লিখেছেনঃ মুজিব রহমান

হুমায়ুন আজাদ একাধারে ভাষাবিজ্ঞানী, কবি, ঔপন্যাসিক, কিশোর সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক। অর্থাৎ সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে তার সুদীপ্ত পদচারণা। এজন্যই তিনি বহুমাত্রিক লেখক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। সব ধরণের লেখাই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে তিনি সব ধরনের লেখাতেই পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তিনি একাধারে সৃষ্টিশীল ও মননশীল লেখক। তাঁর সৃষ্টিশীল লেখার মধ্যে মননশীলতা রয়েছে আবার মননশীল লেখার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা রয়েছে। তাঁর সাহিত্য, ভাষা, সমাজ, রাষ্ট্র বিশ্লেষণ যেমন পাঠক দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে আবার কবিতা এবং উপন্যাস লিখেও কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সব ধরনের লেখার মধ্যেই তিনি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায়। তিনি যখন কবিতা বা উপন্যাস লিখেছেন সেখানে শিল্পীসত্তা প্রকট আবার যখন প্রবন্ধ মানে মননশীল কিছু লিখি সেখানেও তাঁর মননশীল সত্তা প্রকট। তিনি বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখেছেন। প্রথম পর্বে কবিতা, সাহিত্য সমালোচনা, ভাষাবিজ্ঞান চর্চা করেছেন। তখন এবং তারপর বিশ্বের সাহিত্য, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়েও লিখেছেন। তিনি জীবনের সম্পূর্ণ রূপ, সৌন্দর্য, কদর্য-অসৌন্দর্যের রূপ চিত্রণ করতে চেয়েছিলেন। সেটা তাঁর কবিতায় রয়েছে, উপন্যাসে রয়েছে, প্রবন্ধে রয়েছে।

হুমায়ুন আজাদ কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও তাঁর দেশব্যাপী বোদ্ধামহলে ব্যাপক পরিচিতি ঘটে ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে লিখে। প্রথম বই কবিতার হলেও শুরুতে কবিতা কম লিখেছেন। নিজের কবিতা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “অন্যদের সাথে আমার কবিতার পার্থক্য এর তীব্রতা, এর সৌন্দর্যতা, এর কবিত্ব। তাদের সাথে আমার ভিন্নতা বিষয়ে, ভাষায়, সৌন্দর্যের তীব্রতায় ও শিল্পকলাবোধে। আমার কবিতার স্টাইলে দেখতে হবে এর ভাষা ব্যবহার, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন এর ছন্দ মানা ও না-মানা; এর কল্প-রূপক প্রতীক ও স্টাইলের অন্তর্ভুক্তি। আমি অনেক ক্ষেত্রে ছন্দ মানার জন্য ছন্দ মানি নি, যদি দেখেছি যে ছন্দের কবিতার মধ্যেও মাত্রা মিলিয়ে ছন্দটি কৃত্রিম মনে হচ্ছে, তখন আমি তা মানি নি। স্তাবকবিন্যাস, চিত্রকল্প রচনা পদ্ধতি, রূপক তৈরির পদ্ধতি, ভেতরে তো চেতনা রয়েছেই। আমি কবিতায় বানানো পাগলামো বাতিকগ্রস্থতা, আবোলতাবোল বকা পছন্দ করি না। হেয়ালি পছন্দ করি না, আমি কবিতাকে নিটোল কবিতা করতে চেয়েছি, আর আমার কবিতায় রয়েছে আধুনিক চেতনা। আমার দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনও কবিতার অংশ। ভাবালুতা আমাদের দেশে খুব প্রিয়, আমি তা করি নি। ওগুলো গাল ফুলিয়ে পড়ার জন্য।” পশ্চিম বাঙলার এক সমালোচক হুমায়ুন আদাদের একটি বইয়ের কবিতাগুলোকে ত্রিনাদাদের অগ্নিনৃত্যের সাথে তুলনা করেছিলেন। হুমায়ুন আজাদের কাব্যগ্রন্থ মাত্র ৭টি। তিনি বলতেন, কবিতার মতো প্রিয় কিছু নেই আমার বলেই বোধ করি, তবে আমি শুধু কবিতার বাহুপাশেই বাঁধা থাকি নি। খ্যাতি, সমাজ বদল এবং এমন আরো বহু মহৎ উদ্দেশ্যে কবিতা আমি লিখিনি বলেই মনে হয়; লিখেছি সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্যে, আমার ভেতরের চোখ যে শোভা দেখে, তা আঁকার জন্যে; আমার মন যেভাবে কেঁপে উঠে, সে কম্পন ধরে রাখার জন্য।

তিনি বড় হয়েছেন রাড়িখালের প্রকৃতির মধ্যে। রাড়িখালের উত্তরে বিশাল আড়িয়াল বিল। তাঁর মধ্যে নিবিড়ভাবে জড়িয়েছিল আড়িয়াল বিলের সৌন্দর্যতা। রাড়িখাল গ্রামটি হচ্ছে পুকুরের গ্রাম। পুকুরের পর পুকুর। পুকুরের পাশে পাড়া। তিনি যখন রাড়িখাল ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান নেন তখন বুকের গহীনে নিয়ে গিয়েছিলেন রাড়িখালের প্রকৃতিকে। তাঁর ভালাবাসার গ্রামকে কবিতায় সাজিয়েছেন রূপের বর্ণনায়। তাঁর শৈশব নানাভাবে তাঁর লেখায় এসেছে। তাঁর লেখার প্রধান উৎস তাঁর শৈশব। তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ পদ্মা নদীতে চলতে থাকা এই স্টীমারের শব্দ শুনেই ঘুমের ভেতর জেগে উঠতেন। নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরতেন ট্রাওজার। হুমায়ুন আজাদের সৃষ্টিশীলতা জুড়ে রয়েছে তাঁর শৈশব। ছবির মতো শৈশব ভেসে উঠতো তাঁর সাহিত্যে। তিনি চাঁদ নিয়ে লিখেছেন, রাতের চাঁদ ছিল প্রিয় সাদা বেলুনের মতো কিংবা পানু আপার ঠোঁটের হাসির মতো। মাছরাঙা নিয়ে লিখেছেন, পুকুরের আকাশে ধ্র“ব তারার মতো জ্বলজ্বল করে ঝাপিয়ে পড়ে মাছরাঙা। তার লাল তরোয়ারের মতো ঠোঁট ঢুকে যায় পাবদার লাল হৃদপিন্ডে। পিঠে নিয়ে লিখেছেন, পিঠে তৈরি হচ্ছে: মায়ের আঙুলের ছোঁয়ায় কেমন রূপসী আর মিষ্টি হয়ে উঠেছে চালের আটা। সন্ধ্যের পরে মাটির চুলোয় জ্বলছে আম কাঠের লাল আগুন। যেনো লাখ লাখ গোলাপ লাল হয়ে ফুটেছে চুলোর ভিতর। কচুরিফুলকে বলেছেন, পুকুরের ঝাড়বাতি। লাউডগা নিয়ে লিখেছেন, সব গাছই তো স্বপ্ন দেখে আকাশের কিন্তু লাউডগা স্বপ্ন দেখে দিগন্তের। আজো লাউডগা তার শেকড় ছাড়িয়ে ভিটে পেরিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় দিগন্তের দিকে- ঘাসের উপর পড়ে থাকে এক দীর্ঘ সবুজ চঞ্চল সুদ–র পিয়াসী স্বপ্ন। সরপুঁটিকে বলেছেন, পানির নিচের আলো। মাংসের কবিতা হল সরপুঁটি।

হুমায়ূনের লেখার প্রধান উৎস তার শৈশব। সেটা তার উপন্যাস-কিশোর সাহিত্যের পটভূমিকাতেও যেমন সত্য কবিতায়ও সত্য। হুমায়ুন আজাদের প্রকাশিত প্রথম বই কবিতার- ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩)। আমাদের পরিচিত বলয় নিয়েই লিখেছেন। শৈশবে শোনা পদ্মা নদীতে চলা স্টীমারের সিটির শব্দ নিয়ে লিখেছেন-

.. .. নীল ইস্টিমার চোখের মতোন সিটি বাজাচ্ছে থেমে থেমে / আমি ঘুমের ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠছি / অন্ধহাতে খুঁজে ফিরছি আমার নিবিড় ট্রাউজার .. ..।

কী গভীর আবেগ, প্রাণ ছুঁয়ে যায় বসন্তের বাতাস। তার পৈত্রিক বাড়ি যেখানে জীবনের প্রথম ১৫টি বছর নিবিড়ভাবে থেকেছেন সেই বাড়িতে বসেই পদ্মা নদী দিয়ে বয়ে চলা স্টীমারের সিটি শুনেই লিখেছিলন কবিতাটি। বৃষ্টি নামে কবিতায় লিখেছেন: বৃষ্টি নামলেই পাথর সড়ক ট্রেন বিমান চালক ও আরোহী সবাই গ‘লে/ গাঢ় অভ্যন্তওে শাদা ধবধবে বৃষ্টির ফোটা হয়ে যায়।/ আমার শরীর গ‘লে সোঁদামাটি, টের পাই বুকের বাঁ দিকে/ মাটি ঠেলে উদ্ভিদ উঠছে/ আমি তার সরল শেকড়। শহুরে কবিতায় তিনি অবলীলায় ঢুকিয়েছেন নিসর্গকে। ‘তার করতল’ কবিতায় লিখেছেন: তার করতলে প্লেন ওড়ে বয়ে যায় সবুজ বাতাস/ বৃষ্টির পর চাষা আসে বীজ নিয়ে কওে যায় চাষ/ সবুজ চোখের মতো জন্মে গাছ পাখিরা তাকায়/ মাঝির নৌকো দেখে করতল নদী হয়ে যায়। তার নিজেকে নিয়েও একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন। তিনি গ্রামীণ পরিবেশ থেকে দূরে সরে গেলেও হৃদয় জুড়ে গ্রাম তা এখানে প্রকাশ করেছেন। তার জন্মের ক্ষণটি বর্ণনা করেছেন: আব্বার খোলায় ধান মায়েওে কোলেতে আমি একই দিনে/ একই সঙ্গে এসেছিলাম। আড়িয়ল বিল থেকে সোনার গুঁড়োর মতো/ বোরো ধান এলো, … । তাঁর কবিতার গভীর আবেগ কামনা বাসনা স্বপ্ন সর্বদায় থাকলেও দেশের সামাজিক অস্থিরতায় পরবর্তীতে প্রাধান্য পায় রাজনীতি। ১৯৮০ সালে প্রকাশ পায় ‘জ্বলো চিতাবাঘ’। কিন্তু প্রকৃতি তাঁর কবিতায় এসেছে সমভাবে। ‘শত্র“দের মধ্যে’ কবিতায় লিখেছেন: একটি বর্ণাঢ্য বাঘের সৌন্দর্যে- স্বপ্নে- ক্রোধে দিগন্তের পুবপার থেকে/ অভ্র-বন্যা ভেদ করে আমার ঘাড়ের ওপর/ লাফিয়ে পড়লো টকটকে লাল একটা হিংস্র গোলাপ। কবিতার পরবর্তী দু‘টি পংক্তি:

বাল্যপ্রেমিকার মারাত্মক ওষ্ঠের মতো/ কেঁপে উঠলো পদ্মদিঘি। ‘নৌকো’ কবিতায় লিখেছেন: পালগুড়া ধ‘রে আছে বায়ুমন্ত্র, গতি প্রগতিতে কাঁপে সন্মুখ গলুই-/ দীর্ঘ জলে ভেসে যায় শিল্পময় তীক্ষ তীব্র ক্ষিপ্র রুই মাছ। ‘

পাপ’ কবিতায় লিখেছেন: হ‘তে যদি তুমি সুন্দর বনে মৃগী/ অথবা হংসী শৈবাল হ্রদে বুনো,/ মাতিয়ে শোভায় রূপ ভারাতুর দিঘি/ হ‘তে যদি তুমি তারাপরা রুই কোনো। ‘আধঘণ্টা বৃষ্টি’ কবিতায় লিখেছেন: আধঘণ্টা বৃষ্টিতে, বিক্রমপুরের আঠালো মাটির মতো, গললো সূর্যান্ত,/ আলতার মতো ঝ‘রে গেলো বটের ঝুরির তলে সঙ্গমরত দুটি কালো মোষ। তার কবিতায় যে প্রচুর উপমা তা অধিকাংশই প্রকৃতি থেকে নেয়া। তার বেশিরভাগই বিক্রমপুরের রাড়িখালের প্রকৃতি। ‘নৈশ বাস্তবতা’ কবিতায় লিখেছেন: গোপন শেকড় বেয়ে বাক্য হয়ে আসে নদী পল্লবের কোমল বাতাস/ বস্তু ও স্বপ্নের সন্ধি বাম পাশে ডান পাশে সুর আর ছবির সামাস। ‘গাছ’ কবিতায় লিখেছেন: চরের গাঙচিল প্রান্তে ভোরে রোপন করেছি একটি গাছ/ গাছ হয়ে ধীরে ধীরে গাঙচিল ছুঁয়ে ডাল মেলেছে আমার শরীর। সমাজ ও রাজনীতির উপর তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পায় ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ (১৯৮৫) কাব্যগ্রন্থে। কবিতাগুলো শিল্পময় কিন্তু প্রকৃতি থেকে নিয়েই তিনি লিখেছেন। কাব্যগ্রন্থের শিরোনামের কবিতাটিতে লিখেছেন-

.. .. এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র / শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের ঠোঁট / গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স – লেলিন, / আর বাঙলার বনের মতো আমার শ্যামল কন্যা / রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক / আমি জানি সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। .. .. ঘাই হরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল/ কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে। তিনি নৌকো নিয়ে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখেছেন। এই কাব্যগ্রন্থেও লিখেছেন ‘নৌকা, অধরা সুন্দর’ নামে একটি কবিতা: একটি রঙচটা শালিখের পিছে ছুটে ছুটে/ চক পার হয়ে ছাড়াবাড়িটার কামরাঙা গাছটার / দিকে যেই পা বাড়িয়েছি, দেখি- নৌকো-

হুমায়ুন আজাদ জনপ্রিয় ধারার কবিতা লিখেন নি। তবু তাঁর কাব্যের পাঠক কম নয়। কবিতায় তিনি ধরে রেখেছেন তাঁর সময়, তাঁর ভাবনা এবং তীব্রতম উপলব্ধি। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল’। আবারো তিনি ফিরেছেন প্রকৃতির মাঝে। এখানে রয়েছে অনেক সৌন্দর্যতা। লিখেছেন-

সৌন্দর্য যখন সরাসরি তাকায় তখন সুন্ধর / সৌন্দর্য যখন চোখ নত করে থাকে, তখনো সুন্দর।
পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে’(১৯৯০)-এর রয়েছে তাঁর শ্রেষ্ঠ আবেগ উপলব্ধির প্রকাশ। তিনি লিখেছেন-

আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙ্গুলের দাগ / আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবানু / আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো / আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো .. ..
‘এসো, হে অশুভ’ কবিতায় লিখেছেন: হে অশুভ, তুমি ফাল্গুনের ফুল হয়ে এসো/ হে অশুভ, তুমি চৈত্রের কৃষ্ণচূড়া হয়ে এসো/ হে অশুভ, ঝড় হয়ে এসো তুমি বোশেখের প্রত্যেক বিকেলে/ হে অশুভ, শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে এসো তুমি অঝোর ধারায়। ‘কথা দিয়েছিলাম তোমাকে’ কবিতায় লিখেছেন: কথা দিয়ে ছিলাম তোমাকে রেখে যাবো/ পুষ্ট ধান মাখনের মতো পলিমাটি পূর্ণচাঁদ ভাটিয়ালি/ গান উড্ডীন উজ্জ্বল মেঘ দুধেল ওলান মধুর চাকের মতো গ্রাম/ জলের অনন্ত বেগ রুই মাছ পথ পাশে শাদা ফুল অবনত গাছ/ আমের হলদে বউল জলপদ্ম দোয়েল মৌমাছি . . .। ‘পর্বত’ কবিতায় লিখেছেন: পুকুরে পানির সবুজ কোমল ঢেউ হয়েছি অজস্র সন্ধ্যায়। মাঝ পুকুরে বোয়ালের হটাৎ ঘাইয়ে জন্ম নিয়ে টলমল ক‘রে গিয়ে মিশেছি ঘাস, শ্যাওলা, কচুরি পানার সবুজ শরীরে।

তাঁর ‘কাফনে মোড়া অশ্র“বিন্দু’ ((১৯৮০) অনেক কোমল ও গীতিময়, অনেক স্বপ্ন ও দীর্ঘশ্বাসে পূর্ণ। ‘হাঁটা’ কবিতায় লিখেছেন: একলা হেঁটে লেবুগাছ কুমড়োর জাংলা পেরিয়ে/ চ‘লে গিয়েছিলে হিজলের বনে। / তারপর ওই পথে সবাই হেঁটেছে। ‘আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য’ কবিতায় লিখেছেন: আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মরার যাবো/ ছোট্ট ঘাসফুলের জন্যে/ একটি টলোমলো শিশির বিন্দুর জন্যে / আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে / উড়ে যাওয়া একটি পাপড়ির জন্যে/ এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্যে ..। তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘পেরোনোর কিছু নেই’ (২০০৪) অনেক বেশি পরিণত। তাঁর অনেকগুলো প্রিয় কবিতা রয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে। কবিতায় অন্তমিল ও ছন্দ ফিরিয়ে আনার ব্যাকুল স্বার্থক প্রচেষ্টা রয়েছে। এই ধারায় তিনি লিখতে চেয়েছিলেন। সুযোগ হয় নি। কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রটিও অসাধারণ ছন্দমিল কবিতা। কাব্যগ্রন্থের নামেই প্রথম কবিতাটি। সত্যিই কি পেরোনোর কিছু ছিলা না বাকী। কবিতা যখন আরো গভীরভাবে ধরা দিচ্ছিল তখনই তাঁকে চলে যেতে হল।

আজ পেরোনোর কিছু নেই, বসে আছি- স্তব্ধ, শুনি শূন্য বাতাসের / শব্দ, দেখি অন্ধকার নেমে আসে মাঠে জলে, শস্যে শব্জিতে। ‘অন্ধ হওয়ার পর’ কবিতায় লিখেছেন: অন্ধ হওয়ার পর কী দেখি আমি? আজো আমার দু-চোখে/ পাতারা সুবজ? জ্যোৎস্নাময় গন্ধরাজ? স্বর্ণচাঁপা মায়াবী সোনালী?/ কৃষ্ণচূড়া আজো দেখি তীব্র লাল? আমার অসুস্থ বুকে/ ফুটতে দেখি নীলপদ্ম? পূর্ণিমার চাঁদ আজো প্রবল রুপালী। তিনি ‘অন্ধ হওয়ার আগে’ কবিতায়ও প্রকৃতিকে নিয়ে এসেছেন একই ভাবে।

‘বুক পকেটে জোনাকী পোকা’ গদ্যে ও পদ্যে মিশেল দেয়া এক চমৎকার বই। তাঁর ছোট মেয়ে স্মিতাকে উৎসর্গ করা একটি ছড়া রয়েছে- নাম ‘শুভেচ্ছা’।

ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো / ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালী গান, ভালো থেকো / ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা / ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা.. ..

কবিতা জুড়ে নিসর্গকে ভাল থাকার কামনা বাসনা। পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের এবং আল মাহমুদের কবিতার সাথে উপস্থাপনার পার্থক্য অনেক। জসীম উদ্দীন এনেছিলেন পল্লীকে আর আজাদ এনেছেন প্রকৃতিকে। আজাদ অনেক বেশি আধুনিক কিন্তু নৈসর্গ তার সত্বা জুড়ে রয়েছে অনেক বেশি গভীরভাবে। এই বাল্যবিভোরতা, এই প্রকৃতির মাঝে ফেরার ব্যাকুলতা এই টান সীমাহীন। এই টান থেকেই লিখেছেন অনেক অনেক কবিতা।

হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, একটি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন থেকে এবং শিল্প সৃষ্টি করার জন্য তিনি লিখছেন: কোনো অন্ধ মৌলবাদীর হাতে নিহত হওয়ার জন্য নয়। অথচ এই নৈসর্গিক কবিকে নিহত হতে হল মৌলবাদীদের হাতেই।

[মুজিব রহমান: সভাপতি বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, সভাপতি- জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, মুন্সীগঞ্জ জেলা; সম্পাদক- ঢেউ]