লিখেছেন: সত্য সারথী

আমার ঠিকঠাক মনে নেই, খুব সম্ভবত ১৯৯৭ সাল হবে। আমি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণীতে গ্রামেরই স্কুলে পড়তাম। সকালে স্কুলে যাওয়া, দুপুরে ফিরে আসা, বিকেলে আবার সেই স্কুলের মাঠেই ক্রিকেট খেলা। তখন টাকা দিয়ে ব্যাট আর বল কেনার মত এতো টাকা ছিল কোথায়, তাই কাঠ আর দা’এর সাথে যুদ্ধ করে তৈরি করা ব্যাট আর জনপ্রতি ২-৩ টাকা চাঁদা দিয়ে কেনা টেনিস বল দিয়েই চলতো খেলাধুলা। ছাত্র হিসেবে স্কুলে যেমন ছিলাম এক নাম্বার, অনুরুপ বাঁদরামিতেও কোনদিন দুই নাম্বার হই নি। পুরো মহল্লার কোন গাছের আম কখন পাকে, আর কোন গাছের আম কতটা মিষ্টি, তা ছিল মুখস্ত। সেই গাছের আম কিভাবে চুরি করে খাওয়া যায়, সেদিকেও ছিলাম নাম্বার ওয়ান। কতদিন যে নিজের গাছেরই বিভিন্ন ফল বন্ধুদের সাথে চুরি করে খেয়েছি, তার অন্ত নেই। আহ! সেই শৈশবটা যদি আবার ফিরে পেতাম।

আমার পরিবার ছিল প্রচন্ড ধার্মিক। বাবা-মা ইনাদের একবেলা খাবারের কথা ভুল হলেও হতে পারে কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কথা ভুল হবার কোন চান্সই ছিল না। বড় ভাইয়ের বয়স তখন ১৮ কিংবা ২০ এরকম হবে। এমন কোন দিন নেই, যেদিন ঘুমানোর আগে কিংবা খেতে বসার সময় আমাদের বাবা ইসলামী আদবের সহিত খাওয়া এবং আদবের সহিত খাওয়া শেষ করে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠার নিয়ম শেখাতেন না। পুরো সপ্তাহ যাই হোক, শুক্রবার কিন্তু বড় ভাইয়ের মসজিদে যাওয়া চাই-ই চাই। বাবাকে দেখেছি, যখন যে অবস্থাতে থেকেছেন, তখন সে অবস্থাতেই নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। আমার বাবা একজন গ্রাম্য কৃষক। অনেক দিন কাজ করতে করতে দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় না পেলে, মা আমাকে বাবার জন্য খাবার নিয়ে মাঠে যেতে বলতেন। আমি গিয়ে দেখতাম, বাবা মাঠের কোন এক শুকনো জায়গায় দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছেন। যদি কোনদিন কোন কারণে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়তে মিস করেছেন, তাহলে পরবর্তীতে সেই মিস হয়ে যাওয়া নামাজ পড়তে ভুল করতেন না। প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষে পড়ার জন্য আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলতেন। এ কাজটিই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর। আমি পড়তে বসলে বাবাকে দেখতাম, জায়নামাজে বসেই মাথা নাড়াচ্ছেন চোখ দুটো বন্ধ করে (যিকির করতেন), আবার কখনো কখনো তসবি হাতে তসবি পাঠ করতেন। প্রায়ই দেখতাম, বাবা মা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ফজরের নামাজ আদায় করতে। এরপর যে যার কর্মে লিপ্ত হয়ে যেতেন।

প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর পূর্বে চার কালেমা আর ছোট ছোট সূরা আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিতে ভুল করতেন না আমার মা। আমার বাড়ি থেকে দু-তিন মিনিটের দূরত্বেই ছিল হাফেজিয়া মাদ্রাসা এবং তার পাশেই ছিল মসজিদ। প্রতিদিন নিয়ম করে মসজিদে যাবার দরুন মসজিদের ইমামের সহিত বাবার খুব ভালো সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। এছাড়াও বাবার গ্রামে একটা আলাদা সম্মান ছিল, সবাই বাবার যেকোন বিষয়কে কিংবা গ্রামের যে কোন সিদ্ধান্তকে অনেক সম্মান করতেন। এখন গ্রামের এমন একজন লোকের ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে না, বিষয়টা কি ভালো দেখায়? আমি জানি না মাদ্রাসার হুজুর তথা মসজিদের ইমাম বাবাকে কি ধরণের ব্রেন ওয়াশ করেছিলেন, যার ফলে আমি স্কুলে অনেক ভালো ছাত্র হওয়া স্বত্বেও আমাকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে আলেম বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

তৎকালীন সময়ে আশেপাশের গ্রাম তো দূর, দূর দূরান্তের গ্রাম থেকেও ছেলেরা আসত মাদ্রাসায় পড়াশোনা করার জন্য। অন্যান্য গ্রাম থেকে যেসব ছাত্ররা আসত, তাদের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা করা হয়েছিল মাদ্রাসাতেই। ঘুমানোর জন্য জেলখানার মত গাদাগাদি করে মাদ্রাসাতেই ঘুমানো আর খাওয়ার জন্য লোকের বাড়িতে জায়গিরের ব্যবস্থা করা হয়। একেক জন ছাত্রকে একেক বাড়িতে ভাগ করে দেওয়া হল খাওয়ার জন্য। সেইভাবে আমাদের বাড়িতেও একজন ছাত্র রোজ তিনবেলা এসে খাওয়া দাওয়া করত। ছেলেটির নাম আমার মনে নেই। হালকা পাতলা শরীর, আকাশী রঙ্গের পাজামা আর পাঞ্জাবী, মাথায় সাদা টুপি। তিনবেলা আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়ার সুবাদে তার সাথেও আমার বেশ বন্ধুসুলভ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেই সুবাদে প্রায়ই আমি বিকেলে মাদ্রাসায় যেতাম, যখন তাদের খেলার সময় হতো। তাদের সাথে গোল্লাছুট খেলতাম, মাঝে মাঝে ক্রিকেট, আর বৃষ্টির বিকেলে ফুটবল।

হঠাত একদিন রাতে পড়ার সময় বাবা আমাকে মাদ্রাসায় পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানালে, আমি সরাসরি না করে দিলাম। ফলে খেতে হল ধমক। আমাকে অনেক বোঝালেন, বোঝালেন আমার মা’ও। কিন্তু কোন কিছুতেই আমাকে রাজি করাতে পারছিল না। প্রথম কারণ ছিল ভয়। আমি শুনেছি, মাদ্রাসার হুজুর ছাত্রদের অনেক মারধোর করেন। অনেক দিন দেখেছি আমার বাড়িতে খেতে আসা ছাত্রটির হাত, স্পষ্ট বেতের আঘাতের দাগ থেকে যেত। দ্বিতীয় কারণ ছিল, বন্দি জীবন। সারাদিন মাদ্রাসায় একটি মাত্র বড় ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হবে, ইচ্ছামত বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতে পারবো না, আর স্কুলের সহপাঠীদের ছেড়ে থাকতে হবে, এই কথাটা মনে হলেই মনের আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে যেত। বাড়ি থেকে যখন কোন কিছুতেই আমাকে রাজি করাতে পারছিল না, তখন অবশেষে বাবা একটি কৌশল অবলম্বন করলেন হুজুরের সাথে পরামর্শ করে।

হঠাত বিকেলে হুজুর আমাদের বাড়িতে আসলেন। আমার সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলছেন। শ্যামলা বরণ চেহারা, বিশাল ভূড়ির অধিকারী, কাঁচা-পাকা দাঁড়ি মেহেদী রঙ্গে রাঙ্গানো। আমার কাঁধে হাত দিয়ে গল্প শুরু করে দিলেন বিভিন্ন বিষয়ে। আমাকে বললেন, আমাকে নিয়ে গ্রামের মধ্যে ঘুরতে যাবেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম হুজুরের সম্মানের দিকে খেয়াল করে। হুজুর আমাকে বিভিন্ন মজার মজার গল্প শোনাতে শোনাতে স্কুলের পাশের দোকানে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে কয়েক রকমের চকলেট কিনে দিলেন। বিকেলটা খারাপ কাটলো না মোটেও। এরপর থেকে দু একদিন পর পরই হুজুর আসতেন আর আমাকে নিয়ে ঘুরেত বের হতেন। আমার বাড়ির জায়গীর ছেলেটাও দেখি ইদানিং আমার সাথে বেশ সময় কাটায়, কখনো খেলা করে, কখনো বা গল্প করে। সে বিকেলে আমাকে নিয়ে যায় মাদ্রাসায় খেলার জন্য, আমিও যাই মাঝে মাঝে। এরকম চলতে চলতে একটা সময় হুজুরের প্রতি আমার যে ভয় ছিল, সেটা দূর হয়ে গেল। একটা আলাদা ভালো লাগা তৈরি হল হুজুরের সাথে। আমাকে হুজুর বললেন, কাল সকালে স্কুলে না গিয়ে মাদ্রাসায় এসো, যদি তোমার ভালো না লাগে, তাহলে আর আসতে হবে না।

আমিও রাজি হয়ে গেলাম। আমার জানামতে ঐদিনই প্রথম ছিল, যেদিন বাড়িতে থাকা স্বত্বেও আমি স্কুলে গেলাম না। দেখলাম বিশাল ঘরে প্রায় ৩০-৩৫ জন ছাত্র গোল হয়ে পড়াশোনা করছে। হুজুরের জন্য রুম আলাদা ছিল। আমি যেতেই হুজুর আমাকে ডেকে তার পাশে বসালেন। তারপর একেএকে ছাত্রদের ডাকলেন এবং তাদের পড়া নিতে থাকলেন। কেউ বা মাটিতে বসে পুরো শরীরটাকে সামনে পেছনে দোল খাইয়ে খাইয়ে হুজুরকে পড়া শোনাচ্ছে, কেউবা আবার বডির দোলনটা ঠিক রেখে শুধু মাথাটাকে সামনে পেছনে দোল খাইয়ে পড়া শুনাচ্ছে। যখন হুজুরের কোন ছাত্রকে প্রয়োজন পড়তো, তখন হুজুর তার বেত দিয়ে কাঠের টেবিলে জোরে আঘাত করতেন, সেটা শুনেই ছাত্ররা বুঝতে পারতেন এটা কিসের সঙ্কেত, অমনি কোন সিনিয়র ছাত্র হুজুরের সামনে হাজির হতেন।

আমি প্রতিদিন সকাল বেলা মাদ্রাসায় যাওয়া শুরু করলাম। সেখান থেকে ফিরে চলে যেতাম স্কুলে। ধীরে ধীরে মাদ্রাসার প্রতি ভালোলাগা বাড়তে থাকলো, আর অন্যদিকে স্কুলে যেতে না দেওয়ার জন্য বাড়িতে চাপ বাড়তে থাকলো। এই উভয় চাপের মাঝখানে পরে মাদ্রাসায় পড়তে রাজি হয়ে গেলাম, উপায় না দেখে। এখন আমি পার্মানেন্ট মাদ্রাসার ছাত্র। বাড়ি থেকে কাঁথা-বালিশসহ আমাকে পাঠানো হল মাদ্রাসায়। পাশেই বাড়ি হওয়া স্বত্বেও বাড়ি যাওয়া ছিল হুজুরের নিষেধ। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ বার বাবার সাথে দেখা হতো মসজিদে। প্রয়োজনীয় কোন কথা থাকলে সেখানেই সেরে নিতাম। কিন্তু মায়ের সাথে দেখা হতো না। হুজুর পরামর্শ দিয়েছিলেন, বাড়ির প্রতি আকর্ষণ কমলেই মাদ্রাসার প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। আর একজন বাবা যদি তার ছেলেকে আলেম বা হাফেজ বানাতে পারেন, তবে তার জান্নাত আর ঠেকায় কে? বাবা আমার জন্য চিন্তা করে নাকি নিজের জান্নাতের টিকেট কনফার্ম করার জন্য আমি স্কুলের ভালো ছাত্র হওয়া স্বত্বেও আমাকে মাদ্রাসায় পাঠালেন, বুঝতে পারিনি তখন কচি মগজে।

প্রতিদিন ফজরের আযানের পূর্বে হুজুরের টেবিলের উপর বেতের আঘাতের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেত আমাদের। যে যার মত বিছানা গুছিয়ে রেখে হাত মুখ ধুয়ে অযু করে পড়তে শুরু করতাম। কিছুক্ষন পরেই যেতাম মসজিদে ফজরের নামাজের জন্য। প্রথম দিকে বাড়ি থেকে মাদ্রাসায় খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হতো আমার জন্য। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর বাড়িতে যাবার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিলে, হুজুর আমাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য বাড়িতে পাঠানোর আদেশ দেয়। আমি সেদিন মাদ্রাসা থেকে কতটা দ্রুতবেগে দৌড়ে বাড়ি গিয়েছিলাম তা জানি না, তবে মনে হচ্ছিল আজ মুক্ত হয়েছি। মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছিলাম। আমি আর মাদ্রাসায় যেতে চাইছিলাম না। আমার এমন অবস্থা থেকে মায়ের চোখের কোণও খানিকটা ভিজেছিল ঐদিন। তাই বাবাকে বলল, আজকের দিনটা থাক বাড়িতে, তুমি হুজুরকে বলে দিও।

পরের দিন অনেকটা মাইরের ভয় দেখিয়েই পাঠিয়ে দেয়া হল মাদ্রাসায়। দিন দিন হুজুরের মুখোশটা যেন উন্মোচিত হতে থাকলো। হাঁসিমাখা সেই মুখটা যেন আর সাধারণত চোখে পরে না। বেশিরভাগ সময়েই হাতে থাকতো বেত। সবাই হুজুরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলত মাথা নিচু করে, হুজুরের চোখে চোখ রেখে নয়। অনেক ছাত্রের বাবা মা অন্যান্য গ্রাম থেকে যখন ছেলেকে দেখতে আসে, তখন অনেক ছেলেই বাড়ি যাবার জন্য বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি জুড়ে দিত, কিন্তু বাড়ি আর যাওয়া হতো না। বাবা মা অনেক ভাবে ছেলেটাকে ভুলিয়ে, হাতে কিছু টাকা দিয়ে, তার পছন্দের কিছু খাবার দিয়ে, আড়ালে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে যেত।

আমি আস্তে আস্তে দেখতে লাগলাম, পড়া না পারলে হুজুরের বেতের আঘাত কিভাবে ছাত্রদের পায়ে কিংবা হাতের তালুতে গিয়ে পরে। কিভাবে মাটিতে দুপায়ের চারপাশে বেত দিয়ে বৃত্ত বানিয়ে সেই বৃত্তের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে বেতের সাহায্যে সজোরে আঘাত করা হয়। আর সেই আঘাত লাগার পরে কোন কারণে যদি দুটো পায়ের একটিও সেই বৃত্তের বাইরে আসে, তাহলে মাইর পুনরায় প্রথম থেকে শুরু হয়। এখানে আরেকটি বিষয় বিশেষ ভাবে বলে রাখা ভালো যে, ব্যথা যত জোরেই লাগুক না কেন, কান্নার আওয়াজ করা যাবে না। কাজেই আপনি মাদ্রাসা কিংবা মাদ্রাসার আশেপাশে থাকলে, বেতের আঘাতের শব্দ শুনতে পেলেও, কান্নার আওয়াজ কখনোই শুনতে পাবেন না।

আমি প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন মুখস্ত করি, যেদিন হুজুর আমাকে প্রথমে ডাকে পড়া দেয়ার জন্য, সেদিন কোন সমস্যা হয় না, কিন্তু যেদিন দু-চার জন মাইর খাওয়ার পরে ডাকে, সেদিন মাইরের ভয়ে হুজুরের চেহারা মোবারকে তাকানোর পরেই আমি সমস্ত মুখস্ত পড়া ভুলে যেতাম, ফলে মাইরের কোন অভাব হতো না। কেউ কোনদিন কোনভাবেই বুঝতে চায় নি, আমি কেন পড়তে না পারার জন্য মাইর খাই। বাবা মনে করত মাদ্রাসায় পড়ার মনোযোগ নেই বলে মাইর খাই, আর হুজুর চেষ্টা করতো, যেকোন মূল্যে আমাকে ভালো ছাত্র বানিয়ে বাবার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। ফলে দু দিকের প্রচেষ্টায় আমি যেন ধীরে ধীরে চ্যাপ্টা হতে লাগলাম।

আমার ছোটবেলা থেকেই একটা মারাত্মক বদঅভ্যাস ছিল, মাঝে মধ্যেই ঘুমের ঘোরে বিছানায় প্রস্রাব করতাম। এখানে হাঁসির কিছুই নেই, অনেকেরই এই সমস্যা থাকে ছোটবেলায়। প্রচন্ড শীতের রাত। একদিন ভোরবেলা আমার এমন একটা অঘটন ঘটে গেল। এখন পাক পবিত্র না হয়ে কিভাবে কোরান নিয়ে পড়তে বসি? আমি এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। আমার এমন অবস্থায় কেউ বা মুখ চেপে হাঁসে, আবার অনেকেই আমার পরিণতির চিন্তা করে মুখ শুকিয়ে ফেলে। এক কান দু কান হতে হতে বিষয়টা হুজুরের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেল। হুজুর এসে মাদ্রাসার পেছনের পুকুর দেখিয়ে বলল, ওখান থেকে গোসল করে আসতে। ঠান্ডা আর কুয়াশার চোটে একটু দূরে কি আছে দেখার উপায় নাই। শিরশির বাতাসে হাঁটুর সহিত আরেক হাঁটুর ঠকঠক আঘাত লাগছিল কিনা মনে নেই, কিন্তু উপরের পাটির দাঁতের সাথে নিচের পাটির দাঁতের যে একটা যুদ্ধ চলছিল, সেটা মনে আছে স্পষ্ট।

পুকুরের এক তৃতীয়াংশ কচুরি পানায় ঢাকা থাকায় গরম কালে সূর্যের উত্তাপ সেই স্থানের পানিতে পতিত না হবার দরুন, গরমকালে ঐ পুকুরের পানি গোসলের জন্য সাক্ষাৎ যেন জান্নাতি ঝর্না ধারার পানি। আর একই কারণে শীতকালে যে কি অবস্থা হতে পারে, সেটা মনে হয় আর ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। হুজুরের মাইরের কথা চিন্তা করে সেই পুকুরে নামতে বাধ্য হলাম। পুকুরের পানিতে নামার পরে শরীরের নিচের অংশ শরীরের সাথে লেগে আছে নাকি নাই, তা ক্ষনিক সময়ের জন্য বুঝতে পারিনি। গোসল সেরে পড়তে শুরু করলাম যথা নিয়মে। ঐদিন থেকেই ঠান্ডা জ্বর। আল্লাহর যেন এক কঠিন পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল এতো ছোট বয়সে আল্লাহর কোরান তেলায়াতের বিনিময়ে। খুব সম্ভবত দু দিন বাড়িতে ছিলাম অসুস্থতা নিয়ে। বাড়িতে বিষয়টি বলার পরে আমি তাদের চেহারায় কোন কষ্ট কিংবা অন্য রকম কোন অনুভূতি দেখতে পেলাম না। কারণ হয়তোবা বাবা-মা আর জান্নাতের মাঝখানের সিঁড়ি ছিলাম আমি, সেইজন্য।

হঠাত একদিন দেখলাম হুজুরকে নিয়ে গ্রামে একটা বিচার বসেছে। কারণটা তখন জানতাম না। শুধু এটুকু জানতে পারলাম যে, ঐ হুজুর যে বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করতেন, তার পাশের বাড়ির গিন্নীর সাথে গোপন যোগাযোগ ছিল, যা কোনভাবে প্রকাশ পেয়ে গেছে। বিচারে ঠিক কি হয়েছিল তা জানি না, তবে সেই বিচারের পর থেকেই হুজুর মাদ্রাসা থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছিলেন। ক্ষনিক সময়ের জন্য মনে হল বোধহয় মুক্তি পেলাম। কিন্তু পরোক্ষনেই জানলাম, আগামী কালই পাশের গ্রাম থেকে আরেক হুজুর আসবে। থেমে যাওয়া বৈশাখী ঝড় যেন আবারো শুরু হল মনের ভেতর। কালো রাত শেষ হয়ে যেন সকাল আর আসে না।

এরপর আসলো মিজানুর রহমান হুজুর। তৎকালীন সময়ের কোরানের হাফেজ, বিশাল সম্মানের ব্যাপার। ৪০-৪২ বছরের ফর্সা সুন্দর চেহারার অধিকারী ছিলেন তিনি। কালো কুচকুচে মাথার চুল ও দাঁড়ি, সাদা কালারের স্টাইলিশ পাঞ্জাবি আর সেই সময়কার দামী স্টাইলিশ টুপি। হুজুর যখন হাসতেন, তখন যেন উনার চেহারায় সবচেয়ে সুখী মানুষের ভাব ফুটে উঠত। কিন্তু যখন রেগে যেতেন, তখন উনার চেহারা ব্যাখ্যা করার মত ভাষা আমার জানা ছিল না। এই হুজুরের নাম স্পষ্ট মনে থাকার একটা বিশাল কারণ রয়েছে। হয়তো এই নাম ইহ জীবনে আর ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমাদের নিকটে উনি মিজান হুজুর নামেই পরিচিত।

যথারীতি পূর্বের নিয়মে মাদ্রাসায় লেখা পড়া শুরু হল। আমি তখন সিপারা শেষ করে কোরান পড়ছি। মাঝখানের আমপারা কিতাব হুজুর আমার হাতে দেয় নি। কারণ, আমি যখন সিপারার শেষের দিকে পড়তাম, তখন থেকেই কোরান পড়া শুরু করেছিলাম সিনিয়রদের হেল্প নিয়ে। বিষয়টি একদিন হুজুর গোপনে লক্ষ্য করে দেখলেন যে, আমি নির্ভুল ভাবেই কোরান তিলায়াত করতে পারি। তারপর থেকেই ডাইরেক্ট আমাকে কোরান দিয়েছেন। দিনের নিয়মে দিন আর সময়ের নিয়মে সময় চলতে থাকলো। একটু একটু করে কোরান মুখস্ত হচ্ছিল আমার। কিছুদিন যেতে না যেতেই হুজুরের আসল চেহারা স্পষ্ট হতে থাকলো। অমানুষিক মাইর কারে কয়, আমি জীবনে মনে হয় ওটাই প্রথম দেখেছিলাম। এমনও হয়েছে যে, ছোট ছোট ছাত্ররা যখন পড়া করতে পারত না, আর হুজুর যখন মাইরের জন্য টেবিলের ওপর থেকে বেত হাতে নিতেন, ঐ ছাত্রটি ভয়েই কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়ানো অবস্থাতেই প্রস্রাব করে পাজামা ভিজিয়ে ফেলতেন। এরপরেও মাইরের কোন বিকল্প ছিল না। আমার গ্রামেরই একটা ছেলে ছিল, নাম জানা স্বত্বেও সঙ্গত কারনেই অরিজিনাল নাম ব্যবহার করলাম না। আমি ধরে নিলাম ঐ ছেলেটির নাম রাশেদ। জানি না কেন, সে একটা দিনও হুজুরের দেয়া পড়া রেডি করতে পারে না। ফলে প্রত্যেকটা দিন সে অমানুষিকভাবে নির্যাতিত হতে থাকতো। পালিয়ে বাড়ি গেলেও রক্ষা ছিল না। বাবা-মা আবার জোর করে হুজুরের কাছে দিয়ে যেত, আর হুজুরকে বলে দিতেন, মাংশ আপনার, আর হাড্ডি আমার। শুধু বেঁচে থাকলেই চলবে।

আমি মাইরের ভয়ে যত কষ্টই হোক না কেন, হুজুর যতটুকু পড়া দিত, তা অটোভাবে মুখস্ত হয়ে যেত। বিশ্বাসীরা হয়তো এটাকে আল্লাহর হেকমত বা রহমত মনে করতে পারেন। কিন্তু মূল বিষয়টা যে আসলে কি, সেটা একমাত্র আমিই জানতাম। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, আজ যতটুকু পড়া কমপ্লিট করতে পেরেছি, তারপর দিন হুজুর আরেকটু বেশি পরা দিত। এভাবে দিনের পর দিন ক্রমাগত পড়া বৃদ্ধি পেতে পেতে আমার ক্ষমতার অত্যাধিক বেশি বোঝা চাপানো হয়ে গেল। আমি আর ঐদিন পড়া করতে পারলাম না। সকালে হুজুরকে পড়া দিতে হবে। কি পরিমাণ মাইর খেতে হবে, সেটা চিন্তা করতেই মস্তিষ্কের নিউরনগুলো যেন অবশ হয়ে যাচ্ছিল। পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন ঠান্ডা বরফ গলা পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছিল।

পরপর তিন জন পড়া দিতে গিয়ে তিন জনই অমানবিক মাইর খেয়ে পাছায় হাত দিয়ে ডলতে ডলতে ফিরে আসলো আর চোখে ছলছল অশ্রু। আরেক জন তো ফিরে এসে মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। আর তিন জন পর আমার পড়া দেবার সিরিয়াল আসবে। আমি দিগ্বিদিক জ্ঞান হারা হয়ে প্রস্রাব করার অযুহাতে বের হয়ে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাড়ি যাওয়া যাবে না, কারণ বাড়ি গেলে পুনরায় যদি সেই রাশেদের মতো আবার মাদ্রাসায় দিয়ে যায়, তারপর তো অবস্থা আরো খারাপ হবেই, সেই সাথে পালিয়ে কেন গিয়েছিলাম এর জন্য একদফা স্পেশাল মাইর খেতে হবে একদম ফ্রিতে। দুই গ্রাম পরে আমার চাচার বাড়ি। তৎকালীন সময়ে সেই গ্রামে যেতে কোন রাস্তা ছিল না। বর্ষার সময় নৌকা, আর শুকনো মৌসুমে সোজা মাঠ পেরিয়ে রাস্তা। কাদামাটির রাস্তা থাকলেও তিনগুন পথ বেশি হাটতে হয়, কোন যান বাহনের ব্যবস্থা ছিল না। আমি একা একা অনেকবারই গিয়েছি সেখানে, সমবয়সী চাচাতো ভাইদের সাথে আড্ডা মারতে। হেঁটে গেলে বেশিদূর যাবার আগেই আমাকে দেখে ফেলতে পারে, তাই দৌর দিলাম। ৪-৫ কিলোমিটার রাস্তা কত দ্রুত বেগে যে দৌড়িয়েছিলাম অন্তত চোখের আড়াল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত, তা আজ আর মনে পরে না।

কিছুটা পথ দৌড়িয়ে, কিছুটা পথ দ্রুত বেগে হেঁটে, যখন শরীর একেবারেই নাজেহাল অবস্থা, তখন উঁচু আইলের ওপাশে শুয়ে পড়তাম, যাতে আমাকে খুঁজতে এসে কেউ দেখতে না পায়। অবশেষে চাচার বাড়ি পৌঁছে গেলাম। সবাই আমাকে দেখে অনেক খুশি, অনেক দিন পরে বেড়াতে এসেছি। চাচা চাচী জিজ্ঞেস করেছিল, আমি বাবা মাকে বলে এসেছি কিনা। আমি জবাবে বলেছিলাম, মাদ্রাসা এক সপ্তাহের জন্য ছুটি, তাই বাবা মাকে বলেই এখানে বেড়াতে এসেছি।

ওদিকে মাদ্রাসা তো দূর, পুরো গ্রাম হুলস্থুল কান্ড বেঁধে গেল আমাকে নিয়ে। আমি কোথায় যেতে পারি, কারো মাথা তখন কাজ করছিল না। হুজুর নাকি কিসব দোয়া দরুদ পড়ে ধ্যানে বসে জানতে পেরেছিলেন, আমাকে নাকি পরী ধরে নিয়ে গেছে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রদের সাথে নাকি অনেক সময় এরকম হয়েই থাকে। হুজুর তখন সেই পরী বশ করার চেষ্টায় আছে। তবে আমার বাবা-মাকে এও বলে সান্ত্বনা দিয়েছে যে, আমার কোন ক্ষতি হবে না, অবশ্যই ফিরে আসবে, হয়তো একটু সময় লাগতে পারে। হুজুর তার মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমি তো বহাল তবিয়তেই রয়েছি। দু’দিন অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরেও যখন কোন সমাধান হল না, তখন বাবা একজন লোক পাঠালো সর্বপ্রথম আমার ফুফুর বাড়ি। আমাদের আশে পাশের গ্রামেই তিন ফুফুর বাড়ি। সেখান থেকে রেজাল্ট আসলো নেগেটিভ। আমি সেখানে নেই। এরপর লোক পাঠালো চাচার বাড়ি এবং এসে আমাকে পেয়েও গেল। আমি সেই লোকের সাথে গেলাম না। এরপর বড় ভাই আসলো, আমি উনার সাথে চলে গেলাম বাড়ি। স্পষ্ট করে বলে দিলাম, মাদ্রাসায় পাঠানোর চেষ্টা করলে, এরপর হয় চিরদিনের জন্য কোথাও পালিয়ে যাবো, নয়তো আত্মহত্যা করবো। সবাই অনেক ভয় পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলো, আমাকে আর মাদ্রাসায় দিবে না। আমি মাদ্রাসার পাঠ চুকিয়ে আবারো স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। সামনেই চতুর্থ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে পরীক্ষাটা দিয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠলাম। ওদিকে হুজুর সুযোগ পেলেই বাবার ব্রেনওয়াশ করতে থাকে। বাবা তখন বিভিন্ন ছুতোয় নাতায় আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। আমাকে নাকি আর কোনদিন মারবে না হুজুর, এবার মাদ্রাসায় গেলে। তিনবেলা খাবার জন্য বাড়ি আসতে পারবো ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ঐদিনের ঘটনার পর থেকে আর কোনদিন জোর করে কিছু বলেনি।

আমি পুনরায় নিয়মিত স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম, তবে মাদ্রাসার ড্রেসটা আর ছাড়তে পারলাম না। অনেক দিন পর থেকে, হয়তো ২-৩ মাস পর থেকে মাদ্রাসার পোশাক ছেড়ে অন্যান্যদের মতোই সাধারণ পোশাকে স্কুলে যাওয়া শুরু। দীর্ঘদিন মাদ্রাসায় পড়াশুনা করার জন্য, আমার ভেতরে দারুন ভাবে ধর্মভীতি গেঁথে গিয়েছিল। তাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ছাড়তে পারছিলাম না। কখনো বাবার সাথে মসজিদে, কখনো বা একা একাই বাড়িতে।

হঠাত একদিন গ্রামজুড়ে হৈ হৈ রৈ রৈ অবস্থা বেঁধে গেল। যে যেভাবে পারছে, দৌড়ে যাচ্ছে মাদ্রাসার দিকে। তখন আমি কেবল মাত্র স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কৌতূহলটাকে আর এড়িয়ে যেতে পারলাম না। আমিও অন্যান্যদের মতো দৌড়ে মাদ্রাসার দিকে রওয়ানা হলাম। সেখানে পৌঁছেই দেখি, যেসময় সমস্ত ছাত্রের পড়াশোনা করার কথা, সেই সময় সমস্ত ছাত্ররা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বুঝতে পারলাম, কিছু একটা অঘটন নিশ্চয় ঘটেছে। এরপর ধীরে ধীরে সমস্ত রহস্য উন্মোচিত হল। পূর্বেই বলেছিলাম আমাদের গ্রামেরই একটা ছেলের কথা, রাশেদ। যে প্রতিটা দিন হুজুরের হাতে মাইর খেত পড়া করতে পারতো না বলে। ঐ ছেলেটাই মূলত সেই অঘটনের মূল হোতা। সে একদিকে হুজুরের মাইর আর অন্যদিকে বাড়ির প্রেসারের ফলে মাদ্রাসা থেকে মুক্তির কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে, অবশেষে এক ভয়ংকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐ ছেলেটি আমার থেকে ৩-৪ বছরের বড় হবে বয়সে। সে হুজুরকে খুন করে মুক্তির একটা পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলে।

সকালে যখন সমস্ত ছাত্র একসাথে খেতে বসেছিল নিজ নিজ খাবারের বাটি নিয়ে, ওমনি তারা কীটনাশকের বাজে গন্ধ পায় খাবারের নিকট থেকে। কিন্তু কার বাটি থেকে এমন গন্ধ বেরোচ্ছে, তা বুঝতে না পেরে মাদ্রাসার সিনিয়র এক ছাত্র হুজুরকে ডাক দিলে, হুজুর একটা একটা করে বাটি চেক করতে গিয়ে অবশেষে ধরা পড়লো ব্যাপারটি। যে মাটিতে কীটনাশক ছিল, ঐ বাটি আর হুজুরের খাবারের বাটি প্রায় একই রকম ছিল। কাজেই হুজুরের খাবারের বাটি মনে করে, এক ছাত্রের বাটিতেই কীটনাশক মিশিয়ে দেয় খাবারের মধ্যে। কিন্তু ঘটনাটি কে ঘটিয়েছে তার কোন প্রমাণ না থাকায়, হুজুর সন্দেহ মূলক ভাবে ঐ রাশেদকেই যখন পিটানি শুরু করে, তখন সে নিজ থেকেই সব বলে দেয়। এরপর গ্রামে ডাকা হল সালিশ। মেম্বার চেয়ারম্যান সহ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অল্প সময়ের মধ্যেই হাজির হয়ে গেল মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে। ছেলেটিকে যে কি পরিমাণ মাইর দেওয়া হয়েছিল, তা কল্পনার অতীত। আমি ছেলেটির আর্তনাদ সহ্য করতে না পেরে একটা দৌড় দিয়ে ওইস্থান ত্যাগ করেছিলাম। এক দৌড়ে ততদূর পর্যন্ত গিয়েছিলাম, যতদূর পর্যন্ত গেলে ঐ আর্তনাদ আমার কানে আসবে না। এরপর থেকে মাদ্রাসা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।

ছোটবেলা থেকেই আমার বিজ্ঞানের প্রতি ইন্টারেস্ট ছিল। তাই বিজ্ঞান বিভাগেই এস.এস.সি পাশ করে, পুনরায় বিজ্ঞান বিভাগেই ভর্তি হলাম কলেজে। ছোটবেলা থেকেই আমার গল্প উপন্যাসের বই পড়তে ভালো লাগতো না। আমার এমন কোন বই পড়তে সবচেয়ে ভালো লাগত, যা পড়ার পর অনেক রকম চিন্তা এবং প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করবে। তাই হাতের কাছে সেরকম কোন বিজ্ঞানের বই পেলে, সেটা পড়তে মিস করতাম না। সেই সাথে চলছে আমার সপ্তাহে একদিন জুম্মার নামাজ, একই সাথে কোরান তেলায়াত। আমি একটা মেসে থাকতাম, রুমমেট ছিল দর্শন বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের এক বড় ভাই। মাঝে মধ্যে যখন উনার পাঠ্যবই হাতাহাতি করতাম, তখন সূচিপত্রে দেখি ধর্ম, বিশ্বাস, আস্তিকতা, নাস্তিকতা বিষয়ে কিরকম সব উদ্ভট বিষয় উল্লেখ করা। আমি তখনো জানতাম না যে, মানুষ নাস্তিকও হতে পারে। আমার ধারণা ছিল, বিশ্বের প্রতিটি মানুষই কোন না কোন ধর্মে নিশ্চিত। কিন্তু এইরকম ভাবে যে ডাইরেক্ট সকল রকম ধর্ম ও স্রষ্টায় অবিশ্বাসীও হতে পারে, তা ঐ রুমমেট বড় ভাইয়ের কাছে থেকেই সর্বপ্রথম জানতে পারলাম। মূলত নাস্তিক শব্দটির সাথেই আমি পরিচিত ছিলাম না। কৌতূহলটাকে আর কিছুতেই দমাতে পারলাম না। কারণ, যে ধর্ম ও স্রষ্টায় বিশ্বাসী, তার নিকট বিশ্বাসের যুক্তি অবশ্যই রয়েছে, তদ্রুপ যে অবিশ্বাসী, তার নিকটও অবিশ্বাসের কোন না কোন স্ট্রং যুক্তি অবশ্যই থাকবে। কি সেই যুক্তি, তা আমাকে জানতেই হবে। কাজেই বাহির থেকে আর কোন বই সংগ্রহ নয়, বড় ভাইয়ের পাঠ্যবই-ই হয়ে উঠল আমার এক্সট্রা ব্যয় করা সময়ের একমাত্র মাধ্যম।

যতই পড়ছিলাম, ততই যেন মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছিল। এ কি লেখা আছে এসব? এটাও কি সম্ভব? হাজারো প্রশ্ন মাথায় পেইন দিতে শুরু করলো। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি প্রশ্ন কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছিল না। নাস্তিকতা বিষয়টিকে আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। ধর্ম পালন না করুক, আল্লাহকে না ডাকুক, তাই বলে ডাইরেক্ট আল্লাহকে অস্বীকার, ধর্মকে অস্বীকার, নবী আর কোরানকে অস্বীকার, মানতে পারছিলাম না কিছুতেই। অন্যদিকে যেসব প্রশ্ন মনের মধ্যে ঝড় তুলেছে, সেসব প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমনও মনে হচ্ছিল যে, এসব প্রশ্ন মনে আনাই পাপ, তবুও ভুলতে পারছিলাম না। অবশেষে বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম একদিন। আমি বললাম,
“আচ্ছা ভাই, এই যে আমাদের সামনে বই, খাতা, কলম এগুলো সবই তো সৃষ্টি করেছে মানুষ। আপনা থেকেই তো সৃষ্টি হয় নি তাই না?”
উনি জবাবে বললেন, “হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই।“
আমি বললাম, “আমরাও তো নিজে থেকে সৃষ্টি হই নি। বাবা মাকে মাধ্যম করে আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন।“
উনি আবারো জবাবে বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই।
আমি আবারো প্রশ্ন করলাম, “তাহলে আল্লাকে কে সৃষ্টি করেছে?”

বড় ভাই এবার বড় বড় চোখ করে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। একবার আমার প্রতি তাকায়, একবার উনার টেবিলের বইগুলোর প্রতি তাকায়। উনি বুঝতে পারলেন, তার বই পড়েই আমার মধ্যে এসব প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। উনি বললেন, আল্লাহ সৃষ্টি ও ধ্বংসের ঊর্ধ্বে, জন্ম ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। আল্লাহ যদি সৃষ্ট কিংবা জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে তাঁর ধ্বংস কিংবা মৃত্যু অবশ্যই ঘটতো প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী। তাহলে কি তিনি আল্লাহ হতে পারতেন?

আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম, না। কিন্তু উত্তরটা কেন জানি আমার মনের মতো যুক্তিযুক্ত হল না। তাই আর কোন প্রশ্ন না করে, চুপ রইলাম। আর উনি আমাকে বললেন, নিজের পড়ার বই বাদ দিয়ে আমার পড়ার বই নিয়ে টানাটানি কেন শুনি? নিজের পড়ায় মন দাও।

আমার মাথায় এই একটা বিষয় কিছুতেই ঢুলছিল না যে, স্রষ্টা ছাড়া যদি সৃষ্টি সম্ভব না হয়, তাহলে স্রষ্টার স্রষ্টার স্রষ্টা থাকবে না কেন? অবশেষে এক জুম্মাবারে জুম্মার নামাজ শেষ করে বসে রয়েছি। শহরের মসজিদ, শুক্রবারের জামায়াতে প্রচুর মুসল্লির আগমন ঘটে। এতো বড় মসজিদের ইমাম নিশ্চয় কোন ছোটখাটো ইমাম হবেন না। তাই এই প্রশ্নটি হুজুরের নিকটে করবো চিন্তা করেই মসজিদের সকল মুসল্লি চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছি একদম শেষ কাতারে বসে। একে একে সমস্ত মুসল্লি চলে গেলে, ইমাম সাহেবও বের হতেই দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হলে, ইমাম সাহেব আমার নিকট এসে বললেন, তুমি বাড়ি যাবে না?
আমি বললাম, হুজুর, কিছু মনে না করলে, আপনার কাছে আমার একটি বিষয় জানার ছিল।
হুজুর আগ্রহের সহিত বলল, কি বিষয় বাবা, বলো?
আমি বললাম, হুজুর, স্রষ্টা ছাড়া যদি সৃষ্টি সম্ভব না হয়, তাহলে আল্লাহর স্রষ্টা কে?
আমার প্রশ্ন শুনে ইমাম সাহেবের চোখ যেন বিস্ফোরিত নেত্রে পরিণত হলো। এতো ছোট ছেলের মুখে এতো বড় প্রশ্ন হয়তো হুজুর আশা করেন নি এজন্যই। হুজুর আমাকে বললেন, বাবা এখন তো খাবার সময়, তুমি বাসায় যাও, বিকেলে আসরের নামাজ শেষে আমার সাথে দেখা কর, তখন আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দেবো, ঠিক আছে?

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে, হুজুরকে সালাম দিয়ে চলে গেলাম। পুনরায় যথাসময়ে হাজির। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেড়িয়ে একটা কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, তুমি ১,২,৩ এভাবে নিশ্চয় গুনতে পারো। আমি বললাম, হ্যাঁ পারি তো। হুজুর বললেন, তাহলে ৫ থেকে উল্টো দিকে গুনতে থাকো।
আমি ৫, ৪, ৩, ২, ১ বলে থেমে গেলে হুজুর বললেন, এরপর কি?
আমি বললাম, ০ (শূন্য)। হুজুর আবারো বললেন, তারপর?
আমি বললাম, তারপর তো আর কিছু নেই।
হুজুর বললেন, তার মানে শুন্যের পূর্বে আর কিছু নেই তো? আল্লাহও ঠিক এরকম। যার পূর্বে আর কিছু নেই। যেখান থেকেই সব কিছুর সূচনা।
হুজুরের উত্তরটাও আমার কেন যেন মনমতো হল না। কারণ, শুন্যের পরে আর কিছু থাকে না, সেটা তো গণিতের সাধারণ হিসাব। কিন্তু বাস্তবে শুন্যের পূর্বেও তো -১, -২, -৩, -৪ এভাবে চলতেই থাকবে অসীম পর্যন্ত। তাহলে এটা কি হুজুরের উত্তরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হল? বিষয়টা রয়েই গেল প্রশ্নাকারে মনের ভেতর। আমার রুমমেটও বেজায় ধার্মিক, শুক্রবারের নামাজ, রমজানের রোজা, বিশেষ বিশেষ রাতে সারা রাত জেগে ইবাদত মিস করতেন না। সাথে সাথে আমিও থাকতাম এসব ইবাদতে। কেননা, আমার ধারণা ছিল, ধর্মের কিছু বিষয় বিভিন্ন মোল্লাদের দ্বারা অতিরঞ্জিত হতেও পারে, তাই বলে ধর্ম আর আল্লাহ তো মিথ্যা হতে পারে না। আমার প্রশ্নের উত্তর দু একজন মানুষ দিতে পারছে না বলে তো এমন নয় যে, এই প্রশ্নের উত্তর দুনিয়ার কোন মানুষের কাছেই নেই।

আমি এখন এইচ.এস.সি ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছি। জীববিজ্ঞান পরীক্ষার দিন আকাশ অনেক মেঘলা। রিক্সা যোগে পরীক্ষার হলে পৌঁছুতে সময় লাগে ১৫ মিনিটের মত। মাঝরাস্তায় আচমকা শুরু হল প্রচন্ড ঝড়। এক ঝটকায় পুরো শরীর ভিজে গোসল হয়ে গেল। ঝড়ের কারনে রিক্সার পক্ষে আর যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ওদিকে অপেক্ষা করতে করতে পরীক্ষার সময় ১০ মিনিট অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। আমি আর কিছুতেই লেট করতে পারছি না। প্রচন্ড বৃষ্টি আর ঝড় উপেক্ষা করেই দিলাম দৌড়। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন হয়তো ঐদিন অনেক কৌতুহলেই তাকিয়ে ছিল আমার প্রতি। পরীক্ষার সময় প্রায় ২৫ মিনিট অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। গেটের দারোয়ান আমাকে আটকানোর চেষ্টা করলে, আমি তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সোজা হলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দারোয়ানকে ধাক্কা দেওয়া দেখে দুইজন পুলিশও আমাকে আটকানোর চেষ্টা করতে আমার পিছু পিছু দৌড়ে আসছিল। হলে ঢুকতেই সেখানে দায়িত্বরত ম্যাডাম আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমার লেটের কারণ তাঁকে জানাতে হল না বাহিরের আবহাওয়া দেখে। পুলিশ দুজনকে হাত ইশারার দ্বারা বিদায় করে দিলেন ম্যাডাম। আমি প্রচন্ড হাঁপাচ্ছিলাম। ম্যাডাম আমাকে হাত ধরে আমার বেঞ্চে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন, আর বারংবার বলছেন রিলাক্স, রিলাক্স। মাত্র পচিশ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, তার জন্য কোন টেনশন নয়। তুমি চেষ্টা করতে বাকি আড়াই ঘণ্টাতেই সকল প্রশ্নের উত্তর সমাপ্ত করতে পারবে। আর তাছাড়া আজকে তোমার খাতা সবার শেষে জমা নেবো, তুমি একদম চিন্তা কর না।

ম্যাডাম আমাকে বসিয়ে খাতা আর প্রশ্নপত্র দিলেন, সেই সাথে দিলেন তাঁর ছোট্ট রুমাল। আমি কোন রকম হাত আর মাথাটা মুছে ম্যাডামকে থ্যাংকস জানাতেই, ম্যাডাম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, আরো পাঁচ মিনিট রিলাক্স করে তারপর থেকে লেখা শুরু করবে, ওকে? আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।

একদিন পরেই কেমিস্ট্রি পরীক্ষা। বৃষ্টিতে ভেজা শরীরে পরীক্ষা দেয়ায়, রাতে শুরু হল সর্দি, কাশি, জ্বর, মাথা ব্যথা। ঔষধ খেয়েও যেন নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছি না। পরদিনও একই অবস্থা। পরীক্ষার কথা চিন্তা করে কতবার যে আল্লাহকে ডেকেছি আর স্মরণ করেছি, তার কোন হিসাব নেই। পরদিন শরীর একটু ভালো লাগলেও, পড়ার প্রতি কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। কিছুক্ষন পড়লেই মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যাচ্ছে। পরদিন সকালে আবারো দিতে গেলাম পরীক্ষা। তখন শরীরে জ্বর না থাকলেও আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারি নি। প্রশ্নপত্রের ৯০% প্রশ্ন কমন হওয়া স্বত্বেও বিক্রিয়া লিখতে গিয়ে আটকে যাচ্ছি। এভাবে যতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েছি, প্রত্যেকটারই বিক্রিয়ায় গিয়ে আটকে গিয়েছি, নয়তো ভুল করেছি। আমি বুঝতে পারলাম আমার পরীক্ষার কি অবস্থা। শুধু কাঁদতে পারছিলাম না সবার সামনে। অবশেষে পরীক্ষা শেষ করে বাসায় ফিরে আসলাম। এক সময় পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল। অন্যান্য সাব্জেক্ট ভালো রেজাল্ট হলেও, কেমিস্ট্রিতেই ফেল এসেছে। নিজের কাছেই নিজের রেজাল্টশীট অবিশ্বাস্য লাগছিল। বাড়িতে রেজাল্টের খবর জানালে, সবাই মনে করেছে রেজাল্ট হয়তো খারাপ হয়েছে, কিন্তু সেই খারাপ যে ডাইরেক্ট ফেল, সেটা বুঝতে পেরেছে আমি বাসায় পৌঁছার পর। পরিবারের কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো রেজাল্ট অনেক খারাপ হবে, তাই বলে ফেল হবে, এটা আমিও কল্পনা করতে পারিনি।

আমার সাথের ক্লাসমেট সকলেই অনার্স লেভেলে চলে যাবে, ক্লাসমেট বন্ধুগুলো হয়ে যাবে বড় ভাই, আর আমি হয়ে থাকবো তাদের ছোট ভাই। বিশ্বাস করুন, এই অনুভূতিটা যে কতটা মারাত্মক, তা ভুক্তভোগী ব্যতিত বোঝানো সম্ভব নয়। দুদিন পরেই জুম্মাবার। নামাজ পড়ে এসে রুটিনের মতো কোরান তেলায়াতের জন্য বসেছি। ওমনি মনে পড়তে লাগলো, ঐদিন বৃষ্টিতে ভেজার পরেও বাসায় এসে জহুরের নামাজ হয়নি বলে, তাও পড়তে ভুল করিনি। অসুস্ত থাকা স্বত্বেও নামাজ বাদ দেই নি। অথচ আমারই এক হিন্দু ক্লাসমেট ভালো রেজাল্টে পাশ করে গেল, আর আমি হয়ে গেলাম তার ছোট ভাই। বিষয়টা মন থেকে মানতে পারছিলাম না। তাহলে আল্লাহকে খুশি করার প্রতিদান বুঝি এটাই ছিল? এটা কি আমার ঈমানের পরীক্ষা ছিল? কিন্তু এমন পরীক্ষা কি নেওয়া উচিৎ, যার মাসুল সারা জীবনেও শেষ হবে না? বিষয়টা আমি মানতে পারলাম না। কিসের কোরান তেলায়াত, কার জন্য কোরান তেলায়াত? সেদিন কতটা জোরে আছাড় দিয়ে কোরান রেখেছিলাম, তা নিজেরও মনে নেই। মনে মনে চিন্তা করলাম, আল্লাহকে খুশি করতে গিয়েও যদি এরকম বিপদের সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে এসব ইবাদতের দরকার কি? উনি পরীক্ষাই করতে থাকুক, আমি পরীক্ষা দিতেই থাকি।

মানসিক ভাবে দারুন ভাবে ভেঙ্গে পড়লাম। পুরো একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে পরীক্ষার জন্য। পুনরায় সেই দিন চলে আসলো। পরীক্ষা দিলাম, রেজাল্টও ভালো হল। এবার যে কেমিস্ট্রিতে ফেল করেছিলাম, সেই কেমিস্ট্রিতেই বি.এসসি করার চিন্তা করলাম। ভর্তি হলাম একটা সরকারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাসা থেকে কলেজ অনেক দূর, তাই উঠলাম মেসে। সেখানে পরিচয় হল এক বড় ভাইয়ের সাথে। বড় ভাই তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের দর্শন বিভাগের ছাত্র। এতোদিনে আল্লাহর উপর থেকে রাগ ক্ষোভ সব কমে গিয়েছে। আমি আবারো আগের মত জুম্মাবারে নামাজ আর নামাজ শেষে কোরান তেলায়াত করতাম। যতটা সময় ফ্রি পাই, তার সবটুকুই ঐ বড় ভাইয়ের সাথে কাটাই। অসাধারন একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তবে উনাকে কোনদিন ধর্মের কোন বিধি বিধান পালন করতে দেখিনি। না দেখেছি কোনদিন নামাজ পড়তে, না দেখেছি কোনদিন রোজা রাখতে। প্রশ্ন করলে উল্টাপাল্টা উত্তর দিতো, যা আমার ভালো লাগতো না। তাই ধর্মীয় বিষয় পারিতপক্ষে এভোয়েড করেই চলতাম। মাঝে মধ্যে তার দর্শন বই ঘাঁটাঘাঁটি করতাম, আরও ঘাঁটাঘাঁটি করতাম উনার মনোবিজ্ঞানের বই। ধীরে ধীরে উনার বইগুলোর প্রতি আমি দারুন ভাবে আকৃষ্ট হয়ে গেলাম।

যত প্রশ্ন জমা হতো, তার সবগুলোই আমি সেই ভাইয়ের সাথে শেয়ার করতাম, উনি সব প্রশ্নের উত্তরই এতো সুন্দর ভাবে যুক্তিসহকারে বুঝিয়ে দিতেন যে, সেখানে কথা বলার মতো আর কোন অপশনই থাকতো না। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম, ধর্ম, বিজ্ঞান, রাজনীতি, যুক্তিবিদ্যার সবকিছুর জ্ঞান একসাথে একজন মানুষ কিভাবে আয়ত্ব করতে পারে? রাতের পড়াশোনা শেষ করে কোন কোন দিন রাত বারোটা কিংবা একটার সময় দুজনে ছাদে গিয়ে বসতাম, নয়তো মেসের সামনের ফাকা জায়গাটাতে। কোন কোন দিন ধর্ম নিয়ে বিতর্কে তুমুল অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যেত। উনি ততদিনে বড় ভাই থেকে ফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছিলেন।

এইবার আমার সেই কাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন এই ভাইকে করলাম, সেইসাথে পেয়েও গেলাম মোক্ষম জবাব, সেই সাথে আমারও ঈমানের ভিত্তিটায় যেন খানিকটা ফাটল ধরল। আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছে, এই উত্তরে উনি বললেন, আল্লাহ যে স্রষ্টা হিসেবে থাকবেই হবে, এমন শর্ত কে দিয়েছে? ল্যাও ঠ্যালা। এ দেখি আরও এককাঠি ওপরে। আমি বললাম, স্রষ্টা ছাড়া কি কোন কিছু সৃষ্টি হওয়া সম্ভব? উনি বললেন, তাহলে সেই স্রষ্টার আবার আরেক স্রষ্টার প্রয়োজন হয়ে পড়বে, সেই স্রষ্টার জন্য আবার আরেক স্রষ্টা, এভাবে চলতেই থাকবে, আদৌ কি উত্তর পাওয়া সম্ভব?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, তাহলে উপায়?
উনি এক বাক্যে জবাব দিলেন, যা নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি, সেটা বাদ দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। শুধুশুধু সমস্যা ধরে টানাটানি করে কি লাভ?

আমার এইবার মনে পড়লো সেই নাস্তিক শব্দটা। আমি এতোদিনে স্পষ্ট বুঝে গেলাম যে, ঐ ভাই ছিলেন নাস্তিক। উনি বললেন, মনে কর তুমি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে গিয়েছো। তখন তোমার বয়স ছিল ১ বছর। তোমাকে একটি লোক বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে আসার সময় সেখানেই নিয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে তুমি প্রাপ্ত বয়স্ক হলে চলে গিয়েছো আমেরিকায় এবং ওখানেই থেকে গেলে। তুমি জানতে পারলে, যাদের কাছে তুমি মানুষ হয়েছো, মূলত তারা তোমার কেউ নয়, তোমার বাবা মা ছিল বাংলাদেশে, তুমি হারিয়ে গিয়েছিল। এখন তোমার বয়স চল্লিশ, তো স্বাভাবিক ভাবেই তোমার বাবা মা এতো বছর বেঁচে থাকার কথা নয়। ধরে নিলাম বেঁচে আছে, কিন্তু তুমি জানো না, বাংলাদেশের কোন জেলায়, কোন থানায়, কোন ইউনিয়নের, কোন ওয়ার্ডের, কোন গ্রামে তোমার বাড়ি। তুমি জানো না তোমার বাবা মায়ের নাম, মনে নেই চেহারাটাও। এখন তুমি যদি বাংলাদেশে এসে তোমার বাবা মাকে খুঁজে পাবার চেষ্টা কর, আদৌ কি পাওয়া সম্ভব?
আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম, না।

উনি বললেন, দেখো, নবী মুহাম্মদের জন্ম হয়েছিল ১৪০০ বছর পূর্বে। তাঁর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল আল্লাহর। আল্লাহর সাথে তাঁর কি রকম সম্পর্ক ছিল, কি কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল, এসব আমরা দেখিও নি শুনিও নি, কেবলই মোল্লারা যা বলে, আর কিতাবে যা পাই, সেটাই বিশ্বাস করি। সময়ের সাথে সাথে কোন একটা ঘটনার সহিত রং ঢং লাগিয়ে তাকে অতিরঞ্জিত করা মানুষের একটা স্বভাব। এখন ১৪০০ বছর দূরের আল্লাহকে যদি আমরা খুঁজে পাবার চেষ্টা করি, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াবে ঐ হারিয়ে ফেলা বাবা-মাকে বৃথা খুঁজে পাবার চেষ্টা করার মতো। আমাদের জীবনকে চালিত করতে কোন আল্লাহ/ঈশ্বর বা ভগবানের প্রয়োজন নেই। উনাদের যদি আমাদের প্রয়োজন হয়, তাহলে উনারাই আমাদেরকে খুঁজে বের করবে।

উনার এসব কথা শুনে কি বলবো, বুঝে পাচ্ছিলাম না। সেদিনের মত আড্ডা শেষ করে যে যার রুমে গেলাম। তবে ইদানিং নিজের মধ্যে অনেকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। ধর্মের বিরুদ্ধে কোন যুক্তি শুনলে আর রাগ হয়না, বড়জোর পাল্টা যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করি মনে মনে। রাতে ঘুম কমে গেছে অনেকটা। ভোরবেলা একটু সময়ের জন্য চোখ বন্ধ হয় মাত্র। বই পড়ার প্রতি ঝোঁক বৃদ্ধি পেয়েছিল অনেকগুন। এখন থেকে ধর্মীয় বই পড়ে দেখার ইচ্ছা হচ্ছিল খুব। একই বিষয়ের অনেক রকমের মন্তব্য শুনেছি একেক রকম ওয়াজি হুজুরদের নিকট। অন্যদিকে বিজ্ঞানের ছাত্রের সুবাদে কিছু কিছু বিষয় দেখি ধর্মের উল্টাপথে চলে, অন্যদিকে ডিজিটাল নবী টাইবাবা জাকির নায়েককেও দেখি কত সুন্দর করে বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের মিলকরনে আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয়, বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের তো বিরোধ নাই-ই, উল্টো বিজ্ঞানের এসব আবিষ্কার পূর্ব থেকেই কোরানে এসব বিজ্ঞান লুকায়িত রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে মাথার মধ্যে উল্টা পাল্টা অবস্থা। মস্তিষ্ক ভীষন অস্থির। এরই মাঝে পরিচিত হলাম, প্রবীর ঘোষের “অলৌকিক নয় লৌকিক” বইয়ের সাথে। একে একে সবগুলো খন্ডই সাবার করে ফেললাম। আমি এখন দ্বিধাদ্বন্দ্বের এক কারখানা। পরিচিত হলাম হুমায়ুন আজাদের “মহাবিশ্ব” বইয়ের সাথে। আরও পরিচিত হলাম “আরজ আলী মাতুব্বরের রচনা সমগ্রের সাথে।“

ঘুম নেই দুচোখে। সারাক্ষন অন্যমনস্ক হয়ে থাকি। কি যেন ভাবনায় অজান্তেই ডুবে যাই। দু থেকে তিন বার ডাক না দিলে যেন সম্বিত ফিরে পাই না। মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে, প্রয়োজন ছাড়া অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে বিরক্ত লাগে। দুনিয়ার সব কিছু যেন বিস্বাদে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আচমকা আমার এমন পরিবর্তন দেখে সেই বড় ভাই ব্যাপারটি বুঝতে পেরে আমাকে যথেষ্ট সময় দিতে থাকলো। চেষ্টা করছে সারাক্ষন আমাকে স্বাভাবিক রাখতে।

আমি আমার যুক্তিতেই এখন বুঝতে পারছি, ধর্ম মিথ্যা। মনকে শান্তনা দিচ্ছিলাম, ধর্ম মিথ্যা হলেও হতে পারে, তাই বলে আল্লাহর গ্রন্থ ওহী তো কিছুতেই মিথ্যা হতে পারে না। কাজেই আল্লাহর বিধান পরিষ্কার করে বুঝতে নিজেকেই পড়তে হবে। এরই মাঝে পরিচিত হলাম, মুক্তমনা, সংশয় এবং পরিচিত হলাম আসিফ মহিউদ্দিনের বিতর্কের সাথে। বিতর্ক দেখতাম ফেসবুক লাইভে, আরও দেখতাম ইউটিউবে। এবার সবকিছু বাদ দিয়ে দৌড় দিলাম বইয়ের লাইব্রেরীতে এবং কিনে নিলাম বাংলা অনুবাদের কোরান। এতোদিন অন্ধের মতো সুন্দর সুর করে না বুঝে কোরান পড়েছি, এবার বুঝে পড়বো আসলে কি রয়েছে এতে। উত্তেজনায় টান টান অবস্থা। কোরানের অনুবাদটা কোন প্রকাশনীর তা এখন আর মনে নেই। সাত দিনের মধ্যে নাওয়া খাওয়া ছেরে পুরো কোরানের অনুবাদ পড়ে ফেললাম, সেখানে পেলাম অনেক নবীর সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনী, পেলাম আল্লাহর গজবের বর্ণনা, পেলাম জান্নাতী হুরের বর্ণনা, পেলাম একই বিষয়ের চর্বিত চর্বণ, পেলাম কিছু বৈজ্ঞানিক আয়াত ইত্যাদি। কিন্তু কোন ভুল ত্রুটি খুঁজে পেলাম না কোরানে। কিন্তু কি আশ্চর্য, নাস্তিকরা নাকি কোরানের মধ্যে অনেক ভুল ত্রুটি খুঁজে পায়, তাহলে আমি পেলাম না কেন?

তখন চিন্তা করে দেখলাম, কোরান পড়া শুরুই করেছিলাম ভুল চিন্তা থেকে। আমি যদি আগে থেকেই চিন্তা করি যে, কোরানে কোন ভুল থাকতেই পারে না, তাহলে কোরানে ভুল খুঁজে পাওয়া মনে হয় সম্ভব হবে না। কাজেই, এই চিন্তাটাকে দূরে রেখে আমাকে আবারো কোরান পড়া শুরু করতে হবে। মনটাকে পক্ষপাতিত্ব মুক্ত করে পড়তে হবে। এবার মনটাকে মুক্ত করে কোরান খুলতেই শুরুতেই শুরু হল দ্বিধাদ্বন্দ্ব। প্রত্যেকটি সূরার শুরুতেই দেখলাম “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” লেখা। মাথায় প্রশ্ন আসলো, এই “বিসমিল্লাহ” কি কোন সূরার আয়াত, নাকি কোন আয়াতের অংশ? যদি নির্দিষ্ট কোন সূরার আয়াত হয়, তবে তা প্রত্যেকটি সূরার শুরুতেই থাকবে কেন? যদি কোন সূরার আয়াত বা আয়াতাংশ হয়, তাহলে তা কোন সূরার আয়াত বা আয়াতাংশ? যদি কোন সূরার আয়াত না হয়, তবে তা কোরানে ঠাই পেলো কিভাবে?

বিশ্বাস করুন, যতই কোরানের গভীরে যেতে থাকলাম, ততই দ্বন্দ্বে জড়াতে থাকলাম। খুঁজে পেতে থাকলাম ভ্রান্তি আর অজ্ঞতামূলক কথাবার্তা। সূরার নামের সাথে বিষয়ের তো কোন মিল নাইই, মাঝে মধ্যে বিজ্ঞানের যে যেসব বস্তাপচা তত্ত্ব বিদ্যমান, তা রীতিমত ভয়ানক। আরও বেশি ভয়ানক জাকির নায়েকের মতো জ্ঞানপাপীদের জন্য। জাকির নায়েকের কোরানের বৈজ্ঞানিক আয়াতের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের মিলকরণ আর রাস্তায় পড়ে থাক “মল” স্বর্ণের প্লেটে উঠিয়ে ম্যাংগো পাবলিকদের “স্যুপ” বলে খাইয়ে দেয়ার মধ্যে কোন তফাত নেই। বিশ্বাস করুন, এবার কোরান সমাপ্ত করতে সাত দিন তো দূর, পুরো তিন মাস সময় লেগে গিয়েছিল। কোরান শেষ করার পর, এক অন্য আমাকে আবিষ্কার করলাম। ধর্ম না হয় মিথ্যা বুঝলাম, তাই বলে ধর্মগ্রন্থ মিথ্যা হতে পারে না ভ্রান্তি এবার সম্পূর্ণ কেটে গিয়েছিল। এক কোরানের অনুবাদে ভুল থাকতে পারে চিন্তা করে আরও দুইটি ভিন্ন অনুবাদ সংগ্রহ করে পড়লাম। বিশেষ কোন তফাত খুঁজে পেলাম না। সংগ্রহ করলাম বুখারী শরীফ, পড়তে গিয়ে দেখি, হাদিস গ্রন্থ তো কোরানেরও এককাঠি উপরে। আমার বুঝতে বাকি থাকলো না যে, এই রকম একটা ধর্মগ্রন্থ কোনদিনই আল্লাহর হতে পারে না। আল্লাহ কখনো এরকম মূর্খের মতো বক্তব্য দিতে পারে না। ইসলামের ধর্মগ্রন্থ যদি এরকম হয়, তাহলে ইসলামের আল্লাহ কতটা সত্যের উপর ভিত্তি স্থাপন করে রয়েছে, তা বুঝতে বাঁকি থাকলো না আর। আরও বুঝলাম, কেন কেউ ইসলামের বিরুদ্ধে কোন যুক্তি দেখাতে গেলে তাকে নাস্তিক ট্যাগ লাগিয়ে হত্যা করতে উঠেপরে লেগে যায় জিহাদী বাহিনী।

বিশ্বাস করুন, এতোদিন একটা ভরসা ছিল যে, এই জীবনে যা কিছুই করি না কেন, আরেকটা অনন্ত জীবন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। একটা অনেক বড় সুখের অনুভূতি আর হতাশা মুক্ত জীবন ছিল আমার। যখন থেকে বুঝতে পারলাম, মানুষের শরীরে আত্মা বলে কিছু হয়না, পরজনম বলে কিছু নেই, তখন থেকেই এক নিঃসীম হতাশায় ডুবে যেতে থাকি ক্রমান্বয়ে। প্রায় ছয় মাস, আমার ঘুম ছিল না হতাশার কারনে। পুরো অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। এরপর স্বাভাবিক হতে আরও কয়েক মাস সময় লেগে গিয়েছিল আমার। নিজের প্রতি নিজেরই অনেক রাগ হল আমার। এবার নিজের চিন্তাকে প্রকাশ করতে লাগলাম ফেসবুকের মাধ্যমে। আমার সকল বন্ধু বান্ধব আমাকে নিষেধ করতে থাকলো, সেই সাথে ভয়ও দেখাতে থাকলো। আসতে থাকলো বিভিন্ন রকমের হুমকি ধামকি। নিজের রিয়েল আইডি বাদ দিয়ে একটা ফেইক আইডি খুললাম ইন্ডিয়ার এক ফ্রেন্ডের মাধ্যমে। একাউন্ট খোলা হল ইন্ডিয়ান ফোন নাম্বার এবং সেই ফ্রেন্ডের নাম দিয়েই। আমি ভিপিএন ব্যবহারের মাধ্যমে লগইন করতাম, যাতে আমাকে কোনভাবেই ট্রেস করা না যায়। মোল্লার গুষ্ঠিরা কিছুদিনের মধ্যেই আমার সাথে যুক্তি আর তর্কে কুলোতে না পেরে ম্যাসেজের মাধ্যমেই আমার মা বোনের সাথে চু চু করতে চাইলো, অর্থাৎ তারা মনে করেছিল, আমার ধর্মবিরোধী বক্তব্যে আমার মা বোন তাদের জন্য গ্ণিমতের মাল হয়ে গিয়েছে। তাদের গণহারে রিপোর্টের কারণে আইডি উড়ে চলে গেল আল্লাহর আরশের নিচে, যেখানে রাতের বেলা সূর্য বাবাজী ঘুমিয়ে থাকে। এরপর জুকার বার্গ-এর সাথে অনেক কিছুর বিনিময় শেষে, রিয়েল আইডি প্রুভ করলে তবেই আবার আইডিটা ফিরে পাই। পুনরায় লেখালেখি শুরু করলে, কিছুদিনের মধ্যে আবারো একই ঘটনা ঘটলো। বিরক্ত হয়ে আইডিটাকে আর ফেরত নিয়ে আসার চেষ্টা করলাম না। কিছুদিন পর থেকেই বাংলার বুকে শুরু হয়ে গেল নাস্তিক হত্যার মিশন। যা সমাপ্ত হয়েছিল আভি’দা কে দিয়ে। মোল্লার বাচ্চারা প্রমাণ করে দিয়েছিল, তাদের আল্লাহ তার নিজেরই ধর্ম রক্ষা করতে অক্ষম, তাই সেই দায়িত্ব নিজ থেকেই হাতে তুলে নিয়েছে। যার ধর্ম তার খবর নাই, মোল্লাদের হয় ঘুম কামাই। আজ পর্যন্ত শুনলাম না, ধর্ম অবমাননার দায়ে আল্লাহ নিজে কিংবা কোন ফেরেস্তা বাহিনী পাঠিয়ে কোন নাস্তিককে হত্যা করেছে। অথছ মোল্লার বাচ্চাদের নাকি শান্তি নষ্ট হয়।
আমার কাছে এখন ধর্ম আর ধর্মগ্রন্থ স্রেফ বিনোদনের একটা উৎস।
মনে আছে, সর্বশেষ যেদিন জুম্মাবার নামাজে গেলাম, ঐদিন নামাজ শেষে যখন হুজুরের সাথে মোনাজাত ধরলাম, তখন হঠাত মাথায় প্রশ্ন আসলো, কার কাছে আমি আমার চাওয়া পাওয়ার কথা জানাচ্ছি যে আসলেই নেই। কেমন যেন উঁচুতে ধরে রাখা হাত দুটো অটমেটিক নিচে পতিত হয়ে গেল। তারপর থেকে আর কোনদিন মসজিদে যাওয়া হয়নি।

অনেক দিন পর মেস থেকে কয়েক দিনের জন্য বাড়িতে এসেছি। নামাজ কালাম তো নাই-ই, সেই সাথে জুম্মাবারেও নামাজে না যাওয়াতে বাড়ির সবাই যেন আমাকে এমন ভাবে দেখছে, আমি যেন চিড়িয়াখানার কোন বিশেষ জন্তু। সাথে বাঁকা বাঁকা কথা ফ্রি। মায়ের মুখ যেন কিছুতেই থামছে না। শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে বললাম, বাবা তো মারা গেলে ৭২ টা যুবতী হুর পেয়েই যাবে, তোমার এতো কপাল ঠুকে কি লাভ, সেই চিন্তাটা করেছ কোনদিন? তারপর মায়ের বকাবকি চুপ হয়ে গিয়েছিল। আমিও আপাতত বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম।

কয়েক দিন পর বাড়ি থেকে আবার মেসে যাবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি। বাড়ি থেকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে তিন চাকার ভ্যান গাড়িই ছিল একমাত্র সম্বল, যাতে সময় লাগতো প্রায় ২০ মিনিটের মতো। আমি ভ্যানে বসতেই পেছন থেকে মসজিদের হুজুর ভ্যানে বসলো বাজারে যাবার চিন্তা করে। হুজুরের সহিত ভদ্রতাসুলভ আলাপ করতে করতেই যাচ্ছিলাম। হুজুর আমাকে ধর্মজ্ঞান দেওয়া শুরু করলেন। প্রায় বাবার বয়সী মানুষ, কিছু বলতেও পারছি না। নামাজের নানা রকমের ফযিলত, জান্নাতের লোভ, সেই সাথে জাহান্নামের ভয় দেখাতে লাগলেন। হুজুর আমাকে আচমকা প্রশ্ন করে বসলেন, তুমি নামাজ পড় না কেন?

হুজুরের এমন আচমকা প্রশ্ন করাতে আমি একটু ইতস্ততই হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম, আমার কয়েক দিনের এমন উদ্ভট কথাবার্তায় বাবা নিজেই ব্যাপারটি হুজুরের সাথে পরামর্শ করেছেন। আমি কোন উত্তর না দিয়ে বললাম, আপনি নামাজ পড়েন কেন?
হুজুর মনে হয় তার জীবনে এমন বেক্কলে প্রশ্নের কবলে পড়ে নাই, তাই উল্টা প্রশ্ন করলেন, তার মানে?
আমি বললাম, আপনি যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, তার তো কোন কারণ নিশ্চয় আছে। অযথা তো আর এটা করেন না, তাই না?
হুজুর বললেন, হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। নামাজ আল্লাহর বিধান। নামাজ পড়লে জান্নাতে যাওয়া যায়, সেখানে কেবল সুখ আর সুখ। পরকালীন অনন্ত সুখের জীবন পাওয়া যাবে, নয়তো ভোগ করতে হবে অনন্ত কষ্টের জীবন।

আমি বললাম, তার মানে জান্নাতের লোভে আপনি নামাজ পড়েন। আল্লাহ যদি বলতেন, তোমরা নামাজ পড়, নামাজ পড়লে তোমাদেরকে জাহান্নামে দেবো। তবুও আমাকে খুশি করতে তোমরা নামাজ পড়, তাহলে নিশ্চয় আর নামাজে ধারে কাছেও যেতেন না। আপনার নামাজের উদ্দেশ্য আসলে আল্লাহকে খুশি করা নয়, নিজের লোভনীয় স্বার্থ সিদ্ধি করা। আপনি কি জানেন, ইসলামে পাঁচটি কুরিপুর কথা বলা আছে, যা একেবারে হারাম, তন্মধ্যে লোভ একটি। এই বয়সে লোভের বশবর্তী হয়ে নিয়মিত নামাজকে মাধ্যম করে হারাম কাজ করে যাচ্ছেন, এটা কতটুকু ঠিক?

হুজুর আর কোন কথা বলেন নি বাঁকিটুকু রাস্তা। কাজেই ঐটুকু রাস্তা খুব শান্তিতে ছিলাম। পরে জানতে পারলাম, হুজুর নাকি বাবাকে সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আমাকে বুঝানো তার কর্ম নয়।
এরকম আরও কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা যে জীবনে ঘটে গিয়েছে, তা লিখতে গেলে একটি আস্ত বই হয়ে যাবে। তবে আমি এখন মুক্ত। আমার মাঝে লোভ নেই, হিংসা নেই, পরনিন্দা নেই, কেবল শান্তি আর শান্তি।