যুক্তি, বুদ্ধি নিয়ে নির্ধার্মিক (‘এথিস্ট’) মানুষ যখনই ধর্মবিশ্বাসীদের সঙ্গে তর্কে নামেন, অনেক সময়ই দেখা যায় যে আলোচনা অচিরেই গুটিয়ে যায় কারণ একটি বাঁধা গতে ধর্মবিশ্বাসীরা বলে থাকেন – ওঃ নির্ধার্মিক? তাহলে তো কোন কিছুতেই বিশ্বাস নেই – তাহলে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি?
বিভিন্ন ইন্টারনেট-ভিত্তিক ফোরামে এহেন কথা শুনতে শুনতে এক প্রতিষ্ঠিত নির্ধার্মিক ব্লগার – যিনি সর্বদা কাট্লফিশ ছদ্মনামের আড়ালে লেখেন, এবং যাঁর প্রায় সমস্ত পোস্ট হয় কবিতায় – একটি লেখা লেখেন, নির্ধার্মিক হিসেবে তিনি কিসে কিসে বিশ্বাস করেন তার একটা ফিরিস্তি দিয়ে। লেখকের অনুমতিক্রমে সেই লেখাটি এখানে অনুবাদ করে দেওয়া হল। অনুবাদে ভুলত্রুটি মার্জনীয়।
নির্ধার্মিক-এর বিশ্বাস
বিশ্বাস আমার প্রেমে-করুণায়
বিশ্বাস আমার সহায়তা-হাতে
বিশ্বাস আমার দৃঢ় অভিমতে
বিশ্বাস মত প্রকাশেতে
বিশ্বাস করি সহযোগিতায়
কঠিন পথটা পার করে
বিশ্বাস করি পারব আমরা
বিশ্বাস নেই – ঈশ্বরে।
বিশ্বাস করি শিক্ষা দীক্ষা
বিশেষ-জ্ঞানের সাধনায়
বিশ্বাস করি দূরদৃষ্টি
মহাজনপথে পাওয়া যায়।
বিশ্বাস করি কবিতা লেখায়
গাইতে প্রেমের জয়গান
প্রহেলিকা কত দুনিয়াতে, তবু
নেই উপরে ভগবান।
চিত্রকলা, সঙ্গীতে আর
কণ্ঠস্বরের যুক্তিতে
চিরসুন্দর প্রকৃতি এবং
স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিতে।
বিশ্বাস করি ভবিষ্যতে
তাকে গড়ে তুলি আমরাই
বিশ্বাস করি জ্ঞানবন্টনে
ধর্মগ্রন্থ ছাড়ি তাই।
শূন্য থেকে আগমন আর
শূন্যতে হবে প্রস্থান
বিশ্বাস করি অজানা অনেক
কিন্তু অনেকই পাব জ্ঞান
বিশ্বাস করি প্রাণ-সংযোগে
কতো আরও আছে প্রতীতি
বিশ্বাস করি আমরা মানুষ
যথেষ্ট সেটা নয় কি?
যুক্তি-তর্ক বিশ্বাসকে এনে দিতে পারে না। বিশ্বাস থাকে মনের গভীরে যেখানে আমিত্ব পৌঁছাতে পারে না, শুধু অনুভব করে।
@মৌনমনা,
আমিত্ব-তুমিত্বের ব্যাপার ঠিক বুঝিনা, কিন্তু এই কথাটা ঠিক যে বিশ্বাস থাকে মনে গভীরে। ঠিক সেই কারণেই যার যার বিশ্বাস তার কাছে, এটা নিশ্চয় মানবেন? কিন্তু মুশকিল টা সেই খানেই। ধর্ম, ঈশ্বর, কুসংস্কার, ইত্যাদি বিশ্বাসগুলো ওই “মনের গভীরে” কখনোই চেপে থাকেনা। বরং বিশ্বাসীরা প্রাণপণে আকুল হয় ওঠে সেই বিশ্বাসগুলো চারপাশের আর পাঁচটা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে – বহুক্ষেত্রেই গায়ের জোরে। আপনার কি মনে হয় সেটা উচিত বা যুক্তিযুক্ত?
খুব ভালো লাগলো!
@তানিম এহসান, ধন্যবাদ আপনাকে।
(Y)
@পৃথিবী, ধন্যবাদ। থাম্বস আপ দিয়েছেন দেখে খুশী হলাম।
দারুণ। কবিতাটার ভাষা একটু সাদামাটা, তবে সেটা অনুবাদকের দোষ নয় মনেহয়…
@কৌস্তুভ, সেটা একেবারেই অনুবাদকের দোষ – কাঁচা হাতের কাজ যাকে বলে আর কি।
বিশ্বাস ব্যক্তিগত বিষয়, প্রচারযোগ্য বিষয় নয় । ব্যক্তিগত বিষয় ইন্টারনেটে আলোচনার জন্য আসা উচিত নয় ।
@আ হা মহিউদ্দীন,
হা হা হা। আপনার এই মহান উপদেশ বাণীখানা মুহাম্মদসহ সব ধর্মের প্রচারকদের দিতে পারলে খুব দারুণ হতো। তারা তাদের বিশ্বাসকে ব্যক্তিগত মনে করে প্রচারযোগ্য না করলে কী যে ভালোটাই না হতো। তাহলে, আর আজকে সারা বিশ্বব্যাপী বিশ্বাসের এই ছড়াছড়ি দেখতে হতো না আমাদের।
@ফরিদ আহমেদ,
দু’এক জনকে র্নিভয়ে দিতে পারলেও বিশেষ একজনকে সাবধানতা অবলম্বনে দেওয়া লাগত। :))
এই কথা যদি সবাই বুঝত তাহলে বিশ্বাস প্রচারে দেহ মন প্রাণ অর্থ বিত্ত সম্পদ কোন কিছুই অপচয় করার প্রয়োজন হত না বরং তা চিকিৎসা শিক্ষা ও সাহায্যের কাজে ব্যয় করলে মানব সভ্যতে আরো অনেক দূর অগ্রসর হত।
@আ হা মহিউদ্দীন,
সেটা হয়ত আপনি জানেন। কিন্তু বিশ্বাস বা বিশ্বাস-ব্যবসায়ীরা সেটা জানে কি?
কবিতাটি দারুন লেগেছে…
:))
@রাহনুমা রাখী, অনেক ধন্যবাদ। আপনার ভাল লেগেছে জেনে আমারও দন্ত বিকশিত হয়ে গেল।
মুক্তমনায় স্বাগতম, এবং সুন্দর একটি অনুবাদের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
তবে, যেগুলোকে উনি ‘বিশ্বাস’ বলছেন, সেগুলোকে আমি ঠিক ‘বিশ্বাস’ বলব না, আমি বলব ‘আস্থা’। জ্ঞান, বিজ্ঞান, মনাবিকতা, প্রগতি – এগুলোর উপর আমি আস্থাশীল বলা যায়। বিশ্বাসের ব্যাপারে আমি একটু খুঁতখুঁতে; ‘বিশ্বাস’ জিনিসটা আসলে আমার কাছে এমন একটা কিছু যার পেছনে কোন যুক্তি বা প্রমাণ নেই, হুমায়ুন আজাদ যেমন বলতেন, বিশ্বাস হচ্ছে একটি অপবিশ্বাসমূলক ক্রিয়া। তার ধারালো মন্তব্যটি ছিল এরকমের –
‘যে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই, যার কোন অস্তিত্ব নেই যা প্রমাণ করা যায় না, তাতে মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। মানুষ ভুতে বিশ্বাস করে, পরীতে বিশ্বাস করে বা ভগবানে, ঈশ্বরে বা আল্লায় বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস সত্য নয়, এগুলোর কোন বাস্তব রূপ নেই। মানুষ বলে না, আমি গ্লাসে বিশ্বস করি বা পানিতে বিশ্বাস করি, মেঘে বিশ্বাস করি। যেগুলো নেই সেগুলোই মানুষ বিশ্বাস করে। বিশ্বাস একটি অপবিশ্বাসমূলক ক্রিয়া। যা সত্য, তাতে বিশ্বাস করতে হয় না; যা মিথ্যে তাতে বিশ্বাস করতে হয়। তাই মানুষের সব বিশ্বাস ভুল বা ভ্রান্ত, তা অপবিশ্বাস।’
আমার অবস্থান এই ব্যাপারে অনেকটা হুমায়ুন আজাদের মতোই। অনেকে দেখি খুব ভুলভাবে নাস্তিকতাকেও এক ধরণের বিশ্বাস বলে চালানোর চেষ্টা করেন, যদিও আমি সেটা ঠিক মনে করিনা। এটা নিয়ে আমি লিখেছি এখানে, এবং অবিশ্বাসের দর্শন বইয়ে।
মুক্তমনায় আরো লিখুন।
@অভিজিৎ,
(Y) (Y)
@অভিজিৎ, ব্রাভো! :guru:
আপনি, অফ কোর্স, একদম সঠিক কথাটা বলেছেন। তবে শব্দচয়ন নিয়ে – দুইখান কথা আসে! আসল লেখকের লেখার সংগে আমি পরিচিত বলে বলতে পারি বিশ্বাস আর আস্থার মধ্যে এই তফাৎ সম্পর্কে তিনিও অবহিত। তা সত্ত্বেও তিনি বারংবার বিশ্বাস (বিলীফ) কথাটা ব্যবহার করেছেন একদমই একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে, কারণ ধার্মিক এবং ধর্মবিশ্বাসীরা বিশ্বাস কথাটা ছাড়া অন্য কিছু বোঝেনা। যারা ভাল, মন্দ, সাধারণ, অসাধারণ, প্রাকৃতিক, অপ্রাকৃতিক, সব কিছু এক অদৃশ্য, অলীক, কল্পনাপ্রসূত এনটিটি-র ওপর ন্যস্ত করে অভ্যস্ত, তাদের আর আস্থা – বিশেষত, নিজেদের ওপরে আস্থা – আসবে কি করে?
চেষ্টা করব সময়বিশেষে মক্তমনায় লেখার। বাংলায় লেখার অভ্যেস অনেক দিন চলে গেছে, এখানকার বিদগ্ধ লেখক পাঠকদের উপস্থিতিতে তাই কলম চালাতে (থুড়ি, কী-বোর্ডের চাবি টিপতে) একটু লজ্জা লাগে।
দারুন সুন্দর কবিতা । ভালো লাগল । আমার সাধারনত কবিতা তেমন ভালো লাগে না তবে এটা খুবি ভালো লেগেছে।
@বিনায়ক হালদার, অনেক ধন্যবাদ।
তিনি তো নিধার্মিক নন, তিনি কবি ! হা হা হা !!
@রণদীপম বসু, তাহলে পৃথিবীটা ধার্মিক, নির্ধার্মিক আর কবি এই তিন ভাগে ভাগ করা যায় বলছেন? 😀
@রণদীপম বসু,
এথিস্ট এর বাংলা রূপ নিধার্মিক করেছেন? আমার কেবলই মনে হয় নিধার্মিকের থেকে নিরীশ্বরবাদী এখনও বেশী যুক্তিযুক্ত ভবিষ্যতের কথা বলতে পারব না। এক আলোচনায় প্রবীরদা ও এমনই বলেছিলেন। বিবেচনায় নিবেন আশা করি।
কবিতা সুন্দর হয়েছে, ভাল লেগেছে।
@কৌশিক
হওয়ার কথাছিল, কি ভুলে কীভাবে যেন @রণদীপম বসু হয়ে গেছে। দুঃখিত।
@আব্দুল হক, কোন চিন্তা নেই। আসলে দুটি নামের আড়ালে আমরা একই লোক। :lotpot:
(বসু সাহেব সেটা অবশ্য মেনে না নিতেই পারেন) 😀
কিছু মনে করবেন না, ঐ নির্ধার্মিক না নিরীশ্বরবাদী তর্কটা আমার একটু ‘যার নাম চালভাজা, তার নাম মুড়ি’ গোত্রীয় বলে মনে হয় – যদিও নিজস্ব প্রেফারেন্স-এর কথা বললে নির্ধার্মিক-টাই আমার পছন্দ। আমার মনে হয় (এবং এটা একান্তই আমার মতামত) নিরীশ্বরবাদী তিনিই, যিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না কারণ এক বা একাধিক ঐশ্বরিক এন্টিটির অস্তিত্ব বা উপস্থিতির কোন আস্থাযোগ্য প্রমাণ তিনি পাননি। অপরপক্ষে, একজন নির্ধার্মিকও ইশ্বরের উপস্থিতি বা অস্তিস্ত্ব সম্পর্কে সন্দিহান, সেই একই কারণে, কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস অন্য কারও আছে কি নেই সেটা তাঁর কাছে বড় কথা নয় – কারণ এই ব্যাপারে তিনি মনে করেন ইশ্বর বা একই ধরণের কোন অলীক কল্পনায় বিশ্বাস থাকাটা যার যার নিজস্ব মানসিকতার ব্যাপার।
কিন্তু একজন নির্ধার্মিক-এর মুশকিল শুরু হয় যখন তিনি দেখেন যে সেই ঈশ্বরবিশ্বাসী লোক যখন দ্বিতীয় একজন মানুষের ওপরে তার নিজের বিশ্বাসটা জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়। অর্থাৎ, যেখানে ধর্মের গোড়াপত্তন। ধর্মবিশ্বাস কিছুতেই এক জায়গায় থেমে থাকেনা, ক্রমাগত ছড়িয়ে যেতে চায়। (এই নিয়ে একখানা লেখার আইডিয়া অনেক দিন ধরে মাথায় ঘুরছে, একটু সময় পেলে লিখে ফেলব।) যাইহোক, আশাকরি আমি যে ডিস্টিংকশন টা করি এই দুটো টার্মের মধ্যে সেটা বোঝাতে পারলাম। আপনার মতামত জানলে ভাল লাগবে।