স্টালিন বনাম হিটলারঃ ইতিহাসের কুখ্যাততম খুনী কে? (২য়-পর্ব)
রাজনৈতিক ক্ষমতার সংজ্ঞাই হচ্ছে অন্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, নিজের সিদ্ধান্ত চাপানো। ক্ষমতার প্রতি লোভ কি এদের প্রথম থেকেই ছিল? স্বৈরাচারের লক্ষন কি তাদের আগের রাজনৈতিক জীবনে দেখা যায়? আদর্শবাদের প্রতি নিষ্ঠাই কি তাদের ক্রমশ ক্ষমতা লোভী করে তোলে? না বিবর্তনের পথে এই ক্ষমতার লোভ আগে থেকেই বিদ্যমান-কিন্ত স্যোশাল ডারউনিজমে প্রভাবিত হয়ে-এই লোভ মারাত্মক আকার ধারণ করে? দুজনের জীবনীতে সব থেকে যেটা সাধারন গ্রাউন্ড-সেটা হচ্ছে দুজনেই মনে করতেন রাষ্ট্র এবং আদর্শের দাম মানুষের প্রাণের থেকে বেশী। একাধিবার দুজনেই বলেছেন মানুষ মরণশীল, তাই রাষ্ট্রের প্রগতির জন্যে মানুষের প্রাণ গেলে তা নিয়ে কান্নাকাটি করে বোকারা। স্যোসাল ডারুনিজমে বিশ্বাসী এ এক মারাত্মক কাল্ট অব ডেথ। হিটলার মনে করতেন জার্মানজাত যেহেতু পৃথিবী সেরা, বাকী নীচু জাতের সম্পূর্ণ বিলোপ “বিজ্ঞান সম্মত”। স্ট্যালিনের ক্ষেত্রে সেটাই ছিল শ্রেণী শত্রু-কুলাক বা একটু সম্পন্ন চাষিরা। প্রতিবিপ্লবে অভিযুক্ত লোকেরা। আসল ঘটনা হচ্ছে, সেসব ও ঠিক না-স্টালিনের সময় শ্রেফ কোটা ঠিক করতেই, কোটি কোটি নিরাপরাধ লোকের প্রাণ গেছে-যারা না ছিল কুলাক, না ছিল প্রতিবিপ্লবী। যদিও বলাই বাহুল্য-এবং আমি আগেই লিখেছি, জীববিজ্ঞান এবং বিবর্তন থেকে আমরা সম্পূর্ণ উলটো সংবাদই পায়। পর্যাপ্ত খাবার থাকলে পশুরা, নিজেদের প্রজাতিকে প্রায় আক্রমন করেই না, লিভ এবং লেট লিভ-অধিকাংশ স্তন্যপায়ীর জীবন দর্শন। সেই জন্যেই স্যোশাল ডারুনিজম পৃথিবীর সব থেকে ভয়ংকরতম রাজনৈতিক মতবাদ-যা মানুষকে পশুর থেকেও অধম বানিয়েছে। অথচ এর সাথে ডারুনিজমের কোন সম্পর্ক নেই।
ছবি-১-লেনিন এবং ট্রটস্কি আড্ডা দিচ্ছেন
লেনিনের মৃত্যুর পর, স্টালিনের সাথে ট্রটস্কির দ্বন্দ বহুল প্রচলিত হলেও, আসল সত্যটা একটু অন্য। আমরা দুই ভাবে এটাকে দেখবো।
প্রথমত, জোসেফ স্ট্যালিনকি আদর্শবাদের বিশুদ্ধতার কারনে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নেমেছিলেন? ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি স্টালিন নাকি আদর্শবাদি কম্যুনিউস্ট! শোধনবাদের বিরুদ্ধেই তার যত লড়াই খুন খারাপি!
ভুল। এসব আসলেই রটনা। আসল সত্য সম্পূর্ণ বিপরীত।
স্ট্যালিন মোটেও বিশুদ্ধ আদর্শবাদি ছিলেন না। একদম প্রথম থেকেই ছিলেন বাস্তববাদি। ১৯২১ সালে ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত অন্তত তিনবার মেনশেভিকদের সাথে জোট বাঁধার চেস্টায় প্রমান হবে, স্ট্যালিন আসলেই বাস্তববাদি লোক-তাত্ত্বিক জ্ঞানের চেয়ে, বাস্তবকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশুদ্ধ রাজনৈতিক মতবাদে বরং বিশ্বাস করতেন লেনিন-তাই তিনটি ক্ষেত্রেই মেনশেভিকদের সাথে হাত মেলানোতে তিনিই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
(১)১৯০৯ সালের মার্চে জারের পুলিস, প্রায় প্রতিটি বলশেভিক নেতাকে ট্রেস করে ফেলে। বলশেভিকদের রাশিয়াতে টেকা দায়। সেই সময়, জারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মেনশেভিকদের সাথে হাত মেলাতে চেয়েছিলেন স্টালিন, যা লেনিন নাকচ করেন।
(২) দ্বিতীয়বার ১৯১২ সালের জুলাই মাসে জারের দমন নীতির বিরুদ্ধে, স্টালিন বলশেভিক এবং মেনশেভিকদের এক হওয়ার ডাক দিলেন পার্টির মুখপাত্র প্রাভদাতে। মেনশেভিক নেতাদের সাথে জোট বন্ধন ও করে ফেলেছিলেন-কিন্ত এবার লেনিন দারুণ রেগে গেলেন। প্রাভদার সম্পাদক পদ থেকে বহিস্কার করলেন স্ট্যালিনকে। স্ট্যালিন বাধ্য শিষ্যর মতন লেনিনের তিরস্কার মেনে নিলেন[১]।
(৩)তৃতীয়বার একই ঘটনার পুরনাবৃত্তি আমরা দেখবো ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের পরবর্ত্তী সময়ে মার্চ মাসে। সাইবেরিয়ার মধুচন্দ্রিমা বা নির্বাসন থেকে ফিরে এসে লেভ ক্যামেনেভের সাথে হাত মিলিয়ে প্রাভদার পুরানো সম্পাদকমন্ডলীকে সরিয়ে, সম্পাদক হলেন স্ট্যালিন। এবং কেরেনাস্কির সরকারকে সাপোর্ট করে, বিশেষত কেরেনাস্কিকে “সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী” বলে প্রশংসা করে সম্পাদকীয় লিখলেন[১]। শুধু তাই নয়। লেনিন নির্বাসনে থেকেই কেরেনাস্কি সরকারের বিরুদ্ধে বলশেভিক আন্দোলনের ডাক দিয়ে প্রবন্ধ লিখলেন মার্চ মাসে। স্টালিন, ছাপালেন না সেই প্রবন্ধ-সরাসরি লেনিনের বিরুদ্ধে গিয়ে, নাকচ করলেন এই বলে, নির্বাসনে থাকার জন্যে লেনিন গ্রাউন্ড রিয়ালিটি বুঝতে পারছেন না[১]। আমি নভেম্বর বিপ্লব না প্রতিবিপ্লব প্রবন্ধে [২]কেরেনাস্কিকে সমাজতন্ত্রী হিসাবে দেখানোয়, অনেক কম্যুনিউস্টরা আমাকে গালাগাল করেছেন। তারা স্ট্যালিনের এই কেরেনাস্কি স্তুতিকে কি বলে গালাগাল দেবেন? যাইহোক, এপ্রিল মাসে লেনিন ফিরে এসে, বলশেভিক পার্টিকে কেরেনাস্কির বিরুদ্ধে দাঁড় করালেন। স্ট্যালিনকে এবারো বাধ্য করলেন লেনিন।
অর্থাৎ দুটো জ়িনিস খুব পরিস্কার। বলশেভিক এবং মেনশেভিক বিভাজন, একমাত্র লেনিনের জন্যে টিকে ছিল। এবং লেনিনের বিরুদ্ধে বলার মতন বলশেভিক পার্টিতে কেও ছিল না। তার থেকেও বড় কথা স্টালিন নিজেই “শোধনবাদি” ছিলেন-যদিও ওই দোষ দিয়ে নিজে খুন করবেন তার সমস্ত কমরেডদের।
তার থেকেও হাস্যকর হচ্ছে স্ট্যালিন পন্থীরা ট্রটস্কির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার সময় লেলিনের লেখা দুটি চিঠি দেখান। যেখানে ট্রটস্কিকে দলবাজির জন্যে তিরস্কার করেছেন লেনিন। অথচ বাস্তব সত্য হচ্ছে লেনিনই সব থেকে বেশী দলবাজি করেছেন ক্ষমতার লোভে-তার জন্যেই বলশেভিক, মেনশেভিকরা এক হতে পারেন নি। এমন কি ট্রটস্কি ১৯০৫ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত মেনশেভিক ও বলশেভিকদের একত্রিত করতে, অনেক চেস্টা করেছেন। স্ট্যালিন বা ট্রটস্কি দুজনের কেওই দলবাজি আগে করেন নি-বিপ্লবকেই গুরুত্ব দিয়েছেন আগে। তাদের দলবাজি পর্ব শুরু হয়, লেনিন স্ট্যালিনের মধ্যে ক্ষমতার বীজ পুঁতলে। স্ট্যালিনকে ক্ষমতালোভি দৈত্য বানানোর পেছনে, সবথেকে বড় হাত লেনিনের।
১৯১৭ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত স্ট্যালিন এবং ট্রটস্কি দুজনেই বিপ্লবকে প্রতিষ্ঠিত করতে এত নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছেন- লেনিনের হাতে তিরস্কৃত হোন তাদের বর্বরোচিত কাজের জন্যে। জর্জিয়ার ওপর দমন নীতি-এবং কৃষকদের ওপর অত্যাচার করে খাদ্য সংগ্রহের কাজে স্টালিন এত দুর্নাম কুড়িয়েছেন তখন, লেনিন মুখরাক্ষার্থে স্টালিনকে তিরস্কার করতে বাধ্য হন (১৯১৯)[৩]। এদিকে গৃহযুদ্ধ জিতে রেড আর্মির সর্বাধিনায়ক হিসাবে, ট্রটস্কি পার্টিতে নিজের পজিশন শক্ত করেছেন -এমন কি পোলান্ডে স্ট্যালিনের ব্যার্থতার বিরুদ্ধে ট্রটস্কির সমালোচনাও পার্টি গ্রহণ করেছে। মনে রাখতে হবে, লেনিনের ঘনিষ্ঠ সার্কলে ট্রটস্কিকে তখন ও সন্দেহ এবং ঈর্ষার চোখে দেখা হচ্ছে। কারন ট্রটস্কি বলশেভিক পার্টিতে যোগ দেন ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে-যদিও লেনিনের সাথে তার বন্ধুত্ব এবং কর্মকান্ড সেই ১৯০২ সাল থেকে। আসলে মেনশেভিক এবং বলশেভিকদের মিলন সম্ভব-এমন ধারনার বশবর্ত্তী হয়েই ট্রটস্কি অনেক পরে বলশেভিক পার্টিতে যোগ দেন। যার জন্যে পার্টিতে তার উত্থানে সবথেকে রুষ্ট ছিলেন, আরেক তাত্ত্বিক-লেভ ক্যামেনেভ। এবং এটাও ঈর্ষার দ্বন্দ-আদর্শবাদের দ্বন্দ মোটেও না। কারন লেনিনের পরবর্ত্তীতে তাত্ত্বিক নেতা কে হবেন-সেই পজিশনটা যখন ট্রটস্কি নিয়ে নিচ্ছিলেন, তখনই রুষ্ট হন ক্যামেনভ। ট্রটস্কি আনুষ্ঠানিক ভাবে বলশেভিক পার্টীতে যোগদানের আগে তিনিই ছিলেন লেনিনের পরে তাত্ত্বিক নাম্বার টু-কে আর নিজের পজিশন হারাতে চাই?
ট্রটস্কির পরবর্ত্তীকালের লেখা থেকে অনেকেরই ধারণা, ট্রটস্কি ছিলেন লিব্যারাল গণতান্ত্রিক-আর স্টালিন স্বৈরাচারী। ১৯২০ সালের বাস্তব সম্পূর্ণ উলটো। বস্তুত ট্রটস্কি ছিলেন অতিবাম-রেড আর্মিকে তিনিই যথাযত নেতৃত্ব দিয়ে দাঁড় করিয়েছিলেন। এবং সেটা করতে গিয়ে, বন্দুকের নলের ডগায় প্রাত্তন সৈনিকদের রেড আর্মিতে ঢোকাতেন। দলছুটদের শাস্তি হত্যা। এবং অবাধ্য হলে স্ত্রী ও সন্তানদের পুলিশ তুলে আনতো সৈন্যদের বাধ্য করাতে। নৃসংশতায় তিনিও কম যাচ্ছিলেন না। যদিও তার মধ্যে মানবিকতাও ছিল-তিনি অকারনে সাধারন মানুষের ওপর অত্যাচার নিশিদ্ধ করেন[৪]। এবং গণতান্ত্রিক ও ছিলেন না ট্রটস্কি। নিজের বিরুদ্ধ মতামত মোটেও সহ্য করতে পারতেন না [৫]। ১৯২০ সালে লেনিনের সাথে বিরোধ বাধল ট্রেড ইউনিয়ান নিয়ে। ট্রেড ইউনিয়ান ভেঙে দিতে চাইলেন ট্রটস্কি। তার বক্তব্য ছিল রাষ্ট্রই যখন শ্রমিকদের, ট্রেড ইউনিয়ান দরকার নেই। লেনিন দ্বিমত পোষন করলেন। লেনিন ও আসলেই ট্রটস্কিতে অতটা পছন্দ করতেন না-কারন ট্রটস্কি ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির বুদ্ধিজীবি।
স্ট্যালিনকে ডাকলেন লেনিন। এবং দেখলেন যেহেতু ক্যামেনভ এবং স্ট্যালিন দীর্ঘদিন একসাথে কাজ করেছেন এবং উভয়েই ট্রটস্কিকে অপছন্দ করেন, এদেরকেই ট্রটস্কির বিরুদ্ধে লাগানো যাক। লেনিনের সাপোর্টে তেশরা এপ্রিল, ১৯২২ সালে পার্টির দশম পার্টি কংগ্রেসে, স্ট্যালিন জেনারেল সেক্রেটারি মনোনীত হলেন। এখান থেকেই ক্ষমতার ভুত স্ট্যালিনের মাথায় চেপে বসল। এবং বসালেন স্বয়ং লেনিন। নইলে ট্রটস্কিরই জেনারেল সেক্রেটারী হওয়ার কথা।
লেনিনের তখন অথর্ব। গোর্কির বাগান বাড়িতে স্ট্যালিনের মাধ্যমেই পার্টির সব নির্দেশ পাঠাতেন। ট্রটস্কি তখনও রেড আর্মির সর্বাধিনায়ক। যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে ট্রটস্কির সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন লেনিন। এবং এখানেই স্ট্যালিনের সাথে লেনিনের শেষ এবং সিরিয়াস গন্ডোগল বাধল। ট্রটস্কির সাথে যোগাযোগ রাখার কাজ করতেন লেনিনের স্ত্রী নাডেজা ক্রুপস্কা। স্টালিন জানতেন না, ক্রুপস্কা এই কাজ করছেন লেনিনেরই নির্দেশে। ফলে ক্রপস্কার সাথে একদিন তার প্রচন্ড ঝগড়া বাধল-এবং পার্টি বহির্ভুত কাজের জন্যে ক্রুপস্কাকে “সিফিলিটিক হোর” অর্থাৎ “যৌনরোগ বাধানো বেশ্যা” বলে গালাগাল দিলেন[৬]। আসলে মেয়েদের বেশ্যা বলে গালাগাল দেওয়া স্ট্যালিনের পুরানো অভ্যেস।
ছবি-২ঃ লেনিন এবং তার স্ত্রী ক্রুপস্কা-যিনি নিজেও একজন বড় মার্ক্সবাদি দার্শনিক ছিলেন
ক্রুপস্কা তখন মহাখাপ্পা। লেনিন ও পুরো ঘটনা জেনে অগ্নিশর্মা। স্ট্যালিনের অবজেকশন অন্যায় কিছু ছিল না। সত্যিইত-তাকে পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী করা হয়েছে। রেড আর্মির সব নির্দেশ তার হাত দিয়েই ট্রটস্কির হাতে যাওয়ার কথা। এখন লেনিন তাকে পুতুল জেনারেল সেত্রেটারী বানিয়েছেন বলে কি, তারজন্যে প্রটোকোল মানা হবে না? আর মেয়েদের বেশ্যা বলে গালাগাল দেওয়াটা তার জর্জিয়ান অভ্যেস! পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অভ্যেস কি আর কম্যুনিজম দিয়ে ধোয়া যায়?
সে যাইহোক লেনিন বুঝলেন স্ট্যালিনের মতন কর্কশ স্বৈরাচারীর হাতে পার্টি নিরাপদ না। স্ট্যালিনকে জেনারেল সেক্রেটারি থেকে সরানোর অনুরোধ জানালেন ১৯২৩ সালের এপ্রিল পার্টি কংগ্রেসে [৭]। সমস্যা হচ্ছে লেনিনের সেক্রেটারীকে আগেই হাত করেছিলেন স্টালিন-ফলে বিপদ আসছে জানতে পেরে, পলিটবুরোতে ক্যামেনভ এবং জিনোভিয়েভের সাথে হাত মিলিয়ে পার্টি কংগ্রেসে স্ট্যালিনকে হঠানোর জন্যে লেনিনের টেস্টামেন্ট পড়তেই দিলেন না। এদিকে ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে লেনিনের স্ট্রোক হল। ক্রপস্কা লেনিনকে নিয়ে এত ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন, স্টালিনের এই চেপে দেওয়া আটকাতে ব্যার্থ হলেন। কিন্ত লেনিনের এই লাস্ট টেস্টামেন্টের জন্যেই স্ট্যালিনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল আটকে থাকবে আরো পাঁচ বছর। ১৯২৪ সালে ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেসে লেনিনের লাস্ট টেস্টামেন্ট পড়াতে বাধ্য করলেন ক্রপস্কা। কি লেখা ছিল তাতে? স্টালিনের স্বৈরাচার এবং অন্যান্য কমরেডদের ক্ষমতার লোভের তীব্র সমালোচনাঃ
Comrade Stalin, having become Secretary-General, has unlimited authority concentrated in his hands, and I am not sure whether he will always be capable of using that authority with sufficient caution. Comrade Trotsky, on the other hand, as his struggle against the C.C. on the question of the People’s Commissariat of Communications has already proved, is distinguished not only by outstanding ability. He is personally perhaps the most capable man in the present C.C., but he has displayed excessive self-assurance and shown excessive preoccupation with the purely administrative side of the work.
These two qualities of the two outstanding leaders of the present C.C. can inadvertently lead to a split, and if our Party does not take steps to avert this, the split may come unexpectedly.
——
——
Stalin is too rude and this defect, although quite tolerable in our midst and in dealing among us Communists, becomes intolerable in a Secretary-General. That is why I suggest that the comrades think about a way of removing Stalin from that post and appointing another man in his stead who in all other respects differs from Comrade Stalin in having only one advantage, namely, that of being more tolerant, more loyal, more polite and more considerate to the comrades, less capricious, etc. This circumstance may appear to be a negligible detail. But I think that from the standpoint of safeguards against a split and from the standpoint of what I wrote above about the relationship between Stalin and Trotsky it is not a [minor] detail, but it is a detail which can assume decisive importance.
অর্থাৎ স্ট্যালিন যে ভবিষ্যতে দৈত্য হয়ে উঠবেন, সে ব্যাপারে লেনিন নিশ্চিত হয়ে গেছেন মৃত্যুর আগে। পার্টিকে সাবধানও করলেন সেই মোতাবেক। সমস্যা হল, নিজের স্ত্রীকে গালাগাল না করা পর্যন্ত লেনিন বোঝেন নি স্ট্যালিন একটি দৈত্য? ১৯১৭-১৯১৯ । এই তিন বছর স্ট্যালিন রাশিয়ায় গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়েছেন-কৃষকদের ওপর স্টীম রোলার চালিয়েছেন। পাঁচ লাখ কৃষক স্ট্যালিনের অত্যাচারে তখনই প্রাণ হারিয়েছে। লেনিন তাকে মৃদু বকে ছেড়ে দিয়েছেন। এমনকি তাকে পার্টির শীর্ষপদেও বসিয়েছেন। আর যেই নিজের স্ত্রী স্ট্যালিনের হাতে বেশ্যা বলে গালাগাল খেল, শুধু সেই জন্যেই স্ট্যালিন হয়ে গেলেন ভিলেন! পাঁচ লাখ কৃষকের হত্যার রক্তে লেনিনের উপলদ্ধি হয় নি-নিজের স্ত্রীর অপমানে হুঁস ফিরলো প্রলেতারিয়েত মহান নেতা লেনিনের! যাকে সমস্ত কমিনিউস্ট সাহিত্য ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছে! আসলে কম্যুনিজমের ইতিহাস খুব নিখুঁত ভাবে পড়লে বোঝা যায় প্রতিটা নেতাই ছিলেন ক্ষমতালোভি কুকুর। ক্ষমতা হাঁসিল করতে মহান আদর্শবাদের আলখাল্লা পরে ঘোরাফেরা করতেন। সাচ্চা আদর্শবাদিরা কোনদিনই কম্যুনিউস্ট পার্টিতে টেকে নি। মেরে ফেলা হয়েছে তাদের-ক্ষমতা ভোগ করেছে তারাই, যারা ক্ষমতার জন্যে লালায়িত ছিলেন। লেনিন এই মহান ট্রাডিশনের কোন ব্যাতিক্রম নন।
অবশ্য ১৯২৮ সালের পর এই ডকুমেন্ট চেপে দেওয়া হবে স্ট্যালিনের নির্দেশে। ১৯৩৩ সালে ক্রুপস্কার সন্দেহজনক অবস্থায় মৃত্যু হয়। লেনিনের স্ত্রীয়ের এই মৃত্যুর পেছনেও স্ট্যালিনের হাত আছে বলে শোনা যায়। সমস্যা হচ্ছে স্ট্যালিনের জমানা এত কিছু চেপে গেছে-কি সত্যি আর কি রূপকথা তা ঠিক করাই এক গোয়েন্দা রহস্য [৬]।
লেনিনের এই চিঠি স্ট্যালিনের জন্যে মৃত্যুবানই ছিল। ফলে এই চিঠির জেরে জেরবার হল আরো তিন কংগ্রেস। স্ট্যালিন এখানেই খেল দেখালেন। প্রথমত পার্টির লিব্যারেল উইং-যার নেতৃত্বে ছিলেন বুখারিন, তার সাথে হাত মেলালেন স্ট্যালিন- ট্রটস্কিকে আটকাতে। সবথেকে বড় কথা ক্ষমতার খেয়োখেয়ি, এবং অন্যের দিকে কাদা ছোঁড়া যখন অব্যাহত, চতুর্দশ কংগ্রেসে তিনি সবাইকেই বকা দিলেন, নিজের কৃতকর্মের ও সমালোচনা করলেন। এবং “শুধু রাশিয়ার জন্যে স্যোশালিজম” বা ন্যাশানাল স্যোশালিজম যা আদতেই কোন মার্ক্সীয় দর্শন হতে পারে না-সেটার মাধ্যমে জাতিয়তাবাদকেই সুরসুরি দিয়ে নিজের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করলেন। এটা ভীষন দরকার ছিল স্ট্যালিনের জন্যে। এক ঢিলে তিন পাখি মরল। কমিনিউস্ট পার্টতে জেনারেল সেক্রেটারীর রোল তাত্ত্বিকের-সেখানে স্টালিনের পরিচিতি সফল প্রশাসক হিসাবে। কেও তাকে এতদিন তাত্ত্বিক হিসাবে ভাবে নি। সেই খামতি পূরণ করলেন। জাতিয়তাবাদ এনে রাশিয়ান লবি ম্যানেজ করলেন। এবং এটাকে লেনিনের চিন্তার উত্তরাসূরী হিসাবে দেখালেন। যেখানে ট্রটস্কির পৃথিবীব্যাপি বিপ্লবের অতিবিপ্লবী চিন্তা বাকিদের কাছে অবাস্তব কল্পনাবিলাসীর মতন শোনালো।
ছবি৩-বুখারীন-প্রাভদার সম্পাদক এবং লিব্যারাল বলশেভিকদের নেতা-একেও খুন করবেন স্ট্যালিন
জিনোভিয়েভ এবং ক্যামেনকভ, এই দুজনে স্ট্যালিনের সাথে জুটি বেঁধে ছিলেন ট্রটস্কিকে আটকাতে। এদের বলে ত্রৈকা। এরা দুজনেই তাত্ত্বিক-তাই ঈর্ষা উদ্ভুত ক্ষমতার লোভে ট্রটস্কির সাথে নোংরা বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। স্টালিন কোন তাত্ত্বিক ডীবেটে অংশই নিলেন না। ফলে ইমেজ হারালেন ক্যামেনকভ, জিনোভিয়েভ এবং ট্রটস্কি। চুপচাপ থেকে লাভ হল স্ট্যালিনের। আসলে ত্রৈকার সাথে ট্রটস্কির বিরোধ এক উত্তেজক উপন্যাস। একটা প্যারাগ্রাফে সারা অসম্ভব। তাও নিজের দুকথা বলি।
কমিনিউস্ট পার্টিতে সেক্রেটারী জেনারেলের ক্ষমতা বড্ড বেশী। ট্রটস্কিকে কোনঠাসা করতে এবং লেনিনের লাস্ট টেস্টামেন্টকে নিউট্রালাইজ করতে অভূতপূর্ব বুদ্ধিমত্তার সাথে এই পজিশন ব্যাবহার করেছেন স্ট্যালিন। প্রথমত ক্যামেনকভ আর জিনোভিয়েভের সাথে ট্রটস্কির কাজিয়া ইচ্ছা করে লাগিয়েছেন এবং ম্যানুপুলেট ও করেছেন। ক্যামেনভ ১৯২২ সালেই লেনিনকে আর্জি জানান ট্রটস্কিকে সরাতে হবে। লেনিন বড় মাপের নেতা ছিলেন-ধমক দিলেন ক্যামেনকভকে। আসলে ক্যামেনকভ এবং জিনোভিয়েভ অক্টবর বিপ্লবের বিরুদ্ধেই ছিলেন। কিন্তু লাভের গুড় খাওয়ার বেলায়, ক্ষমতার পিঁপড়ের মতন, লেনিনের অনুগত হলেন। এদের নিউট্রাইজ করতে, অক্টবর বিপ্লবে তাদের ভূমিকা, জনসমকক্ষে ফাঁস করেন ট্রটস্কি[৮]।
ফলে ১৯২৩ সালের দ্বাদশ পার্টি কংগ্রেসে স্ট্যালিনের সাহায্যে এরা ট্রটস্কিকে বসিয়ে রাখলেন। এই ত্রৈকাই সেবারের কনফারেন্স নিয়ন্ত্রন করল-ট্রটস্কি কয়েক মিনিট বলার সুযোগ পেলেন-তাতেই প্রচুর হাততালি পড়ল। স্ট্যালিন নিজের মহাত্ম্য প্রচারের সুযোগ পেলেন। অন্যদিকে প্রাভদার সম্পাদনায় তখন বুখারীন। প্রাভদাতেও ট্রটস্কির লেখা আটকে দেওয়া হল কারন বুখারীন এবং স্টালিন জ়োট বেঁধেছেন ট্রটস্কিকে আটকাতে। অন্যান্য পত্রিকা রাশিয়াতে বন্ধ। ফলে ট্রটস্কি তখন চেকমেট [৮]।
তবুও ট্রটস্কি তখন ক্ষমতাশুন্য নন। রেড আর্মির সর্বাধিনায়ক। ফলে ক্যু ঘটিয়ে আরেকটা বিপ্লব করে এদের সরাতে পারতেন। কিন্ত ট্রটস্কি ছিলেন পার্টির প্রতি নিবেদিত প্রাণ-তাকে এই ত্রৈকা যখন কোনঠাসা করে ফেলেছে, তখনও পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্যে তিনি ১৯২৪ সালের পার্টি কংগ্রেসে আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ একেই স্ট্যালিনিস্টরা বলবেন ফ্যাকশনালিস্ট!
The party in the last analysis is always right because the party is the single historic instrument given to the proletariat for the solution of its fundamental problems. I have already said that in front of one’s own party nothing could be easier than to say: all my criticisms, my statements, my warnings, my protests–the whole thing was a mere mistake. I, however, comrades, cannot say that, because I do not think it. I know that one must not be right against the party. One can be right only with the party, and through the party, for history has created no other road for the realization of what is right.-ট্রট-১৯২৪ সালের পার্টি কংগ্রেসে ভাষন।
যাইহোক কোনঠাসা অবস্থায় ট্রটস্কিও পালটা চাল দিলেন। তার ভরসা তখন পার্টির সদস্যরা। কারন সেন্টাল কমিটি ত্রৈকা ম্যানেজ করে ফেলেছে। প্রাভদা তার লেখা ছাপাচ্ছে না।
১৯২৩ সালে রাশিয়ার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে, শ্রমিক অসন্তোশ সেই সুযোগ এনে দিল। পার্টির অসন্তুষ্ঠ কমরেডরা দুটি সিক্রেট গ্রুপ তৈরী করে-ওর্কার’স ট্রূথ এবং ওয়ার্কার’স গ্রুপ। সোভিয়েত পুলিশ এদের পিটিয়ে জেলে পুরে দিল প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য। ১৯২৩ সালের সেপেটম্বর মাসে জার্মানীতে কম্যুনিউস্ট অভ্যুত্থান ব্যার্থ হল। শ্রমিকদের মধ্যে কম্যুনিউস্ট নেতাদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ লক্ষ্য করলেন ট্রটস্কি-এবং পার্টিকে চিঠি দিলেন, এই ভাবে চললে এটা বুরোক্রাটদের পার্টি হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকদের পার্টি এটা আর নেই। তাই পার্টিতে গণতন্ত্র দরকার।
In the fiercest moment of War Communism, the system of appointment within the party did not have one tenth of the extent that it has now. Appointment of the secretaries of provincial committees is now the rule. That creates for the secretary a position essentially independent of the local organization. […] The bureaucratization of the party apparatus has developed to unheard-of proportions by means of the method of secretarial selection. There has been created a very broad stratum of party workers, entering into the apparatus of the government of the party, who completely renounce their own party opinion, at least the open expression of it, as though assuming that the secretarial hierarchy is the apparatus which creates party opinion and party decisions. Beneath this stratum, abstaining from their own opinions, there lays the broad mass of the party, before whom every decision stands in the form of a summons or a command.
বাকী কমিনিউস্ট নেতারাও ত্রৈকার অগণতান্ত্রিক কাজে অখুশী-তারাও গলা মেলালেন পার্টির বুরোক্রাটিক নেতৃত্বের ব্যাপারে [৮]
[…] we observe an ever progressing, barely disguised division of the party into a secretarial hierarchy and into “laymen”, into professional party functionaries, chosen from above, and the other party masses, who take no part in social life. […] free discussion within the party has virtually disappeared, party public opinion has been stifled. […] it is the secretarial hierarchy, the party hierarchy which to an ever greater degree chooses the delegates to the conferences and congresses, which to an ever greater degree are becoming the executive conferences of this hierarchy.
ত্রৈকা সাময়িক ভাবে পিছু হটল। কিন্তু ক্ষমতা তাদের হাতে। তাই ১৯২৪ সালের পার্টি কংগ্রেসে ট্রটস্কির বিরুদ্ধে দলবাজির অভিযোগ আনা হল।
একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। পার্টিতে তখন গণতন্ত্র চাইছিলেন বলেন ট্রটস্কিকে শোধনবাদি বলে গালাগাল দেন আজকের স্টালিনিস্টরা।
কিন্তু বাস্তবটা কি? ট্রটস্কি আসলে ১৯২০ সালে ট্রেড ইউনিয়ানও বন্ধ করতে চাইছিলেন! হঠাৎ করে তার এত গণতন্ত্র প্রেম জাগল কেন? উত্তরটা পরিস্কার। শোষনবাদ বা আদর্শবাদ সব কমিনিউস্টদেরই আদর্শবাদের আলখাল্লা-আসল রংটা ক্ষমতা দখলের।
যাইহোক ১৯২৪ সালের কংগ্রেসেও খেয়োখেয়িটা সামনে এল না। লেনিন সদ্য প্রয়াত বলে, চক্ষুলজ্জার খাতিরেই, মৃত মহান নেতার শ্রদ্ধাঞ্জলিতে একটা ঐক্যের চেস্টা হল। স্টালিন পলিটবুরো থেকে সেন্ট্রাল কমিটি সর্বত্র নিজের লোক ঢোকাতে লাগলেন। ট্রটস্কির শরীর ভেঙে পড়ে। উনি ছুটিতে গেলেন। লেনিনের মৃত্যু সংবাদ ট্রটস্কি জানলেন স্ট্যালিনের কাছ থেকে, কিন্তু লেনিনের ফুনারেলে যাতে ট্রটস্কি না থাকতে পারেন, তার জন্যে ভুল একটা ডেট জানানো হল তাকে! তার অসুসস্থতার সুযোগে, রেড আর্মির সর্বাধিনায়ক পদ থেকে তাকে ছেঁটে ফেলা হল[৮]। সেটা জানুয়ারী, ১৯২৫। ক্যামেনকভ, পলিটবুরো এবং পার্টির সেন্ট্রাল কমিটি থেকে ট্রটস্কিকে ছাঁটতে চাইলেন। স্টালিন চাইলেন না। অপূর্ব ম্যনিপুলেশনে খেলছেন তখন স্ট্যালিন। তার ইমেজ উজ্জ্বল হচ্ছে-ক্যামেনকভ তার কাজ করছেন এবং নিজে ডুবছেন [৫]।
ট্রটস্কিকে আটকালেন সবাই মিলে। এবার কি হবে? বাকিরা ত আর আদর্শের জন্যে ট্রটস্কির বিরোধিতা করেন নি-করেছেন ট্রটস্কিকে আটকাতে-কারন ট্রটস্কি থাকলে, তারা সবাই আস্তাকুড়ে থাকতেন। ট্রটস্কিকে বসানো মাত্র খেয়োখেয়ি শুরু হল ত্রৈকার নিজেদের মধ্যে।
১৯২৫ সালের চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেসে শুরু হল সেই খেওখেয়ি। এবার জিনোভিয়েভ এবং ক্যামেনিকভ কে সরানোর জন্যে পার্টির মধ্যে লিব্যারাল গ্রুপ-বুখারীন, রাইকভ এবং টমস্কির সাথে স্টালিনের চুক্তি হল। “স্যোশালিজম ইন ওয়ান কান্ট্রীর “ নামে স্ট্যালিনের বিকৃত ন্যাশানাল স্যোশালিজম তত্ত্ব এই পার্টি কংগ্রেসেই পাশ হয়। জিনেভিয়েভ এবং ক্যামেনকভ স্ট্যালিনকে সরানোর জন্যে লেনিনের স্ত্রীর সাথে জোট বাঁধলেন। ফলে ১৯২৭ সালে কংগ্রেসে তারা পার্টি থেকে বিতাড়িত হলেন। ট্রটস্কিও পার্টি থেকে বিতাড়িত হলেন। শেষমেশ স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে তারা রেডস্কোয়ারে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ দেখাতে বাধ্য হন। তারা গ্রেফতার হলেন। ট্রটস্কিকে রাশিয়া থেকেই তাড়ানো হল।হাতে হাতকড়া পরিয়েই তাড়ানো হল-এবং তার ফিল্মও তোলা হল রাশিয়াতে ত্রাসের সৃষ্টির জন্যে। তখনো নির্বিদ্বিধায় খুন খতম করার মতন অবস্থায় আসেন নি স্ট্যালিন। ১৯২৮ সালের কংগ্রেসে, বুখারীন, রাইকভদের তাড়ালেন পলিটবুরো থেকে। অসংখ্যা পার্টি কর্মীকে তাড়ানো হল ট্রটস্কির সমর্থক সন্দেহে। কারন, তাদের সাহায্য আর তার প্রয়োজন নেই। এইভাবে ১৯২৮ সালের মধ্যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হলেন স্টালিন। তবে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার ক্ষমতা বা খুন খারাপি করার ক্ষমতা তখন ও আসে নি। সেটা হবে প্রেট পার্জের পর। তা নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করব। কি করে অক্টবর বিপ্লবের ৯২% নেতাকে স্ট্যালিন খুন করবেন। ১৯১৭ সালে যারা বলশেভিক বিপ্লব করেছিলেন, তারা যদি একবারো জানতেন-গণতন্ত্রকে ধ্বংশ করে শুধুই দৈত্যই তৈরী হয়! জারের আমলে তাদের কে বড়জ়োর সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হত-সেখানে প্রেমটেমও তারা করতেন। আর নিজেদের বৈপ্লবিক আমলে-তাদের বিপ্লবী বন্ধুরা একদম ফায়ারিং স্কোয়াডে ফেলবেন! ঈর্ষাত আসলে আদর্শবাদি শত্রুদের চেয়ে আর ভয়ংকর রোগ-এটাই আসল বৈজ্ঞানিক সত্য!
১৯২৮ সালের পর থেকেই স্ট্যালিন সোভিয়েতকে পুলিশ স্টেট বানানো শুরু করলেন। গীর্জায় যেখানে যীশুর ফটো ঝুলছিল, সেখানে তার ফটো লাগানো হল [৯]। রেডীও এবং সংবাদপত্রে তার জয়গান সারাদিন। অবস্থা এমন স্ট্যালিন বক্তৃত্তা দিতে উঠলে, হাততালি থামত না। মানে কেও থামাতে সাহস পেত না। যে প্রথমে থামবে, সে প্রতিবিপ্লবী বলে ধরা পড়তে পারে [৯]। সমস্ত লেখককে স্টালিন স্তুতিতে বাধ্য করা হল। ১৯২৮ সালের পরে রাশিয়াতে এন কে ভিডী বা সিক্রেট পুলিশ কিভাবে জনমানসে সন্ত্রাস সৃস্টি করে এবং দুর্ভিক্ষে একের পর সোভিয়েত প্রদেশে গণহত্যা সংগঠিত হয়, তা নিয়ে পরের সংখ্যায় আলোচনা করব।
তুলনামুলক ভাবে হিটলারের ক্ষমতা উত্থান অনেক অনেক মসৃণ। কারন পার্টিতে তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য একমাত্র নেতা। জেল খেটে ফেরার পর মেইন ক্যাম্প লেখার দৌলতে তিনি তখন জনপ্রিয় –তাই রাইমার রিপাবলিকে শ্রেফ গণতান্ত্রিক পথেই ক্ষমতা দখল করেন তিনি। বিরোধিদের হত্যা এবং গণতন্ত্রকে ধ্বংশ করা শুরু হবে ১৯৩৩ সালের পর থেকে-যখন গণতন্ত্রের পথেই তিনি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়েছেন।
Nazi Party Election Results |
||||
Date |
Votes |
Percentage |
Seats in Reichstag |
Background |
1,918,300 |
6.5 |
32 |
হিটলার জেলে |
|
907,300 |
3.0 |
14 |
জেল থেকে মুক্তি |
|
810,100 |
2.6 |
12 |
|
|
6,409,600 |
18.3 |
107 |
জার্মানির অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরে |
|
13,745,800 |
37.4 |
230 |
প্রথম প্রেসিডেন্সি ক্যান্ডিডেট |
|
11,737,000 |
33.1 |
196 |
|
|
17,277,000 |
43.9 |
288 |
চ্যান্সেলর থাকার সময় |
এই তথ্য থেকে পরিস্কার- ১৯৩০ সালের গ্রেট ডিপ্রেশন হিটলারের কাছে ছিল সবথেকে বড় আর্শীবাদ। হতাশ জনগণের কাছে হিটলারের “শত্রুতত্ত্ব” – ভার্সাই এর চুক্তি জার্মানদের দুরাবস্থার জন্যে দায়ী-সেটাই সব থেকে বেশী খেয়েছে। সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে, সেই সময় নাজিদের ঠেকানোর মতন কেও ছিল না। জার্মান কমিনিউস্টরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতন এখানেও জন বিচ্ছিন্ন। জণগণ চাইছে চাকরী-এরা শোনাচ্ছিলেন বলশেভিক বিপ্লবের গল্প। তা এদের আর কে পাত্তা দেবে! খ্রীষ্ঠান রক্ষনশীল নেতা প্যাপেন, তাও একটু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন-কিন্তু কি করে দেবেন? সবাই যে নাজিদের জনপ্রিয় এজেন্ডাতে মহিমান্বিত! এমনকি ১৯৩১ সালে প্রচুর প্রপাগান্ডা করতে গিয়ে নাজি পার্টির ফান্ড যখন শুন্য-স্থানীয় ব্যাবসাদাররা ধার মকুব করে দিলেন! এরা কম্যুনিউস্টদের পেটাচ্ছে, ইহুদিদের শাসাচ্ছে, ভার্সাই চুক্তি যা জার্মানীকে শোষন করার চুক্তি, তা মানবে না বলছে! আর কি চাই? ২৭ শে ফব্রুয়ারী,১৯৩০। এক কমিনিউস্ট রাইখে আগুন ধরানোর চেষ্টা করতেই, বিরোধি রাজনীতি বন্ধ করার ছূতো পেয়ে গেলেন গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত চ্যান্সেলর হিটলার, যিনি বছর খানেক আগেও জার্মান নাগরিকই ছিলেন না! ১৪ই জুলাই, ১৯৩৩ সালে বাকি সবপার্টিকে নিশিদ্ধ করা হল। ট্রেড ইউনিয়ান নিশিদ্ধ করা হল। বিরোধি নেতাদের জেলে ভরা এবং হত্যা করা শুরু করল নাজি পার্টি। নাজিদের পুলিশ স্টেট নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করব।
ছবি-৪-প্রথমবার যখন চ্যন্সেলর
এখানে একটা জিনিস উল্লেখ্য। লেনিনও ঠিক একই ভাবে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছিলেন[২]-কিন্ত জনগন তার সাথে ছিল না। তাই লেনিনকে ১৯১৭-১৯১৯, এই দুবছর ধরে গৃহযুদ্ধ করতে হয়েছে। হিটলারকে ওসব কিছু করতে হয় নি-শ্রেফ দুদিনেই বিরোধিদের সাফ করে দিয়েছিলেন। কারন, জনগণ তার সাথে ছিল-বক্তৃতার মাধ্যমে হিটলার তাদের মাথাই ঢুকিয়েছিলেন, একমাত্র তিনিই পারবেন তাদের খেতে দিতে, চাকরি দিতে।
যারা বলেন বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে প্রকৃত ক্ষমতা জণগনের হাতে গেছে-সেটাত ১০০% মিথ্যে কথা বটেই-যদি ধরেও নি, তা সত্য, তাহলেও হিটলারে উদাহরন থেকে বলা যেতে পারে, জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করাও আসলে কোন কাজের কথা না। হিটলারের এই কুকীর্তি, পরে নাশের বা সুহার্তোরাও করবেন।
মোদ্দা কথা কোন যুক্তিতেই সংসদীয় গণতন্ত্রের হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়। যেসব কমিনিউস্টরা পার্টির আভ্যন্তরীন গণতন্ত্রের মাহাত্ম্যে ভরপুর-তাদের জন্যে ১৯১৭ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার ইতিহাস তুলে দিলাম। ওটাকে পার্টির আভ্যন্তরীন গণতন্ত্র না ক্ষমতার মিউজিক্যাল চেয়ার বলবেন? সংসদীয় গণতন্ত্রকে লেনিন যদি শুয়ারে খোয়ার বলেন, তাহলে তার মৃত্যুর পরে বলশেভিক পার্টির আভ্যন্তরীন গণতন্ত্রকে কি ক্ষমতার সার্কাস বলা যায়? স্টালিন শ্রেফ দাবা খেলেছেন। শেষে যখন জিতেছেন পার্টিতে তার সব বিরোধিদের খুন করেছেন। ১৯২৮ সালের আগে অবশ্য তাদের শুধু বহিস্কার করেছেন। এটা কমিনিউস্টদের ইতিহাসে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। চীনেও একই ঘটনা ঘটেছে। পার্টির মধ্যে বিরোধিদের মেরে ফেলা কোন ধরনের গণতন্ত্র? আর এইসব পার্টি গণতন্ত্রের রূপকথা শোনানো আমাদের বঙ্গজ কমিনিউস্টরা কি রাশিয়ার ইতিহাস কিছুই পড়েন নি?
যাইহোক, বঙ্গজ কমিনিউস্টদের সাথে আমার অভিজ্ঞতা বলে এরা না জানে মার্ক্সবাদ, না জানে বলশেভিকদের ইতিহাস। কারন বলশেভিকদের ইতিহাস ঠিকঠাক জানলে, নিজেদের কমিনিউস্ট বলে পরিচয় দিতে এরা লজ্জা পেত।
[১]http://en.wikipedia.org/wiki/Joseph_Stalin
[২]https://blog.mukto-mona.com/?p=136
[৩]Robert Service. Stalin: A Biography. 2004. ISBN 978-0-330-41913-0
[৪]Leon Trotsky, founder of the Red Army, issued a decree (24 October 1919) proclaiming, “Woe to the unworthy soldier who sticks a knife into an unarmed prisoner” (The Military Writings and Speeches of Leon Trotsky, Vol. 2 [1979]).
[৫] http://mars.wnec.edu/~grempel/courses/stalin/lectures/StalinTrot.html
[৬]http://en.wikipedia.org/wiki/Nadezhda_Krupskaya
[৭]On the suppressed Testament of Lenin by Leon Trotsky (written in December 1932, published in 1934, sometimes incorrectly dated as 1926)
[৮]http://en.wikipedia.org/wiki/Leon_Trotsky
[৯] BBC documentary-war of the centuries: when Hitler met Stalin. http://www.youtube.com/view_play_list?p=0A3666F1AAC47487
ধ্যুস! এখানে স্ট্যালিন কত লোক মেরেছে, সেই কথা নিয়েই তো কোন আলোচনা হল না! তাহলে, “স্টালিন বনাম হিটলারঃ ইতিহাসের কুখ্যাততম খুনী কে?” নাম রাখার মানে কি?
I have studied communist leaders quite in depth but I have to agree Che stands out as biggest exception among the monsters and a true soul to his ideals. He denounced powerful position in Cuba when offered and instead chose to set out for Bolivia to organize revolution. Eventually he would be killed but nevertheless a true soul, a man truthful to his ideals and his love for the oppressed of the world must be respected.
A big thanks for a detail writings on communism. A lots of people like me have blind idea about communism that they can make freedom and peace in Bangladesh as well.
May be after reading Biplob’s articles on communism , our eyes will open.
May I request to Biplob to write a article on Che Guavara(probably spelling mistake) who is a icon of communism against democracy. Your writings really open our eyes.