.পাকিস্তান এছলামী ছাত্রসংঘ পৃথিবীতে হিন্দুস্তানের কোনো মানচিত্র স্বীকার করে না। এছলামী ছাত্র সংঘ ও আলবদর বাহিনীর কাফেলা দিল্লীতে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র সংঘের একটি কর্মীও বিশ্রাম গ্রহণ করিবে না। : আলী আহসান মুদাম্মাদ মুজাহিদ, দৈনিক আজাদ, ৮ নভেম্বর ১৯৭১।…

এক

১৯৯১ সালে গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দেয়ার প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকী তার বীর উত্তম খেতাব বর্জন করেন। এক-এগারোর পরে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করলে ২০০৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগের এই নেতা নির্বাচন কমিশনকে প্রথম প্রস্তাব দেন, নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের যেনো অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

[লিংক]

[লিংক]

এরপর পরই জামাত নেতা, ঘাতক মুজাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে নাকি কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই!

[লিংক]

মুজাহিদের এই উদ্ধত্ত্বপূর্ণ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয় পুরো দেশ। পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেই, সে সময় গণমাধ্যম জুড়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিলো–যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, যা এতো দীর্ঘ সময় ধরে, জোড়ালোভাবে কখনো আলোচিত হয়নি।

[লিংক]

এরপর ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারীরা ‘সেক্টর কমান্ডারর্স ফোরামের’ ব্যানারে সংগঠিত হন। ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর গঠিত এই সংগঠনটি দাবি তোলেন, সে সময়ের ‘সেনা সমর্থিত অস্বাভাবিক সরকারের’ কাছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্মুখিন করার এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তাদের যেনো অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ৫০ জন যুদ্ধাপরাধীর খসড়া তালিকাও প্রকাশ করে।

[লিংক]

পরে ছোট্ট এই সংগঠনটি সারাদেশে অসংখ্য মতবিনিময় সভাতেও তোলে একই দাবি। আর তারা সারাদেশ থেকেই শিক্ষিত সমাজের মধ্যে পেতে থাকেন ব্যাপক সাড়া।

এর কারণ সম্ভবত এই যে, সে সময় দুর্নীতি বিরোধী ধর-পাকড়ে জে. মইন-ফখরুদ্দীনের সরকারের কাছে মানুষ আশা করেছিলো, দল-নিরপেক্ষ (?) বন্দুকবাজ সরকারটিই হয়তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে সক্ষম, যা নানা হিসেব-নিকেশে শেষ পর্যন্ত দল সমর্থিত সরকার না-ও করতে পারে।

[লিংক]

এরপর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ছাড়বেন–এমন নির্বাচনী প্রচারণায় বারংবার অঙ্গীকার দিয়ে ভোটে জয় লাভ করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, তার এই অঙ্গিকারটিকে জোরালোভাবে সমর্থন দিয়েছে নতুন ভোটাররা, তারাই গত নির্বাচনের ফলাফলে রেখেছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, বিএনপি-জামাতকে হারাতে হয়েছে অসংখ্য নিশ্চিত আসন, ভোটবাজীর লড়াইয়ে তাদের পরাজয় নিশ্চিত হয়।

[লিংক]

দুই

গত বছর তিনেকের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বর্তমান সরকার কতখানি এগুলেন, আসুন এবার তারই একটি সরল অংক কষি।

* গত বছর ৪ এপ্রিল আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, ওই মাসেই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করবে। পরদিন তিনি এ সম্পর্কিত জাতিসংঘের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন।

* গত ৩১ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এ বছরের প্রথোমার্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হবে। তিনি আরো জানান, যুদ্ধাপরাধ বিচারের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তবে এই প্রস্তুতি সর্ম্পকে মন্ত্রী কোনো তথ্য দেননি।

* যুদ্ধাপরাধ বিচারে সবার আগে যুদ্ধপরাধ তদন্ত প্রয়োজন– এ বিষয়ে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল-নির্মূল কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহল একমত। এ জন্য সরকার কি কোনো তদন্ত কমিশন গঠন করেছে?

গত বছরের এপ্রিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ‘২০ এপ্রিলের মধ্যে কমিশন গঠন হবে’ — এ কথা জানিয়ে জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা শিগগিরই তদন্ত শুরু করবো। কমিশনের সদস্য সংখ্যা পাঁচের বেশি হবে না।

আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠক শেষে এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ২০ এপ্রিল কমিশনের সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হবে। বৈঠকে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং এ্যাটর্নি জেনারেল উপস্থিত ছিলেন।

পরে তদন্ত কমিশন গঠনের নির্ধারিত সময় শেষে গত বছর ২১ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জানান, তদন্ত কমিশন ও যুদ্ধপরাধ বিচার বিষয়ক কমিটি গঠনের কাজ পিছিয়ে গেছে। আইনমন্ত্রী ইরান থেকে দেশে ফিরে আসার পর এই কাজে হাত দেওয়া হবে।

তিনি আরো বলেন, সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সরকার কমিশন ও কমিটি গঠন করতে পারছে না। আইনমন্ত্রী ফিরে আসার পর প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হবে।

২৪ এপ্রিল আইনমন্ত্রী দেশে ফেরেন। কিন্তু তারপরেও তদন্ত কমিশন আর গঠন হয়নি।

* যুদ্ধপরাধের বিচার নিয়ে গত বছর ১ জুন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। তদন্ত কমিশন গঠন সম্পর্কে তিনি অবশ্য কিছু বলেননি। পরদিন তিনি বলেন, ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদনের পর কমিশন এবং এর আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হবে।

* অর্থাৎ যথেষ্ট পূর্ব-প্রস্তুতি ছাড়াই আইনমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীবর্গ গণমাধ্যমে দাবি করছেন, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য তৈরি।

বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে গত ১৪ ডিসেম্বরই আইনমন্ত্রী আবারো বলেন, প্রতীক্ষিত যুদ্ধপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হবে।

একই দিনই দেশের শীর্ষস্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা যুদ্ধপরাধ বিচারে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করার দাবি জানান।

ওই দিনই সাংস্কৃতিককর্মীদের দাবি প্রসঙ্গে সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার বলেন, এই দাবি আমি সমর্থন করি। কিন্তু জানি না চলতি মাসে কমিশন গঠন হবে কি না।

* সেই তদন্ত কমিশন আর গঠিত হয়নি।

[লিংক]

তিন

পাঠক, সরল অংকের দ্বিতীয় পর্বে যাই।

যুদ্ধাপরাধের বিচারে সরকার বরাবরই বিশেষ ট্রাইব্যুনালের কথা বলছে। এ জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাব্যুনালের বিশেষজ্ঞদের সাহায্য ও পরামর্শ গ্রহণেও সরকার উদার।

* গত বছর নভেম্বরে সরকার ১৪, আব্দুল গনি রোডে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল বসায়। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি এই স্থান নিয়ে প্রথম আপত্তি তোলে। কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, ওই কার্যালয়টি একটি আন্তর্জাতিকমানের ট্রাইব্যুনালের জন্য যথেষ্ট নয়। এছাড়া অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী এবং মামলার বাদী পক্ষ ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা বিধান সেখানে লংঘিত হতে পারে।

* ২১ ডিসেম্বর আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনাল স্থান পরিদর্শন করেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালের জন্য স্থানটি যথেষ্ট সুপরিসর নয়। এটি স্থানান্তর করা হতে পারে।

* গত দুমাসেও সরকার যুদ্ধাপরাধ বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের স্থানই নির্ধারণ করেনি।

[লিংক]

চার

গত ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা সরকারের এক বছরপূর্তি হয়েছে। একেকটি মন্ত্রনালয় তাদের এক বছরের সাফল্য গাঁথা পৃথক পৃথক সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই ওইদিন টেলিভিশনে জাতি উদ্দেশে দেওয়া লিখিত ভাষণে তার সরকারের সাফল্যের নানা দিক বিস্তারিত ব্যাখা করেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে উচ্চারণ করেন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বাক্য: যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে The International Crimes Tribunals (Amendment) Act, 2009 পাস হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের জন্য প্রাথমিক স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। স্বল্পসময়ের মধ্যে বিচারের কার্যক্রম শুরু করা হবে ইনশাল্লাহ।

[লিংক]

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০ জানুয়ারি সংসদে বলেছেন, বিএনপি সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তো বটেই, এমন কি রাজাকারদের নাম ঢুকিয়েছিলো। আসলে দরকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরির পাশাপাশি রাজকারদের তালিকবা তৈরি। বরং রাজাকারদের তালিকা তৈরি করাই বেশী জরুরি। …

পরিদন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ যুদ্ধারাধীদের বিচারে ‘সরকার প্রতিশ্রুতিব্ধ’ বলে আবারো ঘোষণা করেন।

[লিংক]

সব শেষ এ বছর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তদন্ত কমিশনার নিয়োগ, ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ নানা প্রক্রিয়া চলতি মার্চে শেষ হবে।
[লিংক]
পাঁচ

এইসব ঘটনাপরম্পরায় ১৬ কোটি জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-এর প্রশ্নে সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের আশায় এখনো বুক বেঁধে আছেন। তারা প্রতি ক্ষণ গনণা করছেন; আর ছোট্ট একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ওয়ার ক্রাইম ট্রায়াল ওয়াচ-ও আছে এই নিবিড় পর্যবেক্ষণে।

[লিংক]

জয় বাংলা ।।


ছবি: যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ‘৭১ এর ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় কমিটির গোস্টার, অন্তর্জাল।