লিখেছেনঃ আশরাফ আহমেদ

কাজ থেকে অবসর নিয়েছি প্রায় দেড় বছর হতে চললো। স্ত্রী এখনো কাজে যান। সারাদিন বাসায় একা থাকি। পুরনো স্মৃতি এসে ভিড় করে। এভাবেই চলে গেলাম প্রায় ষাট বছর পেছনে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় বড়বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। সময়টি ছিল ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে।

রওনা হবার আগেই জেনেছিলাম যে ইউসিস, মানে ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস ঢাকা স্টেডিয়ামে এক গোলাকৃতি ডিব্বা-ঘরে ‘সার্কারামা’ নামে এক নতুন ধরণের সিনেমা দেখাচ্ছে। সেখানে সিনেমাটি ঘরের একটিমাত্র দিকের পর্দায় না হয়ে ঘরের ভেতরে যেদিকেই তাকানো যায় সেখানেই সিনেমাটি দেখা যায়। শুনতেই কেমন অদ্ভুত লাগছিল। এ কেমন ধরণের সিনেমা! নাম থেকে এটিকে সার্কাস সার্কাস জাতীয় কিছু মনে হয়েছিল।

ঢাকায় পৌঁছেই আপা ও দুলাভাইয়ের কাছে আবদার করেছিলাম এই সার্কারামা আমি দেখতে চাই। দুলাভাই বললেন এটি তাঁদের এখনও দেখা হয়নি। ইউসিস থেকে আগেভাগেই টিকেট জোগাড় করে রাখবেন। সেই অনুযায়ী টিকেট পাওয়াও গেল জানুয়ারির কোনো এক সময়ে। কিন্তু আমার কপাল খারাপ। ভারতের কোথাও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার প্রতিধ্বনি নতুন বছর শুরুর প্রথম দিকে ঢাকায়ও শুরু হলো। শহরে কারফিউ জারী করা হলো। শুনেছিলাম তখনকার পুরনো ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় আগুন লাগিয়ে লুঠতরাজ চলছিল এবং খুনখারাবিও হচ্ছিল। কারফিউ কিছুটা শিথিল হলে দুলাভাইয়ের সাথে রিক্সা করে কোথাও যাওয়ার সময় সূত্রাপুর কাঠের পুলের ওপর থেকে নিচের প্রায় শুকনো খালে দুটি লাশ বিভৎস ভাবে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। বাংলাদেশে ইদানিং কথায় কথায় ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অজুহাত তুলে সংখ্যালঘুদের ওপর যে অত্যাচার করা হয়, তা আমাকে চৌষট্টির দাঙ্গার চোখ জ্বালা করা সেই দৃশ্যটিকে সামনে এনে দেয়।

যাই হোক, কারফিউর ফলে ইউসিস সেই যে তাদের সার্কারামাটি স্থগিত করেছিল তা আর চালু হয়নি। ফলে তা আমার আর দেখা হয়নি। কিন্তু সার্কারামা শব্দটি মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। সম্ভবতঃ ১৯৯২ সালে ফ্লোরিডার ডিজনিল্যান্ডে সর্বপ্রথম ও শেষবার একটি সার্কারামা দেখেছিলাম। তাতে চিনের অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দেখানো হয়েছিল। সেখানে দর্শকদের গোলাকৃতি একটি ঘরের মাঝে দাঁড় করিয়ে, আমাদের আটটি দিকের গোলাকৃতি দেয়ালে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হচ্ছিল। এ ছিল এক ঘোর লাগা অভিজ্ঞতা।

এই সূত্রে মনে পড়লো একটি সাইক্লোরামা দেখার কথাও। সময়টি ছিল ২০১৯ সালের মার্চ। ঢাকা থেকে আমার এক ভায়রা ভাই সরকারি কাজে আমেরিকায় এলে আমাদের অনুরোধে ছুটির দিনটি আমাদের সাথে কাটাচ্ছেন। তাকে নিয়ে বেড়াতে গেলাম আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অন্যতম ঐতিহাসিক একটি স্থান, পেন্সিলভানিয়া রাজ্যের গেটিসবার্গ শহরে। গাড়িতে আমার বাসা থেকে ৬৫ মাইল, ঘণ্টা দেড়েকের পথ।

 

 

বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হিসেবে ‘ফর দি পিউপল, বাই দি পিউপল,…’ বলে যা পড়ানো হতো এবং সম্ভবতো এখনও হয়, এই গেটিসবার্গের এক সমাবেশে দাড়িয়েই প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বক্তৃতার অংশ হিসেবে এই সংজ্ঞাটি দিয়েছিলেন।

সাইক্লোরামাতে প্রদর্শিত যুদ্ধক্ষেত্রের একটি দৃশ্য

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য গেটিসবার্গ ফাউন্ডেশন নামক একটি সংস্থা এই এলাকার সবগুলো যুদ্ধক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে প্রতিটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সহ স্মৃতিস্তম্ভ এবং সেই যুদ্ধে ব্যবহৃত কামান-বন্দুকগুলোও দর্শকদের জন্য রেখে দিয়েছে।

 

 

 

 

 

ড্রাইভ করে দেখার চেয়ে অল্প সময়ে অনেক কিছু জানতে পারবো ভেবে আমরা দুই ঘণ্টার জন্য মিউজিয়াম, প্রামাণ্য চিত্র এবং সাইক্লোরামার টিকেট কিনে নিয়েছিলাম।

গাড়িতে করে পুরো এলাকাটি ঘুরে আসতে কমপক্ষে দুই ঘণ্টার প্রয়োজন, আর কিছু কিছু স্থানে নেমে কিছুক্ষণ কাটাতে হলে ন্যুনতম সাড়ে তিন ঘণ্টার প্রয়োজন। সময়াভাবে আমরা মাত্র ঘণ্টাখানেক সেখানে কাটাতে পেরেছিলাম।

বিস্তৃত জায়গা ও সময় জুড়ে যে যে যুদ্ধ হয়েছিল তা ধারণ করা হয়েছে সাইক্লোরামা নামের প্রায় আধা ঘণ্টার (সঠিক সময়টি এখন ভুলে গেছি) এক প্রদর্শণীতে।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ইউরোপ ও আমেরিকায় সাইক্লোরামা একটি জনপ্রিয় শিল্প মাধ্যম ছিল। বিখ্যাত যুদ্ধ, ঐতিহাসিক ঘটনা বা সাহিত্যকর্মকে ক্যানভাসের ওপর অসংখ্য তৈলচিত্র অংকন করে একটি গোলাকৃতি ঘরের দেয়ালে পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে রাখা হতো। চিত্রগুলোর সামনে যুক্ত হতো সেই ঘটনা বা গল্প-উপন্যাসে বর্ণিত গাছপালা সহ প্রাকৃতিক দৃশ্য। ফলে চিত্রগুলো ত্রিমাত্রিক বলে প্রতীয়মান হতো। দর্শক কক্ষটির মাঝে দাঁড়িয়ে চারিদিকে চোখ বুলালে নিজেকে দৃশ্যে বর্ণিত সেই ঘটনার জীবন্ত সাক্ষী হিসেবে অনুভব করতে পারতেন। এই ধরণের প্রদর্শণী সাইক্লোরামা নামে প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে সিনেমার আবির্ভাবের সাথে সাথে সাইক্লোরামা পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় এবং দর্শককে গোলাকৃতি ঘরের কেন্দ্রে স্থাপন করে আটটি দিকে সার্কারামা’র আবির্ভাব ঘটে। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ইউসিস এর পক্ষ থেকে ঢাকা স্টেডিয়ামে তেমন একটি সার্কারামা দেখানো শুরু হয়েছিল তার কথা আগেই বলেছি।

সাইক্লোরামা প্রদর্শনী কক্ষে

 

সাইক্লোরামাতে প্রদর্শিত যুদ্ধক্ষেত্রের অপর একটি দৃশ্য

 

সাইক্লোরামাতে প্রদর্শিত যুদ্ধক্ষেত্রের একটি দৃশ্য

দি ব্যাটল অফ গেটিসবার্গ সাইক্লোরামা পাইন্টিং – বর্তমানে পৃথিবীতে যে একটি মাত্র সাইক্লোরামা অবশিষ্ট আছে তা হচ্ছে আমেরিকার পেন্সিলভানিয়া রাজ্যে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় গেটিসবার্গে ১৮৬৩ সালে যে বিভীষিকাময় কিন্তু মোড় ঘুরিয়ে দেয়া যুদ্ধটি সংগঠিত হয়েছিল, পর্দায় তা ধারণ করে রাখার জন্য প্যারিস থেকে পল ডমিনিক ফিলিপ্পোটক্স নামে এক শিল্পী আনানো হয়েছিল। যুদ্ধটি তিনি প্রত্যক্ষ করেননি বলে স্কেচবুক, পেন্সিল ও কলমের সাথে এনেছিলেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কিত ছোট্ট একটি গাইডবুক। পেইন্টিং-এ হাত দেবার আগে তিনি কয়েক মাস লাগিয়ে বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রটি শুধু পরিদর্শনই করেছিলেন যেন স্থানটির পাহাড়, টিলা, সমতলভূমি, নদনদী এবং গাছপালা সম্পর্কে তাঁর মনে একটি মানসচিত্র অংকিত হয়ে যায়। একই সাথে তিনি দৃশ্যগুলোর অসংখ্য স্কেচও আঁকেন। এই কাজে সাহায্যের জন্য তিনি বেশ কয়জন যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধার সাক্ষাৎকার নেন এবং স্থানীয় এক ফটোগ্রাফারকেও নিযুক্ত করেন। পেইন্টিং এর কাজে সাহায্যের জন্য নিজের পিতা সহ পাঁচজন সহকারী নিয়োগ করেন এবং দেড় বৎসরাধিক কাল কঠোর পরিশ্রম করে সাইক্লোরামাটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। তাঁর নির্মিত মূল সৃষ্টিটি উচ্চতায় ছিল ২২ ফুট, পরিধিতে ২৭৯ ফুট, এবং ওজনে ৬ টন! সাইক্লোরামাটি এতোই বাস্তবসম্মত ছিল যে ১৮৮৩ সালে শিকাগো শহরে প্রথম প্রদর্শণীটি দেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক যোদ্ধাকে চোখের পানি মুছতে দেখা গিয়েছিল।

সাইক্লোরামাতে প্রদর্শিত যুদ্ধক্ষেত্রের আরো একটি দৃশ্য

ব্যাটল অব গেটিসবার্গের সাইক্লোরামার মোট তিনটি প্রতিভূ বা ভার্সন বানানো হয়েছিল। গেটিসবার্গে যেটি প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল কয়েকদফায় তা সঞ্জীবিত বা রেস্টোরেশন হয়ে সর্বশেষ ২০০৮ সালে দর্শকদের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

বর্তমানে ৪২ ফুট উঁচু এবং ৩৭৭ ফুট পরিধির এই সাইক্লোরামা প্রদর্শণী স্থানটি আয়তনে একটি আমেরিকান ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়। দেয়ালে সাঁটা চিত্রগুলোর সামনে ও পেছনে সত্যিকারের পাথর ও ঘাস আচ্ছাদিত প্রান্তর এবং গাছ ও গাছের গুঁড়ি ফেলে দৃশ্যগুলোকে জীবন্ত করে তুলেছে। সাথে আছে যুদ্ধের ধারা বর্ণনা। আমরা যখন এটি দেখতে যাই তখন কামান ও বন্দুকের গর্জন এবং সেনাপতিদের আদেশ ও যুদ্ধাহতদের আর্তনাদের সাথে কামান ও বন্দুকের নল থেকে উদ্গত ধোঁয়ায় বারুদের গন্ধ সত্যিকারের এক যুদ্ধ দেখার অনুভূতি এনে দিয়েছিল। যারা ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক ঘটনা জানার আগ্রহ পোষণ করেন, শুধু তাঁরাই নন, সাধারণ পর্যটকরাও এটি দেখে এক অন্যরকম শিহরণ অনুভব করবেন বলে আমার বিশ্বাস।

গেটিসবার্গের নাগরিক সমাজ তাঁদের ইতিহাসকে যেভাবে জীবন্ত করে রেখেছে, তা দেখে বাংলাদেশে আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কতটুকু তুলে ধরতে পেরেছি বা চেষ্টা করেছি সেই ভাবনায় মাথা নত হয়ে আসে।

২১শে জুলাই, ২০২২