বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় ছাত্রদের নকল করা নিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের অপ্রীতিকর ঘটনা প্রাত্যহিক ব্যাপার ছিলো। ১৯৮৬ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে Academic Council এ সবচেয়ে নবীন সদস্য এবং কাউন্সিল মিটিং এ আমার প্রথম যোগদান। ভিসির Conference Room এ জায়গা হয় না, তাই কোন এক ক্লাশ রুমে মিটিং। আমার বক্তব্য পেশ করার জন্য ক্লাশের ব্ল্যাকবোর্ডের সাহায্য চাইলাম। ভিসি প্রফেসর আমিনুল হক মঞ্জুর করলেন। আমি বক্তব্য শুরু করলামঃ
-
নকলের জন্য ছাত্রদের দায়ী করার আগে শিক্ষকরাও যে দায়ী তা অস্বীকার করলে চলবে না। এই কাউন্সিলেই অনেক শিক্ষক আছেন যারা সারা বছর ক্লাশে আসেন না। পরীক্ষার তারিখ ঘোষনা হলেই তারা আসেন এবং বইয়ের কোন কোন জায়গা থেকে পরীক্ষা হবে তা জানিয়ে দিয়েই তারা প্রস্থান করেন। এর অর্থ হলো ছাত্ররা একমাস ধুমসে পড়বে তারপর ব্যাপক গ্যাপ সহ দ্বিতীয় মাসে পরীক্ষা শেষ করবে। দুমাসে একবছর শেষ। এভাবে শিক্ষাক্রম চালালে ছাত্রদেরকে চার বছর আটকে রাখার কোন অর্থ নেই। আমরা আট মাসে কেনো ডিগ্রী দিচ্ছি না? দ্বিতীয় কথা, একমাসে সমস্ত সিলেবাস ছাত্রদেরকে শিখে পরীক্ষা দিতে হলে শিক্ষকরাই ছাত্রদেরকে নকল করার জন্য প্ররোচিত করছে। এটা শিক্ষকদের বুঝতে হবে এবং বন্ধ করতে হবে।
আমি হাত তুলে আমার ঘড়িটা দেখালাম। জাপানে ফেলোশীপ করতে গিয়ে Casio কোম্পানীর ঘড়িটা কিনি বাজারে আসার দ্বিতীয় দিনে। বললাম – এই ঘড়িতে টাইপ করা দশ পাতা সেভ করে রাখা যায়। পরীক্ষার হলে আপনারা ছাত্রদের চুথা আর বই আছে কিনা তাই খুজেন। হাত ঘড়ি থেকে না অন্য কোন ক্যালকুলেটর থেকে নকল করছে আপনারা বুঝতেই পারবেন না। এক টেকনোলোজি ধরবেন, আপনি বুঝার আগে আর এক টেকনোলোজি শুরু হবে। এভাবে নকল খুজে নকল ধরতে পারবেন না। পথ কী?
পথ আপনাদেরকেই বের করতে হবে। তিন ঘন্টায় পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না চেয়ে প্রশ্ন ছোট করুন এবং প্রশ্ন সংখ্যা বাড়িয়ে দিন। এবারে ব্ল্যাকবোর্ডে গিয়ে x-axis এ সময় এবং y-axis এ ছাত্ররা কয়টা প্রশ্নের উত্তর লিখবে তার গ্রাফ করে সংক্ষেপে বললাম – পরীক্ষা হবে Time-tight. যার প্রিপারেশন ভালো, সে সব প্রশ্নের উত্তর লিখেও দশ মিনিট সময় পাবে Review করার। আর যাকে বই অথবা চুথা দেখে লিখতে হবে সে সব প্রশ্নের উত্তর করার সময় পাবে না। বাধ্য হয়ে ভালভাবে প্রস্তুত হয়েই তাকে আসতে হবে। আপনাদের নকল ধরার জন্য সজাগ থাকতে হবে না।
ভিসি সাহেব বুঝলেন ব্যাপারটা। Academic Council এর মিটিং সকালে শুরু হলে রাত পর্যন্ত চলতো। বলাবাহূল্য, এটাই সব চেয়ে ছোট মিটিং ছিলো। একটা কমিটি করলেন। প্রফেসর জেড এইচ ভূঁইয়া সভাপতি এবং আমি নবীনতম সদস্য। মিটিং হলো, কিন্তু আমার যে বক্তব্যে ভিসি কমিটি করলেন তার কিছুই থাকলো না।
স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের সীমাহীন ক্ষমতা প্রদর্শন এবং ব্যবহারের প্রবনতা আছে। ভিক্ষারুন্নেসার শিক্ষিকাদের নিজেদের দোষ-ত্রুটি খুজে বের করতে হবে। কয়েকটা জিনিষ লক্ষ্য করলামঃ
-
ছোট ছোট মেয়েদের মাঝে যে ম্যাচুরিটি দেখলাম তা শিক্ষিকাদের মাঝে অনুপস্থিত। একটি মেয়ে বললো – নকল করে ধরা পড়েছে, ঠিক আছে। প্রথম অপরাধেই কেনো তাকে শাস্তি দেওয়া হলো? একটা চান্স দিলে স্কুলের কী ক্ষতি হতো?
আর একটি মেয়ে বললো – আমিও মোবাইল ফোন এনে ধরা পড়েছিলাম। আমাকে ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। ওয়ার্নিংটাই আমার কাছে বিস্তর শাস্তি। তারপর দ্বিতীয়বার মোবাইল আনার কথা চিন্তাও করিনি।
কর্তৃপক্ষ গার্ডিয়ান ডেকেছেন। এটা স্বাভাবিক। এটা করা হয় ওয়ার্নিং দেওয়ার জন্য। কিন্তু “আগামীকাল টিসি নিয়ে যাবেন” এই কথা বলে দেওয়ার জন্য গার্ডিয়ান ডাকার রীতিনীতি কোন পৃথিবীতে আছে?
অরিত্রির আত্নহত্যার দায়ভার স্কুল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বিচার হবে না। বাংলাদেশে কোন বিচার নাই। ঘটনা অন্য পথে নেওয়ার জন্য ছাত্রীদেরকে দিয়ে ইতিমধ্যে পালটা স্লোগান দেওয়ানো হচ্ছে। এটা হবে গতকালই ভেবেছিলাম।
সত্যি, সেলুকাস! বিচিত্র এই দেশ!
বাংলাদেশের বিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক-শিক্ষিকারা এখনো বদ স্বভাবের, ছোটো-খাটো অপরাধের জন্য বড় সাজা দেয় যা একটি সভ্য দেশে কোনোভাবেই কাম্য নয়।
একজন কিশোরীর এভাবে চলে যাওয়া সত্যিই কষ্টের। কিশোরীর বাবা, মা আর স্বজনরা যে সীমাহীন যন্ত্রনা আর হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ঘটনার প্রতিবাদে যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হয়েছে তার পেছনে রয়েছে বহুদিনের জমে থাকা ক্ষোভ; স্কুলের শিক্ষক আর ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের অভিযোগ বহুদিন ধরেই ছিল।
নকল করা কখনই কাম্য হতে পারে না, নকলকে প্রতিহত করতে হবেই, কিন্তু ভেবে দেখার বিষয় এক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ভুল আছে কিনা। নিষেধ অমান্য করে পাঠ্য বিষয়ের ছবিসহ মোবাইল ফোন সাথে রেখে মেয়েটি নিয়মভঙ্গ করেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই; কিন্তু তাকে একেবারেই পরীক্ষা দিতে না দেয়া এবং অভিভাবক ডেকে টিসির হুমকি দেয়া বাড়াবাড়ি ছিল, বিশেষতঃ প্রকাশিত খবর মতে যখন তাকে সরাসরি নকলরত অবস্থায় দেখা যায় নি। এক্ষেত্রে কেবল সেদিনের পরীক্ষাটি বাতিল করে, মেয়েটি এবং তার অভিভাবকদের সতর্ক করে দেয়া যেত; এবং কাউন্সেলিং-র ব্যবস্থা করা যেত। দেশের ভবিষ্যত নাগরিকদের যোগ্য করে গড়ে তোলা, ভুল করলে শোধরানোর সুযোগ দেয়াটাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, শাস্তি দেয়াটা নয়। দেখা যাচ্ছে সরকার এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন, কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো নেয়ার আগে একটি তাজা প্রাণ অকালে অযথাই ঝরে গেল।