এক.
কবি শহীদ কাদরীর প্রথম প্রেমিকা, প্রথম স্ত্রী পিয়ারী বছর আটেক আগে এসেছিলেন ঢাকায়। বার্লিন প্রবাসী প্রায় ৬০ বছর বয়সী পিয়ারী এখনো দারুন সুন্দর, উজ্জল। ঢাকা ক্লাবের এক পার্টিতে কোনো এক সাংবাদিক বন্ধু পরিচয় করিয়ে দেন তার সঙ্গে।
পানপ্রীতি, সাংবাদিকতা, নাকি অন্য কোনো কারণে জানি না, কেনো যেনো দ্রুত বন্ধুত্ব হয় তার সঙ্গে। পিয়ারী নিমন্ত্রণ করেন একসন্ধ্যায় তাকে সময় দেবার।
ভূতের গলিতে তার এক ভাইয়ের ছোট্ট দোতলার ঘরের সোফায় আয়েশ করে বসি দুজনে। আমি পছন্দের রক্ত গোলাপ কলিরগুচ্ছ খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে শেষে পিয়ারীর জন্য একতোড়া সাদা গ্লডিওলাস নিয়ে গিয়েছি। ফুলগুলো পেয়ে খুশীতে জ্বলে ওঠে তার কালো চোখ। আগুন রঙা লাল চুল, সাদা টপস্ আর আকাশী রঙের লং স্কার্টে তাকে বেশ ফুরফুরে মেজাজের মনে হয়।
একটা পিরিচে কাজু বাদাম, ওল্ড স্মাগলার আর পানির বোতল, টুকরো বরফ ও দুটি গ্লাস দিয়ে পিয়ারী টেবিল সাজান। ছোট্ট একটা জেড স্টোনের অ্যাসট্রে আমাকে উপহার দেন। আমি সিগারেট ধরিয়ে অ্যাসট্রেটি তখনই উদ্বোধন করি। পিয়ারীও আমার দেখাদেখি সিগারেট ধরান। হুইস্কির গ্লাস হাতে শুরু হয় কথোপকথন। …আমি জানতে চাই কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে তার প্রেম-অপ্রেমের কথা।
একটু থমকে গিয়ে পরে পিয়ারী অকপটে সব কথা বলা শুরু করেন।…তারই বয়ানে শোনা যাক সেই সব কথা:
দুই.
১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি বিয়ে করি কাদরীকে। কবিতার কারণেই তার সঙ্গে আমার প্রেম – বিয়ে হয়। যুদ্ধের পরে দুজন ভাগ্য অন্বেষণে পাড়ি জমাই জার্মানীতে। তখনো আমি জার্মানীর বাংলা বেতার বিভাগে যোগ দেই নি। বয়স ছিলো কম; আর দেখতেও নেহাৎখারাপ ছিলাম না। আমার আগ্রহ ছিলো শোবিজে। কিন্তু কাদরী এ সব একদম পছন্দ করতো না।
ওর আপত্তি সত্বেও আমি মডেলিং এ নামি। এই মডেলিংটাই কাল হলো, দুজনের সম্পর্কে চির ধরে। এক সময় আমার মনে হলো বিয়েটা একটা প্রধান বাধা। কাদরীকে না ছাড়লে আমি মডেলিং এ শাইন করতে পারবো না। আমি কাদরীকে বলি, ডিভের্সের কথা। সে সব মেনে নেয়। ডিভোর্সের পর কাদরী পাড়ি দেয় স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। আমার ছোট্ট ছেলেটি ডরমেটরিতে থেকে পড়াশুনা করতে থাকে।
মডেলিং এর নেশা তখন আমাকে পেয়ে বসেছে। জগত বিখ্যাত সব ফটোগ্রাফাররা তখন আমার ছবি তুলছেন। বার্লিন এর নাম করা ফ্যাশন পত্রিকায ছাপা হচ্ছে আমার ছবি। বাঙালি মডেল কন্যাকে পেয়ে ইউরোপ দিশেহারা হয়ে পড়ে। বার্লিনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে আমার খ্যাতি। একের পর এক শোবিজে অংশ নিতে থাকি।….
তিন.
কথায় বিরোতি দিয়ে পিয়ারী উঠে যান পাশের ঘরে। একটা খাম থেকে বের করেন তার প্রথম যৌবনের মডেলিং এর কিছু সাদাকালো ছবি।
আমি চমকাই, এতো সুন্দর! এতো সুন্দর!…
এ ফোর সাইজের প্রতিটা ছবির নীচে তারিখ দিয়ে ফটোগ্রাফারেরর নাম, ক্যামেরার নাম, কোন কোন লেন্সে, কত শাটার স্পিডে, কতো অ্যাপেরচারে তোলা হয়েছে– ইত্যাদি সব বিস্তারিত লেখা।
গ্লাস ভরে পিয়ারী শুরু করেন আবার।
সেই সময় আমার প্রেমিকের অভাব হয়নি। জার্মান যুব সমাজে আমার বেশ কদর ছিলো। সুমন চট্টোপধ্যায় বার্লিনে ছিলেন কিছুদিন। আমি তখন মডেলিং এর ওপর খানিকটা বিরক্ত হয়ে শুরু করেছি সাংবাদিকতা। যোগ দিয়েছি, জার্মান বেতার ডয়েচ ভেলের বাংলা বিভাগে।
সুমনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের দিকে গড়ায়। সুমন যখন বার্লিন ছাড়ে, তখন একটু ভেঙে পড়ি আমি। আমার এতোদিন পরে মনে পড়ে কাদরীর কথা।
চার.
পিয়ারী বলে চলেন, এখনকার মতো যোগাযোগের এতো সহজ উপায় না থাকলেও প্রবাসী বাঙালি মহলে কাদরীর খবর পাওয়া খুব কঠিন ছিলো না। কবিতার কারণে, তুমুল আড্ডাবাজীর কারণে বরাবরই কাদরী অতি জনপ্রিয়।
তো খবর পাই কাদরী হুট করে বিয়ে করেছে, এক মার্কিন মেয়েকে। খুব অসুখি জীবন কাটাচ্ছে। সাদা চামড়াটার কবিতা–টবিতার ওপর কোনো শ্রদ্ধাই নেই। বাসায় কাদরীর পরিচিত কেউ বেড়াতে এলে নাকি মুখের ওপর নাক সিঁটকে বলে, তুমি কি বিখ্যাত কবির সঙ্গে দেখা করতে এসেছো?…এ সব শুনে আমি অস্থির হই; কিন্তু আমার কিছুই করার থাকে না।
আরো পরে খবর পাই অসন্মান থেকে বাঁচতে কাদরী শেষে ওই শয়তনটার সঙ্গে রিলেশন ব্রেক করে, ওকে ডিভোর্স দেয়।
তারপর কাদরী এখন এই শেষ বয়সে এক পুঁচকে বাঙালি মেয়েকে নাকি বিয়ে করেছে। আমার আর কাদরীর হয়তো ওই বয়সী একটা মেয়ে থাকতে পারতো, তাই না!
তো মেয়েটা নাকি কাদরীর কবিতার খুব ফ্যান। আর এখন তো কাদরী প্রায়ই অসুস্থ থাকে। নানান অসুখে একেবারে শয্যাশায়ী। মেয়েটাই নাকি ওর খুব সেবা করে।
আর আমি? আমি একের পর এক সম্পর্কের ভাঙন দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ডুবে থাকি রেডিও নিয়ে। …মাত্র তো অবসর নিলাম কাজ থেকে। ভাবছি, সাংবাদিকতারই কোনো একটা কাজে আবার ঢুকে পড়বো।
পাঁচ.
আমি জানতে চাই, আপনার কাদরীকে দেখতে ইচ্ছে করে না? কেমন আছেন, আপনার প্রথম প্রেম?…
পিয়ারীর মুখ থেকে কথা সরে না। ভ্রমর কালো চোখ ছলছল করে ওঠে। উনি সিগারেটে টান দিতে ভুলে যান। সিগারেট পুড়ে পুড়ে আঙুলের ফাঁকে ছোট হয়ে আসে। কার্পেটে ঝরে পড়ে ছাই। আর সিডি প্লেয়ারে বেগম আখতার নীচু গলায় গেযে চলেন অহেতুক:
জোছনা করেছে আড়ি,
আসেনা আমার বাড়ি…
রাত্রি দীর্ঘ হয়। আমি বাসার দিকে পা বাড়াই।…
—
ছবি: ভ্যানগখ, অন্তর্জাল।
কবিদের কোন্টা যে প্রেম আর কোন্টা যে অপ্রেম বোঝা দায়; শুরু হতেও সময় লাগে না, শেষ হতেও না। আর প্রেমিকারাও তেমনি। একজন কত সহজেই অন্যজন সম্পর্কে মন্তব্য করে ফেলেনঃ
এত বড় কবি, এত চমৎকার কবিতা লেখেন- অথচ কেমন বিবেচনাবোধ!
@প্রদীপ দেব,
হুমম… :-/
মুগ্ধ হলাম। সিগারেটের গন্ধের মতো (বাজে!!) লেখাটা যেন একটা মৃদু আবেশ রেখে গেল। প্রেম মরে না? কেন মরে না??? এতো কষ্ট কেন জীবনে, এতো হারানো কেন, এতো হার কেন? এতো সাধনা, এতো কামনা, কোথায় মেশে??? শেষ দেখতে বড্ড ইচ্ছে হয়।
@ব্লাডি সিভিলিয়ান,
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। :rose:
নতুনদেশ ডটকম-এর সম্পাদক, বন্ধু সেরীন ফেরদৌস লেখাটি পড়ে ইমেইল বার্তায় বলেছেন প্রায় একই কথা। আমি তাকে বলেছি, এটিও প্রেমের একটি রূপ। আজম খান তার গানে যেমন বলেন:
ভাল লাগল!
কোথায় যেন পড়েছিলাম উনি কেমেস্ট্রিতে মাস্টারস।
উনি জার্মানীতেই থাকতে ভালবাসেন
@লাইজু নাহার,
আপনি বোধহয় জেবুন্নাহার পিয়ারীর কথা বলছেন। আমি যতটুকু জানি, তিনি এখন জার্মানিতেই অবসর জীবন কাটাচ্ছেন।
আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ।
ভাল লাগল!
কোথায় যেন পড়েছিলাম উনি কেমেস্ট্রিতে মাস্টারস।
উনি জার্মানীতেই থাকতে ভালবাসেন!
ছোট্ট। কিন্তু দারূণ উপভোগ্য।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
একমত।
@নৃপেন্দ্র সরকার, @সৈকত চৌধুরী,
ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। আগামীতেও সঙ্গে থাকার বিনীত অনুরোধ। :yes:
চমৎকার লেখা।
@আলিম আল রাজি,
সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
@বিপ্লব রহমান,
দারুন লাগলো ! পিয়ারীর হাতে নিঃশেষ হওয়া সিগারেটের মতো লেখাটিও
হঠাৎ শেষ হয়ে গেল !
@ভজন সরকার, 🙂
স্মৃতিকথনটি উপভোগ্য। ধন্যবাদ বিপ্লব রহমানকে।
@ব্রাইট স্মাইল্,
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
শহীদ কাদরী তার কাব্য ‘ তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ বইটি পিয়ারীকেই উৎসর্গ করে লিখেছিলেন —
‘গানগুলো যেন পোষা হরিণের পাল
তোমার চরণ চিহ্নের অভিসারী’
সেই পিয়ারী বেগমের দুঃখজাগানিয়া স্মৃতিচারণ ভাল লাগল। ব্যতিক্রমধর্মী এ সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার জন্য বিপ্লবকে ধন্যবাদ ।
@গীতা দি,
আপনার পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। বিনীতভাবে জানাই, এটি কোনো সাক্ষাৎকার নয়; একটি অনানুষ্ঠানিক স্মৃতিচারণমাত্র। :yes:
@বিপ্লব রহমান,
লেখার পর আবার কেন জানি মনে হল বিপ্লব পিয়ারী বেগমের সাক্ষাৎকারটিকেই স্মৃতিচারণের আংগিকে উপস্থাপন করেছে।
যাহোক, একটি অনানুষ্ঠানিক স্মৃতিচারণ আপনার সাক্ষাতের জন্যই পেয়েছি।
@গীতা দি,
ঠিক আছে। চলুক। 🙂
আহা কি লিখলেন ভাই বিপ্লব। একেবারে বেগম আখতার। মধ্যরাতে বেগম আখতার চালু করে দিলেই রাত্তিরে মাঠের মধ্যে পরী নেমে আসত। তার পরণে রূপোলী শাড়ি। আড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে গলি দিয়ে। শাড়ি লুটোচ্ছে। জান ঠাণ্ডা করে দিলেন রে ভাই।
মাঝে মাঝে শহীদ কাদরীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। উনি থাকেন পার্সন বুলেভার্ডের ৮৯ এভিনিউতে–একটি বড় এপার্টমেন্টের ৬ তলাতে। আমি কখনো যায় নি। কখনো অই পথে হেঁটে যাই। সামনে গীর্জা–আর কবরখানা। নিচে শহীদ কাদরী ক্রাচে ভর রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চুল উড়ছে। বিড় বিড় করে বলছেন, আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও।
আমি এই পথটি দিয়ে জ্যামাইকা সেন্টারে যাই। ওখান থেকে জে ট্রেন। ব্রুকলিন। গীর্জায় ঘন্টা বাজে। দেখতে পাই–কবি শহীদ কাদরী দাঁড়িয়ে আছেন সন্তের মত–তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে একটি মেঠো ইঁদুর। আর সন্ত্রাসের মত নামছে বৃষ্টি। এবং বৃষ্টি।
@কুলদা রায়,
দাদা, চমৎকার মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা। :rose: