লিখেছেন: বক-শালিকঃ আজ ৬ ই অক্টোবর, ২০২২ । আমার জীবনের অন্যতম এক সেরা বন্ধু অনন্ত বিজয় দাশের ৪০ তম জন্মবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো ৪০ বছর। এই বয়স জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কত কিছুই না করার কথা ছিল তাঁর এই বৃহৎ,মহৎ জীবনে।

কি দূর্ভাগ্য আমার, আমাদের এবং গোটা বাঙালী জাতির। এমন সরল, নিষ্পাপ মনের, বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী মানুষটিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হল।

কি দোষ করেছিল সে? সে তো কারো বাড়া ভাতে ছাই দিতে যায়নি। কারো টাকা মেরে দেয়নি। চুরি-ডাকাতি করে নি। ব্যাংকে চাকুরী করত; কই, ব্যাংক ডাকাতি তো করে নি সে, এক টাকাও তো ঘুষ খায় নি। তাহলে তাকে তাঁকে কেন খুন হতে হল ?

রাষ্ট্রের জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের ব্যবসার নামে প্রতারণা, আত্মসাৎ করে রাষ্ট্রীয় আইনের ও সংস্থার সুযোগ নিয়ে মাফিয়া ব্যবসায়ীরা ‘বেগমপাড়া’ তৈরী করেছে পৃথিবীর উন্নত দেশে দেশে। ভাল তবিয়তে আছে তারা।

কি অন্যায় করেছিল অনন্ত? অন্যায় করেছিল বই লিখে, সংগঠন করে। কী বই লিখেছিল? হ্যাঁ, সেসব বই লিখেছিল যেগুলো মানুষের মঙ্গলে মন ও মননের আমূল পরিবর্তন করে। বেশিরভাগ বই-ই লিখেছিল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভংগীর আদলে। সে লিখেছিল মানবাধিকারের পক্ষে, নির্যাতিত মানুষের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে যারা পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

সে কথা বলেছিল, লিখেছিল সমাজের অসাম্যের বিরুদ্ধে – সেটা ধর্মের নামে হোক অথবা অর্থনৈতিক অব্যবস্থার নামে হোক। রাজনৈতিক মাফিয়া নেতাদের দূর্নীতির বিরুদ্ধে কথা লিখেছিল। লিখেছিল রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের যেসব সংস্থা আছে তাদের প্রধান প্রধান সামরিক, আমলাতান্ত্রিক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাষ্টীয় পৃষ্টপোষক বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে অনন্ত বেঁচে থাকলে গত ৮ বছরে আমাদেরকে আরো কত যে নিত্যনতুন তথ্য উপাত্ত দিয়ে, নতুন নতুন জ্ঞাননিষ্ঠ ও জ্ঞান অর্জনের বই উপহার দিত।

অনন্ত বিজয় দাশ বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভংগীর আন্দোলনে এবং মন-মানসিকতার অংগনে বিশাল ভূমিকা পালন করতে পারত। অভিজিৎ রায় প্রায়ই বলত যে “এক অনন্ত বিজয় দাশ লক্ষ অনন্ত বিজয় দাশের সমান “। আর অভিজিৎ রায়কে যখন হত্যা করা হল অনন্ত বিজয় দাশ তখন বলেছিল আমি অভিজিৎ রায়ের হত্যার বদলা নিব কলমের কালো কালি দিয়ে। প্রতিটি কালো কালির অক্ষর হয়ে উঠবে আগুনের ফুলকি। সে আগুনে জ্বলে পুড়ে মরবে সকল পশ্চাৎপদ নোংরা আর অসভ্যরা। মন ও মননের সকল জীর্ণশীর্ণ, দৈন্যতা, হীনমন্যতা। সে কলমের কালি আগুনের ফুলকি হয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিবে রাষ্ট্রের মানুষের মনোজগতের সকল স্তরে। সেখান থেকে উঠে আসবে নতুন জীবনের গল্প, নতুন জীবনের স্বপ্ন।

কী নিষ্ঠুর নিয়তি! রাষ্টীয় প্রতিষ্ঠানের নামে রাষ্ট্রের পালিত খুনি-ঘাতকরা তা আগেই টের পেয়েছিল যে এই আগুনের ফুলকি কে খতম করে দিতে হবে, নাহলে বিপদ আছে তাদের সামনে। সেটা বুঝে কলম দিয়ে “অভিজিৎ রায়ের” খুনীদের বদলা নেবার আগেই তারা অনন্ত বিজয় দাশকে চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিল। তারা হয়তো সেদিন তাঁকে খুন করে ভীষণ আনন্দ উৎসব করেছিল। আনন্দের জোয়ারে ভেসেছিল।

কিন্তু অনন্তের খুনীরা জানে না যে মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে একটা মহা মূল্যবান কথা আছে, তা হল জ্ঞানের যারা সাধক-সারথি তাদের মৃত্যু নেই। তাঁরা বেঁচে থাকে বংশ পরম্পরায় মানুষের মনের ভেতর। সেই সব মন ও মননের মানুষের মাঝ থেকেই আবারও নতুন করে ফিনিক্স পাখির মতো লক্ষ অনন্ত বিজয় দাশ’রা ডানা মেলে উড়ে আসে। নতুনের তরে পথ দেখায়। মানুষকে নতুন জীবনের পথে এগিয়ে যাবার কথা বলে। এভাবেই তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে যায়। সেখান থেকেই নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও নতুন সভ্যতার সূচনা হয়।

অনন্তের মত এইসব ক্ষনজন্মা জ্ঞানী-গুনী সাধকরাই পশ্চাৎপদ সমাজকে এগিয়ে নেন এবং তারাই আধুনিক বিশ্বের মানুষের মন-মননের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকেন তাদের চিন্তার, মেধার ও কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে।

অনন্ত বিজয় দাশ, আজ শুধু আপনার জন্মদিন বলে আপনাকে মনে পড়ছে তা কিন্তু নয়, আপনাকে সব সময়ই মনে পড়ে, তাতে ভীষণ বিষন্ন হই। আপনার মতো এমন বন্ধুকে হারিয়ে প্রতিদিনের জীবন বেদনাবিদূর হয়ে উঠে।

জানি না, আজ আপনার মা আর ভাইবোনদের মনের কী দশা? আঁচ করতে পারা যায় তাদের আজকের দিনে এক সাগর যন্ত্রণাময় দিন যাবে । হাহাকারে কেঁদে উঠবে তাদের মন, প্রশ্ন করে যাবে কেন আমার ছেলেকে বা কেন আমার ভাইকে এতো অল্প বয়সে খুন হতে হলো?

রাষ্ট্র কি আমাদেরকে এর সঠিক জবাব দিবে? কেন আমাদেরকে ভাই হারা হতে হলো, কেন আমাদের মা-কে পুত্রহারা হতে হলো?

আপনি যেখানেই থাকুন, খুব ভাল থাকুন। সেখান থেকে আকাশের মিটিমিটি তারা হয়ে দেখুন বৈশ্বিক সমাজে, মানুষের জীবনের আর মনোজগতের কত গভীর অধঃপতন হয়েছে। এই অধঃপতিত বৈশ্বিক সমাজে আপনার উপস্থিতি আজ বড্ড দরকার ছিল।

আজ আপনার শুভ জন্মদিন উপলক্ষে একগুচ্ছ গোলাপ ফুলের শুভেচছা রইলো। ভাল থাকুন নিরন্তন। আমরা ভাল নেই।