সীমান্তের কোনো বাধাই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। পিঠে একটি চটের ব্যাগ, কাধে ক্যামেরা, চোখে-মুখে অসীম সাহস নিয়ে আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে টগবগে এক যুবক পায়ে হেটে বেরিয়েছিলো বিশ্বটাকে জয় করবার জন্য। পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে ইরান তারপর দীর্ঘ ৭ বছরে একের পর এক ২২টি দেশ ও ২১ হাজার মাইল পথ পায়ে হেটে সফর করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ববাসিকে। বিশ্বজয় করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু আজকে বয়সের ভার ও জীবন যুদ্ধে সে পরাজিত। বাঙ্গালী পরিচয়ে সেই মানুষটি বিশ্ব দরবারে বাঙ্গালী জাতির মাথা উঁচু করেছিলেন আজ সে মানুষটির কেউ আর খোঁজ রাখছে না।
প্যারালাইসিসসহ দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত এ বিশাল মানুষটি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার এক নিভৃত পল্লী পর্ণকুটিরে বসবাস করছে। পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও ভ্রমণ কাহিনীর পান্ডুলিপিগুলি বুকে আগলে নিয়ে তিনি আজও বেঁচে আছেন। কাউকে কাছে পেলে অকপটে বলে ফেলেন “আমার ভ্রমণ কাহিনীর পান্ডুলিপি কি কোন দিন বই আকারে প্রকাশিত হবে না? তাহলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কিভাবে উদ্বুদ্ধ হবে, বিশ্বটাকে জয় করবার জন্য?”। অনেক রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী আমলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাকে। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। মিথ্যা আশ্বাসে প্রতারিত এই মানুষটির কাছে গেলে তাই অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার নাম ওসমান গণি।
গণি জানান, তিনি যখন স্কুলের ছাত্র, তখন সাইকেলে ভ্রমণকারী দুইজন পর্যটকের সাথে তার দেখা হয়। তাদের কাছে ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনে তিনি শিহরিত হন, সংকল্প আটেন তাদের মতই সেও একদিন বেরিয়ে পড়বে বিশ্বটাকে ঘুরে দেখবার জন্য। কিন্তু যাবে কি করে! পশ্চাদপদ উত্তরাঞ্চলের বিত্তহীন গনি শুধু সাহস, স্বপ্ন আর মনোবল নিয়ে একদিন ঠিকই ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েন।
সেদিন ছিল ১৯৬৪ সালের ২৭ এপ্রিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পায়ে হেটে চষে বেড়ানোর পর পশ্চিম পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, জর্দান, মিশর, কলম্বো, বার্মা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ ভিয়েতনাম, হংকং, ফরমোজা, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, আফগানিস্তান ও ভারতসহ ২২টি দেশ পায়ে হেটেই তিনি সফর করেন। এভাবে তিনি টানা ৭ বছর ধরে পায়ে হেটে ২১ হাজার মাইল পথ পরিভ্রমণ করেন।
এ পরিভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। ইরাক থেকে ইরান যাওয়ার পথে মরু ডাকাতরা তার সর্বস্ব কেড়ে নেয়। তারপরও থেমে থাকেননি তিনি। ফিলিপাইনের দক্ষিনাঞ্চল ফুলুদ্বীপ থেকে চোরাচালানিদের মোটর বোড যোগে কয়েকশত কিলো সমুদ্রপথ অতিক্রমের সময় ঝড়ে সেই মোটরবোটটি তছনছ হয়ে যায়। এরপর স্বাধীনতাকামী মোরো জঙ্গীরা তাকে ধরে নিয়ে যায় ইন্দোনেশিয়ার উপকুলিয় দ্বীপ মেনভোতে। সেখান থেকে পালিয়ে আবারও পথ চলা শুরু হয় গনির। পায়ে হেটে ২২টি দেশ সফর কালে পর্যটক ওসমান গনি ঐ সকল দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ পান। রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে নৈশভোজের সুখময় স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে গনির চোখে-মুখে যেন আজও আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ে।
এ সফর কালে ঐ সমস্ত দেশের সংবাদপত্রে গনি বীরত্বপূর্ণ পরিভ্রমণের খবর ছবিসহ ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ঐ সমস্ত পত্রিকার ক্লিপিং রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে নৈশভোজের ছবি গনি আজও স্বযত্নে ফাইলে লেমেনেটিং করে রেখেছেন।
বিশিষ্ট ক্রীড়াবীদ এই পর্যটক ওসমান গণি জানান, তার এই শেষ জীবনে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি ভ্রমণ কাহিনী রচনা করেছেন। তিনি বিগত ২০ এপ্রিল ২০০৩ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার লেখা পান্ডুলিপিটি দেখান। এটি বই আকারে প্রকাশের জন্য অনুরোধ জানালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বইটি প্রকাশের জন্য ষাট হাজার টাকা বরাদ্দ করেন। সেই মতে একজন মন্ত্রীকে বইটি প্রকাশের দায়িত্ব অর্পণ করেন বলেও গনি জানান। অসুস্থ্য শরীর নিয়ে বেশ কয়েকবার ঐ মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। কিন্তু ঐ পর্যন্তই।
গনি আরও জানান, ১৯৬৫ সালে ইরান সফর কালে সীমান্ত শহর শাহরুদ এর একটি সরাইখানায় অবস্থান কালে তার সঞ্চিত সমুদয় অর্থ চুরি হয়ে যায়। তার এ দূর্দশার খবর পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরে পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক সমন্বয়ে গঠিত আঞ্চলিত উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে গনিকে ৩ হাজার মার্কিন ডলারের একটি চেক প্রদান করেন। তিনি এটি ভাঙ্গিয়ে পুরো ডলারই তেহরানস্থ তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত জনাব এস,এম হোসেনের কাছে জমা রাখেন এবং তুরস্ক সফরে চলে যান। স্বাধীনতার পর ১৯৮৬ সালে ৩ হাজার ডলার ফেরৎ চেয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে গনি চিঠি দিলে তিনি তাকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু বিমান দূর্ঘটনায় জিয়াউল হকের মৃত্যু হলে তার টাকা প্রাপ্তির বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। বারংবার যোগাযোগের পর গনি অবশ্য ঐ টাকার সমূদয় না পেলেও নেওয়াজ শরিফ গনির নামে ৮০ হাজার রুপির একটি চেক দিয়েছিলেন। অবশিষ্ট টাকা প্রাপ্তির জন্য তিনি বহুবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেও কোন সুফল পাননি।
পায়ে হেটে পৃথিবীর ২২টি দেশ ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও সাহসীকতা দেখিয়ে বাঙ্গালী জাতির জন্য গৌরব অর্জনকারী পরিব্রাজক ওসমান গনির বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলায়। কড়ালগ্রাসী ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনে সহায় সম্পত্তি ও বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়েই দীর্ঘদিন থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন উলিপুর উপজেলার তবকপুর গ্রামে শ্বশুড় বাড়ীতে।
সুদুর অতীতের সুখময় স্মৃতি আর বিদেশী পরিচিতজনদের কাছ থেকে পাওয়া চিঠিগুলো বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়া গনির এখনো মনবল যোগায়। দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমায় যে মানুষটি কখনো ক্লান্ত হয়ে পড়েনি, রাষ্ট্র প্রধান, মন্ত্রী, আমলা ও নেতাদের প্রতিশ্রুতি আদায়ে সেই মানুষটি ঘুরতে ফিরতে ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্থ ও শয্যাশায়ী।
প্রায় ৮০ বছর বয়সের ভার নিয়ে ওছমান গনির আর বিশেষ কিছু চাওয়া পাওয়া নেই। তার শেষ জীবনের একটাই দাবী, ভ্রমণের পান্ডুলিপিটি বই আকারে প্রকাশিত হোক। আর সেই বই পড়ে আগামী প্রজন্ম আবারও বেড়িয়ে পড়ুক গোটা বিশ্বকে জয় করবার জন্য।
আমাদের গৌরব সম্মানিত পরিব্রাজক জনাব গণী বর্তমানে বেঁচে আছেন কি???
উনার বই প্রকাশ হয়েছে কি???
দয়া করে জানাবেন।
এই লেখাটির জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।
পরিমল,
কালকে আমার প্রকাশকের সাথে কথা হল । আপনার কাছ থেকে ইমেইল পেলে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত জানাতে পারতাম। মূল পান্ডুলিপিটা দেখা দরকার।
আর মুক্তমনায় লেখাটাকে ইবুক আকারে রাখার কোন প্ল্যান করা যায় কিনা সেটাও দয়া করে জানাবেন।
@ মাহবুব সাঈদ মামুন,
পেয়েছিলামতো মেইলটা। ফেইসবুকে খুব একটা পা রাখি না আমি। ওখানে কেউ আমাকে মেসেজ দিলে আমার ই-মেইল এড্রেস এ চলে আসে। তখনই শুধুমাত্র যাওয়া হয় মেসেজ চেক করতে বা উত্তর দিতে। আপনার মেসেজের উত্তরও দিয়েছিলাম মনে হয়। পাননি নাকি?
ভাল আছি মামুন ভাই, চলে যাচ্ছে দিন।
মুক্তমনার আদর্শ এবং মানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলে শুরুতেই মুক্তমনায় ই-বুক হিসাবে প্রকাশ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দুটো সুবিধা পাওয়া যাবে। প্রথমতঃ গ্রন্থ আকারে প্রকাশের আগেই পাঠকের মতামত এবং সুপারিশ জানা যাবে। ফলে, কোন পরিবর্তন বা বা পরিবর্ধনের প্রয়োজন হলে লেখক তা করতে পারবেন। দ্বিতীয়তঃ গ্রন্থটির প্রতি পাঠক আগ্রহ দেখা দিলে প্রকাশকের আগ্রহও তখন বৃদ্ধি পাবে।
মামুন, পরিমল এবং অন্য সবার উদ্দেশ্যেই বলি – লগইন না করে কেউ মন্তব্য করলে সেটা পেন্ডিং এ পড়ে থাকে। মডারেটর এপ্রুভ করার পরই তা কেবল প্রকাশিত হয়। লগ ইন করে মন্তব্য করলে এই ঝামেলা এড়ানো যায়। তাই আমরা সবাইকে উৎসাহিত করি মন্তব্য করার আগে দেখে নিন আপনি লগইন অবস্থায় আছেন কিনা। এটা মডারেটরদের পক্ষ থেকে কিন্তু বার বারই বলা হচ্ছে।
পরিমলকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি ওসমান গণিকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। উনার লেখা সম্বন্ধে আরেকটু ভালভাবে পরিচিত হতে পারলে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া কষ্টকর কিছু হবে না বোধ হয়। আমি আজকেই আমার প্রকাশকদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে দেখব। আপনি এর মধ্যে আমার ইমেইলে উনার লেখা সম্বন্ধে (এবং পান্ডুলিপি সম্বন্ধে) আরেকটু বিস্তারিত ভাবে জানালে বাধিত হব। আমার ইমেইল – [email protected] (চার্বাক আন্ডারস্কোর বিডি @ ইয়াহু ডট কম)
@অভিজিৎ,
ধন্যবাদ থাকলো :evilgrin:
আমিও রাজী আছি।
আমার ও মনে হয় এই ব্যাপারে মুক্তমনা উদ্যোগ নিতে পারে। আমিও অর্থ দানে রাজী আছি।
Dear Friends,
How are you all?
It is a shame that Mr. Osman Gani’s book is not published yet. It is truly a shame.
If Mukto Mona helps Mr. Gani to publish this book, I will contribute $200.
I will send $200 to Mr. Avijit, if MM helps.
Thank you
Adnan L.
[email protected]
পরিমল মজুমদারের ২ লেখায় ২টি কমেন্টস করেছিলাম , কিন্তু লেখা ২টি কোথাও নাই।বুঝলাম না।
@মাহবুব সাঈদ মামুন,
মামুন ভাই,
আপনার কমেন্ট দুটোই পেন্ডিং এ পড়ে ছিল, মডারেশন এর অপেক্ষায়। কমেন্ট করার আগে লগ ইন করে নেবেন। তাহলে আর এই সমস্যা হবে না।
@ফরিদ আহমেদ,
অনেক ধন্যবাদ রলো।ফেস বুকে আপনাকে দেওয়া আমার মেইলটি কি পেয়েছিলেন ? আশা করি সব কিছু নিয়ে ভালো আছেন।
মামুন।
@মাহবুব সাঈদ মামুন,
আমিও অভিজিত সাহেবের লেখায় একটা মন্তব্য ও কয়েকটি প্রশ্নের জবাব চেয়েছিলাম। কয়েক ঘন্টা পর দেখি সে মন্তব্যটা নেই।
তবে আমি আপনার মন্তব্য মুছি নাই। সত্যি বলতে কি, এই ব্লগে মোছার তরিকাও আমি জানিনা।
আপনি মন্তব্যটা আবার করুন।
অসংখ্য ধণ্যবাদ আমাদের এই সাইলেন্ট হিরো গণি সাহেবের সাথে পরিচয় করানোর জন্য।
কি দূঃখের কথা, তার কথা তেমন কেউই জানে না। তার ব্যাতিক্রমধর্মী ভ্রমন কাহিনী প্রকাশিত হলে যে কি অমূল্য এক জিনিস হতে ভাবলেই শিহরিত হচ্ছি। ভ্রমন কাহিনী অনেকেরই আছে, কিন্তু এ যুগে পায়ে হেটে বিশ্ব ভ্রমন আর কয়টা পাওয়া যাবে? তাও আমাদেরই বংগ সন্তান।
উনি অত রথি মহারথিদের সাথে দৌড়াদৌড়ি না করে প্রকাশকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেছেন কিনা জানি না। সেবার কাজী আনোয়ার সাহেবের কথা এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে।
আরো খারাপ লাগল এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতার অধিকারী ভদ্রলোকের বর্তমান অবস্থা শুনে।
এ দুঃখ রাখি কই।এ জাতির কপালে অনেক অনেক কষ্ট লাঞ্ছনা আছে।কারন এখানে আইন নাই, কানুন নাই আছে শুধু খুনাখুনি ও রাহাজানি,আলো নাই,
আছে শুধু অন্ধকার,মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও সহমর্মিতা নাই,আছে শুধু হিংসা ও দ্বেষ। এখানকার রাজনীতি, অর্থনীতি,সংস্কৃতি শুধু নষ্ট-ভষ্ট,পছা পূঁজ আর গোবরে ভরা।রাজনীতিবিদ,অর্থনীতিবিদ,শিক্ষাবিদ,আমলা-পুলিশ সব যতসব ১০ মন ওজনের মোটা মাথা ভারী মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারনার লো্ক।তাই এখানে জ্ঞানের কদর নাই,না আছে গূনের।
ওসমান গনিরা অনেক অনেক কাল মানুষের মাঝে বেঁচে থাকে আর নষ্ট-ভষ্ট রাজনীতিবিদরা ইতিহাসের আস্হাকূঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।
@আদিল মাহমুদ,
তার অর্থনৈতিক দৈন্যতা আর বেশভূষা দেখে প্রকাশকরা আগ্রহ প্রকাশ করেননি। কেউ আগ্রহ দেখালও পরবর্তীতে তারা আর রাজী হননি।