সৌদি নারীদের সত্যি কাহিনী
মূলঃ খালেদ ওলীদ
অনুবাদঃ আবুল কাশেম
ফেব্রুয়ারী ১২, ২০১০

[ভূমিকাঃ ডিসেম্বর মাসে খালেদ ওলিদের ইসলাম পরিত্যাগের জবানবন্দির অনুবাদ করেছিলাম। তখন লিখেছিলাম খালেদ আমাকে বেশ কয়েকটি ইমেইলে সৌদি আরাবের ইসলাম সম্পর্কে লিখেছিল। এখানে আমি তার আর একটি লেখা অনুবাদ করে দিলাম। উল্লেখ্য যে খালেদের এই লেখাটি একটা বইতে প্রকাশ হয়েছে। বইটার শিরোনাম  হলো: Why We Left Islam.

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ: বাংলায় এটা আমার দ্বিতীয় লেখা। কোন ভুলভ্রান্তি থাকলে জানিয়ে দেবেন।
আবুল কাশেম]
:line:

অনেকেই বলে থাকেন ইসলাম নারীদের শ্রদ্ধা করে এবং তাদের মূল্য দিয়ে থাকে। কিন্তু আমার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি বলতে পারি এই ধারনা সর্বৈব মিথ্যা। সৌদি আরবের আদি অধিবাসী হিসেবে আমি স্বচক্ষে দেখেছি কি ঘৃন্য ও নীচু ভাবে ইসলামী সমাজে নারীদেরকে স্থান দেওয়া হয়েছে। আমি যা চাক্ষুষ দেখেছি কি ভাবে ইসলামে নারীদের এই দুর্দশাদায়ক ও হীনকর অবস্থা তা সংক্ষিপ্ত ভাবে বর্ণনা করব এই রচনায়। আমি হলফ্‌ করে বলতে পারি: এই রচনার প্রতিটি শব্দ সম্পূর্ণ সত্য এবং সত্য ছাড়া এক বিন্দু মিথ্যা নাই। এই রচনায় কিছুমাত্র মনগড়া বা অতিরঞ্জিত বিষয় নাই। এই লেখা আমি নিজের মন থেকে লিখেছি, কেউ ই আমাকে বাধ্য কিংবা প্রভাবিত করেনি এই লেখার জন্য। এর কারণ আমার জন্ম সৌদি আরবে, এবং এই সৌদি আরবেই আমি পাকাপোক্ত ভাবে থাকি।

আমার তিন বোন আছে । তারা ভীষণভাবে পড়াশোনা করতে আগ্রহী । নিজের চেষ্টায় ওরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের দেশের নারীদের শিক্ষার উপর বিভিন্ন অযৌক্তিক, সেকেলে ও অন্যায্য নিয়ম চাপিয়ে দেয়ার জন্য ওরা ওদের পছন্দসই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারল না। আমার শত ইচ্ছা সত্বেও ওদের শিক্ষাকে এগিয়ে নেবার জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি । আমার হাত বাঁধা। কারণ আমাদের সমাজে নারী আধুনিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিতা হলে সে সমাজের বিরাগভাজন হয়ে পড়ে।
আমার এক ভগিনী মাধ্যমিক বিদ্যালয় শেষ করে পড়াশোনা ছেড়ে দিল। তার কারণ সে চাইছিল সে সৌন্দর্য প্রশিক্ষণ (বিউটি থেরাপিস্ট) গ্রহণ করবে। কিন্তু আমাদের মতো খাঁটি ইসলামি সমাজে তার অভিলাষ পূর্ণ হওয়া সহজ নয়। তার জন্যে বিউটি থেরাপিস্ট হওয়া একেবারেই অলীক কল্পণা মাত্র। আমার অপর দুই ভগিনী বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হতে চাইল। সেজন্য ওরা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করল।

আমার পরিস্কার মনে আছে আমার ঐ ভগিনীরা যখন মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল তখন ওদের পরচয়পত্রে ওদের নাম ছিল ঠিকই, কিন্তু ছবি ছিল আমার পিতার। এর অর্থ এই যে আমার ভগিনীদের কোন বাস্তব অস্তিত্ব নাই। ওরা কাগজে আছে নামে মাত্র। পাঠকবৃন্দ, আপনারা এই ধরণের জঘণ্য ব্যাবস্থার কথা জেনে চম্‌কে যাবেন না যেন। আমাদের সমাজে নারীদেরকে ধরা হয় গৃহপালিত পশুর মতো। গৃহ পশুর যেমন সর্বদাই এক মালিক থাকে তেমনি ভাবে আমাদের নারীদের সর্বদায় কেউ না কেউ মালিক হয়। আমাদের নারীরা মানব হিসাবে অস্তিত্ব পেতে পারেনা। সৌদি আরবের আইন বলে যে কোন কলেজের মেয়ে তার পরিচয়পত্রে তার নিজস্ব ছবি লাগাতে পারবে না। একমাত্র মেয়ের পিতার, ভ্রাতার, স্বামীর অথবা তার আইনী অভিভাবকের (মাহ্‌রম) ছবি থাকবে।

সে যাই হোক। আমার ঐ দুই বোন শিক্ষকতার জন্য প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে চাকুরীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। কিন্তু বাসা থেকে বলে দেয়া হলো – চাকুরীস্থল আমাদের গৃহের কাছে হতে হবে। কারণ আমার বোনেরা কোন পরিস্থিতিতেই আমার পিতার নাগালের বাইরে যেতে পারবে না। এর সোজা অর্থ হল—ওরা কোনদিনই চাকুরী পাবে না।

একজন বিবেকবান ভ্রাতা হিসাবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে আমাদের এলাকার অনেক পুরুষের তুলনায় আমার ভগিনীরা বিদূষী, দায়িত্ববান—এমন কি আমার চাইতেও। আমি পরিপূর্ণভাবে জানি যে ওদেরকে সুযোগ দেওয়া হলে কোন সমস্যা ছাড়াই ওরা নিজেরাই নিজেদের জীবন সুষ্ঠুভাবে গড়ে নিতে পারবে। সত্যি বলতে কি ওরা অনেক শক্ত কাজ আমাদের চাইতেও ভালোভাবে সম্পন্ন করার সামর্থ্য রাখে।

কিন্তু, হায় কি দুর্ভাগ্য! এই আমার তিন শিক্ষিতা, জ্ঞানসম্পন্ন, উচ্চাকাঙ্খী ও দায়িত্বশীল ভগিনীগন এক নিরক্ষর পিতার হাতে বন্দীনি। আমার পিতা গৃহের বাইরের বিশ্ব সমন্ধে একেবারেই অবগত নন। উনি বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতি ও বিকাশের কোন প্রয়োজনীয়তাই দেখেন না। এরই সাথে তিনি আমার তিন বোনকে বাধ্য করছেন ওনার চৌহদ্দিতে তাদের জীবনকে আটকে রাখতে।

আমার পিতা আমার বোনদের বিবাহ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। এর কারণ এই যে আমার পিতা কঠিন ভাবে শর্ত দিয়েছেন যে অ ধূমপানকারী, পাক্কা ইসলামি এবং একই গোত্রের পাত্র ছাড়া আরা কাউকে আমার বোনেরা বিবাহ করতে পারবে না। এখন দেখা যাচ্ছে এই মূঢ় এবং অনঢ় শর্তের কারণে আমার বোনদের চিরকুমারী থাকতে হবে। ভবিষ্যতে ওদের বিবাহের কোন সম্ভাবনাই নাই।

আমাদের এই কঠোর ইসলামি সমাজে যেসব পুরুষ ধুমপান করে অথবা/এবং নামায রীতিমত পড়েনা তাদেরকে বিবাহের অনুপযুক্ত ধরা হয়। কোন পুরুষ বিবাহ করতে চাইলে তাকে দুইজন সাক্ষী জোগাড় করতে হবে যারা সাক্ষ্য দিবে যে ঐ বিবাহ ইচ্ছুক পুরুষ ধুমপায়ী নয় এবং মসজিদে নিয়মিত নামায আদায় করে। এই নিয়মটা খুবই ধ্যবাধকতামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়। এই প্রক্রিয়াটা সৌদি সমাজে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ঐ সাক্ষ্য ছাড়া বিবাহ ভেঙ্গে যেতে পারে। আরও একটি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এক সৌদি গোত্রের পাত্র অন্য সৌদি গোত্রের পাত্রীকে কোনক্রমেই বিবাহ করতে পারবে না, এমনকি উভয় গোত্র যদিওবা মুসলিম হয় তবুও। এই প্রসঙ্গে কোন সৌদি মহিলার অ মুসলিম পাত্রকে বিবাহের তো প্রশ্নই উঠে না। এটা সম্পূর্ণ হারাম চিন্তাই করা যায় না।

আমাদের গোত্রে নারীরা পুরুষদের তুলনায় প্রায় দুই তিন গুন বেশী। এর অর্থ হল আমাদের অনেক মহিলাকে চিরজীবন অবিবাহিতা থেকে যেতে হবে। কারণ আমাদের গোত্রের বাইরে বিবাহ করা সম্পূর্ণ অচিন্তনীয়। আমাদের সমাজে পুরুষরা বিশ বছরের নীচের মেয়েদেরকে বিবাহ করতে চায়। তাদের রয়েছে ষোল বছর অথবা তার চেয়েও কম বয়সি মেয়েদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ। এর পরিনাম এই যে বিশ বয়সের উর্ধের মেয়েদের বিবাহের সম্ভাবনা একদম শুন্য। এইসব মেয়েদের জন্য একটাই পথ—তাদেরকে বৃদ্ধ পুরুষ বিবাহ করতে হবে।

কাজেই দেখা যাচ্ছে এইসব গোঁয়ার্তুমি ইসলামী নিয়ম কানুনের জন্য আমাদের সমাজের বাড়তি বয়সের মেয়েদের ভবিষ্যত বিবাহজীবন একেবারেই দূরূহ।

এখন দেখা যাক আমার পিতার সত্যিকার কারণ: কেন তিনি তাঁর মেয়েদের বিবাহের ব্যাপারে একেবারেই নিরুৎসাহী। এই ব্যাপারে আমি বলতে চাচ্ছি কেন আমার পিতা তাঁর মেয়েদেরকে অন্য গোত্রের ছেলেদের হাতে তুলে দিতে নারাজ।

বেশিরভাগ সৌদি পুরুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে নারীদের নিজস্ব কোন আশা, আকাঙ্খা, উচ্চাভিলাস থাকতে পারে না। তাই বিবাহের ব্যাপারে সৌদি মেয়েদের অভিমত সম্পূর্ণ অবান্তর। একটি সৌদি মেয়ে সম্পূর্ণভাবে তার মালিকের সম্পদ। মেয়েটির মালিক তার মেয়েটির ভাগ্য নির্ধারক। সৌদি পুরুষেরা মনে করে যে তাদের গোত্রের মেয়েরা অন্য অজানা গোত্রের ছেলের সাথে বিবাহ হওয়া খুবই লজ্জার ব্যাপার। একজন সৌদি কোন রকমেই এটা মানতে পারবেনা যে তাদের গোত্রের এক মেয়ের ‘সম্মান’ অন্য গোত্রের ছেলে দিতে পারবে। এক সৌদি পিতা চিন্তাই করতে পারে না যে তার কন্যা অন্য গোত্রের অচেনা ছেলের সাথে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হবে—এমন কি বিবাহের পরেও। এমনকি জামাই মুসলিম হলেও। এইটাই হচ্ছে আমার পিতার রূপ—তিনি তাঁর মেয়েদের বিবাহে রাজী নন অন্য বাইরের ছেলের সাথে। যদি তিনি ঘুর্ণাক্ষরে চিন্তাও করেন যে কোন বাইরের লোক তাঁর মেয়ের সাথে যৌনসঙ্গম করে কিংবা তাঁর কন্যার যৌনাঙ্গ দেখে ফেলতে পারে, তার মনে হয় মাথাই খারাপ হয়ে যাবে।

উপরে উল্লেখিত কারণের জন্য প্রচুর সৌদি পিতা দ্বি বিবাহের আয়োজন করেন। অর্থাৎ, আপনি আপনার ছেলেকে দিন আমার কন্যার কাছে, এবং আমি আমার কন্যাকে দিব আপনার ছেলের হাতে। এই নিয়মটা ভগিনী হলেও চলবে। এই ভাবে উভয়পক্ষ সান্ত্বনা পায় যে উভয়ের ‘সম্মান’ রক্ষা হলো। আমাদের সমাজে যখন কারও অর্থের প্রয়োজন পড়ে কিংবা নতুন স্ত্রীর প্রয়োজন হয় তখন মেয়েদের এই ভাবে পণ হিসাবে ব্যবহার করে। কিছু সৌদি মহিলা অর্থোপার্জন করে। কিন্তু তারা যা ই আয় করে তার সবটাই চলে যায় তাদের পিতার অথবা স্বামীর পকেটে। অনেক মহিলার পিতা এতোই পাষাণ হৃদয়ের যে, তাঁদের কন্যার আয় স্বামীর কাছে চলে যাক তা তারা চান না —তাই সেই সব পিতারা চান না যে তাঁদের কন্যারা কখনো বিয়ে করুক। আমার মনে হয় এটাও হয়ত একটা কারণ হতে পারে—কেন আমার পিতা একপ্রকার বিবাহ নিষেধাজ্ঞাই জারী করেছেন আমার বোনদের বিয়ের উপর।

তাহলে এই সমাজে আমার বোনেরা কেমন করে বেঁচে আছে?

দেখুন, এই সৌদি সমাজে আমার ভগিনীরা একেবারেই অসহায় এবং সীমাহীন ভাবে নিপীড়িত। নিজেদের জীবন নিজের হাতে নিয়ে চালাবার কোন অধিকার তাদের নেই। ওরা সম্পূর্ণভাবে আমার পিতা, আমার ও অন্যান্য ভাইদের উপর সর্বদা নির্ভরশীল। ওরা কোনভাবেই একা বাইরে যেতে পারে না। অদের কেউ ঘরের বাইরে গেলে একজন পুরুষ, যেমন ভাই অথবা পিতাকে নিয়ে যেতে হবে—তার দেহরক্ষী অথবা সহায় হিসেবে। এমন কি দুর্ঘটনা, হাসপাতাল অথবা অন্য কোন জরুরী অবস্থাতেও ওদের কেউ ঘরের বাইরে পা ফেলতে পারবে না। বিশ্বাস করুন ওদের কারও হাসপাতাল যাবার প্রয়োজন হলে আমার ভাইকে ডাকতে হবে। আমার ভাই থাকে শহরের বাইরে। তাকে অন্য শহর থেকে আসতে হবে ৩০০ কিঃ মিঃ গাড়ী চালিয়ে। সৌদি আরবে মেয়েদের গাড়ি চালানো নিষেধ; আমার বোনেদের গাড়ী চালানোর অধিকার নেই, আর অন্যদিকে আমার পিতাও গাড়ী চালানো কখনো শিখেননি। এই সব কারণে আমার ভগিনীদের এই সীমাহীন দুর্দশার মাঝে কালাতিপাত করতে হয়। যতই জরুরী বা গুরুত্বপূর্ণ হউক না কেন, ওদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য ওদেরকে ওদের মাহ্‌রামের (আমি, আমার ভাই অথবা পিতা) জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া ওদের কোন পথ নাই। এদিকে আমার পিতা কেমন করে ব্যাংকের কার্ড (এ টি এম) ব্যবহার করে টাকা তুলতে হয় তা জানেন না। তাই আমার কোন ভগিনী টাকা ঊঠাতে চাইলে তার কার্ড কোন অজ্ঞাত লোকের হাতে তুলে দিতে হবে। নিত্যনৈমিত্তিক জিনিষ কিনতে চাইলে টাকা কোন অজানা পুরুষের হাতে দিতে হবে। সেই লোক তখন যা খুশী তাই দাম বলবে। এই ভাবে সৌদি মেয়েদের দৈনিক অসীম দুর্দশাপূর্ণ অবস্থার মাঝে জীবন কাটাতে হয়। আমি এখানে মাত্র কয়েকটি উদাহরণ দিলাম। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি আমার নিজের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ওদের সাহায্য করি।

আপনারা হয়তো বলবেন: ওদেরকে সৌদি আরবের বাইরে কোথাও নিয়ে যাও। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়। সৌদি মেয়েদের পাসপোর্ট পেতে হলে ওদের আইনী অভিভাবকের লিখিত অনুমতির প্রয়োজন। শুধু পাসপোর্ট পেলেই হবে না; বিদেশে একা যাবার জন্য মেয়েদের তাদের পিতা অথবা তাদের স্বামীর স্বাক্ষরিত বিশেষ কাগজপত্র জোগাড় করতে হবে। আমি নিশ্চিত যে একজন নিরক্ষর হিসেবে আমার পিতা কস্মিকালেও আমার বোনদেরকে বিদেশে পাড়ি দেবার অনুমতি দেবেন।

মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি কেন আমাদের সমাজের নারীদেরকে এই সীমাহীন উৎপীড়ন সইতে হচ্ছে। আমার বোনেরা তাদের পিতা অথবা ভাইএর অনুমতি ব্যতিরেকে কিছুই করতে পারে না। ওরা সর্বদায় ঘরের ভিতরে আছে, টেলিভিশন দেখছে। ওদের জন্য না আছে কোন খেলাধুলা, না আছে কোন কাজ, না আছে কোন বেঁচে থাকার লক্ষ্য। সত্যি বলতে কি ওরা বিশ্বের বৃহত্তম জেলে বন্দী আছে—সেই জেলখানা হচ্ছে গোটা সৌদি আরব; আর এই দেশ হচ্ছে খাঁটি, সত্যিকার ইসলামের দেশ।

সুসঙ্গত কারনেই হয়ত অনেকে জানতে চাইবেন সৌদি নারীদের এই অবর্ণনীয় দুর্দশার হেতু কি; কিসের জন্যে এখানকার নারীরা অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে যাচ্ছে? অতি সহজেই আমরা নির্বোধ, যুক্তিহীন, অশিক্ষিত ও সেকেলে সৌদি নিয়ম কানুন কে দোষী সাব্যাস্ত করতে পারি। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারি যে এই সব কিছুরই উৎস হচ্ছে ইসলাম। পরিষ্কারভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এসবের জন্য একমাত্র ইসলাম দায়ী। ইসলামী আইন কানুন আমাদের নারীদেরকে পরিনত করেছে পুরুষদের সম্পত্তিতে। তাদেরকে দাসিত্বে ফেলে দিয়েছে এবং নারী হিসেবে তাদের যে মান, সম্ভ্রম, মর্যাদা ও শ্রদ্ধা আছে তাও হরন করে নিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি ইসলাম আমাদের নারীদের নারীত্বের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করে তা ধুলিসাৎ করে দিয়েছে।

ইসলাম একজন পিতাকে তার কন্যার উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়েছে। পিতা কন্যাকে সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। কন্যকে যেমনভাবে বিবাহ করানো, তাকে সামাজিক জীবন থেকে সরিয়ে রাখা, এমনকি তাকে মেরে ফেলারও সম্পূর্ণ আধিকার পিতার রয়েছে। আপানারা হয়তো এই জেনে আশ্চর্য হবেন যে এক সৌদি পিতা যখন খুশি তার কন্যাকে মেরে ফেলতে পারে আইনের তোয়াক্কা না করে। অনুগ্রহপূর্বক জেনে নিন যে এক সৌদি পিতা তার কন্যাকে মেরে ফেললেও সে পিতা কক্ষনই মৃত্যুদণ্ড পাবে না। এর কারণ হচ্ছে, কন্যা পিতার সম্পত্তি, সে ঐ সম্পত্তি যেভাবে খুশী নিষ্পত্তি করে দিতে পারে—এমন কি মেরে ফেলেও। সৌদি আরবে শরিয়া আইন অনুযায়ী কোন পিতা তার কোন সন্তানকে খুন করলে, সরকারের কোন ক্ষমতা নাই ওই পিতাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা।

ইসলামী আইন অনুযায়ী পিতার অনুমতি ছাড়া কন্যা বিবাহ করতে পারে না। করলে তা হবে হারাম। সংক্ষিপ্ত ভাবে বলা যায় যে ইসলামে পিতা হচ্ছেন একজন পবিত্র, সাধু পুরুষ—একজন সেনাপতি ও এক বদমেজাজী একনায়ক। এমনকি পিতা অশিক্ষিত, নিরক্ষর, মূঢ়, অনৈতিক, অন্যায়কারী ও সন্তানদের প্রতি অবহেলাপূর্ণ হলেও তার সন্তানদের, বিশেষতঃ কন্যাদের, সেই পিতার বিরুদ্ধে করার কিছুই নাই।
আমি এখন কি করতে পারি?

এই প্রশ্নের সোজা উত্তর হবে আমার করার কিছুই নাই। এই অবস্থার পরিবর্তন করার কোন ক্ষমতাই আমার নাই। আমি যদি আমার পিতার বিরুদ্ধে মামলা করি তবে ইসলামী বিচারক আমার পিতাকে হয়তো প্রশ্ন করবে: আপনি আপনার কন্যাদের বিবাহের ব্যবস্থা করেন না কেন? এর উত্তরে আমার পিতা হয়তো উদাসীন ভাবে বলবেন: আমার এই মেয়েগুলো আমার আধীনে আছে; এর আমার সম্পত্তি। এদের জন্যে আমি যদি সুপাত্র না জোগাড় করি তবে আল্লাহ্‌ আমাকে শাস্তি দিবেন। এর প্রমান হিসাবে আমার পিতা হয়তো দেখাবেন যেই সব পাত্র তিনি দেখেছেন তাদের সবাই ধুমপায়ী। উনি হয়তো সাক্ষী নিয়ে দেখাবেন ঐসব পাত্ররা মসজিদে অনামাযী। এর বিরুদ্ধে ইসলামি বিচারককে নিশ্চুপ থাকতে হবে। বিচারক কোন ক্রমেই আমার পিতাকে সাজা দিতে পারবে না। বরঞ্চ বিচারক আমাকেই সাজা দিবেন, কেননা আমি আমার পিতার সিদ্ধান্ত মানি নাই, এবং আমার পিতাকে সম্মান করি নাই।

এখন এইরূপ যন্ত্রনা ও হতাশার মাঝে থেকে আমি ধৈর্য ধরে আমার পিতার মৃত্যুর অপেক্ষা করছি। উনি মারা যাবার পর আমার ভগিনীদের দায়দায়িত্ব আমারই হাতে আসবে। সরকারীভাবে তাদের মালিকানা আমার হাতে ন্যাস্ত হবে। আমরা যেমনভাবে গাড়ি, বাড়ি, ছাগল, ঊট…ইত্যাদির মালিক হই, সেভাবেই আমিও আমার ভগিনীদের মালিক হব। তারপর আমার ইচ্ছামত আমি তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হব। আমি ইচ্ছা করলে তাদেরকে স্বর্গে পাঠাতে পারি অথবা নরকেও।

পাঠকবৃন্দ, অনুগ্রহপূর্বক আমার ভগিনীদের জন্য কোন দুঃখ প্রকাশ করবেন না, এবং তাদের প্রতি করুনাও করবেন না। আপনারা জেনে একটু তৃপ্তি পাবেন যে তুলনামূলক ভাবে আমার ভগিনীরা অনেক সৌভাগ্যবতী। কেননা ওরা বছরে একবার অথবা দুই বার শপিং কমপ্লেক্সে বেড়াতে যেতে পারে। ওরা সৌন্দর্যচর্চার জন্য মেক আপ ব্যবহার করতে পারে। এমনকি চুপি চুপি সঙ্গীতও শুনতে পারে। তাদের সবচাইতে বড় স্বাধীনতা হচ্ছে তারা টেলিভিশনের চ্যানেল পরিবর্তন করতে পারে। কেননা বহু সৌদি নারীদের এই অধিকারটুকুও নাই। আপনাদের কাছে এটা বিস্ময়কর মনে হতে পারে – কিন্তু সৌদি আরবে এটাই সত্য।

খালেদ ওলীদ
জানুয়ারী ২৭, ২০০৬