অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে স্মরণ ও তাঁকে নিয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি কেবল একজন নন্দিত শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন জাতির বিবেকস্বরুপ। শিক্ষকতা পেশাকে ছাপিয়ে যে পরিচয়ে তিনি অনেক বেশী বিখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত। তিনি বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন সক্রীয় কর্মী ও প্রতিবাদের প্রতীক ছিলেন। বর্তমানে দেশ এক প্রকট সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ সময় তাঁর মত প্রবল ব্যক্তিত্বের বড় প্রয়োজন ছিল, সে সময়েই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। এটা আমাদের জন্য এক অপুরণীয় ক্ষতি। সেই বাস্তবতায় তাঁকে স্মরণ এই ক্ষতির পরিধি উপলব্ধিতে সহায়ক হবে। সবারই মৃত্যু হবে কিন্তু মৃত্যুই মানুষের জীবনের শেষ কথা নয়। সৃষ্টিশীল মানুষ কর্মের মাঝেই বেঁচে থাকেন, সক্রীয় থাকেন।

ডঃ আনিসুজ্জামান ছিলেন একজন পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। আন্তোনিও গ্রামসি বলেছেন, যিনি জাতির নৈতিক ও সামাজিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য তৈরি থাকেন, তাকে পাবলিক পারসুয়েশন বলা হয়। তিনি জনগণকে বুঝিয়ে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রামে নামার কাজটি করেন। আনিসুজ্জামান এই কঠিন দায়িত্বটি পালন করেছেন। আমাদের দেশে হাতেগোনা কয়েকজনকেই আমরা পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বলতে পারি। তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগন্য একজন। দেশের যে কোন সংকটে তিনি সরব থেকেছেন। স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক অনাচার, শিক্ষার অধিকার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও সংগ্রামে তিনি সবসময় সক্রীয় ছিলেন।

 স্বাধীনতার আগে থেকেই তিনি এই জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক স্বার্থের পক্ষে ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছেন, সংগ্রাম করেছেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে বহির্বিশ্বে জনমত সৃষ্টিতে কাজ করেছেন। আফ্রো-এশীয় লেখক ইউনিয়নের সংগঠক হিসেবে উপনিবেশবিরোধী নানামাত্রিক সংগ্রাম ও চিন্তাধারার বিকাশে ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।

পাকিস্তান আমলে এই ভূখন্ডে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র ছিল, তাঁর গান, কবিতা, সাহিত্যকে বাঙালির মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু আনিসুজ্জামানসহ অন্যান্য তরুণ বুদ্ধিজীবীদের তীব্র বিরোধীতা ও প্রতিবাদের কারনে পাক-শাসকের পক্ষে সেটা করা সম্ভব হয়নি। সে সময় এ কাজগুলো করা সহজ ছিল না কিন্তু তিনি সাহসের সঙ্গে সেটি করেছেন। তিনি বাঙালি সংস্কৃতি ও চেতনাকে ধারণ করতেন এবং তার প্রতিষ্ঠার পক্ষে আমৃত্যু কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিষ্ঠাই শুধু না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সংগ্রাম এবং তার বিচারিক প্রক্রিয়াতেও তিনি সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। ২০১৩ সালে ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবীতে গড়ে ওঠা তারুণ্যের বিস্ফোরণ ’গণজাগরণ মঞ্চের’ প্রতিও ছিল তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন।

এ বছর জানুয়ারীতে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের ট্রাস্টি ডা: সারোয়ার আলীর উপর হামলার প্রতিবাদে এক সমাবেশে অংশগ্রহন করেন এবং সেখানে তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, “বর্তমানে যারা মুক্তবুদ্ধি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করেন তারা এ দেশে নিরাপদ নন”। স্যারের এ কথাগুলো নতুন কিছু নয়, আমরা অনেক দিন ধরেই এমন কথা শুনে আসছি। তবে তিনি শাসকদের জন্য অস্বস্তিকর অপ্রিয় এই নির্মম কথাগুলো আমৃত্যু বলে গেছেন। এক্ষেত্রে তিনি আপোষ করেননি। বরং তিনি তাঁর সংগ্রামে অবিচল থেকেছেন। তাঁর মুখ থেকে একথাগুলোর পুনরাবৃত্তি ছিল গরুত্বপূর্ণ, কারণ দৃঢ়তার সাথে এমন কথা বলার মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যাঁরা ছিলেন তাদের অনেকেই আপোষ করেছেন। অনেকে শংকিত হয়ে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন কিন্তু তিনি সে কাজ করেননি।

চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে স্যার আরো সাহসী বক্তব্য রেখেছেন। আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “সরকারকে মানুষের ধর্ম মানার সাথে সাথে ধর্ম না মানারও স্বাধীনতা দিতে হবে।“ আমাদের সমাজে এমন কথা প্রকাশ্যে বলার মত হিম্মত কারো নেই বললেই চলে। যেখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে অন্যায়-অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। যেখানে পাঠ্যপুস্তক থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ উঠিয়ে দেয়া হয়। হিন্দু ও বিধর্মী লেখকদের লেখা সিলেবাস থেকে বাদ দেয়া হয়। ধর্মের সমালোচনার বিরুদ্ধে আইন তৈরী করা হয়। মতপ্রকাশের কারণে দেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখক-প্রকাশক, বুদ্ধিজীবী, মুক্তচিন্তার মানুষদের প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে জেলে যেতে হয়েছে। অনেককে দেশান্তর হতে হয়েছে। অনেক বিজ্ঞান ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখা বই-পুস্তক-ব্লগ বাতিল-বাজেয়াপ্ত হয়েছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক-চিন্তক তরুণ দেশের মাটি ছেড়ে বিদেশে পারি জমাতে চেষ্টা করছেন। সেখানে তাঁর এমন বক্তব্য অবশ্যই অন্যদের থেকে তাঁকে আলাদা করেছে।

সমাজের প্রতি বুদ্ধিজীবীদের দায় অনেক। মানুষও তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে। বর্তমান সময়ও সেটা দাবী করে। যে আশা নিয়ে এ দেশ তার যাত্রা শুরু করেছিল, মানুষের সে মোহ ভেঙ্গে গেছে। আমাদের আরো এগিয়ে যাবার কথা ছিল, কিন্তু আমরা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছি। আমাদের আরো সভ্য, আধুনিক, মানবিক, আদর্শবান, মূল্যবোধসম্পন্ন হবার কথা ছিল আমরা সেটা হতে পারিনি। আমরা আরো স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রীক, লোভী, পরশ্রীকাতর, কূপমন্ডুক, নষ্ট-ভ্রষ্ট, উগ্র, মেকি, দলান্ধ-ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক হয়েছি। একটি শোষন-বৈষম্যহীন ন্যায়-নীতি ইনসাফের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবার কথা ছিল, সেটা হয়নি। দেশব্যাপী একটি জবরদস্তিমুলক লুটপাটের অর্থনীতির বিস্তার লাভ করছে। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিষ্ঠানসমুহ ক্রমশ অকার্যকর হয়ে পড়ছে। মৌলিক মানবাধিকার প্রচন্ডভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। মানুষ দিনদিন ভীতো ও অসহায় হয়ে পড়ছে।

যে কোন নৈরাজ্যকর, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা জাতীর বিবেকের ভূমিকা পালন করে। সামগ্রিক পরিবর্তনে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশ একটি বড় ধরণের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। শাসকশ্রেনীর বেপরোয়া ও কঠোর মনোভাব ও ব্যক্তি সুবিধাবাদের কারনে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও ভীতি, নিরবতা, আপোষের মনোভাব-প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ কারনে বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে নাগরিকদের মধ্যে বিরুপ ধারণা দেখা যায়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নিয়েও কারো কারো মধ্যে কিছু বিষয়ে নেতিবাচক সমালোচনা লক্ষ্য করেছি। আমাদের সমস্যা-সংকটের পরিধি এতটা ব্যাপক যে, অনেক ক্ষেত্রে সবদিকে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। এই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করতে হবে। কিন্তু এর উদ্দেশ্যমুলক ও নেতিবাচক মূল্যায়ন কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। কিছু প্রশ্নে মানুষের যৌক্তিক আক্ষেপ আছে, সে কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মানুষের সে ভাবনা-আলোচনাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি, কারণ আমি মনে করি, সেটাই একটি সমাজে চিন্তাশীলদের বিষয়ে সঠিক অবস্থান নির্ধারণের প্রক্রিয়া। তারপরও বলি, ব্যক্তি মানুষের সমালোচনা অস্বাভাবিক কিছু নয়, যাঁরা কাজ করে তাদেরকে ঘিরে এমন আলোচনা হবেই। পৃথিবীতে কোন মহামানবও সে আলোচনার উর্ধে ছিলেন না।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আনন্দ জামান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এত ভক্তি, এত শ্রদ্ধা, এত ভালবাসা! আব্বার আর চাওয়ার কিছু নেই। একটি পরিপূর্ণ জীবনের সমাপ্তি।’ সত্যি, তাঁর জীবন ভালোবাসা ও পরিপূর্ণতায় ভরা। তিনি ছিলেন শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে তাঁর সাফল্য কিংবদন্তিতুল্য। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলা বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক হয়েছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও একই বিভাগের দ্বিতীয় এমেরিটাস হলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি সব ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছেন, হয়েছেন জাতীয় অধ্যাপকও। ছাত্রছাত্রীদের কাছেও পেয়েছেন সবটুকু সম্মান ও ভালবাসা।

জ্ঞান-বুদ্ধি, মেধা-মনন মেশিনে, প্রকল্পে তৈরী হয় না, সম্ভব না! যুগেযুগে, শতবছরে, অনেক সাধনা, পরিশ্রমে দুই-চারজন অনন্য প্রতিভাকে আমরা পাই। তাঁরা অনগ্রসর, অন্ধকার-কূপমন্ডুক সমাজে আলো জ্বেলে মানুষকে আলোকিত করে। পরাধীন, সুবিধাবঞ্চিত, অধিকারহীন সমাজে জীবন বিপন্ন করে অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যান। তাদের কল্যানে সমাজ সভ্য, আধুনিক, উন্নত, মানবিক হয়! আমাদের মাঝ থেকে এমন মানুষের বিদায় সমাজের এগিয়ে যাবার ধারাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে, এক বড় শূণ্যতার সৃষ্টি করে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বিদায় তেমনি এক শূণ্যতা। সেই অপুরণীয় ক্ষতি সহজে পুষিয়ে ওঠার নয়।

——————————————————————————

ডঃ মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা।