(ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি ইজরায়েলের জেরুজালেম হিব্রু ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক। তিনি স্যাপিয়েন্স, হোমো ডিউস, টুয়েন্টি ফার্স্ট লেসনস ফর টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ইত্যাদি বেস্ট সেলিং বইয়ের লেখক। সম্প্রতি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন বৈশ্বিক কোভিড-১৯ ভাইরাসের মহামারী প্রসঙ্গে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের রিপোর্টার লিন্ডা লিউয়ের সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি অতীত ইতিহাসের আলোকে মহামারী মোকাবেলায় করণীয় এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্কতা নিয়ে আলাপ করেছেন। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্যে সাক্ষাৎকাটি অনুবাদ করা হয়।)
লিন্ডা লিউ: হোমো ডিউস বইতে আপনি লিখেছেন, ‘যদি আমরা সত্যি দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি…’ সেই কথার সূত্র ধরেই বলি, করোনাভাইরাস যদি লাগামহীন চলতেই থাকে, তবুও কি আপনি বলবেন, মানুষ মহামারী থামাতে সক্ষম হয়েছে?
হারারি: খুব স্বাভাবিক, নতুন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব আমরা এখনো ঠেকাতে পারি না। জীবাণু নিয়মিতই পশুপাখি থেকে মানুষের কাছে চলে আসছে। কখনো কখনো জীবাণু অন্য প্রাণীর শরীরে গিয়ে নিজেকে বদলে ফেলছে ফলে, আগের তুলনায় অধিক সংক্রামক এবং মারাত্মক হয়ে উঠছে। যাইহোক না কেন, আমাদের মহামারী নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আছে এবং সংক্রমণ প্রতিহত করে ঠেকাতে পারি মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু এবং ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারি বিশ্বের অর্থনীতি।
অতীতের সময়ের সাথে বর্তমানের পরিস্থিতি তুলনা করে দেখা উচিৎ। আধুনিক যুগের আগে যখন মহামারী ছড়িয়ে পড়ত তখন মানুষের কোন ধারণাই ছিল না কী কারণে মানুষ মরে যাচ্ছে, মানুষ জানত না কিভাবে মহামারী থামাতে হয়। তারা সাধারণত মহামারীর জন্য দায়ী করত কোনও অদৃশ্য রাগান্বিত দেবতার রোষ অথবা কালো জাদু। মহামারী থেকে রক্ষা পেতে গোত্রের সব মানুষ দল বেঁধে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করত যা অনেক সময় সংক্রমণ সমগ্র গোত্রের সবার মাঝে ছড়িয়ে যাওয়ার পথ সুগম করে দিত। ১৪ শতকে যখন ব্ল্যাক ডেথের মড়কে এশিয়া এবং ইউরোপের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ মরে গেল তখনও কিন্তু মানুষ জানত না এর কারণ কী। ১৬ শতকে যখন আমেরিকা, অ্যাজটেক, মায়া, ইনকা অঞ্চলের ৯০ শতাংশ অধিবাসী মারা যায় গুটিবসন্ত এবং অন্যান্য মহামারীতে তখনকার মানুষের কাছেও কোন ধারণা ছিল না কেন লাখে লাখে মানুষ মারা যাচ্ছে।
পক্ষান্তরে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন নোভেল ভাইরাসের কারণে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের জিনোম সিক্যুয়েন্স বের করতে সক্ষম হয়েছেন এবং আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করতে নির্ভরযোগ্য রোগনির্ণয় যন্ত্রপাতি বানাতে পেরেছেন। জীবাণুর সাথে চলমান হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে ডাক্তাররাই বিজয়ী হবেন, কারণ রোগজীবাণুর পরিবর্তন নির্ভর করে ব্যাপক সংক্রমণের উপর, কিন্তু ডাক্তার নির্ভর করে সঠিক তথ্যের উপর। ভাইরাসে কম আক্রান্ত সেদেশগুলো মহামারীতে আক্রান্ত দেশগুলোকে ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য, দক্ষ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণক ডাক্তার, জনবল এবং যন্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করতে পারে। সরকার এবং ব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানকে অর্থনীতির আসন্ন ধস ঠেকাতে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
কিন্তু মানুষের অনেক সীমাবদ্ধতা। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের মহামারী নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষ সবসময় বিবেচনাবোধ থেকে ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ করতে পারে। ২০০৫ সালে হোমো ডিউস বইতে আমি লিখেছিলাম, “যেহেতু আমরা নিশ্চিত নয় যে ইবোলা বা অন্যকোন অজানা ফ্লু ভবিষ্যতে পৃথিবীতে মহামারী আকারে সংক্রমিত হয়ে লাখ লাখ মানুষ মেরে ফেলবে কীনা, কিন্তু তবুও মানুষ অনিবার্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করবে না। বরং আমরা দেখতে পাবো মানুষের অমার্জনীয় ব্যর্থতার খেসারত এবং সেই সময় রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন ছিল… সংক্রমণ যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তবুও মানুষের কাছে তথ্য আছে, মেধা আছে, মহামারী ঠেকেনোর উপায় আছে। মহামারী ছড়ায় মানুষের অসহযোগিতা এবং বোকামির কারণে এবং সংক্রমণ ছড়ানোর অন্তরালে বসে নেই কোন ঈশ্বর।
আমি মনে করি, হোমো ডিউসের লেখা কথাগুলো এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং সত্য। আমরা এখন পৃথিবী জুড়ে যে মহামারীর সম্মুখীন সেটা অনিবার্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটা না ঠেকাতে পারাটা স্রেফ মানুষের ব্যর্থতা। দায়িত্বহীন সরকারগুলো স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অবহেলা করেছে, সংক্রমণ শুরু হলে দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এখনো বিশ্বব্যাপী নিজেদের মধ্যে পারষ্পারিক সমন্বয় করতে সক্ষম হয়নি। মহামারী থামানোর ক্ষমতা আমাদের আছে, কিন্তু আমাদের প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞার খুব অভাব।
লিন্ডা লিউ: চীন তার দেশে মহামারী ঠেকানোর সফলতার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছে, বিশ্বের কাছে প্রচার করছে চীনের অভ্যন্তরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে। মহামারী প্রতিরোধে স্বৈরাচারী রাজত্বের একনায়কের কঠোর হস্তের লকডাউন, আধুনিক যন্ত্রপাতি বেশি কার্যকর নাকি পশ্চিমা গণতন্ত্র বেশি কার্যকর?
হারারি:সে আলোচনা এখানে আবশ্যিক নয়। অসচেতন, এবং সন্দেহভাজন মানুষের উপর সারাক্ষণ নজরদারী থেকে আত্মসচেতন এবং তথ্য সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী সাথে থাকলে যেকোন মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। কোটি কোটি মানুষের টয়লেটে, ঘরে ঘরে ক্যামেরা বসিয়ে বা তাদের পিছনে পুলিশ লাগিয়ে তদারকি করে প্রতিদিন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া নিশ্চিত করতে পারবেন? সেটা অবশ্যই খুব কঠিন কাজ। কিন্তু মানুষকে যদি সচেতন করানো যায় এবং মানুষ যদি সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার সঠিক তথ্য জানে তাহলে সব মানুষ নিজ উদ্যোগেই তাদের হাত নিয়মিত সাবান দিয়ে জীবাণুমুক্ত করবে।
স্কুল থেকে আমি শিখেছি ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া রোগ সৃষ্টির কারণ। আমি শিখেছি সাবান দিয়ে হাত ধুলে রোগজীবাণু মরে যায় বা অপসারিত হয়। আমি সেই তথ্যের উপর আস্থা রেখেছিলাম। সুতরাং আমি নিজ থেকেই হাত ধোয়া অভ্যাস করি, কোটি কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত সেটাই করছে।
সমস্যা হচ্ছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতারা এমনকি গণতান্ত্রিক দেশের নেতারাও ইচ্ছাকৃতভাবে জনগণকে বিজ্ঞানবিমুখ করে রেখেছে, গণমাধ্যমের উপর জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে এবং সরকারি কর্তৃপক্ষকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। আস্থাহীন মানুষ বুঝতে পারে না কী করতে হবে। ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে জনগণের উপর একক কর্তৃত্বের স্বৈরাচারী শাসন চাপিয়ে দেয়া কোন সমাধান নয়। সমাধান হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান, গণমাধ্যম এবং সরকারী কর্তৃপক্ষের উপর আস্থা পুনর্প্রতিষ্ঠা করা। এসব ভরসার জায়গা তৈরি করতে পারলে রাষ্ট্র তখন জনগণের উপর নির্ভর করতে পারবে, এমনকি সারাক্ষণ নজরদারি শাস্তির ভয় না দেখিয়েও জনগণের কাছ থেকে সঠিক কর্তব্য আদায় করে নিতে পারবে।
লিন্ডা লিউ: আমরা দেখেছি চীনসহ কয়েকটি দেশ করোনা মহামারী ঠেকাতে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নাগরিকদের অবস্থান এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য জোগাড় করেছে। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর কারণে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কি সর্বাত্মক বায়োমেট্রিক হতে যাচ্ছে?
হারারি: হ্যাঁ, সেটাই সবচেয়ে বড় বিপদের আশংকা। মানুষের উপর নজরদারির ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস মহামারী ইতিহাসের বুকে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন এঁকে দেবে। প্রথমত, করোনাভাইরাস মানুষের উপর সর্বাত্মক নজরদারিকে আইনত বৈধতা দেবে এবং নজরদারি হয়ত নিত্যনৈর্মিত্তিক হয়ে যাবে, যা হয়ত স্বাভাবিক সময়ে করতে গেলে সরকারকে তীব্র প্রতিরোধ এবং প্রত্যাখ্যানের মুখে পড়তে হতো। দ্বিতীয় কারণটি আরো গুরুত্বপূর্ণ, এর ফলে নজরদারিতে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটবে। নজরদারি এখন মানুষের শরীরের চামড়া ভেদ করে রক্তে মাংসে মজ্জায় চলে যাবে। আগে সরকার মানুষের বাহ্যিক চলাচল এবং কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করত যেমন নাগরিক কোথায় যায়, কার সাথে দেখা করে ইত্যাদি। কিন্তু সরকার এখন মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে কী ঘটছে সেটা দেখার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্র জানতে চাচ্ছে নাগরিকের শারীরিক অবস্থা কী, শরীরের তাপমাত্রা কত, রক্তচাপ কত। এই ধরনের বায়োমেট্রিক তথ্য সরকারকে বলে দেবে এমন সব তথ্য যা হয়ত নাগরিক নিজেও জানে না নিজের সম্পর্কে।
একবার কল্পনা করে নিন কিছু একনায়কতান্ত্রিক দেশ গত ১০ বছরে প্রত্যেক নাগরিকের হাতে পরিয়ে দিয়েছে একটা বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট যা ২৪ ঘণ্টা প্রতিটি নাগরিকদের পর্যবেক্ষণ করে। আমরা ক্রমেই বুঝতে পারছি আমাদের শরীর এবং মস্তিষ্ক এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপরিসীম ক্ষমতা দিয়ে সরকার মানুষের ইতিহাসে প্রথমবারের মত প্রতিটি নাগরিকের প্রতি মুহুর্তের আবেগ অনুভূতির কথা জানতে পারছে। যদি কোন নাগরিক সর্বোচ্চ নেতার টেলিভিশন ভাষণের সময় বায়োমেট্রিক সেন্সর বুঝতে পারে নাগরিক রেগে যাচ্ছে, (রক্তচাপ বেড়ে গেল বা শরীরের তাপমাত্রা সামান্য পরিবর্তন হয়ে গেল কিংবা মস্তিস্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণ অংশের তৎপরতা বেড়ে গেল) তাহলে সেই নাগরিক ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে। ভাষণ শুনে নাগরিক হাসি দিয়ে যান্ত্রিকভাবে হাত তালি দিলে সমস্যা নাই, কিন্তু যদি রেগে যায় সরকার তা জেনে যাবে।
সরকার হয়ত যুক্তি দেখাতে পারে যে এই নজরদারি সাময়িক সময়ের জন্য, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই। রাষ্ট্রের জরুরি অবস্থার জন্য সাময়িক পদক্ষেপ। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটা খারাপ দিক হচ্ছে, সাময়িক সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময় অনন্তকাল স্থায়ী হয়ে চেপে বসে আমাদের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূত। রাষ্ট্র বোঝাতে চায় ভবিষ্যতের পথে পথে আরও মহামারী ওঁত পেতে আছে। এমনকি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় নেমে এলেও হাতের মুঠোয় বায়োমেট্রিক তথ্যের বিশাল ভাণ্ডার পেয়ে যাওয়া সরকার পুনরায় করোনাভাইরাসের ভয় দেখিয়ে অথবা এবছর আফ্রিকাতে ইবোলা নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে বা সম্ভাব্য নতুন কোন মহামারী হতে পারে এমন কারণ দেখিয়ে বায়োমেট্রিক নজরদারি জারি রাখতে পারে। সুতরাং রাষ্ট্র কিন্তু দ্বিধান্বিতভাবে ভাবতে পারে তাহলে করোনা ভাইরাসের পর নজরদারি কেন থামিয়ে দেব?
আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে সম্প্রতি ঘটে যাচ্ছে যুদ্ধ অন্তঃসলিলে। করোনাভাইরাস মহামারী সেই যুদ্ধের গতি পালটে দিতে পারে। করোনাভাইরাস মহামারী ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা, স্বাস্থ্য আর নজরদারি সরকার ও নাগরিকের মধ্যে সংঘাত ত্বরান্বিত করবে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা আর স্বাস্থ্যের মধ্যে বেছে নিতে বললে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে স্বাস্থ্য সুবিধাকেই তারা প্রাধান্য দেবে। সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা বেছে নেয়ার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমস্যার সূচনা, কারণ মানুষের সামনে এই ধরণের বেছে নেয়ার সুযোগই বানোয়াট এবং চতুরতা। আমাদেরতো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং স্বাস্থ্যসেবা দুটো একসঙ্গেই ভোগ করার অধিকার থাকা উচিৎ। আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং করোনা মহামারী থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিনিময়ে আমাদের উপর সার্বক্ষণিক নজরদারির করার প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরাচারীতে পরিণত না হয়ে বরং জনতার হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করা উচিৎ। মানুষকে শিক্ষিত করে এবং ক্ষমতায়ন করে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, মানুষের যদি বিজ্ঞান শিক্ষা থাকে এবং সরকারের উপর আস্থা রেখে তার গোপনীয়তা বলে দেয় তাহলে মানুষ নির্বিঘ্নে নিজেদের প্রচেষ্টাতেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে।
লিন্ডা লিউ: যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের দেশগুলো চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পরেও কয়েকমাস সময় পেয়েছে কিন্তু করোনাভাইরাস মোকাবেলায় তারা খুব দেরিতে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে, এর থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই?
হারারি: আমি মনে করি, এই মহামারী থেকে মানুষ বুঝতে শিখেছে যে আমাদের সবাইকে আসলে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। করোনাভাইরাস মানুষকে এক ছাতার তলে নিয়ে আসছে। ভাইরাস মহামারী আসলে চীনের বা ইতালির একার সমস্যা নয়, এটা বৈশ্বিক সংকট। পৃথিবীর সব মানুষ একই রকম স্বার্থ, ভয় এবং আতংকিত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভাইরাসের দৃষ্টিতে সব মানুষই সমান পোষক, সব মানুষই ভাইরাসের সম্ভাব্য শিকার। আর মানুষের প্রেক্ষিতে যে কোন দেশেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে আমরা সবাই বিপদে পড়ে যাবো, কারণ ভাইরাস সবাইকে সমানভাবে আক্রান্ত করতে পারে। সুতরাং বৈশ্বিক মহামারী প্রতিরোধে আমাদের বিশ্বব্যাপী সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
লিন্ডা লিউ: বৈশ্বিক মহামারী কি বিশ্বায়নের সুবিধা অসুবিধা নতুন করে পুনরায় মূল্যায়ন করতে বাধ্য করবে এবং দেশের ভৌগলিক সীমারেখা, বাণিজ্য এবং সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করবে?
হারারি: কিছু মানুষ করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর জন্য বিশ্বায়নকে দায়ী করে এবং বলছেন, ভবিষ্যতে এরকম মহামারী ঠেকাতে আমাদের বিশ্বায়ন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু সেটা হবে সম্পূর্ণ ভুল সিদ্ধান্ত। ইতিপূর্বে বিশ্বায়নের অনেক আগেও কয়েকটা মহামারী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। মধ্যযুগে ভাইরাস ছড়াতো ভারবাহী ঘোড়ার গাড়িতে মন্থরগতিতে এবং সংক্রমণ ঘটানো শুধু সামান্য কিছু শহরে বা গ্রামে। তবুও ব্ল্যাক ডেথ বর্তমানের মহামারী থেকেও ভয়ানক। যদি মহামারীর কারণে মানুষকে বিচ্ছিন্ন হতে হয় তাহলে মানুষকে ফিরে যেতে হবে পাথর যুগে। কেবল পাথর যুগেই মানুষ মহামারী থেকে মুক্ত ছিল, কারণ তখন মানুষ ছিল অল্প, তাদের যোগাযোগও ছিল স্বল্প।
মহামারীর প্রকৃত প্রতিষেধক বিচ্ছিন্ন থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া নয়, প্রতিষেধক হলো তথ্য এবং পারষ্পারিক সহযোগিতা। ভাইরাসের থেকে মানুষের সুবিধা হলো, মানুষ সমন্বয় করে কাজ করতে পারে। চীনের করোনাভাইরাস এবং আমেরিকার করোনাভাইরাস আরও বেশি মানুষকে কিভাবে আক্রান্ত করা যায় সে সম্পর্কে নিজেদের মাঝে তথ্য আদান প্রদান, যুক্তি পরামর্শ করতে পারে না। কিন্তু চীন আমেরিকাকে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে কিভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যায় তার বাস্তবিক ধারণা দিতে পারে। শুধু তাই নয়, চীন আমেরিকায় করোনা নিয়ন্ত্রণে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ চিকিৎসা জনবল পাঠিয়ে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু ভাইরাস এসব কিছুই করতে পারে না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, নেতৃত্বের অভাবে আমরা আমাদের সামর্থ্যের সবটুকু মানুষের সাহায্যে কাজে লাগাতে পারছি না। বিগত কয়েক বছরে পৃথিবীর দেশে দেশে দায়িত্বজ্ঞানহীন অপরিণামদর্শী রাজনীতিবিদরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পারষ্পারিক সহযোগিতা এবং আস্থার সম্পর্ক ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমরা এখন জীবন দিয়ে তার মূল্য দিচ্ছি। পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আমাদেরকে শুধরে চলার পরামর্শ দেয়ার কোন সুজন নাই।
তবে আশার কথা হচ্ছে, হয়ত অতি দ্রুতই আমরা দেখব নিচের পাঁচটি ক্ষেত্রে কার্যকর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে বিভিন্ন দেশ।
১. নির্ভরযোগ্য তথ্যের আদানপ্রদান। যেসব দেশ ইতিমধ্যে মহামারী মোকাবেলা করেছে তাদের উচিৎ নতুন আক্রান্ত দেশের সাহায্যে এগিয়ে আসা। করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে প্রতিষেধক ওষুধ এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কারে বিশ্বব্যাপী তথ্যের অবাধ এবং দ্রুত প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।
২. করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় মেডিকেল সরঞ্জাম, টেস্টিং কিট, সংক্রমণরোধী বিশেষ পোশাক, কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র তৈরি এবং বিতরণের জন্য দরকার বিশ্বব্যাপী সমন্বয় এবং সহযোগিতা। সমগ্র বিশ্ব একযোগে কাজ করলে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা কমে আসবে এবং নিশ্চিত করা যাবে ধনীগরিব নির্বিশেষে যে দেশ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত সেই দেশে চিকিৎসা সামগ্রী দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে।
৩. এখন পর্যন্ত যেদেশগুলো অপেক্ষাকৃত কম করোনাভাইরাস আক্রান্ত সেসব দেশ ডাক্তার নার্স মহামারী আক্রান্ত দেশে সাহায্য পাঠাতে পারে। এতে বিপদের সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো হল আবার মহামূল্য অভিজ্ঞতাও অর্জন হবে। সব দেশের সমন্বয়ে গঠিত মহামারী নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে তদারকি করতে হবে দক্ষ জনবল বিশ্বব্যাপী পালাক্রমে কাজ করছে। কিছুদিন আগে হয়ত চীন তার দক্ষ জনবল পাঠিয়েছিল, এখন ইউরোপ এবং ভবিষ্যতে আমেরিকা বা তারপরে ব্রাজিল, আক্রান্ত দেশে দক্ষ ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী পাঠাবে। যদি ব্রাজিল আজকে চিকিৎসা সামগ্রী ইটালিকে সাহায্য পাঠায়, এবং যদি মাসদুই পরে ইতালি মহামারী নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয় কিন্তু এর মধ্যে ব্রাজিল নতুন করে মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে যায় তবে ইতালি ব্রাজিলের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারবে।
৪. সবচেয়ে আক্রান্ত, ক্ষতিগ্রস্ত দেশ এবং ক্ষেত্রগুলোকে বাঁচাতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে হবে। বিশেষত গরীব দেশগুলোর জন্য এমন উদ্যোগ খুব গুরুত্বপুর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বা জার্মানির মত দেশ হয়ত ধ্বস কাটিয়ে উঠতে পারবে কিন্তু মহামারীর মড়ক আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়লে এখানের দেশগুলোর অর্থনীতি পুরোপুরি ধসে পড়বে। এসব দেশের সম্ভান্য অর্থনৈতিক ধ্বস ঠেকাতে বৈশ্বিক সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা দরকার।
৫. আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হল, রাষ্ট্রগুলো এমন সিদ্ধান্তে আসুক, সব ধরনের আন্তর্জাতিক চলাচল কয়েকমাসের জন্য নিষিদ্ধ। যদিও এই সিদ্ধান্তের ফলে সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধ বাধাগ্রস্ত হবে। শুধু জরুরী প্রয়োজনে বিজ্ঞানী, ডাক্তার, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদেরকে সীমান্ত অতিক্রম করতে হয়, সুতরাং তাদের জন্য নিয়ম শিথিল করে দিতে হবে। বিশ্বের সব দেশের মধ্যে চুক্তি হতে পারে জরুরী প্রয়োজনে কেউকে দেশের বাইরে যেতে হলে নিজ দেশ থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় নীরোগ প্রমাণিত হলেই কেবল তিনি ভ্রমণ করতে পারবেন। যদি কোন দেশ নিশ্চিত হয় সতর্ক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের তল্লাশি পেরিয়ে তবেই একজন যাত্রী বিমানে উঠতে পারে, তবে তার সেদেশে প্রবেশে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।
লিন্ডা লিউ
চীনে জন্ম, কিন্তু বেড়ে উঠেছেন নিউজিল্যান্ডে। লিন্ডা লিউ অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে বাণিজ্য এবং মানবিক বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন এবং পরবর্তীতে চীনের সিংহুয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসায় সাংবাদিকতা নিয়ে মাস্টার্স করেন। তিনি ২০১৮ সালে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। তার আগে তিনি চীনের প্রযুক্তি সংবাদ মাধ্যম ‘টেকনোড’ পত্রিকায় ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতেন।
প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ
ইউভাল নোয়া হারারিঃ করোনা পরবর্তী পৃথিবী
বৈশ্বিক মহামারী কীভাবে থামবে?
Leave A Comment