লিখেছেন: জীবন
মূলতঃ যে সকল গান প্রান্তিক জনগন সার্বজনীনভাবে গ্রহণ-বরণ-শ্রবণ করেন বা যে সকল গানে সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ভাষায় প্রাপ্তিক জনগনের কথা বলা হয়ে থাকে গবেষকগণ সে সকল গানগুলোকে “লোকজ গান” বলে থাকে। এই সংজ্ঞায় যদি বিশ্বাস রাখি, তবে কি বাউল গানও লোকজ গান? আমরা সরল ভাবনার মনুষ্যগণ বাউল গানকেও শতাধিক বছর ধরে লোকজ গানের কাতারে চিন্তা করলেও মূলতঃ বাউল গান সান্ধ্য-সন্ধ্যা-গোপ্য-গুহ্য ভাষায় বিশেষ শ্রেণির শ্রোতা-সাধকের জন্য রচিত হয়ে থাকে। বাউলগণ একদিকে গানের মাধ্যমে সাধণার তত্ত্ব-মন্ত্র-শ্লোক-আয়াত প্রচার করেন, অপরদিকে এঁরা গানের মাধ্যমেই “মনের মানুষ” “প্রানের মানুষ” অর্থাৎ ঈশ্বর-আল্লাহ-ভগবানকে খুঁজেন, পূজা করেন, সাধণা করেন, ধ্যান করেন, ভজন করেন। কাজেই বাউল তত্ত্বে-মতে-আর্দশে দিক্ষীত না হলে কারো পক্ষে বাউল গানের নিগূঢ় তত্ত্ব উপলব্দিতে বা ব্যাখ্যার নিয়ে আসা সম্ভব না। উদাহরণ হিসেবে এখানে মহাত্মা লালনের একটি গানের উল্লেখ করছি:
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করবো কি
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম তারে তোমরা বলবে কি ?
তিন মাসের এক কন্যা ছিল নয় মাসে তার গর্ভ হল
এগার মাসে তিনটি সন্তান কে বা করবে ফকিরি ?
ঘর আছে তার দুয়ার নাই লোক আছে তার বাক্য নাই রে
কে বা তারে আহার জোগায় কে বা দেয় সান্ধ্যাবাতি ?।
ফকির লালন ভেবে বলে ছেলে মরে মাকে ছুঁলে
এই তিন কথার আর্থ নইলে তার হবে না ফকিরি ।
বাউল সাধনার শীর্ষস্তরে না গিয়ে কারো পক্ষে কি এই গানে কি বলা হয়েছে বা বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা উদ্ঘাটন করা সম্ভব? আমার উত্তর হচ্ছে-না। তবে, আমরা যারা সাধারণ এবং নিম্নমধ্যবিত্ত জ্ঞানের রাস্তার হাঁটি তারা কিন্তু থেমে থাকিনা। আমরা কিন্তু নিজেদের মতো করে গানের একটা মানে দাঁড় করিয়ে নিই। কিন্তু সেই মানেটা কতটা মূলে যেতে পারে তা আমার পক্ষে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। তবে, এই কথা নির্ধিদ্বায় বলা যায় যে, অনেক গবেষকের পক্ষেও এরূপ গানের নিগূড় তত্ত্ব উন্মোচন বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। কেও কেও যে চেষ্টা করেন না তা কিন্তু নয়। কিন্তু তা নিগূঢ়তাকে কতটুকু স্পর্শ করতে পারে তা কেবল প্রকৃত বাউলগণই বলতে পারবেন। কিন্তু এখানেও প্রতিবন্ধকতা আছে, কেননা প্রকৃত বাউল হলে তার কর্তৃক নিগূঢ় তত্ত্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন পূর্বক বিতরণ করা সম্ভব না। কারণ বাউলগণ বলে থাকেন “আপন সাধনার কথা, না বলিও যথা তথা”।
গোপন তত্ত্বে-সূত্রে মানুষের আজন্ম আকাংখা। যেখানে গোপনীয়তা, সেখানেই মানুষের আগ্রহ প্রবল। যেকারণে বাউলদের গান-সাধনার পদ্ধতি-রীতিনীতি নিয়ে ধর্ম্যানুধায়ী এবং শিক্ষিত সমাজে শত বছর ধরে আগ্রহ ছিলো-আছে এবং বলা যায় যে, থাকবে আরো কয়েক দশক। যেহেতু বাউল মতে-তত্ত্বে বিশ্বাসী কেও তাঁদের সাধণার নিগূঢ়তত্ত্ব নিয়ে সাধারণের মাঝে কোন কথা বলেন না, তাইতো সমাজ-সংসারে তাঁদের নিয়ে বিদ্যমান ধারণার বৈচিত্রতা দেখা যায়। কিন্তু সেই সকল ধারণাসমূহ কতটুকু বাস্তব? বা বাস্তবের কাছাকাছি? তা বলা বেশ মুশকিলই। তাইতো এই আলোচনাকে ওদিকে না নেয়াই শ্রেয়। তবে বাউল সাধণা এবং সাধণাশ্রিত গাণ-পদ-বাক্য একটা বিরাট শ্রেনির মানুষের মননে দাগ কেটেছিলো তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়। তাইতো গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বন্দরের বাউল গাণ আজকে বিশ্বদরবারে প্রবেশ করেছে। ভিন্ন ভাষাভাষী বা সংস্কৃতির লোকজনও বাউলগাণ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। কেও কেও বাউলদের নিয়ে দীর্ঘ গবেষনাও করছেন। আমরাও এই সুযোগকে দারুনভাবেই সদ্বব্যবহার করেছি। বাউল আর্দশ-চেতনা দেহে-মননে-মানসে ধারণ না করলেও কণ্ঠে নিয়েছি দারুনভাবেই। আজকাল বিভিন্ন ট্যালেন্টহান্ট প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারীগণ দৃষ্টি আকর্ষণের হাতিয়ার হিসেবে বাউলগাণ করেন। বিচারকগণও মুষ্ঠিভরে তাঁদের নম্বর দিয়ে শীর্ষে নিয়ে যান। চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ হয়ে তাঁরা তারকাখ্যাতি পান বটে। কিন্তু বাউল গানকে ত্যাগ করতেও তেমন সময় নেয়না তারা।
ইদানিং হিন্দুধর্ম থেকে আগহ বাউলগণ (!!) নামের শেষে “দাস” ও “বাউল” এবং মুসলিম ধর্ম থেকে আগত বাউলগণ (!!) নামের শেষে “শাহ্” “ফকির” ও “বাউল” যুক্ত করে বিদেশ সফর করছেন। ডলার, পাউন্ড কামাচ্ছেন। লোকচক্ষুর সামনে বিভিন্ন রং-এর হাজারি তালি দেয়া ভূষন পরিধাণ করলেও তাদের যাপিত জীবন কিন্তু বেশ আয়েশি বলেই শুনা যায়। ব্যক্তিগত সহকারীদের ম্যানেজ করেই তাদের সাক্ষাত প্রার্থী হতে হয়। ডিসেম্বরের কোন আয়োজনে তাদের অংশগ্রহণ মার্চ-এপ্রিলের মধ্যেই নিশ্চিত করতে হয়। অপরদিকে সমাজের বিভিন্ন অংশের চাপ সামলাতে সামলাতে বাউল সাধণা-তত্ত্ব বিলুপ্ত প্রায়। হাটে-মাঠে-গঞ্জে-আখড়ায় বাউল হিসেবে যাদের আমরা দেখি বা ভাবনায় নেই তাদের অধিকাংশ মূলত কর্মে ভীত একশ্রেণির মানুষ, কিংবা বাউল ভেক ধারণ করে নানাধরণের আকামে লিপ্ত। বাউল আজ পণ্য। দারুনভাবেই পণ্য।
কিন্তু একটা সময়ে বাউল তত্ত্ব-সাধণা ধর্মাশ্রয়ীদের বেশ বিপদেই ফেলে দিয়েছিলো বলা যায়। শাস্ত্র-কিতাবের বাইরে গিয়ে এবং সকল প্রকার জাত-পাতকে পিষ্ঠ করে বাউলগণ মানুষকে ঈশ্বরজ্ঞাণ করেছেন। মানুষের মধ্যে ঈশ্বর খুঁজেছেন। তাঁদের সাধণার ঈশ্বর ছিলোনা-ধর্ম ছিলোনা-বর্ণ ছিলোনা-ধনী গরীব ছিলো না । তবে তাঁদের গুরু ছিলেন-মুরশিদ ছিলেন। অনেকটা বৌদ্ধ সহজিয়া-বৈঞ্চব সহজিয়া এবং সুফীবাদের মতো। তাঁদের সকল সাধণা ছিলো “মনের মানুষ” কেন্দ্রিক। তাইতো তারা সকাল-সন্ধ্যা গেয়েছেন:
(১)
মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে।।
চাতক প্রায় অহর্নিশি
চেয়ে আছি কালো শশী
হব বলে চরণ-দাসী,
ও তা হয় না কপাল-গুণে।।
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘেই যেমন
লুকালে না পাই অন্বেষণ,
কালারে হারায়ে তেমন
ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে।।
যখন ও-রূপ স্মরণ হয়,
থাকে না লোক-লজ্জার ভয়-
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
(ঐ) প্রেম যে করে সে জানে।।
(২)
বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথা এক পড়শি বসত করে।
আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে।।
গেরাম বেড়ে অগাধ পানি
নাই কিনারা নাই তরণী পারে।
মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে
কেমনে সে গাঁয় যাই রে।।
কি বলবো সেই পড়শির কথা
তার হস্তপদ স্কন্ধমাথা নাইরে।
ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর
ক্ষণেক ভাসে নীরে।।
পড়শি যদি আমায় ছুঁতো
যম যাতনা সকল যেতো দূরে।
সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।।
বাউলের “মনের মানুষ” এবং আরশিনগরের “পড়শি” কিন্তু বাংলার রাম-রহিম-কালার মনের মানুষ নয়। তারপরও বাংলার উদাসীমানুষ চিরদিন বাউল গাণ শুনেছেন এবং নিশ্চিতভাবেই তার যাপিত জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছেন। সরল কথা ও বাক্যের এমন দু’টি গাণ যদি সাধারণ মানুষকে ভ্রমে ফেলতে পারে, তবে প্রথমে উল্লেখিত গাণটি নিয়ে কথা না বলাই ভালো। এতো সীমাবদ্ধতা-প্রতিবন্ধকতার পরেও একশ্রেণির মানুষ বাউল সেজে বাউল গাণকে পণ্য বানাচ্ছেন দেধারচ্ছে। অপরদিকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উদাসী-ক্লান্ত বাঙ্গালিগণ ভেক বাউলদের গাণ শুনে বগল বাজাচ্ছেন। আজকে বাউল গাণ নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট চালানোর পাশাপাশি বাউলগানে বিভিন্ন যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার করা হচ্ছে। তরুন প্রজন্ম বাউলগাণ শুনছে। কেও কেও নিজেদের মতো করে বাউল গাণ করছে এবং নিশ্চিতভাবে তা হারিয়েও যাচ্ছে খুব দ্রুতলয়ে।
মূলতঃ অন্তরাত্মায় বাউলিয়ানা স্থাপিত না থাকায় এবং বিজ্ঞানের সর্বগ্রাসী জয়যাত্রার বিপরীতে মানসপটের বাউলভাবনা খেই হারিয়ে ফেলায় ইদানিং বাউলগাণ কর্ণকুহরে যাচ্ছে বটে, কিন্তু অন্তর ঠিক জুড়াচ্ছেনা।
খুব ভালো লাগলো।
“শাস্ত্র-কিতাবের বাইরে গিয়ে এবং সকল প্রকার জাত-পাতকে পিষ্ঠ করে বাউলগণ মানুষকে ঈশ্বরজ্ঞাণ করেছেন। মানুষের মধ্যে ঈশ্বর খুঁজেছেন।”
মাফ করবেন। বেশ খানিকটা গুলিয়ে গেল কী?
বাউল দর্শন মতে, “মানুষ” “সহজ মানুষ” “মনের মানুষ” আসলে ঈশ্বর। তাকে নিজ দেহে ধারণ করাই দেহত্তত্ত্বের মূল কথা, এ ভাবেই জীবন আত্মার সাথে পরমাত্মা মিলন ঘটে।
তাই ফকিরি গানে বলেছে, “মানুষ ধরো, মানুষ ভজ, শোন বলি রে পাগল মন/ মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরাজন”….
এছাড়া বাউল গানকে লোক গান বলে চালিয়ে দেওয়া ভ্রান্তি হবে, কারণ বাউল আসলে গুপ্ত ধর্ম, গান তার সাধনার অনুসংগ, নিছক বিনোদন নয়। এর ধরণই আলাদা।
“ইদানিং হিন্দুধর্ম থেকে আগহ বাউলগণ (!!) নামের শেষে “দাস” ও “বাউল” এবং মুসলিম ধর্ম থেকে আগত বাউলগণ (!!) নামের শেষে “শাহ্” “ফকির” ও “বাউল” যুক্ত করে বিদেশ সফর করছেন।”
ফকিরদের “শাহ” পদবীর ব্যবহার সম্পর্কে লেখকের ধারণা বোধহয় স্পষ্ট নয়। বাউল গানে প্রায়ই “সাঁই” কথাটি ব্যবহার হয়। পদবীতেও এর ব্যবহার রয়েছে।
লালন নিজেই তার গানে বলেন, “সিরাজ সাঁই কয় কোথায় রে মন, সোনার খাট-পালংক এমন? /লালন কহে সব অকার, সার হবে মাটির বিছানা…”
এখানে “সাঁই” অর্থ প্রভু, গুরু, গাইড ইত্যাদি। আবার “সাঁইজি” বলতে বাউল সম্রাট লালনকেই বোঝায়। মুঘলদের “শাহ” পদবী বাউলদের নামের জুড়ে দেওয়া ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। এটি “সাঁই” কথাটিরই অপভ্রংশ হতে পারে, কবি বন্ধু, লালন গবেষক আবদেল মান্নানের সাথেও এ নিয়ে একদা আআলাপচারিতা হয়েছিল।
বিভ্রান্তি আরো জেঁকে বসে কয়েক বছর আগে কুষ্টিয়ায় সরকারি উদ্যোগে “লালন শাহ” সেতু উদবোধনের পর। সম্ভবতঃ শরিয়তপন্থীদের আক্রমণের চাপে এখনকার বাউলরা “শাহ” পদবী নিতে বাধ্য হচ্ছেন৷ এনিয়েও অনুসন্ধান প্রয়োজন।
আলোচনা সত্যিই ভালো ছিল তবে আরো বিস্তারিত আশা করেছি
খুব সুন্দর এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা।