আমার জন্ম বাংলাদেশে। ছোটবেলা থেকে এই শিক্ষায় বড় হয়েছি যে জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও গর্বের। বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারেখার কোন এক গ্রামে আমার শিকড় পোঁতা, নাড়ি পোঁতা। এতসব গভীর আবেগের কথা না বললেও বাংলাদেশের ষড়ঋতুর আবর্তনে আমি বেড়ে উঠছি। কাজী নজরুল ইসলামের “একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী” গানের কথার মত আক্ষরিকভাবেই মিশে আছি আমি।

মহম্মদপুরের একগ্রামের কিশোর আমি ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াইছি, বৃষ্টিতে ফুটবল খেলছি, শিশিরভেজা ঘাসে খালি পায়ে হাঁটছি, বন্যার সময় কলাগাছের ভেলা বানাইছি, শাপলা দিয়ে মালা গাঁথছি, মধুমতীর তীরে শুয়ে শুয়ে কাটাইছি কত যে রাত, গুনেছি আকাশভরা তারা, ধান কাটছি, মাছ ধরছি পদ্মপুকুরে। ছোটবেলায় আমি ছিলাম হুমায়ুন আজাদের “শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা” উপন্যাসের জলকদর। শৈশবের বন্ধু জিয়া, পাপেল, হারুন, শের আলী, শিবলী, ফিরোজ, খোকনের সাথে স্কুলে গেছি। মহম্মদপুরে স্কুল কলেজে পড়ার সময় মালা*উন শব্দের সাথে পরিচয় থাকলেও কোনদিন কেউ গালি দেয় নি। মালা*উন গালি শুনছি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। পুরোগতিশীল রাজনীতির লোকেরাও মাঝেমধ্যে হাসিঠাট্টার ছলে মালা*উন বলে আদর করত। কিন্তু সেসব আসলে তেমন বড় সমস্যা ছিল না।

আমার সেই শৈশবের বাংলাদেশ আমার চোখের সামনে প্রতিদিন বদলে যেতে দেখছি। সমস্যা হয়ে গেল ধর্ম যখন রাজনীতি হয়ে গেল। রাজনীতির প্রভাবে দেশের সংবিধান বদলে গেল, বদলে গেল একটা নাগরিকের রাজনৈতিক পরিচয়, সামাজিক মর্যাদা। ফলে একই দেশে বসবাস করেও শুধু ধর্মের ভিত্তিতে আমার বন্ধু ইমদাদুল হক আর বিকাশ মজুমদারের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নাগরিক বৈষম্য। রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয় থাকলে বিকাশ মজুমদার হয়ে যায় কাফের; তখন কাফের আর নজরুল ইসলাম রাসেলের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব না।

সেই মানুষটাই সুখি যে নিজের জন্মভূমিতে যদি জোটে সামান্য শাকভাত সেটা খেয়েই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। রাষ্ট্রধর্মের পরিচয়ের কারণে সাংবিধানিক বৈষম্যের শিকার হয় দেশের সংখ্যালঘু নাগরিক আর বৈষম্য নিপীড়নে পরিণত হতে সময় লাগে না। সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু আইডিয়াটাই এমন যে আধিপত্য বিস্তার না করে থাকতে পারে না। ফলে শাকভাত খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর স্বপ্ন অনেকের জন্যই বিলাসীতায় পরিণত হয়। বাঁচার জন্য কিছু মানুষ সাধের আশ্রয় ছেড়ে পাড়ি জমায় অন্যদেশে, কেউ হয় রিফিউজি, কেউ বাস্তুহারা উন্মুল। বিদেশে হয়ত কিছু মানুষ আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তায় সুখে থাকে কিন্তু সে কি কোনদিনও ভুলতে পারে তার শৈশবের নদী, খেলার মাঠ, স্কুলের গোল্লাছুট, শীতের সকালে খেজুরের রস, মাতৃভাষায় কথা বলার আকুতি? সে কি আসলেই সুখি হয়?
আজকে ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে, থেমিসের ভাষ্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে, রাহুল আনন্দের বাড়ি পোড়ানো হয়েছে এরজন্য দায়ী রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয় আর নাগরিকের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। মন্দির পোড়ানো, বাড়িঘর লুটের ঘটনাকে বিভিন্ন কারসাজি করে গুজব বলে প্রচার করা হচ্ছে। এরথেকে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? এই সবকিছুর জন্য দায়ী রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বৈষম্য।

বাংলাদেশকে কি আবারো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করা যায় না?

সুশীল ভাইলোগ, হিন্দুদের বিপদটা বোঝার চেষ্টা করেন। তাদের অবস্থা এখন জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। এই ধর্মের জনগোষ্ঠীর উপর হামলা, হত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরণ, জ্বালাও পোড়াও ইতিহাস তো দীর্ঘদিনের ইতিহাস।
সাম্প্রতিক সময়ে সেই হামলা, মন্দির পোড়ানো শুরু হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে। মন্দির পোড়ানোর কথা, হত্যা নির্যাতনের কথা ফেসবুকে পোস্ট করলে কিছু সুশীল মানুষ বলতেছে এসব গুজব। গুজবের জবাবে যখন তথ্যপ্রমাণ হাজির করতেছি তখন বলতেছে এসব আমলীগের ষড়যন্ত্র। তো সেকুলার ভাই, শুধু হিন্দুরাই কেন বারবার আক্রান্ত? তাদেরই কেন বাড়িঘরে, মন্দিরে আগুন জ্বলে ওঠে? শুধু তারাই কেন লুটতরাজের শিকার হয়।

ব্যাপারটা এমন যেন, বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর অত্যাচার হবে কিন্তু সেই কথা তারা বলতে পারবে না। যদি বলে তাহলে সেটা ষড়যন্ত্র। আচ্ছা আমলীগ তো সারাদেশে ৫৬০টা মডেল মসজিদও বানিয়েছিল, কারো কাছে কোন খবর আছে এপর্যন্ত একটা মসজিদে আগুন দেয়া হয়েছে?

যেকোন সভ্য এবং আধুনিক রাষ্ট্রের কোন ধর্মীয় পরিচয় নাই, থাকতে পারে না, থাকা উচিৎ না। রাষ্ট্র কোন মানুষ না যে তার মরার পরে তার বিচার হবে, বিচারের পর স্বর্গ/নরক বা ঐ জাতীয় যা কিছু আছে সেখানে যাবে অনন্ত সুখের জন্য। রাষ্ট্র হলো মানুষের রাজনৈতিক প্রয়োজনে আইন করে একটা বানানো কৃত্রিম পরিচয় মাত্র।
হ্যাঁ, রাষ্ট্রে বসবাসকারী মানুষের ধর্মীয় পরিচয় থাকতে পারে। কিন্তু শুধু জনগণের ধর্মীয় পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয় দেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সুদূরপ্রসারী অশুভ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পিত ভণ্ডামি। কারণ একটা দেশে শুধু একটা নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষই বসবাস করে না, সেখানে আরো অনেক পরিচয়ের মানুষ বাস করে। তাহলে যদি রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু জনগণের ধর্মের ভিত্তিতে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করেন তার ফলে অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগণ সাংবিধানিকভাবে অবহেলিত হয়ে যাবে, রাষ্ট্রযন্ত্রের যত অর্গান আছে সবখানেই তারা বঞ্চিত হয়ে যাবে। মোটকথা, রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয় থাকলে কিছু জনগণ স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে যাবে।

এরকম বৈষম্যের পরিস্থিতিতেই রাষ্ট্রপ্রধানদেরকে গণমাধ্যমে বারবার বলতে হয়, “আমরা অসাম্প্রদায়িক, আমরা ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য করি না, আমাদের দেশে সব জনগণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বসবাস করছে”। যেমন, বাংলাদেশ একটা অসাম্প্রদায়িক দেশ, এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভণ্ডামি এবং রাজনৈতিক মিথ্যাচার। এখানে কোন ভেদ নেই মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট আওয়ামীলীগ, জাতীয়তাবাদি বিএনপি, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামাত, মৌলবাদি হিজবুত তাহরিরের মধ্যে। কারণ তখন রাজনৈতিক দলগুলোর মুখে মুখে অসাম্প্রদায়িকতার বুলি আওড়ে তলে তলে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করার সুযোগ পায়। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ধর্মীয় পরিচয়ই তাদেরকে বৈষম্য করার আইনি অধিকার দিয়ে দেয়।

ধর্মীয় রাজনীতির বিরোধীতা প্রসঙ্গে একবার মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বলেছিলেন শুনো,
“ধর্ম আর দেশ মিলাইতে যাইয়ো না।
পরে ফুলের নাম কি দিবা ফাতেমা চুড়া? ”

ইসলামের নবী হজরত মুহম্মদ নিজেই কিন্তু ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে গেছেন। আলোচনা প্রসঙ্গে বলে রাখি, একবার সিরিয়া থেকে কিছু লোক হজরত মুহম্মদের কাছে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করতে আসছিলো। নবী মুহম্মদ সেই খ্রিস্টানদের জন্য কাবাঘরের একপাশে তাদের প্রার্থনার জায়গা করে দিয়েছিলেন। তিনি এটাও বলে গেছেন, “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন’ অর্থ- ‘তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আর আমার দ্বীন আমার’ (১০৯. সূরা কাফিরুন-৬)।
একটা আধুনিক কল্যাণমুখি রাষ্ট্রব্যবস্থা সব জনগণের সবধরণের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করে। আপনারা সবাই জানেন যেকোন সভ্যদেশের নাগরিকদেরকে কোন অফিশিয়াল ফরমে তাদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করার দরকার হয় না। ইনফ্যাক্ট সেখানের ফরমে ধর্মীয় পরিচয়ের কোন অপশন থাকে না।

তাই আগামী দিনের তরুণ নেতৃত্বের কাছে প্রত্যাশা, একটা ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ চাই। একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাই। একটা জনকল্যাণমুখি বাংলাদেশ চাই।