থ্যাঙ্কস গিভিং থেকেই আমেরিকাতে ছুটি ছুটি আবহে ঢিলেমি দিয়েই কাজ চলে। নির্বান্ধব প্রবাসে, এই ডিসেম্বর মাসটা আমার খুব প্রিয়। বাইরে সাদা বরফ। কাজের চাপ নেই। ফলে চিন্তাভাবনার অবকাশ অনেক। সাথে প্রিয় হুইক্সি থাকলে বিশ্বব্রহ্মান্ডের ভাবনা ঠেকায় কে!
আমার অনেক দিনই মনে হয় বেঁচে থাকাটা বেশ কঠিন কাজ। সেই সুকুমার রায়ের ফকিরের মতন। বাবা-মা-বৌ-বাচ্চা-প্রতিবেশী-প্রেমিকা-বস-কোম্পানী-অদ্য ফেসবুকের বন্ধু। প্রত্যাশার শেষ নেই। আর প্রত্যাশা মানেই কাজ। শুধু কাজ না-অনেক অনেক কাজ। তার মধ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা। নৌকা বেশ চলছিল-হঠাৎ হঠাৎ চোরা শ্রোত, ঝড় এসব আছেই। এতকিছু ভাবার অবকাশ পেলেই আমি অবাক দাঁড়কাক। বেঁচে থাকাটা সত্যিই বিড়াম্বনা।
এমনিতে জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই। এই মহাবিশ্বের বয়স তের বিলিয়ান বছর। আকারে অসীম। এর মধ্যে স্থান কালের ভিত্তিতে আমরা সবাই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দু। সেই রবীন্দ্রনাথ ও এক বিন্দু-এক ভিখারী যে জীবনে কিছু দিয়ে যেতে পারে নি-সেও আরেক বিন্দু। তাহলে এত খেটে লাভ কিসের? আলটিমেটলি কোনই লাভ নেই। বরং এত বাদ বিবাদে বিড়াম্বনা নিয়ে কষ্টেই বেঁচে থাকা।
সুতরাং কষ্ট নিয়ে বেঁচে থেকে লাভ নেই। বেঁচে থাকতে গেলে, আনন্দে মস্তিতে বেঁচে থাকার তাও মানে আছে। সুতরাং যেকদিন আছি, সুখের সন্ধান- পারস্যুট অব হ্যাপিনেসটাই আসল। বাকী সব কিছুই গৌন। দর্শন শাস্ত্রে এর একটা পোষাকি নাম আছে। হেডোনিজম। তবে হেডোনিজমে একটা টুইস্ট আছে। এরা মনে করে ভাব্বাদি সুখ না, বস্তুবাদি সুখ-যা সেন্সুয়াল প্লেজার থেকে আসে, সেটাই আসল। আমি অবশ্য বস্তুবাদি আর আধ্যাত্মিক-দুই ধরনের প্লেজারেই আনন্দ পাই।
সুখের সন্ধান ব্যপারটা নতুন কিছু না। আমেরিকান সংবিধানের প্রেনেতা থমাস জেফারসন ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতার ঘোষনায়, কোন স্বর্গের সন্ধান বা অলীক জাতিয়তাবাদকে আশ্রয় করে আমেরিকার স্বাধীনতা দাবী করেন নি। সংবিধান এবং আমেরিকান রাষ্ট্রের ভিত্তি সেই পারস্যুট অব হ্যাপিনেস ।
সুতরাং কি কি জিনিস আনন্দ দেয়, তার একটা লিস্ট করা যেতে পারে। তবে যাহাই আনন্দ, তাহাই বিষাদের কারন ও বটে। সুস্বাথ্য ছাড়া কোন ভাবেই সুখী হওয়া সম্ভব না। সুতরাং স্বাস্থ্য সবার আগে। আর স্বাস্থ্য ভাল রাখা ম্যাজিক না। এর জন্যে খাটতে ত হবেই-সাথে সাথে খাওয়া দাওয়া নিয়ন্ত্রনে রাখতে হয়। অর্থাৎ কিছু কিছু সেন্সুয়াল প্লেজার না কমালে সুখী হওয়াটা বেশ কঠিন।
সুখী সুখী ভাবটা-অবশ্যই বায়োলজিক্যাল। হর্মোন এবং জেনেটিক্স প্রভাবিত। রিসার্চ বলছে সুখী থাকার ৫০% জেনেটিক্স। আমি একমত না। আমার পিতা অধিকাংশ সময় খুশীর থেকে অখুশী থাকেন বেশী। আমি কিন্ত বেশ খুশ মনেই থাকি অধিকাংশ সময়।
হার্ভাডের দীর্ঘ ৭৬ বছরের গবেষনা বলছে, সুখী থাকার সব থেকে শ্রেষ্ঠ উপায় সবার সাথে ভাল সম্পর্ক রাখা। বিশেষ করে যারা ছোটবেলায় বাবা-মায়েদের সাথে স্ট্রং বন্ডিং এর সুযোগ পেয়েছে, তারাই পরবর্তীকালে সুখী বেশী। সুতরাং একটা সুখী ফ্যামিলিই সুখী থাকার প্রথম এবং মুখ্য ধাপ।
টাকা পয়সা খরচ করেও সুখ কেনা যায়। তবে নিজের জন্য জামা কাপড় কিনে বা রেস্টুরেন্টে গিয়ে না। টাকা পয়সা যদি অন্যের দুঃখ দারিদ্র ঘোচাতে খরচ করা হয়। এটা বিবেকানন্দ রচনাবলীতে একাধিবার এসেছে। আশার কথা এই যে হার্ভাড বিজনেস স্কুলের গবেষনাও এক কথা বলছে। সুখী হতে চাইলে টাকা পয়সা দিয়ে চ্যারিটি করা অনেক বেশী কার্যকরী-নিজের পেছনে খরচ করার থেকে।
সাইক্রিয়াটিস্ট মার্টিন সেলিগ্যাম সুখী থাকার পাঁচটা ডাইমেনশন দিয়েছেন ঃ
(1)প্লেজার-খাদ্য, যৌন সুখ, আরামপ্রদ ঘুম। এর মধ্যে খাদ্য গুরুত্বপূর্ন। একাধিক স্টাডি প্রমান করেছে যারা ফল্মূল ভেজিটেবল বেশী খায়, তারা সুখী বেশী। ননভেজ খাওয়া দোষের না-কিন্ত সাথে সাথে যথেষ্ট ভেজিটেবল না খেলে বা ফল না খেলে, খাওয়ার ফলে সুখের থেকে দুঃখ বেশী হবে।
(2) এনগেজমেন্ট মডেল ঃ হাইকিং, দৌড়ানো, খেলাধূলা করা
(3) জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া-যতই ভুঁয়ো,ফলস হৌক, ধর্ম, কমিউনিজম এগুলো মানুষএর জীবনকে একটা বৃহত্তর অর্থ দেয়। ফলে এরা অনেক আপাত দুঃখেও সুখী থাকে।
(4)সাফল্য- সামনে কিছু পেশাদার বা অপেশাদার টার্গেট যাই থাকুক না-কেন-সেগুলো পূরন হলে সাময়িক সুখ আসে। এই জন্য সামনে বড় টার্গেট রাখতে নেই। ছোট ছোট ধাপ। নেক্স ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমি এই এই করব। এবং সেই ছোট ছোট কাজগুলো সাফল্যের সাথে হলেই মনে তৃপ্তি আসে।
(5)সম্পর্ক -নিঃসন্দেহে জীবনের সুখের মূল হচ্ছে বাবা মা ছেলে মেয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যের সম্পর্ক। এই সম্পর্কগুলো সুখী না হলে, সুখী জীবন অসম্ভব।
বিভিন্ন স্টাডিতে এটাও স্পষ্ট ধার্মিক লোকেরা নির্ধামিকদের থেকে মনের দিক দিয়ে বেশ কিছুটা বেশী সুখী থাকে। তবে এটাও নানান স্টাডিতে দেখা গেছে, এখানে ধার্মিক মানে যারা নামাজি, পূজারি, মন্দিরে মসজিদের যাচ্ছে-সেই টাইপের লোক না। ধার্মিক তারাই এইসব স্টাডিতে যারা ধর্মে বিশ্বাস করে নানান ধরনের চ্যারিটি করছেন কমিটেড ভাবে, মানুষের উপকারের সাথে জড়িত-তারা সাধারনত নির্ধামিকদের থেকে বেশী সুখী। আবার যেসব নির্ধামিকরা যেমন কমিনিউস্টরা ওউ একই রকম একটা জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে নিয়েছেন , সাধারন মানুষের জন্য কাজ করেন- তারাও খুশী। সুতরাং জীবনের একটা উদ্দেশ্য সেটা যাইহোক না কেন-সেটা না দাঁড় করতে পারলে, জীবনে সুখ অধরাই থেকে যাবে।
সুখই জীবনের অন্তিম লক্ষ্য এটা নিৎসে মানেন নি। তার মতে বিরাট কিছু প্রাপ্তি ভীষন কষ্ট এবং সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই আসে। এখন মোদি যেমনটা বলছেন-কালো টাকা শুন্য ভারত গড়তে জনগণকে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হবে!
তবে যে যাই বলুক, যে যতই চাক তার ধর্ম, তার রাজনৈতিক আদর্শ পৃথিবী রাজ করবে-সেটি হবে না। কারন আস্তে আস্তে পৃথিবীব্যাপি “হ্যাপিনেস” সাবজেক্টটাকে আর সাবজেক্টিভ রাখা হচ্ছে না। অনেক গবেষনা চলছে। এতে আস্তে আস্তে অর্থনীতি , সমাজনীতি, আইন, খাদ্যভ্যাস এমন করে গড়া যাবে যাতে লোকেদের সুখের সন্ধান সহজ হয়। এই ব্যাপারে বিগ ডেটা আনালাইটিক আস্তে আস্তে স্টেজে অবতীর্ন। ফলে ধর্মের প্রভাব কমতে বাধ্য। কারন আস্তে আস্তে ধর্ম বাদ দিয়ে, সুখের সন্ধানের বিজ্ঞানই সামাজিক ও রাষ্ট্রের আইনের ভিত্তি হবে বা হতে বাধ্য।
আমি উদাহরন দিচ্ছি। যেমন ডিভোর্স আইন। হিন্দু ধর্মে ত ডিভোর্স আইনই নেই-ইসলামে যা আচ্ছে তা পুরুষকে খুশি রাখতে পারে, কিন্ত তা নারী বিদ্বেশী এবং মধ্য যুগীয়। বৃটিশ আইন ও এট ফল্ট ডিভোর্স-যা আদৌ ভাল না। অন্যদিকে কড়া টাইপের মনোগ্যামি আইনে অধিকাংশ নারী পুরুষ বিবাহিত জীবনে প্রায় জেল খানায় কাটায়। এবার পারস্যুট অব হ্যাপিনেস যদি আমাদের সমাজের সুপ্রীম অবজেক্টিভ হয়-তাহলে বিবাহ বা ডিভোর্স কিভাবে হওয়া উচিত?
এটি জটিল প্রশ্ন । কারন এই নিয়ে যথেষ্ট নৃতাত্ত্বিক গবেষনা হয় নি। ফলে এমন সব পারিবারিক আইনের আওতাই আমরা আছি, যাতে সুখের সন্ধান ত দূরের কথা, কোন রকমে ঝগড়া ঝাঁটি ছাড়া দিন গুজরান হলেই সবাই বাঁচে!
আমার ধারনা এই বিগডেটা এনালাইটিক অনেক কিছু নতুন দিশার সন্ধান দেবে স্যোশাল সায়েন্সের গবেষনাতে-যার থেকে আমরা আস্তে আস্তে বুঝতে পারব, বিবাহ ব্যাপারটা আউটডেটেড কি না-এখন যেভাবে ছেলে মেয়ে মানুষ হচ্ছে, সেটা ঠিক কি না। সেদিন এখনো আসে নি।
বিপ্লব পাল ,
আপনার এই লেখা টা ভাবতে শেখায় । লেখার সব শেষের লাইন টা ” বিবাহ ব্যাপার টা আউটডেটেড কিনা ” তা এখন কার সমাজে ঠিক হতে চলেছে ।
বর্তমান যুগের ছেলে মেয়েদের কাছে বিয়ে টা ব্যাক ডেটেড এবং তারা আরও বলে “Two Indivitually” এক সঙ্গে থাকা সম্ভব নয় ।