প্রথম পর্ব: মুহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু আক্রমণ
পর্ব দুই: সুলতান মাহমুদ গজনী’র ভারত আক্রমণ
পর্ব তিন:মুহম্মদ ঘুরীর দিল্লী দখল
পর্ব চার: কুতুব উদ্দিন আইবেকের শাসনামলের শুরু; হত্যা, দাসত্ব এবং মন্দির ধ্বংসের মাত্রা
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বর্তমানের আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামসির শহরের তুর্কি গোত্রে। মাত্র দুই প্রজন্ম আগে ইসলামে ধর্মান্তরিত অত্যন্ত সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া বখতিয়ার খিলজির শারীরিক কাঠামো ছিল ত্রুটিপূর্ণ, চেহারা দেখতে কুৎসিত, শরীরের তুলনায় হাত দীর্ঘকায় এবং উচ্চতা খর্বকায়। শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই কেউ তাকে কোন কাজ দিতো না, ভাগ্যের অন্বেষণে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে দিনের পর দিন। আফগানিস্তানের ঘর এলাকায় সে দেওয়ান হিসেবে প্রথম নিয়োগ পায়। উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার খিলজি দেওয়ানি ছেড়ে দিয়ে ১১৯৩ সালে ভারতের দিকে অগ্রসর হয় এবং কুতুবউদ্দিন আইবেকের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়। তখন সে ভারতের আরও পূর্বদিকে চলে আসে এবং সেখানে মাকলিক হিজবার আল-দিনের অধীনে বেদুঈন প্লাটুনে সেনা হিসেবে নিয়োগ পায়। অল্প কিছুদিন পরেই অযোধ্যায় মালিক হুসাম আল-দিনের সাথে দেখা হয় বখতিয়ার খিলজির এবং মালিক হুসামই প্রথম বখতিয়ারের মধ্যে যুদ্ধের দামামা দেখতে পায়। মালিক হুসাম বিহার ও অযোধ্যার মাঝামাঝি মির্জাপুরের একটা পরগনার শাসনভার দেয় বখতিয়ারকে। কিছুদিনের মধ্যেই বখতিয়ার বিহারের দুর্বল প্রতিরক্ষার অঞ্চলগুলোতে নিয়মিত সফল হামলা চালাতে শুরু করে। প্রতিবার আক্রমণেই খিলজি বিপুল পরিমাণ লুটের মাল, নারীদের বন্দী করে নিয়ে আসতে লাগল মির্জাপুরে। কয়েকটা অতর্কিত আক্রমণ এবং অভিযানে সফল হবার কারণে বখতিয়ার খিলজির দুঃসাহসিকতার খ্যাতি ও ভীতি ছড়িয়ে পড়ে, দিল্লী পর্যন্ত পৌঁছে যায় তার রাজ্য জয়ের খবর। দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে তার নাম আতঙ্কের প্রতিশব্দ। সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করেই কুতুবউদ্দিন আইবেক তার জন্য মূল্যবান বস্ত্র, সৈনিকের ইউনিফর্ম উপহার পাঠায় এবং বিহার আক্রমণের সেনাপ্রধান হিসেবে মনোনীত করে।
বখতিয়ার খিলজির রাজনৈতিক জীবনের দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যায় ১২০০ সালে বিহার দখল করার মধ্য দিয়ে। বিহার দখলের পরেই দিল্লী বুঝতে পারে বখতিয়ারের রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব। দিল্লীর সহযোগিতায় একই বছর বখতিয়ার তার সেনাবাহিনী বড় করে বাংলার দিকে ধাবিত হয় এবং ১২০৩ সালে তৎকালীন বাংলার বৃদ্ধ শাসক লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য আক্রমণ করে। জনশ্রুতি আছে বখতিয়ারের ঘোড়া এত দ্রুত নবদ্বীপে এসে পৌঁছায় যে তার বাকি সৈন্যরা তার সাথে তালই মেলাতে পারেনি, ফলে মাত্র ১৭জন (মতান্তরে ১৮জন) অশ্বারোহী যোদ্ধা তার সাথে ছিল। বখতিয়ার লক্ষ্মণ সেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আদ্যোপান্ত আগে থেকেই ভালো করে জেনে বুঝে এসেছে। ঘোড়া বিক্রেতার ছদ্মবেশে ১৭জন সৈন্য নিয়েই বখতিয়ার লক্ষ্মণ সেনের রাজ প্রাসাদে ঢুকে পড়ে। ভোগ বিলাসে মত্ত থাকা লক্ষ্মণ সেন তখন সবে দুপুরের আহার করতে বসেছে, এই সময়ে অতর্কিত আক্রমণে সে কোন রকম বাঁধা না দিয়েই ভীরু কাপুরুষের মত পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। ইতিমধ্যেই পৌঁছে যায় তার বাকি সৈন্যদল। বখতিয়ার খিলজি গৌড়, লক্ষণাবতী দখল করে বখতিয়ারের সেনাবাহিনী মেতে ওঠে রক্তের হোলি খেলায়। প্রাসাদের অস্ত্রধারী সব পুরুষদের হত্যা করা হয়, যারা তীব্র স্রোতের সামনে বৃথা বালির বাঁধের মত প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল, শিশুদের আলাদা করা হয় দাস হিসেবে বেচার জন্য আর প্রতিটি নারীকে গণধর্ষণ করে সৈন্যরা। (Lal, K. S. (1994). Muslim slave system in medieval India. New Delhi: Aditya Prakashan. Chapter 4)
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা এবং অত্র অঞ্চলের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙয়ের বর্ণনায় শশাঙ্কের আক্রমণ ও নালন্দা ধ্বংসের ইতিহাস ফুটে উঠেছে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজি দ্বারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বখতিয়ার খিলজির বিহার অভিযানের আলোচনা ইতিহাসবিদ মিনহাজের তাবাকাত-ই-নাসিরি বইতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। উইকিপিডিয়ার বয়ানে তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থ থেকে এই লুণ্ঠনের বিবরণ পাঠকের সামনে তুলে ধরতে সরাসরি নীচের অংশটি হুবহু প্রতিলিপি দিচ্ছি:
“মুহাম্মদ-ই-বখত-ইয়ার সাহসের সঙ্গে খিড়কি দরজা দিয়ে সেই স্থানে প্রবেশ করে দুর্গটি দখল করেন এবং প্রচুর সামগ্রী লুট করেন। সেই স্থানের অধিকাংশ বাসিন্দাই ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং এই সকল ব্রাহ্মণদের সকলেরই মস্তক ছিল মুণ্ডিত। তাঁদের সকলকে হত্যা করা বখতিয়ারের সেনাবাহিনী। সেখানে প্রচুর বই ছিল। বইগুলি দেখতে পেয়ে মুসলমানেরা কয়েকজন হিন্দুকে আদেশ দেয়, তারা যেন সেই বইগুলি সম্পর্কে তাদের তথ্য দেয়। কিন্তু ইতিমধ্যে সকল হিন্দুকেই হত্যা করা হয়ে গেছে। ফলে বইগুলো লিখিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করার মত পণ্ডিত আর একজনও বেঁচে ছিলেন না। [বইগুলির বিষয়বস্তু সম্পর্কে] অবহিত হওয়ার পর জানা যায়, সেই দুর্গ ও শহরটি ছিল আদতে একটি মহাবিদ্যালয় যাকে আমরা বর্তমানে নালন্দা বলে শনাক্ত করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নালন্দা সমগ্র পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং ইতিহাসের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও একটি। এর স্বর্ণযুগে ১০,০০০ এর অধিক শিক্ষার্থী এবং ২,০০০ শিক্ষক এখানে জ্ঞান চর্চা করত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত যেমন চীন, জাপান, কোরিয়া, গ্রীস, ইরান, তুরস্ক ইত্যাদি দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জন্য নালন্দা আসতো। একটি প্রধান ফটক এবং সুউচ্চ দেয়ালঘেরা বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপত্যের নিদর্শন এবং মাস্টারপিস হিসেবে সুপরিচিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন স্বনামে খ্যাত পণ্ডিত হলেন আর্য ভট্ট, মহাবীর, ব্রহ্মগুপ্ত প্রমুখ।
১১৯৩ সালে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি নালন্দ মহাবিহারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে; এই ঘটনাটি ভারতবর্ষে শুধু বৌদ্ধ ধর্মের পতনের সূচক নয়, ভারতবর্ষকে দীর্ঘমেয়াদে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ছুঁড়ে দেবার নীল নকশার বাস্তবায়ন। পারস্যের ইতিহাসবিদ মিনহাজ তার তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থতে লিখেছেন যে, “হাজার হাজার বৌদ্ধ পুরোহিতকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় কিংবা মাথা কেটে ফেলা হয়; খিলজি এভাবে এই অঞ্চল থেকে বৌদ্ধধর্ম উৎপাটন করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, মহাবিহারের গ্রন্থাগারটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে এত পরিমাণ বই ছিল যে তা পুড়তে তিন মাস সময় লেগেছিল”।
মূলত এই ধ্বংসযজ্ঞের জনশ্রুতি এত বেশি ডালপালা বিস্তার করে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, তৎকালীন হিন্দু সেন রাজবংশের শাসক লক্ষ্মণ সেনকে ভীত করে তুলে। এই ভীতিই অবশেষে ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে বিনা যুদ্ধে রাজ সিংহাসন ত্যাগ করার কারণ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। লক্ষ্মণ সেন ছিল অত্যাচারী রাজা, প্রজাদের মাঝে আগে থেকেই অসন্তোষ বিদ্যমান ছিল। লক্ষ্মণ সেনই হিন্দুদের উপর আরোপ করে চতুর্বর্ণ বিভাজন, ফলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা হয়ে গেল অচ্ছুৎ। তাছাড়া কট্টর হিন্দু সেন-বংশ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী পালবংশকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে ফলে বৌদ্ধধর্মের অনুসারীগণ পিছিয়ে পড়তে থাকে। সমকালীন রামাই পণ্ডিতের লেখাতে উল্লেখ আছে কীভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের ঘৃণা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে বৌদ্ধ এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুরা। রামাই পণ্ডিত নিজেও ব্রাহ্মণ শাসন থেকে মুসলিম শাসনের প্রশংসা করেছেন। একসময়ের লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্র খিলজির দরবারে ইসলামিক দরবেশ এবং ধর্মীয় রীতিনীতির প্রশংসা করে কবিতা লিখেছিলেন। হলায়ুধ মিশ্রের সমসাময়িক কবি উমাপতি ধর বখতিয়ার খিলজির বীরত্বের প্রশংসা করে লিখেছিলেন, “’সাধু ম্লেচ্ছ নরেন্দ্র সাধু সাধু। ভবতো মাতৈব বীরপ্রসূর্নীচেনাপি, ভবদ্বিধেন বসুধা সুক্ষত্রিয়া বর্ততে।’” যার অর্থ হচ্ছে “সাধু ম্লেচ্ছরাজ সাধু! আপনার মাতাই যথার্থ বীরপ্রসবিনী। নীচ সম্প্রদায়ের হলেও আপনার মতো লোকের জন্য পৃথিবী সুক্ষত্রিয় রয়েছে”।
বখতিয়ার খিলজির হাতে নালন্দা ধ্বংসের কথা অধিক প্রচলিত হওয়ার কারণেই হয়ত বিক্রমশীলা, জগদ্দল, ওদান্তপুর, তক্ষশীলা থেকে গেছে লোক চক্ষুর অন্তরালে। সবাই ভুলে গেছে নদীয়া, গৌড়ে, লক্ষণাবতীতে খুনের ইতিহাস। খিলজির সেনাবাহিনী এইসব প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, স্থাপনা, মন্দির, লাইব্রেরি, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আশ্রম ধ্বংস করে পুরোপুরি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়, আগুনে পুড়িয়ে দেয়। স্থানীয় হিন্দু, বৌদ্ধরা প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে হাজারে হাজারে পালিয়ে যেতে থাকে নেপালে, তিব্বতে, ভারতের অন্যান্য জায়গায় যে যেমন পেরেছে। যারা পালাতে পারেনি তারা সবাই নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছে বখতিয়ার বাহিনীর তরোয়ালের আঘাতে। মুসলিম ইতিহাসবিদের লেখাতেও উঠে এসেছে কীভাবে স্থানীয় বৌদ্ধ এবং হিন্দুরা নিশ্চিহ্ন হয়েছিল, সেখানে ইতিহাসের পাতায় পাতায় রক্তের দাগ। ১১৯৭ সালে বিহারে বখতিয়ার খিলজির সেনাবাহিনীর হাতে ধর্মীয় গণহত্যার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন ভারত বিশেষজ্ঞ, ইতিহাসবিদ এবং শিল্প-সমালোচক Vincent Arthur Smith, তার “The Early History of India” ইতিহাস বইতে উল্লেখ করেন বখতিয়ারের সেনাবাহিনী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বিপুল পরিমাণ বই দেখে বইতে কী লেখা আছে সে সম্পর্কে জানতে চায় কিন্তু ইতিমধ্যে সমস্ত ছাত্র এবং পণ্ডিতদের হত্যা করা হয়ে গেছে, যখন তারা নালন্দার লাইব্রেরীর বই সম্পর্কে জানতে চায় তখন সেই বই থেকে পাঠোদ্ধার করার মত কেউ আর অবশিষ্ট ছিল না।
“The decline and fall of Buddhism” বইতে Bhimrao Ramji Ambedkar তার Dr. Babasaheb Ambedkar: Writings and Speeches বলেছেন, “খিলজির সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চলকে তছনছ করে দিয়েছে, ইসলামে ধর্মান্তরকরণও চলেছে সমানতালে, সর্বাত্মক তরোয়ালের জোরে। ১২০০ সালের শেষের দিকে বখতিয়ার খিলজি বিহারে অভিযান শুরু করে, মূল আক্রমণটা চালায় নালন্দা বিক্রমশীলা, উদান্তপুরের উপর। তখনকার সময়ে বিহার বলতে কলেজ বোঝাত এবং বিহারের স্থাপত্যের দিকে তাকালে মনে হয় যেন দুর্গ, চারিদিকে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানকার পণ্ডিত এবং শিক্ষার্থীরা ছিল প্রধানত বৌদ্ধধর্মের। কিন্তু হিন্দুধর্মের শিক্ষার্থীরাও ছিল প্রচুর। বখতিয়ার উদ্দিন তাদের কিছু অংশকে হত্যা করে বাকি অংশকে ইসলাম গ্রহণ করার শর্তে ছেড়ে দেয়। বিহার আক্রমণের ফলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রায় বিলুপ্তির মুখে পড়ে যায়, প্রাণের দায়ে তাদের সবাইকে ইসলাম কবুল করতে হয়।”
ভাগ্যের অন্বেষণে ঘুরে বেড়ানো ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি পূর্বদিকে ছুটতে লাগল রাজ্যজয়ের নেশায়। ১২০০ সালে বখতিয়ার খিলজি উদান্তপুরী বিহার আক্রমণ করে বিহারটির বৌদ্ধভিক্ষুদের হত্যা করে, ধ্বংস করে দেয় নালন্দা, পুড়িয়ে দেয় নালন্দার সমস্ত বই। অতর্কিত আক্রমণে দখল করে নেয় নদীয়া। Abd al-Qadir Badayuni ‘র Muntakhab-ut-Tawarikh বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সীতারাম গোয়েল The story of Islamic imperialism in India বইতে লিখেছেন, “নদীয়া আক্রমণ করে বখতিয়ার বাহিনীর হাতে এসে যায় বিপুল পরিমাণ লুটের মাল ও অঢেল অর্থবিত্ত। তারা পুজোর মন্দিরগুলো ভেঙে দিলো, বিধর্মীদের মন্দিরমঠগুলো রাতারাতি পরিণত হয়ে গেল মসজিদ আর খানকা।” Indian Institute of Management’র অধ্যাপক, ইতিহাসবেত্তা বরুণ দে’র অনুবাদে কলকাতা থেকে প্রকাশিত Nizamuddin Ahmad‘র Tabqãt-i-Akbarî গ্রন্থ থেকে জানা যায়, “ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি দীনহীন থেকে রাজাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে, মসজিদে নামাজের খুৎবায় তার নাম উচ্চারিত হয়, মুদ্রায় তার নাম অঙ্কিত হয়েছে। বিধর্মীদের মূর্তি ও মন্দির ভেঙে সেখানে স্থাপিত হয়েছে খানকা আর মাদ্রাসা।”
Ghulam Husain Salim’র Riyãzu’s-Salãtîn বইটি ফার্সি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন আবদুস সালাম এবং প্রকাশিত হয় দিল্লী থেকে। মুহম্মদ বখতিয়ার নালন্দা বিহারে ধ্বংসের কালো হাত বিছিয়ে দেয়, নিশ্চিহ্ন করে পুরো জনপদ, সেখানকার বাসস্থান, পুজোর মন্দির, বৌদ্ধ বিহার ও আশ্রম। লক্ষ্মণ সেনের গৌড় দখলে নিয়ে রাজধানী লক্ষণাবতী লুট করে তার ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়। বখতিয়ার পুরো শাসনামলে মন্দির ভেঙে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করে এবং ইসলামের প্রসার ও খেদমতে নিয়োজিত ছিল।
Koenraad Elst তার Decolonizing the Hindu Mind বইতে Louis Frederic’র L’Inde de l’Islâm (Islam of India) বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, “মুহম্মদ ঘুরি আজমিরের মন্দির গুড়িয়ে দিয়ে সেখানে মসজিদ স্থাপনের নির্দেশ দেয়, মসজিদের পাশেই নির্মাণ করে মাদ্রাসা। ঘুরি কনৌজ, কাশি দখল করে সেখানে ধ্বংস এবং লুটপাট অব্যাহত রাখে। একইসাথে বাংলার অন্য প্রান্তে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে বখতিয়ার। সে বিহারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে প্রায় নির্মূল করে ফেলে, ধ্বংস করে দেয় তৎকালীন জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শন চর্চার পীঠস্থান নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। বখতিয়ার খিলজি লক্ষ্মণ সেনকে উৎখাত করে সেখানে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। লক্ষণাবতীর গঙ্গাতীরের ব্যাসল্ট পাথরে নির্মিত একটা মন্দিরকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। ১২০২ সালে উদান্তপুরি বিহারে সে দুই হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করে।”
দিল্লী থেকে প্রকাশিত Kishori Saran Lal তার Theory and practice of Muslim state in India গ্রন্থে লিখেছেন, গড়ে পড়তায় হিন্দু এবং বৌদ্ধদের বিদ্যা-শিক্ষা ভয়ানক বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। মন্দির, আশ্রমের পাশেই থাকত টোল, নিয়মিত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়াতে সেগুলো তখন বিলুপ্তির পথে। কুতুবউদ্দিন আইবেক যেমন আজমিরের বিশাল-দেবা সংস্কৃত কলেজে হামলা চালিয়ে সেখানে Arhai din ka Jhonpra মসজিদ স্থাপন করে। আর পূর্বদিকে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি বৌদ্ধবিহার, ওদান্তপুরি, নালন্দা, বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসে নিয়োজিত। ভারতে ইসলামি সাম্রাজ্যের সর্বত্র হিন্দু মন্দির, টোল, পাঠশালা ধ্বংস চলতেই লাগল সেই সময় থেকে আওরঙ্গজেবের শাসনামল পর্যন্ত। আওরঙ্গজেব কিছুটা উদার হলেও সেও কিন্তু ব্যতিক্রম না। আমি দীর্ঘদিন দিল্লী, ভোপাল, হায়দ্রাবাদে (দাক্ষিণাত্য) বাস করি। এতবড় এলাকাতে মুসলিম আক্রমণের পূর্বের কোন মন্দির আর অবশিষ্ট নাই। হিন্দুদের শিক্ষাব্যবস্থা মন্দির, মঠ এবং আশ্রমের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল এবং এইসব প্রতিষ্ঠানগুলো শহরকেন্দ্রিক ছিল। ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি সুপরিকল্পিতভাবে টোল, পণ্ডিত এবং মন্দির ধ্বংস করতে থাকে।
ইতিহাসের পাতায় যা লেখা থাকুক না কেন ইখতিয়ার উদ্দিন মুসলিম সমাজে যুদ্ধ বিজয়ী নায়ক হিসেবে উপস্থাপিত হয়। বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করে বখতিয়ার। মাত্র ১৭জন সৈন্য নিয়ে নদীয়া দখলের বীরত্বগাঁথা মুসলিমদের কাছে মিথের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি আল মাহমুদ বখতিয়ার খিলজিকে নিয়ে লিখেছেন চরম সাম্প্রদায়িক কবিতা “বখতিয়ারের ঘোড়া”। কবিতাটি বিভিন্ন ইসলামিক ছাত্র সংগঠনগুলো ব্যাপক চর্চা করে।
বখতিয়ারের ঘোড়া
মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে
মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;
আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।
জেগেই দেখি কৈশোর আমাকে ঘিরে ধরেছে।
যেন বালিশে মাথা রাখতে চায় না এ বালক,
যেন ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে মশারি,
মাতৃস্তনের পাশে দু’চোখ কচলে উঠে দাঁড়াবে এখুনি;
বাইরে তার ঘোড়া অস্থির, বাতাসে কেশর কাঁপছে।
আর সময়ের গতির ওপর লাফিয়ে উঠেছে সে।
না, এখনও সে শিশু। মা তাকে ছেলে ভোলানো ছড়া শোনায়।
বলে, বালিশে মাথা রাখো তো বেটা। শোনো
বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে।
আসছে আমাদের সতেরো সোয়ারি
হাতে নাংগা তলোয়ার।
মায়ের ছড়াগানে কৌতূহলী কানপাতে বালিশে
নিজের দিলের শব্দ বালিশের সিনার ভিতর।
সে ভাবে সে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়দৌড়। বলে, কে মা বখতিয়ার?
আমি বখতিয়ারের ঘোড়া দেখবো।
মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন,
আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি। খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।
দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে
দ্যাখো, দ্যাখো।
মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক
তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার
নিশেন ওড়ায়।
কোথায় সে বালক?
আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা
মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।
বারুদই বিচারক। আর
স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।
নালন্দা বিহার এবং এতদঞ্চলের বৌদ্ধদের উপর বার বার নেমে এসেছে আঘাত। হিউয়েন সাং সাত শতকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন এবং তখনই লক্ষ্য করেছিলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। ইসলামের বিজয়ের আগে থেকেই বৌদ্ধরা হিন্দু ব্রাহ্মণ, শৈবদের দ্বারা আক্রান্তের শিকার। ইতিহাসবিদ সীতা রাম গোয়েল বৌদ্ধ জনসংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদের নির্যাতনকে দায়ী করেছেন। গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক বুদ্ধের মূর্তি, বোধিবৃক্ষ ভেঙে দেয়। মুসলিমদের আক্রমণের আগেও নালন্দা দুইবার আক্রান্ত হয়েছিল। নালন্দার উপর প্রচণ্ড আঘাত আসে মিহিরাকুলের নেতৃত্বে। কিন্তু রাজ্য জয়ের পর মিহিরাকুল নালন্দা বিহারকে নতুন করে নির্মাণ করে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় আক্রান্ত সপ্তম শতকে গৌড়দের হাতে কিন্তু রাজা হর্ষবর্ধন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আবার সংস্কার করেন।
বাংলা ভাষা-তাত্ত্বিক সুকুমার সেন তার ‘বঙ্গভূমিকা’ বইতে লেখেন, “নদীয়া আক্রমণের সময় বখতিয়ার খিলজি রাজমহলে প্রবেশের নিয়মিত রাস্তা পরিহার করে ঝাড়খণ্ডের বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাজধানীর দিকে আসতে থাকে। তার সৈন্যদলকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে নিজে নেতৃত্ব দিয়ে এত দ্রুত রাজপ্রাসাদে চলে আসে যে মাত্র ১৭ জন সৈন্য তার সাথে তাল মিলিয়ে আসতে পেরেছিল। বর্ণ বৈষম্যে জর্জরিত তখনকার নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মাঝে তখন মিথ প্রচলিত ছিল যে নির্যাতিতকে রক্ষা করতে রক্ষা করতে ঘোড়ায় চড়ে কল্কি নামে এক অবতারের আবির্ভাব হবে। খিলজি সেদিন সাদা ঘোড়ায় চড়ে লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য আক্রমণ করেছিল সেদিন অত্যাচারিত প্রজারা ভেবেছিল এই বুঝি এসে গেছে তাদের ত্রাণকর্তা কাঙ্ক্ষিত কল্কি অবতার।
ইতিহাসবিদ মিনহাজ, বাদুয়ানি, নিজামউদ্দিন , গোলাম সেলিম সহ এতগুলো ইসলামিক ইতিহাসবিদ স্বীকার করে গেছে নালন্দা ধ্বংস করেছিল বর্বর বখতিয়ার আর ইনি কোথা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে এক শাক্য মুনীর কথা। আপনারাই হলেন বখতিয়ারের ঘোড়ার বাচ্চা। এইসব অস্বীকার আর কত করে স্বপ্নের ধর্মের বর্বর সেনাদের বাঁচাবেন। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থাকা সত্বেও আপনাদের মত মুসলিমদের বোঝানো যায়না। কোথা থেকে একেকটা ইতিহাস বের করে ডিফেন্স করবেন নিজেদের বর্বরতার। n Alam
সাম্প্রতিক তথ্য আমাদের সামনে আসছে যে, বখতিয়ার খলজি নালন্দায় কোনােদিন যাননি। ঐতিহাসিক কে কে কানুনগাে জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সােসাইটি অফ বেঙ্গল-এ প্রকাশিত শরৎচন্দ্র দাশের ‘অ্যান্টিকুইটি অফ চিটাগাঁও’ প্রবন্ধ থেকে জানাচ্ছেন যে, কামিরের বৌদ্ধ পণ্ডিত শাক্য শ্রীভদ্র ১২০০ সালে মগধে গিয়ে দেখেছিলেন বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী বিহার ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুর্কিদের ভয়ে শ্রীভদ্র ও ওই বিহার দুটির ভিক্ষুরা বগুড়া জেলার জগদ্দল বিহারে আশ্রয় নেন। (নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস, আদিপর্ব, দে’জ পাবলিশিং হাউস, ৭ম সংস্করণ, কলকাতা, ১৪১৬, পৃ. ৪১১)। কিন্তু শরৎচন্দ্র দাশ তার উক্ত প্রবন্ধে এমন কথা বলেননি যে, ১২০০ সালে বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী বিহার দুটিকে ধ্বংস করা হয়েছিল। বরং তিনি তাঁর সম্পাদিত তিব্বতীয় শাস্ত্র ‘পাগসাম ইয়ান জাং’-এ বলেছেন, বিহার দুটি ধ্বংস হয়েছিল ১২০২ সালে। ফলে শাক্য শ্রীভদ্র জগদ্দল বিহারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই ঘটনা বখতিয়ারের বিহার অভিযানের (১২০৩) পূর্বেকার। আর এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হল, ক্ষতিগ্রস্ত বিহারগুলির মধ্যে নালন্দার নাম নেই। তাছাড়া মিনহাজ বা অন্য কোনাে সূত্রেও নালন্দা ধ্বংসের কথা বলা হয়নি। ১২৩৪-৩৬ সালে অর্থাৎ বখতিয়ারের বিহার জয়ের ৩১ বছর পর তিব্বতী সাধু ধর্মস্বামী মগধে আগমন করেন ও সেখানে অবস্থান করেন। নালন্দা মঠকে তিনি তখন চালু অবস্থায় দেখতে পান। সেখানে মঠাধ্যক্ষ রাহুল শ্রীভদ্রের পরিচালনায় সত্তর জন সাধু অধ্যয়নে নিয়ােজিত ছিলেন এবং তিনি নিজে ছমাস সেখানে জ্ঞানার্জন করেন। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল এই যে, বখতিয়ারের আক্রমণে নালন্দা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বলে যে প্রচারণা ছিল ধর্মামীর বিবরণে তার উল্লেখ নেই। তবে তিনি বিক্রমশীলা মহাবিহারকে সম্পূর্ণ ধ্বংস অবস্থায় ও ওদন্তপুরীকে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি রূপে দেখতে পান। (জি রােয়েরিখ সম্পাদিত, বায়ােগ্রাফি অফ ধর্মস্বামী, কে পি জয়সওয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পাটনা, ১৯৫৮, পৃ. ৬৪, ৯০-৯৩ )।