অঁরি পোঁকারের Intuition and Logic in Mathematics থেকে অনুবাদ

ফরাসী গণিতবিদ পোঁকারে বিখ্যাত পোঁকারে অনুমানের জন্য সবচেয়ে পরিচিত, কিন্তু তিনি গণিতের বহু শাখায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। অনুদিত প্রবন্ধটি ১৯০৫ সালে লেখা বিজ্ঞানের মূল্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত। প্রবন্ধের ইংরেজী অনুবাদ, যেখান থেকে এই বাংলা অনুবাদ করা হচ্ছে, ইন্টারনেটে সহজলভ্য।

গণিতে অন্তর্জ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যা ১
গণিতে অন্তর্জ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যা ২

যে প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবেই ওঠে তা হল: এই বিবর্তন কি শেষ হয়ে গিয়েছে? আমরা কি গণিতে ত্রুটিহীন নিশ্ছিদ্রতায় উপনীত হয়েছি? বিবর্তনের প্রতিটি ধাপেই মনে করা হয়েছিল, এই বুঝি শেষ ধাপ। সেসব ধারণা প্রতিবারই ভুল ছিল, অতএব আমরা যদি অাবারো সেই দাবী করি সেক্ষেত্রে আমরাও একই ভাবে নিজেদের প্রতারিত করছি কিনা, এটা ভেবে দেখা দরকার।

গাণিতিক যুক্তিমালায় অন্তর্জ্ঞানের আর প্রয়োজন নেই, দার্শনিকরা আমাদের এই বিশ্বাসকে বিভ্রম বলে আখ্যায়িত করবেন। তাঁরা বলবেন, বিশুদ্ধ যুক্তি নত্ুন কিছুর উদ্ভব ঘটাতে পারেনা, শুধু যুক্তি থেকে আসতে পারেনা কোন নতুন সত্য, কোন নতুন বিজ্ঞান। এক অর্থে এই দার্শনিকরা ভুল বলছেন না: জ্যামিতি বলুন, বিজ্ঞান বলুন, কি এমনকি পাটিগণিতই বলুন না কেন, এসব যেকোন ক্ষেত্রেই নতুন কিছু করবার জন্য চাই বিশুদ্ধ যুক্তি ছাড়াও অন্য কিছু। এই “অন্য কিছু”-র কি নাম দেব, অন্তর্জ্ঞান ছাড়া? কিন্তু প্রশ্ন হল, এই এক নামের পেছনে আসলে ভিন্ন-ভিন্ন কতগুলি ধারণা লুকিয়ে আছে?

এই চারটি স্বতঃসিদ্ধকে তুলনা করুন:

১) দুটি মান-এর প্রত্যেকটিই যদি তৃতীয় আরেকটা মানের সমান হয়, তবে মান দুটি সমান।

২) যদি একটি উপপাদ্য ১ সংখ্যাটির জন্য সত্য হয়, এবং যদি আমরা দেখাতে পারি যে উপপাদ্যটি একটি মান n এর জন্য সত্য হলে n+1 এর জন্যও সত্য হবে, তাহলে উপপাদ্যটি সব পূর্ণ সংখ্যার জন্য সত্য।

৩) ধরা যাক, A, B, C এবং D একটি সরলরেখার উপর কয়েকটি বিন্দু। যদি C বিন্দুটি A ও B এর মধ্যে থাকে, আর D বিন্দুটি A ও C এর মধ্যে থাকে, তাহলে D বিন্দুটি A ও B এর মধ্যে থাকবে।

৪) ধরা যাক একটি সরলরেখা ও একটি বিন্দু দেয়া আছে। তাহলে ওই বিন্দুর মধ্যে একটার বেশি সরলরেখা যেতে পারে না, যেটা প্রথমোক্ত সরলরেখার সমান্তরাল।

চারটিকেই অন্তর্জ্ঞান মূলক বলা হয়, কিন্তু প্রথমটি যুক্তিবিদ্যার একটি নিয়মের ব্যাখ্যা, দ্বিতীয়টি একটি synthetic a priori judgment এবং গাণিতিক আরোহন পদ্ধতির ভিত্তিমূল, তৃতীয়টি কল্পনা শক্তির ব্যবহার, চতুর্থটি আসলে একটি সংজ্ঞা।

অন্তর্জ্ঞান যে স্রেফ ইন্দ্রিয়জাত, তা নয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি সহস্রভূজকে কল্পনা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়না, কিন্তু আমরা অন্তর্জ্ঞানের সাহায্যে সব বহুভূজ সম্বন্ধেই চিন্তা করতে পারি, যার মধ্যে সহস্রভূজও অন্তর্ভুক্ত।

এই শতাব্দীতে পঁসেলের মত অন্তর্জ্ঞান কম লোকেরই ছিল; এবং অন্তর্জ্ঞানের ব্যাপারে তাঁর প্রায় বাড়াবাড়ি রকম উৎসাহই ছিল বলতে হবে। তাঁর তথাকথিত continuity নীতির উদাহরণ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এই নীতি অনুযায়ী, যা real মানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা imaginary মানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া চাই, এবং নীতি ব্যবহার করে পরাবৃত্তউপবৃত্তের মধ্যে তিনি অসাধারণ এক সমন্বয় সাধন করে ফেললেন — পরাবৃত্তের দুটি real asymptote রয়েছে, আর উপবৃত্তের দুটি imaginary aymptote রয়েছে, এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে। এখানেও বলতে হবে অন্তর্জ্ঞানের এই বলিষ্ঠ উদাহরণ ইন্দ্রিয়জাত নয়, কারণ চোখে দেখলে পরাবৃত্ত আর উপবৃত্তকে বেশ ভিন্নই দেখায়। অদ্ভুত এক দর্পিত অন্তর্জ্ঞানজাত সাধারণীকরণ এটা — সত্যি বলতে কি, আমি যে এটাকে খুব সমর্থন করি তাও নয়।

তাহলে দেখছি যে অন্তর্জ্ঞানও বহুবিধ। প্রথমে, ইন্দ্রিয় এবং কল্পনাশক্তির ব্যবহার। দ্বিতীয়, পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান থেকে ধার করা অন্তর্জ্ঞান। আর অবশেষে, তিন নম্বর, বিশুদ্ধ সংখ্যাবিষয়ক অন্তর্জ্ঞান, যেখান থেকে উপরে আলোচিত দু নম্বর স্বতঃসিদ্ধ এসেছে, এবং যেখান থেকে বিশুদ্ধ গাণিতিক যুক্তির সূত্রপাত। আমি উদাহরণের সাহায্যে দেখিয়েছি প্রথম দুটি আমাদের নিশ্চয়তা দিতে পারেনা, কিন্তু তৃতীয়টি সন্দেহের ঊর্দ্ধে বলেই মনে হয়।

আজকের দিনের analysis এ কেউ যদি নিশ্চয়তা চান, তাহলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওই বিশুদ্ধ সংখ্যাবিষয়ক অন্তর্জ্ঞানই ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু এই অন্তর্জ্ঞান বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবেনা, অবএব বলা যেতে পারে আজ আমরা সেই বিবর্তনের শেষে এসে সত্যি পৌঁছেছি, বিশুদ্ধ নিশ্ছিদ্রতা আজ করায়ত্ব।

চলবে…