, হযরতও তেমনি আবু তালিবকে আপন পিতা অপেক্ষা বেশি ভালবাসতেন। (সূত্রঃ মহানবী, ডক্টর ওসমান গনী, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মল্লিক ব্রাদার্স, পৃঃ ১৬৭)। মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে বিন্দুমাত্র খারাপ ধারণা থাকলেও আবু তালিব তাঁর নিজের পুত্রকে সম্পূর্ণ নতুন এক ধর্ম গ্রহণের জন্য নিশ্চিন্তমনে তাঁর কাছে সমর্পণ করতেন কি?

ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, মক্কার কাফের ও কোরাইশ সম্প্রদায় দীর্ঘ তের বছর (৬১০-৬২২ খ্রিঃ) ধরে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর চরিত্রহননের চেষ্টা করেছে। হাতের কাছে প্রমাণ না পেয়ে কখনও পাগল, কখনও জাদুকর, কখনও কবি, কখনও মৃগীরোগী ইত্যাদি নানা কষ্ট-কল্পনায় তাঁকে সম্বোধন করেছে (সূত্রঃ Sir William Muir, Life of   Mahomet, 1861)। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। তাঁর সমর্থক সংখ্যা আরও বেড়েছে। নির্যাতন করেও ধর্মান্তর বন্ধ করা যায়নি। উল্টো আমীর হামজা আবু জাহেলকে প্রহার করেছেন এ কারণে যে সে অযথা মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নির্যাতন করেছে। আমীর হামজা তাকে পিটিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনিও ঘটনাস্থলেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এ অবস্থায় যদি মুহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক উম্মে হানির ঘরে (স্বামীর অনুপস্থিতিতে) রাত্রিযাপনের কোন ঘটনা আসলেই ঘটত, তাহলে অবশ্যই নিম্নলিখিত ঘটনাগুলো ঘটত—

(১) মক্কার অবিশ্বাসীরা একবাক্যে মুহাম্মদ (সাঃ)-কে ‘চরিত্রহীন` খেতাব দিয়ে আল্লাহ্‌র নবী হিসাবে নাকচ করে দিত।

(২) আরবের প্রথা অনুযায়ী গোত্র প্রধানগণ সালিশ বসিয়ে তাঁর বিচার করত।

(২) চাচা আবু তালিব মারা যাওয়ায় এই বিচার অনুষ্ঠানে প্রতিপক্ষের কোন সমস্যা হত না।

(৩) মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী সাওদাও (রাঃ) স্বামীর এই কাজ সমর্থন করতেন না। ফলে তিনিও কোরাইশদের দলে যোগ দিতেন।

(৪) যে ক’জন সাহাবা ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তাঁরাও এহেন ‘চরিত্রহীন` ব্যক্তিকে আর সমর্থন করতেন না। ফলে তাঁরাও ইসলাম ত্যাগ করে পূর্বের ধর্মে ফেরত যেতেন।

কিন্তু প্রভাবশালী কোরাইশগণ সে পথে না যাওয়ায় এবং ৩-৪ ক্রমিকে বর্ণিত ঘটনাগুলি সংঘটিত না হওয়ায়, বিশেষ করে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জনসমর্থন আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় যে কোন যুক্তিবাদী পাঠকের মনেই এ প্রশ্ন জাগবে—

(১) কোরাইশগণ সে পথে না গিয়ে রাসুল (সাঃ)-এর কাছে আল-আকসা মসজিদের বিবরণ জানতে গেলেন কেন?

(২) মুহাম্মদ (সাঃ) কেন সকলকে জানালেন যে, মেরাজে দীর্ঘ সময় ব্যয় হলেও পৃথিবীতে মুহূর্তকাল মাত্র ব্যয় হয়েছে? কেন তিনি বললেন না যে, উম্মে হানির ঘরে অবস্থানের সম্পূর্ণ সময়টাই মেরাজে ব্যয় হয়েছে?

(৩) মুহাম্মদ (সাঃ) যেভাবে গভীর রাতে গোপনে (লেখকের ভাষায়) উম্মে হানির বাড়ি গেলেন, সেভাবে ফেরত না এসে কেন ঐ বাড়িতে সকাল পর্যন্ত থাকলেন?

(৪) সেই হতভাগ্য উম্মে হানির স্বামীর কি হলো? সে নিশ্চয়ই পাগল হওয়ার কারণে এমন একজন লোককে ছেড়ে দিতে পারে না যে তার স্ত্রীর সাথে রাত্রি যাপন করেছে। অন্যরা ছেড়ে দিলেও দিতে পারে। গোটা ইতিহাস তন্ন তন্ন করেও এই লোকের আর কোন হদিস পাওয়া যায় না কেন? শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত` উপন্যাসের সেই ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার`-এর মত কেন বলতে হচ্ছে, ‘তিনি আসিলেনই বা কিরূপে, গেলেনই বা কোথায়?`

লেখক আল-আকসা মসজিদের ইতিহাস বর্ণনায় যে সকল লিংকের Reference দিয়েছেন, সেগুলোতেও পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, http://www.islamic-awareness.org/Quran/Contrad/External/aqsa.html-এর এক জায়গায় বলা হচ্ছে, ‘Moreover, the Further [sic!] Mosque was not in existence at the time of Muhammad, but was built about a hundred years after his death! How could he have prayed in it, then, or described its gates and windows?` আবার একই লিংকের অন্য জায়গায় বলা হচ্ছে, ‘By the time Bishop Arculfus was in Jerusalem, some 40 years after the death of Prophet Muhammad, the al-Aqsa mosque was already being used as a place of worship by Muslims.` এই তথ্য দুটো পরস্পরবিরোধী। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যুর ১০০০ বছর পর আল-আকসা মসজিদ নির্মিত হলে সেই মসজিদ আবার তাঁর মৃত্যুর ৪০ বছরের মধ্যে মুসলমানদের নামাযের ঘর হিসেবে ব্যবহার হয় কি করে, যেখানে লেখক নিজেই বলছেন, রোমানরা জেরুজালেম দখল করে ৭০ খৃষ্টাব্দে টেম্পল অব সলোমন ধ্বংস করে দেয়ার পর ৬৯১ খৃষ্টাব্দে খলিফা আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ান সেখানে একটা মসজিদ তৈরী করেন? তাছাড়া http://en.wikipedia.org/wiki/Al-Aqsa_Mosque-এ উল্লেখ আছে, ‘Analysis of the wooden beams and panels removed from the mosque during renovations in the 1930s shows they are made from Cedar of Lebanon and cypress. Radiocarbon dating indicates a large range of ages, some as old as 9th-century BCE, showing that some of the wood had previously been used in older buildings`। অর্থাৎ তিরিশের দশকে পুনঃনির্মিত আল-আকসা মসজিদ ভবনে খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীর কাঠের বীম (Beams) ব্যবহার করা হয়েছে। তারমানে খৃ:পূ: ৯৫০ সালের টেম্পল অব সলোমনের একটা কাঠামো কমপক্ষে ১৯৩০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বহাল ছিল যার উপর আল-আকসা মসজিদ পুনঃনির্মাণ সম্ভব হয়েছে।

বুখারী শরীফ (৬ষ্ট খণ্ড, হাদিস নম্বর ৩৬০৭, পৃঃ ৪০৮, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ) ও সহীহ মুসলিম (প্রথম খণ্ড, হাদিস নম্বর ৩৩৬, পৃঃ ২৮৭, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ) থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে উল্লিখিত আছে, ‘জাবির ইব্‌ন আবদুল্লাহ্‌ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, যখন (মিরাজের ব্যাপারে) কুরাইশরা আমাকে অস্বীকার করল, তখন আমি কাবা শরীফের হিজর অংশে দাঁড়ালাম। আল্লাহ্‌তাআলা তখন আমার সম্মুখে বায়তুল মুকাদ্দাসকে প্রকাশ করে দিলেন, যার ফলে আমি দেখে দেখে বায়তুল মুকাদ্দাসের সমূহ নিদর্শনগুলো তাদের কাছে বর্ণনা করছিলাম।` এখানে বুঝা যাচ্ছে, বায়তুল মুকাদ্দাস তখন যে অবস্থায় ছিল, তিনি সে অবস্থারই বর্ণনা দিয়েছেন—কোন দরজা-জানালার বর্ণনা দেননি। কাজেই লেখকের বর্ণিত ‘কুরাইশদের নানা প্রশ্নের উত্তরে মোহাম্মদ আল-আকসা মসজিদের কয়টি দরজা, কয়টি গেট, আশে পাশে কি আছে তারও একটা বর্ণনা দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে`—এ কথার কোন সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে না। ‘কথিত আছে` এমন কোন বিষয় আমরা কেন Data হিসাবে পেশ করতে যাব?

http://www.islamic-awareness.org/Quran/Contrad/External/aqsa.html-লিংকে আরও একটা মজার জিনিস আছে। আবু জর গিফারী (রাঃ)-এর (আবু ধার নয়) প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মদ (সাঃ) কেন মসজিদুল কাবা ও মসজিদুল আকসার নির্মাণকালের ব্যবধান ৪০ বছর বলেছিলেন, তার উত্তরও এখানে আছে। সেখানে বিশ্ববিখ্যাত দু’জন মুহাদ্দিস ইবনে হাজর (রঃ) এবং ইবনে আল জাওযি (রঃ)-এর বরাত দিয়ে ঐতিহাসিক সূত্র (সূত্রঃ N. Robinson, Discovering The Qur’an: A Contemporary Approach To A Veiled Text, 1996, SCM Press Ltd.: London, p. 192.) উল্লেখপূর্বক বলা হয়েছে, দুটো মসজিদই (বাইতুল কাবা ও বাইতুল আকসা) হযরত  আদম (আঃ)-এর হাতে পর্যায়ক্রমে নির্মিত হয়। পরবর্তীতে বহুকাল পর যথাক্রমে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং সোলায়মান (আঃ) সেগুলো পুনঃনির্মাণ করেন। মুহাম্মদ (সাঃ) যে ৪০ বছর ব্যবধানের কথা বলেছেন, তা হযরত আদম (আঃ)-এর সময়কালের কথা বলেছেন—হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কিংবা সোলায়মান (আঃ)কিংবা খলিফা আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ান-এর সময়কালের কথা নয়। কিন্তু লেখক এখানেও দুর্বোধ্য কারণে তাঁর উদ্ধৃত লিংক থেকে এই অংশ বাদ দিয়ে অন্য অংশ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন? সে কি এজন্য যে পাঠক মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ঐ কথার ব্যাখ্যা পেয়ে যাবেন?

ইতিহাস ও বিজ্ঞান উভয়েরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো উভয়েই Trial and Error-এর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। যখনই কোন নতুন তথ্য পাওয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে আগের তথ্য পরিত্যক্ত হয়। যার কারণে দেখা যায়, প্রতিটি খননকার্যের পর ইতিহাস ও বিজ্ঞান নতুন করে লেখা হয়। বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ রচিত ‘ইতিহাসের খেরোখাতায়` যা ‘দৈনিক যুগান্তর`-এ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে, পড়লেই এ কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে খননকার্য ও প্রাচীন শিলালিপির সাহায্যে রাজধানী ঢাকার বয়স নতুন করে নির্ধারণ করতে হয়েছে। এই সেদিনও আমরা জানতাম যে, ঢাকার (প্রতিষ্ঠাকাল (১৬০৮ খ্রিঃ) বয়স হলো চারশ বছর। এখন দেখা যাচ্ছে, এটি একটি হাজার বছরেরও পুরাতন নগরী। এরকম প্রেক্ষাপটে খ্রিস্টপূর্ব সময়ের (যখন ইতিহাস সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না) পরস্পরবিরোধী Reference দিয়ে খ্রিস্টজন্মের পরের একজন ইতিহাস-স্বীকৃত ব্যক্তিকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করার চেষ্টা কি বিদ্বেষমূলক ও সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত নয়?

‘কেউ যদি মসজিদ না দেখেই থাকে তাহলে ভুল ধরবে কিভাবে?`—লেখকের এই মন্তব্য তাঁর স্ববিরোধিতারই একটি প্রমাণ। তিনি নিজেই বলেছেন, মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে থেকে আল-আকসা মসজিদের বর্ণনা দিতে যাননি। মক্কার অধিবাসীদের মধ্যে যারা আগে সেখানে গেছেন এবং আল-আকসা মসজিদ স্বচক্ষে দেখেছেন, তারাই মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে উক্ত মসজিদের বর্ণনা শুনতে চেয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো, সেখানে যদি আদৌ কোন মসজিদ না থাকে, তাহলে তারা বর্ণনা শুনতে চাইবেন কেন? তারপর “By God, you perfectly and correctly described it.”—এ কথাই বা বলবেন কেন? ‘এমন কোন গাধা আছে যে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনার চাক্ষুষ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও  মোহাম্মদকে নবী মানত না?`—এটি লেখকের যুক্তিহীন হেত্বাভাসের (Fallacy) আর একটি উদাহরণ। হাদিস ও ইতিহাসগ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে, এর চেয়েও বড় অলৌকিক ঘটনা দেখানো সত্ত্বেও একশ্রেণীর লোক মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নবী বলে স্বীকার করেনি। যেমন, তাঁর চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করার ঘটনা। মক্কার অবিশ্বাসীরা তাঁকে নবুয়তের প্রমাণ হিসেবে মুজিযা দেখানোর দাবী জানালে তিনি চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করে দেখান (বুখারী শরীফ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, পৃঃ ২৪৭, ৩৯৭ ও ৩৯৮)। কিন্তু তারা তাঁকে নবী বলে স্বীকার করেনি। আরবের ইহুদী ধর্মযাজকগণ মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট এমন তিনটি প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলেন, যার উত্তর তাঁদের কাছে ছাড়া আর কারও কাছে ছিল না। তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে তাঁকে নবী বলে মেনে নেবেন। মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন। তাতে তাঁর নবুয়ত সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু সেই ধর্মযাজকেরা রাসুল (সাঃ)-কে নবী বলে স্বীকার করেননি (সূত্রঃ আবদুল খালেক, সাইয়েদুল মুরসালীন, প্রথম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ১৩৭-১৩৮)।

ইতিহাস থেকে এমন ঘটনাও জানা যায় যে, মুহাম্মদ (সাঃ) নিজের অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণের সুযোগ পেয়েও তা গ্রহণ করেননি। নবম হিজরীতে তাবুক অভিযানের পর মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পুত্র ইব্রাহিম মাত্র ১৬ মাস বয়সে মারা যায়। যেদিন ইব্রাহিম মারা যায়, সেদিন সূর্যগ্রহণ হয়। তখন লোকজন বলতে লাগল, ইব্রাহিমের মৃত্যুর কারণেই সূর্যগ্রহণ হয়েছে। কাজেই মুহাম্মদ (সাঃ) একজন সত্য নবী। তখন মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন, ‘নিশ্চয়ই সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহের মধ্যে দু’টি নিদর্শন। কারও মৃত্যু বা জন্মের কারণে এ দুটোর গ্রহণ হয় না। কাজেই যখন তোমরা এদের গ্রহণ হতে দেখবে, তখন তাদের গ্রহণমুক্ত হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ্‌র নিকট দোয়া করবে এবং নামায পড়বে।`(সূত্রঃ মহানবী, ডক্টর ওসমান গনী, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মল্লিক ব্রাদার্স, পৃঃ ৩৪৯ এবং সহীহ বুখারী, ২য় খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, হাদিস নম্বর ৯৮৬ ও ১০০১, পৃঃ ২৫৬ ও ২৬৭-২৬৮)। এখানেও লেখকের যুক্তি অনুসরণ করে কি বলা যায় না যে, ঐ সময় যদি মুহাম্মদ (সাঃ) শুধু নীরব থাকতেন, তাহলেও বহু  অবিশ্বাসী তাঁকে নবী বলে মেনে নিত?

আসল কথা হলো, কোন অজানা জিনিস বলতে পারা কারও নবী হওয়ার প্রমাণ নয়। এ ক্ষমতা সকল যুগেই কারও না কারও মধ্যে দেখা গেছে। এখনও দেখা যায়। তাই বলে কেউ তাদের নবী বলে মানে না। মনোবিজ্ঞানে এ ক্ষমতাকে ESP (Extra Sensory Perception) বলে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটিতে এ বিষয়ে একাধিক পরীক্ষা চালানো হয়েছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এ ক্ষমতা সুস্থ লোকের তুলনায় মানসিক-অসুস্থদের মধ্যে বেশি (সূত্রঃ The Journal of Parapsychology, Vol. III, 1973)। জনাব ভবঘুরে বলছেন, ‘এই একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষগুলোর সামনেও যদি এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা প্রমাণ করা যেত, সিংহভাগ মানুষই মোহাম্মদকে নবী মানত।` এখন কি তিনি এই পাগলদের নবী মানবেন? পরীক্ষায় আরও দেখা গেছে, মানুষের তুলনায় এই ক্ষমতা পশুপাখিদের মধ্যে আরও বেশি। হাতের কাছেই উদাহরণ আছে। ‘দৈনিক প্রথম আলো`র ১৬/০৭/২০১১ তারিখের সাপ্তাহিক ‘ছুটির দিনে` ম্যাগাজিনে ‘Reader’s Digest`-এর বরাত দিয়ে এরকম একটি সত্য ঘটনা ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, অস্কার নামের একটি বিড়াল মানুষের মৃত্যুর খবর আগাম জেনে যাচ্ছে। একবার নয়, দু’বার নয়, বহুবার পরীক্ষা করা হয়েছে। তাতে বিড়ালটির ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২৫ জুলাই ২০১১ তারিখে National Geography Channel-এ দেখানো হয়েছে Scamp নামক একটি কুকুর Pine Nurshing Home-এর ৪০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। নিউজিল্যাণ্ডে কুকুর নিয়ে গবেষণা করছেন টেড রাফম্যান। তিনি তাঁর গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে জানাচ্ছেন, কিছু কিছু কুকুরের ভবিষ্যৎ বুঝতে পারার ক্ষমতা মানুষের চেয়েও বেশি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদিম যুগের মানুষ সাপ, ইঁদুর, গাভি ইত্যাদির পূজা করত। এখনও আদিবাসী সমাজে এর প্রচলন আছে। তাহলে আমরাও কি এই বিড়াল বা কুকুরের পূজা শুরু করব? তাহলে হয়তো এই ক্ষমতা আমাদের মধ্যেও চলে আসতে পারে (!) এবং এই লেখা অনুযায়ী আমাদেরকেও নবী বলে মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না!!

একজন মানুষ নবী কি-না, তার প্রমাণ কেরামতি দিয়ে হবে না। জাদু দিয়েও হবে না। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ট জাদুশিল্পী হলেন জুয়েল আইচ। তিনি এমন জাদুও দেখান, যেখানে সম্মোহন করে কোন ব্যক্তির নাড়ির স্পন্দন একদম বন্ধ করে দেন। তারপর ঐ ব্যক্তির শরীর রক্তশূন্য করে ফেলেন। তারপর সার্জিক্যাল ছুরি দিয়ে তার রক্তশূন্য জিহ্বা কেটে ডাক্তারের হাতে তুলে দেন। অনেক দর্শক স্নায়ুর চাপ সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। যদিও পরে আবার ঐ জিহ্বা জোড়া লাগিয়ে সেই ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তাঁর জাদু সমাপ্ত করা হয় (সূত্রঃ জুয়েল আইচ, অন্তরালের আমি, সময় প্রকাশন, বাংলাবাজার, ঢাকা, পৃঃ ২১-২২)। সেই জুয়েল আইচ তাঁর স্মৃতিচারণমূলক লেখায় একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে এটিই হলো সবচেয়ে বড় জাদু। কি সেই জাদু? জীবনে প্রথম তিনি মঞ্চে জাদু দেখাচ্ছেন। হলভর্তি দর্শক। জুয়েল আইচ তাঁর শৈশবের এক বন্ধুকে সম্মোহিত করেছেন। তারপর সেই বন্ধুর জিহ্বায় একের পর এক পেরেক ঢোকাচ্ছেন। বন্ধু টের পাচ্ছেন না। জুয়েল আইচ নিজের সাফল্যে মহাখুশি। দর্শকরাও হাততালি দিচ্ছে। পরে দেখা গেল, সেই বন্ধু আসলে সম্মোহিত হননি। শতকরা পাঁচজন মানুষ কখনও সম্মোহিত হয় না। বন্ধু গোবিন্দ তাদেরই একজন। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু বলেননি। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করেছেন। যেন বন্ধুর মর্যাদাহানি না হয়! জুয়েল আইচ জেনেছেন পরে। জেনে পাথর হয়ে গেছেন। মানুষের জন্য এই যে ভালবাসা, এর চেয়ে বড় জাদু আর কি হতে পারে?—এই প্রশ্ন করেছেন জুয়েল আইচ নিজেই। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর যদি কোন মোজেজা থাকে, তা জানতেও আমাদেরকে ওই জায়গায় যেতে হবে। তাঁর তুলনাহীন সততা, সত্যবাদিতা, মহানুভবতা, আত্মত্যাগ, সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা, মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা, সর্বোপরি একটি হাজার বছরের ঘুণে ধরা, ক্ষয়িষ্ণু, বর্বর সমাজ-কাঠামোকে শূন্য হাতে রাতারাতি বদলে ফেলার ক্ষমতা সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে, তা সত্য কি-না দেখতে হবে। দেখার জন্য প্রচুর গবেষণাগ্রন্থ বাজারে আছে। যেমনঃ

  1. M. N. Roy-এর ‘The Historical Roll of Islam, Vora & Co. Publishers Ltd., Bombay, 1938` (M. N. Roy তৎকালীন সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর একমাত্র ভারতীয় সদস্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। বইটির pdf version http://ia700500.us.archive.org/10/items/historicalroleof032545mbp/historicalroleof032545mbp.pdf ওয়েবসাইট থেকে free download করা যাবে)
  2. ফরাসী কবি ও রাজনীতিক Alphonse de Lamartine (1790-1869)-এর ইংরেজিতে অনূদিত ‘Histoire De La Turquie, Paris, 1854, vol. II`
  3. ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Edward Gibbon (1737-1794)-এর History Of The Saracen Empire, London, 1870 ও History of the Decline and Fall of the Roman Empire, London, 1838, vol.5,
  4. ব্রিটিশ কিংবদন্তী নাট্যকার ও সাহিত্যিক George Bernard Shaw-এর ‘The Genuine Islam`
  5. সাহিত্যিক-দার্শনিক Thomas Carlyle-এর ‘On Heroes and Hero Worship, 1840`
  6. Reverend Bosworth Smith (1794-1884)-এর ‘Mohammed and Mohammedanism`
  7. John William Draper-এর ‘A History of the Intellectual Development of Europe, London 1875`
  8. Professor K.S. Rama Krishna Rao-এর ‘Mohammad, The Prophet of Islam`
  9. J.H. Denison-এর ‘Emotions as the Basis of Civilization`
  10. Philip K. Hitti-এর ‘History of the Arabs`
  11. Rev E. Stephenson-এর ‘My Reflections`
  12. H.N. Spalding-এর ‘Civilization in East and West`
  13. Raymond Lerouge-এর ‘Life de Mohamet`
  14. Dr. Mawde Royden-এর ‘The Problem of Palestine`
  15. M.H. Hyndman-এর ‘The Awakening of Asia`
  16. Lewis Mumford-এর ‘Transformation of Man`
  17. Mohandas Karamchand Gandhi (1869-1948) Indian thinker statesman, and nationalist leader এর Lectures published in Young India (periodical), 1928, Volume X
  18. Sir Syed Ameer Ali-এর ‘The Spirit of Islam, ড. রশীদুল আলম অনূদিত, ৩য় সংস্করণ, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, ১৯৯৮`
  19. ড. ওসমান গণী-এর ‘মহানবী, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা (ড. ওসমান গণী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বইটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচিভুক্ত)।

আগেই বলেছি, কোন সমাজই একটা বা দুইটা ঘটনা দেখে কাউকে নবী বলে স্বীকার করে না। সে দাবীদারের কাছে এমন কিছু দেখতে চায়, যা ঐ সমাজে আগে কখনও দেখা যায়নি (Unprecedented)। এ কারণেই মক্কার কোরাইশরা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে আল-আকসা মসজিদের বর্ণনা শুনেও ইসলাম গ্রহণ করেনি। কারণ, এটা তাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না। সে সময় আরবে জ্যোতিষ ও জাদুকরের ছড়াছড়ি ছিল। জ্যোতিষদের বলা হতো ‘কাহিন`। এ সকল কাহিন ‘আজলাম` ও ‘কিদাহ্‌‌` পদ্ধতিতে মানুষের অজানা বিষয় বলে দিত (সূত্রঃ Sir Syed Ameer Ali, ‘The Spirit of Islam, ড. রশীদুল আলম অনূদিত, ৩য় সংস্করণ, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, ১৯৯৮, পৃঃ ৫৬ ও ৬৯ এবং ড. ওসমান গণী, ‘মহানবী,  মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ৯১। তখন ‘এমন এক যুগ ছিল যখন অলৌকিক ঘটনা সাধারণ সাধু-সজ্জনদের কাছে আটপৌরে ঘটনার সামিল ছিল, যখন সমগ্র পরিবেশ অলৌকিকতার দ্বারা অধ্যুষিত ছিল, শুধু আরবে নয়, প্রতিবেশী দেশসমূহে যেখানে সভ্যতা আরও এগিয়ে গিয়েছিল।` (সূত্রঃ Sir Syed Ameer Ali, ‘The Spirit of Islam, ড. রশীদুল আলম অনূদিত, পৃঃ ৯৯)। সে কারণেই মক্কার লোকেরা পূর্ব অভ্যাসবশত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে কখনও চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করার জন্য, কখনও গুপ্ত বিষয় বলার জন্য চ্যালেঞ্জ করেছে। এক পর্যায়ে ইহুদী ধর্মযাজকগণও রাসুল (সাঃ)-এর নিকট এমন তিনটি প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন, যার উত্তর তাঁদের কাছে ছাড়া আর কারও কাছে ছিল না। তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই তাঁরা তাঁকে নবী বলে মেনে নেবেন। রাসুল (সাঃ) এই তিনটি প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর জানালেন। তিনি চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করেও দেখালেন। কিন্তু তারা স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে নবী বলে মানল না, যার কারণ পূর্বেই বলা হয়েছে। (সূত্রঃ ড. ওসমান গণী, ‘মহানবী`, পৃঃ ১৪১, Sir Syed Ameer Ali, ‘The Spirit of Islam, ড. রশীদুল আলম অনূদিত, পৃঃ ৯৮-৯৯ এবং আবদুল খালেক, সাইয়েদুল মুরসালীন, প্রথম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ১৩৭-১৩৮)। এ প্রসঙ্গে কোরআনে উল্লেখ আছে, ‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে, আর চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। তারা কোন নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, ‘এটা তো চিরাচরিত জাদু।`(সুরা কামার, ১-২)। আরও উল্লেখ আছে, ‘তারা কোন নিদর্শন দেখলে উপহাস করে। এবং বলে, ‘এটা তো এক সুস্পষ্ট জাদু ব্যতীত আর কিছুই নয়।`(সুরা সাফ্‌ফাত, ১৪)। ‘আমি যদি তোমার প্রতি কাগজে লিখিত কিতাবও নাযিল করতাম আর তারা যদি তা হস্ত দ্বারা স্পর্শও করত তবুও কাফেররা বলত, ‘এটা স্পষ্ট জাদু ব্যতীত আর কিছুই নয়।‌` (সুরা আনআম, ৭)।

কাজেই ঐতিহাসিকভাবে এটা প্রমাণিত যে, আরবের অবিশ্বাসীরা ততদিন পর্যন্ত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নবী বলে স্বীকার করেনি, যতদিন পর্যন্ত না তারা তাঁর কাছে এমন কিছু জিনিস দেখেছে, যা ছিল তাদের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।

আরবের অবিশ্বাসীরা প্রথম অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হয় যখন তারা দেখতে পায় যে, একজন ব্যক্তি তার জন্মের পর থেকে একটানা চল্লিশ বছর যাবত এমন এক পরিচয় বহন করছেন, যা ছিল আরবের আঞ্চলিক ভাষায়, ‘আস্‌সাদিক আল-আমীন` অর্থাৎ ‘সত্যবাদী বিশ্বস্ত`। ঐতিহাসিকের ভাষায়, ‘তিনি এমনি সম্মানজনকভাবে বা অধ্যাবসায়ের সঙ্গে জীবন নির্বাহ করেছেন, যার ফলে তাঁর স্বদেশবাসীর নিকট থেকে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত—এই উপাধি পেয়েছেন (সূত্রঃ Hugh’s Dictionary of Islam, পৃঃ ৩৬৮-৩৬৯, Sir Syed Ameer Ali, ‘The Spirit of Islam, ড. রশীদুল আলম অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ৬৩-৬৪)। নবুয়ত দাবীর পাঁচ বছর পূর্বেও কাবাগৃহ সংস্কারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট গোত্রকলহের মীমাংসাকারী হিসেবে আরববাসীগণ তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে এই যুক্তিতে মনোনীত করে যে, ‘এই তো আমাদের বিশ্বস্ত ব্যক্তি, আমরা তার সিদ্ধান্তে একবাক্যে রাজি` (সূত্রঃ George Sale, Translation of the Koran, Preliminary Discourse, বুখারী শরীফ, হাজরে আসওয়াদের বিবরণ অধ্যায়)। নবুয়ত প্রাপ্তির পরেও যখন তিনি সাফা পাহাড়ের পাদদেশে লোকদের একত্রিত করে প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেন, তখন বক্তব্য রাখার পূর্বে উপস্থিত লোকদের প্রশ্ন করেন, ‘আমার সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি?` তারা একবাক্যে জবাব দেয়, ‘তোমার মধ্যে সত্যপরায়ণতা ছাড়া আমরা আর কিছুই দেখিনি।` (সূত্রঃ বোখারী ও মুসলিম)। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আর একজন ব্যক্তির কথাও জানা যায় না, যার জীবন বিতর্কিত হয়ে ওঠার পূর্বে (নবুয়ত দাবীর কারণে) দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত মানুষের সামনে ছিল এবং তাঁর পরিচিতজনেরা তাঁর চরিত্র ও কার্যাবলী সম্পর্কে এত উচ্চ ধারণা পোষণ করত। এই অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা মক্কার অবিশ্বাসীদেরকে কি রকম সমস্যায় নিক্ষেপ করে, তার নমুনা পাওয়া যায় বয়োজ্যেষ্ট কোরাইশ নেতা নাজার ইবন হারিসের উক্তি থেকে। তিনি বলছেন, ‘হে কুরায়শ, মুহাম্মদের আহ্বান তোমাদেরকে এমন একটি সমস্যায় নিক্ষেপ করেছে যে, তার কোন সমাধান তোমাদের কাছে নেই; সে তোমাদের চোখের সামনেই ছোট থেকে বড় হয়েছে, তোমরা ভালভাবেই জান যে, সে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সত্যবাদী, সবচেয়ে বেশি বিশ্বস্ত এবং সর্বাধিক জনপ্রিয়। কিন্তু যখন তার চুল সাদা হওয়ার উপক্রম হয়েছে এবং সে ঐ মূল্যবান বাণী কোরআন পেশ করছে যা তোমরা শুনছ, তখন তোমাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে, তোমরা বলতে শুরু করেছ ‘এই ব্যক্তি জাদুকর,` ‘এই ব্যক্তি কবি,` ‘এই ব্যক্তি পাগল`। আল্লাহ্‌র শপথ, আমি মুহাম্মদের মুখে নিখুঁত কোরআনের বাণীসমূহ শুনেছি—সে না জাদুকর, না কবি আর না পাগল। আমার বিশ্বাস, তাকে অস্বীকার করলে তোমাদের উপর কোন একটি বিরাট বিপদ আপতিত হবে (সূত্রঃ সীরাতুন্নবী, ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৩১৯)। যাই হোক, মুহাম্মদ (সাঃ)-এর এই অপ্রত্যাশিত স্বভাবের কারণেই তিনি যখন তাঁর নবুয়তের দাবী প্রকাশ করেন, তখন কোন প্রমাণ ছাড়াই আরবের বিভিন্ন শ্রেণীর চল্লিশজন ব্যক্তি বিনা দ্বিধায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন (সূত্রঃ ড. ওসমান গণী, ‘মহানবী`, পৃঃ ১৩৭)। কিন্তু অধিকাংশই আরও নিদর্শনের জন্য অপেক্ষায় থাকেন।

আরবের অবিশ্বাসীদের জন্য দ্বিতীয় অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল তাদের বর্বরোচিত আচরণের মোকাবেলায় মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতিক্রিয়া। তখনকার আরবে যে কোন অপরাধের সামাজিক প্রতিকার ছিল চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, খুনের বদলে খুন ইত্যাদি। এ প্রথার মধ্যে তখন অন্যায়ের কিছু ছিল না। কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর ক্রমাগত অমানুষিক ও বর্বর নির্যাতন এবং তাঁর একাধিক অনুসারীকে হত্যা ও জখম করা সত্ত্বেও (সূত্রঃ Sir William Muir, Life of Muhammed) তিনি সে পথে গেলেন না। এমনকি গালির উত্তরে গালি, নিন্দার উত্তরে নিন্দা কিংবা অভিশাপের উত্তরে অভিশাপও তিনি দিলেন না। বরং তায়েফবাসীদের কাছে ভয়াবহ ও অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েও মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ্‌র কাছে এই বলে দোয়া করলেন যে, ‘আমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। হয়তো আল্লাহ্‌তায়ালা তাদের বংশে এমন মানুষ সৃষ্টি করবেন, যারা আল্লাহ্‌র ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকেও শরীক করবে না।`(সূত্রঃ বুখারী শরীফ, ৫ম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, পৃঃ ৩৭৯-৩৮০ এবং আবদুল খালেক, সাইয়েদুল মুরসালীন, প্রথম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ১৯৭)। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর এই অপ্রত্যাশিত আচরণ আরববাসীকে এমন হতবাক করে দেয় যে, তাদের মধ্যে ‘মহাবীর` খ্যাত হযরত আমীর হামজা (রাঃ) স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন (সূত্রঃ মহানবী, পৃঃ ১৪৮-১৪৯ এবং Sir Syed Ameer Ali, ‘The Spirit of Islam, ড. রশীদুল আলম অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ৯১)। পরে (হোদায়বিয়া সন্ধির পর) খালিদ-বিন-ওয়ালিদ এবং আমর-ইবনুল-আস ইসলাম গ্রহণ করেন।

আরবের অবিশ্বাসীদের জন্য তৃতীয় অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল পূর্বের ধর্মগ্রন্থসমূহে মুহাম্মদ (সাঃ) সংক্রান্ত নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী। সে সময়ের আরবে মূর্তিপূজক পৌত্তলিক ছাড়াও ইয়াহুদী ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অনেক ব্যক্তি ছিলেন, যাঁদের কাছে পূর্বের ধর্মগ্রন্থ ছিল। তাঁরা যখন সবিস্ময়ে দেখলেন যে, এ সকল ধর্মগ্রন্থে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নাম-ধামসহ নবুয়তের পূর্ণ বৃত্তান্ত রয়েছে, তখন তাঁদের অনেকেই বিনা দ্বিধায় তাঁকে আল্লাহ্‌র নবী বলে মেনে নিলেন। মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কায় থাকাকালীন ২০ জন আরব খ্রিস্টান এবং মদীনা থেকে খাযরাজ গোত্রের দশজন ইয়াহুদী তাঁর নিকট আসেন এবং তাঁদের ধর্মগ্রন্থের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে মিল দেখে ইসলাম গ্রহণ করেন (মহানবী, পৃঃ ১৫৮ ও ১৮৫)।

আরবের অবিশ্বাসীদের জন্য চতুর্থ অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সমরনীতি ও যুদ্ধবন্দীদের প্রতি তাঁর আচরণ। তখনকার আরবে যুদ্ধ মানেই ছিল পররাজ্য দখল, লুন্ঠন, গণহত্যা ও পৈশাচিকতা। মুহাম্মদ (সাঃ) যখন মদীনায় হিযরত করলেন, সেখানেও তাঁর শত্রুরা দীর্ঘ দশ বছর যাবত তাঁর উপর একের পর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। এ সকল যুদ্ধ পরিচালনাকালে মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর বাহিনীর অধিনায়ককে এই মর্মে নির্দেশ দেন যে, ‘কোন ক্ষেত্রেই তোমরা প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় গ্রহণ করবে না, মৃতদেহ বিকৃত করবে না এবং কোন শিশুকে হত্যা করবে না। (সূত্রঃ মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিযী এবং ইবনে হিশাম, পৃঃ ৯৯২ এবং স্যার সৈয়দ আমীর আলী, দ্য স্পিরিট অব ইসলাম, ডঃ রশীদুল আলম অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ১৬৩)। বাইজানটাইনদের বিরুদ্ধে প্রেরিত সৈন্যদলকে লক্ষ্য করে  মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন, ‘আমাদের ক্ষতির প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপারে পরিবারের অন্তরালস্থিত নিরীহ ব্যক্তিদের অবমাননা করবে না; নারীদের অব্যাহতি দেবে; শিশুদের কিংবা পীড়িত ব্যক্তিদের আঘাত করবে না। বাধাদান করে না এমন অধিবাসীদের গৃহ ধ্বংস করবে না; তাদের জীবিকার অবলম্বন বিনষ্ট করবে না, তাদের ফলের গাছও নষ্ট করবে না, তাদের খেজুর গাছও স্পর্শ করবে না।` (সূত্রঃ স্যার সৈয়দ আমীর আলী, দ্য স্পিরিট অব ইসলাম, ডঃ রশীদুল আলম অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ১৬৩)। তাঁর এ সকল নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হয়। যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারেও তিনি কড়া নির্দেশ দিলেন যে, বন্দীদের দুর্ভাগ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে এবং তাদের প্রতি সদয় আচরণ করতে হবে। তাঁর নির্দেশানুসারে মদিনার নাগরিকগণ ও যেসব মুহাজির তাদের গৃহের অধিকারী হয়েছিলেন, তারা সকলে বন্দীদের অভ্যর্থনা করেন এবং প্রভূত গুরুত্ব সহকারে তাদের প্রতি আচরণ করেন। পরবর্তীকালে একজন বন্দী বলেছিল, ‘মদিনার লোকদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। তারা আমাদের অশ্বপৃষ্ঠে যেতে দিতেন এবং নিজেরা হেঁটে যেতেন। তারা আমাদেরকে রুটি খেতে দিতেন, নিজেদের জন্য রুটি অবশিষ্ট থাকত না, তারা খেজুর ভক্ষণ করে ক্ষুধা নিবৃত্ত করতেন, তাতেই তৃপ্ত থাকতেন।` (সূত্রঃ ইবনে হিশাম, পৃঃ ৪৫৯-৪৬০; কসিন দ্য পার্সিভেল, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৭৯; উইলিয়াম মুর, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ১২২; Sir Syed Ameer Ali, ‘The Spirit of Islam, ড. রশীদুল আলম অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ১৩৪-১৩৫)। রাসুল (সাঃ)-এর এ আচরণ ছিল তৎকালীন আরবের জন্য এমনই অকল্পনীয় ও অভূতপূর্ব যে বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দী ও তাদের পরিবারবর্গ তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে তাদের বর্ণনা শুনে আরও অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে। উল্লেখ্য যে, মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সমরনীতি, যুদ্ধকালীন বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি অনুসৃত নীতি, যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত নীতি এবং মৃতদেহ সংক্রান্ত নীতি পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের জেনেভা কনভেনশনে অন্তর্ভুক্ত (Incorporate) হয়েছে। তবে পার্থক্য হলো এখানেই যে, খোদ জাতিসংঘ এবং তার প্রভাবশালী সদস্যরাষ্ট্রগুলোই তা অনুসরণ করে না। কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) মুখে যা বলেছেন, কাজেও তা করে দেখিয়েছেন।

আরবের অবিশ্বাসী পৌত্তলিক শ্রেণী সবচেয়ে বড় অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হয় মক্কা বিজয়ের পর। হিযরতের ৬ষ্ট বছরে মক্কাবাসী ও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মধ্যে ‘হোদায়বিয়ার সন্ধি` নামক যে চুক্তি সম্পাদিত হয়, সেই চুক্তি ভঙ্গ করে মক্কার কোরাইশরা বণী খোজা গোত্রের উপর আক্রমণ চালায়। তারা এই গোত্রের বেশ কিছু লোককে হত্যা করে এবং বাকি লোকদের তাড়িয়ে দেয়। বণী খোজা গোত্র মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে এসে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করে। এর ফলশ্রুতিতে মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কার কোরাইশদের কাছে ক্ষতিপূরণ চান। তারা তাতে রাজি না হওয়ায় তিনি দশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী সহযোগে মক্কা অভিযানে রওনা হন। এই অভিযানে অল্প কিছু প্রতিরোধ ছাড়া প্রায় বিনা বাধায় মক্কা বিজিত হয়। এ সময় মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর সেনাবাহিনী পরাজিত শত্রুর সাথে অপ্রত্যাশিত আচরণ করেন (T.P. Hughes, Dictionary of Islam)। মুহাম্মদ (সাঃ) সমগ্র মক্কাবাসীর জন্য সাধারণ ক্ষমা মঞ্জুর করেন। তাঁর একজন কন্যা—তাঁর অত্যন্ত প্রিয় সন্তান জয়নাব হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মক্কা থেকে পলায়নকালে হাবরার বিন আসওয়াদ নামক একজন কোরাইশ তাঁকে বল্লমের খোঁচায় হিংস্রভাবে হত্যা করে। মক্কা বিজয়ের পর হাবরারকে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সামনে হাজির করা হয়। মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা করেন। যে ইহুদী রমণী খায়বারে তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিল এবং আবু জাহেলের পুত্র ইকরামা, যে তাঁর প্রতি শত্রুতায় ছিল চরম নিষ্টুর ও ভয়ংকর—উভয়কেই তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা প্রদান করেন (সূত্রঃ Sir Syed Ameer Ali, ‘The Spirit of Islam, ড. রশীদুল আলম অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ১৬২-১৬৩ এবং ড. ওসমান গণী, ‘মহানবী`, পৃঃ ৪৬২)।

ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, নবুয়ত দাবী করার পর মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর অমানুষিক নির্যাতন নেমে আসে। তাঁর চলার পথে কাঁটা বিছানো হয়, নামাযরত অবস্থায় গলায় চাদরের ফাঁস দিয়ে টান দেয়া হয়, দীর্ঘ তিন বছর জনমানবহীন পার্বত্য উপত্যকায় অবরোধ করে রাখা হয়, তায়েফের রাস্তায় পাথর মেরে রক্তাক্ত ও সংজ্ঞাহীন করে ফেলা হয়। অবশেষে তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিনি শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে মদীনায় আশ্রয় নেন। সেখানেও তাঁর শত্রুরা দীর্ঘ দশ বছর যাবত তাঁকে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত রাখে। এসকল যুদ্ধে তিনি বহুবার আহত হন, একটি দাঁত হারান এবং তাঁর অনেক অনুচর শাহাদাত বরণ করেন। এভাবে নির্যাতন ও নিগ্রহের ২০টি বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে মক্কা বিজিত হয়। তখন তাঁর শত্রুরা বন্ধুহীন, সহায়হীন অবস্থায় তাঁর সামনে দাঁড়িয়েছিল। এমন সময়ে বিজয়ী যা করে, তা তো সবারই জানা। কিন্তু আল্লাহ্‌র রাসুল তেমন কিছু করলেন না। তিনি তাদের উপর কোন প্রতিশোধ নিলেন না। শুধু জানতে চাইলেন, ‘হে কোরাইশ সম্প্র্রদায়, আমি তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করব বলে তোমরা মনে কর?` তারা উত্তর দিল, ‘হে দয়ালু ভ্রাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র। আমরা তোমার নিকট থেকে করুণা ও সহানুভূতি চাই।` ঐতিহাসিক তাবারী উল্লেখ করেছেন, এ কথা শ্রবণ করে মুহাম্মদের (সাঃ) চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল এবং তিনি বললেন, ‘ইউসুফ তাঁর ভ্রাতাদের যেরূপ বলেছিলেন, আমিও তেমনিভাবে তোমাদের বলব, ‘আমি আজ তোমাদের তিরস্কার করব না; আল্লাহ্‌ তোমাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ্‌ সবচেয়ে দয়ালু ও সহানুভূতিশীল।` তিনি ঘোষণা করলেন, ‘যাও, আজ তোমরা সবাই মুক্ত।` এ সময়ে এমন একটি দৃশ্যের অবতারণা হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে যার তুলনা নেই। দলে দলে সবাই মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ধর্ম গ্রহণ করতে লাগল। সাফা পর্বতের উপর বসে তিনি সেই পুরাতন শপথনামা মদিনাবাসীদের নিকট থেকে গ্রহণ করলেনঃ ‘তারা কোন বস্তুর উপাসনা করবে না; তারা চুরি, ব্যভিচার কিংবা শিশুহত্যা করবে না; তারা মিথ্যা বলবে না কিংবা নারীদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাবে না।` (সূত্রঃ সীরাতুন নবী, ইবনে হিশাম, কায়রো, চতুর্থ খণ্ড, পৃঃ ৩২, ইবনুল আসির, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৯২; ইবনে হিশাম, পৃঃ ৮২১; তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ১৩৪; Sir Syed Ameer Ali, ‘The Spirit of Islam, ড. রশীদুল আলম অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ১৭২-১৭৪)। এভাবেই জনাব ভবঘুরে’র ভাষায়, মক্কার যে অবিশ্বাসীরা ইতোপূর্বে তাঁর মেরাজের ঘটনা বিশ্বাস করেনি, বাইতুল-আকসা মসজিদের বর্ণনা শুনেও তাঁকে  নবী বলে স্বীকার করেনি, তারাই তাঁকে একবাক্যে নবী বলে স্বীকার করে নেয়। শুধু তাই নয়, তারা ইসলাম ধর্মকে আরবের বাইরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়।

এগুলি হলো আজ থেকে ১৪০০ বছর আগের ঘটনা। মরুচারী আরবের সেই দিনও আর নেই। এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি একবিংশ শতাব্দীর সিঁড়িতে। এখন আমরা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছ থেকে কোন্‌ মোজেজা দেখে তাঁকে আল্লাহ্‌র নবী বলে মানব?

আধুনিক বিজ্ঞানই এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ কোরআনই হলো সেই মোজেজা। এ কালের বিজ্ঞানীরা রায় দিয়েছেন, কোরআন মানুষের লেখা গ্রন্থ হতে পারে না। কারণ, তা আধুনিক বিজ্ঞানকে দেড় হাজার বছর পেছনে ফেলে দিয়েছে। বিজ্ঞানের পেছনে কোরআন নয়, কোরআনের পেছনেই দৌঁড়াচ্ছে বিজ্ঞান। কোরআনে আছে Big Bang Theory (সুরা আম্বিয়া ৩০), যা ১৯২৭ সালে বেলজিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী G. Lemaitre আবিস্কার করেন, সেখানে আছে Theory of Expanding Universe (সুরা যারিয়াত, ৪৭), যা এডুইন হাবল ১৯২৯ সালে আবিষ্কার করেন। সেখানে আছে Law of Gravitation and Centrifugal Force (সুরা লোকমান, ১০ ও সুরা ফাতির, ৪১), যা কোরআন নাযিল হওয়ার ১২০০ বছর পর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আইজাক নিউটন আবিষ্কার করেন। সেখানে আছে  Theory of Solar Apex (সুরা ইয়াসিন ৩৮), যা জ্যোতির্বিজ্ঞানী Shapley ১৯২৭ সালে আবিষ্কার করেন। সেখানে আছে Modern Human Embryology (সুরা হুজুরাত ১৩, সুরা নাহল ৪, সুরা মুমিনুন ১৩, সুরা দাহর ২ এবং সুরা তারিক ৫-৭), যা ইতালীয় জীববিজ্ঞানী Lazzaro Spallanzani (১৭২৯-১৭৯৯) অষ্টাদশ শতাব্দীতে আবিষ্কার করেন। সেখানে আছে Law of Gravity (সুরা মুরসালাত, ২৫-২৬), যা বিজ্ঞানী নিউটন ১৬৮৭ সালে আবিষ্কার করেন। সেখানে আছে Water-cycle বা ‘পানিচক্র` (সুরা আরাফ ৫৭, সুরা রুম ৪৮, সুরা হিজর ২২, সুরা নূর ৪৩, সুরা নাবা ১৪-১৬ ও সুরা মুমিনুন ১৮), যা ১৫৮০ সালে বার্নার্ড প্যালিসি প্রথম আবিষ্কার করেন। সেখানে আছে, সৌরজগতের মোট গ্রহের সংখ্যা এগার (সুরা ইউসুফ ৪)। সম্প্রতি আরও দুটো গ্রহ (Vulcan ও Planet-x) আবিস্কার হয়ে আমাদের সৌরজগতের মোট গ্রহের সংখ্যা হয়েছে এগার। সেখানে আছে মহাবিশ্ব ও পৃথিবী দুইটি পর্ব (Phase) ও ৪টি অধিযুগে (Era) সৃষ্টি হয়েছে (সুরা হা-মীম আস-সাজদা, ৯-১০), আধুনিক বিজ্ঞানও তাই বলছে। সেখানে আছে, নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল সৃষ্টি করা হয়েছে নির্ভুল অনুপাতে (সুরা আনআম, ৭৩), আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে, ‘বৃহৎ বিস্ফোরণের এক সেকেণ্ড পর যদি সম্প্রসারণের হার এক লক্ষ মিলিয়ন মিলিয়ন (১০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০) ভাগও কম হতো, তাহলে মহাবিশ্ব বর্তমান আয়তনে পৌঁছানোর আগেই চুপসে যেত।` (সূত্রঃ Stephen W. Hawking, A Brief History of Time, Chapter-VIII: The Origin and Fate of the Universe, http://www.fisica.net/relatividade/stephen_hawking_a_brief_history_of_time.pdf)।  সেখানে আছে, প্রত্যেক বস্তুর বিপরীত বা যুগল সৃষ্টি করা হয়েছে, তা মাটি থেকে হোক, মানুষ থেকে হোক কিংবা সেইসব থেকে যা তারা অবগত নয় (সুরা ইয়াসীন, ৩৬), ১৯৩২ সালে C D Anderson কর্তৃক সর্বপ্রথম মহাবিশ্বে প্রতিবস্তুর (Antiparticles) উপস্থিতি প্রমাণিত হয় (সূত্রঃ The New Kexton Encyclopedia, Vol. 1)। এরই ধারাবাহিকতায় আবিস্কৃত হয় ইলেকট্রনের প্রতিকণা পজিট্রন। আরও আবিস্কৃত হয় নিইট্রিনো, মেসন ইত্যাদি। পরবর্তীতে আইনস্টাইনের Theory of Relativity ও অন্যান্য আবিস্কারের ফলে আধুনিক বিজ্ঞান এখন নিঃসন্দেহ যে প্রতিটি বস্তুরই প্রতিবস্তু (Anti-matter) বা জোড়া রয়েছে। এরকম আধুনিক রসায়নবিদ্যা, Agronomy, আবহাওয়াবিজ্ঞান, প্রাণীবিজ্ঞান, ভূ-বিজ্ঞান ও সামুদ্রিক-ভূ-বিজ্ঞান সংক্রান্ত অসংখ্য তথ্য আল-কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, যাকে আধুনিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার সমর্থন করছে। পবিত্র কোরআনে এরকম এক হাজারেরও অধিক আয়াত রয়েছে। এ সকল কারণে এ কালের শীর্ষ বিজ্ঞানীরা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, কোরআন মানুষের বাণী হতে পারে না, এটা Divine Revealation। কোন কোন বিজ্ঞানী আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে সপ্তম শতাব্দীর কোরআনের আলোকে তাঁর একবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক গ্রন্থের নতুন সংস্করণ বের করেছেন!! যেমন, কানাডার টরেন্টো ইউনিভার্সিটির Human Embryology বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কিথ এল. মুর (Keith L. Moore)। তিনি যখন দেখলেন যে, মাতৃগর্ভে ভ্রুণের ক্রমবিকাশের পর্যায়গুলি আধুনিক বিজ্ঞানের তুলনায় পবিত্র কোরআনে আরও যথাযথভাবে বর্ণিত আছে এবং সেখানে আরও কিছু অতিরিক্ত তথ্য আছে, যা তিনিও আগে জানতেন না, তখন তিনি তাঁর ‘The Developing Human` গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণে কোরআনের সেই বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত করে নেন (সূত্রঃ Keith L. Moore, The Developing Human, Clinically Oriented Embryology, With Islamic Additions, 3rd edition)। ড. কিথ এল. মুর (Keith L. Moore) অকপটে স্বীকার করেছেন যে, ‘ভ্রুণবিদ্যার ইতিহাস অনুযায়ী মানব ভ্রুণের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের স্তর সম্পর্কে বিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত এত অল্প জ্ঞান ছিল যে, সপ্তম শতাব্দীতে বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে কোরআনে এ ধরনের তথ্য পেশ করা সম্ভব ছিল না। এর একমাত্র যৌক্তিক উপসংহার হতে পারেঃ এই বর্ণনা ঈশ্বরের পক্ষ থেকে মুহাম্মদের উপর প্রত্যাদেশ করা হয়েছে।` তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হলো, ‘এতে কি বোঝা যায়, আপনি বিশ্বাস করেন যে, কুরআন আল্লাহ্‌র বাণী?` তিনি উত্তরে বললেন, ‘I find no difficulty in accepting this.` থাইল্যাণ্ডের চিয়াংমাই বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের প্রধান Professor Tejatat Tejasen সুরা নিসা ৫৬ নং আয়াত পড়ে প্রাণীদেহের ত্বকে (চর্ম) ব্যথা অনুভবকারী স্তর (Receptor) সম্পর্কে জানতে পারেন, যা অতি সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। তিনি নিশ্চিত হন যে, সপ্তম শতাব্দীতে এটা কারও পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। ফলে তিনি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে ১৯৮৩ সনে অনুষ্ঠিত অষ্টম মেডিক্যাল সম্মেলনে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেন। Professor দুর্গা রাও হলেন Marine Geology-এর একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি সৌদি আরবের যিদ্দায় কিং আব্দুল আযীয ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করতেন। তিনি জানতেন যে, তিনটি প্রতিবন্ধকতার  কারণে সমুদ্রের গভীরে আলো পৌঁছতে পারে না। এগুলো হলোঃ মেঘমালা, সাগরের অগভীর ঢেউ (Surface wave) এবং সাগরের অন্তঃস্থ ঢেউ (Internal wave)। ডুবোজাহাজ ও যন্ত্রপাতির সাহায্যে এগুলো সম্প্রতি জানা গেছে। ২০০ মিটার নিচে কোন আলো থাকে না। ১০০০ মিটার নিচে ঘোর অন্ধকার। সেখানে নিজের হাতও দেখা যায় না (সূত্রঃ Oceans, Elder and Pernetta, p. 27)। দুর্গা রাও যখন জানতে পারলেন যে, এ কথাগুলো হুবহু সুরা নূর ৪০ আয়াতে আছে, তখন তিনি বলেন যে, ‘এ আশ্চর্যজনক বিষয় সেই যুগে বর্ণনা করা কোন মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব ছিল না। নিশ্চয়ই কোরআন আল্লাহ্‌র বাণী।`

তথ্যসূত্রঃ

http://www.islamic-awareness.org/Quran/Science/scientists.html http://www.youtube.com/watch?v=FUUPYs0gElU)

মুহাম্মদ (সাঃ) যদি মিথ্যাবাদীই হতেন, তাহলে এ অভিযোগ সবার আগে উত্থাপিত হত তাঁর শত্রুদের তরফ থেকে। কিন্তু ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, নবুয়ত প্রাপ্তির পরেও যখন মুহাম্মদ (সাঃ) সাফা পাহাড়ের পাদদেশে লোকদের একত্রিত করে প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেন, তখন বক্তব্য রাখার পূর্বে উপস্থিত লোকদের প্রশ্ন করেন, ‘আমার সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি?` তারা একবাক্যে জবাব দেয়, ‘তোমার মধ্যে সত্যপরায়ণতা ছাড়া আমরা আর কিছুই দেখিনি।` (সূত্রঃ বুখারী শরীফ ও সহীহ মুসলিম)।

আবু জেহেল—যিনি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পিতৃব্য ছিলেন এবং জঘন্যতম শত্রুও ছিলেন, তিনিও বলেন, ‘মুহাম্মদ, আমি এটা বলছি না যে তুমি মিথ্যাবাদী; কিন্তু তুমি যা প্রচার করছ তা যথার্থ নয়, আমি এটাকে ভ্রান্ত বলে মনে করি।` (সূত্রঃ তিরমিযী)। এছাড়া মক্কার অবিশ্বাসীরা, যারা মুহাম্মদের (সাঃ)-এর এমন শত্রু হয়ে উঠেছিল যে নিজের জন্মভূমিতেও তাঁকে বসবাস করতে দিতে নারাজ ছিল, ইতিহাসের ভাষায়, তারাই তাঁর সম্পর্কে এই মনোভাব পোষণ করত যে, ‘মক্কার কারও কাছে যদি এমন কোন বস্তু থাকত, যার রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে সে আশংকিত হয়ে উঠত—তখন সে জিনিসটি তার (মুহাম্মদের) কাছেই রাখত। কেননা তার সত্যতা ও বিশ্বস্ততা ছিল সর্বজনবিদিত ও সর্বপ্রকার সন্দেহের ঊর্ধ্বে।` (সূত্রঃ সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৯৮)।

মদিনায় হিযরতের পর মুহাম্মদ (সাঃ) অন্যান্য দেশের শাসনকর্তাদের নিকট ইসলামের আমন্ত্রণবাণী নিয়ে  পত্র প্রেরণ করেন। যাদের কাছে পত্র প্রেরণ করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস। সে সময় আবু সুফিয়ানসহ কিছু কোরাইশ বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়ায় অবস্থান করছিল। হিরাক্লিয়াস মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে জানার জন্য তাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। তারপর জানতে চাইলেন, ‘তোমাদের শহরে যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহ্‌র রসুল বলে দাবী করছে, তোমাদের মধ্যে কেউ তার নিকটাত্মীয় আছ কি?‌` তখন আবু সুফিয়ান বললেন, ‘সে আমারই বংশের লোক।` অতঃপর হিরাক্লিয়াস জানতে চাইলেন, ‘এই দাবীর পূর্বে তোমরা কি কখনও তাকে মিথ্যা বলতে শুনেছ?` আবু সুফিয়ান বললেন, ‘কখনও না।` হিরাক্লিয়াস জানতে চাইলেন, ‘সে কি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে?` আবু সুফিয়ান বললেন, ‘এখনও সে কোন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেনি।` হিরাক্লিয়াস বললেন, ‘এই যখন অতীত অভিজ্ঞতা যে, সে কখনও মানুষদের ব্যাপারে মিথ্যা বলেনি, তাহলে এটা কি করে বলা যেতে পারে, সে আল্লাহ্‌র ব্যাপারে এতবড় একটা মিথ্যা কথা বলবে?` এটা হলো ঐ সময়কার কথা, যখন আবু সুফিয়ান ছিলেন রাসুলুল্লাহ্‌র ভয়ানক শত্রু এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী। পরবর্তী সময়ে আবু সুফিয়ান বলেছেন, ‘আমার যদি এই আশংকা না থাকত যে, হিরাক্লিয়াসের দরবারে অন্য যে সব কোরায়শী বসে আছে, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করবে, তাহলে আমি ঐ সময় মিথ্যার আশ্রয় নিতাম।` (সূত্রঃ সহীহ্‌ বোখারী, প্রথম খণ্ড, হাদিস নম্বর ৬, পৃঃ ৯-১১ এবং সহীহ মুসলিম, ৬ষ্ট খণ্ড, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, পৃঃ ২৪৬-২৫১)।

মুহাম্মদ (সাঃ) মিথ্যাবাদী কি-না, তা জানার আরেকটি নির্ভরযোগ্য উৎস হলেন তাঁর স্ত্রীগণ। মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর মৃত্যুর সময় মোট নয় জন বিধবা স্ত্রী রেখে যান। এঁদেরকে ‘উন্মুল মোমেনীন` বা ‘বিশ্বাসীদের জননী` বলা হয়ে থাকে। তাঁর স্ত্রীদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে পূর্বেই নিষেধাজ্ঞা ছিল যে, ‘তোমাদের আদৌ উচিৎ নয় আল্লাহ্‌র রাসুলকে দুঃখ দেওয়া এবং তাঁর ইন্তেকালের পর বিবিগণকে বিবাহ করা।` (সূত্রঃ সুরা আহযাব, ৫৩)।  অন্যত্র বলা আছে, ‘নবীর স্ত্রীগণ মোমিনদের মাতা স্বরূপ।` ((সূত্রঃ সুরা আহযাব, ৬)। কোরআনের এ নির্দেশের কারণে সাহাবাগণ রাসুলের (সাঃ) বিধবা স্ত্রীদের আপন জননীর মত শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁদের যে কোন নির্দেশ মেনে চলতেন। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর সাহাবাগণ ইসলাম প্রচারের জন্য বিশ্বের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েন। তখন এই বিধবা স্ত্রীদেরও সুযোগ ছিল যে কোন অমুসলিম দেশে গিয়ে কোরআনের এ নির্দেশ লঙ্ঘন করার এবং যে কারও সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার। বিশেষ করে তৃতীয় স্ত্রী আয়েশা (রাঃ)-এর কথা বলা যায়। ইনি ছাড়া মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বাকী এগার জন স্ত্রীর সবাই ছিলেন পূর্ব থেকেই বিধবা ও বয়স্কা (যাদের মধ্যে তিনজন নবীর জীবদ্দশাতেই মারা যান)। সাত বছর বয়সে আয়েশা (রাঃ)-এর বিয়ে হয়, নয় বছর বয়সে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকটে আসেন। তাঁর ১৮ বছর বয়সে মুহাম্মদ (সাঃ) মারা যান। (সূত্রঃ মহানবী, ডক্টর ওসমান গনী, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মল্লিক ব্রাদার্স, পৃঃ ৩৮৫)। পূর্ণ যৌবনবতী এ নারী অনায়াসেই দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারতেন। সর্বোপরি মুক্ত গণতন্ত্রের দেশে গিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে যে কোন ‘অসদাচরণ, ভণ্ডামী কিংবা মিথ্যাচারের` অভিযোগ (যদি থাকত) তাঁর বিধবা স্ত্রীগণ করতে পারতেন। যেমন, বর্তমান বিশ্বে ভণ্ড পীরদের বেলায় করা হয়।  কেননা, কারও চরিত্রের গোপন খবর তাদের স্ত্রীদের চেয়ে ভালো আর কারও জানার কথা নয়। সুতরাং এ সুযোগ নবীর স্ত্রীগণেরও ছিল। পশ্চিমা বিশ্বও এ ধরনের যে কোন অভিযোগ পরম আগ্রহের সাথে লুফে নিতো। কিন্তু ইতিহাস ও হাদিস গ্রন্থগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর আয়েশা (রাঃ) ও অন্য স্ত্রীগণ ছিলেন হাদিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ‘মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর আয়েশা (রাঃ) আরও ৪৮ বছর  বেঁচেছিলেন। তিনি ৫৭ হিজরীতে ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমর (রাঃ) এবং হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাসনামলে তিনি ফতোয়া দিতেন। তিনি ২৪১০টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, আহকামে শরীয়তের এক-চতুর্থাংশ হাদিস আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট হতে বর্ণিত হয়েছে।` (সূত্রঃ মাওলানা আবদুল জলিল, বিশ্বনবীর (সাঃ) জীবনী, তৃপ্তি প্রকাশ কুঠি, বাংলাবাজার, ঢাকা, পৃঃ ১৭০-১৭১)। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) ছাড়া আর কোন পুরুষ সাহাবী আয়েশা (রাঃ)-এর চেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করতে পারেননি। তিরমিজি শরীফ থেকে জানা যায়, হযরত আবি মুসা আল-আশয়ারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, ‘আমরা আছহাবে রাসুল (ছঃ)-এর কোন হাদিস সম্পর্কে অসুবিধার সম্মুখীন হলে তা সাইয়্যেদা আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করতাম এবং তাঁর নিকট থেকেই জ্ঞান লাভে সমর্থ হতাম।`

যে কোন বিষয়ে গবেষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি স্বীকৃত পদ্ধতি এই যে, উক্ত গবেষণায় যে Reference ব্যবহার করা হবে, তার কিছু অংশ স্বীকার এবং কিছু অংশ অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু জনাব ভবঘুরে তাঁর লেখায় আগাগোড়া এই কাজই করেছেন। তিনি বোরাকের বর্ণনার ক্ষেত্রে সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং অত্যন্ত জোর দিয়ে বলছেন যে, বোরাক কোন মহাকাশযান নয়; কারণ উক্ত হাদিসগ্রন্থে বোরাককে খচ্চরের চেয়ে ছোট ও গাধার চেয়ে বড় আকারের একটি সাদা জন্তু হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সহীহ বুখারী শরীফের যে হাদিসে (বুখারী শরীফ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, হাদিস নম্বর ৩৬০৮, পৃঃ ৪১১, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ) বোরাকের বর্ণনা আছে, তার আগের হাদিসেই (হাদিস নম্বর ৩৬০৭, পৃঃ ৪০৮) উল্লিখিত আছে যে, ‘ইয়াহ্‌ইয়া ইব্‌ন বুকায়ের (রা)…..জাবির ইব্‌ন আবদুল্লাহ্‌ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, যখন (মিরাজের ব্যাপারে) কুরাইশরা আমাকে অস্বীকার করল, তখন আমি কাবা শরীফের হিজর অংশে দাঁড়ালাম। আল্লাহ্‌তাআলা তখন আমার সম্মুখে বায়তুল মুকাদ্দাসকে প্রকাশ করে দিলেন, যার ফলে আমি দেখে দেখে বায়তুল মুকাদ্দাসের সমূহ নিদর্শনগুলো তাদের কাছে বর্ণনা করছিলাম।` সহীহ মুসলিম, প্রথম খণ্ডের ৩৩৬ নম্বর হাদিসেও একই বর্ণনা আছে। কিন্তু জনাব ভবঘুরে এই অংশকে সত্য বলে স্বীকার করছেন না। এছাড়া উভয় হাদিসগ্রন্থে বর্ণিত (সূত্রঃ বুখারী শরীফ, ৫ম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, পৃঃ ৩৬৭-৩৬৯ ও ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ৪১১-৪১৪, সহীহ মুসলিম, প্রথম খণ্ড, হাদিস নম্বর ৩২২ ও ৩২৪, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ২৭২ ও ২৭৭) মেরাজের সম্পূর্ণ বর্ণনা (বোরাকের বর্ণনা ছাড়া) অস্বীকার করছেন। সেখানে যে বর্ণিত আছে, মেরাজের রাত্রিতে রাসুল (সাঃ) কাবাগৃহের হাতিমে শায়িত ছিলেন—তা-ও অস্বীকার করছেন। আবার তিনি সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের Reference দিয়ে বলছেন, ‘বোরাক হলো গাধার চাইতে একটু বড় একটা জন্তু যার মূখটা ছিল মানুষের মত, আর ছিল দুইটা ডানা।‌` কিন্তু বোরাকের মুখ মানুষের মত ছিল, এরকম কোন তথ্য এ সকল হাদিসে নেই।

আলোচ্য লেখায় মেরাজের অসারতা প্রমাণের জন্য আপেক্ষিক তত্ত্বের (Theory of Relativity) যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তা-ও ভুল। পৃথিবীর কোন লোকের মহাশূন্যে যাওয়া-আসা করতে ২৭ বছর ব্যয় হলে পৃথিবীতেও ২৭ বছর কেটে যাবে—এটাই কি Theory of Relativity? হায় ঈশ্বর! আইনস্টাইন বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন, ‘আমার মাথায় পানি ঢালো।` আসলে বিজ্ঞানের যে কোন Theory নিয়ে লিখতে হলে সেই Theory সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা আমাদের সবারই থাকা দরকার। তা নাহলে নিজেও বিভ্রান্ত হব, অন্যকেও বিভ্রান্ত করব।

আইনস্টাইন Special Theory of Relativity দেন ১৯০৫ সালে। ওই থিওরীর আলোকে ১৯১১ সালে পদার্থবিদ Paul Langevin একজোড়া যমজের উদাহরণ (Twin Paradox) হাজির করেন। Paul Langevin বলেন যে, একজোড়া যমজের মধ্যে প্রথমজন (ধরা যাক A) পৃথিবীতে থাকল, দ্বিতীয়জন (ধরা যাক B) মহাকাশযানে চেপে আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে (Theory of Relativity অনুযায়ী কোন বস্তুর গতি আলোর গতির সমান হতে পারে না) মহাশূন্যের একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়ে আবার একই গতিতে ফেরত এল। B যখন পৃথিবীতে ফিরে আসবে, তখন দেখা যাবে, A-এর বয়স B-এর তুলনায় বেড়ে গেছে। এটা ছিল Special Relativity তত্ত্বের আলোকে Paul Langevin-এর একটি Hypothesis। এটি কোন Scientific Theory নয়। সে বছরই (১৯১১) আইনস্টাইন Special Relativity তত্ত্বের কিছু ত্রুটি স্বীকার করে নিয়ে তা ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, ‘To avoid unnecessary complications, let us for the present disregard the theory of relativity [the 1905 theory], and regard both systems from the customary point of view of kinematics, and the movements occurring in them from that of ordinary mechanics‌` (সূত্রঃ http://www.twinsparadox.co.uk/)। তারপর তিনি ১৯১৫ সালে General Relativity Theory প্রতিষ্ঠা করেন। এই থিওরির ভবিষ্যদ্বাণী হলো, ‘পৃথিবীর মত গুরুভার বস্তুর সন্নিকটে সময়ের গতি সবসময় শ্লথ বলে মনে হবে। পৃথিবী থেকে খুব উচ্চে অবস্থিত কোন লোকের মনে হবে নিচের সব ঘটনাই একটু দেরীতে ঘটছে। এই ভবিষ্যদ্বাণী পরীক্ষা করা হয়েছিল ১৯৬২ সালে। তখন একটি জলাধার স্তম্ভের উপরে এবং নিচে একজোড়া নির্ভুল ঘড়ি স্থাপন করা হয়েছিল। যে ঘড়িটা পৃথিবীর নিকটতর ছিল, দেখা গেল তার গতি ধীরতর।`

  1. Stephen W. Hawking, A Brief History of Time, Chapter-II http://www.fisica.net/relatividade/stephen_hawking_a_brief_history_of_time.pdf)।
  2. Feynman, Richard Phillips; Morínigo, Fernando B.; Wagner, William; Pines, David; Hatfield, Brian (2002). Feynman Lectures on Gravitation. West view Press. p. 68. ISBN 0-813-34038-1., Lecture 5)

এটা ছিল ১৯৬২ সালে পরিচালিত একটি পরীক্ষার ফলাফল, যা Paul Langevin-এর Hypothesis-এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারচেয়েও বড় কথা, প্রথমটা প্রমাণিত সত্য, দ্বিতীয়টা অনুমান। কারণ, আলোর গতির কাছাকাছি যাওয়া তো দূরের কথা, সেকেণ্ডে সাত মাইলের কিছু বেশি (রকেটের গতি) গতিই এখনও পর্যন্ত আমাদের ভরশা। আর Paul Langevin-এর Hypothesis-এর শর্তই হলো আমাকে আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণ করতে হবে এবং শুধু যাওয়া-আসা (acceleration) করতে হবে। কোথাও থামলে চলবে না। সেখানে আরও বলা হয়েছে, পৃথিবী থেকে দূরে যেতে যে সময় ব্যয় হবে, ফিরে আসতে Gravitational Time Dilation-এর কারণে তার চেয়েও কম সময় ব্যয় হবে। কাজেই জনাব ভবঘুরে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মেরাজে যাওয়া এবং ফেরত আসার জন্য যে সাড়ে তের বছর করে সময় বরাদ্দ করেছেন, তা-ও Paul Langevin-এর Hypothesis অনুযায়ী সঠিক নয়।

এবার দেখা যাক, সেই মহাশূন্যচারী যদি acceleration বন্ধ করে মাঝপথে যাত্রাবিরতি করেন (মেরাজের সময় যা ঘটেছে), তখন কি ঘটবে? Paul Langevin-এর Hypothesis-এ তার ব্যাখ্যা নাই। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান তার ব্যাখ্যা দিয়েছে। সুইডেনের Goteborg University-এর পদার্থবিদ Marek Abramowicz ও পোল্যাণ্ডের Nicolaus Copernicus Astronomical Center-এর জ্যেতির্বিজ্ঞানী Stanislaw Bajtlik এক গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে, সেই একজোড়া যমজের মধ্যে যিনি মহাকাশযানে চেপে আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে মহাশূন্য ভ্রমণ করবেন, তিনি যদি শুধু acceleration (ত্বরণ)-এর মধ্যে থাকেন, তাহলে তার সময় পৃথিবীর সময়ের তুলনায় Slow হতে পারে। কিন্তু তিনি যদি acceleration বন্ধ করে মাঝপথে যাত্রাবিরতি করেন, তাহলে তার সময় প্রথমজনের (যিনি পৃথিবীতে ছিলেন) তুলনায় দ্রুততর হবে। তিনি যখন পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করবেন, তখন দেখা যাবে তাঁর বয়স প্রথমজনের তুলনায় বেড়ে গেছে। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক এবং University College, London-এর অধ্যাপক হার্বাট ডিঙ্গেল (Herbert Dingle) সেই ১৯৫০-এর দশকেই রায় দেন যে, Special Theory of Relativity এবং Twin Paradox—দুটোই ভুল। তাঁর এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্র ‘WIRELESS WORLD` পত্রিকায় ১৯৮০ সালের অক্টোবর সংখ্যায় ছাপা হয়। সেখানে তিনি বলেন, ‘As I have said, it throws no light at all on what would happen if the experiment were made, for it is an analysis, not of a physical process that has never occurred, but of the requirements of a theory that purports to accord with physical processes, and I think it shows beyond doubt that the special relativity theory at least must be wrong.`এদিকে নাসা-র (NASA) Radiation Studies বিভাগের প্রধান বিজ্ঞানী Frank Cucinotta ও আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী পৃথক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মহাশূন্যের তেজস্ক্রিয়তা মানবদেহের ক্রোমোজম ও ডিএনএ-এর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, যার কারণে যিনি দীর্ঘসময় মহাশূন্যে অবস্থান করবেন, তার বয়স-নির্দেশক telomeres অধিক ক্ষয়প্রাপ্ত হবে এবং তাঁর বয়স পৃথিবীর অন্যদের তুলনায় তাড়াতাড়ি বাড়বে। Apollo মহাকাশযানে চড়ে যাঁরা চাঁদে ভ্রমণ করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। তাঁদের শরীরে অন্য মহাশূন্যচারীর (যারা অল্প সময় ও কম দূরত্বে ভ্রমণ করেছেন) তুলনায় সাত বছর আগেই Cataracts (বয়স বৃদ্ধির লক্ষণ) ধরা পড়েছে। নাসা-র এই গবেষণাও Special Theory of Relativity এবং Twin Paradox-এর বিপরীত ফল প্রকাশ করছে।

তথ্যসূত্রঃ

  1. 1. Twin Paradox Twist, the Accelerated Twin is Older, http://www.physorg.com/news163738003.html
  2. The Twins Paradox of Relativity, Herbert Dingle http://www.worldnpa.org/pdf/abstracts/abstracts_215.pdfIn
  3. NASA Science News, http://science.nasa.gov/science-news/science-at-nasa/2006/22mar_telomeres/
  4. The Twin Paradox: The Experiment Which Proves Einstein Wrong (http://www.twinsparadox.co.uk/)
  5. The Twins Paradox of Relativity Is Certainly Absolutely Wrong! (http://mb-soft.com/public2/twinspar.html)
  6. Time Dilation and Twin Paradox Debunked (http://www.physicsmyths.org.uk/timedilation.htm)
  7. Space and TimeWarps, Stephen Hawking (http://www.hawking.org.uk/index.php/lectures/publiclectures/63)

আইনস্টাইন যখন Gereral Theory of Relativity দেন, তখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের সম্প্রসারণই আবিষ্কার হয়নি। পরবর্তীতে  ১৯২৯ সালে এডুইন হাবল (Edwin Hubble) মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ (Expanding Universe) আবিষ্কার করেন, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে উইলসন ও পেনজিয়াস Big Bang Theory প্রতিষ্ঠা করেন। তার আলোকে Stephen Hawking এবং Penrose ১৯৭০ সালে চূড়ান্তভাবে রায় দেন যে, ‘ব্যাপক অপেক্ষবাদ (General Relativity Theory) একটি অসম্পূর্ণ তত্ত্ব। মহাবিশ্ব কি করে শুরু হল, এ তত্ত্ব তা বলতে পারে না।` (সূত্রঃ A Brief History of Time, Chapter-III, http://www.fisica.net/relatividade/stephen_hawking_a_brief_history_of_time.pdf)।)। আরও বলেছেন,‘ ‘মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে, সেগুলি শুধু স্থান-কালকে প্রভাবিত করে তাই নয়, স্থান-কাল নিজেরাও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ঠিক যেমন মহাবিশ্বে যে ঘটনাগুলি ঘটছে, স্থান-কাল সম্পর্কে ধারণা ছাড়া সেগুলি সম্পর্কে বলা সম্ভব নয়। ব্যাপক অপেক্ষবাদেও তেমনি মহাবিশ্বের সীমানার বাইরে স্থান-কাল সম্পর্কে বলা অর্থহীন। ` (সূত্রঃ A Brief History of Time, Chapter-II: Space and Time, http://www.fisica.net/relatividade/stephen_hawking_a_brief_history_of_time.pdf)।

এ অবস্থায় আমরা যাকে বাস্তব কাল (Physical Time) বলি, তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও Stephen Hawking বলছেন, আমাদের বাস্তব কাল দিয়ে মহাবিশ্ব ও কৃষ্ণগহ্বর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, কিন্তু কাল্পনিক কাল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে! তাঁর নিজের ভাষায়, ‘এ থেকে মনে হতে পারে তথাকথিত কাল্পনিক কালই আসলে বাস্তব কাল আর যাকে আমরা বাস্তব কাল (Physical Time) বলি, সেটা আমাদের কল্পনার উদ্ভাবন। সেই জন্য আমরা যাকে কাল্পনিক কাল বলি হয়তো সেটাই আরও বেশি মৌলিক (More basic)। (সূত্রঃ A Brief History of Time, Chapter-VIII: The Origin and Fate of the Universe, http://www.fisica.net/relatividade/stephen_hawking_a_brief_history_of_time.pdf)।

বর্তমান ধারণা থেকে এটা পরিষ্কার যে, মহাজাগতিক সকল স্থান ও কাল ভিন্ন ভিন্ন হবে। তা পৃথিবীর সময়ের তুলনায় দ্রুতও হতে পারে, আবার ধীরও হতে পারে। যেমন, বুধ গ্রহে এক বছর হয় ৮৮ দিনে আর মঙ্গল গ্রহে ৬৮৭ দিনে। সেই হিসেবে এই সৌরজগতের বুধগ্রহেই কেউ ৪০ বছর কাটিয়ে দিলে পৃথিবীর হিসেবে তা হবে মাত্র ৯.৬ বছর। মহাশূন্যের অন্য কোন স্থানে এই পার্থক্য এত ব্যাপক হতে পারে যে, পৃথিবীর হিসেবে তা হতে পারে মাত্র কয়েক সেকেণ্ড। এ অবস্থায় ‘স্থান` ও ‘কাল` সম্পর্কে Basic ধারণা আছে, এমন কাউকে যদি বলা হয় যে, মহাবিশ্বের যে কোন স্থানের সাথে পৃথিবীর সময়ের অনুপাত (Ratio) একই রকম থাকবে এবং মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মেরাজে অতিবাহিত ২৭ বছর (যদি ধরে নিই) পৃথিবীতেও অতিবাহিত হবে—তাহলে সেই ভদ্রলোক দ্বিতীয়জনের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাবেন, যেন মানুষ দেখছেন না—সার্কাসের জন্তু দেখছেন। অন্য কোন সন্দেহও করতে পারেন।

তাছাড়া Quantum Mechanics আবিষ্কারের পর থেকে বিজ্ঞানীরা দাবী করছেন যে, এই মহাবিশ্ব ছাড়াও আরও মহাবিশ্ব আছে। বিজ্ঞানীদের এই দাবী থেকে Parallel Universe-এর Theory এসেছে। Stephen Hawking বলছেন, ‘মহাবিশ্ব হয় স্থানিকভাবে অসীম, নয়তো অনন্তসংখ্যক মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে।` (সূত্রঃ Brief History of Time, Chapter-VIII: The Origin and Fate of the Universe, http://www.fisica.net/relatividade/stephen_hawking_a_brief_history_of_time.pdf)। যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থবিজ্ঞানী এবং Massachusetts Institute of Technology-এর Physics-এর অধ্যাপক এলান গুথ (Alan Guth) Parallel Universe-এর এমন এক Theory উপস্থাপন করেছেন, যেখানে একাধিক মহাবিশ্ব থাকতে পারে। সে সকল মহাবিশ্বে পৃথিবীর মত ত্রিমাত্রিক জগৎ থাকতে পারে, আবার বহুমাত্রিক জগৎও থাকতে পারে। California University-র একদল Quantum Physicist দাবী করছেন, সময়ের সুড়ঙ্গ দিয়ে অনায়াসে সে সকল  Parallel Universe-এ যাতায়াত করা যাবে। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুনঃ

  1. Parallel Universes Theory: The Basics (http://www.quantumjumping.com/articles/parallel-universe/parallel-universes-theory/)
  2. Freaky Physics Proves Parallel Universes Exist (http://www.foxnews.com/scitech/2010/04/05/freaky-physics-proves-parallel-universes/
  3. Parallel Universes, Max Tegmark Dept. of Physics, University of Pennsylvania, Philadelphia (http://space.mit.edu/home/tegmark/multiverse.pdf)
  4. THE UNIVERSE AND MULTIPLE REALITY by Professor M. R.Franks (http://www.manyuniverses.com/indexH.htm)
  5. The Parallel Universe: Does The Multiverse Provide A Theory of Everything? (http://www.suite101.com/content/the-parallel-universe-a34657)
  6. The Case of Parallel Universes (http://www.scientificamerican.com/article.cfm?id=multiverse-the-case-for-parallel-universe)

পৃথিবীর প্রচলিত সময়ের ধারণাকে যাঁরা চ্যালেঞ্জ করেছেন, তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত একজন হলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে, ডব্লিউ ডান (J W Dunn)। তাঁর An Experiment With Time বইটি ক্ল্যাসিক হিসেবে পরিচিত। ডানের Theory হলো, সময় দুই রকম। প্রথমটি সামনের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, দ্বিতীয়টি প্রথমটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সময়ের হিসাবে মানুষের অস্তিত্বও দুই রকম। প্রথমটি বর্তমান জীবনটা ভোগ করছে। এটি নশ্বর। দ্বিতীয়টি সময়ের ধরাবাঁধা নিয়ম থেকে মুক্ত। সে সময়ের সম্মুখ-পশ্চাৎ দেখতে পায়। এ কারণে মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তার প্রথম সত্ত্বাও ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু দ্বিতীয় সত্ত্বা ঘুমায় না। সে বেরিয়ে পড়ে। সে সময়ের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। এই সত্ত্বা একটি ইউনিভার্সাল মাইণ্ডের অংশবিশেষ। এই মহাবিশ্বে একটা ফোর্থ ডাইমেনশনাল সিরিয়াল ইউনিভার্স আছে, যার ভেতর মানুষের দ্বিতীয় সত্ত্বা কখনও কখনও Space-Time অবগতির একটা ভিন্ন ডাইমেনশনে ঢুকে পড়ে, যা তাকে সময়ের মধ্যে মুক্তভাবে বিচরণ করতে দেয়, সেটা সামনে কিংবা পেছনে যেদিকেই হোক (সূত্রঃ http://en.wikipedia.org/wiki/John_William_Dunne)। কোরআনেও বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ্‌ই প্রাণ হরণ করেন জীবসমূহের তাদের মৃত্যুর সময় এবং যাদের মৃত্যু আসে নাই তাদের প্রাণও নিদ্রার সময়। অতঃপর তিনি যার জন্য মৃত্যুর সিদ্ধান্ত করেন তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অপরগুলি ফিরিয়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য (সুরা যুমার, ৪২)।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারলাম—

এক. ব্যাপক অপেক্ষবাদ (General Relativity Theory) একটি অসম্পূর্ণ তত্ত্ব। মহাবিশ্ব কি করে শুরু হল, এ তত্ত্ব তা বলতে পারে না।

দুই. এই মহাবিশ্বের বাইরে আরও একাধিক মহাবিশ্ব থাকতে পারে।

তিন. ব্যাপক অপেক্ষবাদ (General Relativity Theory) মহাবিশ্বের সীমানার বাইরে স্থান-কাল সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না।

চার. Theory of Relativity অনুযায়ী কোন বস্তুর গতি আলোর গতির সমান কিংবা বেশি হতে পারে না।

পাঁচ. কোন ব্যক্তি যদি আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে মহাশূন্য ভ্রমণে বের হন, তাহলে ব্যাপক অপেক্ষবাদ অনুযায়ী acceleration (ত্বরণ)-এর সময় ছাড়া অন্য যে কোন অবস্থায় (যদি তিনি কোথাও যাত্রাবিরতি করেন) তাঁর সময় পৃথিবীর সময়ের তুলনায় দ্রুততর হবে এবং পৃথিবীর সময় তুলনামূলকভাবে Slow হবে।

ছয়. আমাদের বাস্তব কাল (Physical Time) দিয়ে মহাবিশ্ব ও কৃষ্ণগহ্বর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, কিন্তু কাল্পনিক কাল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে! এ থেকে ধারণা করা হয়, তথাকথিত কাল্পনিক কালই আসলে বাস্তব কাল আর যাকে আমরা বাস্তব কাল বলি, সেটা আমাদের কল্পনার উদ্ভাবন।

সাত. মানুষের দ্বিতীয় সত্ত্বা সময়ের সামনে-পেছনে যে কোন দিকে বিচরণ করতে পারে।

এবার দেখা যাক, প্রামাণ্য দলিল (কোরআন, হাদিস ও ইতিহাস) অনুযায়ী মেরাজের রাতে কি ঘটেছিল। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন কাবাগৃহে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন, তখন জিব্রাইল (আঃ) তাঁর নিকট আগমন করেন। তারপর তিনি বোরাক নামক একপ্রকার অত্যন্ত দ্রুতগামী বাহনে চড়ে প্রথমে বাইতুল মুকাদ্দাস (আল-আকসা) মসজিদে গমন করেন। তারপর সেখান থেকে একই বাহনে চড়ে সপ্ত আকাশ অতিক্রম করেন। প্রতিটি আকাশে তিনি যাত্রাবিরতি করেন এবং পূর্ববর্তী রাসুলগণের (আঃ) সাথে কুশল বিনিময় করেন। সময় নিয়ে আল্লাহ্‌র বিভিন্ন নিদর্শন দেখেন। তারপর একসময় সিদরাতুল মুনতাহার নামক বৃক্ষের কাছে উপস্থিত হন। জিব্রাইল (আঃ) তাঁকে জানান যে, এটা সৃষ্টির সীমানা, এর বাইরে তিনি (জিব্রাইল) আর যেতে পারবেন না। তখন বোরাক হযরত (সাঃ)-কে নিয়ে বাইতুল মামুর পর্যন্ত গিয়ে থেমে দাঁড়ায়। এ পর্যায়ে  সবুজ রঙের গদিবিশিষ্ট ‘রফরফ` নামক একটি স্বর্গীয় যানে চড়ে রাসুল (সাঃ) আল্লাহ্‌র একান্ত সান্নিধ্যে আরশে আজিমে গিয়ে উপস্থিত হন। আল্লাহ্‌র দরবারে তিনি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান ও উপদেশ লাভ করেন। তারপর আবার পৃথিবী অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। এ যাত্রাকালেও তিনি নানা স্থানে যাত্রা বিরতি করেন। এক পর্যায়ে ষষ্ট আসমান (যেখানে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম অবস্থান করছিলেন) থেকে আল্লাহ্‌র আরশ পর্যন্ত মোট দশবার আসা-যাওয়া করেন। এ আসা-যাওয়ার মাধ্যমে তিনি ফরয নামাযের পরিমাণ পঞ্চাশ ওয়াক্ত থেকে পাঁচ ওয়াক্তে নিয়ে আসেন। অবশেষে তিনি পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং কাবাগৃহে ফজরের নামায আদায় করেন (সূত্রঃ ইবনে হিশাম, আল-তাবারী, ইবনে আথির, বুখারী শরীফ, ৫ম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, পৃঃ ৩৬৭-৩৬৯ ও ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ৪১১-৪১৪, সহীহ মুসলিম, প্রথম খণ্ড, হাদিস নম্বর ৩২২, ৩২৪ ও ৩৩৮, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, পৃঃ ২৭২, ২৭৭ ও ২৮৮)।

মেরাজের এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার যে, এটা শুধু যাওয়া-আসা ছিল না; সেখানে প্রতিটি আসমানে যাত্রাবিরতি ছিল, আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার ব্যাপার ছিল। তারপর ছিল অবতরণের ব্যাপার। অবতরণ তিনি কিভাবে করেছিলেন, তখন তাঁর বাহন কি ছিল, আদৌ কোন বাহন ছিল কি-না, এ সম্পর্কে ইতিহাসে বা হাদিসে কিছু নেই। এমনকি তিনি যে ষষ্ট আসমান (যেখানে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম অবস্থান করছিলেন) থেকে আল্লাহ্‌র আরশ পর্যন্ত মোট দশবার আসা-যাওয়া করেন, এই আসা-যাওয়ার বাহন সম্পর্কেও হাদিসে কিছু উল্লেখ নেই। কিন্তু তাফসীরে রুহুল বয়ান-এ একটি ব্যাখ্যা আছে। সেখানে ‘সুরা নাজম`-এর প্রথম তিনটি আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘নিম্নগামী তারকার শপথ! তোমাদের সাথী মুহাম্মদ (সাঃ) কখনও পথ ভুলেননি বা পথভ্রষ্টও হননি`। উক্ত আয়াত মেরাজের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণ অর্থে অস্তমিত তারকা হলেও ইমাম জাফর সাদেক (রাঃ) বলেছেন, ‘নাজম দ্বারা উক্ত আয়াতে নবী করিম (সাঃ)-কেই বুঝানো হয়েছে। কেননা, রাসুল (সাঃ)-এর এক হাজার নামের মধ্যে ‘আন-নাজম` একটি নাম। আর আরবী ‘হাওয়া` শব্দের অর্থ হলো ‘নিম্নগামী`। তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, ‘আল্লাহ্‌র দরবার থেকে নিম্নগামী তারা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর শপথ।` এটা মেরাজ  থেকে ফেরত আসার অবস্থার বর্ণনা। আর ‘পথ ভুলেননি` অর্থ ‘যে পথে তিনি এসেছেন, সে পথেই ফেরত গেছেন।` বোরাক বা রফরফের মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন করলে এ কথার প্রয়োজন হতো না। কেননা, তখন সেই বাহনই তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসত। কাজেই রাসুল (সাঃ) যে মেরাজ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে আল্লাহ্‌র কুদরতে বাহন ছাড়া যাতায়াত করেছেন, এটাই সুস্পষ্ট। কারণ, তিনি তো নূর। আর নূর ও আলো সবকিছু ভেদ করে সরল গতিতে ধাবিত হয়, এটাই বিজ্ঞানের নিয়ম।` (তাফসীরে রুহুল বয়ান, সুরা আন-নাজম)। মহানবীর জীবনীগ্রন্থেও ‘সুরা নাজম`-এর উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়  মুহাম্মদ (সাঃ)-কে ‘আকাশের নক্ষত্রের` সাথে তুলনা করা হয়েছে। (সূত্রঃ ড. ওসমান গণী, ‘মহানবী`, পৃঃ ১৮২-১৮৩)। তাছাড়া আল-কোরআনের ‘আমি শপথ করি পশ্চাদপসরণকারী নক্ষত্রের, যা প্রত্যাগমন করে ও অদৃশ্য হয়।` (সুরা তাকভীর, ১৫-১৬)—এই আয়াতটিও দ্বৈত-অর্থবোধক। আধুনিক মহাকাশবিদ্যার (Modern Cosmology)আলোকে এটি যেমন প্রসারমান মহাবিশ্ব ও কৃষ্ণগহ্বর নির্দেশ করছে, তেমনি মহানবী (সাঃ)-এর ষষ্ট আসমান  থেকে আল্লাহ্‌র আরশ পর্যন্ত আসা-যাওয়াকেও সমর্থন করছে।

‘কেউ কেউ বলে থাকে যে-আল্লাহর সকাশে যেতে মোহাম্মদের সাড়ে তের বছর সময় লেগেছিল আর ফিরে আসতেও একই সময় লেগেছিল অর্থাৎ মোট সময় লেগেছিল সাতাশ বছর`—এটি লেখকের Reference বিহীন উক্তির আরেকটি নমুনা। মেরাজে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কি পরিমাণ সময় ব্যয় হয়েছিল, তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ নাই। এটা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কোন কোন জীবনীগ্রন্থে আছে, ‘নবী করিম (সাঃ) আরশে আজিমে পৌঁছানোর পথে সত্তরটি নূরের পর্দা অতিক্রম করেন। এক একটি পর্দার ঘনত্ব ছিল পাঁচশত বৎসরের রাস্তা। এ হিসাবে (পর্দাগুলোর মাঝখানের দূরত্বসহ) ৩৬ হাজার বৎসরের রাস্তা অতিক্রম করে রাসুল (সাঃ) আরশের মাকামে পৌঁছলেন।` (সূত্রঃ নূর-নবী, অধ্যক্ষ হাফেজ এম এ জলিল, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, ঢাকা, পৃঃ ৭৩)। এই পরিমাণ সময় যদি পৃথিবীতে ব্যয় হত, তাহলে তাঁর প্রত্যাবর্তনকালে তাঁর সাহাবীগণ তো দূরের কথা, আমাদেরও কোন অস্তিত্ব থাকত না। কিন্তু এ সময় পৃথিবীতে অতিক্রান্ত হয়নি, মহাবিশ্বের অন্য কোন সময়-অঞ্চলে (Time-Zone) অতিবাহিত হয়েছে। হাদিস ও ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে, মেরাজের রজনীতে মুহাম্মদ (সাঃ) সৃষ্টিজগতের শেষ প্রান্ত (সিদরাতুল মুনতাহা) অতিক্রম করেন। তারমানে এটা আমাদের মহাবিশ্বের বাইরের কোন জগৎ। আমরা আগেই জেনেছি, এই মহাবিশ্বের বাইরে আরও একাধিক মহাবিশ্ব থাকতে পারে। আরও জেনেছি, মহাবিশ্বের বাইরের কোন জগতের স্থান-কাল সম্পর্কে General Relativity Theory কিছু বলতে পারে না।

আরবী গ্রামার ও ডিকশনারী অনুযায়ী আরবী ‘বারক্‌‌` শব্দের অর্থ হলো ‘বিদ্যুৎ` আর এই ‘বারক্‌‌`-এর Superlative degree হলো ‘বোরাক`। আমরা জানি, আলোর গতি সেকেণ্ডে ৩০০,০০০ কিঃমিঃ। সেই আলো-কে Superlative degree করার কারণে বোরাক হচ্ছে এমন এক প্রাণী (বা মহাকাশযান) যার গতিবেগ ছিল আলোর গতির চাইতেও বেশি। আমরা আগেই জেনেছি, আইনস্টাইনের Theory of Relativity অনুযায়ী কোন বস্তুর গতি আলোর গতির সমান কিংবা বেশি হতে পারে না। যার ফলে এটা খুবই পরিষ্কার যে, এই Theory এমন কোন বস্তু বা ব্যক্তি সম্পর্কে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে না, যার গতিবেগ আলোর গতির চাইতেও দ্রুততর। উদাহরণস্বরূপ এখানে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রসঙ্গও আনা যায়। পবিত্র কোরআনে তাঁকে জ্যোতি বা আলো হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, ‘হে নবী! আমি তো তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, আল্লাহ্‌র অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারীরূপে এবং উজ্জ্বল আলো রূপে।` (সুরা আহযাব, ৪৫-৪৬)। কিংবা ‘হে কিতাবীগণ! আমার রাসুল তোমাদের নিকট এসেছে, তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে, সে তা তোমাদের নিকট প্রকাশ করে এবং অনেক কিছু ক্ষমা করে থাকে। আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট এসেছে একটি জ্যোতি এবং একটি স্পষ্ট কিতাব ।` (সুরা মায়িদা, ১৫)। এরকম ঘোষণা আরও রয়েছে পবিত্র কোরআনের সুরা আরাফ, ১৫৭, সুরা তাগাবুন, ৮, সুরা নিসা, ১৭৪ ও সুরা শুরা, ৫২ নম্বর আয়াতে। ইমাম গায্‌যালী (রহঃ)-এর দাকায়েকুল আখবার (মাওলানা আকমাল হোসেন খান অনূদিত, ব্রাদার্স পেপার এণ্ড পাবলিকেশন্স, ঢাকা), আবদুল খালেক রচিত ‘সাইয়েদুল মুরসালীন` (ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা) এবং অধ্যক্ষ হাফেজ এম এ জলিল রচিত ‘নূর-নবী` (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, ঢাকা) গ্রন্থে মুহাম্মদ (সাঃ) যে নূরের তৈরি তা কোরআন-হাদিসের সাহায্যে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

আমরা আগেই জেনেছি, নূরের তৈরি ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ) মানুষের আকৃতিতে কখনও কখনও মুহাম্মদ (সাঃ) নিকট আসতেন। এখন দেখা যাচ্ছে, নূরের তৈরি মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আল্লাহ্‌ মানুষের আকৃতিতে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন। আইনস্টাইনের Matter Transmission Theory বলছে, ‘Matter could be converted into power and then transmitted to a long distance and then reassembled to get back the matter`। অতএব, Matter Transmission পদ্ধতি, কোরআনের আলোকতত্ত্ব এবং হাদিসের বোরাকতত্ত্বের নিরিখে মুসলিম বিজ্ঞানীরা মেরাজের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এভাবে যে, সর্বময় শক্তিধর আল্লাহ্‌ তাঁর শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর শারীরিক অস্তিত্বকে প্রথমে বিদ্যুতে রূপান্তর করেন এবং পরে তা আলোতে প্রবর্তিত করেন। সাধারণ আলোর গতিবেগ প্রতি সেকেণ্ডে ৩০০,০০০ কিঃমিঃ, কিন্তু এ আলো-কে ‘বোরাক` নামক Superlative degree করার কারণে এর গতিবেগ ছিল সর্বাধিক এবং চোখের পলকে তিনি অর্থাৎ মুহাম্মদ (সাঃ) পুনরায় মানবরূপে তাঁর প্রভুর সামনে উপস্থিত হয়ে যান (সূত্রঃ বিজ্ঞানময় কোরআন: Al-Quran is All Science, মুহাম্মদ আবু তালেব, চতুর্থ সংস্করণ, পৃঃ ১৭৪-১৭৫)। এ ব্যাখ্যা গ্রহণ করা না করা যার যার নিজের ব্যাপার। কিন্তু Matter Transmission যে সম্ভব, এটা বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত। আইনস্টাইনের ভাষায়, “It followed from the special theory of relativity that mass and energy are both but different manifestations of the same thing—a somewhat unfamiliar conception for the average mind. Furthermore, the equation E = mc², in which energy is put equal to mass, multiplied by the square of the velocity of light, showed that very small amounts of mass may be converted into a very large amount of energy and vice versa. The mass and energy were in fact equivalent, according to the formula mentioned before. This was demonstrated by Cockcroft and Walton in 1932, experimentally.”

তথ্যসূত্রঃ

1.http://en.wikiquote.org/wiki/Albert_Einstein#Out_of_My_Later_Years_.281950.29

2. ‘Does the Inertia of a Body Depend Upon Its Energy-Content?` By Albert Einstein, published in the Annalen der Physik, 27 September 1905, http://www.fourmilab.ch/etexts/einstein/E_mc2/www/

3.http://www.worsleyschool.net/science/files/emc2/emc2.html

4.http://www.hyperhistory.com/online_n2/History_n2/index_n2/einstein_theory.html ।

‘মেরাজের কথা প্রচার করার পর কুরাইশরা তাকে নানা রকম প্রশ্ন করতে থাকল তার ঘটনার প্রমাণ দাখিল করার জন্য। মোহাম্মদ (সাঃ) তখন বললেন- তিনি এক মরুভুমির এক জায়গায় কিছু মানুষকে দেখলেন যাদের উট পালিয়ে গেছিল ও তারা সেগুলো খোঁজাখুঁজি করছিল। তিনি তাদের উটগুলো খুঁজে বের করে দিলেন ও দামাস্কাসের দিকে তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। ফেরার পথে তিনি দেখলেন এক জায়গাতে এক দল লোক ঘুমাচ্ছিল, তিনি তাদের পাত্র থেকে পানি পান করলেন ও পাত্র যেমন ছিল তেমন রেখে দিলেন।`—এ ঘটনা উল্লেখ করে জনাব ভবঘুরে মন্তব্য করেছেন, ‘উনি চলেছিলেন বোরাকের পিঠে সওয়ার হয়ে উর্ধ্বাকাশ দিয়ে আল্লাহর সাথে দেখা করার জন্য সেই আল্লাহর আরশে। হঠাৎ আকাশপথে যাত্রা বিরতি করে মরুভূমিতে নেমে পড়েন এবং উপরোক্ত কর্মকান্ডসমূহ করেন ।এমন উদ্ভট গল্প কে কবে শুনেছে?` এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, এ বর্ণনাটি কোরআন, হাদিস ও ইতিহাস দ্বারা সমর্থিত নয়। এ বর্ণনার উৎস একমাত্র ‘কিতাবুস্‌ সিরাহ্‌’ (যাকে সংক্ষেপে সিরাহ্‌ বলা হয়) নামক একটি গ্রন্থ। যেখানেই এ ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যাবে, সেখানেই ‘কিতাবুস্‌ সিরাহ্‌’-এর Reference পাওয়া যাবে। জনাব ভবঘুরেও যে লিংক থেকে (http://www.questionsonislam.com/index.php?s=article&aid=10849) ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন, সে লিংকের সূত্রও ওই ‘সিরাহ্`। এই ‘সিরাহ্` বা ‘কিতাবুস্‌ সিরাহ্‌’ সম্পর্কে একটু জানা দরকার। এ গ্রন্থের রচয়িতা হলেন মহম্মদ ইবনে ওমর (৭৫২-৮২৯),  যিনি ওয়াকেদী নামেই বেশি পরিচিত।  ইসলামের সকল ইমাম, পণ্ডিত ও মোহাদ্দেস (হাদিসবিদ) সর্বসম্মতভাবে এই জীবনীকারকে মিথ্যা ও বানোয়াট বর্ণনার জন্য অগ্রহণযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন (সূত্রঃ মহানবী, ডক্টর ওসমান গনী, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ৫৪) । মজার কথা হলো, পশ্চিমা লেখকদের প্রধান অবলম্বন কিন্তু এই ওয়াকেদীই। Rev. T. P. Hughes তাঁর ‘Dictionary of Islam` গ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘A celebrated Moslem Historian, much quoted by Muir in his “Life of Mahomet` (সূত্রঃ পূর্বোক্ত)। ধারণা করা হয় যে, বাজারে মুহ্ম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে যতগুলি আজগুবি কাহিনী চালু আছে, তার প্রায় সবগুলিরই উৎস এই ওয়াকেদী। উটের কাফেলার বর্ণনাও সে রকম একটি আজগুবি বর্ণনা, যা দুটি কারণে বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথমতঃ, মেরাজের সময় মুহাম্মদ (সাঃ) জিব্রাইলের (আঃ)-এর পরামর্শ ছাড়া কিছুই করেননি। এমনকি ডানে-বামেও তাকাননি। সেখানে তিনি আগ বাড়িয়ে আকাশ থেকে নিচে কারও সাথে কথা বলবেন, এটা বাস্তবসম্মত নয়। দ্বিতীয়তঃ, কারও জিনিস অনুমতি ছাড়া গ্রহণ করা যে চুরি এবং মহাপাপ—এ কথা তিনি আগেই তাঁর অনুসারীদের শিখিয়েছেন। কাজেই কোন ঘুমন্ত ব্যক্তির পানি তিনি তাঁর অগোচরে পান করবেন না। তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য ছিল, অপরকে যা নির্দেশ দিতেন, নিজে তা আগে পালন করতেন। তারপরও তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে, এই বর্ণনা সত্য, তাহলেও দেখা যাবে, লিংকের বর্ণনার সাথে জনাব ভবঘুরে’র বর্ণনা মিলছে না। ওই লিংকে কোথাও বলা হয়নি যে, রাসুল (সাঃ) আকাশপথে যাত্রাবিরতি করে মরুভূমিতে নেমে পড়েছিলেন। বরং সেখানে বলা আছে, তিনি যাওয়ার পথে অমুকের হারিয়ে যাওয়া উটগুলোকে পথনির্দেশ করেন, যা বোরাকে সওয়ার অবস্থায়ও হতে পারে। আর ‘ফেরার পথে একদল ঘুমন্ত লোকের পাত্র থেকে পানি পান করার ঘটনা`টি বর্ণিত আছে এভাবেঃ After my return, I was in Dabhanan, I came across the caravan of so-and-so’s sons and his community was sleeping. I opened the covered water-cup belonging to them and drank from it. I covered it as it had been before. অর্থাৎ তাঁর পৃথিবীতে অবতরণের পর, তিনি যখন Dabhanan নামক স্থানে তখন এ ঘটনা ঘটে। তারমানে ‘আকাশপথে যাত্রাবিরতি`র কোন ঘটনা ওই লিংকে পাওয়া যাচ্ছে না।

আলোচ্য লেখায় কোরআনের সুরা নাজম ১-১৮ আয়াতের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘সে তাকে আরেকবার দেখেছিল- এখানে তাকে বলতে আল্লাহকেই বুঝানো হচ্ছে, কারণ জিব্রাইল মোহাম্মদের সাথে সব সময়ই ছিল সুতরাং তাকে বলতে জিব্রাইল বুঝালে বাক্যটির কোন অর্থই হয় না। এর অর্থ কোরানের আল্লাহ্‌ বলছেন তাঁর আকার আছে, অথচ ইসলামের মূল বক্তব্য হলো আল্লাহ্‌র কোন আকার নাই।`

আল্লাহ্‌কে দেখা গেছে, তাই আল্লাহ্‌র আকার আছে—এটা খুবই দুর্বল যুক্তি। যা কিছু দেখা যায়, তারই যদি আকার থাকে, তাহলে তো আগুন, পানি—এসবেরও আকার আছে। আল্লাহ্‌ নিরাকার বলতে সেরকমই বোঝানো হয়েছে, আগুন ও পানি বলতে আমরা যেরকম বুঝি। অর্থাৎ যার কোন নির্দিষ্ট আকার নেই। পার্থক্য হলো, আগুন ও পানি যে পাত্রে (বা চিমনিতে) রাখা হয়, সে আকার ধারণ করে, আর ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ্‌ যখন যে রূপ ধারণ করতে চান, তখন সে রূপ ধারণ করতে পারেন। মানুষের মত তাঁর এই সীমাবদ্ধতা নেই যে, সারাজীবন একই রকম থাকতে হবে। লেখাটির অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘এখানে দেখা যাচ্ছে খুব নিষ্কলুষ একটা বাক্য- Muhammad was staying in the house of his cousin, Hind, daughter of Abu Talib, who was also called Umm Hani- যেন এটা কোন বিষয়ই নয়।` মজার কথা হলো, লেখক নিজেও জিব্রাইল (আঃ) প্রসঙ্গে গোটা লেখায় এই কাজই করেছেন। জিব্রাইল (আঃ)-এর প্রসঙ্গ এমনভাবে বলে গেছেন, যেন এটা কোন ব্যাপারই নয়। তিনি বলছেন, ‘বোরাক নামক একটা জন্তু যার ডানা আছে সে কিভাবে বায়ুমন্ডলের বাইরে গিয়ে এক এক করে সাতটা বেহেস্ত ভ্রমণ করল? কারণ বায়ূমন্ডলের বাইরে তো ডানা দিয়ে উড়ে যাওয়া যায় না।` বোরাক বায়ূমন্ডলের বাইরে ডানা দিয়ে উড়ে যেতে পারে না, তাহলে জিব্রাইল (আঃ) যাচ্ছেন কিভাবে? জিব্রাইলেরও তো ডানা আছে। তিনি বলছেন, আল্লাহ্‌র আকার নেই, তাই আল্লাহ্‌র সাথে দেখা করা যায় না। জিব্রাইলের (আঃ) কি আকার আছে? থাকলে তাঁকে অন্যরা দেখতে পাচ্ছে না কেন? তিনি একেক সময় একেক রূপেই বা আসছেন কিভাবে? (সূত্রঃ বুখারী শরীফ, ৫ম খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, হাদিস নম্বর ২৯৯০, পৃঃ ৩৭৩)।

প্রকৃতপক্ষে সুরা নাজম ১-১৮ আয়াত মনোযোগ সহকারে পড়লে যে কেউ দেখবেন, এখানে ১-১০ আয়াতে জিব্রাইলের (আঃ) সাথে এবং ১১-১৭ আয়াতে আল্লাহ্‌র সাথে সাক্ষাতের বিষয় বর্ণিত হয়েছে। ৫ নম্বর আয়াতে তো শক্তিশালী ফেরেশতার কথা উল্লেখই আছে। ৬-৯ নম্বর আয়াতে আছে সেই ফেরেশতার নিকটবর্তী হওয়ার বর্ণনা। ১০ নম্বর আয়াতে আছে উক্ত ফেরেশতা কর্তৃক মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আল্লাহ্‌র দাওয়াত সম্পর্কে অবহিত করার বিষয়, যা লেখকের পূর্বে উদ্ধৃত একটি ওয়েবসাইটেই সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে, যেখানে ’মহান আল্লাহ্‌ জিব্রাইল (আঃ)-কে বলছেন, ‘আমার সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়তম ব্যক্তি অবিশ্বাসীদের ব্যবহারে মনে কষ্ট পেয়েছে এবং ঐ অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে। তুমি তাঁকে দাওয়াত দিয়ে আমার কাছে নিয়ে আস।` (http://www.muhammadanreality.com/ascentionmiraj.htm)। ১১-১৭ আয়াতে আল্লাহ্‌র সাথে দু’বার সাক্ষাতের বিষয় বর্ণিত আছে। ১৮ আয়াতে মেরাজে গমনের পর মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ্‌র যে নিদর্শনাবলী দেখেছেন, তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (সূত্রঃ বুখারী শরীফ, ৫ম খণ্ড, হাদিস নম্বর ৩০০৫, ৩০০৬, ৩০০৭ ও ৩০০৮, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, পৃঃ ৩৮০-৩৮১ এবং সহীহ মুসলিম শরীফ, হাদিস নম্বর ৩৪০, ৩৪১, ৩৪২, ৩৪৩, ৩৪৭, ৩৫০, ৩৫২, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, পৃঃ ২৯০-২৯১ ও ২৯৫-২৯৬)।

‘মানুষ কখন কসম কাটে? কারা কসম কাটে? সাধারনত মিথ্যাবাদী প্রকৃতির মানুষ যাদেরকে অন্যরা বিশ্বাস করে না তারাই কসম কাটে, কসম কাটে আল্লাহ্‌ বা খোদার নামে। যেমন বলে- খোদার কসম আমি মিথ্যা বলছি না।`—লেখকের এই কথাগুলোও অতি সরলীকরণ, স্ববিরোধিতা ও যুক্তিহীনতার নমুনা মাত্র। যারা আল্লাহ্‌র নামে কসম কাটে, তারা সাধারণত মিথ্যাবাদী; তাহলে যারা অন্য বস্তুর নামে কসম কাটে তারা তো সত্যবাদী! এখানে আল্লাহ্‌ তো অন্য বস্তুর নামেই শপথ করছেন। এখানে মিথ্যার সুযোগ কোথায়? কেউ কেউ বলতে পারেন, আল্লাহ্‌ তো নিজের নামে কসম করবেন না, তাই অন্য বস্তুর নামে করছেন। এটাও সত্য নয়। অনেক সুরায় (যেমন, সুরা শামস, সুরা লাইল, সুরা বুরুজ) তিনি নিজের নামেও শপথ করেছেন। এখানে ব্যাখ্যা কি দাঁড়াবে? একই সাথে সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী? ১৯৭১ সালে যারা আল্লাহ্‌র নামে শপথ করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, যারা পতাকা ছুঁয়ে দেশকে স্বাধীন করার শপথ নিয়েছিলেন, তারাও কি মিথ্যাবাদী? জেল থেকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি পড়েছি, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ্‌ আছেন। সত্যের জয় হবেই।` তিনিও কি মিথ্যা কথা বলছেন?

কোরআন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আল্লাহ্‌ যখন মানুষকে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছেন, তখন সেই বিষয়ের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য শপথ করছেন। যেমন, তিনি যখন বলছেন, মানুষ খুব খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন কালের শপথ করছেন (যেমন, সুরা আসর)। আবার নক্ষত্রলোকে ভ্রমণের (মেরাজ) বর্ণনায় নক্ষত্রের শপথ করছেন (যেমন, সুরা নাজম)। যখন কোরআনের গুরুত্ব বর্ণনা করছেন, তখন কোরআনের শপথ করছেন (যেমন, সুরা সাদ, সুরা ইয়াসিন, সুরা যুখরুফ, সুরা দুখান, সুরা কাফ, সুরা তূর ও সুরা কালাম)। তাফসিরকারকদের মতে, এগুলি প্রচলিত অর্থে শপথ নয়। এগুলি সাক্ষ্য। মানুষকে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মানুষেরই জন্য সৃষ্ট বস্তুর সাক্ষ্য। এটা দিয়ে তিনি তাঁর কথার গুরুত্ব বুঝাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে উল্লেখ আছে, ‘আর তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমস্ত কিছু নিজ অনুগ্রহে, চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য তাতে তো রয়েছে নিদর্শন।`(সুরা জাছিয়া, ১৩)। কোরআনে আরও উল্লেখ আছে, ‘‘পরন্তু আল্লাহ্‌ সাক্ষ্য দেন তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন, তার মাধ্যমে। তিনি তা অবতীর্ণ করেছেন নিজ জ্ঞানে এবং ফেরেশতাগণও সাক্ষ্য দেয়। আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট।` (সুরা নিসা, ১৬৬)।

সবচেয়ে মজার কথা হলো, মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মেরাজের কথা যে শুধু কোরআনেই আছে, তা কিন্তু নয়—বিশ্বের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও আছে। তিনি যে আল্লাহ্‌র নবী বা অবতার, তাঁর নাম যে ‘মুহাম্মদ` এবং ‘আহমদ`—তা-ও উল্লেখ আছে। যাঁরা আগ্রহী, তাঁরা নিচের Reference দেখতে পারেন—

(১) ভবিষ্য পুরাণ, প্রতিসর্গ পর্ব, ৩য় খণ্ড, ৩য় অধ্যায়, মন্ত্র-৫-২৮, ৪১৯ পৃঃ হিন্দী অনুবাদক পণ্ডিত শ্রীরাম শর্মা আচার্য, National Library, Calcutta

(২) শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ, উপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র অনূদিত, দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, প্রথম স্কন্ধ, পরমেশ্বরের আকার ও অবতার কথন, পৃঃ ৭ এবং দ্বাদশ স্কন্ধ, অথ কলিধর্ম কথন, পৃঃ ৮৫৮

(৩)কল্কিপুরাণ, তৃতীয়াংশ, ২১ অধ্যায়, শ্লোক-৩৯, দ্বিতীয়াংশ, একাদশ অধ্যায়, শ্লোক-৫, প্রথমাংশ, তৃতীয় অধ্যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্লোক, দ্বিতীয়াংশ, প্রথম অধ্যায়, শ্লোক-২৩, তৃতীয় অংশ, ষোড়শ অধ্যায়, শেষ অধ্যায়, ১ম সুক্ত এবং প্রথমাংশের ৩য় অধ্যায়, ২৫ শ্লোক

(৪) সামবেদ-সংহিতা, পরিতোষ ঠাকুর অনূদিত, হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা, দ্বিতীয় অধ্যায়,  ঐন্দ্র কাণ্ডঃইন্দ্রস্তুতি, চতুর্থ খণ্ড, মন্ত্র-১৫২ ও ১৫০০ এবং প্রথম অধ্যায়, সপ্তম খণ্ড, মন্ত্র ৬৪, পৃঃ ৬

(৫) ঋগ্বেদ-সংহিতা, রমেশচন্দ্র দত্ত অনূদিত, হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা, ৮ম মণ্ডল, ৬ষ্ঠ সুক্ত, মন্ত্র-১০,

(৬) অথর্ববেদ-সংহিতা, শ্রীবিজনবিহারী গোস্বামী অনূদিত, হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা, ২০ কাণ্ড, ঊনবিংশ সুক্ত, মন্ত্র-১ এবং ২০তম কাণ্ড, ৯ম অনুবাক, ৩১ সুক্ত, মন্ত্র-২

(৭)) যজুর্বেদ-সংহিতা, ১ম কাণ্ড ৭ম প্রপাঠক ৪ মন্ত্র, পৃঃ ৩৪১-৩৪২

(৮)  Gospel of Buddha by Carus, পৃঃ ২১৭ ও ২৫৪

(৯) Muhammad in the Buddhist Scriptures, p. 15, 64 and 79

(১০) Warren, পৃঃ ৭৯

(১১) The Dhammapada, S.B.E., Vol X, p. 67 ও Vol XI, p. 64

(১২) Saddharma-Pundrika, S.B.E., Vol XXI, p. 225)।

(১৩) The Life and Teachings of Buddha, Anagarika Dhammapada, p. 84

(১৪) Romantic History of Buddha by Beal, p. 237 and 241

(১৫) Taka Kusu, p. 213

(১৬) জিন্দাবেস্তা, প্রথম পরিচ্ছেদ

(১৭) Deuteronomy, 18-18, The Books of Old and New Testament, Printed in Great Britain

(১৮) Old testament, Song of Solomon chapter 5 verse 16:, “Hikko Mamittakim we kullo Muhammadim Zehdoodeh wa Zehraee Bayna Jerusalem.” অর্থ ‘His mouth is most sweet: yea, he is Muhammad. This is my beloved, and this is my friend, O daughters of Jerusalem.”

(১৯) St. John, 14-16

(২০) Sir William Muir, Life of Mohamedt (Abridge Edition), Page 164

(২১) বেদ ও পুরাণে আল্লাহ্‌ ও হযরত মোহাম্মদ, মূল রচনাঃ ধর্মাচার্য ড. বেদপ্রকাশ উপাধ্যায়, রিসার্চ স্কলার, প্রয়াগ বিশ্ববিদ্যালয়, এলাহাবাদ, ভারত। অনূবাদঃ অধ্যাপক ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রাক্তন অধ্যাপক, পঞ্চানন সংস্কৃত বিদ্যামন্দির, শিবপুর, হাওড়া, ভারত) ও ডঃ গৌরী ভট্টাচার্য (অধ্যাপক, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়), কলিকাতা।

ইতিহাস ও গবেষণাসূত্রে জানা যাচ্ছে, ঋগবেদের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০-১৫০০ শতাব্দীতে (সূত্রঃ Stuart Piggot, Prehistoric India, Chapter VII এবং ঋগ্বেদ-সংহিতা, রমেশচন্দ্র দত্ত অনূদিত, ‘ঋগ্বেদ পরিচয়` অংশ, হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা, পৃঃ ৪৫-৪৬)।  ঋকবেদের দুই থেকে তিন শতাব্দীর মধ্যে পরবর্তী তিনটি বেদ রচিত হয়। ডা. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মতে, ‘ধর্মের মূলভিত্তি বেদ। ঋকবেদ অর্থাৎ ঋকসংহিতা জগতের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ, যা তিলকের মতে ৪৫০০ খ্রিঃপূর্বে রচিত।’ (সূত্রঃ ডা. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস, পৃ: ৪৪)। উপনিষদের রচনাকাল হলো, খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকে (সূত্রঃ ঋগ্বেদ-সংহিতা, রমেশচন্দ্র দত্ত অনূদিত, ঋগ্বেদ পরিচয়, ড. হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা, পৃঃ ৩৫)। গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন খ্রিঃপূঃ ষষ্ট শতকে উত্তর-পূর্ব ভারতের বর্তমান নেপাল ও বিহারের সীমান্তবর্তী রাজ্যে (সূত্রঃ ঋগ্বেদ-সংহিতা, রমেশচন্দ্র দত্ত অনূদিত, ‘ঋগ্বেদ পরিচয়` অংশ, পৃঃ ৩৪)। অন্য এক স্থানে আছে, `Five hundred and sixty years before Christ a religious reformer appeared in Bengal-Buddha’।(সূত্রঃ Buddha and Early Buddhism)। বুদ্ধদেব প্রায় ৪৫ বছরকাল ধর্মপ্রচার করেন এবং খ্রিঃপূঃ ৪৮৩ অব্দে দেহত্যাগ করেন। ইহুদী ধর্মের প্রবর্তন হয় প্রাচীন মিশরে। এই ধর্মের প্রবর্তকের নাম মোজেস যিনি মুসলমানদের নিকট হযরত মুসা (আঃ) নামে পরিচিত। মিশরের রাজা ফেরাউনের রাজত্বকালে মোজেসের আবির্ভাব ঘটে। জরথুস্ত্র ধর্মের প্রবর্তক জরথুস্ত্র পারস্যের পূর্বাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রবর্তিত ধর্মমতকে সাধারণভাবে পার্সী ধর্ম বলা হয়। যিশু ইসরাইলের জুদিয়া রাজ্যের বেথেলহেম নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক নাম জোশুয়া; জিসাস ক্রাইস্ট বিদেশী নাম। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে তাঁর সময়কালের ব্যবধান ছয়শত বৎসর (সূত্রঃ Sir Syed Ameer Ali, ‘The Spirit of Islam, ড. রশীদুল আলম অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ২২৪)।

জনাব ভবঘুরে লিখেছেন, ‘জেরুজালেম থেকে মক্কার সোজা বিমান উড্ডয়ন দুরত্ব হলো ১,২১৫ কি. মি.।আর স্থল পথ দুরত্ব নিশ্চয়ই ১,৩০০ কি. মি. এর নীচে হবে না। সেই কালে কঠিন ও দুর্লঙ্ঘ এত বিরাট দুরত্ব অতিক্রম করে মানুষ সচরাচর জেরুজালেম থেকে মক্কা বা মক্কা থেকে জেরুজালেম যেত না। সে কারণে মক্কাতেও জেরুজালেম আগে গেছে এরকম মানুষ না থাকার সম্ভাবনাই বেশী ছিল। তার মানে জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদ কোথায় আছে তা দেখতে কেমন তা জানার মত লোক মক্কাতে ছিল বলে বিশ্বাস করা কঠিন। অন্য কথায়, আল-আকসা নামের মসজিদ বা মন্দির-এর বাস্তব অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না তা কেউ জানত না।` এই যদি হয় ৬২১ খ্রিস্টাব্দের মক্কা ও জেরুজালেমের অবস্থা, তাহলে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ শতাব্দীর ভারত ও খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ট শতাব্দীর নেপালে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মেরাজের বৃত্তান্ত গেল কিভাবে? এই দুই দেশ ছাড়াও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্মের ৬০০ বছর পূর্বের বেথেলহেম, হাজার বছর পূর্বের মিসর এবং পারস্যে তাঁর নাম, জীবনবৃত্তান্ত ও মেরাজের বিবরণ গেল কিভাবে? তিনি কি তাঁর জন্মের আগেই ঐ সকল কিতাবে এসব লিখে এসেছিলেন?

মেরাজ এমন একটি ঘটনা, যা বর্তমান বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। হয়তো এমন একটি দিন আসবে, যেদিন ভবিষ্যতের বিজ্ঞান এর  যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে সক্ষম হবে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। দ্বাদশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, ‘সূর্য স্থির নক্ষত্র।` ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রমাণিত হয়েছে, সূর্য একটি গতিশীল নক্ষত্র। পূর্বে বলা হয়েছিল, সূর্যের আলো ব্যতিরেকে সালোক সংশ্লেষণ (Photosynthesis) হয় না। এখন আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, অন্ধকারেও Photosynthesis ঘটতে পারে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান Closed Bing Bang Theory দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, মহাকর্ষ শক্তির (Gravitational Force) প্রাবল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে মহাবিশ্ব একটি বিন্দুতে এসে Closed হয়ে যাবে। বিজ্ঞান এভাবেই Trial and Error-এর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। বিজ্ঞান যখনই নতুন কোন বস্তু বা শক্তির সাথে পরিচিত হয়েছে, তখন দেখেছে, প্রচলিত পরিমাপের একক দিয়ে তাকে পরিমাপ করা যাচ্ছে না। ফলে, প্রতিবারই এমন ঘটেছে যে, বিজ্ঞান আগে কোন একটি নির্দিষ্ট শক্তি বা বস্তুর অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তারপর তার পরিমাপের একক আবিষ্কার করেছে। যেমন, আলোকের ঔজ্জ্বল্য পরিমাপের একক ক্যাণ্ডেলা, তাপমাত্রা মাপার জন্য ফারেনহাইট, বিদ্যুৎ পরিমাপের জন্য ভোল্ট এবং  মহাজাগতিক দূরত্ব মাপার জন্য আলোকবর্ষ ইত্যাদি। মেরাজও সেরকম বিজ্ঞানের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। এরকম নতুন অভিজ্ঞতা বিজ্ঞানের আরও আছে, যার ব্যাখ্যা বর্তমানে দেয়া যাচ্ছে না। যেমন, Bing Bang বা বৃহৎ বিস্ফোরণ। এই বৃহৎ বিস্ফোরণের পূর্বে মহাবিশ্বের কিছুই বলা যাচ্ছে না। কারণ, ‘বৃহৎ বিস্ফোরণে এসে সকল Scientific Theory ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতাও। আমরা যদি জানতে পারি, বৃহৎ বিস্ফোরণের পরে কি ঘটেছিল, তাহলেও আমরা তার আগে কি ঘটেছিল তা নির্ধারণ করতে পারি না। শুধু কল্পনা করতে পারি, অতীতের যে কোন কালে ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন।` (সূত্রঃ পূর্বোক্ত, Chapter-I: Our Picture of the Universe and Chapter-III: The Expanding Universe http://www.fisica.net/relatividade/stephen_hawking_a_brief_history_of_time.pdf)।

গোঁড়ামী যে ধর্মের একচেটিয়া জিনিস নয়, এটি যে নাস্তিকদের মধ্যেও থাকতে পারে, এটা আমরা প্রথম জানতে পারি মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘The bigotry of the nonbeliever is for me nearly as funny as the bigotry of the believer‌`. অর্থাৎ ‘আস্তিক ও নাস্তিক উভয়েরই গোঁড়ামী আমার কাছে সমান হাস্যকর।` (Letter to Rabbi Solomon Goldman of Chicago’s Anshe Emet Congregation, http://en.wikiquote.org/wiki/Albert_Einstein)। আর বর্তমান সময়ের প্রগতিবাদী লেখক-বুদ্ধিজীবী যতীন সরকার তাঁর ‘প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন` বইতে এই গোঁড়া নাস্তিকদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন, তাদের চিহ্নিত করেছেন প্রগতির শত্রু হিসেবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের আশেপাশে এ রকম দায়িত্বশীল বস্তুবাদী আস্তিকদের খুব বেশি সংখ্যায় আমরা দেখতে পাই না। বরং খুব কম সংখ্যায় হলেও দেখা পাই এমন কিছু স্বঘোষিত নাস্তিকের যাঁদের বৈদগ্ধের ও অবিশ্বাসের অহংকার আছে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদে বিশ্বাস ও স্থির প্রত্যয় নেই, লোকসাধারণের ভাব-ভাবনার সঙ্গে গভীর যোগাযোগ নেই এবং কোনরূপ সামাজিক দায়িত্ববোধও নেই। এঁদের দেখাদেখি যাঁরা নাস্তিকতার ফ্যাশনে আক্রান্ত হন, তাঁরা তো আরও ভয়ংকর। এই ভয়ংকরেরাই দায়িত্বহীন কথাবার্তা ও আচরণ দিয়ে ধর্মান্ধ ও মৌলবাদীদের পথচলাকে সুগম করে দেন। ফ্যাশনদুরস্ত নাস্তিকদের স্থুল যুক্তি ও বাহ্যিক আচরণগুলিকেই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদী ও মৌলবাদীরা আরও স্থুলভাবে লোকসাধারণের কাছে উপস্থাপন করে এবং তার ফলে লোকসাধারণ ধর্মধ্বজীদের মিত্র বলে গ্রহণ করে বিজ্ঞানসম্মত ধ্যান-ধারণার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখে।` (সূত্রঃ যতীন সরকার, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন, নাস্তিকতা-মুর্দাবাদ, বিজ্ঞানচেতনা-জিন্দাবাদ, শোভা প্রকাশ, ঢাকা, পৃঃ ১২৬)।

যতীন সরকারের কথাগুলোকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। এ কারণে যে, আমাদের সমাজে এমন একদল বর্ণচোরা নাস্তিকের আবির্ভাব ঘটেছে, যাদের সাথে ধর্মান্ধ মৌলবাদের বিস্ময়কর আঁতাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের সমাজে একদল ধার্মিক ও একদল অধার্মিক আগেও ছিলেন। যারা অধার্মিক, তাঁরা ধর্ম মানতেন না, ধর্ম-কর্মও করতেন না। তাঁরা নানা মাধ্যমে তাঁদের বিশ্বাস তুলে ধরতেন, কিন্তু অন্যের বিশ্বাসকে আক্রমণ করতেন না। কারও চরিত্রও হনন করতেন না। যা বলার তা শিল্পের ভাষায়, সাহিত্যের ভাষায় বলতেন। যাদের বুঝার তারা বুঝে নিতেন। যেমন, কাজী আবদুল ওদুদ, আরজ আলী মাতব্বর। তাঁরা মোল্লাতন্ত্রের কাছে ‘কাফের` ফতোয়া পেয়েছেন। কিন্তু জনসমর্থনও পেয়েছেন। প্রাকৃতজনের ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে গোঁড়ামী ছিল না। আবার শিক্ষিত ধার্মিক শ্রেণীর কাছে মোল্লাতন্ত্রের জায়গা ছিল না। ফলে উভয় দলের (ধার্মিক ও অধার্মিক) মধ্যে সহাবস্থান ছিল। সে সময় জঙ্গীবাদ ছিল মিশরে, মধ্যপ্রাচ্যে। মৌলবাদ ছিল ইউরোপে। সেখানে ‘ব্লাসফেমি আইন` ছিল, এখনও আছে। আরও পরে জঙ্গীবাদ এসেছে আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে। কিন্তু বাংলাদেশে কোন জঙ্গীবাদ ছিল না। তাহলে এই জঙ্গীবাদ বাংলাদেশে কখন ঢুকল?

এটা জানতে হলে পেছনে তাকাতে হবে। দেখতে হবে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ কখন ঢুকল, কার কারণে ঢুকল। এটা জানা আমাদের জন্য জরুরী। কারণ এ ঘটনা বেশিদিন আগে হয়নি। নব্বইয়ের দশকে হয়েছে। একজন ‘নারীবাদী` লেখিকা সর্বপ্রথম ‘আল্লাহ্‌`, ‘রাসুল` ও ‘কোরআন` সম্পর্কে কুৎসিত ও অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ শুরু করেন। এভাবে তিনি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হাতে ইস্যু তুলে দেন। যারা নজরুল ও ইকবালকে কাফের ফতোয়া দিয়েও জনসমর্থন পায়নি, তারা জনসমর্থন পেতে শুরু করে, ‘ব্লাসফেমি আইন` তৈরীর দাবীতে রাস্তায় নেমে আসে। এই লেখিকা কৌশলে এ আন্দোলনকে আরও উস্‌কে দেন। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীর আক্রমণে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়। তার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটে। তসলিমা বাংলাদেশের ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে একটি উপন্যাস লেখেন, যার নাম ‘লজ্জা`। এ উপন্যাস হিন্দু-মুসলিম উভয় মৌলবাদকেই সহায়তা যোগায়। বাংলাদেশের ধর্মান্ধশ্রেণী নতুন রাজনৈতিক ইস্যু পেয়ে যায়, আগে যেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না, সেখানেও প্রবেশাধিকার লাভ করে। ওদিকে ভারতের মৌলবাদী দল ‘বিজেপি` বইটি লুফে নেয়। তারা বইটির হাজার হাজার কপি ছাপিয়ে বিতরণ করে। বিজেপির হিন্দী ও ইংরেজী মেনিফেস্টোতে ‘লজ্জা`র অনুবাদ অন্তর্ভুক্ত হয়।‌` (সূত্রঃ তসলিমার ‘লজ্জা` ও বিপন্ন সময়, অশোক চট্টোপাধ্যায়, তসলিমা নাসরিনের স্বরূপ সন্ধানে, মল্লিক ব্রাদার্স, কলিকাতা, পৃঃ ৪২-৪৬)। যার ফল তারা হাতেনাতে পায়। ভারতের পরবর্তী নির্বাচনে তারা বিপুল ভোটে ক্ষমতাসীন হয়। বিজেপি সরকারের কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আরও নতুন নতুন ইস্যু পায়। ততদিনে তসলিমার কাতারে আরও নতুন লেখক এসে যোগ দেন। তারাও ধর্মের বিরুদ্ধে কুৎসিত ও উস্কানিমূলক লেখা শুরু করেন। তাতে ধর্মব্যবসায়ী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আরও শক্তিশালী হয়। শেষ পর্যন্ত যা কেউ কল্পনাও করেনি, তা ঘটে। রাষ্ট্রক্ষমতার এক অবিশ্বাস্য পালাবদল ঘটে। বাংলাদেশের পরজীবী ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ী শক্তি অন্যের ঘাড়ে চড়ে প্রথমবারের মত রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়। তারপর যা হওয়ার, তা-ই হয়। বাংলাদেশেও জঙ্গীবাদ ঢুকে পড়ে। শায়খ, মুফতী ও বাংলা ভাইদের উত্থান ঘটে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কিছু স্বঘোষিত গোঁড়া নাস্তিক্যবাদীর হঠকারিতায় বাংলাদেশ আজ আফগানিস্তান হওয়ার স্বপ্নও দেখছে!

‘মহানবী মোহাম্মদের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র, পর্ব-২` লেখাটি পড়লে মনে হবে ‘মেরাজ` যে সত্য নয়, এটা প্রমাণ করাই এখন সময়ের দাবী। এটাই অগ্রাধিকার। ১৪০০ বছর ধরে এরকম একটি জিনিস বিশ্বাস করার কারণেই আজ পৃথিবীর এই দূরবস্থা! চারদিকে এত মৃত্যু, এত শোষণ, এত বঞ্চনা, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, পররাজ্য দখল, সম্পদ লুণ্ঠন, বিশ্বায়নের নামে আন্তর্জাতিক মহাজনশ্রেণীর আধিপত্য—সবকিছুর মূলে এই মেরাজ! তাই যে করেই হোক, মিথ্যা যুক্তি দিয়ে, ভুল উদ্ধৃতি দিয়ে, অসত্য, অর্ধসত্য ও বিকৃত তথ্য দিয়ে এবং স্ববিরোধিতা দিয়ে হলেও এই ঘটনাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে। তাতেই সব ঝামেলা জাদুর প্রদীপের মত উধাও হয়ে যাবে! কিন্তু অন্যের চরিত্রহনন করতে গিয়ে আমারও যে চরিত্রহনন হচ্ছে, মিসেস উইলিয়ামের মত অবস্থা হচ্ছে—সে খেয়াল কি আছে? মিসেস উইলিয়ামের একটি কৌতুক আছে, সেই কৌতুক দিয়েই লেখাটা শেষ করছি—

মিসেস উইলিয়াম আদালতে গেছেন তার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে।

আদালত জানতে চাইল, ‘আপনার অভিযোগ কি?`

মিসেস উইলিয়াম বললেন, ‘আমার স্বামীর চরিত্র ভাল না।`

‘কিভাবে বুঝলেন?`

‘আমার একটা বাচ্চাও তার মত না।`

এ কারণেই আমি মনে করি ‘মুক্তমনা` ব্লগে এমন কোন লেখা প্রকাশ করা সমীচীন নয়, যা প্রকারান্তরে মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতার হাতকেই শক্তিশালী করবে। যেমন করেছে আগেও।

ব্লগের সকলের প্রতি একরাশ শুভকামনা।

লেখক পরিচিতিঃ কবি, ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের গীতিকার। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ১২ (বারো)।