খুব বেশিদিন আগের কথা নয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে মিনোস বলে ব্যঙ্গ করা হতো। মিনোস মানে ক্ষুদ্র মাছ যা বড়শির টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নবাগত একটি দলকে এই ব্যঙ্গার্থক  শব্দ দিয়ে চরমভাবে আন্ডারমাইন করা হত।হাসিঠাট্টা তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ তো ছিলই। আমাদের ক্রিকেটারগণও ক্রিকেটশৈলীতে যতটুকু না ছিলেন পারদর্শী মানসিকভাবে ছিলেন তারচেয়ে অনেকগুণ দুর্বল।হারার আগে হেরে যাওয়া ছিল চিরাচরিত সিনারিও। দুর্দন্ড প্রতাপশালী জমিদারের হাত থেকে অনুগত প্রজার করুণা ভিক্ষার মত আমাদের ক্রিকেটারগণও ভাল খেলার চেয়ে ভিনদেশী ক্রিকেটারদের কাছ থেকে ট্রিপস নেয়াকেই পরম গর্বের কাজ বলে মনে করতেন। মাশরাফি  নেতৃত্বে এসে দলের এই নতজানু মানসিকতাকে পুরোই পাল্টে দিলেন। তিনি শেখালেন কীভাবে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হয়। কীভাবে চোখ রাঙ্গানির বদলে পাল্টা চোখ রাঙ্গাতে হয়। খেলোয়াড়দের ন্যুব্জ মেরুদন্ডকে তিনি হ্যাচকা টানে ঋজু করে দিলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বদলে যাওয়া ভাবমূর্তির পেছনে মাশরাফির এই ট্রিপসই হল মূল অনুঘটক। মাশরাফি বদলে যাওয়া ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশের মূল রূপকার। এজন্য তিনি আমাদের জাতীয় বীর। জনপ্রিয়তার মাপকাটিতে তার ধারেকাছেও কেউ নেই এমনকি ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীও নন।এহেন জনপ্রিয় আইকনকে দলে ভিড়িয়ে আওয়ামীলীগ হয়তো একটি আসন কনফার্ম করে ফেলল কিন্তু এতে বাংলাদেশের ক্রিকেট  তার প্রধান প্রেরণাদাতা সাহসী এবং লড়াকু কাণ্ডারিটিকে হারিয়ে ফেলল কি না তা প্রত্যক্ষ করতে হয়তো আমাদিগকে আসন্ন নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নির্বাচনে যদি আওয়ামীলীগ হেরে যায় তবে মাশরাফির ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়তে পারে। কারণ ক্রিকেটের নতুন কর্তা হয়ে যিনি আসবেন তিনি একজন আওয়ামী এমপিকে দলে রাখবেন বা দলের নেতৃত্ব আবারও তার কাধে চাপিয়ে দেবেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচার বিবেচনায় তা বিশ্বাস করতে হলে অতি আশাবাদী হতে হয়। তার নেতৃত্বে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের চমকপ্রদ সাফল্যের সম্ভাবনা থাকলেও তাকে সে সুযোগ দেয়া হবে তাও বিশ্বাস করতে ভয় হয়। কারণ এতে দেশ গৌরবান্বিত হলেও এর বড় কৃতিত্বটাযে প্রতিপক্ষদল পেয়ে যাবে। আবার নির্বাচনে আওয়ামীলীগ জিতলেও মাশরাফি যে পূর্বের মত অদম্য এবং অখন্ড মনঃসংযোগ দিয়ে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন তাও নিশ্চিত করে বলা যায়না। কারণ তার বোলিং বা  নেতৃত্ব এখন আর নিরংকুশভাবে দর্শক সমর্থিত হবেনা।তার প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তায় এখন বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখা দিয়েছে। আগে তিনি ছিলেন পুরো দেশের এখন একটি দলের।দেশের বিশাল একটি সমর্থকগোষ্টি রাতারাতি তার ভক্ত থেকে শত্রু পংক্তিভুক্ত হয়ে গেছে। হাঁ, সোজাসাপটা শত্রু বলাটাই ভাল কারণ এটাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। স্রেফ মহামানবতূল্য মানুষও দুই দলের একটির প্রতি সামান্য দুর্বলতা দেখানোমাত্র ভিন্নশিবিরে মুহুর্তে খলনায়কে পরিনত হয়ে যান। মাশরাফিও এর ব্যতিক্রম নন। রাজনীতিতে পা রাখামাত্রই অনেকের কাছে তার বর্ণাঢ্য অতীত আর দেশের জন্য তার সকল অবদান ধূসর হয়ে গেছে। শুধু কি তাই? ইতোমধ্যে তাকে উদ্দেশ্য করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল অশ্রাব্য গালিগালাজের ঝড় শুরু হয়ে গেছে। এই ঝড় বইতেই থাকবে। হয়তো কিছুদিনের মাঝেই তথ্য বেরিয়ে যাবে দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে কখন কোন জিতাম্যাচ ইন্ডিয়াকে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলেন ইত্যাদি। মাশরাফি বিএনপিতে যোগদান করলেও গালাগালের ঝড়টা খুব কমমাত্রায় হতো তাও মনে করার কোনো  কারণ নেই। হয়তো এতদিনে বেরিয়ে যেত তার কোন পূর্বপুরুষ যুদ্ধাপরাধে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তার হালনাগাদ তথ্য উপাত্ত। মাশরাফি সাহসী যুদ্ধা। আদরের ছোট্ট শিশুকন্যাকে আইসিইউতে রেখে তিনি ছুটে গেছেন মাঠে। কারণ দেশটা তার কাছে অনেক বড়। তিনি যেরকম অদম্য অনমনীয় চরিত্রের অধিকারী আশা করা যায় রাজনীতির নোংরা জল তা যত বেগবান খরস্রোতাই হোক তাকে ভাসিয়ে নেবেনা। কিন্তু প্রশ্ন হল হাঁটুর সাত সাতটি কঠিন ইনজুরি কাটিয়ে ওঠা মাশরাফি কি  হাঁটুর নিচের অসংখ্য কামড়ের ক্ষতকে কাটিয়ে উঠতে পারবেন? কেননা শারিরীক ইনজুরির জন্য সার্জারির সমাধান থাকলেও স্বজাতীর নোংরা মানসিকতাজাত বিষ  নিরাময়ের জন্য শরীরের কোন অঙ্গে তিনি সার্জারি করাবেন?

 

মাশরাফি রাজনীতি করবেন কি না করলে কখন করবেন কোন দল করবেন তা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার।আমি  ব্যক্তিগতভাবে কেবল সময়টি নিয়ে একটু দ্বিধান্বিত। তিনি কিছুটা তাড়াহুড়া করে ফেললেন নাতো? মাশরাফি যেমন চিরতারুন্যকে ধারণ করে আছেন আরও পাঁচটি বছর অপেক্ষা করলে বয়সের দিক দিয়ে তিনি খুব একটা অথর্ব হয়ে যেতেননা।এতে মনে হয় লাভ হতো বাংলাদেশের একই সাথে ব্যক্তি মাশরাফিরও।কেননা পুরো বাংলাদেশ তার নেতৃত্বে আগামী বিশ্বকাপ নিয়ে কিছুটা স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিল।মাশরাফির মত স্বপ্নটাও এখন খন্ডিত হয়ে গেল।আর ব্যক্তি মাশরাফির লাভ হতো পাঁচ বছরে রাজনীতির ভালমন্দ সোজা সর্পিল ব্যাপারগুলোকে ভাল করে পাঠ করে নিজেকে ঋদ্ধ করে নেবার সুযোগ পেতেন।রাজনীতির পথ ক্রিকেট পীচের চেয়েও কঠিন।অর্জুনা রানাতুঙ্গা শ্রীলংকান ক্রিকেটে রূপকথার মহানায়ক।মিঃ কোল’ খ্যাত রানাতুঙ্গার চওড়া ব্যাটে ভর করেই প্রথমবারের মত বিশ্বকাপটি লংকানদের কাছে ধরা দিয়েছিল।রানাতুঙ্গা রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও মহিমান্বিত কোনো ঘটনার জন্ম যে দিতে পারেননি তা বলাই বাহুল্য।ক’দিন আগে খবরে দেখলাম রানাতুঙ্গাকে পুলিশ এরেষ্ট করে নিয়ে যাচ্ছে কি এক গোলাগুলির ঘটনায়।খবরটি দেখার পর বিশ্বকাপের সেই ঐতিহাসিক ফাইনাল আর  নির্বিকার এক যুদ্ধার মত রানাতুঙ্গার ব্যাট চালানোর দৃশ্যটি স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠল।যে মহানায়ক শ্রীলংকাকে একদিন ক্রিকেটের হিমালয়ে্ তুলেছিলেন সময়ের আবর্তে তাকেই  বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে সেদেশের পুলিশ।কী নির্মম বাস্তবতা!কী সুকঠিন রাজনীতির মঞ্চ! এসব বিবেচনায় সাকিব আল হাসানের সিদ্ধান্তকে অধিক বুদ্ধিদীপ্ত মনে হয়েছে।আমারতো মনে হয়না একজন ক্রিকেটারের বর্নাঢ্য ক্যারিয়ারের চেয়ে আমাদের দেশের একজন সাংসদ বা মন্ত্রীর ক্যারিয়ার খুব বেশি উজ্জ্বল এবং জ্যোতির্ময় হতে পারে। মন্ত্রীবাহাদুর যত দাপুটে এবং ক্যারিশমেটিকই হননা কেন তার পরিচিতি আমাদের রাষ্ট্রীয় সীমানা অতিক্রম করে দিল্লী হিল্লি দূরে থাক ঘরের পাশের আগরতলা গোয়ালপাড়ায়ও পৌঁছে কি না সন্দেহ কিন্তু ফর্মে থাকা একজন ক্রিকেটারের দ্যুতি ছড়াতে পারে বিশ্বময়।

নির্বাচনের টিকিট নিয়েছেন একাধিক জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পীও। এরা আমাদের মনোরঞ্জনে নিবেদিতপ্রাণ হলেও বহির্বিশ্বে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেননা। সুতরাং এরা গান গাওয়া ছেড়ে দিয়ে ফুলটাইম রাজনীতিবিদ হলেও জাতীর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হবেনা সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও  সৃষ্টি হবেনা ভয়াবহ কোনো শূন্যতার কেননা তাদের স্থান দখল করতে শত শত শিল্পী তৈরি হয়েই আছেন।হাজার হাজার শব্দটা বললামনা। কিন্তু ক্রিকেট এবং ক্রিকেটারদের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা কেননা এর সাথে আমাদের জাতীয় স্বার্থ জড়িত। একমাত্র এই মাধ্যমটিই আমাদের মত ক্ষুদ্র এবং স্বল্পোন্নত দেশকে অনেক উন্নত দেশের কাছাকাছি নিয়ে গেছে,বাংলাদেশ নামক দেশটির নাম আর পরিচিতি দুই গোলার্ধের বেশিরভাগ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।এরচেয়েও বড়কথা এই একটিমাত্র খেলা বড় কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের সময় দলমত জাতীধর্ম নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষকে এক সূতায় বেঁধে ফেলে।তখন জাতী হিসেবে আমরা নিজেদের মাঝে এক অটুট ঐক্যেকে আবিষ্কার করতে পারি আমাদের হাজারো অনৈক্যের বিভ্রান্তিজালে যে ঐক্য এখন দুর্লভ সোনার হরিণ । সুতরাং দেশের প্রতিনিধিত্বকারী এই এম্বেসেডারদের ক্রিকেটে থাকা না থাকার বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যু হওয়ার সঙ্গত দাবি রাখে।

শিল্প সাহিত্য ক্রীড়া তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল মানুষেরা রাজনীতিতে গিয়েও যে সফল হবেন তার কি নিশ্চয়তা আছে? এ প্রসঙ্গে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরের কথা উল্লেখ করা যায়।তাঁর রাজনীতিতে যোগদানের প্রাক্কালে অভিনেতা নাট্যকার আবুল হায়াত পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছিলেন।অনেক আগের লেখা শুধু একটা অংশ মনে আছে যেখানে তিনি আসাদুজ্জামান নূরকে উদ্দেশ্য করে অনেকটা এরকম প্রশ্ন করেছিলেন ‘একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী যখন সংসদে আপনার পাশে বসে পা নাড়াবে কথা বলবে তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে? তখন জয়নাল হাজারীর যুগ এবং আবুল হায়াত সন্ত্রাসী বলতে যে তাকেই বুঝিয়েছিলেন তা বলাই বাহুল্য। না,আবুল হায়াতের এই লেখা সতীর্থ অভিনেতাকে তার লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনি। তিনি সাংসদ হলেন। মন্ত্রী হলেন। মাঝে একবার সহজাত মহৎ অভিপ্রায়ের কারণে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী হয়ে সাংস্কৃতিক জগতে কোনো বৈপ্লবিক হাওয়া তিনি বইয়ে দিতে পারেননি বা দলীয় সংস্কৃতি বদলেও স্মরণীয় কোনো অবদান রাখতে পারেননি। বরং হেফাজতের সুপারিশে পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক পাঠের অন্তর্ভুক্তি এবং মানবিক পাঠের মহাপ্রয়াণে ব্যথিত হয়ে ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তা অনেকের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। তাহলে কীহল তার মন্ত্রী হয়ে? এখনওতো তিনি বাকের ভাইয়ের ইমেজকে অতিক্রম করে একজন ডাকসাইটে মন্ত্রীর ইমেজ তৈরি করতে পারলেননা। তার অর্থবিত্ত ব্যাংক ব্যালেন্সও স্ফীত হলনা তাহলে লাভটা কীহল? অবশ্য লাভ হয়েছে আওয়ামীলীগের তারা একটি আসন ইলেকশনের আগেই হিসেবের খাতায় জমা করে নিতে পারছে। অবশ্য এই আসন বাড়ানোর সমীকরণে আব্দুর রহমান বদির স্ত্রীকেও নমিনেশন দেয়া হয়েছে। মাশরাফি এম পি, মন্ত্রী হলে আসাদুজ্জামান নূরের মত একজন সৎ এবং ক্লিন ইমেজের মন্ত্রী হবেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘বেড পিক এন্ড ওয়ার্স সিলেকশন’ আরিফ খান জয়ের মত দুর্বৃত্ত হবেননা একথা হলফ করে বলা যায় কিন্তু যদি তিনি আগামী বিশ্বকাপটা খেলতে না পারেন দলকে উজ্জীবিত নেতৃত্ত দিতে না পারেন অথবা তার স্বাভাবিক খেলাটি না খেলতে পারেন তাহলে জাতীর যে ক্ষতিটি হবে তা কি একজন সৎ মন্ত্রীর মহিমা দিয়ে পুষিয়ে দিতে পারবেন?