লিখেছেন: শিবব্রত গুহ
অনেক নামীদামি সাহিত্যিক, বাংলা সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ। তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি হলেন বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম নাম। তাঁর রচিত উপন্যাস ও ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের পাঠক – পাঠিকাদের খুব প্রিয়। তাঁর লেখনী অনবদ্য। বাংলা সাহিত্যে
, নারী চরিত্র সৃষ্টিতে, তাঁর তুলনা মেলা ভার। তাঁর সৃষ্ট নারীচরিত্রগুলো, এক – একটা অপূর্ব শিল্পরসে সমৃদ্ধ।
শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলো, মনে হয়, সব যেন জীবন্ত। তাঁরা যেন রয়েছে আমাদের সমাজেই। আমাদের পরিবার, সংসারের ভিতরেই তাঁরা যেন আজো বিদ্যমান আছে। অনেক যত্ন করে তিনি এই নারী চরিত্রগুলোর নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর এক একটি নারী চরিত্র, এক এক রকমের। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা নারীসত্তার আধিকারী। যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, নারী যেখানে অবরুদ্ধ, পুরুষের শক্তির কাছে, সে বন্দিনী, তাকে বারংবার হতে হয়েছে ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বলি। নারীর সন্মান যে সমাজে হয় পদে পদে ভুলুন্ঠিত, সেই নারীজাতির ও নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
তাঁর নারী চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে নারীজাতির দয়া, মায়া, মমতা, ক্ষমা, ঔদার্য, সহনশীলতা সহ নানা চিরন্তন গুণগুলি। নারী সত্যিই অপরূপা! তাঁর রূপের নেই শেষ। সে যেমন স্বামী, পুত্র, কন্যা সহ সুন্দরভাবে, একাই তাঁর ঘর সংসার, পারে সামলাতে। ঠিক তেমনি, সে মা দুর্গার মতো অস্ত্র হাতে নিয়ে মহিষাসুরদের বধও করতে পারে। নারী হল অসীম শক্তিশালী। তাঁর শক্তির নেই কোন সীমা-পরিসীমা। শরৎচন্দ্র নারী চরিত্র সৃষ্টি করতে গিয়ে করেছেন নারীজাতির বন্দনা।
শরৎচন্দ্র, তাঁর উপন্যাস, পল্লী সমাজ, অরক্ষণীয়া, দেনা – পাওনা, বড়দিদি ও ছোটগল্প, অনুপমার প্রেম, বিলাসী, ইত্যাদি ছোটগল্পে, নারী চরিত্র, পল্লী বাংলার নানাবিধ ঘাত – প্রতিঘাত, মানবিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক পঙ্গুত্ব ও নারীর অসহায়তা খুব সুন্দরভাবে করেছেন সৃষ্টি। তাঁর উপন্যাস পল্লীসমাজে, যেভাবে, অসহায় বিধবা এক নারী রমা, এসে দাঁড়িয়েছিল, রমেশের পাশে তাঁর সততার জন্য, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
অরক্ষণীয়া উপন্যাসে, তিনি আমাদের মনকে করে তুলেছেন বেদনাসিক্ত। এই উপন্যাসে, তিনি এক সমাজ পরিত্যক্তা নারীর চরম দুর্দশার চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসের জ্ঞানদা চরিত্র হল এককথায় অনন্যসাধারণ। এটি বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম সেরা করুণ নারী চরিত্র, বলে আমি মনে করি। জ্ঞানদা একটি, ১১ বছরের নাবালিকা কন্যা।
আমাদের সমাজ বড় নিষ্ঠুর। এই সমাজে, মানুষের ইচ্ছে – অনিচ্ছের চেয়ে অনেক বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় সামাজিক নিয়মকানুনগুলিকে। সমাজের উচ্চবর্গের মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রেই, তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, হাতিয়ার করে এই সামাজিক নিয়মনীতিগুলোকে। যা প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের অন্যায়।
শরৎচন্দ্র, ঠিক এই জায়গায় করেছিলেন এক প্রবল আঘাত। জ্ঞানদা ছিল শ্যামলা মেয়ে, গরীব ঘরের শ্যামলা মেয়ে, সমাজে বারবার হয়েছে, অন্যায় অবিচারের শিকার। তাছাড়া, সে ছিল বাবাহারা এক কন্যা। তাই, আরো আরো অবহেলিত ছিল সে। উপেক্ষা, অপমান ও উপহাসে জর্জরিত হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবন। তাঁর মা দুর্গামনি, বিধবা হওয়ার পরে, জ্ঞানদা আর তাঁর মাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁদের বাড়ির থেকে। তাঁদের শেষমেশ স্থান হয়েছিল তাঁদের মামারবাড়ির এক অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রামে।
তাঁর মামা – মামি তাঁদের মোটেই গ্রহণ করে না সমাদরে। সেইখানে, জ্ঞানদার, মামা, শম্ভু, জ্ঞানদার সাথে, তার বুড়ো কয়েক সন্তানের পিতাশ্যালকের সাথে বিবাহ দিতে উদ্যোগী হয়েছিল, অর্থের লোভে। সত্যিই, অর্থ, মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে ডেকে আনে অনর্থ, একথা সর্বৈব সত্য। এই অর্থের লোভ মানুষকে মানুষ থেকে রূপান্তরিত করে পশুতে।
এদিকে, জ্ঞানদার মা, ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে, শয্যাগত হয়। টাকার লোভী মামা যখন তাঁর বিয়ে দিতে উদ্যত হয়, তখন হঠাৎ, তাঁর মামির সাহায্যে, সে পালায় মামার খপ্পর থেকে। শরৎচন্দ্রের
অধিকাংশ নির্যাতিতা নারী কিন্তু, দরিদ্র। তবে, সমাজের ধনী, সম্পদশালী পরিবারের মেয়েরাও, যে সমাজের অমানবিক প্রথার শিকার হয়েছে, তার প্রমাণ আমরা পাই অনুপমার প্রেমে। এখানে প্রধান চরিত্র, অনুপমা, হল এক ধনীর ঘরের দুলালী। কিন্তু, তাঁর বিয়ের সময়, হবু স্বামীর পলায়ন – এক মর্মান্তিক ঘটনা। তাঁর বাবা মারা যাবার পরে, সৎ ভাইয়ের দ্বারা, তাঁর বারংবার নির্যাতিত হওয়া। তারপর, পঞ্চাশোর্ধ এক বুড়োকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয় তাঁকে। শেষে, বিধবা হয়ে, সৎ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে, সবকিছু হারিয়ে, বাড়ির কাজের মেয়ের উপহাসের পাত্রী হয়ে যাওয়া – এসব যে দুর্ভাগ্য আর দুর্ভাগ্য।
শরৎচন্দ্র তাঁর ছোটগল্পে, তাঁর নারীচরিত্রগুলোকে করে তুলেছেন এক মহিমান্বিত। এখানে পাওয়া যায়, তাঁর সমাজবোধের পরিচয়। তিনি ছিলেন একজন সমাজবিজ্ঞানী – এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। সমাজ ও সমাজের বিবর্তন, তিনি খুব ভালো ভাবে পারতেন বুঝতে। তাই, তাঁর লেখায় এর প্রতিফলন আমরা বারবার দেখতে পাই। সমাজ সংসারের কোন দিকই তাঁর নজর এড়িয়ে যায়নি।
নারীমনের নাগাল পাওয়া বড় দুষ্কর। একজন পুরুষের পক্ষে, তা খুবই কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু, শরৎচন্দ্র, এই কঠিন কাজকে করে ফেলেছিলেন অবলীলাক্রমে। তিনি নারীদের মনকে খুব ভালো ভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। নারীদের চাওয়া পাওয়া, পছন্দ অপছন্দ, ভালো লাগা, মন্দ লাগা – সবকিছু ছিল তাঁর নখদর্পণে। তাই, তাঁর সৃষ্ট সব নারী চরিত্র এত জীবন্ত বলে এখনো আমাদের মনে হয়। তাঁরা কালের সীমা করেছে অতিক্রম।
তাঁর মেজদিদি গল্পের হেমাঙ্গিনী এক অদ্ভুত নারী। তাঁর মানসিকতা সমাজের অন্যান্য নারীদের থেকে একদম ভিন্ন। তাঁর মনে আছে দয়া, মায়া, বুকভরা ভালোবাসা। তিনি তাঁর জা কাদম্বিনীর বৈমাত্রেয় ভাই, কেষ্টার প্রতি, ঘটে চলা ক্রমাগত অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার দেখে আর, চুপ করে থাকতে পারেননি। কেষ্টাকে না খাইয়ে রাখা, ছেলে স্বামীকে দিয়ে কারণে অকারণে মার খাওয়ানো, অন্যায় অপবাদ দেওয়া, কেষ্টাকে চাকরের মতো খাটানো – এসব দেখে হেমাঙ্গিনীর প্রাণ ফেটে যেত।
বেচারা কেষ্টা, সবকিছু মুখ বুজে যেত সহ্য করে। তার কাছে যখন এই পৃথিবীর সবকিছু লাগছিল
বিস্বাদ। তখনই, হেমাঙ্গিনীর তার প্রতি মধুর ব্যবহার তার জীবনে নিয়ে আসে এক আশার আলো। কেষ্টার কষ্ট দেখে, হেমাঙ্গিনী অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে তাঁর স্বামীকে কাতর অনুনয় করে বলে, ” কেষ্টাকে আশ্রয় দাও, নইলে আমার এ জ্বর সারবে না। মা দুর্গা আমাকে কিছুতেই মাপ করবেন না। কিন্তু, তাঁর স্বামী যখন তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েও, তা ভঙ্গ করে , তখন অভিমানে তিনি, কেষ্টাকে নিয়ে, বাড়িঘর ছেড়ে এক অজানার উদ্দেশ্য পাড়ি দিয়েছিলেন। সত্যিই, সাহস ছিল বটে হেমাঙ্গিনীর। এই সাহস তারিফযোগ্য। তখন তাঁর স্বামী ভুল বুঝতে পারে। সে অনুনয় করে বলে, ” মাপ কর মেজ বউ, বাড়ি চল! ” হেমাঙ্গিনীর উত্তর ছিল, ” কাজ না সেরে আমি কোন মতেই বাড়ি ফিরতে পারব না। ” তাই, তাঁর স্বামী হেমাঙ্গিনীর কথা রাখতে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত, জয়লাভ করেছিল হেমাঙ্গিনীর মাতৃপ্রেম।
এইখানে অভিনবত্ব দাবী করে শরৎচন্দ্রের নারীচরিত্র। সে নারী একদিকে নারীসত্তায়, অন্যদিকে মাতৃত্বসত্তায় পরিপূর্ণা। নারীর রূপের নেই শেষ। কখনো সে ভগিনী, কখনো সে দিদি, কখনো সে প্রেয়সী, কখনো সে জীবনসঙ্গীনী, কখনো সে কন্যা, এক অঙ্গে কত রূপ! যা দেখলে মনে লাগে বিস্ময়! নারীর এইসব রূপের পরিপূর্ণ যথাযথ প্রকাশ ঘটেছে শরৎচন্দ্রের নারীচরিত্রগুলোতে। তাই, শরৎ সাহিত্যে নারী, বহুরূপে সজ্জিতা, নানারূপে ভূষিতা, অনেকগুণে গুণান্বিতা । এই নারীতো হল ভারতীয় সভ্যতার ধারক ও বাহক।
Leave A Comment