দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন আলাপ আলোচনা ও বিতর্কে আমরা যুক্তি, বিশ্বাস, অভিমত ও অনুভূতির উদাহরণ দেখতে পাই। কিন্তু দেখা যায় অনেকেই এগুলোকে গুলিয়ে ফেলেন ও ব্যক্তিগত মত বা বিশ্বাসকে যুক্তি বলে ভাবেন বা চালাতে চেষ্টা করেন। আবার অনেকে অনুভূতিকে যুক্তির পরিপন্থী বলে মনে করেন। কিন্তু এর কোনটাই ঠিক নয়। এই ধারণগুলি নিয়েই একটু সতর্কতা ও যত্ন সহকারে আলোচনা করে কিছু বিভ্রান্তির অবসান করতে সচেষ্ট হব এই লেখায়। যখন কেউ তার মত বা সিদ্ধান্তকে সঠিক আর অন্যের মত বা সিদ্ধান্তকে ভুল বলে দাবী করে তখনই যুক্তি তর্কের প্রয়োজন বা প্রশ্ন ওঠে। কারণ যখন পরস্পর বিরোধী দাবী করা হয় তখন কোনটি সত্য তা নির্ধারন করার জন্য চিন্তা বা মননের সর্বসম্মত এক পদ্ধতি যার দ্বারা বাক্যের সত্যতা বা মিথ্যাত্ব নির্ভুল্ভাবে নির্ণয় করা যায় তার প্রয়োজন দেখা দেয়। আর সেটা হল যুক্তির সার্বজনীন নিয়মাবলী। এর বিশদ আলোচনা এখানে করার সুযোগ না থাকায় পাঠকদের “যুক্তিবিদ্যা পরিচিতি” নামে মুক্তমনায় প্রকাশিত আমার লেখাটা পড়তে অনুরোধ করছি। প্রথমেই যেটা খেয়াল করা দরকার সেটা হল কোন বাক্যে যদি অস্পষ্ট বা অসংজ্ঞায়িত কোন ধারণার অবতারণ করা না হয় আর তা যদি সুস্পষ্টভাবে হয় সত্য না হয় মিথ্যা হয় তাহলে তাকে যুক্তির পরিভাষায় বচন (Proposition) বলে। অনেক বিশ্বাস বাক্যে কিছু অস্পষ্ট বা অসংজ্ঞায়িত ধারণা বা শব্দের অবতারণা করায় বাক্যটির বস্তুনির্ভর কোন অর্থ হয় না যার দরূণ সেই সব বিশ্বাসবাক্যের পরম সত্য বা মিথ্যা গুণ থাকতে পারেনা। তাই সেই সব বাক্য বচন হিসেবেও গণ্য করা যাবে না। এই ধরণের বাক্যকে অনবধারণযোগ্য বাক্য বা ধারণা (Non-Cognitive) বলা হয়। এর উদাহরন হলঃ (১) ইশ্বর আছেন। (২) আত্মা আছে। এই দুটো বাক্য যতই আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক এবং অর্থবহ মনে হোক না কেন কিন্তু এটা যুক্তির কঠোর বিচারে ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ মাত্র। এর কোন বস্তুনির্ভর অর্থ নেই “ইশ্বর” ও “আত্মা” শব্দ দুটির কারণে। এর কোনটিই সুসংজ্ঞায়িত নয়। এ দুটো শব্দের জনপ্রিয় বা বহুল প্রচলিত “সংজ্ঞা”র সবগুলি যুক্তির চূড়ান্ত বিচারে ভ্রান্তিপূর্ণ এবং স্ববিরোধপূর্ণ। বিদগ্ধ দার্শনিক মহলে (যারা যুক্তিশাস্ত্রে পারদর্শী) এই ভ্রান্তির কথাটা সুপরিচিত ও সুস্বীকৃত। এ দুটো বাক্যকে সত্য বলাটা ভুল ত বটেই অসত্য বলাটাও যুক্তির বিচারে ভুল, কারণ এই বাক্যদ্বয়ের বস্তুগত সত্যতা বা অসত্যতা কোনটাই নেই বা অর্থবহ নয়। অবশ্য ইশ্বরের এমন সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব যা সুস্পষ্ট, সে ক্ষেত্রে ইশ্বর আছে বলাটা যুক্তি বিরুদ্ধ হবেনা, যদিও সে ইশ্বর আছে কিনা সেটা হয় হয়ত জানা সম্ভব হবেনা। বলাই বাহুল্য এই ধরণের সংজ্ঞা বহুল প্রচলিত বা জনপ্রিয় নয়। এর উদাহরণ এভাবে দেয়া যায়ঃ বিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম অভিজ্ঞানের দরূণ এটা এখন বলা যায় যে মহাবিশ্ব ও প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের অভিব্যক্তির পরিণামে। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের উৎপত্তির কোন আদি কারণ কি আছে নাকি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম আসলে সদা বিরাজমান, স্বয়ম্ভূ এর কোন আদি কারণ নেই, এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই এবং কখনও জানা যাবে না। লক্ষ্য করার বিষয় যে এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট সত্যতা মিথ্যাত্ব আছে, যদিও আসলে কোনটা তা আমাদের জানা নেই। দুটো সম্ভাবনার কোনটাই যুক্তবিরুদ্ধ নয়। তাই যদি ইশ্বরের সংজ্ঞা হিসেবে কেউ বলেন সে ইশ্বর হল পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের আদি কারণ এবং বলেন যে সেই আদি কারণ আসলেই আছে তাহলে তা এক অবধারণযোগ্য বচনবাক্য হিসেবে গণ্য হবে ও গ্রহণযোগ্য হবে। আবার এটাও বলা যায় যে একই সংজ্ঞায় ইশ্বর নেই সেটা বলাটাও গ্রহণযোগ্য হবে। এখানে প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে বলি কি কারণে “ইশ্বর আছেন” এই বাক্যটি অধিকাংশের কাছে স্বাভাবিক ও অর্থবহ মনে হয়। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের উৎপত্তির কোন আদি কারণ আছে কি মেই বা থাকলে সেটা কি তা মানুষের জানা নেই। সাধারণ মানুষের কাছে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের দ্বারা মহাবিশ্ব ও প্রাণের সৃষ্টির সূক্ষ্ণ ও জটিল তথ্য জানা বা বোঝা সম্ভব নয় তাই তাদের দৃষ্টিতে মহাবিশ্ব ও প্রাণের সৃষ্টিটাই রহস্য । যেহেতু দৈনন্দিন জীবনের অনেক উপকরণই মানুষের সৃষ্টি সেহেতু প্রকৃতির সবকিছু ই কাহার বা কোন কিছুর দ্বারা সৃষ্ট এই বিশ্বাস সহজাত ভাবে তাদের মনে আসে। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের উৎপত্তি বা সৃষ্টিই যে আসল রহস্য সেটা তাদের পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের উৎপত্তি অজানা থাকায় সৃষ্টির মূল কারণটাই অজানা। এই অজানা সব মানুষের মধ্যে এক বিশেয অনুভূতির সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষের কাছে অজানাটা হল মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ আর বিজ্ঞান সচেতন মানুষের কাছে অজানাটা হল মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণের কারণ (অর্থাৎ পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রের সৃষ্টির কারণ) । যাহোক এই পরম অজানাটা যে বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি করে তাকেই মানুষ নানা ভাষায় নানাভাবে ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছে। এই অনুভূতিই মরমীয়াবাদের (Mysticism) জন্মদাতা। মরমীয়াবাদ আসলে কোন মতবাদ নয়। এই অজানার অনুভূতির এক প্রকাশ মাত্র। মরমীয়ারা(Mystics) এমন কোন গভীর সত্য বা তথ্য সম্পর্কে অবগত নন যা বিজ্ঞানীরা জানেন না। অজানার অনুভূতিকে তাঁরা কাব্যিক ভাষায় ব্যক্ত করে এবং সেই সঙ্গে তাঁদের নিরাসক্ত জীবন যাপনের দ্বারা সম্মান অর্জন করে সাধারণ্যের কাছে এক আবেপূর্ণ ভক্তির সৃষ্টি করেন। আইনসটাইনও এই অজানার অনুভূতির কথা স্বীকার করেছিলেন। সব বৈজ্ঞানিকেরাই এই অজানার কথা বলেন বা অনুভব করেন। আসলে দার্শনিক সংজ্ঞায় নাস্তিক তাকেই বলা যায় যিনি দাবী করেন যে পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম স্বয়ম্ভূ, এর কোন আদি কারণ নেই, কাজেই তাদের কাছে কোন অজানা নেই আর সেহেতু অজানার কোন অনুভূতিও নেই। এরকম নাস্তিকের সঙ্খ্যা অবশ্য খুবি কম। এখানে এটা জোর দিয়ে বলা দরকার যে যারা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের উৎপত্তি অজানা বলে স্বীকার করেন তাদের অনেকেও পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম স্বয়ম্ভূ, এর কোন আদি কারণ নেই এই সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেন না। কিন্তু আদি কারণ থাকতে পারে এই সম্ভাবনাকেও নাকচ করেন না। এদেরকে দার্শনিক অজ্ঞেয়বাদী বলা যায়। আবার অনেকে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের উৎপত্তির আদি কারণ অজানা বলে স্বীকার করলেও আদি কারণ যে আছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত। এরা দার্শনিক অর্থে আস্তিক হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হবেন। তবে এই দার্শনিক আস্তিক, নাস্তিক আর অজ্ঞেয়বাদীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ধর্মের আস্তিক, নাস্তিক আর অজ্ঞেওবাদীদের কোন মিল নেই। আনুষ্ঠানিক ধর্মের আস্তিক, নাস্তিক আর অজ্ঞেয়বাদীরা সবাই কম বেশী হেত্বাভাসের(Logical Fallacy) স্বীকার। কারণ ধর্মীয় বিশ্বাসবাক্যগুলি অবচনবাক্য। অবচনবাক্যজনিত মত বা বিশ্বাসের অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব বা অজানা হওয়া, এর কোনটারই যৌক্তিক ভিত্তি নেই।

এবার আসি অভিমতের প্রসঙ্গে। অনেক অভিমতই ব্যক্তিগত রুচি বা আদর্শের প্রতিফলন মাত্র, এর কোন পরম সত্যতা বা মিথ্যাত্ব থাকতে পারেনা। আর তাই সেটা বচন হতে পারে না। আর বচন নয় বলে সেইরকম অভিমতকে কেউ সত্য বলে দাবী করলে তা যুক্তির নিয়ম লঙ্নন করবে। একই কথা বলা যায় বিশ্বাসের বেলায়ও। এটা পরিস্কার করা দরকার যে অভিমত বা বিশ্বাস থাকলেই যে সেটা যুক্তির পরিপন্থী হতে হবে তা নয়। যদি বিশ্বাসের বস্তু স্পষ্ট ও বস্তুনির্ভরভাবে সংজ্ঞায়িত হয় ও বিশ্বাসবাক্যটি বচনবাক্য হয় তাহলে সেই বিশ্বাস যুক্তির পরিপন্থী হবে না, বিশ্বাসবাক্যটি আসলে সত্য না মিথ্যা সেটা অবশ্য অন্য ব্যাপার। এর উদাহরণ হল পৃথিবীর বাইরে মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা। প্রাণের ধারণা জীব বিজ্ঞানে সুসংজ্ঞায়িত। মহাজগতে প্রাণের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা যুক্তিবিরুদ্ধ নয়, যদিও বিশ্বাসের সত্যতা বা মিথ্যাত্ব এখনও অজানা। আরেকটা উদাহরণ হল পক্ষীরাজ ঘোড়া আছে এটা বিশ্বাস করা। পক্ষীরাজ ঘোড়ার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দেয়া যায়, ঘোড়ার মত দেখতে প্রাণী যার পাখা আছে ও উড়তে সক্ষম। যদি ঘোড়ার আকৃতির প্রাণীর পাখা দিয়ে উড়াটা পদার্থবিজ্ঞান (সঠিক ভাবে বলতে হলে বায়ুগতিবিজ্ঞানের) কোন নিয়ম লঙ্ঘন না করে তাহলে এই বিশ্বাস যুক্তির নিয়ম বিরুদ্ধ হবে না, কারণ এটা হয় সত্য নয় মিথ্যা অর্থাৎ বচন বাক্য। সেই বিশ্বাসই যুক্ত্বির নিয়মবিরুদ্ধ যে বিশ্বাসের বস্তু অস্পষ্ট বা যার সর্বগ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নেই বা যে বিশ্বাসবাক্যের কোন সুস্পষ্ট সত্য বা মিথ্যা মূল্য নেই(অর্থাৎ বচন নয়)। “এটা দেখতে খুব সুন্দর”, “এটে খেতে খুব মজা”, বা “এটা খুবই স্বাভাবিক/অস্বাভাভিক” ইত্যাদি বাক্যগুলি ব্যক্তিবিশেষের রুচি , মূল্যবোধ বা আদর্শের প্রতিফলক মাত্র এবং এটা প্রকাশ বা ঘোষণ করাটা যুক্তির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। যুক্তিবাদী মানুষেরও ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ বা মতাদর্শ থাকতে পারে। কিন্তু কেউ যদি তার এই ব্যক্তিগত বিচার বা মূল্য আরোপকেই একমাত্র সঠিক বা সার্বজনীন দাবী করে অন্য কোন বিচার বা মূল্য আরোপকে ভুল বলে ঘোষণা দিয়ে বসেন তাহলে তা যুক্তিবিরুদ্ধ হবে। যদি কোন বিশ্বাসের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত সত্যের বিরুদ্ধে যায় সেটাও যুক্ত্বিবিরুদ্ধ বিশ্বাস হবে। যেমন পৃথিবীটা সমতল বিশ্বাস করা বা দাবী করা। যুক্তিসঙ্গত বিশ্বাস ভবিষ্যতে ভুল প্রমাণিত হতেও পারে। ভুল প্রমাণিত হবার পরেও কেউ ঐ বিশ্বাসকে আকড়ে ধরে রাখে তখন সেটা যুক্ত্বিবিরুদ্ধ বিশ্বাস হবে। বৈজ্ঞানিক প্রকল্প যুক্তিসঙ্গত বিশ্বাসের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বৈজ্ঞানিক বচন আবশ্যিকভাবে সত্যারোপণযোগ্য বা মিথ্যারোপণযোগ্য (Verifiable or Falsifiable) হতে হবে। এটা ভুল বা সত্য প্রমাণিত হতে পারে ভবিষ্যৎ সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা। প্রকল্পটি ভুল প্রমাণিত হলে তা পরিত্যক্ত হয় আর সত্য প্রমাণিত হলে তা বৈজ্ঞানিক সূত্র বা তত্বে উন্নীত হয়। বিজ্ঞানীরা প্রকল্প প্রস্তাব করার সময় এই দুই সম্ভাবনার কথা মেনে নিয়েই তা করেন। বৈজ্ঞানিক মতবাদ তাই সবিচার মতবাদ। এর বিপরীতে ধর্মীয় বা অনেক রাজনৈতিক/সামাজিক মতবাদ শুধু পরম সত্য হবার দাবী নিয়েই নিজেদের প্রচার করে। ভুল হবার সম্ভাবনাকে নীতিগতভাবেই নাকচ করে দেয়া হয় এই ধরণের মতবাদে। এগুলিকে নির্বিচার মতবাদ (Dogma/Doctrine) বলা হয়। আসলে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক মতবাদ এর প্রকৃত সত্যতা বা মিথ্যাত্ব নেই। এগুলি ব্যক্তিনির্ভর মত, বিচার বা মূল্যারোপণের উদাহরণ মাত্র। <!–[if gte mso 9]> Normal 0 MicrosoftInternetExplorer4 <![endif]–>তবে নির্বিচার মতবাদ শুধু ব্যক্তিনির্ভর মত হিসেবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত থাকে না। যখন এই মতের দ্বারা অণুপ্রাণিত হয়ে একাধিক ব্যক্তি সংঘবদ্ধ হয়ে গোটা সমাজে এটা চাপিয়ে দিতে চায়ে তখনি এটাকে একটা নির্বিচার মতবাদ বলা যায়। নির্বিচার মতবাদ এর প্রচারকেরা এগুলিকে ব্যক্তিনির্ভর বলে স্বীকার না করে সার্বজনীন ও সবার জন্য প্রযোজ্য বলে দাবী করে এটাকে অনেক সময় বলপূর্বক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।

 

আগেই বলেছি কোন ব্যক্তিগত মত যদি বৈজ্ঞানিক সত্যকে বা যুক্তির নিয়মকে লঙ্ঘন না করে তাহলে সেই মত যুক্তিবিরুদ্ধ নয়। কিন্তু যুক্তিবিরুদ্ধ নয় মানে যৌক্তিক বা নির্ভুল নয়। আধুনিকোত্তরবাদীরা (Post Modernists) , ধর্মবাদীরা ও কিছু অধ্মাত্ব্যবাদীরা সুকৌশলে তাদের কোন কোন মতবাদকে নির্ভুল বলে দাবী করেন এই যুক্তি দেখিয়ে যে তাদের বিশ্বাস ত যুক্তিবিরুদ্ধ নয়। একটা সাধারণ ভ্রান্ত উক্তি (কখনো পরোক্ষ ভাবে) হল যেহেতু ভুল প্রমাণিত হয়নি অতয়েব তা নির্ভুল এই ধরনের উক্তি হল পূর্বোক্ত হেত্বাভাসের(Logical Fallacy) একটা উদাহরণ। এই বিশেষ উদাহরণের হেত্বাভাসকে অজ্ঞতার যুক্তি(Argument from Ignorance) বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা যাচাই না হওয়া পর্যন্ত যুক্তিবিরুদ্ধ নয় এমন যে কোন বিশ্বাস বা মতবাদ অপ্রমাণিত, ঝুলমান বা অনিশ্চিত হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হবে। এই অপ্রমাণিত, ঝুলমান বা অনিশ্চিত অবস্থার যথার্থ অবধান আমাদের সংস্কৃতিতে অবর্তমান। আমাদের সংস্কৃতিতে যুক্তি ও সাক্ষ্যের অভাব হলেও কোন উক্তি বা মতবাদকে হয় সঠিক বা ভ্রান্ত বলে তাৎক্ষণিক রায় দেয়া হয় । যারা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিখ্যাত শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের কথা জানেন ও বোঝেন তারা এই ঝুলমান বা অনিশ্চিত অবস্থার ব্যাপারটা হৃদঙ্গম করতে পারেন। বিড়ালটি হয় জীবিত নয় মৃত বটে, কিন্তু পর্যবেক্ষণের পূর্বে জীবিত বা মৃত কোনটাই বলা যাবে না। এখানে স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার যে ভুল/নির্ভুল বা সত্য মিথ্যা বচন বাক্যের বেলায় প্রযোজ্য। কিন্তু দৈনন্দিন বিতর্কে দেখা যায় যে বিতর্কের বিষয়বস্তু হল অবচনবাক্যকে নিয়ে। আগেই বলেছি যে অবচনবাক্যকে নিয়ে সত্য না মিথ্যা এই তর্ক অবান্তর। এই ক্ষেত্রে একজন সুতার্কিক বিতর্কের বিষয়বস্তুটা যে অবচনবাক্য এবং সেহেতু সত্য না মিথ্যা কোনটা বলা ঠিক নয়, অথবা অপরপক্ষ বাক্যটি সত্য বা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য যে যুক্তি দেখাচ্ছেন সেটা যে ভ্রান্ত তার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দেখা যায় যে একপক্ষ বাক্যটিকে সত্য আর অন্য পক্ষ উক্তিকে মিথ্যা প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টায় রত। আর যদি তর্কের বিষয়বস্তু বচনবাক্যই হয় তাহলেও উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের আগে তা সত্য না মিথ্যা তর্ক করাটা অবান্তর। এক্ষেত্রে অবশ্য তর্কে লিপ্ত না হয়ে সত্য বা মিথ্যার সপক্ষে উভয় পক্ষ নিজ নিজ সম্ভাব্য যুক্তি অভিমত হিসেবে পেশ করতে পারেন মাত্র। তবে হ্যা যদি কোন পক্ষের কাছে বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে অকাট্য (ও অবশ্যই বস্তুনির্ভর) যুক্তি বা সাক্ষ্য প্রমাণ থাকে তাহলে সেটা পেশ করে সত্য বা মিথ্যা চূড়ান্ত রায় আবশ্যই দিতে পারেন সেই পক্ষ।

 

আগাই উল্লেখ করেছি যে কোন ব্যক্তিগত মত বা বিশ্বাস যদি বৈজ্ঞানিক সত্যকে বা যুক্তির নিয়মকে লঙ্ঘন না করে তাহলে সেই মত বা যুক্তিবিরুদ্ধ নয়। আর তাই এধরণের বিশ্বাস একজন নিষ্ঠাবান বৈজ্ঞানিকের পক্ষেও ধারণ করা সম্ভব । এর বাস্তব উদাহরণ অনেক আছে। অনেক বৈজ্ঞানিকেরা দার্শনিক আস্তিক। এটা খুব ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। নোবেল পদার্থবিজ্ঞানী পাউলি কার্ল জাং এর ঘটনা পরম্পরার মধ্যে এক মহাজাগতিক যোগসূত্রের তত্বে (Synchronicity) বিশ্বাস করতেন । অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী অশরীরি প্রপঞ্চে (Psi or Paranormal Phenomena) বিশ্বাসী। মন দ্বারা জড় কে প্রভাবিত করা সম্ভব (Mind over Matter) এটাই এই বিশ্বাসের মূল বিষয়। নোবেল পদার্থবিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন অশরীরি প্রপঞ্চে বা এর সম্ভাব্যতায় বিশ্বাসী। প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ও লেখক পল ডেভিস তাঁর ঈশ্বরের মন (The Mind of God) এর এক জায়গায় লিখেছেন যে মানুষের যে কোন চিন্তা বা ভাবনাতেই অন্তত একটি ইলেক্ট্রনের নড়াচড়া হয়। এই ইলেক্ট্রন এর নড়াচড়া যে মহাবিশ্বে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনা এটা কখনো বলা যায় না। প্রার্থণার সম্ভাব্য ফলের কথা প্রসঙ্গে এটা বলা। প্রার্থণায় অনেক মানুষের সমন্বিত মস্তিষ্ক সঞ্চালনের প্রভাব পরিবেশে পড়ার সম্ভাবনা অনেকে উড়িয়ে দেন না। তাঁরা অবশ্য প্রার্থনার কার্যকারিতার সম্ভাব্যতা স্বীকার করলেও তার ধর্মীয় ব্যখ্যায় বিশ্বাস করেন না যেখানে প্রার্থণার ফলে কল্পিত ইশ্বর তুষ্ট হয়ে প্রার্থনাকারীর মনোবাসনা পূরণ করেন। স্মরণ করিয়ে দেই প্রার্থণার কার্যকারিতা যেমন বিজ্ঞানের নিয়ম দ্বারা সঠিক প্রমাণযোগ্য নয়, তেমনি বিজ্ঞানের নিয়মের পরিপন্থী ও নয়। পর্যবেক্ষণ ও পরিসঙ্খ্যান এর দ্বারা এর সত্যমিথ্যা যাচাই করার চেষ্টা করা হয় বটে, কিন্তু পারিসাংখ্যিক পদ্ধতির নির্ভুলতা প্রশ্নাতীত নয়। আরেকটা উদাহরণ হল বিখ্যাত গণিতজ্ঞ, সংশয়বাদী ও যুক্তিবাদী দার্শনিক মারটিন গার্ডনার। জাল বিজ্ঞান ও কুযুক্তিপূর্ণ তত্ব ও মতবাদের বিরুদ্ধে যিনি অক্লান্তভাবে লিখে গেছেন Skeptical Inquirer” ও অন্যান্য গ্রন্থে। তিনি তাঁর বই (The Whys of a Philosophical Scrivener) এ স্বীকার করেছেন যে তিনি স্রষ্টা ও পরজ়ীবনে (অর্থাৎ অমরত্বে) বিশ্বাসী। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন যে এই বিশ্বাস তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত এবং তা তার মনের ভেতরের ইচ্ছারই প্রতিফলন মাত্র। তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি পুরোপুরি আস্থাহীন ও সমালোচকও বটে।

বুদ্ধিমান নক্সা (Intelligent Design) নিয়ে প্রায়ই লেখালেখি ও হৈচৈ হয়। এর দুটো দিক আছে। বুদ্ধিমান নক্সার অনেক

প্রবক্তাই স্পষ্টতই আনুষ্ঠানিক ধর্মের সমর্থক এবং তারা সরাসরি বা আকারে ইঙ্গিতে আনুষ্ঠানিক ধর্মের সপক্ষেই যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চান যে ধর্মে বর্ণিত বুদ্ধিমান স্রষ্টার হস্তক্ষেপ ছাড়া মহাবিশ্বের অনেক কিছুই সৃষ্ট হওয়া বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এদের কেউ কেউ রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণেও ধর্মকে সমুন্নত করতে চান বলে বুদ্ধিমান নক্সার পক্ষ নেন। এরা বিবর্তনের ব্যখ্যায় সন্তুষ্ট না। এদেরকে যুক্তির বিরুদ্ধ পক্ষই ব্বলা যায় কারণ বিবর্তনের পক্ষে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ আছে। কিন্তু আর এক দল বিজ্ঞানী আছেন যাঁরা এক ভিন্ন অর্থে বুদ্ধিমান নক্সায় বিশ্বাসী। এদের মধ্যে নাম করা হলেন ব্যারো, টিপ্লার, পল ডেভিস প্রমুখ। এদের বক্তব্য হল মহাবিশ্বের অনেক কিছুই (যেমন প্রাণ ) পদার্থবিজ্ঞানের কতকগুলি ধ্রুবকের সূক্ষ্ণ সমন্বয়ের দরূন সম্ভব। এই সূক্ষ্ণ সমন্বয় কে পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। কাজেই এই সূক্ষ্ণ সমন্বয়কে তাঁরা এক বুদ্ধিমান নক্সাতুল্য মনে করেন। এই সূক্ষ্ণ সমন্বয় না ঘটলে প্রাণ সহ অনেক কিছুই সৃষ্টি হত না পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম সত্ত্বেও। এই বিজ্ঞানীরা কোনক্রমেই প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী নন এবং এদের কেউই বিবর্তনের বিপক্ষে যুক্তি দেন না বরং বিবর্তনের সত্যকে স্বীকৃতি দেন। এদেরকে কখনই বিজ্ঞান বিরুদ্ধ মতাবলম্বী বলা যায় না। সমান্তরাল জগতের দ্বারা এই সূক্ষ্ণ সমন্বয়ের ব্যখ্যা দেয়া হয় ঠিকই কিন্তু সেটাও একটা অপ্রমাণিত মত। আবার কিছু কিছু বিজ্ঞানী আছেন তাঁরাও ধর্মের পক্ষে যুক্তি না দিয়ে বা প্রচলিত ধর্মে বিশাসী না হয়েও প্রকৃতির কোন কোন ঘটনা বা সৃষ্টিকে বিবর্তনের দ্বারা ব্যখ্যা দেয়া যায় না বলে দাবী করেন। এদের কারো কারোর দাবী ভুল প্রমাণিত করা গেছে সম্ভাব্য ব্যখ্যা বের করে। আবার কোন কোন দাবীকে ভুল প্রমাণ করা যায়না বা সহজ নয়। এই ক্ষেত্রে এগুলিকে ব্যক্তিগত মত হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা যায়। যেহেতু তাঁদের মত হয় সত্য না হয় মিথ্যা (অর্থাৎ বচনবাক্য) আর যেহেতু তাঁদের মতকে বিজ্ঞানের দ্বারা ভুল প্রমাণও করা যায়না কাজেই তাকে যুক্তিবিরুদ্ধ বলা ঠিক হবে না।

 

আরেকটা কথা জোর দিয়ে বলা দরকার যে নামী দামী বিজ্ঞানী বা বিখ্যাত ব্যক্তির বিশ্বাসের জন্য কোন মতবাদ বা বিশ্বাসের গ্রহণযোগ্যতা হয় না বা বাড়ে না। কিছু কিছু নির্বিচার মতবাদীরা বিশেষ করে ধর্মবাদীরা তাদের মতবাদের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে অমুখ বিজ্ঞানী, তমুখ চিকিৎসক তাদের মতের অনুসারী ইত্যাদি বলে থাকেন। এটা হল খ্যাতি বা কর্তৃত্বের যুক্তির হেত্বাভাস (Fallacy of Argument from Authority) এর উদাহরণ। গ্রহণযোগ্যতা কেবল যুক্তি সাক্ষ্য প্রমাণের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয় বা বাড়ে। বিজ্ঞানী, মনীষী বা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব সবাই অন্য সকল মানুষের মত সহজাত কিছু অনুভূতি বা প্রবৃত্তির দ্বারা প্রভাবিত হন তাঁদের মত বা বিশ্বাসের সৃষ্টিতে। এট কোন সমস্যা নয় যদি না তারা যুক্তি বা বৈজ্ঞানিক সত্যকে লঙ্ঘন না করেন। যুক্তি বা বৈজ্ঞানিক সত্যকে লঙ্ঘন না করার সীমানার মধ্যে এক বিস্তীর্ণ এলাকা রয়েছে এর মধ্যে থেকে ব্যক্তিগত মত বা বিশ্বাস গড়ার জন্য।

 

অজানার অনুভূতির কথা উপরে উল্লেখ করেছি। পদার্থবিজ্ঞানের মূল কারণ অজানা হওয়ায় একটা ধারণ মনে জন্ম হতেই পারে যে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলি যদি অজানা কোন মূল কারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে সেই অজানা আদি কারণের ফলে এমন অনেক ঘটনাও ত ঘটতে পারে যা পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না এমনকি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের পরিপন্থী ও হতে পারে। অজানার মানেই ত অনেক সম্ভাবনার দ্বার খোলা থাকা। অশরীরি প্রপঞ্চে বিশ্বাস এই কারণেই হয়ত উদ্ভুত। ভূত প্রেতে বিশাস করাটা যুক্তি বা বিজ্ঞানের দ্বারা সমর্থন করা যায়না ঠিকই, কিন্তু অশরীরি আতঙ্ককে বিজ্ঞান বিরুদ্ধ বলা যায়না। অজানার কারণে ভয় বা ভীতি বিবর্তন জনিত এক সহজাত প্রবৃত্তি। একজন যুক্তিবাদী মানুষ ও একাকী কোন নির্জন কুঠিবাড়ীতে রাত কাটাতে বা শ্মশান/গোরস্থান এর মধ্য দিয়ে গভীর রাতে একা হাঁটতে ভয় পেতে পারেন। এতে যুক্তির কোন লঙ্ঘন হয় না। যুক্তির সাথে অনুভূতির কোন যোগসূত্র নেই। যুক্তি হল মস্তিষ্কের কর্টেক্স (Cortex) নামক অঙ্গের মাধ্যমে চিন্তন প্রকৃক্রিয়ার ফল। এটা সচেতন ক্রিয়া। অনুভূতি অসচেতনভাবে প্রবৃত্তিগতভাবে সৃষ্ট এক ক্রিয়া।

 

এবার আসি যুক্তির সঙ্গে সামাজিক কিছু বিষয়ের উপর অভিমতের সম্পর্ক নিয়ে। পূর্বে উল্লেখ করেছি যে রাজনৈতিক বা সামাজিক অভিমত ব্যক্তিনির্ভর এক বিচার। যুক্তির দ্বারা কোন বাক্যের সত্যতা অসত্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণ করতে হলে বাক্যটি যুক্তির কোন নিয়ম বা আশ্রয়বাক্য (বা স্বতঃসিদ্ধ সত্য) কে লঙ্ঘন করছে কিনা সেটা দেখাতে হয়। অধিকাংশ সমাজই কিছু কিছু সামাজিক নীতি বা মূল্যবোধকে আশ্রয়বাক্য হিসেব(বা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে) সত্য বলে স্বীকৃতি দেয়। সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাগুলি (Universal Human Rights Declaration) এর উদাহরণ। যদি যুক্তির নিয়ম দ্বারা দেখান যায় যে কোন সামাজিক অভিমতের পরিণামে উক্ত মানবাধিকারের সিদ্ধান্তগুলির কোন একটি লঙ্ঘিত হচ্ছে তখন সেই অভিমতকে মানবাধিকারের স্বতঃসিদ্ধের সাপেক্ষে অসত্য বা অগ্রহণযোগ্য বলা যায়। কিন্তু এছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে কোন অভিমত যদি সার্বজনীন বা সর্বগ্রহণযোগ্য কোন আশ্রয়বাক্যকে (বা স্বতঃসিদ্ধ কে) লঙ্ঘন করেনা না তাহলে সেই অভিমতের সত্য মিথ্যা বা গ্রহণযোগ্যতা যাচাই যুক্তির দ্বারা করা সম্ভব নয় । কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক। ব্যক্তিগত রুচি বা বিচারের উদাহরণ হিসেবে সমকামিতা যে স্বাভাবিক এই দাবীকে নিয়ে আলোচনায় আসি। এই দাবী নিয়ে প্রায়ই আবেগপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হতে দেখা যায়। প্রকৃতির নানারকম উদাহরনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলার চেষ্টা করা হয় সমকামিতা স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক। যা প্রকৃতিতে দেখা যায় বা ঘটে তাকে প্রাকৃতিক বলাটা দ্বিরুক্তির হেত্বাভাসে (Fallacy of Tautology) দুষ্ট। যা প্রকৃতিতে ঘটে বা পরিলক্ষিত হয় তা তাই স্বাভাবিক বলাটা প্রকৃতিবাদী হেত্বাভাস (Naturalistic Fallacy)। সেই যুক্তিতে পৃথিবীর সব কিছুই স্বাভাবিক হবার কথা, অস্বাভাবিক বলে কিছু থাকতে পারেনা, কারণ পৃথিবীর কোনকিছুই ত প্রকৃতির বাইরে নয়। সাধারণ ভাবে স্বাভাবিক বলতে এটাই বোঝায় যা প্রকৃতিতে নিয়ম হিসেবে ঘটে, ব্যতিক্রম হিসেবে নয়। যা সচরাচর অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়। অস্বাভাবিক হল তার উল্ট, অর্থাৎ যা ব্যতিক্রম হিসেবে ঘটে। সেই অর্থে সমকামিতা যে অস্বাভাবিক সেই যুক্তিও দেয়া যায়। আবার যদি বিবর্তনের মূল লক্ষ্যকে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক বিচারের মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা হয় তাহলেও সমকামিতাকে অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করা ভুল হবে না। হ্যা এক ধরণের টিকটিকির উদাহরণ আছে যাদের শুধু স্ত্রী লিংগ দেখা যায় আর তাদের মধ্যে প্রসবে সহায়তা করার জন্য তাদের মধ্যে রতিক্রিয়া দেখা যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তার দ্বারা বিবর্তনের মূল লক্ষ্য অর্থাৎ প্রজননের দ্বারা বংশাণু সঞ্চারণ সেই লক্ষ্যই মেটান হয়। কাজেই সেই অর্থসেটা স্বাভাবিক বটে। কিন্তু মানুষের বেলায় সমকামিতা অনুরূপ কোন প্রজনন সুবিধা বা বংশাণু বিস্তারে সহায়তা করে না। কাজেই সমকামী টিকটিকির উদাহরণ দিয়ে মানুষের বেলায় ও যে তা স্বাভাবিক এই যুক্তি দেয়া সঠিক নয়। যাহোক আসল কথা হল সমকামিতা স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক তা ব্যক্তিনির্ভর মূল্যবিচারের প্রতিফলন, যুক্তিবাদের প্রতিফলন নয়। সমকামীদের বিবাহের অধিকারের প্রশ্নে একই মন্তব্য প্রযোজ্য। এই অধিকারের দাবীও ব্যক্তিনির্ভর এক অভিমত। এই অধিকার স্বীকৃত না হলেও যুক্তির দ্বারা (অর্থাৎ মানবাধিকারের আশ্রয়বাক্যের সাপেক্ষে) এটাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রমাণ করা যায়না। এখানে এটা পরিস্কার করে দেয়া দরকার যে বিবাহের অধিকার বলতে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির কথা বোঝান হচ্ছে। সমকামীরা প্রচলিত আইন এর আওতায় থেকেও সামাজিক বা ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী বিবাহ করতে পারেন। এতে কোন বাধা নিষেধ নেই। বিবাহের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একটি সুবিধা (Priviledge), মৌলিক মানবাধিকারের কোন অংশ নয়। অধিকার ও সুবিধা এক নয়। এ দুটোকে গুলিয়ে ফেলেন অনেকে। এই গুলিয়ে ফেলাটা হিজাব বিতর্কেও দেখা যায়। তুরস্কে হিজাব পরে সংসদে যাওয়ার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় অনেক সংগঠন ও সমালোচক এটাকে মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে অভিযোগ করেছিলেন। তার এটাকে হিজাব পরার উপর বিধিনিষেধ বলে প্রচার করছিলেন। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা ছিল যে তুরস্কে (শুধু তুরস্কে কেন সর্বত্রই) হিজাব পরার উপর কোন বাধানিষেধ নেই বা ছিলনা। কেবল হিজাব পরে সংসদে যাওয়ার উপর বিধিনিষেধ ছিল। সংসদে যাওয়া একটি সুবিধা। এই সুবিধা ভোগের জন্য শর্ত আরোপ করা কখনই মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, যেমনটি নয় কোন কোন রেস্তোরায় শার্ট না পরে ঢোকার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করায়। যাহোক বিবর্তনের কারণেই মানব সমাজ নর-নারীর বিবাহকেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির সুবিধা দিয়েছে মানব প্রজাতির রক্ষা ও বিস্তারের জন্য। যুক্তির দ্বারা সমকামীদের বিবাহের পক্ষে রায় দেয়া যায় না। গণতন্ত্রের আওতায় যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ এর পক্ষে রায় দেয় কখনও তখনই এই অধিকার অর্জন সম্ভব । তবে এ কথাও জোর দিয়ে বলা দরকার যে সমকামীতা স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক ভাবা দুটোই ব্যক্তিগত মত হিসবে গ্রহণযোগ্য হলেও শুধু সমাকামীতার কারণে কাউকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা (বিবাহের রাষ্ট্রীয় সার্টিফিকেট এর মধ্য পড়েনা) মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং তা অগ্রহণযোগ্য।

 

আরেকটা সামাজিক ইস্যু যা নিয়ে খুব তর্ক বিতর্ক ও আবেগের সঞ্চার হয় তা হল গর্ভপাতের নৈতিকতা ও অধিকার নিয়ে। অনেকটা একি যুক্তি প্রযোজ্য এখানেও। যুক্তির পরিবর্তে ব্যক্তিগত দর্শন,মূল্যবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গী ই এখানে প্রাসঙ্গিক। গর্ভপাত (অর্থাৎ ভ্রূণহত্যা) প্রাণহত্যা কিনা সেটা নিয়ে তর্ক উঠে। যদি প্রাণের জীববৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা গ্রহণ করা হয় তাহলে যেহেতু সে সংজ্ঞায় ভ্রূণ একটি প্রাণ, তাই ভ্রূণহত্যা প্রাণহত্যারই সামিল। আবার যদি কেউ বলে প্রাণ হত্যা নয় বরং নরহত্যাই অনৈতিক বিবেচ্য হওয়া উচিত তাহলে গর্ভপাত-> ভ্রূণহত্যা->প্রাণহত্যা যেহেতু নরহত্যা নয় তাই এটা অনৈতিক নয়। েখানে নর বলতে মানুষের ভূমিষ্ট হওয়ার পরবর্তী পর্যায় কে বোঝান হচ্ছে। সংজ্ঞার মারপেঁচে এক নিমিষে নৈতিকতার ও অনৈতিকতার মধ্যকার সীমারেখা বদলিয়ে দেয়া যায়! যাহোক মোদ্দা কথা হল এখানেও যেহেতু কোন সর্বগ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা বা মাপকাঠি নেই তাই কোনটা সত্য,মিথ্য্‌ নৈতিক, অনৈতিক, ভুল বা সঠিক ইত্যাদি বলা যায়না নিশ্চিতভাবে।