স্বপন বিশ্বাস
উচুঁনীচু পাহাড়ে ঘেরা সবুজ বনানীর দেশ ভুটান। আয়তনে দেশটি বাংলাদেশের চার ভাগের এক ভাগ কিন্তু জনসংখ্যা মাত্র ৭ লক্ষ। তথ্য প্রযুক্তির যুগে বহুকাল ধরে ঘোমটা পরে থেকেছে এ দেশ। শুনে অবাক হয়েছি যে, ১৯৯৯ সালে ভুটানে প্রথম টেলিভিশন চালু হয়; টেলিভিশন চালুর ক্ষেত্রে ভুটান পৃথিবীর সর্বশেষ দেশ। দেখে অবাক হয়েছি যে, ভুটানের রাজধানী থিম্পু নগরীতে কোন ট্রাফিক লাইট, পুলিশ কিছু নেই।
২০১০ আগষ্টের এক সকালে ভুটানের ‘পারো’ বিমান বন্দরে এসে নামলাম; বলা বাহুল্য ওটাই দেশের একমাত্র বিমান বন্দর। ড্রুক এয়ারলাইন্সের দুটো বিমান আছে- যা দিল্লী-কলকাতা-ব্যাংকক- ঢাকা যাতায়াত করে। অন্য কোন দেশের বিমান পারো’তে নামে না। পারো বন্দর ছোট হলেও দেখতে বেশ ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন।
ইমিগ্রেশন কাস্টম সেরে বাইরে বেরিয়ে দেখি আমার জন্য গাইড কিন্লে ও ড্রাইভার স্যাঙ্গে। কিন্লে পরেছে ‘কিরা’ আর স্যাঙ্গের গায়ে জড়ানো ‘ঘো’ । ঘো ও কিরা ভুটানের পুরুষ ও মহিলাদের জাতীয় পোষাক। ভুটানের অফিস আদালতে জাতীয় পোশাক পরে আসা বাধ্যতামূলক।
বিমানবন্দর থেকে সোজা পুনাখার পথে। পুনাখা ভুটানের দ্বিতীয় রাজধানী । পথে কিন্লেকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করি- উত্তর পেয়ে যাই জলদি। গাড়িতে থাকতে হবে তিন ঘন্টা ; দু’পাশে পাহাড়ের শ্যামলিকা দেখে কতক্ষণ আর চুপচাপ থাকা যায়?
কিন্লেকে জিজ্ঞেস করি, তোমার দেশে নাকি সুখ আছে?
হা হা করে হেসে ফেলল কিন্লে।
-হাঁ আছে বৈকি?
-তোমার দেশের মানুষ সুখী?
-হ্যাঁ।
-তুমি সুখী?
-হ্যাঁ আমিও সুখী। আমরা স্কুলে শিখেছি কি করে অল্পতে তুষ্ট থাকতে হয়।
-তোমার বেতন নিয়ে তুমি খুশী? তোমার পতি আর কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় না?
কিন্লে আমার হিউমার বুঝতে পারে । সে দার্জিলিং ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে। কিন্তু আমার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া তার পক্ষে সহজ নয়। কিন্লেকে বললাম সারা দুনিয়ায় যা নেই ভুটানে আছে, সেই Gross National Happiness (GNH) বিষয়ে কিছু বল না? প্রশ্নটি তার কাছে নতুন নয়।
ভুটানের চতুর্থ রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক ক্ষমতায় আসেন ১৯৭৪ সালে । রাজ্যের সুখ দুঃখ অর্থনীতি বিষয়ে বলতে গিয়ে বললেন Gross National Happiness is more important than Gross Domestic Product (GDP) । রাজার এ মন্তব্য একটি ছোটখাট আলোড়ন সৃষ্টি করে বিশেষত ভুটানের বাইরের দেশগুলোয়। অর্থনীতিবিদরাও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকেন।
পৃথিবীর বহু দেশ অর্থনীতির মানদন্ড হিসেবে GNP অথবা GDP ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু ভুটানের বেলায় তা GNH । অর্থনীতি সাহিত্যে GNH ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে ওঠেছে বলে মনে হয় যদিও এতে অসামান্য নতুনত্ব কিছু নেই। GNH বিষয়ে চার চারটি বিশ্ব সম্মেলন হয়েছে; শেষটি অনুষ্ঠিত হয় ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে। ‘দ্যা সেন্টার ফর ভুটান স্টাডিজ’ এই সম্মেলন সংগঠনে বিশেষ ভুমিকা রাখে।
GNP দেশের নাগরিকদের ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত ধন ; GDP সংজ্ঞাও এর খুব কাছাকাছি। কিন্তু GNH কি? GNH অর্থনীতির অংশ ; পরিমাপযোগ।
GNH চারটি স্তম্ভের উপর দন্ডায়মান। প্রথম স্তম্ভ- টেকসই ও ন্যায়ভিত্তিক সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন। দ্বিতীয় স্তম্ভ- পরিবেশ সংরক্ষন। সনাতন GNP সংজ্ঞায় পরিবেশের উন্নয়ন ও অবক্ষয় অন্তর্ভুক্ত নয়। তৃতীয় স্তম্ভ- সাংস্কৃতিক অক্ষুন্নতা ও বিকাশ। ভুটানে সংস্কৃতি বলতে বোঝায় বৌদ্ধধর্মভিত্তিক জীবনাচরন যা মানসিক সুখ ও আবেগকে সংহত করে। চতুর্থ স্তম্ভ- সুশাসন।
অর্থনৈতিক ভাষণ শুনে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সুখ হয়তোবা মনঃস্তাত্তিক বিষয়; মাপতে গেলে ওটা দূরে সরে যেতে পারে।
GNH সূচকে তোমরা সুখ পরিমাপ করো কি করে?
কিন্লে বলল, ‘দ্যা সেন্টার ফর ভুটান স্টাডিস’ প্রজাসাধারণের সুখ-দুঃখ জানার একটি প্রশ্নপত্র ডিজাইন করেছে। উত্তরের বিচারবিশ্লেষণ করে সুখ-দুঃখের কিছুটা নিশানা করা সম্ভব।
পুনাখার একটি বিশালায়তন দুর্গে প্রবেশ করি। দুর্গের একভাগে স্থানীয় প্রশাসনের অফিস, অন্যপাশে মন্দির ও বিহার। প্রার্থনা হলের চারপাশের দেয়ালে আঁকা অসংখ্য চিত্র ; বৌদ্ধের জীবন ও কর্ম, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোকায়ত গাল গল্পের চিত্র-শিল্পায়ন। ক্লান্তিহীন কিন্লে; একটার পর একটা ব্যাখ্যা করে চলেছে- লক্ষ্য, আমাকে ইমপ্রেসড করা, হয়তোবা।
দুর্গ থেকে মুক্তি পেয়ে আবার গাড়িতে চড়ি। এবার গন্তব্য থিম্পু। কিনলে দেখাল, একটি নতুন বাড়ি উঠছে। আমি বললাম, প্রতিবেশীর সুখ হারাম হচ্ছে। নির্মাণের প্রতিযোগিতায় সুখ পালায়। নির্মাণ কাজে সহায়তা করার জন্য শ্রমিক এসেছে বাংলাদেশ থেকে। খবরটি শুনে আনন্দিত হব না দুঃখ পাব বুঝতে পারিনি। জানলাম, ভুটানে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশী। ভারতের নাড়ির সঙ্গে বাঁধা ভুটান। রাজস্ব আয়ের সিংহভাগ আসে ভারতের কাছে জলবিদ্যুৎ বিক্রি করে। ভারতীয় রুপী ও ভুটানীজ নলথ্রুম সম মূল্যমানের ; এই দুই মুদ্রাই ভুটানে সর্বত্র প্রচলিত। বড়শি দিয়ে মাছ ধরা নিষেধ। জন্তু-জানোয়ার বলি দেওয়া নিষেধ কিন্তু খেতে মানা নেই। মাছ-মাংস আসে ভারত থেকে আমাদানি হয়ে। কি আজব কথা! মাছ-মাংস খাওয়া যাবে, বলি দেওয়া যাবে না- এর কি কোন মানে হয়? বৌদ্ধধর্মের বজ্রজান শাখার শেষ বর্ম-ভুটান ।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে শেষ প্রশ্ন,
-মিস কিন্লে, তোমাদের দেশে একটি ছেলে না কি একাধিক বিয়ে করতে পারে?
-হ্যাঁ, পারে বৈ কি! একটি মেয়েও একাধিক ছেলে বিয়ে করতে পারে।
শুনে প্রীত হলাম, নারীবাদী’রা খুশী হবেন! ছেলেমেয়ের এই একাধিক বিয়ের (Polygamy) ব্যাপারে কিছু সামাজিক-অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও এখন আর তা জনপ্রিয় নয়।
সন্ধ্যা হয়ে এল ; গাঁ-গেরামের মতো হালকা হালকাভাবে বাতি জ্বলছে থিম্পু শহরে। এবার হোটেল-ঘরে ফেরার পালা। রাত পোহালেই আবার কিনলে এসে হাজির। শিল্প ও কারিগরী কেন্দ্রে যাই, বিভিন্ন ক্লাস ঘুরে ঘুরে দেখি। কেউ ছবি আঁকছে, কেউ করছে কাঠ খোদাই, কেউ বানাচ্ছে মাটি দিয়ে অসাধারণ মূর্তি। পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখবার জাতীয় প্রয়াস দেখে কিছুটা অবাক হতে হয়। অদূরে একটি পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত হচ্ছে বিশালাকৃতির বৌদ্ধ মূর্তি। চূড়া থেকে দেখতে পেলাম সমগ্র থিম্পু নগরী; কোলাহল নেই, নেই ধূলোবালি কিংবা যানজট। তিন-চারতলার বেশী উঁচু কোন বিল্ডিং নেই। ছোট্ট নগরীর বুক চিরে বহমান এক সরু নদী যার জলধারা অভাবনীয় ভাবে স্বচ্ছ।
বিকেলে পারো’র নিকটবর্তী ‘টাইগার নেস্ট’ বিহার দর্শন করার একটা চেষ্টা চালাই। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। ঠিক এই অবস্থায় পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। পাহাড়ী পথে চলবার জন্য চাই যুৎসই জুতো। কিন্লে জুতোজোড়া বদলে নিল। এক হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত টাইগার নেস্ট বিহার। এক ঘন্টার বেশি অবিরাম হেঁটে অর্ধেক পথ এসেছি। যদি আরও এক ঘন্টার উপরে যাই, তাহলে নামতে নামতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে। তারচে’ বরং ক্ষনিকের পান্থশালায় গরম চা পান করে হোটেলে ফিরি। উঠতে উঠতে ও নামতে নামতে কথা বার্তা চলতে থাকে- হিসেবটা এই যে কম সময়ে ভুটানকে যতটুকু জেনে নেয়া যায়- ততই ভাল! কিন্লে পাহাড় থেকে কিছু মাশরুম কুড়িয়ে নিল- রাতে নাকি রান্না করে খাবে! কোথায় যেন মিল! নাগরিক জীবনের ইঁদুর দৌড়ে ভুটান এখনো অভ্যস্থ হয়ে ওঠেনি ; ভুটানবাসী হয়তোবা অপেক্ষাকৃত সুখী!
বরাবরই সবুজ চোখ জুড়ায় , চোখে আনে এক শিতল তৃপ্ততা আর মনকে করে প্রানবন্ত। লেখাটি পরে ভুটানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পারলাম আর মনে মনে ভুটান ভ্রমনের ইচ্ছা জাগ্রত হলো। এমন সুন্দর পরিবেশে দিনের পর দিন নিজের অস্তিত্ব বিলিয়ে দেওয়া যায়।
অনেক সুন্দর একটি পোষ্ট এই পোষ্টের মাধ্যমে ভূটান সম্পর্কে সহজ ভাবে জানতে পারলাম এরকম পোষ্ট আরো চাই
ভুটান তাদের সংস্কৃতি ধরে রেখেছে, উন্নত বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে পশ্চিমা হওয়ার চেষ্টা করেনি। নিজের সংস্কৃতি ধরে রাখাও তাদের সুখের অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি।
ভুটানের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে সেখানে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনীর চেয়ে বেশি সুস্পষ্ট কিছু জানা যায় না। এখানে হয়ত খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দেও বসতি ছিল, তবে ৯ম শতকে এখানে তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের প্রচলনের পরেই এলাকাটির সম্পর্কে আরও জানা যায়। সেসময় বহু তিব্বতি বৌদ্ধ ভিক্ষু পালিয়ে ভুটানে চলে আসেন। ১২শ শতকে এখানে দ্রুকপা কাগিউপা নামের বৌদ্ধধর্মের একটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটিই বর্তমানে ভুটানের বৌদ্ধধর্মের প্রধান রূপ। ভুটানের বৌদ্ধ মন্দির ও ধর্মশিক্ষালয় দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসের উপর সবসময় প্রভাব ফেলেছে।
– লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই !!
অসাধারণ ভ্রমণকাহিনী। শিশুদের পাঠের জন্য CogniTech পেইজে আপনার লেখাটি শেয়ার করতে চাই। অনুমতি পেলে শেয়ার করবো।
Go ahead, Pranab! It is my pleasure if my article helps any one in any way.
আহা কি সুন্দর লিখেছেন স্বপন ভাই। ছবিগুলো অসাধারণ। GNH বা এই সুখের মাপকাঠি যে ভুটানেও এত গুরুত্বপূর্ণ তা জানতাম না। আরো ভ্রমণ কাহিনী অথবা এই ধরণের লেখা চাই কিন্তু। পৃথিবীময় এত অশান্তির খবরের মাঝে এমন লেখা অন্য রকম একটা শান্তি শান্তি ভাব এনে দিয়েছে।