রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা-যদি তেমন বই হয়। বইপড়া বা বই কেনাবেচায় উৎসাহী করার জন্য এরচেয়ে ভাল বিজ্ঞাপন আর হয়না তাই বোধহয় বই প্রসঙ্গে এই উদ্ধৃতিটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যারা এই উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেন  তাদের প্রায় সবাই এটিকে ওমর খৈয়ামের নামে চালিয়ে দেন কিন্তু বাস্তবে কি ওমর খৈয়াম এ জাতীয় কিছু তাঁর কোনো রুবাইতে বলেছেন? উদ্ধৃত এই অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ প্রবন্ধ থেকে নেয়া। কিন্তু কি করে সৈয়দ মুজতবা আলীর নিজের এই সরস উক্তিটি ওমর খৈয়ামের সাথে ঘোলিয়ে ফেলা হলো তা বুঝতে হলে উদ্ধৃতাংশের কিছুটা পেছনে যেতে হবে। বই বিষয়ে সারগর্ভ আলোচনা করতে গিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী দার্শনিক বার্টান্ড রাসেলের একটি উদ্ধৃতি কোট করেছেন যেমন-“বারট্রান্ড রাসেল বলেছেন, ‘সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়।’ আর মনের ভেতর বিচিত্র ভুবন সৃষ্টির অন্যতম উপায় হিসেবে বইকে প্রাধান্য দিতেই সৈয়দ মুজতবা আলী ওমর খৈয়ামের রুবাইটির উল্লেখ করেছেন কেননা এতে বর্ণিত বেহেশতের চার অনুসঙ্গের একটি হলো বই।

Here with a loaf of bread/beneath the bough./A flash of wine, a book of/verse and thou,/Beside me singing in the wilderness/And wilderness is paradise enow.১

এই রুবাইয়ের ঠিক নিচেই তিনি তাঁর অবিস্মরণীয় মন্তব্যে লিখেন- “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা-যদি তেমন বই হয়। তাই বোধ করি খৈয়াম তাঁর বেহেশতের সরঞ্জামের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কেতাবের কথা ভোলেন নি” বিভ্রান্তিটি বেঁধেছে ঠিক এখানেই। সৈয়দ মুজতবা আলী রুবাইটির কোনো আক্ষরিক বা কাব্যিক অনুবাদ না দিয়ে নিজের মতামতটিই এখানে ব্যক্ত করেছেন আর তাকেই বাঙালি পাঠক ধরে নিয়েছেন রুবাইয়ের বাংলা অনুবাদ বা ভাবানুবাদ হিসেবে। বক্তব্যটি এতই হৃদয়গ্রাহী হয়েছে যে এর বিপুল জনপ্রিয়তা্র নিচে চাপা পড়ে গেছে ওমর খৈয়ামের মূল রুবাইটি এবং তা ই হয়ে পড়েছে খৈয়ামের নিজের বক্তব্য। আমরা যদি এটিকেই খৈয়ামের উক্তি বলে মনে করি তবে এর এমন একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে মূল ফার্সি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড সাহেব গড়বড় করে ফেলেছিলেন এবং বহুভাষাবিদ পন্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী তা সংশোধন করে ফার্সির মূল সুরটিই এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন।ফিটজেরাল্ডের ইংরেজি অনুবাদের পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর বিতর্ক আছে এটা যেমন ঠিক তেমনি সত্য তাঁর অনুবাদের মাধ্যমেই বিশ্বময় রুবাইয়াতের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তার অনুবাদের অসংখ্য সংস্করণ ইউরোপ এবং আমেরিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। বাংলাতেও রুবাইয়াত এসেছে ফিটজেরাল্ডের অনুবাদকে ভিত্তি করেই অথচ ১৮৫৯ সালে ফিটজেরাল্ড যখন তার নিজ খরচে পঁচাত্তরটি রুবাইয়াতের সংকলন-Rubaiyyat of Omar khaiyyam, the Astronomer-Poet of Persia নামে প্রকাশ করেন অনুবাদকের নাম ছাড়াই তখন দুবছর গুদামজাত থাকার পরও বইয়ের কোনো কপি বিক্রি না হওয়ায়  বই ব্যবসায়ী প্রতিষ্টান এক শিলিং মূল্যমানের বই এক পেনি দরে বিক্রি করে দিয়ে গুদাম সাফ করে ফেলেছিলেন। ১৮৬৭ সালে টি বি নিকোলাসের ফরাসি ভাষায় অনুদিত রুবাইয়াত প্রকাশ পাওয়ার পর ফিটজেরাল্ড আবার উৎসাহী হয়ে ওঠেন এবং দ্বিতীয় দফায় ১০১টি চতুস্পদীর অনুবাদ করে রুবাইয়াতের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন এবং এ সংস্করণও তিনি নিজ খরচেই প্রকাশ করেন।এই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের পরই ইংরেজিতে রুবাইয়াতের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমান্বয়ে ইউরোপ আমেরিকায় রুবাইয়াতের জনপ্রিয়তা এতই উন্মত্ততার পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যায় যে প্রথম সংস্করণের এক পেনি দরে বিক্রি করে দেয়া এক একটি কপির মূল্য ষাট পাউন্ড বা তার চেয়েও বেশি মুল্যে বিক্রি হতে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় ওমর খৈয়াম ক্লাব ঘটিত হয়। অসংখ্য রুবাইয়াত পাঠচক্র গড়ে ওঠে। রুবাইয়াতের লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয় কিন্তু এর অনুবাদক যে ফিটজেরাল্ড তা প্রকাশিত ১৮৭৫ সালে। রুবাইয়াতের পঞ্চম সংস্করণে অনুবাদক হিসেবে ফিটজেরাল্ডের নাম ছাপা হয়। ২ ভাষাগত জটিলতার কারণে ফিটজেরাল্ড এই রুবাইয়ের কোনো বিচ্যুতি ঘটিয়েছেন কি না বাংলাভাষী পাঠকের জন্য তা যাচাই করে দেখার একমাত্র উপায় কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদ কেননা বাংলায় রুবাইয়াত অনুবাদকারীদের মধ্যে একমাত্র নজরুলই মূল ফার্সি থেকে তা বাংলায় ভাষান্তর করেন।  এ প্রসঙ্গে কবি নজরুলের নিজের মন্তব্যটি উল্লেখ করার মতো- “আমি ওমরের রুবাইয়াত বলে প্রচলিত প্রায় এক হাজার রুবাই থেকেই কিঞ্চিদধিক দুশো রুবাই বেছে নিয়েছি ; এবং তা ফারসি ভাষার রুবাইয়াত থেকে। কারণ আমার বিবেচনায় এগুলি ছাড়া বাকি রুবাই ওমরের প্রকাশভঙ্গি বা স্টাইলের সাথে একেবারে মিশ খায়না।৩ ভিন্ন একটি ভাষার কোনো কবি বা লেখকের প্রকাশভঙ্গি বা স্টাইল ধরার ক্ষমতা যার রয়েছে এবং সহস্রাধিক কবিতা থেকে আসল নকল নির্ণয়ের সক্ষমতা যিনি ধারণ করেন সেই ভাষায় তিনি কতটুকু পারঙ্গম তা কি আর আলাদা করে ভাবার অবকাশ থাকে? যাইহোক আমরা এবার দেখে নিই ফিটজেরাল্ড তাঁর অনুবাদ গ্রন্থে এগারো নম্বরে যে রুবাইটিকে স্থান দিয়েছেন মূল ফার্সি থেকে নজরুল তার কেমন অনুবাদ করেছেন। নজরুলের অনুবাদ-

“এক সোরাহি সুরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর/প্রিয়া সাকী, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার/জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ/এই যদি পাই চাইব নাকো তখত আমি শাহানশার।৪

এখানে ফিটজেরাল্ডের ইংরেজি অনুবাদ এবং নজরুলের বাংলা অনুবাদে ভাবগত তেমন কোনো পার্থক্যই চোখে পড়েনা। শুধু ফিটজেরাল্ড যেখানে লিখেছেন নির্জনতার কথা নজরুলে রয়েছে জীর্ণ জীবনের কথা আবার ফিটজেরাল্ডের স্বর্গ নজরুলে হয়েছে শাহানশাহের তখত এছাড়া আর সবকিছুইতো একই রকম আছে। কোথাও কি মদ রুটি ফুরিয়ে যাবার কথা আছে ?

 

এবার দেখা যাক অন্য যাঁরা ফিটজেরাল্ড থেকে বাংলায় রুবাই অনুবাদ করেছেন তারা এই এগারো নম্বর রুবাইটিকে কীভাবে ভাষান্তর করেছেন। বাংলায় রুবাইয়াত রচনায় সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম কান্তিচন্দ্র ঘোষ। তাঁর রুবাই পড়তে যেমন ছন্দময় তেমন এর আবেদনও পাঠকের চিত্ত স্পর্শ করে।কান্তিচন্দ্র ঘোষের ‘রোবাইয়াত-ই ওমর খৈয়াম’ প্রকাশের পর পরই এর অনেকগুলি সংস্করণ প্রকাশই তাঁর অনুবাদের জনপ্রিয়তার প্রমাণ। তাঁর রুবাই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন-“কবিতা লাজুক বধুর মত এক ভাষার অন্তপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তপুরে আসতে গেলে আড়ষ্ট হয়ে যায়।তোমার তর্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙ্গেচ তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্চে।“ ৫   কান্তিচন্দ্র ঘোষের অনুবাদটি এ রকম-

“সেই নিরালা পাতায়-ঘেরা/বনের ধারে শীতল ছায়/খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে/ছন্দ গেঁথে দিনটি যায়/মৌণ ভাঙ্গি মোর পাশেতে/গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর/সেইতো সখি স্বপ্ন আমার,/সেই বনানী স্বর্গপুর। ৬

কবি ঔপন্যাসিক ও অনুবাদক নরেন্দ্র দেব রুবাইয়াত অনুবাদ করেন। তাঁর অনুবাদ গ্রন্থ ‘ওমর খৈয়াম’ ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর অনুবাদটি এ রকম-

এইখানে-এই তরুতলে-/তোমায় আমায় কুতুহলে/এ-জীবনের যে-কটা দিন কাটিয়ে যাবো প্রিয়ে/সঙ্গে রবে সুরার পাত্র,/অল্প কিছু আহার মাত্র,/আর একখানি ছন্দ-মধুর কাব্য হাতে নিয়ে/থাকবে তুমি আমার পাশে,/গাইবে সখি প্রেমোচ্ছাসে,/মরুর মাঝে স্বপ্ন সরগ করব বিরচন,/গহন কানন হবে লো সই/নন্দনেরই বন।

কবি গীতিকার নাট্যকার ও সম্পাদক  সিকান্দর আবুজাফর কৃত ‘রুবাইয়াত ; ওমর খৈয়াম’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। তাঁর অনুবাদ-

“এখানে কোথাও পল্লবঘন নির্জন তরুতলে/বসে থাকি যদি নিরুদ্বিগ্ন দিন কাটাবার ছলে/সাথে থাকে যদি কিছু আহার্য, মদিরা পাত্র ভরা/একটি কাব্য সুরভিসিক্ত ছন্দের শতদলেঃ/নব জীবনের সলাজ মধুর বিষ্ময়ে সচকিতা/সাথে থাকো যদি লীলায়িত তনু মধুমুখী মধুমিতা/তনুতে মুছায়ে তনুর পিপাসা আর যদি গাহো তুমি/ফিরদৌসের সমারোহে হবে এ বনানী সুশোভিতা।

কোথায়, কারো অনুবাদেইতো মদ রুটি ফুরিয়ে যাবার কথা নেই। তাহলে কেন আমরা যুগ যুগ ধরে একই বিভ্রান্তির আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে একজনের সৃষ্টিকে অন্যের নামে চালাচ্ছি? এতে যার নামে চালানো হচ্ছে তাকে যেমন ছোট করা হচ্ছে আর যারটি চালানো হচ্ছে তাঁকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে। এর কিন্তু আরেকটি ভয়াবহ অর্থও হচ্ছে পংক্তিটি যিনি অনুবাদ করেছেন তার ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ করা।এখানে আমাদের সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে, ডজনের উপর ভাষায় যাঁর জ্ঞান আগলমুক্ত, গোগোল ট্রেন্সলেটরের জ্ঞান নিয়ে যেন আমরা মনের ভুলেও সেই ধৃষ্টতাটুকু না দেখাই।

এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার উপসংহার এই- খৈয়াম তাঁর রুবাইয়ে বলছেন-রুটি মদ প্রিয়া আর বই এই চার উপদান থাকলে আমার বাদশাহী তখতের প্রয়োজন নেই, বরং সেটাই আমার স্বর্গ, সৈয়দ বলছেন- আরে তোমার চার উপাদানের তিনটির আয়ুস্কালইতো নিতান্ত সীমিত। রুটি মদ অনিঃশেষ নয়, প্রিয়ার ভ্রমর কালো মদির আখিঁরও মেয়াদোত্তীর্ণতার সময়সীমা আছে কিন্তু ভাল একখানা বই আঙ্গিকে বহিরাভরনে যতই জীর্ণ মলিন হোকনা কেন তার যৌনাবেদন অনন্তকাল ব্যাপি।

তথ্যসূত্র

১।Rubayat of Omar Khayyam-Edward FitzGerald, St.Martin press, Newyork edition-1983, p.11

২। সিকান্দর আবুজাফর রচনাবলী সম্পাদনা-আব্দুল মান্নান সৈয়দ, পৃ-৪৩৬-৩৭

৩। ভূমিকা-রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম, নজরুল রচনাবলী ৬ষ্ট খন্ড, পৃ-১৫১

৪। ঐ ৬১ নং রুবাই,পৃ-১৭, ১৬৫

৫।রোবাইয়াত-ই ওমর খৈয়াম-কান্তিচন্দ্র ঘোষ। ভূমিকাংশ

৬।ঐ ১১ নং রুবাই

৭।সিকান্দর আবুজাফর রচনাবলী ১ম খন্ড, পৃ-৪৫০