লিখেছেনঃ মুজিব রহমান
হুমায়ুন আজাদ একাধারে ভাষাবিজ্ঞানী, কবি, ঔপন্যাসিক, কিশোর সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক। অর্থাৎ সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে তার সুদীপ্ত পদচারণা। এজন্যই তিনি বহুমাত্রিক লেখক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। সব ধরণের লেখাই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে তিনি সব ধরনের লেখাতেই পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। তিনি একাধারে সৃষ্টিশীল ও মননশীল লেখক। তাঁর সৃষ্টিশীল লেখার মধ্যে মননশীলতা রয়েছে আবার মননশীল লেখার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা রয়েছে। তাঁর সাহিত্য, ভাষা, সমাজ, রাষ্ট্র বিশ্লেষণ যেমন পাঠক দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে আবার কবিতা এবং উপন্যাস লিখেও কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সব ধরনের লেখার মধ্যেই তিনি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায়। তিনি যখন কবিতা বা উপন্যাস লিখেছেন সেখানে শিল্পীসত্তা প্রকট আবার যখন প্রবন্ধ মানে মননশীল কিছু লিখি সেখানেও তাঁর মননশীল সত্তা প্রকট। তিনি বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখেছেন। প্রথম পর্বে কবিতা, সাহিত্য সমালোচনা, ভাষাবিজ্ঞান চর্চা করেছেন। তখন এবং তারপর বিশ্বের সাহিত্য, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়েও লিখেছেন। তিনি জীবনের সম্পূর্ণ রূপ, সৌন্দর্য, কদর্য-অসৌন্দর্যের রূপ চিত্রণ করতে চেয়েছিলেন। সেটা তাঁর কবিতায় রয়েছে, উপন্যাসে রয়েছে, প্রবন্ধে রয়েছে।
হুমায়ুন আজাদ কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও তাঁর দেশব্যাপী বোদ্ধামহলে ব্যাপক পরিচিতি ঘটে ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে লিখে। প্রথম বই কবিতার হলেও শুরুতে কবিতা কম লিখেছেন। নিজের কবিতা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “অন্যদের সাথে আমার কবিতার পার্থক্য এর তীব্রতা, এর সৌন্দর্যতা, এর কবিত্ব। তাদের সাথে আমার ভিন্নতা বিষয়ে, ভাষায়, সৌন্দর্যের তীব্রতায় ও শিল্পকলাবোধে। আমার কবিতার স্টাইলে দেখতে হবে এর ভাষা ব্যবহার, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন এর ছন্দ মানা ও না-মানা; এর কল্প-রূপক প্রতীক ও স্টাইলের অন্তর্ভুক্তি। আমি অনেক ক্ষেত্রে ছন্দ মানার জন্য ছন্দ মানি নি, যদি দেখেছি যে ছন্দের কবিতার মধ্যেও মাত্রা মিলিয়ে ছন্দটি কৃত্রিম মনে হচ্ছে, তখন আমি তা মানি নি। স্তাবকবিন্যাস, চিত্রকল্প রচনা পদ্ধতি, রূপক তৈরির পদ্ধতি, ভেতরে তো চেতনা রয়েছেই। আমি কবিতায় বানানো পাগলামো বাতিকগ্রস্থতা, আবোলতাবোল বকা পছন্দ করি না। হেয়ালি পছন্দ করি না, আমি কবিতাকে নিটোল কবিতা করতে চেয়েছি, আর আমার কবিতায় রয়েছে আধুনিক চেতনা। আমার দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনও কবিতার অংশ। ভাবালুতা আমাদের দেশে খুব প্রিয়, আমি তা করি নি। ওগুলো গাল ফুলিয়ে পড়ার জন্য।” পশ্চিম বাঙলার এক সমালোচক হুমায়ুন আদাদের একটি বইয়ের কবিতাগুলোকে ত্রিনাদাদের অগ্নিনৃত্যের সাথে তুলনা করেছিলেন। হুমায়ুন আজাদের কাব্যগ্রন্থ মাত্র ৭টি। তিনি বলতেন, কবিতার মতো প্রিয় কিছু নেই আমার বলেই বোধ করি, তবে আমি শুধু কবিতার বাহুপাশেই বাঁধা থাকি নি। খ্যাতি, সমাজ বদল এবং এমন আরো বহু মহৎ উদ্দেশ্যে কবিতা আমি লিখিনি বলেই মনে হয়; লিখেছি সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্যে, আমার ভেতরের চোখ যে শোভা দেখে, তা আঁকার জন্যে; আমার মন যেভাবে কেঁপে উঠে, সে কম্পন ধরে রাখার জন্য।
তিনি বড় হয়েছেন রাড়িখালের প্রকৃতির মধ্যে। রাড়িখালের উত্তরে বিশাল আড়িয়াল বিল। তাঁর মধ্যে নিবিড়ভাবে জড়িয়েছিল আড়িয়াল বিলের সৌন্দর্যতা। রাড়িখাল গ্রামটি হচ্ছে পুকুরের গ্রাম। পুকুরের পর পুকুর। পুকুরের পাশে পাড়া। তিনি যখন রাড়িখাল ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান নেন তখন বুকের গহীনে নিয়ে গিয়েছিলেন রাড়িখালের প্রকৃতিকে। তাঁর ভালাবাসার গ্রামকে কবিতায় সাজিয়েছেন রূপের বর্ণনায়। তাঁর শৈশব নানাভাবে তাঁর লেখায় এসেছে। তাঁর লেখার প্রধান উৎস তাঁর শৈশব। তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ পদ্মা নদীতে চলতে থাকা এই স্টীমারের শব্দ শুনেই ঘুমের ভেতর জেগে উঠতেন। নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরতেন ট্রাওজার। হুমায়ুন আজাদের সৃষ্টিশীলতা জুড়ে রয়েছে তাঁর শৈশব। ছবির মতো শৈশব ভেসে উঠতো তাঁর সাহিত্যে। তিনি চাঁদ নিয়ে লিখেছেন, রাতের চাঁদ ছিল প্রিয় সাদা বেলুনের মতো কিংবা পানু আপার ঠোঁটের হাসির মতো। মাছরাঙা নিয়ে লিখেছেন, পুকুরের আকাশে ধ্র“ব তারার মতো জ্বলজ্বল করে ঝাপিয়ে পড়ে মাছরাঙা। তার লাল তরোয়ারের মতো ঠোঁট ঢুকে যায় পাবদার লাল হৃদপিন্ডে। পিঠে নিয়ে লিখেছেন, পিঠে তৈরি হচ্ছে: মায়ের আঙুলের ছোঁয়ায় কেমন রূপসী আর মিষ্টি হয়ে উঠেছে চালের আটা। সন্ধ্যের পরে মাটির চুলোয় জ্বলছে আম কাঠের লাল আগুন। যেনো লাখ লাখ গোলাপ লাল হয়ে ফুটেছে চুলোর ভিতর। কচুরিফুলকে বলেছেন, পুকুরের ঝাড়বাতি। লাউডগা নিয়ে লিখেছেন, সব গাছই তো স্বপ্ন দেখে আকাশের কিন্তু লাউডগা স্বপ্ন দেখে দিগন্তের। আজো লাউডগা তার শেকড় ছাড়িয়ে ভিটে পেরিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় দিগন্তের দিকে- ঘাসের উপর পড়ে থাকে এক দীর্ঘ সবুজ চঞ্চল সুদ–র পিয়াসী স্বপ্ন। সরপুঁটিকে বলেছেন, পানির নিচের আলো। মাংসের কবিতা হল সরপুঁটি।
হুমায়ূনের লেখার প্রধান উৎস তার শৈশব। সেটা তার উপন্যাস-কিশোর সাহিত্যের পটভূমিকাতেও যেমন সত্য কবিতায়ও সত্য। হুমায়ুন আজাদের প্রকাশিত প্রথম বই কবিতার- ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩)। আমাদের পরিচিত বলয় নিয়েই লিখেছেন। শৈশবে শোনা পদ্মা নদীতে চলা স্টীমারের সিটির শব্দ নিয়ে লিখেছেন-
.. .. নীল ইস্টিমার চোখের মতোন সিটি বাজাচ্ছে থেমে থেমে / আমি ঘুমের ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠছি / অন্ধহাতে খুঁজে ফিরছি আমার নিবিড় ট্রাউজার .. ..।
কী গভীর আবেগ, প্রাণ ছুঁয়ে যায় বসন্তের বাতাস। তার পৈত্রিক বাড়ি যেখানে জীবনের প্রথম ১৫টি বছর নিবিড়ভাবে থেকেছেন সেই বাড়িতে বসেই পদ্মা নদী দিয়ে বয়ে চলা স্টীমারের সিটি শুনেই লিখেছিলন কবিতাটি। বৃষ্টি নামে কবিতায় লিখেছেন: বৃষ্টি নামলেই পাথর সড়ক ট্রেন বিমান চালক ও আরোহী সবাই গ‘লে/ গাঢ় অভ্যন্তওে শাদা ধবধবে বৃষ্টির ফোটা হয়ে যায়।/ আমার শরীর গ‘লে সোঁদামাটি, টের পাই বুকের বাঁ দিকে/ মাটি ঠেলে উদ্ভিদ উঠছে/ আমি তার সরল শেকড়। শহুরে কবিতায় তিনি অবলীলায় ঢুকিয়েছেন নিসর্গকে। ‘তার করতল’ কবিতায় লিখেছেন: তার করতলে প্লেন ওড়ে বয়ে যায় সবুজ বাতাস/ বৃষ্টির পর চাষা আসে বীজ নিয়ে কওে যায় চাষ/ সবুজ চোখের মতো জন্মে গাছ পাখিরা তাকায়/ মাঝির নৌকো দেখে করতল নদী হয়ে যায়। তার নিজেকে নিয়েও একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন। তিনি গ্রামীণ পরিবেশ থেকে দূরে সরে গেলেও হৃদয় জুড়ে গ্রাম তা এখানে প্রকাশ করেছেন। তার জন্মের ক্ষণটি বর্ণনা করেছেন: আব্বার খোলায় ধান মায়েওে কোলেতে আমি একই দিনে/ একই সঙ্গে এসেছিলাম। আড়িয়ল বিল থেকে সোনার গুঁড়োর মতো/ বোরো ধান এলো, … । তাঁর কবিতার গভীর আবেগ কামনা বাসনা স্বপ্ন সর্বদায় থাকলেও দেশের সামাজিক অস্থিরতায় পরবর্তীতে প্রাধান্য পায় রাজনীতি। ১৯৮০ সালে প্রকাশ পায় ‘জ্বলো চিতাবাঘ’। কিন্তু প্রকৃতি তাঁর কবিতায় এসেছে সমভাবে। ‘শত্র“দের মধ্যে’ কবিতায় লিখেছেন: একটি বর্ণাঢ্য বাঘের সৌন্দর্যে- স্বপ্নে- ক্রোধে দিগন্তের পুবপার থেকে/ অভ্র-বন্যা ভেদ করে আমার ঘাড়ের ওপর/ লাফিয়ে পড়লো টকটকে লাল একটা হিংস্র গোলাপ। কবিতার পরবর্তী দু‘টি পংক্তি:
বাল্যপ্রেমিকার মারাত্মক ওষ্ঠের মতো/ কেঁপে উঠলো পদ্মদিঘি। ‘নৌকো’ কবিতায় লিখেছেন: পালগুড়া ধ‘রে আছে বায়ুমন্ত্র, গতি প্রগতিতে কাঁপে সন্মুখ গলুই-/ দীর্ঘ জলে ভেসে যায় শিল্পময় তীক্ষ তীব্র ক্ষিপ্র রুই মাছ। ‘
পাপ’ কবিতায় লিখেছেন: হ‘তে যদি তুমি সুন্দর বনে মৃগী/ অথবা হংসী শৈবাল হ্রদে বুনো,/ মাতিয়ে শোভায় রূপ ভারাতুর দিঘি/ হ‘তে যদি তুমি তারাপরা রুই কোনো। ‘আধঘণ্টা বৃষ্টি’ কবিতায় লিখেছেন: আধঘণ্টা বৃষ্টিতে, বিক্রমপুরের আঠালো মাটির মতো, গললো সূর্যান্ত,/ আলতার মতো ঝ‘রে গেলো বটের ঝুরির তলে সঙ্গমরত দুটি কালো মোষ। তার কবিতায় যে প্রচুর উপমা তা অধিকাংশই প্রকৃতি থেকে নেয়া। তার বেশিরভাগই বিক্রমপুরের রাড়িখালের প্রকৃতি। ‘নৈশ বাস্তবতা’ কবিতায় লিখেছেন: গোপন শেকড় বেয়ে বাক্য হয়ে আসে নদী পল্লবের কোমল বাতাস/ বস্তু ও স্বপ্নের সন্ধি বাম পাশে ডান পাশে সুর আর ছবির সামাস। ‘গাছ’ কবিতায় লিখেছেন: চরের গাঙচিল প্রান্তে ভোরে রোপন করেছি একটি গাছ/ গাছ হয়ে ধীরে ধীরে গাঙচিল ছুঁয়ে ডাল মেলেছে আমার শরীর। সমাজ ও রাজনীতির উপর তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পায় ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ (১৯৮৫) কাব্যগ্রন্থে। কবিতাগুলো শিল্পময় কিন্তু প্রকৃতি থেকে নিয়েই তিনি লিখেছেন। কাব্যগ্রন্থের শিরোনামের কবিতাটিতে লিখেছেন-
.. .. এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র / শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের ঠোঁট / গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স – লেলিন, / আর বাঙলার বনের মতো আমার শ্যামল কন্যা / রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক / আমি জানি সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। .. .. ঘাই হরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল/ কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে। তিনি নৌকো নিয়ে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখেছেন। এই কাব্যগ্রন্থেও লিখেছেন ‘নৌকা, অধরা সুন্দর’ নামে একটি কবিতা: একটি রঙচটা শালিখের পিছে ছুটে ছুটে/ চক পার হয়ে ছাড়াবাড়িটার কামরাঙা গাছটার / দিকে যেই পা বাড়িয়েছি, দেখি- নৌকো-
হুমায়ুন আজাদ জনপ্রিয় ধারার কবিতা লিখেন নি। তবু তাঁর কাব্যের পাঠক কম নয়। কবিতায় তিনি ধরে রেখেছেন তাঁর সময়, তাঁর ভাবনা এবং তীব্রতম উপলব্ধি। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল’। আবারো তিনি ফিরেছেন প্রকৃতির মাঝে। এখানে রয়েছে অনেক সৌন্দর্যতা। লিখেছেন-
সৌন্দর্য যখন সরাসরি তাকায় তখন সুন্ধর / সৌন্দর্য যখন চোখ নত করে থাকে, তখনো সুন্দর।
পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে’(১৯৯০)-এর রয়েছে তাঁর শ্রেষ্ঠ আবেগ উপলব্ধির প্রকাশ। তিনি লিখেছেন-
আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙ্গুলের দাগ / আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবানু / আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো / আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো .. ..
‘এসো, হে অশুভ’ কবিতায় লিখেছেন: হে অশুভ, তুমি ফাল্গুনের ফুল হয়ে এসো/ হে অশুভ, তুমি চৈত্রের কৃষ্ণচূড়া হয়ে এসো/ হে অশুভ, ঝড় হয়ে এসো তুমি বোশেখের প্রত্যেক বিকেলে/ হে অশুভ, শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে এসো তুমি অঝোর ধারায়। ‘কথা দিয়েছিলাম তোমাকে’ কবিতায় লিখেছেন: কথা দিয়ে ছিলাম তোমাকে রেখে যাবো/ পুষ্ট ধান মাখনের মতো পলিমাটি পূর্ণচাঁদ ভাটিয়ালি/ গান উড্ডীন উজ্জ্বল মেঘ দুধেল ওলান মধুর চাকের মতো গ্রাম/ জলের অনন্ত বেগ রুই মাছ পথ পাশে শাদা ফুল অবনত গাছ/ আমের হলদে বউল জলপদ্ম দোয়েল মৌমাছি . . .। ‘পর্বত’ কবিতায় লিখেছেন: পুকুরে পানির সবুজ কোমল ঢেউ হয়েছি অজস্র সন্ধ্যায়। মাঝ পুকুরে বোয়ালের হটাৎ ঘাইয়ে জন্ম নিয়ে টলমল ক‘রে গিয়ে মিশেছি ঘাস, শ্যাওলা, কচুরি পানার সবুজ শরীরে।
তাঁর ‘কাফনে মোড়া অশ্র“বিন্দু’ ((১৯৮০) অনেক কোমল ও গীতিময়, অনেক স্বপ্ন ও দীর্ঘশ্বাসে পূর্ণ। ‘হাঁটা’ কবিতায় লিখেছেন: একলা হেঁটে লেবুগাছ কুমড়োর জাংলা পেরিয়ে/ চ‘লে গিয়েছিলে হিজলের বনে। / তারপর ওই পথে সবাই হেঁটেছে। ‘আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য’ কবিতায় লিখেছেন: আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মরার যাবো/ ছোট্ট ঘাসফুলের জন্যে/ একটি টলোমলো শিশির বিন্দুর জন্যে / আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে / উড়ে যাওয়া একটি পাপড়ির জন্যে/ এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্যে ..। তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘পেরোনোর কিছু নেই’ (২০০৪) অনেক বেশি পরিণত। তাঁর অনেকগুলো প্রিয় কবিতা রয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে। কবিতায় অন্তমিল ও ছন্দ ফিরিয়ে আনার ব্যাকুল স্বার্থক প্রচেষ্টা রয়েছে। এই ধারায় তিনি লিখতে চেয়েছিলেন। সুযোগ হয় নি। কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রটিও অসাধারণ ছন্দমিল কবিতা। কাব্যগ্রন্থের নামেই প্রথম কবিতাটি। সত্যিই কি পেরোনোর কিছু ছিলা না বাকী। কবিতা যখন আরো গভীরভাবে ধরা দিচ্ছিল তখনই তাঁকে চলে যেতে হল।
আজ পেরোনোর কিছু নেই, বসে আছি- স্তব্ধ, শুনি শূন্য বাতাসের / শব্দ, দেখি অন্ধকার নেমে আসে মাঠে জলে, শস্যে শব্জিতে। ‘অন্ধ হওয়ার পর’ কবিতায় লিখেছেন: অন্ধ হওয়ার পর কী দেখি আমি? আজো আমার দু-চোখে/ পাতারা সুবজ? জ্যোৎস্নাময় গন্ধরাজ? স্বর্ণচাঁপা মায়াবী সোনালী?/ কৃষ্ণচূড়া আজো দেখি তীব্র লাল? আমার অসুস্থ বুকে/ ফুটতে দেখি নীলপদ্ম? পূর্ণিমার চাঁদ আজো প্রবল রুপালী। তিনি ‘অন্ধ হওয়ার আগে’ কবিতায়ও প্রকৃতিকে নিয়ে এসেছেন একই ভাবে।
‘বুক পকেটে জোনাকী পোকা’ গদ্যে ও পদ্যে মিশেল দেয়া এক চমৎকার বই। তাঁর ছোট মেয়ে স্মিতাকে উৎসর্গ করা একটি ছড়া রয়েছে- নাম ‘শুভেচ্ছা’।
ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো / ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালী গান, ভালো থেকো / ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা / ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা.. ..
কবিতা জুড়ে নিসর্গকে ভাল থাকার কামনা বাসনা। পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের এবং আল মাহমুদের কবিতার সাথে উপস্থাপনার পার্থক্য অনেক। জসীম উদ্দীন এনেছিলেন পল্লীকে আর আজাদ এনেছেন প্রকৃতিকে। আজাদ অনেক বেশি আধুনিক কিন্তু নৈসর্গ তার সত্বা জুড়ে রয়েছে অনেক বেশি গভীরভাবে। এই বাল্যবিভোরতা, এই প্রকৃতির মাঝে ফেরার ব্যাকুলতা এই টান সীমাহীন। এই টান থেকেই লিখেছেন অনেক অনেক কবিতা।
হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, একটি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন থেকে এবং শিল্প সৃষ্টি করার জন্য তিনি লিখছেন: কোনো অন্ধ মৌলবাদীর হাতে নিহত হওয়ার জন্য নয়। অথচ এই নৈসর্গিক কবিকে নিহত হতে হল মৌলবাদীদের হাতেই।
[মুজিব রহমান: সভাপতি বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, সভাপতি- জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, মুন্সীগঞ্জ জেলা; সম্পাদক- ঢেউ]
হুমায়ুন আজাদ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমন এক অধ্যায়ের নাম যেই অধ্যায়ের শুরু হয়েছে শুধুমাত্র তার সময়েই এবং বলা যায় শেষও হয়েছে তার মৃত্যুর সাথে সাথেই। বাংলাদেশে এমন প্রতিভা তার পুর্বে ছিলনা, এখন নেই, এবং নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় ভবিষ্যতেও হবে কিনা। যদিও আমরা চাই এমন প্রতিভা আমাদের দেশের ঘরে ঘরে হোক।
হুয়ায়ুন আজাদ এক তীব্র আলোর নাম। তার লেখা সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য আমাদের সবার উচিত তার সব লেখার সাথে পরিচিত হওয়া। তার প্রত্যেকটি লেখার মধ্যে আমরা দেখি সম্পুর্ন নতুনত্বের পরিষ্কার ছাপ। কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ এমন এক উপন্যাসীর নাম যেরকম লেখা এর আগে বাংলা ভাষায় আগে কখনও লেখা হয় নি। দর্শন, সাহিত্যের যে বিশদ আলোচনা তিনি এই লেখায় করেছেন, সত্যি অনবদ্য। সম্পুর্ন উপন্যাস যেন একটা সতন্ত্র কবিতার প্রকাশই ঘটায়।
তার কবিতা এমন এক পরশ পাথরের নাম যার সংস্পর্শে এলে প্রভাবিত না হয়ে থাকা অসম্ভব। তার প্রায় প্রত্যেকটি কবিতা সতন্ত্র বৈশিষ্টে উজ্জ্বল। আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি কবিতা খুব বেশী লিখে যেতে পারেন নি। মনে হয় এ কথা বলাই যায়, আমরা তাকে আসলে লিখতে দিই নি।
আজাদ স্যারের যেসকল সমালোচনা আমরা দেখি সবই বালখিল্যতায় পরিপূর্ণ। সত্যি বলছি বালখিল্যতায় পরিপূর্ণ। এসকল সমালোচনার ধরন অনেকটা এমন যে, তিনি নাকি মানুষের অনুভুতিকে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন। কথা ১০০% সত্য। আমরা সবাই তোষামদিতে আপ্লুত হই। আমরা তোষামদি করি প্রোফেশনাল পথে। এক জনের পিঠ আরেকজন চাপরে দেই, সে আবার আমাকে চাপরায়, আমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করি। এর মাঝে যখন আমাদের সামনে কেউ আয়না ধরে বলে ওঠে, “ওহে তোমার কিঞ্চিত সমস্যা রহিয়াছে” তখনই আমাদের তোষামদি পাওয়া মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে যায়। তখন মাথা শীতল করার নিমিত্তে ছুড়ে দেই বালখিল্যতাময় বাক্যমন্ডলি।
শুধুমাত্র বলা যায়, দুঃখজনক।
লেখককে ধন্যবাদ সুন্দর একটি লেখার জন্য।
হুমায়ুন আজাদের জীবন নিয়ে “স্মৃতিতে হুমায়ুন আজাদ” নামে একটা বই আছে। লেখকের নাম এই মূহুর্তে মনে করতে পারছি না। বইটা বেশ ভালো। পড়ে দেখতে পারেন।
@সাইফুল ইসলাম,
সহমত।
আর হুমায়ুন আজাদের আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে উনি শুধু আমাকে দেখার নতুন চোখেরই সন্ধান দেননি অনেক মানুষকে চিনিয়েছেন। তার লেখাতেই আমি সুধীন্দ্রনাথকে চিনেছি, জীবনানন্দকে তীব্রভাবে উপলব্ধি করেছি,রবীন্দ্রনাথকে ভক্তি গদগদভাবে গলে না পড়েও তার কবিতার সৌন্দর্যকে ভালভাবে বিচার করতে শিখেছি ,ব্যাক্তি মানুষের সীমাবদ্ধতাকে চিন্তায় রেখেই সৌন্দর্যকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছি, মেরি ওলস্টোনক্রাফটকে চিনেছি আরো কত কিছু। তবে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি শিখেছি তা হল জেনে কথা বলতে হয়, জেনে লিখতে হয়, অসম্ভব পরিশ্রম করে ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে কোন কিছু জানতে ও জানাতে হয়। তার ‘নারী’ লেখার পেছনেই যে পরিশ্রম ও পড়াশোনার কথা আমি যেনেছি তাতেই আসলে নতুন এক ধরণের উদ্দীপনা পেয়েছি যে জানতে হবে, কষ্ট করে জানতে হবে। এবং জানতে অনেক কষ্ট হলেও জানতে ভাল লাগে, জেনে ভাল লাগে, জানার মাঝেই নিরর্থক জীবনের অর্থ পাওয়া যায়।
ভাল লাগল। :yes:
না ভাই আমি ইয়ার্কি মারবো কেনো? তিনি যে মৌলবাদীর হাতে নিহত হয়েছেন, তা আমার জানা ছিলোনা। আহত হয়েছিলেন বলে জানি। আপনারা এত খবর রাখেন কিভাবে বুঝিনা।
@আদনান, এখন কিন্তু সত্যিই প্রমাণ করলেন আপনি ইয়ার্কি মেরেছেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ তার মারাত্মকভাবে আহত হয়া। জামার্নিতে গিয়ে হয়তো কেউ খুন করে আসে নি।
হুমায়ুন আজাদের কবিতার অসাধারণ কিছু লাইন সামনে নিয়ে আসায় ভাল লাগছে। লেখককে মুক্তমনায় স্বাগতম।
হুমায়ুন আজাদকে আমি প্রধাণত একজন উচ্চমানের ভাষাবিদ, অসাধারণ কবি এবং মুক্তমনা প্রথাবিরোধী মানুষ হিসেবে মনে করি। তার উজ্জ্বল রচনা হচ্ছে তার কবিতাগুলো, “নারী”, তার প্রবন্ধগুলো। তার উপন্যাসগুলো আমার তেমন ভাল লাগেনি। এই অসাধারণ মানুষটিকে আমি যে কারণে শ্রদ্ধা করি তা হল তার প্রতিটি লেখা পড়ে বোঝা যেত তিনি প্রচুর পড়ে এবং জেনে লিখতেন, তার কবিতার ছত্রে ছত্রে ছিল তার অনুভূতি নামক ইন্দ্রিয়ের স্বাক্ষর।
আমার চিন্তাধারাকে একটি নতুন পর্যায়ে নিয়ে যায় “নারী”।
হুমায়ুন আজাদকে শ্রদ্ধা জানাই
@লীনা রহমান,ধন্যবাদ আপনাকে। সহমত পোষণ করছি। তার কবিতাগুলো আসলেই অন্যরকম ছিল। ড. আজাদ কবিতা নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলেন। তিনি কবিতা কম লিখেছেন বলে তাঁর আক্ষেপ ছিল। আমার কাছে তাঁর উপন্যাসগুলো ভাল লেগেছে; অন্যরকম মনে হয়েছে। সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে কিংবা পাকসার জমিন সাদবাদ এর দাশর্নিক দিক রয়েছে। এরকম উপন্যাস বাংলা ভাষায় লেখা হয়নি।
@Mojib Rahman, তার উপন্যাস আসলেই একটু অন্যধরনের কিন্তু আমার আসলে মনে হয়েছে উনি কবিতা বা প্রবন্ধ লেখায় যে জায়গাটিতে যেতে পেরেছেন উপন্যাসে সেটা হয়নি। আমি অবশ্য তার উপন্যাস পড়েছি মাত্র দুটি।
@লীনা রহমান, বিষয়টা জায়গায় যাওয়া বা না-যাওয়ার মতো না।সাহিত্যের আপেক্ষিক তুল্যমূল্য বিচার হয়।হুমায়ুন আজাদ যেমন তাঁর ‘সীমাবদ্ধতার সূত্রে’ আক্ষেপ করেছেন-বাংগালীরা পশ্চিম থেকেও আহরণ করতে পারে নি,কেননা পশ্চিমে বিকশিত হয়েছে সাহিত্যের নানা-রকম প্রথা-ভাংগার আন্দোলন,আর এটা হয়েছে তাদের ঐতিহাসিক সমাজ-বাস্তবতার খুব দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।কিন্তু আমরা একরকম স্থবিরতায় আচ্ছন্ন ছিলাম বহুকাল,হয়তো এখনো আছি;ফলে আমরা তৈরি করতে পারি নি কোন আধুনিক ভাষারীতি।ঊপন্যাস মানে যে শুধু আরিস্ততলীয় ধারার ধারাবাহিক প্লটের বিন্যাস নয়,এর বিকাশের পথ যে বিভিন্ন হতে পারে,হুমায়ুন আজাদ তার একটা নিদর্শন রেখে গেছেন।বাঙ্গলা সাহিত্যে এটা একটা পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা।তাই অন্যদের সাথে তাঁর উপন্যাসের তুল্যমূল্য বিচার করতে গেলে আপনি কিছুটা বিভ্রান্ত হবেন-ই।ফলে আপনার কাছে মনে হতে পারে আজাদের উপন্যাসগুলো ঐ মান(??) অর্জন করতে পারে নি।তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল এই যে,তিনি মোটামুটি একই ধারার নায়ক নিয়ে কাজ করেছেন।ভিন্নতা আনতে পারেন নি।
@Imran Mahmud Dalim,
এটা তো আমি মানিই।
আপনি ভুল বুঝেছেন। আমি প্রচলিত উপন্যাসের ধারার সাথে তার তুলনা করিনি। কারণ মুরগীর সাথে হাঁসের তুলনা হয়না (এটা জাস্ট উদাহরণ, কোন তুলনা বা উপমা নয়)।
আর তার উপন্যাস সম্পর্কে এটা আমার ব্যাক্তিগত মত। হয়ত হুমায়ুন আজাদের বক্তব্য তার মত করে বুঝে উঠতে পারিনি। আমার এই মতের উপর আমার সাহিত্য বোধের অনেক প্রভাব আছে (সবার সাহিত্য বিচারের মতের উপরই যার যার সাহিত্যবোধের প্রভাব থাকে)
@লীনা রহমান,
@লীনা রহমান,সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে উপন্যাসটিতে একটি দাশর্নিক বক্তব্য রয়েছে। পাকসার জমিন সাদবাদ মৌলবাদীদের নিয়ে তাদের জীবন, জীবিকা নিয়ে অসাধারণভাবেই লিখেছেন; আশার কথা শুনিয়েছেন। এগুলো অবশ্যই মানসম্মত উপন্যাস। অবয়য়ে ছোট; দ্যা আইটসাইডারো অবয়বে ছোট।
“…অথচ এই নৈসর্গিক কবিকে নিহত হতে হল মৌলবাদীদের হাতেই।”
তাই নাকি?
@আদনান,
আপনি কি ভাই সিরিয়াসলি জিগাইলেন কথাটা নাকি ইয়ার্কি মাইরা?
@ফাহিম রেজা, তাকে মেৌলবাদীরা আঘাত করার কারণেই তিনি মারা যান। জার্মানিতে তাকে সরাসর মৌলবাদিরা হয়তো খুন করেনি।
@আদনান,
আপনার কী মনে হয়?
আবেগ বেশী ঢেলেছেন।হুমায়ুন আজাদকে ব্যাখ্যা করার জন্য বিশ্লেষণের আরো গভীর স্তরে ঢুকা উচিত ছিল।যেমন, চমস্কি প্রস্তাবিত ‘রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ’-এর প্রতিফলন তাঁর কাব্যভাষায়,এমনকি গদ্য ও প্রবন্ধে,প্রকট।আর এরই মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে একদম প্রথার বাইরে এসে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন।আর কবিতার ক্ষেত্রে আজাদের নৈসর্গিক চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে শব্দের পর শব্দের একটা গাণিতিক গাথুঁনির মধ্য দিয়ে,আজাদ নিজেই যেটা বলেছন-কবিতায় পাগলামো তার পছন্দনীয় নয়,ফলে অনেক কবিতাই তাঁর ব্যর্থ হয়েছে আবেগের নিস্তরংগতার মধ্য দিয়ে।অথবা হতে পারে এটা একটা নতুন শৈলী ,যার সাথে বাংগালীরা এখনো পরিচিত হয়নি। গল্পে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন,আমরা বলতে পারি,পুরোপুবি কাব্যিক;তার এক একটা উপন্যাস হয়ে উঠেছে এক একটা বিশুদ্ধ কবিতা।বলা যায়,এখানেও তিনি বাংলা সাহিত্যে মৌলিক,যার ভিত্তিভূমি তৈরী হয়ছে অস্তিত্ত্ববাদী দর্শনের প্রভাবে।তাঁর অধিকাংশ নায়করা হয়ে উঠেছে পলায়নবাদী,সংসার থেকে তার নিতে চাইল মুক্তি,এর পেছনে কাজ করছিল নষ্ট হয়ে যাওয়া বাঙ্গলার সমাজ ব্যবস্থার নিদারুণ কশাঘাত।ইউরোপে রোমান্টিকসদের মাঝেও দেখি একই রকম পলায়নবৃত্তি। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ ভেঙ্গেছন সবকিছু,ক্রমাগত ভেঙ্গেছেন নিজেকেও।তাই দেখা যায় পলায়নবৃত্তি বন্ধ করে তার নায়করা ঘুরে দাড়িয়েছে,মৌলবাদী নায়ক শেষ পর্যন্ত আশ্রয় খুঁজেছে নারী ও দেশের কাছে,(পার সার জমিন সাদ বাদ)।আজাদ ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন বিশুদ্ধ সৌন্দর্য তৈরী করা যায় কেবলমাত্র সাধারণ মানুষের কাতারে দাড়িয়ে।তাই যেমনি ভাবে তার উপন্যাসের নায়কেরা ক্রমশ সাধারণের প্রতিনিধিত্ব করা শুরু করল,কবিতায় ব্যাক্তি আজাদও ঠিক তেমনিভাবে বেড়িয়ে আসলেন,বহু আগেই,’আর্ট গ্যালারী থেকে প্রস্থান’ কবিতাটির মধ্য দিয়ে।অস্তিত্ত্ববাদি আজাদ নিজেকে নিয়ে আসতে চাইছিলেন গণ মানুষের কাতারে,অসাধারণ সব ভাষাগত উৎকর্ষ,সৌন্দর্য,আর বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে।ফলে তিনি খুব দ্রুত পবিণত হন ধর্মীয় মৌলবাদের প্রধানতম টার্গেটে।এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক যে আমরা কোন অসাধারণ মেধাকে কখনোই মূল্য দিতে পারি নি।হুমায়ুন আজাদ আরো একবার আমদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেলেন।
@ইমরান মাহমুদ ডালিম, অসাধারণ বলেছেন; আপনি আজাদকে নিয়ে লিখলে ভাল লিখবেন বলেই মনে হচ্ছে। আপনার লেখার সাথে সহমত পোষণ করছি। হুমায়ুন আজাদ নিজেকে প্রথাবিরোধী লেখক হিসাবেই মনে করতেন; আমরাও করতাম। তিনি কবিতায় শ্লোগান নিয়ে আসেন নি; কবিতাকে গড়তে চেয়েছেন ভিন্ন সাচে। এখানে শুধু নৈসর্গ নিয়েই আলোচনা করেছি। যদি সমর্থন পাই অন্য বিয়ষে লিখবো। ধন্যবাদ আপনাকে।
@Mojib Rahman,
ধন্যবাদ।সমর্থন রইল।লিখে যান।
মুক্তমনায় স্বাগতম :rose2: ।
লেখাটি ভাল লেগেছে।
@সৈকত চৌধুরী, ধন্যবাদ। ব্লগে আপনার লেখাটিও পড়েছি। বিবর্তন আমার প্রিয় বিষয়।
অনেক আগ্রহ নিয়ে লেখাটি পড়লাম। ভাল লেগেছে। বিশেষ করে উদাহরন টেনে লেখার ঢংটি আমার পছন্দ হয়েছে। আমার কাছে এটা পরিষ্কার যে, লেখক গবেষনালব্ধ ও তথ্য নির্ভর লিখেছেন।
সেই সাথে আমি একটি কথা বলতে চাই। হুমায়ুন আজাদের ভক্তের সংখ্যা অনেক। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, ভক্তের আবেগ বা উচ্ছাসের বাইরে গিয়ে হুমায়ুন আজাদের লেখা বা জীবন সম্পর্কে তেমন কোন লেখা নেই, বা আমি পাইনি। হুমায়ুন আজাদের লেখায়ও কখনো নির্মোহতার ছাপ ছিল বলে জানা নাই। যে বিষয়টি আমাকে পিরিত করেছে তা হল, তার লেখায় বা কাজে বারংবারই আঘাৎ এসেছে, আঘাৎগুলো এসেছে বিভিন্ন মানুষের ইমোশনের উপরে। মৌলবাদিরাও তার থেকে যেমন রেহাই পাই নি, তেমন কবিকূলও রেহাই পায়নি! তার প্রয়োজনীয় খ্যাতির কমতি থাকতে পারে(যদি আদৌ তা সত্যি হ্য়), তবে সেই বিরাগকে যুক্তিবাদি কেই আঁরতুর র্যাঁ বোর সাথে তুলনা করবেন না, সে আস্থা আমার আছে। করলেও তিনি, নেহায়েত বালক ছিলেন, বয়সের হিসাবে, কবি হিসাবে নয়। তাই মানুষের বা কোন গোত্র বা বিশ্বাসের বা ইমোশনের প্রতি প্রয়োজনাতিরিক্ত বিষ বানকে শুধু বালখিল্লই বলা যাবে কি? তাঁর লেখনী গুন নিয়ে কোন সংসয় নেই, তবে আমার কাছে কখনও এমনও মনে হয়েছে যে মাত্রাতিরিক্ত আমিত্বে ভরা লেখা।
লেখার গুন বিচারে, লেখক অনেক গবেষনা করে এই লেখাটি লিখেছেন বলেই প্রতিয়মান হয়। তাই তাকে সাধুবাদ জানাই, সেই সাথে অনুরোধ জানাই সামনের লেখায় হুমায়ুন আজাদের লেখার ভিন্ন কিছু দিক নির্মোহ ভাবে তুলে ধরতে।
@নাসিম মাহ্মুদ,
যাকে আমরা মরে যেতে বাধ্য করেছি চাপাতির আঘাতে তাঁর লেখা উচ্ছাসের বাইরে গিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণের অধিকার আমাদের জন্মে নি।
আপনার মন্তব্যের কিছু অংশ দুর্বোধ্য লাগছে।
@সৈকত চৌধুরী, আপনার মন্তব্যটি আমাকে ভাবাচ্ছে; নির্মোহ লেখার অধিকার আছে কি নেই?
ধন্যবাদ আপনাকে।
@সৈকত চৌধুরী,
:yes: :yes:
@নাসিম মাহ্মুদ, হুমায়ুন আজাদ কাউকে নিজ থেকে আঘাত করতে যাননি।কবি সম্প্রদায় তাকে যেভাবে আঘাত করেছে তিনি তার প্রতিউত্তর দিয়েছেন মাত্র।যেমন-আল মাহমুদ তাঁর ‘নিঃসঙ্গে শেরপা’ গ্রথকে ‘বাজে কথার জঞ্জাল’ বলে অভিহিত করেছে।আল মাহমুদ তার ‘কবির আত্নবিশ্বাস’-এ লিখেছেন,হুমায়ুন আজাদ নামে যে কোন কবি আছে তা তিনি না-কি জানতেন না।আরো লিখেছেন যে,হুমায়ুন আজাদ না-কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামক দূর্গে বসে লেখালেখি কবেন।তিনি প্রশ্ন তুলেছেন,হুমায়ুন আজাদকে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানানো হল।এমনকি যথেষ্ট পরিমাণ কাব্য-প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও হুমায়ুন আজাদের কবিতার কথা খুব কম লোকই সাহিত্য পাতাগুলোতে তুলে ধরেন।তার শামসুর রাহমান পর্যন্ত এসে থেমে যান।তাকে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করা হয়েছে।তিনি সেগুলোর প্রতি-উত্তর দিয়েছেন মাত্র।
সংশোধনী- ‘তার শামসুর রাহমান পর্যন্ত এসে থেমে যান’-এখানে ‘তারা’ হবে
@নাসিম মাহ্মুদ, হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে আসলেই তেমন লেখালেখি হয়নি। আমি প্রকাশক ওসমান গণি সাহেবকে বলেছিলাম, তার একটি জীবনি গ্রন্থ প্রকাশ করার জন্য। তিনি বলেছিলনে, হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে লেখার মতো কেউ নেই। আমি ডাক যোগে একটি জীবনিগ্রন্থ পাঠিয়েছিলাম; তিনি প্রকাশ করেন নি। হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে লেখালেখি আসলেই অনেক কম হয়। কেন কম হয় তার ব্যাখ্যাও রয়েছে। তাকে নিয়ে লিখতে চাই।
@Mojib Rahman,
সেটা কি আপনার লেখা ছিল? যদি আপনার লেখা হয় তবে তা মুক্ত-মনায় ধারাবাহিক ভাবে দিতে পারেন এবং পরিশেষে ওটাকেই একটা ই-বুক বানিয়ে নিলাম। কেমন?
মুজিব রহমান,
চমৎকার বলেছেন। এজন্যই তো হুমায়ূন আজাদের সাহিত্য ও ভাষার ইতিহাস বিষক গ্রন্থদ্বয়ের নাম যথাক্রমে – লাল নীল দীপাবলী আর কত নদী সরোবর।
@গীতা দাস, আপনিও অসাধারণ বলেছেন; এজন্যই তার প্রবন্ধের বইয়ের নাম অসাধারণ। তাঁর কাব্যগ্রন্থ উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধের বই; সবর্ত্রই নামগুলো অসাধারণ।
এই ধরনের সাহিত্য আলোচনা মুক্তমনায় দেখতে পেলে সত্যিই ভাল লাগে। মুক্তমনায় স্বাগতম এবং সেই সাথে আশা করছি নিয়মিত লিখবেন এখানে।
আহা হুমায়ুন আজাদ! তাঁর মত আধুনিক মননের বাঙালি জন্মে নি আর। আমাদের পশ্চাদপদ মানসিকতার দেশে সময়ের চেয়ে অনেক আগে জন্মে গিয়েছিলেন তিনি। ফলে, তাঁকে ধারণ করতে অক্ষম হয়েছি আমরা। এক ফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে হাহাকার নিয়ে মারা গিয়েছিলেন এই সৌন্দর্যপিপাসু মানুষটি।
তাঁর এই কবিতাটা আমার অসম্ভব প্রিয়। তুলে দিলাম এখানে সবার জন্যে। অনেকদিন আগে বন্যা পোস্ট করেছিল তাঁর কিছু কবিতা। সেখান থেকেই কপি করেছি আমি কবিতাটি।
আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো
ছোট ঘাসফুলের জন্যে
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
দোয়েলের শিসের জন্যে
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে
এক টুকরো মেঘের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে
খুব ছোট দুঃখের জন্যে
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।
@ফরিদ আহমেদ,কবিতাটি আমরো প্রিয়। এ কবিতাটিতে প্রকিৃতি রয়েছে। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, তার সান্নিধ্য পাবার জন্য। আমাদের বাড়ি কাছাকাছি। আমি যে ইউনিয়নে জন্মেছি তিনি একই ইউনিয়নে জন্মেছেন। তার কবিতায় প্রকৃতির চেয়ে সৌন্দর্য অনেক বেশি। তাকে নিয়ে আরো পোস্ট করার ইচ্ছা আমার রয়েছে। ধন্যবাদ।
@ফরিদ আহমেদ,
কবিতা এ..ত.. সুন্দর হয় কি করে??????