প্রথম পর্ব;  দ্বিতীয় পর্ব

প্রথম পর্বে জানিয়েছিলাম আমার এক বিজ্ঞান পাগল কাকার কথা, যার মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতার শুরু। বিজ্ঞানকে দিন দিন আকড়ে ধরতে লাগলাম। বাসায় রাখা হতো দৈনিক সংবাদ, তার প্রতি মঙ্গলবার বেরুতো বিজ্ঞান পাতা (পরে তা দু পৃষ্ঠার করেছিল)। ঐ পাতাটি শুধু গোগ্রাসে গিলতাম না- সংগ্রহও করতাম, সংবাদের বিজ্ঞান পাতা দিয়ে সুটকেস ভরিয়ে ফেলেছিলাম। কত ক যে জানতে পেরেছিলাম ঐটুকু বয়সে! হয়তো অনেক কিছু বুঝিনি, তবে দুনিয়াটা যে আমার আগের জানা ছোট্ট গণ্ডির নয়, তার কত বৈচিত্র আছে- দুনিয়ার বা বিশ্ব জগতের সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা কার্যকরণ সম্পর্ক আছে- এটা বুঝতে শিখতে থাকি।

এসময় আরেকটি কাজও করতে থাকি- চোখের সামনে বিভিন্ন ঘটনার বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা করা আরম্ভ করি। এবং একসময় নিশ্চিত হতে পারি যে, অলৌকিক বলে কিছু থাকতে পারে না। (এই সিদ্ধান্তে আসার পেছনে অবদান প্রথমত সেই কাকার, তারপরে সংবাদের বিজ্ঞান পাতার এবং আরেকটু পরে- মানে বড় হয়ে প্রবীর ঘোষের “অলৌকিক নয় লৌকিক” বই পড়ার পরে আর কোন সন্দেহই থাকে না)।

ফলে, এই সময়টাতে বিভিন্ন সময়ে দাদী-নানী প্রমুখদের কাছ থেকে শুনা এবং এক সময় বিশ্বাস করা ভূত-প্রেত-জ্বিন-পরীদের অবিশ্বাস করা আরম্ভ করি, আমাদের এলাকায় একটি বড় পেয়ারা গাছে জ্বিন/ভূতের গল্প প্রচলিত ছিল- ভর দুপুরে বা আযানের সময় গাছে উঠে থাকলে জ্বিন/ভূত এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, এটাও আমাদের বয়সী প্রায় সবাই বিশ্বাস করতাম, সাহস করে উঠে দেখলাম- কিছুই হলো না (প্রথমবার প্রচণ্ড ভয় অবশ্য পেয়েছিলাম)।

একবার সেই কাকা আরেকটা গল্প শোনালেন। গ্রামের একলোক নাকি গল্প করছিল- বিমান ক্রাশে জিয়াউল হকের শরীর টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছিল- কিন্তু তার পকেট-কোরআন অক্ষত ছিল, কোরআন কখনো নষ্ট হতে পারে না, আগুনে পুড়তে পারে না … ইত্যাদি। এটা শুনে তিনি আস্ত কোরআন নিয়ে এসে সেখানকার কয়েকপাতা ছিড়ে আগুন ধরিয়ে দেখিয়ে দেন- কোরআনও তো কাগজে ছাপা অক্ষর বিশেষ, এবং তা পুড়ানো যেতে পারে। কিন্তু কোরআন ছেড়া ও পুড়ানোয় গুনাহ হবে কি না জিজ্ঞেস করায় জানালেন- আল্লাহ যদি সত্যি থেকেই থাকেন- তিনি মানুষের তৈরী ঐ কাগজের চেয়ে সত্যের ধারক হওয়ার কথা। মনে গেথে যায়।

বিশ্বাস করতাম “সুরা এখলাস উল্টাদিক করে পড়লে” চাইলে ইঁদুর হওয়া যায়, বিজ্ঞানের বদৌলতে সেটাকে সন্দেহ করতে শিখলাম। প্রমাণের জন্য উল্টো করে পড়ে দেখলাম, গুনাহর ভয় কাটানোর জন্য কাকার সেই যুক্তির কথা ভাবলাম। দেখা গেল- ইঁদুর হইনি। এমন অনেক সংষ্কারই ধীরে ধীরে মাথা থেকে দূর হতে থাকে। অবশ্য এক্ষেত্রে “সংবাদ” এর বিজ্ঞান পাতার ভূমিকা ছিল- সেখানে প্রচলিত কুসংষ্কার নিয়ে সত্যিকার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি কি হতে পারে সেরকম লেখা নিয়মিত ছাপাতো। এই মুহুর্তে সাপ ও ওঝাদের নিয়ে একটা বিশাল লেখা এবং জ্যোতিশাস্ত্র ও রাশিফল নিয়ে বিশাল লেখার কথা মনে পড়ছে।

একদিনের কথা। প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে, যথারীতি পাড়ার এক মাঝবয়স্ক ভদ্রলোক চিৎকার করে আযান দিতেছেন। আযান দিলে নাকি ঝড় থেমে যায়, ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি করার সম্ভাবনা কমে যায়। আগে বিশ্বাস করলে- তখন আমি ঝড়ের প্রকৃত কারণ জানি (ক্লাসের বিজ্ঞান বইয়েই ছিল), ঝড়ের সাথে যে আযানের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না এটাও নিশ্চিত। কিন্তু ঐ সময় আমার উপস্থিতি প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারটির বাসায় ছিল। সেখানে এই কথা বলার সাথে সাথে আমাকে দিদি-কাকি দারুনভাবে সাপোর্ট করলেন- মনে মনে খুশী হলাম এই ভেবে যাক এনারা অনেক বিজ্ঞানমনস্ক। কিন্তু দুদিন পরেই তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখি তারা এক কালী মন্দিরের কথা বলছেন- যার চারদিকে সাত বার ঘুরলে নাকি কেউ বাঁচতে পারে না। যতই বিজ্ঞানের কথা বলি- ওনারা ততই তাদের বিশ্বাসের কথা বলতে থাকেন। মেজাজ-মুজাজ খারাপ করে শেষ পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ জানাই- সেখানে যাবো। পরে অবশ্য আর যাওয়া হয়নি- আমার মায়ের জন্য; মায়ের যুক্তি- কালীর অলৌকিক ক্ষমতা না থাকুক- মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা তো মানুষের থাকতে পারে! (আসলে ঐ সময়ে তখনও প্রবীর ঘোষ পড়া ছিল না- ফলে মায়ের কথায় সহজেই ভয় পেয়ে থেমে গিয়েছিলাম….)

সেদিন কালীর অলৌকিকত্ব নিয়ে কাজ করার সুযোগ না পেলেও, কিছুদিনের মধ্যেই দুটো ঘটনা কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাই। একটা মাংসে আল্লাহ লেখা, আরেকটা একজনের বাড়িতে বিগত এক পীর সাহেবের কবর জেগে উঠা। দুটি ঘটনাই হাজার হাজার মানুষের সাথে সাথে আমিও প্রত্যক্ষ করার জন্য ছুটে যাই, কিন্তু দুঃখের কথা, অন্য সকলের মত এতে আমার ঈমান পোক্ত হয়নি- বরং ধাপ্পাবাজিই মনে হয়েছে (আমি তখনও স্কুল পড়ুয়া, আমার কথায় কান দেয়ার মত কেউ ছিল না- ফলে আমার পক্ষে ধাপ্পাবাজিটা পুরো উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি; কেবল কিছু বন্ধুবান্ধব, পাড়ার কিছু লোকের সাথে যুক্তি-তর্ক করেছি)।

ঐ মাংসে আল্লাহ লেখা দেখে তো এক বন্ধু মাংস খাওয়াই বাদ দিয়ে দিল- মাংস খেতে গেলেই নাকি তার মনে হতো- এখানে যদি আল্লাহ লেখা থাকে- তাহলে সেই আল্লাহ লেখাঅ’লা মাংস খেয়ে ফেললে কতই না গুনাহ হবে! তার সাথে তর্ক হলো। বললাম- “আল্লাহ লেখাটার দিকে ভালো করে খেয়াল করো। পাশাপাশি চারটা খাড়া দাগ বা লাইনের বামের তিনটার নিচের দিকে যদি কোনরকমে মিলে যায়- তবে সেটাকেই আল্লাহ বলে চালানো যায় কি-না?” মজার ব্যাপার হলো- অলৌকিক যে মাংস খণ্ডটি দেখতে গিয়েছিলাম- সেটাতে এরকমই ছিল- সর্ববামে ‘হা’ বা ‘হু’ ছিলই না। বন্ধুকে বললাম- “এবারে গরু-ছাগলের মাংসের দিকে খেয়াল করো- সেখানে আড়াআড়ি অনেক দাগ থাকে- ফলে এগুলো থেকে সহজেই যেকেউ চাইলেই আল্লাহ বানাতে পারবে। সে হিসাবে আমরা প্রতিবার মাংস ভক্ষণেই অনেকবার আল্লাহকে হজম করে ফেলছি”। তাকে আরো জানালাম- “ঐ একই নিয়মে চাইলে মাংসেখণ্ডে ‘লাইলাহা’ মানে ‘কোন মাবুদ নাই’ এটাও খুঁজে বের করা সম্ভব”। তর্কের আউটপুট হলো- বন্ধুটি নাস্তিক না হয়ে গেলেও (নাস্তিক হবে কি- তখনও তো আমি পুরো নাস্তিক নই)- আবার মাংস খাওয়া শুরু করে দেয়।

আর- পীর বাবার কবরের ঘটনাটি হলো- ঐ ঘরের পাশে এক বড় গাছের শিকড়ের কীর্তি (কবরটা ভেঙ্গে বা জায়গাটা খুড়তে পারলেই ভালো প্রমান হয়ে যেত- সেটা অ্যারেঞ্জ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না- আমি কেবল নিজের যুক্তির জায়গাটা পরিষ্কার করতে পেরেছিলাম)। এর সাথে ঐ বাড়ির এক বৃদ্ধা মহিলার স্বপ্নে পীরবাবার হাজির হওয়া ও নানান রকম নির্দেশনা দেয়াটাও আমার খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক মনে হয়েছে। কেননা- এরচেয়েও উদ্ভট টাইপের স্বপ্ন আমরা অনেকেই দেখি।

….

(চলবে)