তখন ও এখন
গীতা দাস
(২৫)
স্কুল-কলেজে পড়ার সময় বইয়ের গাঁটের (বাঁধাই করা অংশের) উল্টোদিকে তেরছা করে ধরে বিশেষ কৌশলে বইয়ে নিজের নাম লিখতাম। ঐখানে অনেক বড় করে লিখলেও স্বাভাবিক অবস্থায় তা ছোট দেখাত। তবে তেরছা অবস্থায় লেখার সময় কলমটি একটু বিশেষ কায়দায় ধরে তেরছা করেই লিখতে হত। তা না হলে লেখা যেত না।
এখনও আমার এ অভ্যাসটি রয়ে গেছে। নিজের বই হলে এভাবেই নাম লিখি, তবে নিজের টাকায় কিনলেও পরিবারের সম্পদ হিসেবে এখন বই কিনি। আমার শুধু পড়ার স্বত্ত্ব রাখি। টাকা আমার আর মালিকানা পরিবারের সবার। এবং বই পড়ার স্বত্ত্ব যে কারও। যে বই একান্তই নিজের — অর্থাৎ দাপ্তরিক প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত সেগুলোতেই গাঁটে নিজের নাম লিখি। আগে পাঠ্য বইয়ের বাইরে কেনা বইয়ে কিন্তু বইয়ের পাতা মুড়াবেন না বা ছিঁড়বেন না মন্তব্যসহ নিজের নাম লেখা সীল মেরেছি। তখনকার আমিত্ব আর এখনকার আমিত্বে পার্থক্য বিবেচনা করে নিজেই বিস্মিত হই। বইয়ের মালিকানার ধারণাও পালটে গেছে।
ছোটবেলায় আমার গ্রন্থাগার বিজ্ঞান সম্বন্ধে ধারণা না থাকলেও পাঠ্য বইয়ের ভেতরের একটি নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায়ও নিজের নাম লিখতাম। বইটি চুরি হলেও খুঁজে পাবার ধান্দায়। ছোটবেলায় বই চুরি হতে পারে এমন নেতিবাচক চিন্তা মাথায় আসত। যদিও কখনও এমন কোন ঘটনা আমার ক্লাসে ঘটেনি। কালেভদ্রে ভুলে কারো সাথে কখনো নিজের বই পাল্টে গেলে প্রমাণের জন্যে বইয়ের ভেতরের নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায় নিজের নামটি দেখিয়ে বাহাদুরি করতাম। তখন — ছোটবেলায় বাহাদুরি করার কত ঠুনকো বিষয়ই না ছিল!
এখন! এখনও —- বড়বেলায়ও আমরা অনেকেই কত ঠুনকো বিষয় নিয়েই না বড়াই করি!
আমাদের উঠানে একটা তমাল গাছ ছিল। তুলসী তলার পাশে। ঐটার ফল কাঁচা থাকতে সবুজ ও পাকলে লালাভ হলুদ রঙ হত। খাওয়ার অযোগ্য। আফসোস হত। তমালের বদলে অন্য কোন ফল গাছ লাগালেও তো পারত।
প্রশ্ন করে জেনেছি — তমাল গাছটি লাগায়নি। আপনা আপনি অর্থাৎ নিজে নিজেই উঠেছে। তবে আপনা আপনি উঠলেও পরে অনেক যত্ন পেয়েছে।
উঠান ঝাড়ু দিয়ে তমালের পাতা সাবধানে রাখা হত যাতে উনুনে না যায়। যে গাছের ডালে কৃষ্ণ বসে সে গাছের পাতা পর্যন্ত ভুলেও পুড়ানো মহাপরাধ। কিন্তু কৃষ্ণের বসবাসের গাছের ফল কেন যে খাওয়ার অযোগ্য তা বোধগম্য হত না। কৃষ্ণ বসার ফলে তো তমাল ফল অমৃত হয়ে যাবার কথা। ঠাকুরমাকে বা বোনকে এ প্রশ্ন করলে খেপে যেতেন —- লোভের আর লাভের চিন্তা। বাপ কাকায় যে ফল আনে তা খেয়ে পোষে না। তমালের ফল কেন খাওয়া যায় না এ নিয়ে ঘুম নাই।
সদুত্তরের অভাবে রাগের বহিঃপ্রকাশ। এতো সব সময়েরই কৌশল। চুপ করে যেতাম।
শুধুমাত্র ছোটবেলা বাংলা দ্বিতীয় পত্রের ক্লাসে তমাল গাছটি নিয়ে গর্ববোধ করতাম—–
‘কপোল ভিজে যায় নয়নের জলে
দুই পা বাঁধা আছে তমালের ডালে’
পড়ে খুশী হতাম এই ভেবে যে আমাদের উঠোনের গাছটি বইয়ের পাতায়! ছোটবেলার ছোট্র মন খুশীতে ভরে যেত।
বড়বেলায়ও খুশী হই ঢাকায় কোন ট্রাকের রেজিষ্ট্রেশন নাম্বারে নরসিংদী লেখা দেখলে। কিসের টান যেন উপলদ্ধি করি। নরসিংদীর নাম ঘুরছে বিভিন্ন শহরে। তেমনি ইংল্যান্ডে ব্রিকলেনে দোকানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা দেখে তো আমার চোখে জলই এসে গিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে চারমাস উইনচেষ্টারের কিং আলফ্রড কলেজ ক্যাম্পাস থেকে পরে একদিনের জন্যে ঐখানে গিয়েছিলাম। ইতোমধ্যে আরও কয়েকটি শহর ঘুরলেও বৃটিশ ভূমে আমার প্রথম বাংলা হরফ লেখা দেখা। এটাই কি তবে যথাক্রমে মাটি প্রেম — আঞ্চলিক প্রেম — দেশপ্রেম!
তমাল গাছে দড়ি বেঁধে দোল খেতে গেলেও বড়রা অপছন্দ করত। যদি ডাল ভেঙ্গে যায়!
বলতাম — তমালের ডাল ভাঙলে তো আর কৃষ্ণের হাত পা ভাঙবে না। এতে আরও ক্ষেপে যেতেন আমার বোন। বলতেন — যত সব আজাইরা চিন্তা মাথায় ঘুরে। মুখে কিছু আটকায় না।
তবে তমালের ছায়া ঠান্ডা ছিল। এর তলায় বসে বিভিন্ন খেলা খেলতাম। ঝাঁকড়া ডালপালা ও পাতা বলে রোদ ভেদ করতে পারত না। সুর্যিদেবকে আটকে রাখতো কৃষ্ণের গাছ।
হঠাৎ এবার বাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করলাম উঠানের তমাল গাছটি নেই। যুগের হাওয়ায় অপ্রয়োজনীয় তমাল কেটে ফেলেছে আমার ভাই। কৃষ্ণ সময়ের চাহিদা মিটাতে পারেনি। ঠাকুমার আবেগ ও বিশ্বাস উত্তরাধিকার অর্জন করতে পারেনি। তমালের শিকড় আলোড়িত — বিস্তৃত হতে পারেনি পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত। ঐ জায়গায় এখন একটা নারকেল গাছ। তমাল যে অনেক আগেই কাটা পরেছে এর প্রমাণ নারকেল গাছের আকার। কিন্তু প্রতি বছর বাড়ি গেলেও আমার দৃষ্টির অগোচরে ছিল। আসলে মনের অগোচরেও। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের বলাই গল্পটির কথা মনে পড়ল, তবে বলাইর মত বৃক্ষ প্রেমে নয় বা কৃষ্ণ বিশ্বাসেও তো নয়ই — শৈশবের স্মৃতি হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করলাম।
গীতা দাস
২৭ পৌষ, ১৪১৫/ ১০ জানুয়ারী , ২০০৯
নাসরিনকে ধন্যবাদ আমার লেখা পড়ার জন্য।
আমি দুঃখিত ,না জেনে না বুঝে আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকলে। আপনার ই মেইল ঠিকানা দিলে লিখব।
গীতা দি
আপনার স্মৃতি কথাগুলো পড়লাম। অতি সাধারণ পাঠক আমি, সাধারণ মানুষ। সুখী মানুষ। গত ৫ বছর আগেও আমি ভাবিনি জীবনে হাসি আছে। সবার করুণার পাত্রী ছিলাম আমি। আমার বোনদের অনাগত ভবিষ্যঁত এর বাধা। আজ আমি ভাল আছি। আনেক ভাল। মাঝে মাঝে ভয়ে কেঁপে উঠি হারানোর ভয়ে।
নাসরিন
গীতা দি,
স্মৃতি আমার একটা প্রিয় বিষয়, যারা স্মৃতিকাতর তারা নাকি নতুন কিছু গ্রহণ করতে পারে না, কথাটা আমার কাছে ডাহা মিথ্যা মনে হয়। বরং উলটো, তোমার লেখা পড়ে আবার বিশ্বাস করলাম যে যারা স্মৃতি দ্বারা তাড়িত তারাই নতুনকে সাহসের সাথে গ্রহণ করতে পারে কারণ তারা সৎ।
তোমার লেখা খুব ভাল।
লুনা