ধর্ম, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতা
শহিদুল ইসলাম
মডারেটরের নোট : মুক্তমনার পাতায় অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের লেখা খুব একটা দেখা না গেলেও বাংলাদেশের যে কজন বুদ্ধিজীবী আমাদের মুক্তমনা আন্দোলন এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চার সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ড. শহিদুল ইসলাম তাদের মধ্যে অন্যতম। নিজ দায়িত্বে মুক্তমনা লেখকদের বইগুলোর রিভিউ করা তিনিই প্রথম শুরু করেছিলেন বাংলাদেশের পত্রিকার পাতায়। এমনি একটি রিভিউ মুক্তমনায় রাখা আছে ‘মানুষ ও মহাবিশ্ব এবং আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (দৈনিক সংবাদ, জুন ১৬, ২০০৫) শিরোনামে। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা ‘ব্রুনোর আত্মত্যাগ এবং যুক্তিবাদ‘ যা পঠিত হয়েছিলো জিওর্দানো ব্রুনোর স্মারক সেমিনারে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নব প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের তিনি ছিলেন প্রথম পরিচালক। ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তির অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। শিক্ষা, বিজ্ঞান দর্শন তাঁর লেখার প্রিয় বিষয়। সমাজ ও রাজনীতি সচেতন এই শিক্ষাবিদ শিক্ষা ও শিক্ষক সম্বন্ধীয় সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনের সাথে জড়িত। শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের অন্যতম সহ সভাপতি। দুটি খন্ডে সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থটির নাম ‘বিজ্ঞানের দর্শন’। তাঁর অন্যান্য পরিচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্র রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ : সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, প্রসঙ্গ : শিক্ষা, দেশভাগ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ইত্যাদি।
আমরা অধ্যাপক শহিদুল ইসলামকে আমাদের মুক্তমনা ব্লগে পেয়ে আনন্দিত বোধ করছি। তাঁর এই প্রবন্ধটি ২৮ জুন ২০০৯ তারিখে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশে ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতা’ শিরোনামে পঠিত হয়েছিলো। আমরা লেখাটিকে আমাদের ই-বুক ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়?‘-এর জন্য নির্বাচিত করেছি।
শিরোনামে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটি দুবার ব্যবহার করা হয়েছে। তদুপরি আমি একজন বিজ্ঞানের ছাত্র বলেই নিজেকে মনে করি। তাই এরূপ ধারণার জন্ম নেওয়া অসম্ভব নয় যে আজকের লেখাটি বিজ্ঞান বিষয়ক। মোটেই তা নয়। আজকের লেখার মধ্যে বিজ্ঞান নাই। আছে মূলত দর্শন, সেইসঙ্গে ইতিহাস। দর্শন ও ইতিহাসে কোনরকম ট্রেনিং না থাকা একজন বিজ্ঞানের ছাত্রের পক্ষে বিষয়টা যে কতটা বিপজ্জনক, তা পাঠকেরা হয়ত উপলব্ধি করতে পারবেন। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে ১৭৮৪ সালে স্যার উইলিয়াম জোনস কোলকাতায় এতদঅঞ্চলের ইতিহাস গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত এটি একটি ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্র। সাধারণভাবে ইতিহাস সম্পর্কে আমরা যা বুঝি, তা নিয়ে কাজ করা খুব একটা কষ্টকর মনে হয় না। কিন্তু ‘ইতিহাসের দর্শন’-এর কথা উঠলে থমকে দাঁড়াতে হয়। তখন আর বিষয়টা অত সহজ-সরল থাকে না। ইতিহাসের সঙ্গে তখন সমাজ-সংগঠন, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, রাজনীতি সব একাকার হয়ে কাজটি কঠিনতর করে তোলে। ঠিক আজকের বিষয়টিও তেমনি জটিলতর। আমার পক্ষে এই শিরোনামের পক্ষে কতটা সুবিচার করা সম্ভব, সে সন্দেহ মাথায় রেখেই কিছু কথা আজকের এই পন্ডিত মহলে বলার চেষ্টা করবো। তাই প্রথমেই একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এই অসীম ধৃষ্টতার জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ত্রিশ বছরে বিজ্ঞানের জগতে এক বিরাট বিপ্লব ঘটে গেছে। T.S. Kuhn এর ভাষায় এই ত্রিশ বছরে এক নতুন ‘প্যারাডাইমের’ জন্ম হয়েছে। বিজ্ঞানের অধিবিদ্যক রূপটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং বিজ্ঞান একটি চঞ্চল, সদা-পরিবর্তনশীল একটি কর্মকান্ডে পরিণত হয়েছে। সেই বিপ্লব “led to the ideas of science as being in constant flux.”এমনি একটি সদা-পরিবর্তনশীল, যা অনবরত রূপ বদলায় সেরকম একটি প্রপঞ্চের সংজ্ঞা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। তাই বিশ-শতকের দু’জন দিকপাল বিজ্ঞানের ইতিহাস রচয়িতা জর্জ সার্টন এবং জে. ডি. বার্নাল কেউই বিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্ণয়ের চেষ্টা করেননি। সার্টন বলছেন “It (seience) began whenever and whatever men tried to solve the innumerable problems of life.” জন্ম থেকেই মানুষ হাজারটা সমস্যায় জর্জরিত। তার মধ্যে প্রধান যে অস্তিত্ত্ব রক্ষার সঙ্কট তা বোধহয় ভুল নয়। মানুষ নিজেই যদি না বাঁচে তাহলে আর কি থাকে! তাই মানুষের অস্তিত্ত্ব রক্ষার সংগ্রামের মধ্য থেকেই বিজ্ঞানের উদ্ভব। কাজেই সে চেষ্টা না করাই ভাল। তবে আমার মনে হয় মূল লেখায় ঢোকার আগে সামান্য ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখা অপ্রয়োজনীয় হবে না। বিজ্ঞানের এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মধ্যে যেমন বিজ্ঞান সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে তেমনি বিজ্ঞানমনস্কতার বা তার বিরোধী মনোভাবের একটি রূপরেখাও সে আলোচনায় উঠে আসবে বলেই আমার মনে হয়।… (এরপর পড়ুন এখানে )
নৃপেন্দ্র নাথ সরকার,
অসংখ্য রাত জেগে এতো বড় বই ‘যে সত্য বলা হয়নি’ লিখে যা বলতে চেয়েছি তা কয়েকটি বাক্যে বলে দিলেন। হায়! আমিও যদি আপনার মত লেখক হতে পারতাম। হ্যাঁ, অনেক মুক্তমনা দাবীদার লেখকদের লেখায়ও দেখেছি হাজার বার ঈস্বর, ভগবান, বিধাতা ব্যবহার করেণ আর অতি সন্তর্পণে আল্লাহ শব্দটি এড়িয়ে যান পাছে তসলিমা কিংবা হুমায়ুন আজাদের ভাগ্য বরণ করতে হয়। তারা নির্দিধায় গীতা বাইবেল থেকে শ্লোক টেনে উদাহরণ টানতে পারেণ কিন্তু কোরাণ থেকে নেন না যদিও কোরানেও হুবহু আয়াত পাওয়া যায়। আপনার অন্যান্য লেখা পড়তে চাই। লিংক দেবেন প্লীজ।
মাত্র তিন সপ্তাহ আগে (২০ জুন ২০০৯) টেক্সাসের কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক এসেছিলেন আমার বাড়ীতে সৌজন্য সাক্ষাত করতে। তিনি বিজ্ঞানমনস্ক! প্রকাশ করা দরকার। একটি ব্যক্তিগত ঘটনা অহেতুক টেনে এনে আত্মবেদনা প্রকাশ করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন গত গ্রীষ্মে জীববিজ্ঞান পড়াতে। ডারউনের বিবর্তনবাদ পড়াচ্ছিলেন। অধ্যাপক কষ্ট পেলেন, জনৈক তবলিগ জামাতের ছাত্র দাঁডিয়ে বলল, সে এসব বিশ্বাস করে না। তিনি তাঁর কষ্ট লাঘব করার জন্য বিভাগীয় এক অধ্যাপকের সাথে কথা বললেন। কষ্ট লাঘব হল না, বরং বাড়ল। কারন, সেই অধ্যাপক(?) ছাড়া বিভাগের আর কেউই নাকি বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করেন না অথচ বিবর্তনবাদ পড়িয়ে যাচ্ছেন।
গল্প শেষ হলে আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, “আপনি কোনটি বিশ্বাস করেন, বিবর্তনবাদ নাকি সৃষ্টিতত্ব?“ বেকায়দা আর কাকে বলে। মুখ থেকে স্পষ্ট কিছু বেরোলো না। যা বেরোলো তা থেকে কিছুই বুঝা গেল না। আমি মুখপোড়ার মত প্রশ্ন করলাম, “আপনি নিজে যা বিশ্বাস করেন না, ছাত্রদেরকে তাই পড়ান?“ শিক্ষিত লোকদের মাঝে এরকম দ্বৈত মানসিকতা বিরল নয়।
অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের প্রবন্ধটি ঐতিহাসিক তথ্যে সম্মৃদ্ধ। বিষয়টি বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে। বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে পড়ে ফেললাম। মনে হল, লেখকের নিজেরই বিজ্ঞানমনস্কতায় কাটতি আছে। মূল বিষয়বস্তু থেকে বার বারই যেন ছিটকে গেছেন। খৃষ্ট ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সংঘাতের অনেক উদাহরণ দিয়েছেন নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে। অতি সাম্প্রতিক কালে অন্য ধর্ম কর্তৃক অনেক নামীদামী লোক নিগৃহীত হচ্ছেন বা হয়েছেন। লেখক এসবের পাশ কাটিয়ে গেছেন সন্তর্পনে। শুধু শুধু মোল্লা-মুসুল্লীদের মুন্ডুপাত করেছেন। কেন বাবা, এদের কী দোষ? এঁরা ভিতরে-বাইরে স্বচ্ছ কাঁচের মত পরিষ্কার (transparent)। যে ঐশী মন্ত্রে এরা দীক্ষিত তার বাইরে তো এরা কিছুই করে না। মন্ত্র বলেই নুরজাহানকে কোমড়-অবধি মাটিতে পুতে কেন এঁরা পাথর নিক্ষেপ করে মারে। দোষ এদের নয়, দোষ মন্ত্রের।
ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংঘাত নাকি সমন্বয়! বিজ্ঞানের কি মস্তিস্ক আছে যে সে সংঘাত কি জিনিষ তা বুঝবে? বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত সত্য আবিস্কার করে চলেছেন। ধর্ম হাজার বছরের পুরনো মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত একটি তান্ত্রিক মন্ত্র। অশ্ব আর অশ্বডিম্ব? অশ্ব অস্তিত্বশীল আর অশ্বডিম্ব অস্তিত্বহীন। অস্তিত্বের সাথে অস্তিত্বহীনের সখ্যতা, সহবাস, সমন্বয়, সংঘাত? কোন ধর্মই (ধর্মবাজরা) আজ বিজ্ঞানকে অস্বীকার করতে পারছে না। বরং অস্তিত্বের তাগিদে নিজ নিজ ধর্মে বিজ্ঞান আবিস্কার করে বিজ্ঞানের পেছনে ছুটে চলছে অহর্নিশি। এই ছুটে চলা সবে শুরূ হয়েছে। রনে ভংগ দেওয়ার সময়ও আর বেশী দূরে নেই। যুগ যুগ ধরেই মানুষ বিশ্বাস করত – ঝাড়-ফোকে অসুখ-ব্যামো সেরে যায়। প্রাকৃতিক নিয়মেই এক সময় সেরে যায়। ঝাড়-ফোকের কেরামতি হয়। আমার ঠাকুরমা ডান পা ভাংগলে বাম পায়ে ওষুধ দিতেন। কত মানুষের ভাংগা পা যে তিনি সারিয়ে দিয়েছেন তার ঠিক নেই। এসব আজ গল্পের মত শোনায়।
এখনও নর্দমার গন্ধ ঘরে ঢুকে পড়ে। সেদিন আর দেরী নেই যেদিন বাড়ীর পাশে আর কোন নর্দমা ঠাই পাবে না। গ্রামে-গঞ্জে ডাক্তারী পরিসেবার বদৌলতে যে ভাবে আমার ঠাকুরমার ঝাড়-ফোক বিতাড়িত হয়েছে, আজকের ইন্টারনেটের বদৌলতে নর্দমার গন্ধও শীগগীরই বিতাড়িত হবে।
বাংলাদেশের যে ক’জন দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী বিজ্ঞান এবং দর্শন সম্বন্ধে একটি পরিস্কার ধারণা রাখেন, অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম তাদের মধ্যে অন্যতম। যারা প্রতিনিয়ত ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বিজ্ঞান খুঁজে বেরান, কিংবা জোড়াতালি দিয়ে বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়ের প্রচেষ্টা করেন, অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের প্রবন্ধটি তারা পড়ে বোঝার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
বাংলাদেশের মেধা এবং অবস্থা প্রতিদিনই যেভাবে অধঃপতনের দিকে ধাবমান, অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম সেই ধারা থেকে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
সুন্দর লেখা, অনেক ভাল ভাল রেফারেন্স লেখাটির আকর্ষন বাড়িয়েছে।
ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংঘাত নাকি সমন্বয় এ নিয়ে অনেক লেখা পড়েছি। আমার মতে এ দুটই বিষয়ের কোনদিন সমন্বয় সাধন করা যাবে না খুবই যৌক্তিক কারনে। খুব সোজা কথায়, ধর্ম হল বিশ্বাস বা আবেগের জিনিস যার কোন সার্বজনীন বা যুক্তিগ্রাহ্য প্রমান থাকতে পারে না, অন্যদিকে বিজ্ঞান হল যুক্তির ও তথ্য প্রমানের, কোন বা কারো বিশ্বাস বা আবেগের কোন মূল্য এতে নেই। যেখানে ধর্মের সীমাবদ্ধতা, সেখানেই বিজ্ঞানের বিশিষ্টতা। আমি বুঝতে সম্পুর্ন অক্ষম যে এ সোজা কথাটি কেন অনেকে বুঝতে চান না।
তবে আমার মতে দুয়ের সমন্বয় না হলেও সহাবস্থান হতে পারে, অনেকটা মিউচুয়াল আন্ডারষ্ট্যান্ডিং। পাশ্চাত্য সমাজে যা গত শতাব্দী থেকে অনেকটা চলে আসছে। ধর্মবাদীরা বিজ্ঞানের জগতে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস বাহুবল দিয়ে প্রয়োগ না করলেই হল। অবশ্য খোদ পাশ্চাত্য সমাজেও তাদের হাত এখনো অনেক লম্বা, খোদ আমেরিকারই অনেক ষ্টেট এ বিবর্তনবাদ স্কুলে পড়ানো নিষেধ। এ জাতীয় কিছু ঘটনা ছাড়া সেখানে মোটামুটি সহাবস্থান চলে আসছে।
ধর্মে বিশ্বাস করলেই যে বিজ্ঞান চর্চা করা যাবে না এটাও ঠিক না। প্রফেসর সালামের মত বহু বিজ্ঞানীও ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক। তাতে বিজ্ঞান চর্চার সমস্যা হয়নি।
তাই সোজা দুয়ের সমন্বয় না হলেও সফল সহাবস্থান হতেই পারে।