রক্তে আমার রসুন বাগান

 

পরশপাথর

 

 

এইতো আর মাত্র কটা দিন। তারপর শেষ হয়ে বে আমার এই মরার জীবন। প্রকৃতির এক নিপুণ নিয়মে একদিন মায়ের গর্ভ থেকে চলে এসেছিলাম প্রকৃতির কোলে। প্রকৃতিই বড় করেছে কোলে-পিঠে করে । তার আদরে শৈশব গেল, কৈশর গেল। তারপর এল বয়স। লোকে বলে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছ। হয়েছি হয়ত; কিন্তু সাথে সাথে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি  কৃত্রিমতার কাছে। জীবন থেকে ছুটে পালিয়ে গেছে জীবন।

 

সপ্তায় সপ্তায় উইকএন্ড আসে; নভেম্বার, ডিসেম্বার গড়িয়ে থার্টি ফার্স্ট আসে। আমরা রুটিন করে রাখি, মুখস্ত করে রাখি। আনন্দ করতে হবে, নাচতে হবে, গাইতে হবে, আকণ্ঠ ডুবে থাকতে হবে, মগ্ন থাকতে হবে, মত্ত থাকতে হবে। মনকে বলি, রঞ্জিত হও, নেচে ওঠ। মন মুচকি হাসে, বলে, এই হলাম। আমাদের কর্পোরেট মন বুঝে ফেলেছে কর্পোরেট কালচার। কিন্তু হৃদয়ের গহীন গোপন কোণ, যেখানটাতে কোনো কালচার নেই, যেখানটাতে কোনো ভণিতা নেই, সেখানে কিসের এত ব্যাথা ? নিজ থেকে সে- আর নেচে উঠতে পারেনা, পারেনা নিজের মত করে শিহরিত হতে, আন্দোলিত হতে। নয়টা-পাঁচটার কারাগারে বন্দী হয়ে গেছে আমাদের অবুঝ অকৃত্রিম হৃদয়টাও।

 

কর্পোরেট পৃথিবী আমাদের জন্য নিয়ে আসে কাজ, নির্দিষ্ট করে দেয় টার্গেট। কিন্তু টার্গেটএ গিয়েও থামা নয়। ডলার টাকা আর প্রতিপত্তির লোভ দেখিয়ে ধরিয়ে দেয়া হয় আরো বড় টার্গেট। একটুও বসে থাকা নয়, একটুও স্বপ্ন দেখা নয়। দেয়া হয় গাড়ী, দেয়া হবে বাড়ী, অর্থ ,পজিশান। শুধু নিয়ে নেয়া হয় জীবন। উপরে উঠাতে উঠাতে নিয়ে াওয় হয় ঠিক মৃত্যুর কাছাকাছি কোথাও, যেখান থেকে আর হারানো জীবনের দিকে ফিরে তাকানোর সময়টুকুও থাকেনা।

 

খন বুঝতে পারি ক্ষয়ে ক্ষয়ে য় জীবন, তখন তাকিয়ে থাকি পুরোনো জীবনের দিকে। মনে হতে থাকে সেই সমস্ত জীবনের কথা খন আমাদের হৃদয়কে রুটিন করে দোলাতে হোতনা। সে নেচে উঠতো আপনা থেকেই। আমরাই কি দেখিনি সেই সমস্ত শীতের সকাল, জেলেরা খন এক ডুবে পুকুরের মাঝখান থেকে তুলে আনত জলচর, লাফ দিয়ে জাল ছিঁড়ে পালানোর চেষ্টায় ব্যাকুল রুই কাতলা। দেখিনি কি কুয়াশার ভোরে লাঙ্গল কাঁধে হেঁটে ওয়া কৃষকের মুখ, খেজুরের টপটপ করে ঝরে পড়া রসে মুখ রাখা দুটো শালিক, অলস বিকেলে পল্লীমায়ের জুটি করে দেয়া কিশোরী বালিকা। আমরাই কি দেখিনি বাড়ীর পুকুরে বেড়ে উঠা কলমির লতা, কচুরিপানার বেগুনি-সাদা-হলুদ দাগের বাহারি ফুল, এখান থেকে ওখানে উড়ে উড়ে বেড়ানো দুষ্টু ফড়িংয়ের দল; লাল, নীল, কালো, ডোরাকাটা।

 

হলুদ সরষে ক্ষেতের কথা কি মনে আছে? মনে কি আছে জ্বোনাকীদের কথা? এত এত তারা আর অন্ধকার রাতের কথা? বাতাসে ভেসে আসা শিয়ালের ডাক, আশপাশ থেকে ডেকে উঠা ডাহুকের কথা, কালবোশেখীর কথা, কাঁচা আম, হাওয়ায় দুলতে থাকা তেঁতুলের কথা, জলের কথা, ঝিলের কথা, বিলের কথা, শাপলার কথা, শালুকের কথা, বাড়ির পিছনের গাছে বাসা বাঁধা টুনটুনি পাখিটির কথা, মাছরাঙ্গাটির কথা, দাদির ত্নে বেড়ে উঠা লাউ-কুমড়োর গাছের কথা?

 

 

নাহ! জীবন আজ আর সেখানে য়না। তে চায়, ফিরে তে চায়, কিন্তু ওয়া হয়না। তৈরী হয় অজুহাত। আমাদের কর্পোরেট জীবনকে বৈধতা দেবার জন্য আমরাই খুঁজে আনি অজুহাত। উন্নত জীবনের লোভে  শরীরকে টেনে নিয়ে ই অন্য ভূখণ্ডে। মন পড়ে থাকে মনের জায়গায়। তারপর মিছেই সান্ত্বনা খুঁজি। মনকে বুঝানোর চেষ্টা করি, কেন ফিরে াওয়া বেনা খানে মন তে চায় সেখানে। সবচেয়ে বড় অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাই নিজের সন্তান আর তার ভবিষ্যতকে। বলি সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মনের বিরুদ্ধে হলেও আমাকে বেছে নিতে হবে এই জীবন।

 

কিন্তু ভিতরে ভিতরে মন দেখে ফেলে আমার ভণ্ড, কপট চেহারাটা । তাই খন বলি, আজ থার্টি ফার্স্ট, আজ উইকএন্ড, নাচো মন নাচো। মন আমার মুচকি হাসে। বলে এইতো আমি নেচে বেড়াচ্ছি। নেচে য় কৃত্রিমতার উদ্দাম নাচ। শুধু গোপনে আমার চোখে ভেসে উঠে বাড়ীর পাশের বিশাল এক রসুনের ক্ষেত, রসুনের বাগান। মাটির উপরে বেড়ে উঠা এই কোমল, নিষ্পাপ গাছগুলোই মাটির নিচে ধরে রাখে সাদা সাদা রসুন, রসুন আর রসুন, রসুনের মসলায় রান্না তরকারি আমার মা আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন খুব ছোটবেলায়। অবচেতন হলে বুঝে ই আমার রক্তের মাঝে আজও সেই রসুনের বাগান, যেখানটাতে গেলে ফিরে পাবো হারানো জীবন।

 

পারিনা, ফিরে তে পারিনা, নিজের মত করে পন করার জন্য একটা জীবন। ফিরে আর ওয়া হয়না। নিজের কুৎসিত, কপট চরিত্রের কথা ভেবে ঘেন্না ধরে য়। আরো জাগতিক আরো কর্পোরেট হয়ে উঠি দিনের পর দিন। উপরে উপরে, উপরে ঊঠি; ভিতরে ভিতরে, ডুবে ই। সান্ত্বনার ভাবনায় ভাবতে থাকি, এইতো আর মাত্র কটা দিন, তারপর শেষ হয়ে বে আমার এই মরার জীবন।

 

January 09, 2009

[email protected]